নিত্যকথা (৯-৬-২০)
আমাদের চক্ষুদুটো এক বিস্ময়।
আমাদের চক্ষুদুটো একটা বিষ্ময়কর বস্তূ। আমাদের শরীরের যে অঙ্গগুলো স্বয়ংসম্পূর্ন তার মধ্যে চোখদুটো প্রধান। তাই চোখকে আমরা অন্যের শরীরে প্রতিস্থাপন করতে পারি। এর ক্রিয়া কখনো বন্ধ করা যায় না। আমরা দেখতে চাই বা না চাই আমাদের চোখ কিন্তু দেখবেই। আমরা চোখের পাতা বন্ধ করতে পারি, কিন্তু চোখের ক্রিয়া অর্থাৎ দেখা বন্ধ করতে পারি না। এমনকি আমরা চোখের গতি বন্ধ করতে পারি না। আমাদের চোখ সবসময় ঘুরছে।
আমরা চোখ বন্ধ করলেও আমরা কিছু না কিছু দেখতে পাই। চোখ যেমন বাইরের জগৎ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান প্রদান করে, ঠিক তেমনি এই চোখের সাহায্যে আমরা আমাদের অন্তর্জগতের সাথেও সম্পর্ক স্থাপন করতে পারি। তাই চোখ আমাদের অন্তর্জগতের অনুসন্ধানের কাজে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে।
চোখ সবসময় গতিশীল। আমাদের মন যেমন চঞ্চল। আমাদের চোখ দুটোও চঞ্চল। আর একটা কথা হচ্ছে, চোখের চঞ্চলতা কিন্তু প্রবহমান নয়। অর্থাৎ নদির জল যেমন প্রবহমান, চোখ আমাদের তেমনটি নয়। চোখ চড়াই পাখির মতো বা বাবুই পাখির মত চঞ্চল। একডালে বা একস্থানে কখনো স্থির হয়ে বসে থাকে না। ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে, এক ধ্যেয় বস্তু থেকে অন্য ধ্যেয় বস্তুতে প্রদক্ষিণ করছে।
চোখ আমাদের মনের আয়না। আমরা চোখ দেখে বুঝতে পারি, মানুষটি সুখে আছে, না দুঃখে আছে, রেগে আছে না শান্ত আছে। কারুর মনকে আমরা দেখতে পারি না। কিন্তু মন যেহেতু চোখে প্রতিফলিত হচ্ছে, তাই মনকে ভালো করে বুঝতে গেলে, আমরা তাদের চোখের দিকে দৃষ্টিপাত করতে পারি।
এমনকি আমাদের চৈতন্য শক্তির সঙ্গে আমাদের চোখের একটা যোগাযোগ আছে, যা আমাদের অন্য কোনো অঙ্গের সঙ্গে নেই। তাই চোখ যতক্ষন আমাদের ক্রীয়াশীল থাকে ততক্ষন আমাদের চৈতন্য থাকে।তাই আমাদের মৃত্যুর আগে, চোখে ঝাপসা দেখতে থাকি। মৃত্যুতে আমাদের চক্ষু স্থির হয়ে যায়। কেউ সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললে, আমরা চোখে জলের ছিঁটে দেই, সংজ্ঞা ফিরিয়ে আনবার জন্য। তাই চোখ আমাদের একটা গুরুত্ত্বপূর্ন অঙ্গ। আর চোখকে আমরা আধ্যাত্মিক অনুশীলনের জন্য ব্যবহার করতে পারি। চোখের দৃষ্টিকে আমাদের বাইরের থেকে ভিতরের দিকে ফেরাতে হবে।
আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশের জন্য, আমাদের চোখের ক্রিয়াকে স্থির করতে হবে। চোখের ক্রিয়াকে বন্ধ করা আর চোখের পাতাকে বন্ধ করা কিন্তু এক জিনিস নয়। এই পার্থক্যটা আমাদের ভালো ভাবে বুঝতে হবে। যেকোনো মুহূর্তেই আমাদের চোখের পাতা বন্ধ করতে পারি। আমরা ঘুমের সময় চোখ বন্ধ রাখি। কিন্তু চোখের যে অন্তরযাত্রা তা তাতে বন্ধ হয় না। চোখের এই যাত্রা যা একবার বাইরে আর একবার ভিতরে এই যাত্রাকে আমাদের বন্ধ করতে হবে। কিন্তু চোখ সজাগ থাকবে। অর্থাৎ দেখছে, কিন্তু দেখবে না।
প্রথমে আমরা চোখকে বাইরের নির্দিষ্ট বস্তুর উপরে, বা কোনো আলোর শিখার উপরে স্থির করতে পারি। যাকে বলা হয় ত্রাটক। অর্থাৎ চোখকে আমরা এক বস্তু থেকে আর এক বস্তুতে যেতে দেব না।
এর পরে, চোখের পাতা বন্ধ করতে পারি। ও মনের উপরে স্থাপন করতে পারি। এই মনের উপরে দৃষ্টি রাখা বা ধ্যান দেওয়া একমাত্র তখনই করা যেতে পারে, যখন আমরা চোখের চঞ্চল ক্রিয়াকে স্থির করতে পারি। তাই বাহ্যিক ভাবে চোখ বন্ধ করেই আমরা ধ্যানে লিপ্ত হই ।
এবার চোখের উপরে দৃষ্টি দিন। চোখের সাথে যেহেতু চৈতন্যের সবথেকে নিবিড় সম্পর্ক, তাই চোখের সাথে নিজেকে স্থাপন করতে পারলে, আমরা ভিতরের চৈতন্যকে সহজে ধরতে পারবো।
জীবনে সুখ বা দুঃখ কোনটাই চিরস্থায়ী নয়। এমনকি দীর্ঘস্থায়ীও নয়। সুখ বা দুঃখের মাত্রা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। প্রথম রসোগোল্লাতে আমি যে তৃপ্তি পেয়েছিলাম, পরের-পরের-পরের রসগোল্লাগুলো আর সে তৃপ্তি দিতে পারে না। কষ্টের ক্ষেত্রেও এই একই নিয়ম প্রযোজ্য। তাহলে এই সুখ বা দুঃখ যা একসময় তীব্র ছিল, তা কেন ধীরে ধীরে কমতে থাকে ? মা-বাবার মৃত্যুর দিনে যে কষ্ট পেয়েছিলাম, সেই মা-বাবার পারলৌকিক কাজের পরে, জ্ঞাতিভোজনের দিন, ত্রয়োদশ দিনে আর সেই কষ্ট ছিল না। কেন এমন হয় ? আর সুখ দুঃখ কোথায়ই বা যায়?
পুকুরে ঢিল পড়লে, ঢেউ ওঠে। উৎসবিন্দুতে ঢেউয়ের মাত্রা বেশি থাকে। ঢেউ যত ব্যাপকত্ত্ব পায়, অর্থাৎ যত দীর্ঘস্থানে ছড়িয়ে পড়ে, তত তার শক্তি বা মাত্রা কমতে থাকে। ঢেউয়ের উচ্চতা কমতে থাকে। আমাদের সুখ-দুঃখের উৎসবিন্দুতে, উৎস ক্ষনে তাই সুখ-দুঃখের মাত্রা বেশি থাকে। আর ধীরে ধীরে তা কমতে থাকে। এই যে বিধির নিয়ম, এই নিয়মকে যদি আমরা ধরতে পারি, তবে আমরা সুখ-দুঃখের মাত্রা কমিয়ে ফেলতে পারি। উৎসকেন্দ্রে থেকে আমাদের অবস্থানের পরিবর্তন করে, অথবা সুখ-দুঃখের ঢেউকে দ্রুত ছড়িয়ে দিয়ে, এক কথায় বলতে গেলে উৎসবিন্দু থেকে ব্যাপকে ছড়িয়ে দিতে পারলে, তবে আমরা সাম্য অবস্থায় বা স্থির অবস্থায় থাকতে পারবো। আর এই ব্যাপক-অবস্থা হচ্ছে ঈশ্বর। অর্থাৎ আমরা যদি আমাদের সুখ-দুঃখ ঈশ্বরের দিকে ছড়িয়ে দিতে পারি, তবে আমরা সাম্য অবস্থায় থাকতে পারবো। ঈশ্বর ভক্তগন এটাই করে থাকেন, আঘাতের ক্রিয়াকে অনন্তের দিকে চালিত করে দেন। তারা বলেন, হে ভগবান, আমার দুঃখ দূর করে দাও। অথবা হে ভগবান বলো, আমি কি করবো ? এই হলো, ভক্তদের দুঃখ দূর করবার মনস্তাত্ত্বিক পথ। ঠিক তেমনি, জ্ঞানীগণ এইসময়, অনন্তের চিন্তা করতে থাকেন , অর্থাৎ সে যার অংশ। আর অনন্ত সব সময়, সান্তের সাহায্যের জন্য প্রস্তুত। কেননা সান্ত-তো অনন্তেরই অংশ।
গোবিন্দ ভোর বেলায় ফুল তুলতে গেছে । এক সাধু তার দলবল নিয়ে ওই ফুলবাগানের কাছেই এক গাছের নিচে, আশ্রয় নিয়েছে। তো ভোর বেলায়, সাধু তার শিষ্যদের নিয়ে শাস্ত্র আলোচনা করছেন । গোবিন্দের কানে এই শাস্ত্র আলোচনা গেলো। চেয়ে দেখে, এক দিব্যকান্তি সাধু। সারা মুখে সাদা সাদা দাড়ি। সাধুর কথা শুনে গোবিন্দের ভালো লাগলো, কিন্তু কোনো কথা বললো না। সাধু কিন্তু গোবিন্দের সঙ্গে কথা শুরু করলো। আপনি কার জন্য, ফুল তুলছেন ? গোবিন্দ গম্ভীর ভাবে বললো, শিব-পূজার জন্য। তো সাধু আবার বললেন, শিবঠাকুর তো ধুতরো ফুলে সন্তুষ্ট, অন্য ফুলে বিভূতিভূষণের পূজা কি করে হবে ? গোবিন্দ আর কথা বাড়ালো না। গটগট করে মন্দিরপানে চললো। সাধু মিটিমিটি হাসতে লাগলো।
কিছুদিন পরে, সাধুটি তার দলবল নিয়ে আবার সেখানে এলো। গোবিন্দও যথারীতি ভোরবেলায়, সাজি নিয়ে ফুলতে গিয়ে দেখে সাধুকে। এবার, গোবিন্দ সাধুর কাছে গিয়ে বসলো। সাধু বললো, গোবিন্দ, তুমি যে ভক্তিশ্রদ্ধা নিয়ে শিবের পুজো করো, তার কিছুটাও যদি বিষ্ণু সেবায় দিতে, তবে তুমি অনেক আনন্দে থাকতে পারতে।
গোবিন্দ বললো, কেন ? শিবতত্ত্বে ও বিষ্ণুতত্ত্বে কি কোনো ফারাক আছে ? দুজনেই ব্রহ্মভাবের বিলাসমাত্র। তত্ত্বে তো কোনো ভেদ নেই। কেউ কুন্ডলি পাকিয়ে আছে, কেউ বলয়ের আকার নিয়েছে, রশ্মি তো সূর্য্যেরই।
সাধু বললেন, তা কি করে হবে ? শিবভাবে জ্ঞান ও বৈরাগ্য প্রধান। বিষ্ণুভাবে ঐশ্বর্য্য ও আনন্দই প্রধান। মানুষ কি চায় ? মানুষ চায় দুঃখহীন সুখের জীবন। জ্ঞান ও বৈরাগ্য দ্বারা তা কি পাওয়া যাবে ? ঐশ্বর্য্য ও আনন্দ দ্বারা কিন্তু তা সম্ভব। আর তত্ত্বকথা যদি বলো, তবে বলি, ব্রহ্ম ও তার ভাব কখনো শুন্যে অবস্থান করে না। সুবর্নরশ্মি, কুন্ডল ও বলয় থেকে ভিন্ন হলেও, পিণ্ডাদির আকার ত্যাগ করে না। আকারশূন্য তো সুবর্ন কখনো থাকে না। অতএব ব্রহ্মের শিবভাব বা বিষ্ণুভাব ইত্যাদি ত্যাগ করে ব্রহ্ম থাকতে পারেন না। আর এইজন্য, শিবতত্ত্ব আর বিষ্ণুতত্ত্ব এক বলে, যে কোনো একটা ভাবের সাহায্যেই ব্রহ্মের কাছে পৌঁছনো যেতে পারে। তাহলে এর মধ্যে যার ভাবটি ভালো, যে পথটি ভালো, সেই পথে যাওয়াই ভালো কিনা বলো। যেখানে পাহাড়-জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে পৌঁছনো যায়, আবার মসৃন-সমতল রাস্তা দিয়েও যদি পৌঁছানো যায়, তবে মসৃন সমতল রাস্তা দিয়ে যাওয়াই ভালো নয় কি ?
গোবিন্দ বললো, আপনিকি নির্গুণ-নিরাকার-নির্বিশেষ ব্রহ্ম স্বীকার করেন না ? সগুন ও নির্গুণ ব্রহ্মে, ব্রহ্মই আছেন । একটি ক্রিয়ারত, আর একটি ক্রিয়াহীন। ঘুমন্ত সাপ ও সাপ, আবার চলন্ত সাপও সাপ।
সাধু বললো, না ব্রহ্ম কখনো নির্গুণ হতে পারেন না। আর ব্রহ্ম যদি নির্গুণ হয়, তবে তার সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই সম্ভব নয়। আর যাঁর মধ্যে যে জিনিস নেই, তিনি কখনো সেই জিনিস দিতে পারেন না, হতেও পারেন না। বিশ্ব -চরাচরের বা এই জগতের আবির্ভাব, সেখান থেকেই হতে পারে, যেখানে সে ছিল। যেখানে সে ছিল না, সেখান থেকে সে কখনোই আবির্ভাব পারে না। যা নিত্যগুণযুক্ত তা কখনো নির্গুণ হতে পারে না।
গোবিন্দ বলছে, ব্রহ্ম মায়া সহযোগে জ্ঞেয় হন। এবং তখনই তিনি সমস্তকিছুর কারন হন। এই মায়া আসলে ভ্রম বিশেষ। আর ব্রহ্মজ্ঞানে এই ভ্রম দূরীভূত হয়। তখন আমরা যাঁকে জ্ঞাত হই, তিনি তখন নির্গুনই হন। অর্থাৎ মায়াকে বা ভ্রমকে পরিত্যাগ করতে পারলেই আমরা যথাযথ ব্রহ্ম অর্থাৎ নির্গুণ ব্রহ্মকে জানতে পারি।
সাধু বললেন, দেখো বাবা, মায়া ব্রহ্মশক্তি। তাই মায়াকেও নিত্য বলে জেনো। এর নাশ সম্ভব নয়। যাঁরা এঁকে ভ্রম বলছেন, তারাই ভুল করছেন, তাঁরাই ভ্রমে পতিত হচ্ছেন। জীব বা জীবাত্মা যেহেতু পরমাত্মার অংশ, পরমাত্মা যদি নিত্য হয়, তবে জীবাত্মাও নিত্য। জীবের অদৃষ্ট অনুসারে, কর্ম্মফল ভোগের জন্য, স্বয়ং ব্রহ্ম নিজ শক্তি দ্বারা, সূক্ষ্ম কারণরূপ জগৎকে স্থুল জগতে পরিণত করেন। ভগবৎ ইচ্ছায় জীবের যখন অজ্ঞান নাশ হয়, তখন জীব ভগবৎ-দাসের মতো মুক্তি লাভ করে। ভগবৎ-ইচ্ছা-রূপ যে মায়া তার কখনো নাশ হয় না। মায়া ও অজ্ঞান আলাদা। সুতরাং নির্গুণ ব্রহ্ম বলে কিছু হয় না।
গোবিন্দ কথা খুঁজে পেলো না। মনের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব নিয়ে বাবার মন্দিরে গেলো। সারাদিন, সারারাত তার মহাসংশয়ের মধ্যে কেটে গেল। শেষে নিজেই ভাবতে লাগলো, শিব প্রলয়ের কর্তা। বিষ্ণু পালনের কর্তা। অতএব জীবনে আনন্দ ও সুখ লাভ বিষ্ণুর কাছে যতটা পাওয়া সম্ভব, তা শিবের কাছ থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। শিবসেবায়, তমঃগুণের নাশ হলে সত্ত্বগুণের প্রাবল্য হয়, বিষ্ণুপূজায় রজগুনের নাশ হলে সত্ত্বগুণের আধিক্য আসে। উদ্দেশ্য একটাই সত্ত্বগুণের অধিকারী হওয়া। কিন্তু একটা মসৃন পথ আর একটি পাথুরে রাস্তা। ওম শ্রীবিষ্ণু, ওম নমঃ শিবায়। এটি মহাত্মা রামানুজের ভাবধারায় গোবিন্দের বিষ্ণুভক্তি উদয়ের কাহিনী।
কথায় বলে, জপ-তপ যতই করো, মরার কায়দাটা আয়ত্ত্ব করো। মরার আবার কোনো কায়দা আছে নাকি ? আচার্য্য শঙ্কর সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে তিনি শিবলিঙ্গে বিলীন হয়ে যান। কেউ বলেন, তিনি সমাধি যোগে দেহত্যাগ করেন। চৈতন্যদেব-এর মৃত্যু সম্পর্কেও বলা হয়ে থাকে, তিনি জগন্নাথের মূর্তিতে বিলীন হয়ে যান, কেউ বলেন তিনি সাগরে ঝাঁপ দিয়ে মরা যান। ত্রৈলঙ্গ স্বামী যোগ-সমাধিতে দেহত্যাগ করেন। রামানুজ সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে তিনি গোবিন্দ বা পিল্লানের কোলে মাথা রেখে মারা যান। রামচন্দ্র নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মারা যান। শ্রীরাধিকা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মারা যান। শ্রীকৃষ্ণ সামান্য ব্যাধের তীরের আঘাতে মারা যান। তো মারা যাবার আবার আলাদা তারিকা আছে নাকি ? আমরা তো এমনি এমনি মারা যাই। মরার সময় আবার আমাদের কিছু করার আছে নাকি ? যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, হ্যাঁ মারা যাবার সময় তোমাকে যোগস্থ থাকতে হবে। বলছেন, মরণকালে, নিশ্চল হৃদয়ে ভ্রূ-দ্বয়ের মধ্যে প্রাণকে সম্যক আবিষ্ট করলে, ভক্তি ও যোগবলে সেই আদিত্যমন্ডল পরমপুরুষকে প্রাপ্ত হওয়া যায়। আবার বলছেন, মরার আগে সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বার রুদ্ধ করে, এবং হৃদয়-পুন্ডরীকে অন্তঃকরণে সমাহিত করে, আপনার প্রাণ মুর্দ্ধা দেশে রুদ্ধ করে যোগ অবলম্বন করবেন। এর পর "ওং" এই অক্ষররূপ ব্রহ্ম বাচক শব্দটি উচ্চারণ করতে করতে আমাকে (পরমপিতাকে) স্মরণ করতে করতে দেহত্যাগ করতে হবে। তাহলে পরমগতি লাভ করা যাবে। (গীতা ৮/১০-১২-১৩) তাই একটা কথা বলি, যোগের অভ্যাস ছাড়বেন না। সারাজীবন তো বটেই এমনকি মৃত্যুকালেও আমাদের যোগস্থ থাকতে হবে।
ওম নমো নারায়ণায়। এই বিষ্ণুমন্ত্রের অর্থ কি ?
মহাত্মন রামানুজ আঠেরো বার ঘোরাঘুরির পর, গুরু গোষ্ঠীপূর্ণের কাছ থেকে স-রহস্যঃ মন্ত্র পেলেন। মন্ত্র পাবার পর তো তিনি আল্হাদে আটখানা। রামানুজের হৃদয় এক অপূর্ব আলোতে আলোকিত হয়ে উঠলো। জীবনের জ্বালা-যন্ত্রনা-অজ্ঞান-সংশয় সব যেন দূর হয়ে গেলো। হৃদয় এক অপূর্ব আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠলো। রামানুজ যেন নবজীবন লাভ করলেন।
পরদিন গুরুকে প্রণাম করে, গুরুর কাছ থেকে বিদায় নিলেন। রাস্তায় যেতে যেতে তার মনে এক অদ্ভুৎ ভাবের উদয় হল। পথে যাকে দেখছেন, তাকেই বলতে লাগলেন, তোমরা এস, আজ আমি তোমাদের এক অমূল্য রত্ন দেবো। রামানুজের দিব্যজ্যোতিঃ সম্পন্ন মুখ থেকে, তার পিছনে দলে দলে লোক সঙ্গ নিলো। রামানুজ এক মন্দিরের উঁচু, দ্বারের উপরে উঠলেন, যাতে অনেক দূর থেকে তাকে দেখতে পাওয়া যায়। সেখান থেকে উচ্চস্বরে বললেন, হে আমার প্রানপ্রিয় ভাই-বোনেরা, তোমরা যদি চিরতরে সংসারের যাবতীয় জ্বালা যন্ত্রনা থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাও, তোমরা যদি সেই দয়াময় ভগবানকে লাভ করতে চাও, তাহলে আমরা সঙ্গে তিন বার এই মন্ত্র উচ্চারণ করো।
এর পর, দুই হাত তুলে, আকাশপানে চোখ তুলে, বললেন, বলুন - ওঁ নমো নারায়নায়। ওঁ নমো নারায়নায়। ওঁ নমো নারায়নায়। উপস্থিত সমস্ত জনসাধারণ সঙ্গে সঙ্গে সমবেত কন্ঠে, উচ্চস্বরে উচ্চারণ করলেন, ওঁ নমো নারায়নায় ওঁ নমো নারায়নায় ওঁ নমো নারায়নায়। উপস্থিত সবমানুষ এক নব-ভাবে বিভোর হয়ে গেলেন। তাদের জীবনের গতি যেন বাঁক নিলো।
কিন্তু এদিকে এই খবর তার গুরুদেবের কাছে অচিরেই পৌঁছে গেলো। গুরুদেব তো রেগে টং। রেগেমেগে বললেন, দূর হও নরাধম ! তোমাকে এই মহৎ রত্ন দিয়ে আমি মহাপাপ করেছি। আর যেন তোমার মুখদর্শন না করতে হয় আমাকে। জান তোমার অবশ্যই ভবিষ্যতে অনন্ত নরকগতি হবে ! রামানুজ, সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বললেন, আপনি তো বলেছিলেন, এই মন্ত্র লাভ করলে মানুষ পরমগতি লাভ করবে। যদি আমার অনন্ত নরকের বিনিময়ে এত লোকের মুক্তি হয়, তো আমার অনন্ত নরক, অনন্ত বৈকুন্ঠ বাস অপেক্ষাও বাঞ্চনীয় ।
ওম নমো নারায়ণায়। বা ওম নমঃ নারায়ণঃ। এই মহামন্ত্র আমরা সবাই শুনেছি। কিন্তু কি আছে এই মন্ত্রে। আজ আমরা সেই কথাই শুনবো।
ওম - আদি ধ্বনি। হিন্দু শাস্ত্রমতে, এই আদি ধ্বনি সমস্ত সৃষ্টির কারন। অ, উ, ম - ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও লয়ের কর্তা। ওমকে বলা হয়, প্রণব, অর্থাৎ প্রতিনিয়ত নতুন। প্রণব কথাটার আর একটি অর্থ হচ্ছে, যাতে সৃষ্টি হয়, বা যাতে সৃষ্টি হয়েছে। ভূঃ-ভুবঃ-স্বঃ এই তিন লোকের প্রতীক হচ্ছে ওম। ওম নিয়ে আমরা আগে আলোচনা করেছি। তাই এই সম্পর্কে বিশেষ ব্যাখ্যায় যাবো না। ওম শব্দ-ধ্বনি এখানে নারায়ণের বিশেষণ। অর্থাৎ হে ত্রিকালেশ্বর, সমস্ত কিছুর যিনি কর্তা তাকে আমরা স্মরণ করছি।
নারায়ানায় - নারায়ণকে। নারায়ণ কথাটার অর্থ যিনি নর-নারীর আশ্রয়-স্থল। আবার নার কথাটার অর্থ হচ্ছে, জল। তো জল যার আশ্রয়, তিনি নারায়ণ। যিনি ক্ষীরোদ সমুদ্রে শয়ন করে আছেন। যিনি আগে কারন-বারি তে ভাসতে ছিলেন। যিনি স্বর্গীয় সুখে যোগনিদ্রায় শায়িত। বৈষ্ণব মতে, ইনি বিষ্ণু। অর্থাৎ পালন কর্তা। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, নারায়ণ সৃষ্টি-স্থিতি-লয় সব কিছুর কর্তা । ইনিই পরম পুরুষ। ইনিই কারন। অহংকার হতে হলো পঞ্চজন, ক্ষিতি-অপ-তেজ-আকাশ-পবন। রাজসিক গুনের প্রতীক হচ্ছেন, বিষ্ণু।
এখন কথা হচ্ছে এই ক্ষীরোদসাগর ব্যাপারটা কি ? বা কারন-বারি ব্যাপারটা কি ? অর্থাৎ যার মধ্যে এই নারায়ণ শায়িত আছেন, বা আশ্রয় নিয়েছেন। ক্ষীর+উদ = ক্ষীরোদ। আমরা জানি ক্ষীর কথার অর্থাৎ নির্যাস বা দুধের নির্যাস। উদ কথাটার অর্থ হচ্ছে, উচ্চ বা উন্নত। অর্থাৎ জলের যে উৎকৃষ্ট নির্যাস তাকে বলে ক্ষীরোদ। ক্ষীরোদ-সাগরের তার মধ্যে শায়িত আছেন বিষ্ণু। অর্থাৎ সূক্ষ্ম জলের সাগর। এখন এই সূক্ষ্ম জলের সঙ্গে আমাদের কি সম্পর্ক ? আমরা মৃত্যুর পরে, আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়শক্তি, সংস্কার ইত্যাদি নিয়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জলকনাকে আশ্রয় করে ঘুরতে থাকি। এই জলকনাকে উপনিষদে বলা হয় শ্রদ্ধা। আসলে এই ক্ষিরোদসাগর হচ্ছে বিশ্বজগতের বীজ সংরক্ষণ কেন্দ্র। জগৎ যখন কারন স্বরূপে থাকে তখন এখানেই অবস্থান করে। এখান থেকেই রজঃশক্তির প্রভাবে ক্রিয়া শুরু হয় - অর্থাৎ সৃষ্টিকার্য্য শুরু হয়। আবার ক্রিয়াশেষে এখানেই ফিরে যায়।
তাই গীতায় যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলছেন ওং এই অক্ষররূপ ব্রহ্ম বাচক শব্দটি উচ্চারণ করতে করতে আমাকে (নারায়ণ) স্মরণ করতে করতে দেহত্যাগ করতে হবে। তাহলে পরমগতি লাভ করা যাবে।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।হরি ওম।
এমনিতে এখন আর বাড়িতে ভিখারী খুব একটা আসে না। যারা আসে সবাই সাহায্য চাইতে আসে। তো সেদিন এক বৈষ্ণব এলেন। গলায় তুলসীর মালা। কপালে, বাহুতে, বুকে এমনকি পেটে তিলক দিয়ে বিভিন্ন চিহ্ন আঁকা। বললেন, তিনি নাকি শীঘ্রই ভববন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে বৈকুন্ঠে যাবেন। এবং এও বললেন, তার মতো অনেকে এর মধ্যেই বৈকুন্ঠে গিয়ে সুখে বাস করছেন। তো গৃহস্থ একজন ধার্মিক ব্যক্তি। তিনি বললেন, দেখুন, ব্রাহ্মণদের পৈতে ধারণ আবশ্যিক। কিন্তু পৈতে ধারণ করলেই ব্রাহ্মণ হওয়া যায় না। ব্রাহ্মণ হতে গেলে ব্রহ্মজ্ঞান অর্জন করতে হয়। তিলক ধারণ করা ভালো, কিন্তু তিলক ধারণ করলেই বৈকুন্ঠে যাওয়া যায় না। গায়ত্রী ব্রাহ্মণের ধ্যান-জ্ঞান। ঠিক তেমনি বিষ্ণুমন্ত্র জপ ও স্বধর্ম্ম অনুযায়ী কর্ম্ম সম্পাদন করা, প্রত্যেক বৈষ্ণবের অবশ্য কর্তব্য। বিষ্ণুভক্ত কখনো পরগাছা হতে পারে না। বিষ্ণু রজঃশক্তির ধারক। তো বিষ্ণুভক্ত কখনো কর্ম্ম হীন থাকতে পারেন না। আপনি তিলক কেটে অন্নের সন্ধানে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন, দেখে আমার খারাপ লাগছে। আসুন, আজ আমার এখানে অন্ন গ্রহণ করে আপনার সেবার সুযোগ করে দিন। দেখুন, প্রহ্লাদ, ধ্রুব, পঞ্চপান্ডব, এমনকি দ্রৌপদী, কেউ তিলক ধারণ করতেন না। আপনি যদি সত্যিকারের বিষ্ণু ভক্ত হন তবে, তাঁর প্রীতির জন্য, কর্ম্ম অবশ্যই করবেন। চক্র ধারনের ফল, কর্ম্মফলের চেয়ে অধিক হতে পারে না। জগৎ ব্রহ্মময়, কর্ম্মের মাধ্যমে জগতের সেবা করুন, তবেই মুক্তি। কর্ম্মহীনের মুক্তি নেই। কেননা কর্ম্মবিনা অপরোক্ষ জ্ঞান লাভ হয় না। আর জ্ঞান না হলে, মনের বা মানসিক শরীরের উন্নতি হয় না। অন্য শরীরের কথা তো দূর অস্ত।
মানুষ অনেক কুট সমস্যার সমাধান করতে পারে। কিন্তু মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে, নিজেরই কূটস্থ পুরুষকে খুঁজে পাচ্ছে না। এ এক অদ্ভুত রহস্যঃ। জীব বংশপরাম্পরায় নিজের অস্তিত্ত্ব বজায় রাখে। যাঁরা প্রজননে অক্ষম তারা শেষ পর্যন্ত লুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু জীবাত্মা অন্য একটা জীবাত্মার জন্ম দিতে পারে না, তথাপি সে চিরকাল বিদ্যমান। এর অস্তিত্ত্ব নিরবধি।
সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের চারিদিকে সংগীত নিরন্তর চলছে। আমাদের চারিদিকে নাটক চলছে। যা আমরা সাধারণ দৃষ্টিতে দেখতে পাই না বা শুনতেও পাই না। কিন্তু আপনার বাড়িতে যদি টিভি অর্থাৎ গ্রাহকযন্ত্র ও প্রক্ষেপক যন্ত্র থাকে তবে আমরা সেই সব সুর-চিত্র শুনতে বা দেখতে পাই। অর্থাৎ তখন আমরা সেইসব ধ্বনি-দৃশ্য আমাদের ইন্দ্রিয়গোচর হয়। আমাদের এই অন্তরের সূক্ষ্ম অনুভূতি যখন জাগ্রত হয়, তখন আমরা এই সব ঘটনা যা পৃথিবীর কোথাও না কোথাও ঘটছে, তা ঘরে বসেই অন্তরের পর্দায় দেখতে পাই। আমাদের কুণ্ডলিনী শক্তি জাগ্রত হবার ঠিক আগে মুহূর্তে অনাহত ধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। কখনো কখনো একটা বাঁশির সুমধুর সুর শুনতে পাওয়া যায়। যারা যোগের অভ্যাস করছেন, তাদের এই অভিজ্ঞতা অবশ্যই হয়ে থাকবে। তবে এসবে মজে থাকলে চলবে না। আমাদের বংশীধারীকে ধরতে হবে। এই পথে আমরা সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর অনুভূতি সম্পন্ন হবো। স্থুল শরীর থেকে মনের স্তরে, মনের স্তর থেকে আত্মার স্তরে, জীব-আত্মার স্তর থেকে পরমাত্মার স্তরের সংস্পর্শে এসে যাবো। যোগ এইসব অতি-ইন্দ্রিয় স্তরের যাবার সিঁড়ি হিসেবে কাজ করতে পারে।
আমাদের সব বয়সেরই একটা কর্তব্য আছে। একটি শিশুর যা কর্তব্য তা যুবকের নয়, আবার একজন যুবকের যে কর্তব্য তা একজন বৃদ্ধের নয়। তেমনি গৃহকর্তার যে কর্তব্য তা গৃহকর্তীর নয়। ঠিক তেমনি প্রত্যেকটি মানবাত্মার একটা কর্তব্য আছে । আর তা হচ্ছে, এই দেহরূপ ঘরের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বুঝে নিতে হবে, একসময় এই দেহ থাকবে না, আর মানবাত্মা ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে বাস করবে, সেটা স্থির করা,বা বুঝে নেওয়া। এবং সেখানকার গৃহকে তৈরি করে রাখা। তা না হলে আমাদের এই দেহরূপ গৃহে যখন প্রকৃতির নিয়মে ধংশ হবে, তখন আমরা গৃহছাড়া হয়ে বিপর্যস্থ হয়ে পড়বো। আধ্যাত্মিক অনুশীলনের মাধ্যমে আমরা সেই ভবিষ্যৎ গন্তব্য গৃহের নির্মাণ করতে পারি। আর এই কর্তব্য আমাদের অবশ্যই এই মানবদেহে থাকা-কালীন সম্পন্ন করতে হবে।
সারাজীবন যদি মাথা উঁচু করে বাঁচতে চান, তবে তবে ঈশ্বরের পায়ে মাথাটা রেখে দিন। তাঁর শীতল হাত আপনার মাথায় সবসময় রাখবার সুযোগ করে দিন। তাঁর বাহুদ্বয় যেন সর্বদা আপনাকে বেঁধে রাখতে পারে, তাই তার কাছে কাছে থাকুন। পিতার আশ্রয়ে যেমন শিশু, মায়ের কোলে যেমন সন্তান নিশ্চিন্তে থাকে, নিজেকে ঈশ্বরের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে দেবেন না। দিবানিশি তাঁরই আশ্রয়ে থাকুন। আর মাথা উঁচু করে নিভীক-নিশ্চিন্ত জীবন বেছে নিন। এর জন্য কিছু করতে হবে না, শুধু মনের ভাবনাটাকে বিষয় থেকে ঈশ্বরে নিবদ্ধ করুন। সব সমস্যার সমাধান তিনিই করে দেবেন।
আমাদের যদি অহংবোধ না থাকতো, তাহলে এতো ধর্ম্মমত থাকতো না। মানুষের যদি অভাববোধ না থাকতো, তবে এতো প্রার্থনকেন্দ্র গড়ে উঠতো না। মানুষ যদি এতো বৈষম্য না দেখতো, তবে ঈশ্বরের কথা ভাবতেও পারতো না। অন্যের সঙ্গে সংগ্রামের কোনো মূল্য নেই। নিজের সঙ্গে সংগ্রামের মূল্য অপরিসীম।
তিনি আছেন, তাই আমরা সব কিছু জানতে পারছি, দেখতে পারছি, শুনতে পারছি। কিন্তু তাঁকে জানতে পারছি না, দেখতে পারছি না, শুনতেও পারছি না। কারন তিনি মনের বাইরে নন, তিনি চোখের বাইরে নন, তিনি কানের বাইরে নন। তাঁকে জানা যাবে কি করে ? উপনিষদ বলছে, যিনি বলছেন, তাঁকে তিনি জানেন না, তিনিই তাঁকে জেনেছেন। "যস্যামতং তস্য মতম" । আসলে তিনি সার কথা জেনে গেছেন, যে যিনি স্বয়ং জ্ঞাতা, যিনি নিজেই জ্ঞানস্বরূপ, তিনি কখনো জ্ঞানের বিষয় হতে পারেন না। যিনি বলেন, আমি তাঁকে জেনেছি, তিনি আসলে জানেন না। "মতং যস্য ন বেদ সঃ" - তিনি জানেন না যে তিনি জ্ঞেয় বস্তু নন। যাকে বস্তু হিসেবে জানা যায়, তিনি আসলে তিনি নন। এনার তাঁর সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। ব্রহ্মকে চোখে দেখা যায় না, তিনি ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তিনি অসীম, তিনি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। তাই তাঁকে আয়ত্ত্বে আনা যায় না।
ভদ্রলোক দিবানিদ্রা গিয়েছেন। হঠাৎ তাকে ডেকে তোলা হলো। তার একমাত্র ছেলে সেনাবাহিনীতে কাজ করতো, খবর এসেছে ছেলেটি মারা গিয়েছে। ভদ্রলোক গম্ভীর হয়ে কি যেন ভাবছেন। বাড়িতে ধীরে ধীরে আপনজন জড়ো হতে লাগলো। সবাই শোকে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলো। ভদ্রলোক কিন্তু গম্ভীর। আত্মীয়স্বজন সবাই বলাবলি করতে লাগলো, দেখেছো, লোকটা কি নিষ্ঠূর। একমাত্র ছেলে মারা গিয়েছে, কিন্তু কোনো শোকতাপ নেই। চোখে একফোটা জল নেই। স্ত্রী জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি পাগল হয়ে গেলে ? তোমার মুখে কোনো কথা নেই, চোখে জল নেই। ভদ্রলোক বললো, আমি একটু আগে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছিলাম, আমি যেন রাজা হয়ে গেছি, দশ - দশটি ছেলে আমার, বিশাল রাজ্য। পড়শী রাজা আমার দেশ আক্রমন করেছে, আমার দশটি ছেলে যুদ্ধে গিয়েছিলো, তারা সবাই মারা গেছে। এমন সময় তোমরা আমাকে ডেকে তুললে। ভাবছি, আমি ওই দশটি ছেলের জন্য দুঃখ করবো, না এই একটি ছেলের জন্য দুঃখ করবো। আমি কি দশ ছেলের বাবা, না এক ছেলের বাবা ? আমি যে রাজা সেটা সত্যি ? না আমি দীন ব্রাহ্মণ সেটা সত্যি। তোমরা কেউ বলতে পারো, যা দেখেছিলাম সেটা সত্যি না যা দেখছি সেটা সত্যি ?
আমাদের এক বন্ধু আমাকে প্রশ্ন করেছিল, তুমি কি ঈশ্বরকে দেখেছো, যার কথা তুমি প্রচার করতে চাও তাঁকে কি তুমি দেখেছো ? যদি না দেখে থাকো, তোমার এইসব প্রচার অনর্থক, মিথ্যে। তোমরা একটা কল্পনার ফানুসে ভাসছো, আর এই সব কল্পকথা মানুষকে শোনাচ্ছো। এটা অন্যায়, অসত্য। তো আমি তাকে কোনো কোনো জবাব দিতে পারিনি। কারন ঈশ্বরকে যে দেখেনি, তাকে দেখানো যায় না। ঈশ্বরকে যে দেখেছে, সে বাতবিতন্ডা করতে আসে না। আর যে বাতবিতন্ডার অবস্থায় আছে, তাকে ঈশ্বরকে দেখানো যায় না। অপরোক্ষ জ্ঞান আমাদের অপরিবর্তনীয় সত্তাকে উপলব্ধি করতে শেখায়। বিশ্বাসীদের থাকে মতবাদ, অবিশ্বাসীদেরও থাকে মতাদর্শ। এই মতবাদ ও মতাদর্শের উর্দ্ধে ঈশ্বরের স্থান। এখানে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। মুখের কথা মুখের মধ্যেই থেকে যায়। আসলে ধর্ম্মের যে আদর্শ, তাকে প্রচার করা, ঈশ্বরকে উপল্বদ্ধির উপায় প্রচার করা যায়, কিন্তু সেই আদর্শ সেই উপায়কে যিনি অবলম্বন করবার যোগ্য হতে পারেন নি, তাকে অপেক্ষা করতে হবে। এমনকি জন্ম থেকে জন্মান্তর অপেক্ষা করতে হবে। আমার এক অকালপক্ক বন্ধু, ছেলেবেলায়, বালিগঞ্জের ভারত সেবাশ্রমের এক স্বামীজিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি কি ঈশ্বরকে দেখেছেন। তিনি জবাবে বলেছিলেন, তুমি এখনো ছোট, বড়ো হও, তবে বুঝতে পারবে, মুখে ঈশ্বরের কথা বলা যায় না। লঙ্কার ঝাল কাউকে বোঝানো যায় না। জিভে লঙ্কা ঘষে দিতে হয়।
বহুদিন আগে কোনো এক থিয়েটারে একটা গান শুনেছিলাম,
" ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন, তোমরা কেউ কথা বোলো না, শব্দ করো না,
ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন, গোলযোগ সইতে পারেন না। "
সমস্ত মানুষ দেবতুল্য হবেন, সে আশা করি না। কিন্তু কোটি কোটি মানুষ অজ্ঞানের অন্ধকারে বাস করবেন, নিরন্ন থাকবেন, নিরাশ্রয় থাকবেন, এটা ভাবতে কষ্ট হয়। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, "প্রতিটি শিক্ষিত মানুষকে আমি বলবো বিশ্বাসঘাতক, দেশদ্রোহী, কারন এই দরিদ্র মানুষের স্বার্থের বিনিময়েই এরা লেখাপড়া শিখেছে। অথচ তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র মনোযোগ দেবার অবকাশ নেই। দারিদ্র মানুষদের পিষ্ট করে, যারা সব অর্থ সম্পদ অর্জন করেছে, এবং সেই সুবাদে যারা বেশভূষায় পারিপাট্যে গর্ব করে বেড়ায়, তাদের আমি জঘন্য আখ্যা দেব।"
ভগবান না হয়, নিষ্ক্রিয়, ঘুমিয়ে থাকেন, কিন্তু দেবতুল্য মানুষগুলো আজ কোথায় ? তারাও কি ঘুমিয়ে পড়েছেন ? সারা পৃথিবীর মানুষ আজ বিপথগামী, অসহায়, বিভ্রান্ত। হে ঈশ্বর তুমি জাগো। আমাদেরকে সঠিক পথের নির্দেশ দাও।
মহাপুরুষগন বলে থাকেন, আপনি যে মন্ত্র পেয়েছেন, তাই নিয়মিত জপ করে যান। যদি মন্ত্র না পেয়ে থাকেন তবে, যে-কোনো দেবতার নামের আগে ওম শব্দটি জুড়ে, জপ করতে থাকুন। আর ভগবানের কাছে প্রার্থনা করুন, "আমি যাতে তোমার ধ্যান করতে পারি, আমি যাতে তোমার পাদপদ্মে আমার মনকে লিন করে দিতে পারি।" তিনিই আমাদের হৃদয়ের গুরু। তিনিই আমাদের পথপ্রদর্শক, তিনিই আমাদের সর্বস্য, পিতা মাতা সখা। একটা কথা সব সময় মনে রাখতে হবে, এই সংসার চিরস্থায়ী নয়। সংসার আমাদের স্বপ্নাবস্থা বৈ কিছু নয়। পার্থক্য হচ্ছে, আমরা যাকে স্বপ্ন বলি, সেই স্বপ্ন আমাদের ৬ থেকে ৮ ঘন্টা পরে ভেঙে যায়। আমরা বুঝতে পারি, আমরা স্বপ্ন দেখছিলাম। আর এই স্বপ্নবৎ সংসার বিলুপ্ত হতে ৮০ বা ১০০ বছর লাগে। সংসারে আমাকে যারা কাঁদাচ্ছে, বা সংসারে আমার জন্য যারা কাঁদছে, তারা সবাই দুদিনের মাত্র। তাই মন প্রাণ লাগিয়ে, জপ করতে থাকুন। এই জপেই একসময় দেখবেন, বিমল আনন্দ অনুভব করছেন। এই আনন্দের স্থায়িত্ত্বই ধ্যান। ঠাকুরের জ্যোতির্ময় মূর্তি হৃদয়ে ধারণ করুন। প্রথম দিকে কল্পনা করতে হয়, পরে এই কল্পনাই বাস্তবে পরিণত হয়ে যায়। এর পরে এই মূর্তি একসময় লয় হয়ে যাবে। তখন থাকবে শুধু চৈতন্যপ্রভা। আসল কথা হচ্ছে, আন্তরিক ভাবে তাঁকে ডাকা। আর এই আন্তরিকতা একসময় আপনাকে ধ্যানে নিয়ে যাবে। আর এর জন্য আপনার কারুর কাছে যেতে হবে না। আপনার ভিতর থেকেই কেউ একজন নির্দেশ দেবে, কেউ একজন পাল তুলে দেবে। আর জীবনতরী এগিয়ে যাবে। আপনি তখন নিশ্চিন্ত শিশুর মতো মায়ের কোলে নিরাপদ আশ্রয়ে।
গরিব হয়ে জন্মানো আমার হাতে নয়, কিন্তু গরিব হয়ে মৃত্যুবরণ করা বা না করা আমার হাতে। অজ্ঞানী হয়ে জন্মানো আমার হাতে নয়, কিন্তু অজ্ঞানী হয়ে মারা যাবো না জ্ঞানী হয়ে দেহ ছাড়বো, সেটা আমার হাতে। চারা গাছকে বাঁচানোর জন্য বেড়া দিতে হয়, কিন্তু গাছ বড়ো হয়ে গেলে, সেই বেড়া খুলে দিতে হয়, না হলে গাছ বাড়তে পারে না। অধ্যাত্ম জীবনে প্রথম দিকে অনুষ্ঠান দিয়েই শুরু করতে হয়। উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সেই অনুষ্ঠানের উর্দ্ধে উঠতে হয়। ঈশ্বর চিন্তন দিয়েই ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হয়। চিন্তন একসময় প্রেমের সঞ্চার করে। ভক্ত কখনো ঈশ্বরের ঐশ্বর্য্য নিয়ে চিন্তা করে না। কারন তাঁর কাছে ভক্তের কিছু চাইবার নেই। ভক্ত কখনো ঈশ্বরের শক্তি নিয়ে চিন্তা করে না, তাই ঈশ্বরকে সে ভয়ও করে না। এখানে সমতা, অন্তরঙ্গতা, ও মধুর ভাব। এখানে ছোট-বড়ো নেই , উঁচু-নিচু নেই, আছে কেবল মিলনের আনন্দ।
----------
কিছু মানুষ আছেন, যারা গৃহীর্জীবন যাপন করলেও বুঝে নিয়েছেন, যে আত্মোপলব্ধিই জীবনের একমাত্র লক্ষ। পারিবারিক, সামাজিক সমস্ত রকম দায়িত্ত্ব পালনের পর তারা বৃদ্ধ হয়েছেন। তার সংসার থেকে অবসর নিয়ে সত্যিকারের বানপ্রস্থ অবলম্বন করেছেন। অধিকাংশ শাস্ত্রগ্রন্থ এই সব বানপ্রস্থীদের রচনা। সংসারটা তারা দেখেছেন, এখন তাদের বিবেক বৈরাগ্য জেগেছে, তাই তারা অবসর নিয়েছেন। তাদের অন্তরে সদা শান্তি বিরাজ করে থাকে। ইন্দ্রিয় সংযত হয়েছে, বাসনা দূর হয়েছে। মনের হয়েছে, এখন আধ্যাত্মিক জীবনচর্চার সময়। এই জীবনের উদ্দেশ্য কি ? এই জীবনের অর্থ কি ? কিভাবে শান্তি পাওয়া ও দেওয়া যাবে, তা তারা বুঝেছেন। জীবনে একটা সময় আসে, যখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যথেষ্ট হয়েছে, এবার সংসার থেকে অবসর নিতে হবে। অবশ্য এর মানে এই নয়, যে জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া বা আলস্যের জীবন যাপন করা। এটা আসলে আর এক ধরনের জীবন। এই জীবন আরো কঠিন, আরো সংগ্রামের। এই সংগ্রামে যারা জয়ী হন, তারা অচিরেই বুঝতে পারেন, তাদের অভাব-বোধ চলে গেছে। এবং অন্তরের গভীরে একটা শান্তির সম্পদ আবিষ্কার করেন। একেই বোধহয়, বানপ্রস্থ বলে।
আমাদের ব্যবহারিক জীবনে যেমন বিশ্বের অখণ্ডতা উপলব্ধি করতে পারি না, তেমনি বিশ্বের অন্তঃস্থলে চৈতন্য শক্তির খেলা তার লীলা আমরা বুঝতে পারি না। আবার জ্ঞানের উচ্চস্তরে যারা উপনীত হয়েছেন, তাঁরা জগৎকে অসার অলীক বলে অবজ্ঞা করে থাকেন। আসলে যে শক্তি উর্দ্ধে পূর্ণভাবে সজ্ঞান এবং সক্রিয় সেটাই বহিরাকাশে অজ্ঞান এবং অবশেষে নিষ্ক্রিয়। সচ্চিদানন্দ বিচিত্রভাবে আত্মপ্রকাশ করছেন, তা আমাদের উপল্বদ্ধিতে আসে না। জ্ঞানীর দৃষ্টিতে বিশ্ব অখন্ড চৈতন্যময়। আমাদের দৃষ্টিতে খণ্ডিত।
World Population
7,662,680,214
TOP 10 MOST POPULOUS COUNTRIES (July 1, 2020)
1. China | 1,394,015,977 | 6. Nigeria | 214,028,302 |
2. India | 1,326,093,247 | 7. Brazil | 211,715,973 |
3. United States | 329,877,505 | 8. Bangladesh | 162,650,853 |
4. Indonesia | 267,026,366 | 9. Russia | 141,722,205 |
5. Pakistan | 233,500,636 | 10. Mexico | 128,649,565 |
BIRTH : ONE, PER EIGHT SECOND
DEATH : ONE PER TWELVE SECOND
POPULATION GROWTH : ONE, PER TWENTYFOUR SECOND.
পৃথিবীর জনসংখ্যা এখন ৭৬৬ কোটি ২৬ লাখ।
প্রতি ৮ সেকেন্ডে একজন শিশুর জন্ম হচ্ছে, প্রতি ১২সেকেন্ডে একজন মারা যাচ্ছে, অতয়েব প্রতি ২৪ সেকেন্ডে ৩ জন জন্মাচ্ছে, আর ২ জন মারা যাচ্ছে, অর্থাৎ প্রতি ২৪ সেকেন্ডে একজন মানুষের বৃদ্দি হচ্ছে। অথচ জন গণনায় দেখা যাচ্ছে, ১৬ মিনিটেই একজন মানুষ বেড়ে যাচ্ছে। কারন এই সময়ের মধ্যে ২ জন জন্মাচ্ছে, আর মাত্রা একজন মারা যাচ্ছে।
জনসংখ্যার বেশিরভাগ মানুষ আছে, চিনে - ১৩৯.৪০ কোটি। ভারতে আছে, ১৩২.৬০ কোটি। সবচেয়ে আশ্চর্য্যের বিষয় হচ্ছে, ভারতে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার সব চেয়ে বেশি। শীঘ্রই প্রথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষের বাসস্থান হয়ে দাঁড়াবে। যদি না এই জনসংখ্যার একটা অংশ ভারতের বাইরে চলে যায়।
তোমার ধর্ম্মকে স্বাগত জানাচ্ছি, কিন্তু আমাকে আমরাটা নিয়ে থাকতে দাও। আমি জানি তোমরা সম্প্রসারণশীল, আর এইজন্য যদি তুমি তোমার পূর্বপুরুষকে জিজ্ঞেস করো, তবে তুমি শুনবে, তারা তোমার ধর্ম্মে ছিলেন না। আমরা তাঁরই শরণ নেই, যার কিছুই ছিল না, যিনি বেঁচে থাকতে নির্যাতন সহ্য করেছেন। রামচন্দ্র রাজার ছেলে হয়েও, ১৪ বছর বনেবনে ঘুরে বেরিয়ে ছিলেন। বুদ্ধদেব রাজার ছেলে হয়েও সন্যাসী ছিলেন। যিশুখ্রিস্ট অসীম কষ্ট পেয়ে মারা গেছেন। শ্রীকৃষ্ণ অসীম শক্তিধর হয়েও কোনোদিন রাজা হতে চান নি। যাদের প্রচুর ধনসম্পত্তি ছিল, তারা আমাদের মন থেকে হারিয়ে গেছে , আর যারা উঁচু মনের মানুষ ছিলেন, তাদের আমরা আজও স্মরণ করে থাকি। পৃথিবীতে যীশু এসেছিলেন মাত্র দুই হাজার বছর আগে, মোহাম্মদ এসেছিলেন, ২৫০০ বছর আগে, বুদ্ধদেব এসেছিলেন ২৬০০ বছর আগে। শ্রীকৃষ্ণ এসেছিলেন ৩৩০০ বছর আগে, রামচন্দ্র এসেছিলেন ৫০০০ বছর আগে। তারও আগে এসেছিলেন, নর-নারায়ণ, তারও আগে এসেছিলেন মহাদেব শিব। এঁরা কেউ বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, বা হিন্দু বা মুসলিম ঘরে জন্ম গ্রহণ করেন নি। এঁরা কেউ অগাধ ধনসম্পত্তির অধিকারীও ছিলেন না। এঁরা সবাই ছিলেন, মানবিক সম্পত্তির অধিকারী। এঁরা সবাই আমাদের পূর্বপুরুষ। আমরা এঁদেরই স্মরণ করি। প্রণাম করি। আজকের এই সভ্যতা মাত্র দশ হাজার বছরের সভ্যতা। ধর্ম্ম নিয়ে কেউ জন্মায় না। আমরাই আমাদের সন্তানকে ধর্ম্ম শেখাই। আমাদের সবার ধর্ম্ম মানব ধর্ম্ম। মানুষ হয়ে ওঠাই মানুষের সার্থকতা।
আজ ঘেরন্ড-সংহিতা থেকে একটা গুপ্ত যোগের কথা বলি। এঁকে বলে যোনিমুদ্রা। এই মুদ্রা অভ্যাসে আমরা সহজেই সমাধির অবস্থায় যেতে পারি। শিবসংহিতার যোনিমুদ্রা থেকে এটি আলাদা।
সিদ্ধাসনে বসুন। দুই কান দুটো বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে, এবং দুটো চোখ তর্জনী দিয়ে, দুই নাক মধ্যমা দিয়ে এবং মুখকে অনামিকা ও কনিষ্ট আঙ্গুল দিয়ে নিরোধ করুন। এবার কাকীমুদ্রাযোগে অর্থাৎ মুখটাকে কাকের ঠোঁটের মতো করে, প্রাণবায়ুকে আকর্ষণ করুন। এবং অপান বায়ুর সঙ্গে অর্থাৎ নাভির নিচে আমাদের যে বায়ু থাকে, তার সঙ্গে মিলিত করুন। কুম্ভক করুন। এবার আমাদের শরীরে যে ছয়টি চক্র আছে অর্থাৎ মূলাধার থেকে আজ্ঞাচক্র পর্যন্ত যে ছয়টি চক্র আছে, সেই চক্রে হুং ও হংস মন্ত্রের দ্বারা ধ্যান করে, সাধক নিদ্রিত কুণ্ডলিনীকে জাগিয়ে তুলে, জীবাত্মার সঙ্গে মিলিত করে, সেই শক্তিকে সহস্রারে তুলে নেবেন। তারপর স্বয়ং শক্তিময় হয়ে পরমশিবের সঙ্গে মিলিত হয়ে আনন্দময় বিহার করতে থাকুন। এইসময় চিন্তা করতে থাকুন, আমি স্বয়ং আনন্দ স্বরূপ, আমিই ব্রহ্ম। একেই বলে যোনী মুদ্রা। এই মুদ্রা ঠিক ঠিক মতো মাত্র একবার করতে পারলেই সমাধিস্থ হওয়া যায়। যোনিমুদ্রা সিদ্ধিলাভের একটা উৎকৃষ্ট পন্থা। না এতে কোনো ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই। তবে শরীর বুঝে কুম্ভক করবেন। ধীরে ধীরে কুম্ভকের সময় বাড়াবেন।
যখন বিজ্ঞান কোনো কিছু সম্পর্কে আমাদের কিছু বলে, তখন তা আমাদের কাছে জ্ঞান। বিজ্ঞান যখন কিছু জানতে না পরে, তখন সে তার অজ্ঞতা স্বীকার করে। এবং চেষ্টা করে যাতে সে ভবিষ্যতে তাকে জানতে পারে। তাই বিজ্ঞানগ্রন্থ, ধর্ম্মশাস্ত্র থেকে অনেক বেশী বিশ্বাসযোগ্য। ধার্মিক ব্যক্তি বিশ্বাস করে মাত্র। এমনকি এমন জিনিষ সে বিশ্বাস করে যার সম্পর্কে তার কোনো জ্ঞানই নেই। আজ পর্যন্ত কেউ ঈশ্বরকে দেখতে পারে নি। অথচ সেই ঈশ্বরকে নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে কতো-না তর্কাতর্কি। এমনকি এর জন্য একজন আর একজনকে আঘাত করতে এমনকি মেরে ফেলতেও দ্বিধা করে না। বিজ্ঞান সন্দেহের দৃষ্টিতে সব কিছুকে দেখে থাকে, আর সন্দেহ দূর করবার জন্য গভীরে প্রবেশ করে। এবং যে জ্ঞান সে সংগ্রহ করে, তা হয়ে ওঠে সার্বজনীন। আর ধর্ম্মিক ব্যক্তি বিশ্বাসের উপরে ভর করে চলে। আর তার এই বিশ্বাস অন্যের উপরে চাপিয়ে দিতে চায়। আর ধার্ম্মিক ব্যক্তি যদি সত্যিই প্রজ্ঞা লাভ করতে পারেন, তা তার নিজস্ব সম্পদ হয়। ধর্ম্মিক ব্যক্তি যদি বৈজ্ঞানিক হতো, আর বৈজ্ঞানিক যদি ধর্ম্মিক হতো, তবে বিজ্ঞান কখনো আমাদের ধংসের কাজে ব্যবহার হতোনা, আবার তথাকথিত ধর্ম্ম আমাদের প্রতারণা বা বৈষম্যের কারন হতে পারতো না।
আমাদের সবার মধ্যে দুইজন ঈশ্বর আছেন। একজন পার্থিব, আর একজন অপার্থিব । একজন সগুন আর একজন নির্গুণ। সগুন ঈশ্বর সর্বব্যাপী, সগুন ঈশ্বরই স্রষ্টা, তিনিই আমাদের রক্ষাকর্তা, আবার প্রলয় বা নাশের কর্তাও তিনি। তিনি এই বিশ্বচরাচরের চিরকালীন মাতা-পিতা। আর এক জন আছেন আত্মা। ইনি নিষ্ক্রিয়। ইনি কাউকে জন্ম দেন না, আবার নিজেও জন্মান না। ইনি কাউকে রক্ষাও করেন না, আবার কাউকে ধংশও করেন না। এনার উপাসনাতেই, এনার উপাস্যলোকেই আমরা মুক্তির স্বাদ পেতে পারি। এনাকে কোনো বিশেষনে ভূষিত করা যায় না। যিনি নৈর্ব্যক্তিক। যুক্তি তর্কের উর্দ্ধে। চিন্তা, জ্ঞান কোনো কিছুর মধ্যেই যিনি আবদ্ধ নন। চিন্তা জ্ঞান এগুলো মানুষের মনের বিষয়। ইনি বিচারের উর্দ্ধে, কারন বিচারের দ্বারা এঁনাকে জানা যায় না। তাঁর না আছে বন্ধন, না আছে কামনা বাসনা, না আছে সংকল্প। এঁকেই উপনিষদ বলছে, নির্গুণ ব্রহ্ম। এই নির্গুণ ব্রহ্মের সঙ্গে নিজেকে একাত্মবোধ করতে পারলেই, আমরা জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে, সুখ-দুঃখের চক্র থেকে নিস্তার পেতে পারি। আর এই একাত্মবোধের জন্য, কাউকে হাজার হাজার জন্ম অপেক্ষা করতে হয়। আবার কেউ মুহূর্তেই এই উপলব্ধি করতে পারেন। তাই অষ্টাবক্র মুনি বলছেন, তুমি অতি সুন্দর আত্মা - এই কথা তুমি বার বার শুনেছ, তথাপি বিষয়ে আসক্ত হয়ে আছো। তুমিই এই জগৎ, তুমিই ঈশ্বর, এসব কথা বার বার তুমি শুনেছ, কিন্তু এই কথার গভীরে প্রবেশ করতে পারো নি। তুমি এও শুনেছ, যে তুমি শুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ। এর পরেও তোমার খোঁজ শেষ হয়নি। কিসের খোঁজ ? তোমার সমস্ত আসক্তির মোহজাল ছিন্ন হোক। প্রাণশক্তিকে প্রবাহিত করে দাও, বাসনার অবসান হোক, পূর্ন আনন্দে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠো। এর জন্য কালাতিপাতের প্রয়োজন নেই। এক মুহূর্তেই তা পেতে পারো। হাজার বছরের অন্ধকার, দেশলাইয়ের একটা কাঠির ঘর্ষনেই দূর হয়ে যায়। শুধু দেহের প্রাণবায়ু দিয়ে অগ্নিকে প্রজ্জ্বলিত করে দাও। ব্যাস আনন্দই আনন্দ - মুক্তির আনন্দ।
একটা সম্ভাবনাময় দুষ্টু ছেলের গল্প।
আমি তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। আমাদের বাড়িটি ছিল, বিদ্যালয়ের পাশেই। যখনই স্কুলের ঘন্টা বাজতো, আমি তখন বাথরুমে ঢুকে পড়তাম। পরিবারের সবাই বাথরুমের দরজা ধাক্কাধাক্কি করতো। কিন্তু আমি বাথরুমের মধ্যে চুপচাপ বসে থাকতাম। টু শব্দটি করতাম না। এটা আমার প্রতিদিনের ঘটনা।
আমাদের ছোটবেলায়, ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি ছিল, মাল বা মানুষ বহনের জন্য। খোঁড়া ডাক্তারের একটা ঘোড়া ছিল। ঘোড়ায় চড়ে তিনি রুগী দেখতে যেতেন। আবার হাতে রামদা নিয়ে দাঙ্গা করতে দেখেছি খোঁড়া ডাক্তারকে । আর খোঁড়া নিমাই-এর ছিল একটা গাধা। আমরা সবাই খোঁড়া নিমাই-এর ভক্ত ছিলাম। কারন নিমাই-এর সংগ্রহে ছিল, সব অসম্ভবের গল্প। সমস্ত রোগের নিদান ছিল, তার কাছে। কচুর রস দিয়ে কিভাবে দাঁদ-চুলকানির চিকিৎসা করা যায়, তা সে জানতো। আলকাতরা লাগিয়ে কিভাবে ফর্সা হওয়া যায়, সেইসব অসাধারণ দাওয়াই সে জানতো। সাধারনতঃ গাধার পিঠে কেউ উঠে না। কিন্তু খোঁড়া নিমাই এই গাধার পিঠে চড়েই চলাফেলা করতো। গাধার অবর্তমানে থাকতো একটা লাঠি যার সাহায্যে সে যাতায়াত করতো। তো আমরা এই খোঁড়া নিমাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে এই গাধার ভক্ত ছিলাম। গাধা আপাত-দৃষ্টিতে খুবই নিরীহ। কাউকে গুতোতো না কামড়াতো না। গাধাকে দেখে আমাদের, একজন দার্শনিক মনে হতো। গম্ভীর রাশভারী, সবসময় যেন চিন্তা করছে। আমরা গাধার পিঠে উঠবার চেষ্টা করতাম। কিন্তু আশ্চর্য্যের ব্যাপার হচ্ছে, গাধাকে আমরা হাঁটাতে পারতাম না। গাধা নিমাইকে ছাড়া অন্য কাউকে নিয়ে চলতে চাইতো না। আমরা তার পিঠে উঠলেই সে দাঁড়িয়ে পড়তো। নিমাই যদি গাধাকে দু-ঘা দিয়ে চলতে বলতো, তো গাধা একটা অদ্ভুত কাজ করতো, সে কোনো না কোনো দেওয়ালের কাছ ঘেঁষে বা গাছ ঘেঁষে হাটতো, আমাদের পা দেওয়ালে বা গাছে লেগে ছড়ে যেত। আমরা বাধ্য হয়ে নেবে পড়তাম। আপনা কি জানেন, গাধা কখনো, রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাটবে না। হয় ডান দিক দিয়ে হাটবে নতুবা সে বাঁ দিক দিয়ে হাটবে। অর্থাৎ গাধারা হয়, দক্ষিণপন্থী নতুবা বামপন্থী। গাধার বুদ্ধি নেই, তাই এরা কখনো বুদ্ধিভ্রষ্ট হতে পারে না। অর্থাৎ মাঝামাঝি পথে চলতে পারে না। তাই গাধাদের বুদ্ধিমান মানুষ আজও মানুষ করতে পারে নি। গাধারা একমাত্র খোঁড়া নিমাইয়ের কথায় চলে।
এক মহাত্মা বলেছিলেন, আমরা ছোটবেলা থেকে অনেক কর্তব্যের কথা শুনে থাকি। অনেক দায়বদ্ধতার কথা শুনে থাকি। আমি আমার মা-বাবার প্রতি দায়বদ্ধ। আমি আমার ভাই-বোনেদের প্রতি দায়বদ্ধ। আমি আমার মাস্টারের প্রতি দায়বদ্ধ। আমি আমার স্ত্রীর প্রতি দায়বদ্ধ। আমার ছেলে-মেয়েদের প্রতি দায়বদ্ধ। আমি আমার গুরুদেবের প্রতি দায়বদ্ধ। আমি আমার রাষ্ট্রনায়কের প্রতি দায়বদ্ধ। আমি আমার দেশের প্রতি দায়বদ্ধ। লম্বা এই সূচি। কিন্তু কখনো কেউ বলে না, তুমি তোমার প্রতি দায়বদ্ধ। তুমি তোমার জন্য কি করেছো ? তুমি সবাইকে বোঝার চেষ্টা করছো, সবার অভাব পূরণ করবার চেষ্টা করছো। কিন্তু তুমি তোমার অভাব পূরণ করবার চেষ্টা করছো কি ? তুমি তোমাকে বোঝার চেষ্টা করছো কি ? তুমি কি জান, আত্মজ্ঞান লাভের জন্য, আত্মউপলব্ধি করবার জন্য, নিজের মধ্যে নিজেকে লিন করে দেবার জন্য, তুমি দেহ ধারণ করেছিলে ? তুমি কি জান, তোমার ভিতরে এই জ্ঞানের লিপ্সা তোমাকে বার বার দেহ ধারণ করতে বাধ্য করবে ? আর এটা করতে পারলে, সব দায়িত্ব পালন আপনা আপনি হয়ে যাবে। তখন দেখবে, তোমার মধ্যে থেকে রাগ, হিংসা, দ্বেষ, ভয়, লোভ সব শেষ হয়ে যাবে। তখন তোমার ভিতর থেকে অফুরন্ত প্রেমের স্ফূরণ ঘটবে। তখন তোমার কাছে যারা আসবে, তা সে তোমার মা-বাবা-স্ত্রী-পুত্র-শত্রূ-মিত্র সবাই তোমার ভালোবাসার স্পর্শে স্নাত হবে। আমি ভাবছিলাম, লোকটা বড্ড বকবক করে।
মুক্তানন্দ গিরির সাথে আমার মধুর ভাব।
ছোট্ট দুটো ঘটনা বলি। একজন যুবক সাধু দমদম স্টেশানে তিন নম্বর প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিলো । গায়ে গেরুয়া, সারা মাথা কামানো। বনগাঁ লাইনের ট্রেন তিন নম্বরে না দিয়ে, এক নাম্বারে দিয়েছে। তো সাধু তাড়া থাকায়, অন্যদের সঙ্গে নিজেও রেললাইনের উপর দিয়েই তাড়াতাড়ি পাড় হয়ে এলো । এটা দেখে, এক ভদ্রলোক বললেন, সাধুবাবা তুমিও ? সাধু লজ্জ্বা পেয়ে গেলো। মনে মনে ভাবলো, জীবনে আর কখনো, এমনটি করবো না।
একটা চোর সন্ধ্যেবেলা চুরি করতে গিয়ে পাহারাদারের তাড়া খেলো। তো চোর তারা খেয়ে এক মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করলো। মন্দিরে টাঙানো ছিল, একটা গেরুয়া। চট-জলদি, গেরুয়াটা গায়ে দিয়ে, ঠাকুরের সামনে বসে, নারায়ণের নাম জপতে লাগলো জোরে জোরে। পাহারাদার চোরকে না পেয়ে, ফিরে গেলো। চোর ভাবলো, গেরুয়ার কি মাহাত্ম। তাহলে গেরুয়াধারী সত্যিকারের সাধুদের নাজানি কত কিছু থেকে রেহাই পেয়ে যায়। সেই থেকে সে চুরি করা ছেড়ে, সাধু হবার বাসনায়, সাধুসঙ্গ করতে লাগলো।
মহাত্মাগণ বলে থাকেন, একমাত্র ব্রহ্মবিদ্যা বা ব্রহ্মজ্ঞানই আমাদের এই জীবন-মরন প্রবাহের সংসার সাগর থেকে উদ্ধার ক'রে, সমস্ত দুঃখরহিত অবস্থা প্রাপ্তির একমাত্র উপায় দেখায় । আমাদের মধ্যে তিন ধরনের মানুষ আছেন, উত্তম-মাধ্যম-কনিষ্ঠ। প্রত্যেকের জন্যই ঈশ্বর-অনুভূতির আলাদা রাস্তা। কেউ আকাশ পথে, কেউ জলপথে, কেউ বা স্থলপথে লক্ষে পৌঁছান। উদ্দেশ্য সবারই এক তবে রাস্তা ভিন্ন। যে সব মহাত্মা বহুজন্মকৃত নিষ্কাম কর্ম্ম ও সাধন সহায়ে নিজেকে নির্মলচিত্ত করতে পেরেছেন, তারাই এই ব্রহ্মজ্ঞান সাধনের যোগ্য। তাই বলা হয়ে থাকে, উত্তম-অধিকারী এই জন্মেই তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতে পারেন। এই অতি উচ্চ ব্রহ্ম জ্ঞানের একটা ক্ষুদ্র বই হচ্ছে, অষ্টাবক্র সংহিতা। কিছুদিনের মধ্যে এই উচ্চ জ্ঞানের কথা আমরা সাধারণের ভাষায় শুনবো। বিদ্বৎ সমাজে যা প্রচলিত আছে, সেই অমৃত বাণী আমরা আমাদের মতো করে বুঝবার চেষ্টা করবো। যারা এই আলোচনা শুনতে আগ্রহী, তাদেরকে অনুরোধ করবো, অষ্টাবক্র গীতা -অনুবাদক স্বামী ধীরেশানন্দ - উদ্বোধন কার্যালয় থেকে প্রকাশিত - বইটি সংগ্রহ করে নেবেন। এটি একটি অমূল্য সম্পদ। বহু শিক্ষিত রমতা সাধুদেরকে দেখেছি, ঝোলার মধ্যে এই বইটি সবসময় রাখেন। ঠাকুর রামকৃষ্ণ স্বামী বিবেকানন্দকে এই বই পড়তে দিয়েছিলেন।
আমরা সবাই সাধারণ মানুষ হয়ে জন্মেছি। কিন্তু আমরা যেন সাধারণ মানুষ হিসেবেই দেহ ত্যাগ না করি। মনে রাখবেন, আমরা সবাই ঈশ্বরের সন্তান। আমাদের ধর্ম্মকে উপলব্ধি করতে হবে। ধর্ম্ম মানে শুধু শাস্ত্র পাঠ নয়, ধর্ম্ম মানে যুক্তি তর্ক নয়। ধর্ম্ম মানে ভবিষ্যৎবাণী দেওয়া নয়। ধর্ম্ম মানে জ্ঞান বিতরণ নয়। ধর্ম্ম মানে সত্যিকারের উপলব্ধি। ঈশ্বর অনুভূতি। ইন্দ্রিয়সুখ থেকে আমাদের নিজেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে। সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। ধর্ম্ম কোনো নির্দিষ্ট সময় নয়, ধর্ম্ম মানে কোনো দেশ নয়, ধর্ম্ম মানে কোনো নির্দিষ্ট জাতি নয়। ধর্ম্ম মানে কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায় নয়। ধর্ম্ম সার্বজনীন। ধর্ম্মই মানুষকে যোগ্য মানুষ করতে পারে। কারুর দয়ায় নয়, নিজের চেষ্টাতেই আমাদের মানুষ হতে হবে। আর সেই পথই ধর্ম্মপথ।
কেউ বলেন, আমাদের সমস্ত কর্ম্ম পূর্বনির্ধারিত। আবার কেউ বলে থাকেন, মানুষ তার নিজের ভাগ্য নিজেই গড়ে। এই দুটো স্ববিরোধী মনে হয় আমাদের। প্রতিটি জীব মারা যাবে এটা পূর্বনির্ধারিত। এটা আমি জানি আবার জানি না। অর্থাৎ আমি যে ২০০ বছর বাঁচবো না এটা আমি জানি। কিন্তু আমি ঠিক কবে মারা যাবো তা আমি জানিনা। আর বাঁচলে কি করব, সেটা আমাদের জানা নেই। মরবো, এটা নিশ্চিত, কিন্তু মরবার সময় বা মরবার আগে কি করবো, সেটা জানতে আমাদের আগ্রহ নেই। আমি যে বেঁচে আছি, এটা একটা ঘটনা মাত্র। কিন্তু বেঁচে থেকে কি করছি, ? এই যে বেঁচে আছি, কে বেঁচে আছে, অর্থাৎ কে আমি ? আর এই আমি কোথা থেকেই বা আসে, আর কোথায়ই বা চলে যায়। একটা পাগলকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো । তো সে জবাব দিয়েছিল, দেখো কোথা থেকে আসে আর কোথায়ই বা যায়, সেটা বুঝতে গেলে পাগল হতে হবে। তোমরা একবার জন্মের সময় কাঁদো, আবার মরবার সময় কাঁদো। এই কাঁদুনে লোকগুলো দেখলে বোঝা যায়, এরা ভালো জায়গা থেকে আসেও না আবার ভালো জায়গায় যায়ও না। কিন্তু পাগলরা হাসতে হাসতে মারা যায়। কেননা মরবার কৌশলটা তারা বেঁচে থাকতে ভালো ভাবে শিখে নেয় । যে বাঁচতে চায়, সে বাঁচে, আর যে মরতে চায় সে মারা যায়। ইচ্ছেশক্তি আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, আবার এই ইচ্ছেশক্তির অভাবে জীবের মৃত্যু ঘটে।
এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বলি। মহাবীর একবার গোশালক-কে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের দিকে যাচ্ছিলেন। গোশালক মহাবীরের একজন অবিশ্বাসী অনুসরক ছিলেন। অর্থাৎ মহাবীরের সমস্ত কথায় সে বিরোধিতা করতো। সবসময় মহাবিরকে সে পরীক্ষা করতো। তো তাঁরা একটা চারা গাছের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। গোশালক মহাবিরকে জিজ্ঞেস করলো, এই চারা গাছটা কতদিন বাঁচবে ? মহাবীর কোনো জবাব দিচ্ছিলো না, দেখে গোশালক আবার বললো, প্রশ্নটাকে এড়িয়ে যাবেন না। তো মহাবীর চোখ বন্ধ করলো, এবং জবাব দিলো, এই গাছটি পূর্ন হবার প্রত্যাশা নিয়ে জন্মেছে, এই গাছে, ফুল হবে, ফল হবে, তারপর একদিন মারা যাবে। এই চারাগাছ বংশবিস্তার না করে মারা যাবে না। একথা শুনে, গোশালক তক্ষুনি চারাগাছটাকে উপড়ে নিয়ে দূরে ছুড়ে ফেলে দিলো। আর গোশালক হো-হো করে হাসতে লাগলো। মহাবীরের কষ্ট হলো, কিন্তু মহাবীর মৃদু হাসতে লাগলো। আসলে মহাবীর বুঝলেন, এমনি করে, একদিন গোশালককেও উৎপাটনের যন্ত্রনা সহ্য করতে হবে। কিন্তু মরতে পারবে না।
যাইহোক, ৭-দিন পরে আবার তাঁরা ওই একই রাস্তা দিয়ে ফিরছিলেন। মহাবীর চোখ বন্ধ করে, গাছের পরিণতি দেখবার চেষ্টা করলেন। দেখলেন, গাছটি একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আসলে গাছটাকে উপড়ে ফেলে দেবার পরে, সেই রাতেই প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল। আর সেই ভিজে জমিতে গাছটি আবার তার শিকড় ছড়িয়ে দিয়েছে। মহাবীর গাছটার পাশে এসে দাঁড়ালেন। গোশালক হতাশ হয়ে লক্ষ করলো গাছটি আবার দাঁড়িয়ে গেছে। এবার আর সে গাছটাকে উপরে ফেলবার দুঃসাহস করলো না। মহাবীর বললেন, এর প্রাণে কোথাও মরবার আকাংখ্যা নেই। যার মরবার আকাংখ্যা আছে, সে নিমিত্ত পেলেই মারা যেতে পারে। কিন্তু যার মনে মরবার আকাংখ্যা জন্মাতেই পারেনি, তার আত্মশক্তি জাগ্রত থাকে। আর যার আত্মশক্তি বা ইচ্ছেশক্তি যত প্রবল, সে তত নিমিত্তকে পরিহার ক'রে, জীবনের পথে এগিয়ে যেতে থাকে। আমাদের মধ্যে মৃত্যুর ইচ্ছে বা মৃত্যুচিন্তা জাগ্রত না হলে, আমরা মারা যাই না। মৃত্যুর আগে, মানুষকে মৃত্যুভয় চেপে বসে। আর এই মৃত্যুভয় বা মৃত্যুচিন্তা মানুষকে মৃত্যুর দিকেই টেনে নিয়ে যায়। মানুষ একসময় একটা এককোষী প্রাণী ছিল। তারও আগে সে ছিল একটা জৈব পদার্থ মাত্র। বিশ্বশক্তি তাকে ধীরে ধীরে মানুষে রূপান্তররিত করেছে। এই বিশ্বশক্তির একটা অংশ আমাদের ইচ্ছে শক্তি। এর ক্ষমতা অসীম। আজ এই মহামারীর দিনগুলোতে আমাদের ইচ্ছেশক্তিকে জাগ্রত করতে হবে। যারা অসুস্থ হয়েছিলেন, এবং সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন, তারা সবাই বলেছেন, আমি আমার মনের জোর বাড়াবার চেষ্টা করেছিলাম। ইচ্ছেশক্তি নিমিত্তকে পরাস্থ করতে পারে, পরিণতিকে নয়। এটা আমাদের বুঝতে হবে।
আমাদের সবার একটা অতীত আছে। আমাদের সবার একটা বর্তমানও আছে, আবার একটা ভবিষ্যৎও আছে। যদি আমার মা-বাবা এই পৃথিবীতে না আসতো, তবে আমি আসতে পারতাম না। আবার আমার এই জীবন যাত্রায় একটা ভবিষ্যৎ আছে। অর্থাৎ যেদিকে আমি এগিয়ে যাচ্ছি। আর এই যাত্রার মাঝামাঝি হচ্ছে বর্তমান। অর্থাৎ আমার এক পা পিছনে বা অতীতে, এক পা সামনে অর্থাৎ ভবিষ্যতে আর আমার হাতদুটো আছে বর্তমানে। আমার বর্তমানের জন্য যেমন একসময় অতীত উদ্ভাসিত ছিল, ঠিক তেমনি ভবিষ্যৎ নির্মান প্রক্রিয়া প্রতিনিয়ত করে চলেছি । আমার যদি অতীত ও ভবিষ্যৎ না থাকে তবে আমার বর্তমান থাকবে না। বর্তমান হচ্ছে অতীত ক্রিয়ার ফল, আর ভবিষ্যৎ হচ্ছে বর্তমান ক্রিয়ার ফল। এবং এটি একটি সতত ক্রিয়শীল ব্যবস্থা। অতীত ঘটনার অংশীদার আমি, আবার ভবিষ্যতেরও অংশীদার আমি। আমাকে একজন প্রশ্ন করেছিল, সাধুরা কিছুই কাজকর্ম্ম করে না, অথচ আনন্দে থাকে। আর আমরা এতো খেটে মরি, তবু দুঃখ আমাদের যায় না। তো তাকে বলেছিলাম, তুমি দৌড়োচ্ছ, কারন তোমাকে অনেকদূর যেতে হবে। সাধুরা বাড়ির কাছে এসে গেছে, তাই ধীরে ধীরে হাটছে। সাধুর ভবিষ্যৎ তৈরির দরকার নেই, তোমরা ভবিষ্যৎ তৈরির কাজে ব্যস্ত।
ঈশ্বরে আত্ম-সমর্পন মানে আমাদের সমস্ত কাজ করবার সময়, ঈশ্বরকে স্মরণে রাখা। প্রকৃত আত্ম-সমর্পন আমাদেরকে জ্ঞান ও মর্যাদায় ভূষিত করে। কর্ম্মে নিপুনতা বৃদ্ধি করে। কিন্তু তার মানে এই নয়, বোকার মতো আচরণ করতে হবে। আমাদের মধ্যে ভগবান যে বিবেক ও বুদ্ধি দিয়েছেন, তাকে কাজে লাগাতে হবে। এক পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। তার স্ত্রী উনুনে ভাত বসিয়ে, স্বামীকে বললেন আমি একটু বাথরুমে যাচ্ছি, তুমি একটু খেয়াল রেখো। তো ভাত উৎরে উঠলো, হাড়ির গা বেয়ে জল গড়াতে লাগলো। পণ্ডিত ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনায় বসে গেলো। উনুন নিভে গেলো। স্ত্রী বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখে উনুন নিভে গেছে, কিন্তু গ্যাস বেরুচ্ছে। স্ত্রী তাকে বকতে লাগলো, উনুনটা নিভিয়ে দিতে পারোনি?
এই সংসারে প্রত্যেকটি ঘটনা অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, কারো পৌষ মাস কারুর সর্ব্বনাশ। ভাগ্যদেবী আমাদের চারিদিকের অবস্থাগুলোর মধ্যে একটা যোগাযোগ ঘটিয়ে নানান ফল প্রদান করে থাকেন। তা সে সুফল হতে পারে আবার কুফল হতে পারে। যখন শুভযোগ হয়, তখন আমরা সুফল পেয়ে থাকি। আর আমরা বলি আমাদের সৌভাগ্য। আবার যখন তিনি অশুভযোগ ঘটিয়ে কুফল প্রদান করেন, তখন আমরা তাকে বলি দুর্ভাগ্য। রাস্তায় দাঁড়িয়ে যে একদিন মার্ খেয়েছিলো, তিনি এখন আমাদের মুখ্যমন্ত্রী। চায়ের ফেরিওয়ালা আজ আমাদের প্রধানমন্ত্রী। টানা-রিক্সা ওয়ালার মেয়ে আজ প্রশাসনের উচ্চ পদে। বীর নেপোলিয়ান, শেষ দশায় হেলেনা দ্বীপে বন্দি জীবন কাটিয়েছেন। রুশ সম্রাট সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত হয়েছিলেন। অদৃষ্ট কেউ খন্ডাতে পারে না। এই অদৃষ্টের নিয়ামক কে ? আমাদের সামনে ভালো মানুষ দুঃখ-কষ্ট ভোগ করছে, আবার বদমায়েশ লোক সুখে দিনযাপন করছে। কার নির্দেশে এসব হচ্ছে ?
আত্মন - জগতের রঙ্গ-তামাশা দেখে আকৃষ্ট হয়ে নদীর ওপার থেকে এপারে বাসা করেছিলাম। এখন নদীতে ভাঙন শুরু হয়েছে। এবার পাহাড়ে যাবো, তাই প্রশ্নবানে বিব্রত হতে চাই না। আমি তুমি বলে কিছু নেই। আমি আপনার ভিতরেই আছি, আপনিও আমার ভিতরে আছেন। আপনি যখন এইসব কথা শুনছেন, তখন আমি আপনার সাড়া পাই, আমরা সবাই এক। নিজেকে দেখুন, তাহলে "আমি"কেও দেখতে পারবেন। এই হাড়-মাস-রক্ত নির্মিত শরীর -এর ভিতরেই "আমি" আছে। এই আমাকে অনুভব করবার চেষ্টা করুন। সবার সঙ্গেই এই "আমি" আছে। গুরুদেবকে স্মরণ করুন, দেখবেন গুরুদেব আপনার ভিতরে প্রাণবন্ত হয়ে উঠবেন। এর জন্য কারুর সাহায্য নেবার দরকার নেই। আপনার আকুলতা আপনার বিবেক-কে জাগ্রত করে দেবে। আর বিবেকের মাধ্যমেই গুরুদেবের বাণী শুনতে পারবেন। আমরা দেখি অনেকে, কিন্তু দেখতে চাই কজনে ? ফুল, আপন মনে ফোটে, গন্ধ ছড়ায় কাউকে গন্ধ দেবার জন্য গন্ধ ছড়ায় না, কিন্তু যার গন্ধ নেবার সে ঠিক গন্ধ পেয়ে যেতে পারে । এতে ফুলের কিছু যায় আসে না। কিন্তু ফুল ছিঁড়ে নিজের বসার ঘরে ফুলদানিতে রাখলে, ফুল শুকিয়ে যায়। ফুলকে ফুলের জায়গায় থাকতে দিন। ভালো থাকবেন, অবশ্যই ভালো থাকবেন।
আমি নিতান্তই একজন সাধারণ মানুষ। মহাত্মা গুরুনাথের প্রবর্তিত সত্যধর্ম্ম মন্ডলীর সাথে সেইঅর্থে কোনো যোগাযোগ নেই। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি এবং আমার স্ত্রী এই ধর্ম্মে দীক্ষিত। আমার এই চ্যানেল খোলার উদ্দেশ্য ছিল, সত্যধর্ম্মের আদর্শকে ডিজিটাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার করা। যেহেতু আমি এই ধৰ্ম্মে দীক্ষিত নোই, তাই কেউ কেউ...........। এই ধর্ম্মের প্রচারক পারলৌকিক মহাত্মাগণ। তো আমি সেখান থেকে সরে এসে নিজের মতো করে, ভাবতে থাকি। আর এই ভাবনার ফসল এই চ্যানেলের কথা। সরাসরি কারুর সাথে দেখা করা, বা আলোচনায় অংশগ্রহণ করা, আমার মনের শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে বলে মনে করি। তাই এইসব নিয়ে আমি নিজেকে লুকিয়েই রাখতে চাই। ভালো থাকবেন, অবশ্যই ভালো থাকবেন।
কথাগুলো সবই পুরাতন, কিন্তু চির নতুন। আমরা দেহ নোই। আমাদের অনন্ত যাত্রায়, এটি একটি বাহন মাত্র। তো এই বাহনকে আমাদের পরিষ্কার পরিছন্ন রাখতে হবে। এর সমস্ত কলকব্জার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। শরীরের শ্রম-বিশ্রামের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজন সিদ্ধির উপযুক্ত খাদ্য দিতে হবে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, এই গাড়ি আমি চালাবো, গাড়ি যেন আমাকে না চালায়। গাড়িকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়। গাড়ির সাহায্যে আমাকে এগিয়ে যেতে হবে। গাড়ির প্রতি যেন আমরা আসক্ত না হই। মাঝে মধ্যে আমরা যখন জংশন স্টেশনে আসবো, তখন আমাদের এই গাড়ির পরিবর্তনের প্রয়োজন আসবে, তখন আমাদের আবার নতুন ধরনের গাড়ির সাহায্য নিতে হবে। যেন - রিক্সায় চড়ে বড়ো রাস্তায় আসা, সেখান থেকে মোটর গাড়িতে চড়া, এর পরে রেলগাড়িতে চড়া। এইভাবে সময়, অবস্থা ও উদ্দেশ্য ভেদে আমাদের এই গাড়ির পরিবর্তন করতে হবে। গাড়ির আকর্ষনে আমরা যেন গন্তব্যের কথা ভুলে না যাই। এই জ্ঞান আমাদেরকে শ্রেয়পথে চালিত করবে।
আজ সাধন জগতের একটা গুহ্য কথা যা আমরা সাধারণত শ্রীগুরু মুখেই শুনে থাকি, তেমন একটি সাধনসূত্র শুনুন। যারা সাধন জগতের প্রবেশের দ্বারে উপস্থিত হয়েছেন, তারা এই মুহূর্তটাকে ধরবার চেষ্টা করুন। আমরা শুনেছি, যখন আমাদের দুই নাসারন্ধ্র দিয়ে সমান ভাবে বায়ু প্রবাহিত হয়, তখন আমাদের ধ্যান করবার সময়। এটি একটি নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের সবার হয়ে থাকে। আমরা সবাই এই মুহূর্তের সাক্ষী। তো এই সময়টাকে আমরা আমাদের ইচ্ছেমতো সাক্ষাৎ করবো কি করে ? এর জন্য দরকার প্রাণায়াম। পূরক-অন্তকুম্ভক-রেচক বাহ্য-কুম্ভক - কোনো বাঁধাধরা নিয়মের মধ্যে না গিয়ে ক্ষমতা অনুযায়ী এই প্রক্রিয়া করতে থাকুন। ক্ষাণিক্ষণ পরেই আপনি বুঝতে পারবেন, আপনার শ্বাস-প্রশ্বাস দুই নাক দিয়েই প্রবাহিত হওয়া শুরু করেছে। এবার আপনি ধ্যানে বসে যান।
স্বাভাবিক ভাবে স্বাস প্রশ্বাসের গতি ধীর করবেন কি ভাবে ? দীর্ঘপ্রনব উচ্চারণ করুন, ১০-১৮ বার। অনুনাসিক ধ্বনিকে দীর্ঘায়িত করুন । এবার ভ্রূযুগলের মধ্যে বা হৃদয়কেন্দ্রে মনকে স্থির করে বসে থাকুন, খেয়াল করুন, আপনার শ্বাসের গতি ক্ষীণ হয়ে গেছে, অথবা একেবারেই নেই। এই সময়টা ৩০ সেকেন্ড থেকে ২ মিনিট পর্যন্ত হতে পারে। এই বিশেষ ক্ষণকে ঈশ্বর চিন্তায় ডুবিয়ে দিন।
মৃত্যু সবসময় রহস্যে ঘেরা। মৃত্যুকালে প্রথমে বাকশক্তি লোপ পায়, কিন্তু জ্ঞান থাকে, চিন্তা করবার শক্তি থাকে। মুমূর্ষু ব্যক্তি উপস্থিত আত্মীয় স্বজনকে চিনতে পারে। পরে, মন প্রাণে লয়প্রাপ্ত হয়। তখনও জ্ঞান থাকে। পরে প্রাণশক্তি তেজঃশক্তিতে এবং তেজ পরাদেবতাতে লিন হয়। তখন বোধ-শক্তি বিলুপ্ত হয়। আত্মা তখন স্থুল ফেলে সুক্ষ দেহে আশ্রয় নেয়। ব্যক্তির স্বভাব-প্রকৃতি, স্মৃতি, কৃষ্টি, বুদ্ধি, মন সবই তার সঙ্গে যায় - আর যায় কর্ম্ম। ছান্দোগ্য উপনিষদ বলছে - অথ যদাস্য বাঙ্মনসি সম্পদ্যতে , মনঃ প্রাণে, প্রাণস্তেজসি, তেজঃ পরস্যাং দেবতায়াম অথ না জানাতি।
আমার সবকিছু আত্মাতে আশ্রয় করে। অজ্ঞ ব্যক্তি বার বার আসে স্থূল শরীরে, জ্ঞানী মুক্ত হয়ে যান।জীবনটাতো বেশ মজার, তো বার বার জন্মালে ক্ষতি কি ? আসলে সুখে থাকতে যেমন আমাদের ভূতে কিলায়, তেমনি বার বার জন্ম নিতে নিতে একসময় আমাদের আর জন্ম নিতে ইচ্ছে করে না। একদিন সবাই আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। খেলতে খেলতে একসময় আমাদের সবার বাড়ির কথা মনে পড়ে। তখন আমরা খেলাঘর ছেড়ে বাড়ি যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ি। এই ব্যাকুলতাই আমাদেরকে ঈশ্বরকে খোঁজায়। বাড়ির কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু যাঁরা বোধিসত্ত্ব, তাঁরা সবাইকে বাড়ি পাঠাতে চায়।
"স্বামীজী বলেছিলেন, আমি সমাধিতে ডুবে থাকতে চাই। ঠাকুর রামকৃষ্ণ স্বামীজিকে বলেছিলেন, তুই বড় হীনবুদ্ধি রে ! ভেবেছিলাম, তুই বিরাট বটগাছ হবি। সংসারদগ্ধ মানুষ তোর ছায়ায় এসে আশ্রয় পাবে। তা নয় তুই কেবল নিজের মুক্তি চাস ? তুই তো বড় বোকা ! জানিস এর থেকেও উঁচু অবস্থা আছে ? " মানুষ এই আদর্শে পৌঁছুলে, তার কাছে মুক্তিও তুচ্ছ হয়ে যায়।
হিন্দুদের যত দেবদেবীর মূর্তি আছে, তাদের প্রায় সবারই বাহনগুলো পশু-পক্ষী। এগুলো আসলে সবই রূপক। আসলে যে দেবশক্তি যে পশুশক্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত সেই দেবতার বাহন সেইমতো কল্পনা করা হয়েছে। যেমন ধরুন - গনেশ। গনেশের বাহন হচ্ছে মূষিক। গনেশ হচ্ছেন সিদ্ধিদাতা। অথর্বশীর্ষের সায়নভাষ্যে বলা হয়েছে, "মুষ্ণাতি অপহরতি কর্ম্মফলানি ইতি মূষিকঃ"। জীবের কর্ম্মফল সমূহ অজ্ঞাতসারে অপহরণ করে ব'লে এর নাম মূষিক। সিদ্ধিলাভের প্রতিবন্ধক হচ্ছে কর্ম্মফল। তাই আমাদের কর্ম্মফল যতক্ষন বিদ্যমান থাকে ততক্ষন সিদ্ধিলাভ সম্ভব নয়। মানুষ একটাসময় সিদ্ধিলাভের জন্য এতটাই উদগ্রীব হয়ে ওঠে যে, সিদ্ধিলাভের এই প্রতিবন্ধক স্বরূপ কর্ম্মফল ভোগ ব্যতীত ক্ষয় করতে ইচ্ছে করে। এইসময় সাধক মূষিক ধর্ম্মী হয়। ব্রহ্মজ্ঞানরূপ পরম সিদ্ধিলাভের উপযুক্ত হলেই, জীব চুপি চুপি অজ্ঞাতসারে স্বকীয় কর্ম্মফলগুলো কাটতে আরম্ভ করে। অর্থাৎ মানুষ এইসময় মূষিক ধর্ম্মী হলেই পরম সিদ্ধিলাভ করে ধন্য হয়।
লক্ষ্মীর বাহন পেচক বা প্যাঁচা। প্যাঁচা দিনকানা। যারা দিবান্ধ অর্থাৎ আত্মজ্ঞানে অন্ধ তারাই প্যাঁচাধর্ম্মী। জীব যতদিন পেচকধৰ্ম্মী থাকে অর্থাৎ জ্ঞানান্ধ থাকে ততদিন ধনাদি সম্পদের মধ্যে পার্থিব সুখ খোঁজে। আর তাই পার্থিব সুখের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মীর বা ব্রহ্মশক্তির উপাসনা করে। মা ধনেশ্বরী মূর্তিতে দিবান্ধ প্রাণীর উপরেই প্রতিষ্ঠিত থাকে।
সরস্বতী দেবীর বাহন হচ্ছে হংস। মা সরস্বতী দেবী ব্রহ্মবিদ্যা। যে সাধক অজপা মন্ত্রে সিদ্ধ সেই সাধক হংসধর্ম্মী। মানুষ সুস্থশরীরে দিন-রাতে ২১৬০০ বার "হংস" এই অজপা মন্ত্র স্বরূপ শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ-ত্যাগ করে থাকে। কিন্তু এসব করে থাকে সে অজ্ঞানে। যদি সাধক সজ্ঞানে এই স্বাভাবিক জপ উপলব্ধি করতে পারে, তখন সে হংসধর্ম্মী। হাঁসের আর একটা বিশেষ ধর্ম্ম হচ্ছে, জলমিশ্রিত দুধ থেকে জল পরিত্যাগ করে শুধু দুধকে গ্রহণ করতে পারে। মানুষ যদি নশ্বর জগৎ থেকে সার বস্তু অর্থাৎ জ্ঞান-মাত্র সংগ্রহ করতে পারে, তাহলে তার ব্রহ্মবিদ্যা লাভ হতে পারে।
বিষ্ণুর বাহন হচ্ছে গরুড় পক্ষী। শ্রীমৎ ভাগবতে বলা আছে, "ত্রিবৃদ বেদঃ সুপর্নস্তু যজ্ঞং বহতি পুরুষম্।" বেদই গরুড় পক্ষী। ইনি যজ্ঞ পুরুষ বিষ্ণুকে বহন করে থাকেন। জগৎব্যাপী যে চৈতন্য তিনিই বিষ্ণু। জ্ঞান ও কর্ম্ম এই উভয় ধরনের সাধনাই সর্বব্যাপী বিষ্ণু দেবতাকে বহন করে থাকে। পাখি যেমন উভয় পাখা দ্বারা উন্মুক্ত আকাশে বিচরণ করতে সক্ষম, ঠিক তেমনি সাধকগণ জ্ঞান ও কর্ম্মের সাধনবলে বিষ্ণুর সন্ধান পায়। কর্ম্মবিনা জ্ঞান বা জ্ঞানহীন কর্ম্ম দ্বারা জীবের উন্নতি হতে পারে না। জ্ঞান ও কর্ম্ম উভয় যখন সক্রিয় হয়, তখন জীবের মোক্ষ লাভ হতে পারে। মানুষ যখন শাস্ত্র-উক্ত কর্ম্মকান্ডে লিপ্ত হয়, তখন সে পক্ষিরূপ হয়। কর্ম্ম ও জ্ঞান হচ্ছে গরুর পক্ষির দুটি পাখা। গরুড় পাখির আর একটা গুন্ হচ্ছে - গরুড় সর্পভুক। সাপ হচ্ছে এমন একটা জীব, যার হাত পা নেই অথচ গমন করে, অর্থাৎ পতিত থেকেও গমনাগমন করতে পারে। মানুষের কর্ম্ম যখন জ্ঞানময় হতে থাকে ততই সে সংসারাসক্তি, অর্থাৎ দেহাত্মরূপি আমাদের যে কুটিলগতি-সর্প তার বিলোপ সাধন হয়। মানুষ যখন গরুড় ধর্ম্ম অবলম্বন করে, তখন সে দেখতে পায়, মোক্ষদাতা জগৎব্যাপক বিষ্ণু তাহাতেই প্রতিষ্ঠিত। জ্ঞানময় কর্ম্মযজ্ঞই যজ্ঞেশ্বরের বাহক। আসলে এই রূপকগুলো যদি আমরা ধরতে পারি, তবে হিন্দুদের দেব-দেবীর আরাধনার মাহাত্ম বুঝতে পারবো। মানুষ ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির। যার যেমন ইচ্ছে হয়, তার তেমনি সহায় হয়।
শিবের বাহন হচ্ছে বৃষ। বৃষ কথাটা অর্থ হচ্ছে ধর্ম্ম। শিব হচ্ছেন, বিজ্ঞানময় পুরুষ, জ্ঞানরূপী গুরু। বহু উচ্চকোটির সাধক আছেন, যারা শিবকে গুরুরূপে বরণ করেছেন। এঁদের কোনো দেহধারী গুরু নেই। শিবকে গুরুরূপে মান্যতা দিয়েছেন। এই শিবের সন্ধান পেলে আমাদের মৃত্যুভয় দূরীভূত হয়। বৃষের চারটি পা। ধর্ম্মও চারটি পদবিশিষ্ঠ। তপঃ, শৌচ, দয়া ও দান - ধর্ম্মের এই চারটি পাদ। মানুষ যখন এই চতুস্পাদ ধর্ম্মের পালন করে, তখন তাঁর শিবদর্শন বা গুরুলাভ হয়। তাই বৃষে আরোহন করে আছেন শিব।
সিংহবাহিনী দূর্গা। হিংসাই সিংহের প্রধান ধর্ম্ম। পশুরাজ সিংহ। যে মানুষ নিজেকে জীবত্ত্বের (হিংসার) উর্দ্ধে ওঠাতে পেরেছেন, তিনি পশুশ্রেষ্ঠ সিংহ। মানুষের যখন পশুত্বের আধিপত্য থেকে যথার্থ মনুষ্যত্বে উন্নীত হতে পারে, তখন তাকে সিংহ-ধর্ম্মী বলা হয়ে থাকে।
মানুষ সংসারের বিষয়সুখকে আরো নিবিড়ভাবে ভোগ করবার জন্য, ঈশ্বরের আরাধনা করে। আবার সংসারে যখন অসহায় হয়ে যায়, অথবা আপনজনের আঘাতে যখন সংসারে বিরক্তি আসে, তখন মানুষ নির্জনতার মধ্যে আশ্রয় খোঁজে। সংসার থেকে বিতাড়িত হয়ে মানুষ একজন স্নেহশীল গুরুর খোঁজ করে। কিন্তু তখনও মানুষের বিষয়বাসনা বা সন্মন্ধদোষ কাটাতে পারে না। পুরোনো দিনের কথা সে ভুলতে পারে না। কিন্তু একটা সময় আসে, যখন মানুষ বুঝতে পারে,বিষয়-সম্মন্ধ বিষমাত্র। এইসময়ও একটা অজ্ঞেয় শক্তির তাড়নায়, বিষয় গলাদ্ধকরন করতে হয়। এর চেয়ে নরক যন্ত্রনা আর কি হতে পারে ? প্রথম প্রথম এই যন্ত্রনা সামান্যমাত্রায় অনুভূত হয়। ঈশ্বর যখন দয়া ক'রে, তার বুদ্ধিক্ষেত্রে অবস্থানের সুযোগ বেশি করে দিতে থাকেন, তখন এই যন্ত্রণার মাত্রা দ্রুতবেগে বর্দ্ধিত হতে থাকে। জগতের সব কাজ করতে হয়, তাই করে। কিন্তু কিছুতেই যেন সে স্বস্তি পায় না। এই মর্মপীড়া অন্তরে অন্তরে থাকে, সাধক-গুরু ভিন্ন এই অবস্থা অন্য কেউ উপলব্ধি করতে পারে না। তাই মাঝে মাঝে মনে হয়, সাধক হওয়া অপেক্ষা, না হওয়া বরং সুখের। জেনেশুনে বিষ খেতে হয়, আবার না খেয়েও সে পারে না। জেনেশুনে বিষপান কি কষ্টকর তা বর্ণনা করা যায় না।
মায়ের ডাক : জ্ঞানন্তু বিশ্বে অমৃতস্য সত্তাঃ। (পুনঃ প্রচার)
হে আমার প্রানপ্রিয় সন্তানগণ,
সত্যের মঙ্গল আহ্বান কি তোমার কর্ন কুহরে প্রবেশ করেছে ? ভোরের আধোঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে পুবের আকাশে সত্যের আলোকরেখা দেখতে পাচ্ছো কি ? বহু জন্মের মোহ নিদ্রা ভেঙে চেয়ে দেখো, মায়ের স্নেহ শীতল হাতের স্পর্শ কি অনুভব করতে পারছো ? নাকি নিদ্রার জড়তা এখনো কাটেনি ? নাই বা ভেঙেছে ঘুম, এই ঘুম আর জাগরণের সন্ধিক্ষনে অবস্থান করে খান খাড়া করো। ওই শোনো অবিশ্রান্ত মাতৃ-আহ্বান। এই মাতৃ-আহ্বান যার কানে একবার পৌঁছেছে, সে তো জেগে উঠেছে। এই মাতৃ-আহ্বান যার কানে একবার পৌঁছেছে, সে অনাদিকালের জড়তা থেকে জেগে উঠেছে। শুধু মনের ব্যাকুলতা নিয়ে, কর্ণকুহর উন্মুক্ত রাখো। যিনি তোমাকে নিদ্রা থেকে জাগিয়েছেন, তিনিই তোমাকে উঠবার মতো শক্তি দান করবেন। তুমি শুধু কান পেতে থাকো, এই ডাক তোমাকে ব্যাকুল করে দেবে। শুধু কান খোলা রাখো, তবেই প্রানের মধ্যে মায়ের ডাক তোমাকে ব্যাকুল করে দেবে। আর মায়ের মধুর ডাকের প্রবল আকর্ষণ তোমাকে বিষয়-কুল পরিত্যাগ করে মায়ের দিকে ধাবিত করে দেবে।
হে আমার স্নেহের সন্তান, কল্পিত মোহে আচ্ছন্ন হয়ে আছো ? জড়ত্বের সংস্পর্শে, যে সুখ-দুঃখের ভাগিদার হয়েছো, মায়ের কোলে এলে, তোমার সেই সাময়িক বিষয়গত সুখ-দুঃখের চিরতরে অবসান হবে। মায়ের স্নেহ-আদরে, মায়ের কোলের অসীম আনন্দে, তুমি আত্মহারা হবে।
হে প্রাণপ্রতিম, যদি জেগেছো, যদি জগৎকে সত্যরূপে জেনেছো, যদি জড়কে চিন্ময় রূপে জেনেছো, যদি সর্বভূতে মাতৃসত্তা দর্শন করতে অভ্যস্ত হয়েছো, তবে এস উঠে দাঁড়াও। আমার দিকে চেয়ে দেখো, আকাশভরা তারকা মন্ডলী এই আমারই আরতি করছে। আমি এই জগৎ-প্রসবিনী মাতা। আমারই মধ্যে বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড অনন্তকাল ধরে খেলা করছে। অসংখ্য জীবকুল অনাদিকাল থেকে আমারই পূজার অর্ঘ নিয়ে ছুটছে - কাল থেকে কালান্তরে। আমাতেই প্রাণাহুতি দিচ্ছে, আমাতেই আমি-ময় হচ্ছে।
হে আমার শণিতবিন্দু, আর কতদিন বিক্ষিপ্ত থাকবে ? আর কতদিন, সুখ-দুঃখ, জন্ম-মৃত্যুর ঘাত প্রতিঘাতে ক্ষত -বিক্ষত হয়ে যন্ত্রনা ভোগ করবে ? এসো, জন্ম-মৃত্যুর তাড়না থেকে বেরিয়ে এস, রোগ-শোকের কষ্ট থেকে বেরিয়ে এস, আমরা করুনা হস্ত একবারটি আঁকড়ে ধরো। আমি তোমাদের কোলে তুলে নেবার জন্য, তোমাদেরকে আদর করবার জন্য, মাতৃস্নেহ দেবার জন্য ব্যাকুল। ভবের খেলা সাঙ্গ করে আমার কোলে ফিরে এস। প্রাণ-চৈতন্যে প্রতিষ্টিত হও। আশীর্বাদ-পুষ্ট হোক তোমার সাধন জীবন। - জগৎজননী।
মহিষাসুর বধ - বিষ্ণুগ্রন্থি ভেদ :
মহিষাসুর বধের যথার্থ অর্থ কী ?
মায়ের পূজার সময় এলো। গত কয় বছর কোরোনার প্রাদুর্ভাবে, মহিষাসুর বধের আয়োজন ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু মহিষাসুর বধ তো আমাদের সবার সাধন জীবনে অপরিহার্য। নাহলে আমরা সেই পরমপদ কিভাবে লাভ করতে পারবো ? জীবদেহে চিরকাল দেবাসুরের সংগ্রাম চলছে। শাস্ত্র বলছে, আমাদের ইন্দ্রিয়বৃত্তি সবসময় পরস্পর বিরোধী ইন্ধন যোগাচ্ছে। আমাদের যে বৃত্তি অমৃতের আস্বাদন করতে উৎসুক, তা হচ্ছে দেবতা আর বিষয়বৃত্তি হচ্ছে অসুর। উভয়পক্ষ পরস্পরের বিষয় অপহরণের চেষ্টা চলছে। সমস্ত জীবের শরীরে এই উভয় বৃত্তি বর্তমান। পরমাত্ম বিষয়ক ইন্দ্রিয়বৃত্তি, এবং জাগতিক বিষয়ভোগ-রূপ ইন্দ্রিয়বৃত্তি - এই উভয় বৃত্তি পরস্পরের প্রতি দ্বেষাত্মক।
অসুররাজ মহিষাসুর। দেবরাজ ইন্দ্র। এই দুইয়ের সংগ্রাম। কাম-ক্রোধ রজোগুণ থেকে উদ্ভূত। এই ক্রোধ বা ক্রোধের কারন রজগুন। এই রজগুনের প্রতীক মহিষ। রজগুনের বহির্মুখী বিকাশের জন্য, আমাদের যে সঞ্চিত সংস্কার, আমাদের যে বহুত্ত্বভাব ভাব, একেই বলে অসুরবৃন্দ। অনাদিকাল থেকে আমাদের চিত্ত ক্ষেত্রে বহুত্ত্বভাব পোষন করে এসেছি, তাকে দূর করতে পারিনি। রজগুন থেকেই এই সবের অভিব্যক্তি। আমাদের যাবতীয় কামনা, বাসনা, দম্ভ, দর্প , অভিমান, এগুলো সব আসুরিক সম্পদ। এগুলো রজোগুণের স্থূল প্রকাশ। তাই রজোগুনরূপী মহিষাসুর এদের রাজা।
আবার এই রজোগুণের অন্তর্মুখী বিকাশ সমূহ হচ্ছে দেবতা। ইন্দ্র এর অধিপতি। এই ইন্দ্রের আর এক নাম পুরন্দর। অর্থাৎ অন্তঃপুরে যার বাস। পুরকে যিনি ধংশ করেন, তাকেই বলে পুরন্দর। নবদ্বার বিশিষ্ট এই পুরকে অর্থাৎ দেহকে বিদীর্ন করে, অর্থাৎ আমাদের দেহাত্ত্ববোধকে নাশ করে, তিন অবস্থার অতীত, অর্থাৎ জাগ্রত-স্বপ্ন-সুসুপ্তির অবস্থার অতীত তুরীয় অবস্থায় বিচরণ করার জন্য যার প্রয়াস তাকেই বলে পুরন্দর। যিনি দেবতাদের রাজা। দান, ধ্যান, তিতিক্ষা, সত্ত্বশুদ্ধি - ইত্যাদি যাবতীয় দেবভাব এই পুরন্দরের আজ্ঞাধীন।
যখন একদিকে মহিষাসুর অন্যদিকে পুরন্দর অর্থাৎ অসুর ও দেবগনের অধিপতি পরস্পর পরস্পরের শক্তিক্ষয় করতে উদ্দত হয়, তখন আমাদের এই দেহপুরের মধ্যে দেবাসুর যুদ্ধ হয়। একদিকে ,অন্যদিকে অপবর্গের আকর্ষণ এই দুইয়ের মধ্যে সংঘর্ষ প্রতি পরমাণুতে প্রতিনিয়ত সংঘটিত হচ্ছে। জীব যতদিন মনুষ্যত্ত্বে উপনীত না হয়, ততদিন এই সংঘর্ষ চলতে থাকে। অর্থাৎ জীব যতক্ষন বিজ্ঞানময় কোষে আত্মবোধ না করতে পারে, ততদিন এই সংঘর্ষের মধ্যে দিয়েই আমাদের চলতে হয়। জন্ম-জন্মান্তরের সঞ্চিত সুকৃতির ফলে, একসময় মায়ের কৃপা হয় আর সৎগুরুর মাধ্যমে সেই কৃপাবারি আমাদের মধ্যে একটা অনুপ্রেরণার সঞ্চার করে। তখন সাধকের হৃদয়ে সংগ্রামের ঝঞ্ঝা অনুভূত হয়। এই অনুভব হলে বুঝতে হবে, আমাদের জীবন ধন্য হতে চলেছে।
একদিকে সঞ্চিত সংস্কার সমূহ, অন্যদিকে মাকে পাবার অদম্য পিপাসা। এইসময় জ্ঞানযোগরূপ দেবশক্তি মাতৃ-ক্রোড় লাভের সহায় হয়। এই জ্ঞান-অমৃত তখন মায়ের হিরন্ময় মন্দিরের দ্বারে পৌঁছে দেয়। এই জ্ঞানরূপ দেবশক্তি, আমাদের দম্ভ -দর্প দ্বারা লাঞ্ছিত হয়। কিন্তু শরণাগত তখন সজল নয়নে মায়ের কাছে শক্তি ভিক্ষা করে। এইসময় মা স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হন । আমরা তখন মায়ের কোলে, মায়ের আশ্রয়ে আত্মনিবেদিত প্রাণ হয়ে নিশ্চিন্ত ও নিষ্কর্ম্ম হয়ে যাই । আর মা আমাদের দেব ভাব রক্ষার দায়িত্ত্ব পালন করেন, অসুর-স্বভাবকে নিধন করেন। একেই যোগের ভাষায় বিষ্ণুগ্রন্থি ভেদ বলা হয়ে থাকে।
এটাই দেবাসুরের যুদ্ধ যা মহিষাসুর বধ নামেও খ্যাত।
আমাদের ধারণা চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক, এগুলো আমাদের ইন্দ্রিয়। পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন, এগুলো আদৌ ইন্দ্রিয় নয়. এগুলো ইন্দ্রিয়ের অধিষ্ঠান ক্ষেত্র মাত্র। আসলে ইন্দ্রিয়সকল প্রত্যক্ষের অগোচর। ভ্রান্তজ্ঞান সম্পন্ন লোকেরা ইন্দ্রিয়ের অধিষ্ঠান ক্ষেত্রকে ইন্দ্রিয় বলে থাকে। মহাভূতের পরমাণুকে তন্মাত্র বলে। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম - এগুলো পঞ্চভূতের সূক্ষ্ম অবস্থা। আর রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ - এই পাঁচটি হচ্ছে তন্মাত্র । সুক্ষ্মভূত ও তন্মাত্র একই পদার্থ। ইন্দ্রিয়গণ এই তন্মাত্রে আশ্রিত থাকে। যোগীগণ এই তন্মাত্র ও স্থুল শব্দ গ্রহণ করতে সক্ষম । কিন্তু আমরা কেবল স্থুল শব্দই গ্রহণ করতে সক্ষম। খুব কাছের, বা খুব দূরের জিনিস যেমন আমরা দেখতে পাইনা, তেমনি খুব জোরে বা খুব অস্তের শব্দ আমরা শুনতে পাই না। কিন্তু সিদ্ধ পুরুষগন তাদের সিদ্ধির মাত্রা অনুসারে, এই অধিক মাত্রার বা অতি অল্প মাত্রার শব্দ ও দৃশ্য দেখতে বা শুনতে পান।
বহু দেবতার গায়ত্রী মন্ত্র
বিষ্ণু-গায়ত্রী মন্ত্র :
ওঁং ত্রৈলোক্যমোহনায় বিদ্মহে কামদেবায় ধীমহি।
তন্নো বিষ্ণু প্রচোদয়াৎ।।ওঁং
নারায়ণ-গায়ত্রী মন্ত্র :
ওঁং নারায়ণায় বিদ্মহে বাসুদেবায় ধীমহি।
তন্নো বিষ্ণু প্রচোদয়াৎ।।ওঁং
গোপাল-গায়ত্রী মন্ত্র :
ওঁং কৃষ্ণায় বিদ্মহে দামোদরায় ধীমহি।
তন্নো বিষ্ণুঃ প্রচোদয়াৎ।।ওঁং
শিব-গায়ত্রী মন্ত্র :
ওঁং তৎপুরুষায় বিদ্মহে মহাদেবায় ধীমহি।
তন্নো রুদ্রঃ প্রচোদয়াৎ।।ওঁং
গনেশ গায়ত্রী-মন্ত্র :
ওঁং তৎপুরুষায়ঃ বিদ্মহে বক্রতুণ্ডায় ধীমহি।
তন্নো দন্তি প্রচোদয়াৎ।।ওঁং
নৃসিংহ-গায়ত্রী মন্ত্র :
ওঁং বজ্রনখায় বিদ্মহে তীক্ষ্ণ দংষ্ট্রায় ধীমহি।
তন্নো নরসিংহঃ প্রচোদয়াৎ।ওঁং
রাম-গায়ত্রী মন্ত্র।
ওঁং দশরথায় বিদ্মহে সীতাবল্লভায় ধীমহি।
তন্নো রামঃ প্রচোদয়াৎ।ওঁং
শক্তি-গায়ত্রী মন্ত্র :
ওঁং সর্ব্ব সন্মোহিন্যৈ বিদ্মহে বিশ্বজনন্যৈ ধীমহি।
তন্নো শক্তিঃ প্রচোদয়াৎ।ওঁং
সূর্য্য-গায়ত্রী মন্ত্র :
ওঁং আদিত্যায় বিদ্মহে মার্ত্তন্ডায় ধীমহি।
তন্নো সূর্য্য প্রচোদয়াৎ।ওঁং
ত্বরিতা-গায়ত্রী মন্ত্র :
ওঁং ত্বরিতায়ৈ বিদ্মহে মহানিত্যায়ৈ ধীমহি।
তন্নো দেবী প্রচোদয়াৎ।ওঁং
যা দেবী, সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।
যে দেবী সর্বভূতে মাতৃরূপে স্থিত আছেন, সেই মাকে আমি বার-বার প্রণাম জানাই। সমস্ত সূক্ষ্ম জীব-জগৎকে যিনি গর্ভে ধারণ করে আছেন, তিনিই আমাদের মা। সমস্ত স্থুল জগৎকে যিনি অঙ্কে ধারণ করে আছেন, তিনি আমাদের মা। আমাদেরকে অব্যক্ত অবস্থা থেকে ব্যক্ত অবস্থায় যিনি এনেছেন, যিনি এই রূপ দিয়েছেন, তিনি আমাদের মা। পুষ্টিকর স্তনদুগ্ধ দানে, বিষয়-জ্ঞানে যিনি আমাদের পুষ্ট করেছেন, তিনি আমাদের মা। যিনি আমাদের বহুত্ত্ব জ্ঞান দিয়েছেন, তিনি আমাদের মা। আমরা যে অবস্থাতেই থাকি না কেন, সর্বদা মায়ের কোলেই আছি। যতদিন এই জীবরূপে আমরা থাকবো, যতদিন "আমি" বলে নিজেকে বোধ করবো, জগতের বহুত্ত্বে মুগ্ধ থাকবো, ততদিন আমরা মায়ের কোলেই থাকবো। ধন্য এই জীবন। অন্বেষণ করবার কিছু নেই. অভাব বলে কিছু নেই, বিচার করবার কিছু নেই, চিন্তা করবার কিছু নেই। কেননা আমরা তো মায়ের কোলেই আছি। এই বিশ্বব্রহ্মান্ডই মায়ের কোলে।
স্বামীজী একদিন ঠাকুরকে গান শোনাচ্ছেন - "ভজন সাধন তার, কর-রে নিরন্তর।" ঠাকুর হঠাৎ বলে উঠলেন, যা করবি না, মিছামিছি তা কেন বলবি ? বল - "ভজন সাধন তার, কর-রে দিনে দুবার"।
অধ্যাত্ম জীবন কিছু পাবার জন্য নয়। অধ্যাত্ম জীবন হারাবার কৌশল শেখায়। রাগ, দ্বেষ, হিংসা, ভয় বর্জনের কৌশল আয়ত্ব করতে শেখায়। প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের পরিবর্তনের জন্য, আমাদের মধ্যে অস্থিরতা, এমনকি শারীরিক অসুস্থতার জন্ম হয়। এই সময় আমরা দুটো কাজ করতে পারি। এক বাইরে বেরিয়ে পড়তে পারি, অথবা অন্তর্মুখী হতে পারি। অন্তর্মুখী অর্থাৎ জপে নিবিষ্ট হওয়া বা ধ্যানস্থ হবার চেষ্টা করা। আর বহির্মুখী অর্থাৎ অন্যের দুর্দশাকে দূর করবার চেষ্টা করা। বাইরে বেরিয়ে দেখো, প্রকৃতির মধ্যে বৈচিত্রের সৌন্দর্য বিরাজ করছে, আকাশে মেঘের আনাগোনা চলছে। মনটাকে বিশালের মধ্যে বিস্তার করে দাও। সময় প্রতিকূল হোক অথবা অনুকূল হোক, হাত বাড়িয়ে দাও, ঈশ্বরের সৃষ্ট জীবকুল, এমনকি উদ্ভিদকুলের সঙ্গে স্পর্শের উত্তাপ অনুভব করো। প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে পরহিতের চিন্তা করো। যত তুমি হিত চিন্তায় মগ্ন থাকবে, বিশ্বশক্তি তোমার মধ্যে একটা হিল্লোল তুলে দেবে। তোমার অস্থিরতা বা অসুস্থতা তখন ম্রিয়মান হবে, তোমাকে ঘিরে তখন আনন্দের বাতাবরণ তৈরি হবে। তুমি তখন প্রশান্তির জগতে প্রবেশ করবে।
আমাদের একটা ধারণা হচ্ছে, আমরা যতক্ষন জেগে থাকি, ততক্ষন আমরা চেতনা সম্পন্ন হয়ে থাকি। আর এই সময় যা কিছু ঘটে সেটাই আমাদের জীবনের প্রাপ্তি, এবং স্থায়ী। আসলে সত্যিকারের আমি তিনটে অবস্থার মধ্যে বিরাজ করে। জাগ্রত-স্বপ্ন-সুষুপ্তি। সমুদ্রের মাছ জলে থাকে, মাঝে মধ্যে জলের উপরে ভাসে, এমনকি লাফিয়ে ওঠে আকাশের দিকে । লাফিয়ে শুন্যে ওঠা জৈবিক ক্রিয়া, যা ক্ষনিকের আনন্দ মাত্র, এটাই আমাদের জাগ্রত অবস্থা। জলে ভেসে থাকা আমাদের স্বপ্ন অবস্থা, মনের জগতে বিচরণ। আর জলের গভীরে আমাদের সুসুপ্তির অবস্থা, নিষ্ক্রিয় অবস্থা । এই তিনি মিলেই জীব-অবস্থা ।স্থূল শরীরের নাশের পরেও আমাদের দুটি অবস্থা বজায় থাকে। চৈতন্যের সমুদ্রে জীবের অস্তিত্ত্ব এই তিনের ভারসাম্যের মধ্যে রক্ষা পায়। প্রতিদিন আমরা নিজের স্বরূপে লেষহীন ভাবে মিশে যাই। ঘুম আমাদের অব্যক্তের অবস্থায় নিয়ে যায়। সুষুপ্তি আমাদের নিষ্ক্রিয় অবস্থায় নিয়ে যায়। আমরা প্রতিদিন আপন সত্ত্বায় বিলীন হয়ে যাই। নিজেকে হারিয়ে ফেলি। নিষ্ক্রিয় অবস্থায় আমাদের অহং বলে কিছু ক্রিয়াশীল থাকে না। তাই মহাত্মাগণ বলে থাকেন, ঈশ্বরের সাথে আমাদের প্রতিনিয়ত যোগাযোগ আছে । শুরু আমরা ধ্যান দেই না তাই ধরতে পারি না। ঋষি যাজ্ঞবল্ক একটা অদ্ভুত কথা বলছেন, ধ্যানই আমাদের বন্ধনের কারন, আবার ধ্যানই আমাদের মোক্ষের কারন । বিষয়ের ধ্যানে আমাদের বন্ধন, আর স্বরূপের ধ্যানে আমাদের মুক্তি।
মানুষ মৃত্যুকে ভয় করে। সে বেঁচে থাকতে চায়। কিন্তু আশ্চর্য্যের ব্যাপার হচ্ছে, সে আজ যেমনটি আছে, তেমনটি থাকতে চায় না। সে আরো বড়ো হতে চায়। বর্তমান অবস্থা নিয়ে চিরকাল সে থাকতে চায় না। সে আরো শারীরিক বল চায়, সে আরো জ্ঞান চায়, সে আরো সন্মান চায়, সে আরো বিষয় সম্পত্তি চায়। আর এই চাওয়াই তাকে প্রতিনিয়ত রূপান্তরিত করছে। তাই রূপান্তরই জীবের ধর্ম্ম। আর এই রূপান্তর শুধু তার বাহ্যিক জীবনে ঘটে তাই নয়, তার অন্তর্জগতেও এই পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এই পরিবর্তন একসময় তাকে চেতনসত্বার উপলব্ধি ঘটায়। চেতনার রূপান্তর ও বিস্তারের মাধ্যমে একসময় আত্মসত্তার সঙ্গে ব্রহ্মসত্তার মিলন হয়। এই অনুভূতিই জীবন্মৃত অবস্থা।
অসহায়, প্রিয়-জনের বিয়োগ ব্যথায় আছন্ন মায়ের প্রতি :
মাগো, আমরা কেউ অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন সাধু সন্ত নোই। আমরা নিতান্তই সাধারণ মানের ও সংসারী মানুষ। সুখ-দুঃখ আমাদের নিত্যসঙ্গী। প্রিয়জনের বিয়োগ ব্যাথা কাটিয়ে, চিদানন্দে বিরাজ করার অনুভূতি আমাদের নেই।
ঠাকুর রামকৃষ্ণের কাছে একবার এক পুত্র হারানো পিতা (মণিমোহন) গিয়েছিলেন। ঠাকুর জিজ্ঞেস করলেন, আজ তোমাকে এতো শুকনো দেখছি কেন ? কি গো কি হয়েছে ? তো মনি মোহন কাঁদোকাঁদো স্বরে বললেন, আজ আমার পুত্র মারা গিয়েছে। উপস্থিত সবাই স্তম্ভিত হলো, নীরব হলো। মনীমোহনের বিলাপ, ও কান্নাকাটিতে উপস্থিত লোক জন বললো, সংসারের ধারায় এমনিতর। সকলকেই একদিন মরতে হবে। যা হয়েছে, তার জন্য কান্নাকাটি করলে, তা কি আর ফিরে পাওয়া যাবে ? সহ্য করো। এমনি নানান কথা বলতে লাগলেন। যা আমরা সাধারণত বলে থাকি। কিন্তু ঠাকুর চুপ। কোনো কথা বলছেন না। ঠাকুরের তখন বাহ্যদশা। হঠাৎ ঠাকুর দাঁড়িয়ে পড়লেন, তাল ঠুকে গান জুড়ে দিলেন,
জীব সাজ সমরে।
ওই দেখ রনবেশে কাল প্রবেশে তোর ঘরে।
আরোহন করি মহা-পুন্য রথে
ভজন সাধন দুটো এসব জুড়ে তাতে,
দিয়ে জ্ঞান ধনুকে টান, ভক্তি-ব্রহ্ম বান সংযোগ করো রে।
আর এক যুক্তি আছে, শুনে সুসঙ্গতি,
সব শত্রূ নাশের চাইনে রথরথী
রণভূমি যদি করেন দাশরথি ভাগীরথীর তীরে।
গানের সুর-তান অঙ্গভঙ্গি, ঠাকুরের নয়নজলে বৈরাগ্য ও তেজের মিলন দেখে, উপস্থিত সবার মনে এক অপূর্ব আশা ও উদ্দমের স্রোত বইতে লাগলো। সকলের মন তখন শোক-মোহের রাজ্য হতে, বেরিয়ে এক ইন্দ্রিয়াতীত, সংসার-অতীত ঈশ্বরীয় আনন্দে পূর্ন হলো।
ঠাকুর মনীমোহনের কাছে গিয়ে বললেন, আহা ! মৃত্যু শোকের মতো কি আর জ্বালা আছে ? খোলটা (দেহ) থেকে বেরোয় কি না ? খোলটার সঙ্গে আমরা সম্পর্ক পাতাই। যতদিন আমাদের খোলটা থাকে ততদিন আমাদের সম্পর্ক থাকে। আমার ভাইপো অক্ষয় মোলো তখন কিছু হলো না। কেমন করে মানুষ মরে, কেবল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলুম। যেন খাপের ভিতর থেকে তরোয়াল বের করে নিলো। দেখে আমার খুব আনন্দ হলো, হাসলুম, গান করলাম, নাচলুম । তার শরীরটা তো পুড়িয়ে-জুড়িয়ে এলো। তার পরদিন, ঘরের পূর্ব দিকে দাঁড়িয়ে আছি, আর দেখছি, বুকের ভিতরটা, প্রাণের ভিতরটা,গামছা যেমন নিংড়োয়, অক্ষয়ের জন্য প্রানটা তেমনি করছে। ভাবলাম, আমার পোদের কাপড়ের সঙ্গেও সম্পর্ক নেই, তো ভাইপোর সঙ্গে আর কত থাকবে ? তো আমারই মৃত্যুশোকে এরকম হচ্ছে, তো সংসারীদের শোকে কি হয়। মা তুই দেখাচ্ছিস বটে।
ঠাকুর আবার বললেন, তবে কি জানো, যারা ঈশ্বরকে ধরে থাকে, তারা এই বিষম শোকেও তলিয়ে যায় না। একটু নাড়াচাড়া খেয়ে সামলে নেয়। কদিনের জন্যই বা এই সম্পর্ক ? মানুষ সুখের আশায় সংসার করতে যায়। বিয়ে করলে, স্বামী হলো, স্ত্রী হলো, ছেলে হলো, মেয়ে হলো। ছেলে মেয়ে বড়ো হলো, তাদের বিয়ে দিলে, দিন কতক এইভাবে চললো। তারপর একসময় অসুখ হলো, মা গেলো, বাবা গেলো। ছেলেমেয়েদেরও অসুখ বিসুখ লেগেই থাকে, আর আমরা চিন্তায় একেবারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠি। কেউ মোলো, আর কেউ বয়ে গেলো। আমাদের ভাবনা চিন্তা বাড়তেই লাগলো। যত রস মরে তত একেবারে দশ ডাক ছাড়তে থাকে। কাঁচা কাঠ উনুনে দিলে বেশ জ্বলে। কাঠখানা যত পুড়ে আসে, তত কাঠের পিছন থেকে গ্যাঁজলা রস বেরিয়ে আসে। আর শব্দ করে চোঁ চোঁ - ফুস-ফাঁস। নানান রকম আওয়াজ করতে থাকে। আমরা ওই পুড়তে থাকা কাঠ, যত পোড়ে তত রস মরে। অসার এই সংসার, অনিত্য এই সংসার। তবে কি জানো, তাঁকে ধরে থাকলে, সামলে নেওয়া যায়। নদীর ঢেউয়ে ডিঙি নৌকা দোলে বেশী, সামলাতে পারে না। কিন্তু স্টিমার একটু দোল খেয়ে সামলে নেয়। ঘাটে নাও বাঁধা থাকলে, ঢেউ কিছু করতে পারে না।
জীবাত্মাকে কেন্দ্র করে জীবন ঘুরছে। এক্ষেত্রে জীবাত্মা আমাদের চেতন কেন্দ্র। আবার পরমাত্মাকে কেন্দ্র করে আমাদের জীবাত্মা ঘুরছে। এযেন পৃথিবীকে কেন্দ্র করে চাঁদ ঘুরছে। আবার সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘুরছে। প্রত্যেকটি জীবাত্মা একটা বিন্দু, আর পরম-আত্মা যেন অনন্ত বিন্দুর সমষ্টি। জীবাত্মা যদি জ্যোতির্বিন্দু হয়, পরম-আত্মা জ্যোতিঃ-সমুদ্র যেখানে সমস্ত জ্যোতির্বিন্দু একত্রিত হয়েছে। সাধকের কাছে, আজ এই কথাটি কল্পনা মনে হতে পারে, কিন্তু সাধনার পরিণামে এই সত্যই অনুভূত হয়।
আজ মহালয়া। মহ্ কথাটার অর্থ পূজা করা। এর সঙ্গে আ যোগ করলে মহা অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ। মহালয় অর্থাৎ শেষ্ঠ লয়ের পূজা । অর্থাৎ এই দিন নিজেকে পরমাত্মায় লিন হয়ে যাবার পূজার দিন। আমরা সাধারণত জানি মহালয়া মানে পিতৃ-তর্পনের শেষ দিন। এর পর দিন থেকে মাতৃ পক্ষ শুরু হবে। পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে এই দিন তর্পন-আদি করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ পূর্ব্ব পুরুষের স্মরণ দিবস ও তাদের উদ্দেশ্যে জল দান করা হয়ে থাকে। শোনা যায়, এই দিন নাকি, সাপ তার খোলস পাল্টায়। আমাদের কামবীজ, আমাদের জীবাকাঙ্খা ও অবিদ্যা লোপ পাবার দিন, এই মহালয়া ।
আর একটা কথা শোনা যায়, মহৎ আলয়। অর্থাৎ যেখানে বহু তীর্থের অবস্থান। যমলোকং পরিত্যাজ্য আগতা যে মহালয়ে - পিতৃলোকদিগের উৎসবের আলয়। একে বলা হয়, প্রেতপক্ষ। এইসময়, পিতৃলোকের সবাই শ্রাদ্ধ ভোজনের জন্য আনন্দ সহকারে এসে থাকেন। অশ্বিনের শুক্ল পক্ষের আগে যে কৃষ্ণপক্ষ, অর্থাৎ আশ্বিনী অমাবস্যা তিথিতে এই আগমন শেষ হয়। এই সময় হিন্দুদের মধ্যে তর্পন ইত্যাদি করবার বিধি আছে।
মহালয়ের পরে শুরু হয়, মাতৃপক্ষ। অর্থাৎ জগৎ সৃষ্টির শুভক্ষণ। মায়ের খেলা শুরু হয় এই সময় থেকে। এখন থেকে বাসন্তী পুজো পর্যন্ত এই পর্ব চলতে থাকে। এর পরে আবার সৃষ্টির নতুন পর্ব বীজ রোপনের সময়। অর্থাৎ কামবীজ, সংকল্পের বীজ, অজ্ঞানের বীজ, অবিদ্যার বীজ রোপন ক্রিয়া শুরু হয়ে যায়।
মল-মাস - আমাদের আলোচ্য বিষয় মল মাস। আমরা সাধারণত দেখে থাকি, মহালয়ের পরের ষষ্ঠীর দিন থেকে মায়ের আরাধনা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু এবার অর্থাৎ ২০২০ সালে এই মাতৃপূজার দিন পিছিয়ে গেছে, এক মাস। এর কারন হচ্ছে, কার্তিক মাস নাকি মলমাস। এই মলমাসে কোনো শুভ কার্য করতে নেই, বলে হিন্দুদের বিশ্বাস। এই মলমাস ব্যাপারটা কি ?
আমরা জানি মাস দুই রকম। এক চন্দ্রমাস ও দুই সূর্য্যমাস বা সৌরমাস । বৈদিক ঋষিগণ মনে করতেন, নক্ষত্র ২৭ টি। অভিজিৎ নক্ষত্র ধরলে ২৮ টি।
বিশাখা, অনুরাধা, জৈষ্ঠা, মুলা, পূর্বাষাঢ়া, উত্তরাষাঢ়া,
শ্রবণ, ঘনিষ্ঠ, শতভিষা, পূর্বভাদ্র, উত্তরভাদ্র, রেবতী,
অশ্বিনী, ভরনী, কৃর্তিকা, রোহিনী, মৃগশিরা, আদ্রায়, পূর্নবসু,
পুষ্যা, অশ্লেষা, মঘা, পূর্বফাল্গুনী, উত্তর-ফাল্গুনী, হস্তা, চিত্রা ও স্বাতী।
এবং অভিজিৎ। এদের নাম অনুসারেই বিভিন্ন মাসের নামকরণ করা হয়েছে।
.
তো এই ২৭-২৮টি নক্ষত্রকে পরিক্রমা করতে হয়, চন্দ্রকে এমনকি সূর্যকেও । চন্দ্রের পরিক্রমার সময় লাগে ২৭-২৮ দিন। আর সূর্য্যের পরিক্রমা করতে লাগে ৩০ দিন। আমরা জানি বারোটি সৌর মাস নিয়ে এক বছর । অর্থাৎ ৩৬০ দিনে এক বছর। এই সৌর মাস সবসময় স্থির। চন্দ্রমাস ২৮ দিনে, আর সৌর মাস ৩০ দিনে। অতয়েব চন্দ্র মাস অনুসারে বছর পূর্ন হবার কথা ৩৩৬ দিনে। আর সৌরমাস অনুসারে ৩৬০ দিনে বছর পূর্ন হবার কথা। এটি স্থুল গণনা। বৈদিক ঋষিগণ এই চন্দ্র মাস ও সৌর মাসের পার্থক্য ঘোচাতে একটা নতুন মাসের সৃষ্টি করে থাকেন, যাক বলা হয় মল মাস বা চোর মাস।
আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান, দেখলেন, সৌরবছর ৩৬৫ দিনে আর চন্দ্রবছর ৩৫৪ দিনে। অর্থাৎ এই দুই সৌরবৎসর, ও চন্দ্রবৎসর এর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, ১০ দিন ২১ ঘন্টা ৩৫ মিনিট অর্থাৎ প্রায় ১১ দিন। এই স্থূল হিসেবের পার্থক্য সময়গুলোকে যোগ করে, ৩০ দিন হলে একটি মাস হয়। একেই মল মাস বলা হয়ে থাকে। দেখা গেছে, ১৯ বছরের মধ্যে মল মাস হয়, ৭ টি। অর্থাৎ গ্রহের গতিসঞ্চার অনুসারে, ২৮, ৩১,৩২, ৩৩, ৩৫ মাসের ব্যবধানে একটা করে মল মাসের দেখা মেলে। সাধারণ ভাবে তিন বছরে একটা মল মাস হয়ে থাকে। যে সৌর মাসে দুটো অমাবস্যা, বা তিনটি প্রতিপদ আসে, সেই মাসকেই মল মাস বলা হয়ে থাকে। এই মল মাসের নিজস্ব কোনো নাম নেই। যে মাসে এই দুটো অমাবস্যা বা তিনটি প্রতিপাদ দেখা যায়, সেই মাসকেই মল মাস বলা হয়ে থাকে। অশ্বিন মাসে ১, ১৫, ও ৩০ তারিখে প্রতিপাদ পড়েছে। এইজন্য এবছর অর্থাৎ ১৪২৭ বঙ্গাব্দে অশ্বিন মাসকে বলা হচ্ছে মল মাস।
এই মলমাসে, হিন্দুদের মধ্যে কেউ কেউ কোনো শুভ কর্ম্ম করেন না। আবার বৈষ্ণবগন এই মলমাসকেই পুরুষত্তম মাস বলে থাকেন , এই মাসেই নাকি যেকোনো কর্ম্ম লক্ষগুণ বেশি শুভ ফল প্রদান করে থাকে। আসলে যার যেমন বিশ্বাস, তিনি সেই মতো, কার্য্য করে থাকেন। ২০২০ সালের মায়ের পুজো তাই একমাস পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের যেমন ইচ্ছে।
পক্ষ কথার অর্থ হচ্ছে মাসার্ধ। চন্দ্রমাসের অর্ধেক। পক্ষ দুটি - শুক্ল পক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষ। প্রতিপদ থেকে পূর্ণিমা আবার প্রতিপদ থেকে অমাবস্যা। তো এবার দেবীপক্ষ শুরু হচ্ছে ১৭-ই অক্টবর, শুক্ল প্রতিপদ। কিন্তু আমরা বুঝি একটা নিজেকে শুদ্ধিকরণের সময় আর একটা আত্ম-উপল্বদ্ধির সময়।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
এ এক অদ্ভুত বিস্ময়। পাগল ঠাকুরের কুণ্ডলিনী শক্তি নাকি জেগে উঠে সরসর করে পা থেকে মাথায় গিয়ে ওঠে। তো ছেলে-ছোকরারা ধরে বসলো, তখন তোমার কি হয় ? কুণ্ডলিনী শক্তি মাথায় উঠলে নাকি, কি সব দর্শন হয়। তো তখন তোমার কি হয়, কেমন লাগে এসব আমাদের বলতে হবে। তো পাগলা ঠাকুর বললো, দেখ যতক্ষন সেটা মাথায় গিয়ে না ওঠে ততক্ষন আমার হুশ থাকে। কিন্তু যেই মাথায় গিয়ে উঠলো, তখন সব ভুলে গেলুম। তখন না আছে দেখা, না আছে শোনা, না আছে কথা বলা।
মাঝে মধ্যে ভাবি তোদের সব বলবো, ওটা উঠতে উঠতে কত কি দর্শন-দর্শন হয়, সব তোদের খুলে বলবো। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যখন সেটা হৃদয় থেকে কন্ঠে গেলো, তখন কে যেন মুখ চেপে ধরে। কি দেখছি, এটা বলবো ভাবলেই, মনটা হুশ করে উপরে উঠে যায়, আর বলা যায় না।
তো একদিন পাগলা ঠাকুর বললো, আজ তোদের কাছে, সব কথাই বলবো, একটুও লুকোবো না। এই বলে মূলাধার থেকে বিভিন্ন চক্রের কথা বেশ বললেন। অনাহত, বিশুদ্ধি পর্যন্ত সব বললেন, তারপর ভ্রূ মধ্যে আঙ্গুল দিয়ে বললেন, এইখানে মন উঠলেই পরমাত্মার দর্শন হয়, জীবের সমাধি হয়। তখন পরমাত্মা ও জীবাত্মার মধ্যে একটা পাতলা পর্দার আড়াল থাকে মাত্র। সে তখন এই রকম দেখে, বলেই সমাধিতে চলে গেলেন। সমাধি ভঙ্গ হলে, আবার বলতে গেলেন, কিন্তু আবার সমাধিতে চলে গেলেন।আবার সমাধি ভাঙলে আবার বলতে গেলেন, আবার সমাধিতে চলে গেলেন। শেষে করুন স্বরে বললেন, ওরে আমি তো মনে করি, তোদের সব কথা বলি, কিন্তু মা কিছুতেই বলতে দেয় না, মুখ চেপে ধরে। মা বেশি ভারী দুস্টু। ভগবৎ দর্শনের কথা বলবো, তাতে মুখ চেপে ধরা কেন বাপু ? তখন কি জানি, যে মন-বুদ্ধির সাহায্যে কথা বলা যায়, তার দৌড় বেশিদূর নয়। মন-বুদ্ধি যতদূর যেতে পারে, তার বাইরে না গেলে পরমাত্মার দর্শন হয় না। - এই পাগল ঠাকুর আর কেউ নয়, ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ।
আমাদের সবার মধ্যে শ্রেয় থেকে প্রেয়র প্রীতি আকর্ষণ বেশী। আমরা ছোটবেলায় দেখেছি, আমাদের যে বন্ধুটি চুরিতে ওস্তাদ, সে আমাকে আকর্ষণ করে। শান্ত বন্ধু থেকে দুঃসাহসিক বন্ধু আমাদের প্রিয়। শরৎচন্দ্রের কাছে ইন্দ্র প্রিয় ছিল, কারন সে ভালো ছেলে বলে নয়, তার দুঃসাহসীকতা শরৎচন্দ্রকে অবাক করে দিতো।
দেবর্ষি নারদ :
দেবর্ষি নারদ, এক বিচিত্র চরিত্র।একদিকে দেবতা আবার অন্যদিকে ঋষি। একদিকে মুখে সর্বক্ষণ হরিনাম, অন্যদিকে ঝগড়া-বিবাদ বাঁধানো যার স্বভাবে মিশে আছে। নারদ কথাটার অভিধানগত অর্থ হচ্ছে যিনি ব্রহ্মজ্ঞান দান করেন। নার অর্থাৎ নরসমূহকে, দ অর্থাৎ দান করেন। যিনি ব্রহ্মার মানসপুত্র বলে আমরা জানি । আবার কথায় বলে নারদের ঢেঁকী। অর্থাৎ কলহ প্রবর্তক দেবতা যার বাহন হচ্ছে ঢেঁকী। হিন্দু শাস্ত্রের একমাত্র দেবতা যার অবাধগতি। তা সে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর অর্থাৎ বিষ্ণুলোক, ব্রহ্মলোক, শিবলোক সর্বত্র বাধাহীন ভাবে বিচরণ করতে পারেন।
এই দেবর্ষি নারদ একদিকে যেমন প্রচন্ড জ্ঞানী - অর্থাৎ বেদ খুললে নারদ সুক্ত পাবেন। দেবর্ষি নারদ ছিলেন, মন্ত্রদ্রষ্টা। ইন্দ্রের বহু স্তব ঋকবেদে ঋকমন্ত্র নারদের দ্বারা দৃষ্ট হয়েছে। আবার মহাভারত খুললে, নারদের উপদেশ পাবেন। নারদ জ্ঞানের শীর্ষে, আবার ভক্তিমার্গের শীষে অবস্থান করছেন। এই নারদ নামের ঋষি এক না একাধিক তা বলা মুশকিল।
পূর্বজীবন : এই নারদের জন্ম বৃত্তান্ত বিভিন্ন শাস্ত্র বিভিন্ন ভাবে বর্ননা করেছে। বলা হচ্ছে, নারদ পূর্ব জন্মে ছিলেন উপবর্হন নামে এক গন্ধর্ব। আর বিশ্বস্রষ্টাগনের অভিশাপে শূদ্রযোনিতে জন্ম গ্রহণ করেন। কাহিনীটা এই রকম - কোনো একসময় দেবতারা একটা যজ্ঞের আয়োজন করেছিল। তো সেখানে হরিনাম করবার জন্য, হরিগাথা পরিবেশন করবার জন্য, বহু গন্ধর্ব - অপ্সরাদের আহ্বান করা হয়। তো উপবর্হন ভালো হরিনাম-সংকীর্তন করতে পারতেন। তো তাকেও আহ্বান করা হয়। উপর্বহন বহু সুন্দরী-স্ত্রী নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন। তার এই মহিলাপ্রীতি দেখে, প্রজাপতি তাকে অভিশাপ দেন। "তুমি শুদ্র যোনিতে জন্ম গ্রহণ করবে।"
এর পরে তিনি এক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের দাসীর গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন। আর সেই বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের কাছ থেকে তিনি মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই ব্রহ্মবিদ্যা লাভ করেন। নারদের মা ছিলেন, ওই বেদবিদ ব্রাহ্মণের ঘরের দাসী। আসলে সেইকালে ব্রাহ্মণগন দাসীর গর্ভেও সন্তানের জন্ম দিতেন, কিন্তু তাদের পিতার বংশ-মর্যাদা দিতে চাইতেন না। তো যাইহোক, এর মধ্যে নারদের মা সর্পাঘাতে মারা যান। এরপর নারদ একা হয়ে পড়েন, এবং সাংসারিক শোক-তাপ থেকে বাঁচবার জন্য, তীর্থ ভ্রমনে বেরিয়ে পড়েন। বহু তীর্থ ভ্রমন করেন, এবং সেখানে জপ-তপ করে, সিদ্ধি লাভ করে ঋষিত্ব প্রাপ্ত হন।
আবার বলা হয়ে থাকে, ব্রহ্মার দশ পুত্রের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, নারদ। বলা হয়ে থাকে ব্রহ্মার কোল থেকে নারদের জন্ম।
আবার বলা হয়ে থাকে, দক্ষ, বীরন প্রজাপতির কন্যা অসিক্লীর গর্ভে ৫০০০ পুত্রের জন্ম দেন । এদের সবাই নারদের পরামর্শে সন্যাস গ্রহণ করেন। দক্ষ আবার অসিক্লীর গর্ভে ১০০০ পুত্রের জন্ম দেন। এরাও সবাই নারদের পরামর্শে সন্যাস আশ্রম গ্রহণ করেন। দক্ষ এবার নারদের উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। তখন দক্ষ নারদকে যিনি ব্রহ্মার কোল থেকে জন্ম নিয়েছিলেন, তাকে অভিশাপ দেন, যে মায়ের গর্ভ যন্ত্রনা যে কি, সেটা কি দেবর্ষির অজ্ঞাত ? রাগের চোটে, তিনি নারদকে অভিশাপ দিলেন, তুমি বিনষ্ট হও আর গর্ভবাস যন্ত্রনা ভোগ করো। এরপর দক্ষ ঋষি কশ্যপকে একটা কন্যা দান করেন, আর সেই কন্যার গর্ভে নারদ জন্ম গ্রহণ করেন।
আর একজন নারদের কথা আমরা শুনতে পাই। তিনি হচ্ছেন নরদ -এর পুত্র নারদ। এই কাহিনীও রসাত্মক। বলা হচ্ছে, কান্যকুব্জে দ্রুমিল নামে এক রাজা ছিলেন। তার সন্তান ছিল না, আবার সন্তান উৎপাদনের কোনো ক্ষমতা ছিল না। তো তার স্ত্রী কলাবতী স্বামীর কাছে সন্তান প্রার্থনা করলেন। কিন্তু স্বামী তো অক্ষম। তখনকার কালে, একটা প্রচলিত প্রথা ছিল ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপাদন, অর্থাৎ স্বামী যদি স্ত্রীকে সন্তান দানে অক্ষম হন তবে ক্ষেত্রজ পুত্র অর্থাৎ অন্য পছন্দমত পুরুষের সংস্পর্শে এসে সন্তান লাভ করতে পারতেন। যেমন ব্যাসদেব জন্ম দিয়েছিলেন, ধৃতরাষ্ট্র-পান্ডুকে, কুন্তী পেয়েছিলো সূর্যপুত্র, পবনপুত্র ও ধর্ম্মপুত্রকে। তো কলাবতী তখন উপস্থিত হলেন, কশ্যপ-বংশীয় ঋষি নরদের কাছে, এই নরদের পুত্র হচ্ছেন নারদ। - তথ্যসূত্রঃ : ভাগবত ও ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ।
আমরা বছর দুই আগে আমরা বলেছিলাম - বর্তমানে শুক্র গ্রহে আমাদের থেকে আরো উন্নত ধরনের জীবের অস্তিত্ব আছে। এই তথ্যের সূত্র ছিল প্রায় ১০০ বছর আগের লেখা একটা বই - জীবন মরণ - লেখক পরাবিদ্যাবিদ শ্রী ক্ষিতিনাথ ঘোষ। আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিজ্ঞান সেই সত্যকে আবিষ্কারের জন্য একটা সূত্র পেয়েছে। আমাদের সেই video এই লিংকে পাওয়া যাবে।
https://www.youtube.com/watch?v=CBgPZ5tPVi0 -
ভোর রাতে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের অভ্যাস। সন্ধ্যা রাতে বড়শি পেতে রাখে, বা জাল বিছিয়ে রাখে। সকাল হতে না হতেই জাল তুলে নিয়ে আসতে হয়। তো এক জেলে ভোর রাতে বাড়িতে থেকে বেরিয়ে পড়লো, মাছ ধরবে বলে। নদীর পারে, অন্ধকারে কি যেন পায়ে ঠেকলো। হাত দিয়ে বুঝলো, পাথরের টুকরো। তো নদীর পারে বসে, অন্যমনস্ক ভাবে পাথরগুলো এক-এক করে নদীতে ফেলতে লাগলো, আর সূর্য্যোদয়ের অপেক্ষায় থাকলো। সূর্য্যের আলো ফুটতেই সে অবাক হয়ে দেখলো, তার হাতে একটা হীরের টুকরো। তাহলে কি এতক্ষন সে এই হীরের টুকরো গুলোকে সে নদীর জলে ফেলেছে ? সে তখন চিৎকার করে হায়-হায় করতে লাগলো। আর হীরের শেষ টুকরোকে সে আঁকড়ে ধরলো।
আমাদের জীবনের প্রত্যেকটি দিন এই হীরের টুকরো। সারাজীবন অবহেলায়, সেগুলো এক-এক করে অকারনে বিসর্জন দিয়েছি। আর যখন শেষের দিনটি আসে, তখন হাহাকার করতে থাকি। জীবনের যথার্থ অর্থ না জেনে, আমরা আমাদের মূল্যবান দিনগুলোকে অনাবশ্যক ভেবে অকারনে বিষয়সুখে নিবদ্ধ থেকে শেষ করে দিয়েছি। জীবন রহস্যে ভরা। জীবন মানুষকে আনন্দের অন্তিম শিখরে নিয়ে যেতে পারে। ঈশ্বরপ্রাপ্তির অমোঘ সুযোগ এই স্থুল শরীরের মধ্যেই নিহিত। সময় থাকতে আমরা তার মূল্য বুঝি না। তাই জীবন আমাদের অকারনে শেষ হয়ে যায়। আর আমরা সূর্য্য উদয়ের অপেক্ষায় থাকি। তাই বার-বার যন্ত্রনা দায়ক জীবনচক্রের মধ্যে আবদ্ধ রাখি নিজেকে।
এ এক অদ্ভুত চিকিৎসা ব্যবস্থা। বাচ্চাটা ভালো করে হাটতে পারে না। কিছুদূর গিয়েই মাটিতে আছাড় খায়। ব্যথা পায়। কান্না জুড়ে দেয়। মা, অমনি মাটিতে হাত দিয়ে থাপ্পড় মারে। মুখে বলে, আমার ছেলেকে ব্যথা দেওয়া ! এমন মার্ মারবো না! ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে, ছেলেকে কোলে নিয়ে বলে, খুব মেরে দিয়েছি বাবা। আরো কেঁদো না। ছেলেটি মাটির দিকে তাকায়, আর কান্না থেমে যায়।
কেউ যদি আপনাকে ব্যথা দেয়, আপনাকে কেউ অপমান করে, অথচ তাকে আপনি কিছু বলতে পারেন না, কারন আপনি তাকে ভয় পান । পাছে আরো বেশি কষ্ট দেয়। তা সে অফিসের বস হোক, পাড়ার কোনো মাস্তান হোক বা স্কুলের মাস্টার হোক। যাকে আপনি এড়িয়ে চলতে চান, কিন্তু পরিস্থিতি আপনাকে সে সুযোগ দেয় না। আপনি গোপনে একটা কাজ করতে পারেন, যদি সম্ভব হয়, তার একটা ছবি জোগাড় করুন। যদি ছবি জোগাড় করতে না পারেন, তবে যা-ইচ্ছে-তাই করে তার একটা ছবি নিজেই আঁকুন। দেওয়ালে টাঙিয়ে প্রতিদিন মন খুলে গালাগালি করুন। বেত দিয়ে বেধড়ক প্যাদান। দেখবেন, আপনার মনের দুঃখ চলে যাবে। আপনি শান্তি পাবেন। আপনি বলবেন এতো পাগলামি। হ্যাঁ এই পাগলামিটা করে দেখুন, এই পাগলামি আমরা মূর্তি পূজায় করে থাকি। প্রতিমার কাছে আমরা আমাদের সব দুঃখ কষ্টের কথা বলে হালকা হতে পারি, আমরা মনে শান্তি আনতে পারি।
স্ত্রী চায়, স্বামী তাকেই ভালোবাসুক। স্বামী চায় স্ত্রী তাকেই শুধু ভালোবাসুক। সন্তান চায় পিতা-মাতা তাকেই ভালোবাসুক। পিতা-মাতা চায় সন্তান মা-বাবাকেই ভালোবাসুক। এই যে প্রেম-ভালোবাসা, এটি শুধু মিথ্যা নয়, এটি স্বার্থপরতা। আমি তোমাকে ভালোবাসি তাই তুমি আমাকে ভালোবাসবে। এতো দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক। এটি ভালোবাসা নয়। আমি তোমাকে খাওয়াচ্ছি-পড়াচ্ছি, তাই তুমি আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য। এটি নিষ্ঠুরতা। প্রেমের কোনো কারন হতে পারে না। প্রেম অকারনে হয়। ঈশ্বরের যেমন কোনো কারন নেই, প্রেমের কোনো কারন হতে পারে না। যে মা-বাবা সন্তানকে বলে, আমি তোমার মা বা বাবা তাই তুমি আমাকে ভালোবাসো - এই শিক্ষা ভুল। এটা একটা সম্পর্ক মাত্র, যা আমরা জন্মসূত্রে পেয়েছি, বা সামাজিক কারনে পেয়েছি। সম্পর্ক আমাদের কাছে থাকতে সাহায্য করতে পারে, বেঁচে থাকতে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু সম্পর্ক কখনো প্রেম করতে সাহায্য করতে পারে না। তোমাকে পেয়ে যার আনন্দ হবে, তুমি যাকে পেয়ে আনন্দিত হবে- সেই তোমার প্রেমিক-প্রেমিকা, তা সে মানুষ হতে পারে, পশু হতে পারে, বাড়ি-গাড়ি হতে পারে, পাহাড়-নদী হতে পারে। তোমার ব্যক্তিত্ত্ব যেখানে পূর্নতা পাবে, সেটাই প্রেম-ভালোবাসা।
আমরা আমাদের বংশের বড়াই করি। আবার জন্মের কারনে নিজে হীনমন্যতায় ভুগি। বুদ্ধদেব নিজেকে ঈশ্বরের অবতার বলতেন না, আবার নিজেকে রাজার ছেলে বলেও মনে করতেন না। সত্যের সন্ধানে তিনি সংসারের রাজবৈভব ত্যাগ করেছিলেন। তো বোধিজ্ঞান লাভের পরে নিজের অনুভূতির কথা সবাইকে জানিয়ে যেতে চেয়ে ছিলেন। ভিক্ষাপাত্র নিয়ে তিনি দ্বারে দ্বারে যেতেন। এমনকি একসময় রাজদ্বারে উপস্থিত হয়েছিলেন। রাজা শুদ্ধোধন তার পুত্রের ভিক্ষাবৃত্তি দেখে মানসিক যন্ত্রনায় কাতর হয়ে পড়েন। তো মহারাজ শুদ্ধোধন বুদ্ধদেবকে বলেছিলেন, আমাদের মহান রাজপরিবারের বংশ। তুমি এই বংশে জন্ম গ্রহণ করেছো। তোমার বাড়ি-বাড়ি ভিক্ষা করা মানায় না। তুমি এই পথে জীবন-নির্বাহ করো, এটা আমার অভিপ্রেত নয়। তো ভগবান বুদ্ধদেব জবাব দিয়েছিলেন, মহারাজ আপনি নিজেকে রাজবংশের উত্তরাধিকরী বলে মনে করেন, কিন্তু আমার বংশ একেবারেই আলাদা। আমি বুদ্ধ - বুদ্ধগণের বংশে আমার জন্ম। তাই ভিক্ষান্ন ভোজন আমার কর্তব্য, এর অন্যথা হতে পারে না।
আসলে প্রতি-মুহূর্তে আমরা নবজন্ম পাচ্ছি। আমাদের অভিজ্ঞতা, আমাদের জ্ঞান, আমাদের শরীর প্রতিমুহূর্তে পরিবর্তন হচ্ছে। এতে করে আমাদের আত্মিক পরিবর্তন হচ্ছে। এই অনন্ত যাত্রায়, কার ঘরে কবে এসেছিলাম, কতদিন ছিলাম, সেটা বড়ো কথা নয়, এখন কোথায় আছি সেটাই গুরুত্ত্বপূর্ন।
সদগুরুর দর্শন যখন হয়, সদ্গুরুর কৃপা যখন বর্ষিত হয়, তখন জানবেন আপনার নবজন্ম হলো। আপনি দ্বিজ হলেন। আপনার মধ্যে যখন ধ্যান ও প্রেমের সমাহার হলো, তখন জানবেন, আপনার পুনর্জন্ম হলো। ধ্যান ও প্রেম দুইভাই মিলে যখন পরমাত্মার দরজায় এসে দাঁড়ায়, তখন পরমাত্মা নিজে এসে দরজা খুলে দেন। আপনার আজ শরীরের বয়স ৭০ হতে পারে, কিন্তু যদি আপনি সৎগুরুর দর্শন না পেয়ে থাকেন, তবে জানবেন, আপনার এখনো শুদ্ধ জীবন শুরুই হয়নি। আপনার জীবনে যদি প্রেম ও ধ্যানের সমাহার যদি না হয়ে থাকে, তবে জানবেন, আপনার এখনো জন্মই হয় নি। আপনি এখনো জন্মাবার জন্য প্রস্তুতিপর্বে আছেন।
স্বয়ং ঈশ্বর একমাত্র সদগুরু। তিনি আপনার ভিতরেই আছেন। আর এই গুরুদেবের দর্শন পেতে গেলে, তার সান্নিধ্য পেতে গেলে, ধ্যান ও প্রেমের সিঁড়ি বেয়ে নিজেকে উপরে ওঠাতে হয়। আমরা তো নিচের তিনটি সিঁড়িতে ঘোরাফেরা করি। কিন্তু আমরা জানি, সিঁড়ির ধাপ আরো আছে। নিজেকে উপরে ওঠান। বিন্দুতে নিয়ে যান। তখন গুরুদেবের সাক্ষাৎ মিলবে। এগুলো বলে বা লিখে বোঝানো যায় না।
ফেলুরাম ভালো ছেলে। প্রতিদিন স্কুলে যায়। ক্লাসে মাস্টার মহাশয়ের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে। আর মনে মনে ভাবে, মাস্টাররা প্রতিবছর একই কথা বলে, একই বই পড়তে দেয়। এগুলো তো তার সবই জানা। নতুন কথা কিছু নেই। কিন্তু মাস্টারমশায় গন সাব্বাইমিলে ষড়যন্ত্র কোরে ওকে উপরের ক্লাসে উঠতে দেয় না। বেদ-বেদান্ত, গীতা-মহাভারত, উপনিষদ এগুলো সবই হাজার হাজার বছর আগে ঋষিগণ উপলব্ধি করেছিলেন, হাজার হাজার বছর আগে আমাদের জন্য লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। আমাদের চোদ্দপুরুষ এইসব কথাই শুনেছেন। আমরাও হয়তো আগের জীবনে একই কথা শুনেছি, একই বই পড়েছি। তাই এগুলো আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। যুগে যুগে মহাপুরুষগন এসেছেন, সেই একই প্রেমের কথা বলে গেছেন। আমাদের কিন্তু উপরের ক্লাসে ওঠা হলো না। আমরা আজও না পারলাম নিজেকে ভালোবাসতে, না পারলাম মানুষকে ভালোবাসতে, না পারলাম ঈশ্বরকে ভালোবাসতে। আমরা সেই একই ক্লাসের বিষয়মুখী হয়েই রইলাম। বারবার দেহ থেকে দেহান্তরে ভ্রমন করে চলেছি। ঠাকুর বলছেন, তোমাদের চৈতন্য হোক। কবে হবে আমাদের সেই চৈতন্যের উদয় ? তবে কিছু মানুষ কিন্তু সাধারণ-জ্ঞানের স্তর থেকে পরা-বিদ্যা আয়ত্ত্ব করে উন্নত হচ্ছেন, তারাই ধীরে ধীরে মুক্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। উপরের ক্লাশে উঠছেন। আর নীরব সাক্ষী হয়ে যাচ্ছেন। আমরা যারা ফেলুরাম তারা মাস্টারের দোষ দেখছি। কবে নিজের দিকে তাকাবো ?
এক নাট্যকার মজা করে বলছেন, কোনো সমিস্যা নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। সমস্যার দুটো কারন, এক আমাদের চিন্তার দৈন্যতা, আর চিত্তে মোদের লোভের বাসা। এই লোভের বাসাটা ভেঙে দিতে হবে। চিন্তায় স্বচ্ছতা আনতে হবে। মেয়ে সাইকেল চালাতে জানে না। বড্ড সমস্যা । ধ্যাড়ধেড়ে লম্বা গাছে পেঁপে পেকে আছে, পাড়বো কি করে। ভাইয়ে-ভাইয়ে জমি নিয়ে লড়াই। মিটবে কি করে ? ইলেকট্রিক মিটারটা খারাপ হয়ে গেছে, ঠিক হবে কি করে ? ছেলে পড়াশুনা করছে না. কি করবো ? মেয়ের অসুখ কি করবো ? আমরা বলি, ভেবে পাচ্ছি না। সমস্যা সমাধানের জন্য,একমিনিট চুপ করে বসুন, নিজেকে স্থির করুন, সমস্যা সমাধানের সম্ভাব্য রাস্তাগুলো নিয়ে এক মিনিট ভাবুন। আপনি রাস্তা পেয়ে যাবেন ।সমস্যা সমাধানের জন্য, আমাদের নিজেকে বিপন্ন করতে হবে, ঝুঁকি নেওয়া শিখতে হবে, সাহসী হতে হবে। ভাগ্যের অন্বেষনে বেরিয়ে পড়তে হবে। সাইকেল চালাতে গেলে আছাড় খেতে হবে। এইটুকু ঝুঁকি নিতে হবে , বসে গেলে, বা ভয় পেলে চলবে না। পেঁপে পড়তে গেলে বাঁশের কোটা জোগাড় করতে হবে, মিটার ঠিক করবার জন্য, ইলেকট্রিক অফিস-এ খবর দিতে হবে। ভাইয়ে ভাইয়ে জমির লড়াই থামাতে গেলে, লোভকে লাগাম পড়াতে হবে। ছেলেকে নিয়ে নিজেই পড়তে বসুন। মেয়ের অসুখের জন্য ডাক্তার দেখাতে হবে। সমস্যা এলে জানবেন, আপনার একটা অভিজ্ঞতা অর্জনের বা নতুন জ্ঞান অর্জনের সুযোগ এলো। কাজে নেবে পড়ুন, দেখবেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনার সমস্যার গতি-প্রকৃতি পাল্টে গেছে। সমস্যার সমাধানে আপনি একটা অভূতপূর্ব আনন্দ লাভ করবেন। সমস্যাকে এডভেঞ্চার ভাবুন। গাছে ওঠায়, ভয় আছে আবার আনন্দ আছে। সাঁতার শেখায় ভয় আছে আবার আনন্দ আছে। ভয়কে জয় করতে পারলেই আনন্দ পাবেন। সমস্যাই জীবন, আর সমস্যা সমাধানেই বেঁচে থাকার আনন্দ। যার জীবনে সমস্যা নেই, সেতো মৃত।
আমরা সবাই সেই অনন্ত পরমাত্মার অংশ। এইসব কথা আমাদের কাছে নিতান্তই কথার কথা। এই উপলব্ধি আমাদের কারুর নেই। এমনকি আমরা কেউ এই কথা কল্পনা করতেও পারি না। উপলব্ধি করা কঠিন বা সময়সাপেক্ষ হলেও চেষ্টা করলে কল্পনায় এই বিষয়টি আনা যেতে পারে। নিজেকে একটা বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করতে শিখুন। প্রথম দিকে কল্পনাকে প্রসারিত করতে শিখুন। পরে দেখবেন, এটাই আদত হয়ে গেছে। একটা জিনিস জানবেন, কল্পনা ও সংকল্প এই সমগ্র বিশ্ব সৃষ্টি করেছে। আপনার সন্তান, আপনার বাড়ি, আপনার গাড়ি, এগুলো সবই একসময় আপনার কল্পনার বিষয় ছিল। এমনকি আজ যে আপনি উচ্চ শিক্ষিত হয়েছে, সেটাও এক সময় আপনার কল্পনার বিষয় ছিল। আজ কিন্তু বাস্তবে পরিণত হয়েছে। ঠিক তেমনি বিশ্বপিতার সংকল্প এই কাল্পনিক বিশ্ব সৃষ্টি করেছে। যাকে আমরা বাস্তব ভাবছি, বা বাস্তবে দেখছি । আবার, আমরা সেই অনন্ত পরমাত্মার অংশ, এই কথাগুলো, আজ যদি আপনি কল্পনায় আনতে পারেন, তবে আপনি জানবেন, ভবিষ্যতে এই সত্য আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন। তখন এই চিরসত্য আপনার কাছে বাস্তব হয়ে উঠবে।
আমরা সবাই পেটের দায়ে কাজ করি । আমরা সবাই অর্থ উপার্জনের জন্য লেখাপড়া শিখি। আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম করে থাকি। ভবিষ্যতের সুখের কল্পনায় বর্তমানে কঠিন পরিশ্রম করে থাকি। অর্থাৎ কাজ কাজ আর কাজ। কর্ম্মহীন জীবন হয় না। কিন্তু বোকার মতো শুধু কাজ করলেই, জীবনে উন্নতি করা যায় না। তাই মহাত্মাগণ বলে থাকেন, বুদ্ধি সহযোগে কাজ করো। কিন্তু কাজ মানেই পরিশ্রম। আর পরিশ্রম মানেই ক্লান্তি। আর অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম মানে, অতিরিক্ত শরীর ক্ষয়। আবার কাজের পরে যখন আশা অনুরূপ ফল না পাই তখন আমাদের মধ্যে আসে বিষন্নতা। তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, কর্ম্মকে যোগে পরিণত করো। এই কর্ম্মযোগ ব্যাপারটা কি ? কেউ বলছেন, নিষ্কাম কর্ম্মকে কর্ম্মযোগ বলা হয়ে থাকে। আসলে নিষ্কাম কর্ম্ম বলে কিছু হয় না। তাই কেউ কেউ বলে থাকেন, নিজের জন্য নয়, অপরের জন্য কিছু করাকে বলা হয়ে থাকে নিস্কাম কর্ম্ম। আসলে আমাদের কর্ম্মের সঙ্গে যখন প্রজ্ঞার মিশ্রণ হয়, তখন তাকে বলে কর্ম্মযোগ। প্রজ্ঞা কাকে বলে ? অন্যদের কাছ থেকে, বই পড়ে আমরা আমরা যা কিছু শিখি তাকে বলা হয়, জ্ঞান। অর্থাৎ বাইরের থেকে যা কিছু শিখি, তাকে বলা হয় জ্ঞান। আর নিজের ভিতর থেকে যখন কিছু শিখি বা উপলব্ধি করি, তাকে বলা হয় প্রজ্ঞা। এই প্রজ্ঞা আমাদের সৃজনশীল মনের বিষয়, আমাদের নিজেদের বিষয়। জিজ্ঞাসু মন যখন, নিজের মধ্যে প্রশ্নের উত্তর খোঁজে তখন তিনি প্রজ্ঞার সন্ধান করছেন। আর এই প্রজ্ঞার সাহায্যে যখন আমরা কোনো কর্ম্মে লিপ্ত হই, তখন আমাদের কাজে একাগ্রতা বাড়ে, কাজের উৎকর্ষতা বাড়ে, কাজে আনন্দ আসে। তখন, কাজে পরিশ্রম হয় না, অনীহা আসে না। একেই বলে কর্ম্মযোগ। আর এই কর্ম্মযোগ আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যকে সফল করে থাকে।
আমাদের অনেকের ধারণা হচ্ছে জীবন মানেই শুভ আর মৃত্যু মানে অশুভ। সুস্থ শরীর মানে আমরা ভালো আছি, অসুস্থ শরীর মানে আমরা ভালো নেই। দুঃখ আমাদের কাছে অবাঞ্ছিত, সুখ আমাদের কাঙ্খিত। সকালের জন্য আমরা অপেক্ষা করি, সন্ধ্যা আমাদের জন্য অপেক্ষা করে না। প্রকৃতির নিয়মে সকাল-সন্ধ্যা আসে। কারুর জন্যই সকাল বা সন্ধ্যা তার সময়ের থেকে সরে দাঁড়ায় না, অপেক্ষাও করে না। সময় হলেই আকাশে নক্ষত্রের উদয় হয়। ভোরের আলো, মানে নক্ষত্রের বিদায়ের সময়। আমাদের কাজ হচ্ছে অপেক্ষা করা। সকাল হোক বা সন্ধ্যা, ঈশ্বরের শরণে থাকা। দুঃখের দিন আমাদের অগ্রগতির সময়। আমাদের ঋণ পরিশোধ করবার সময়। দুঃখ মানেই সুখের সূচনা করে। অন্ধকার মানেই আলোর রচনা করবার সময়। জানবেন, ঈশ্বর আমাদের সবার ভালোর জন্য, সময়মতো সব কিছু করে থাকেন, দিয়ে থাকেন । সকাল যেমন তাঁরই কীর্তনের সময়, সন্ধ্যাও তাঁরই কীর্তনের সময়। এখন আমরা যা চাই, তা কেন হয় না ? শিশু যখন যা কিছু আবদার করে, বড়রা তাকে কি ঠিক তাই-তাই দেয় ? দেয় না, কিন্তু শিশুর যা কিছু দরকার, তা তাকে অবশ্য়ই বড়োদের সাধ্য অনুযায়ী দেয়। বড়দের মধ্যে সাধ্যের সীমাবদ্ধতা আছে, তাই সব শিশু সময়মতো সবকিছু পায় না। কিন্তু ঈশ্বরের রাজত্ত্বে সীমাহীন সম্পদ। কারুর কিছুর অভাব তিনি রাখেন না। আমার অভাববোধ আমাকে অভাবী করেছে। আমরা প্রকৃতির নিয়মের অবাধ্য হই, তাই আমরা পৃকৃতির দেওয়া শরীরে অসুস্থতা বোধ করি। মন আমাদের নাগালের বাইরে তাই আমরা মানসিক ভারসাম্য হারাই। আমরা আমাদের ইচ্ছেমতো কাজ করি, আর ফল হয় ভগবানের ইচ্ছেমতো। আমরা যদি ভগবানের ইচ্ছেমতো কাজ করতে পারি, তবে ফল হবে, আমাদের ইচ্ছেমতো।
মানুষ মানুষকে মনে রাখে কেন ?
পাখী ধরা পড়েছে। খাঁচায় বন্দী। জীবাত্মা এই দেহ-খাঁচায় বন্দী। বেরুবো কি করে। ঋষি পতঞ্জলি একটা সুন্দর রাস্তা বাতলেছেন। চিত্তে বা মনে যদি মুক্তির আশা জাগে, তবে বেরুবার দরজা খুঁজতে হবে, সময় বুঝতে হবে । পশ্চিমে দুটো দরজা, পূর্বে দুটো দরজা। পশ্চিমের দুটো দরজা বন্ধ থাকে, তাই সেখান থেকে বেরুবার উপায় নেই। আর আমরা এই পশ্চিমের দরজাতেই তাকিয়ে আছি, কখন খুলবে। একটার নাম ক্ষিপ্ত আর একটার নাম মুঢ়। মাঝে একটা জানলা যাকে বলে, বি-ক্ষিপ্ত। তেমনি পুবের দিকে দুটো দরজা একটা একাগ্র আর একটা নিরুদ্ধ। ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, যোগ সাধনা এই দুই দিকেই সম্ভব। কিন্তু বিক্ষিপ্ত জানলায় সম্ভব নয়। কেননা ওই জানলা দিয়েই পাহারাদার নজর রাখছে।
আমাদের চঞ্চল চিত্ত এক দরজা থেকে আর একদরজার দিকে ছুটে বেড়াচ্ছে। দিনের বেলায় আমরা রজগুনের বশবর্তী হয়ে নানান বিষয়কর্ম্মে লিপ্ত থাকছি। রাতে আমরা তমঃগুণের দ্বারা আছন্ন হয়ে গভীর নিদ্রায় মগ্ন থাকছি। এই দুইয়ের মাঝখানে একটা সময় আসে যাকে বলা হয় সন্ধিক্ষণ। এইসময় চিত্তে পরিবর্তন আসে, হয় সে কোনো বিষয়ে একাগ্র থাকে, নতুবা নিরুদ্ধ থাকে। এই সন্ধিক্ষনে দরজার পাহারাদার পরিবর্তন হয়। এই সন্ধিক্ষণ দিনে রাতে চারবার আসে। ভোরবেলা যখন সূর্যদেব উঠি-উঠি করছে, যাকে বলে ব্রাহ্ম মুহূর্ত। এইসময় আমাদের মন তমসা ছেড়ে আলোতে পদার্পন করে থাকে।দুপুরবেলা, যখন সূর্যদেব মধ্যে গগনে থাকে, সন্ধ্যা বা গধূলি বেলা, যখন সূর্যদেব অস্ত যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, আর মধ্যরাত্রি। অর্থাৎ মোটামুটি ছঘন্টা অন্তর পাহারাদারের পরিবর্তনের সময়। এই সময় ক্ষাণিক্ষনের জন্য, দরজা পাহারাবিহীন থাকে। চিত্তকে যদি মুক্তি দিতে হয়, তবে এই সময়টাকে কাজে লাগাতে হবে।
আমরা যখন ভালো থাকি, তখন আমাদের মন ভালো থাকে। আবার উল্টোটা বলা যেতে পারে, আমাদের মন যখন ভালো থাকে তখন আমরা ভালো থাকি। আমরা যখন সৃজনশীল কাজে বা বিনোদনমুলক কাজে মগ্ন থাকি তখন আমরা ভালো থাকি। তখন আমাদের কাছে জগৎসংসার তুচ্ছ হয়ে যায়। সংসারের অস্তিত্ত্ব যেন লোপ পেয়ে যায়। সেই কারিগর আনন্দে আছে, যে একমনে ঠাকুরের মূর্তি গড়ছে, সেই গায়ক আনন্দে আছে, যে গানের মধ্যে বিভোর হয়ে গেছে। সেই গবেষক আনন্দে আছে, যিনি এক মনে গবেষণায় ডুব দিয়েছেন। সাঁতারু সাঁতারের মধ্যে আনন্দ পান। তাই আপনি যদি নিজেকে ভালো রাখতে চান, তবে নিজের ভিতরের চাহিদা অনুযায়ী কাজে লিপ্ত হয়ে যান। মনের বিরুদ্ধে যা কিছু করবেন, তা হবে দুঃখের কারন, তা কখনোই আপনাকে আনন্দ দিতে পারবে না । বাহ্যিক মোহের বশে আচ্ছন্ন না হয়ে, নিজের ভিতরের আনন্দকে উপলব্ধি করুন।
যার মন লুপ্ত হয়ে গেছে, তিনি দেবতা, যার মন সুপ্ত হয়ে আছে সে পশু, আর যার মন সতত ক্রিয়াশীল সেই মানুষ। যার হুঁশ আছে, যে জেগে আছে, যার মন সজীব সেই মানুষ। সব কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে গেলে লাগে মন, সব কিছুর থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে লাগে মন। জড়ানোর নাম ভোগ, ছাড়ানোর নাম মুক্তি। পুরুষ যা চায়, প্রকৃতি তাই দেয়। পুরুষের মনের মতো প্রকৃতি সাজে। এটাই জগৎ সৃষ্টির মূলকথা। পুরুষের প্রয়োজন সিদ্ধ করবার জন্য, অর্থাৎ পুরুষার্থের বিকাশের জন্য প্রকৃতি সাহায্য করে থাকে। অনুভূতি, আস্বাদন, উপলব্ধি পুরুষের ধর্ম্ম। পুরুষের এই ইচ্ছেগুলোকে পূরণ করবার জন্য, প্রকৃতি পসরা সাজিয়ে রাখে। প্রকৃতি ভোগ্য, পুরুষ ভোক্তা। ভোগের মধ্যে যখন চৈতন্যের প্রবেশ ঘটে, তখন ভোক্তা ও ভোগ্য এক হয়ে যায়। একেই বলে সমাধি।
এক সাধিকা গিয়েছেন, এক সাধকের সাথে দেখা করতে। তো গেটে সাধিকাকে দ্বাররক্ষী আটকালো। বললো, এই আশ্রমে মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ। তো সাধিকা বললেন, এখানে কোনো পুরুষ আছে নাকি আবার ? পুরুষ একমাত্র শ্রীকৃষ্ণ, পুরুষ কখনো দুটি হয় না, পুরুষ এক। পুরুষ কোথায় দেখলে তুমি ? সবই তো গোপ-গোপী। তুমি দেখো নারী-পুরুষ আমি দেখি সবই মানুষ। তো সাধিকার এইসব অদ্ভুত কথা শুনে, সাধককে খবর পাঠানো হলো, সাধক স্মিত হেসে, সাধিকাকে আসবার অনুমতি দিলেন।
আসলে আধ্যাত্মিক জগতে নর-নারী, স্ত্রী-পুরুষ বলে কিছু হয় না। জীবজগৎ-উদ্ভিদজগৎ-পাহাড়-নদী-সমুদ্র এমনকি আকাশ-চন্দ্র-সূর্য- নক্ষত্র সবই প্রকৃতির অংশ মাত্র। পুরুষ তিনি, যার নির্দেশে এই জগৎ উদ্ভাসিত হচ্ছে আবার লয় প্রাপ্ত হচ্ছে।
ছেলেবেলায় একটা মেয়ে ছোট-ছোট হাড়ি কড়াই হাতা খুন্তি নিয়ে খেলা করে। কারন সে মায়ের মতো হতে চায়। মাকে যা করতে দেখে, সেও তাই করে। একটা ছেলে সুপারম্যান সাজে। কারন সে সুপারম্যান হতে চায়। মানুষ ঈশ্বরের ভজনা করে থাকে, কারন সে ভিতরে ভিতরে ঈশ্বরসম হতে চায়। কিন্তু তথাকথিত বুদ্ধিমানগন ভাবেন, এইসব ছেলেখেলার অর্থ কি ? সত্যদ্রষ্টা ঋষিদের মতে মানুষের চিন্তাই মানুষকে ধীরে ধীরে পরিবর্তন করে থাকে। এই হয়ে ওঠা কেবল মানসিক নয়, শারীরিকও দিক থেকেও বটে। শিবের উপাসনা করতে গিয়ে মানুষ শিব সাজে। ঈশ্বরের উপাসনা করতে গিয়ে মানুষ গেরুয়া বস্ত্র ধারণ করে থাকে। বৈষ্ণবগন নিজেকে শ্রীরাধিকা সাজায়। জীবাত্মা দেহ-মন-বুদ্ধির দ্বারা সীমাবদ্ধ। এইজন্য আমরা পরমাত্মা থেকে নিজেকে পৃথক ভাবি। কিন্তু আমরা যখন শরীর-মন-বুদ্ধির স্তর অতিক্রম করি, তখন ব্রহ্মের সাথে একাত্মতা অনুভব করি। ব্রহ্ম একটা বিরাট শরীর, ব্রহ্ম মানে সমস্ত মনের সমষ্টিবদ্ধ সংস্করণ। আমাদের এই ক্ষুদ্র শরীরে যেমন অসংখ্য কোষ, একটা মন আছে। ঠিক তেমনি সমস্ত জীব-জগৎ এই ব্রহ্ম-শরীরের অংশ। আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মন হচ্ছে ব্রহ্মমনের অংশ মাত্র। আসলে এগুলো আমাদের উপল্বদ্ধিতে আসে না। আমরা আমাদের নিজেদের ক্ষুদ্র দেহ-মন নিয়েই ব্যস্ত। কিন্তু ধ্যানাবস্থায় হঠাৎ এক ঝলক এসে চেতনার স্তরকে উন্নীত করে দেয়। আর তখন আমরা বিমূঢ় হয়ে যাই। আমি বলে তখন কিছু থাকে না। নিখিল বিশ্বই কেবল ভেসে বেড়ায়।
বাড়িতে বেড়ালের খুব উৎপাত। তিনটে বাচ্চা হয়েছে। তো বিড়ালগুলোকে ধরে বস্তায় মুখ বন্ধ করে, বড় রাস্তার কাছে দিয়ে এলাম। পরেরদিন দুপুরে দেখলাম, বেড়ালগুলো আবার আমাদের বাড়িতে চলে এসেছে। একটা মানুষকে চোখ বেঁধে কোথাও নিয়ে গিয়ে অচেনা জায়গায় ছেড়ে দিলে, সে অন্য কারুর সহযোগিতা ছাড়া বাড়ি ফিরতে পারে না। বিড়াল কি করে পারে ? লোকটাকে দেখে ভালো মনে হয় না। কি এমন দেখলাম তার মধ্যে যে তাকে ভালো লোক বলে মনে হলোনা। ছেলের কথা ভাবছিলাম, হঠাৎ ছেলের টেলিফোন এলো। এই সব ঘটনার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে কি ? ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে কিছু আমাদের শরীরে আছে কি ? আগামী দিনে আমরা এইসব ঘটনার উত্তর খুঁজবো।
কথা হচ্ছিলো, ব্রহ্মার চার অবস্থা নিয়ে। জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি ও তুরীয় অবস্থা নিয়ে। তো একজন বললেন, জাগ্রত অবস্থায় আমরা যা কিছু দেখি, শুনি তা সেই সমস্ত বস্তুই কোনো না কোনো কাজে লাগে। আর স্বপ্নাবস্থায় আমাদের যা কিছু দেখি, শুনি তা আমাদের কোনো কাজে আসে না। স্বপ্নে কেউ কিছু পেলে, বা খেলে তার কোনো উপযোগিতা দেখা যায় না। ধরুন স্বপ্নে আপনি কিছু খেলেন, তাতে কি আমাদের ক্ষিদে চলে যাবে ? যাবে না। জেগে উঠলেই ক্ষিদে লাগবে, খেতে হবে, তবে ক্ষুধার নিবৃত্তি হবে।
ঋষি বলছেন, দেখো, তোমার এই যে খাওয়া বা পাওয়া, তা সে স্বপ্নাবস্থাতেই হোক বা জাগ্রত অবস্থাতেই হোক, কোনোটাই সত্য নয়। তুমি আসলে কোন অবস্থাতে আছো, সেটাই সত্য। আর সেই অনুযায়ী তোমার চাহিদা তৈরি হবে, উপযোগিতার উপভোগ করবে। ধরো স্বপ্নে তোমার ক্ষিদে পেয়েছে, আর তুমি স্বপ্নাবস্থায়, চর্ব্য-চোষ্য খেলে, এতে করে তোমার স্বপ্নের ক্ষিদে মিটবে, কিন্তু আবার যখন জেগে উঠবে তখন তোমার আবার ক্ষিদে পাবে। অর্থাৎ স্বপ্নাবস্থায় যাকিছু তুমি খেয়েছো, বা করেছো, জাগ্রত অবস্থাতে সে সব তুমি বাতিল করে দেবে। আবার ঠিক উল্টোটা ভাব, জাগ্রত অবস্থাতে যা কিছু তুমি খেয়েছো বা করেছো, সেগুলো তোমার স্বপ্নাবস্থাতে কাজে লাগবে না। অর্থাৎ দুই অবস্থাতে তোমার দুই রকম অভিজ্ঞতা হবে। এই দুটো অবস্থাই ক্ষনিকের জন্য, একটা ৬-৮ ঘন্টা, আর একটা ৮০-১০০ বছর মাত্র। এই দুই অবস্থারই শুরু ও শেষ আছে। তাই এই দুই অবস্থাকে বলা হয়, মিথ্যে। আর যা সত্য তার শেষ নেই, শুরুও নেই অর্থাৎ শাশ্বত ও সনাতন। সত্য হচ্ছে একমাত্র আত্মা। এযেন সিনেমার পর্দা, ছবি আসছে-যাচ্ছে। পর্দার উপরে কত ঘটনা ঘটছে, পর্দাটি একই রকম আছে, কিন্তু পর্দা সরিয়ে নাও, ছবি-ঘটনা সব উধাও। এই ভাবেই আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা, আত্মার উপরে প্রতিফলিত হচ্ছে। এমনকি এই যে দেহ এটিও আত্মার উপরে প্রতিফলিত একটা চলন্ত ছবি মাত্র। একমাত্র আত্মাই সত্য-অবিনশ্বর। এই সত্য জেনে সুখী হও। - মান্ডুক্য উপনিষদ (২/৭)
আমরা পরমপিতা পরমেশ্বেরের উপরে নির্ভরশীল। এই কথাগুলো আমাদের কাছে কথার কথা। আমরা এটা বুঝতে পারি না। কিন্তু এটাই সত্য। আমি এই দেহ। এটা আমরা বেশ বুঝি। আর এই মানব দেহ বা জীব দেহ কতকগুলো কোষকলার সমষ্টি বা Biophenomenon অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জৈব বস্তু নিয়ে গঠিত। এই Biophenomenon আবার Metabolic system এর উপরে নির্ভরশীল।Metabolic system হচ্ছে আমাদের দেহের মধ্যে বিপাকক্রিয়ার মাধ্যমে যে রাসায়নিক রাসায়নিক পরিবর্তন হয়। আবার Metabolic system, Blood circulation বা রক্ত সংবহনতন্ত্র-এর উপরে নির্ভরশীল। Blood circulation আবার Respiratory System-শ্বাস-ক্রিয়া এর উপরে নির্ভরশীল। Respiratory System আবার Central Sensory Nurvas system (কেন্দ্রীয় সংবাহক স্নায়ুতন্ত্র) এর উপর নির্ভরশীল। Central Sensory Nurvas system আবার Endrocrine System (অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিতন্ত্র) এর উপরে নির্ভর করে। Endrocrine System আবার মনের (Mind ) উপরে নির্ভরশীল। মন কাজ করে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে। এখন কথা হচ্ছে মন কিসের উপরে নির্ভরশীল ? মন জীবাত্মার উপরে নির্ভরশীল। আর জীবাত্মা পরমাত্মার উপরে নির্ভরশীল। এই সত্যে উপনীত হতে পারলে, আমাদের পরমেশ্বরের উপরে বিশ্বাস দৃঢ় হবে।
সাধারণ মানুষ বলছেন, এই দৃশ্যমান জগৎ সত্য। এই জগৎ আমাদের পুষ্টি যোগাচ্ছে, এই জগৎ আমাদের সুখ শান্তি প্রদান করছে। এই জগতের সঙ্গে সম্মন্ধে আবদ্ধ হয়ে আমরা ভালোবাসার অনুভূতি পেয়ে থাকি। তো জগতের থেকে অধিক সত্য আর কিছু নেই।
একদল পণ্ডিত বলছেন, এই জগৎ মিথ্যা। এই জগৎ একটা গতিশীল ভ্রমাত্মক মরীচিকা মাত্র। যাকিছু দেখছো, যা কিছু শুনছো, সবই একটা ভ্রম। কালের নিয়মে সব বিলোপ প্রাপ্ত হচ্ছে, হবে।
আর একদল মহাত্মা আছেন, যারা বলছেন, সবই সত্য। সবকিছুর প্রয়োজন আছে। তুমি আছো, এটা যদি সত্য হয়, তবে জগৎ অবশ্য়ই আছে। কেননা তুমি জগতেরই অংশ। তুমি যখন থাকবে না, তখন তোমার কাছে জগৎ বলে কিছু থাকবে না। তখন জগৎ মিথ্যে হয়ে যাবে।
------------
স্বামীজী ধ্যানস্থ হয়ে বিশ্রাম করছেন, এক শিষ্য এসে জিজ্ঞেস করলেন, স্বামীজী জীবনটা দুঃখময় কেন ? স্বামীজী বললেন, জীবনটা আনন্দময় নয়, তাই দুঃখময়। স্বামীজী জানেন, এটা প্রশ্নের উত্তর নয় তাই একটা গল্প বললেন, আসলে প্রশ্নের মধ্যে যদি উত্তর থাকে, তবে প্রশ্নের উত্তরদান বৃথা। উত্তর প্রশ্নকে পাল্টাতে পারে না। যখন প্রশ্ন নির্ভর করে প্রশ্ন কর্তার অবস্থানের উপরে, তখন উত্তর নির্ভর করে, প্রশ্নকর্তার অবস্থানের পরিবর্তনের উপরে।
একদিন সকালে, বুদ্ধদেবকে এক জিজ্ঞাসু প্রশ্ন করেছিল, ঈশ্বর বলে কিছু আছে কি ? ভগবান বুদ্ধ উত্তরে বলেছিলেন, না ঈশ্বর বলে কিছু নেই। দুপুরে আরো এক জিজ্ঞাসু জিজ্ঞেস করলেন, ভগবান বলে কিছু আছে কি ? তো তিনি তাকে বললেন, হ্যাঁ নিশ্চয়ই আছে। সন্ধ্যাবেলা আরো একজন জিজ্ঞেস করলেন, পরমাত্মা বলে কিছু আছে কি ? বুদ্ধদেব নীরব রইলেন। কোনো উত্তর দিলেন না।শুধু হাসলেন।
তো আনন্দ নামক শিষ্য যিনি বুদ্ধদেবের নিত্যসঙ্গী, সারাক্ষন যিনি বুদ্ধদেবের কাছে থেকে তাঁর সেবা যত্ন করেন, তিনি দ্বন্দ্বে পরে গেলেন, তার ঘুম ছুটে গেলো। আর গুরুদেবকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি একই দিনে একই প্রশ্নের জবাব তিন ভাবে দিলেন। কাউকে হ্যাঁ বললেন, কাউকে না বললেন, কাউকে আবার স্মিতহাস্যে নীরবে জবাব দিলেন। অর্থাৎ হ্যাঁ বা না কিছুই বললেন না। এই তিন সত্য কিভাবে হতে পারে ? ভগবন, আপনি যতক্ষন না এই প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন, ততক্ষন আমি ঘুমুতে পারছি না। দয়া করে আমাদে সত্য বলুন।
বুদ্ধদেব হাসলেন, বললেন, দেখো, সকালে যে ব্যক্তিটি আমার কাছে এসেছিলো, যে আমাকে ভগবানের কথা জিজ্ঞেস করেছিল, সে ছিল আস্তিক ঈশ্বরে বিশ্বাসী। সে আমার কাছে এসেছিলো তার বিশ্বাসকে আরো দৃঢ় করতে। আর আমি কারুর বিশ্বাসকে দৃঢ় করবার জন্য বসে নেই। কারন বিশ্বাসী মন কখনো অনুসন্ধানী হতে পারে না। বিশ্বাস মানুষকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে রাখে। আমি ওর বিশ্বাসকে ভেঙে দিতে চাই। ঈশ্বর আছে কি নেই, তা আমার কথাতে বা জবাবে বোঝা যাবে না। সে এসেছিলো, তার বিশ্বাসের জায়গায়টাকে পোক্ত করতে। অর্থাৎ সে অন্যদের বোঝাতে চাইছে, দেখো, আমি যা বিশ্বাস করি, স্বয়ং বুদ্ধ তাই-ই বিশ্বাস করেন। অতএব ঈশ্বর আছেন। সে ঈশ্বরকে বুঝতে আসেনি, সে এসেছিলো, স্রেফ আমাকে তার বিশ্বাসের সাক্ষী রাখতে । আর তার এই বিশ্বাস ভয় থেকে, অজ্ঞানতা থেকে। তার অজ্ঞতাকে ঢেকে রাখবার জন্য সে বিশ্বাসের মোড়ক লাগাতে চায়। এই ব্যাপারে আমি তাকে সাহায্য করতে পারি না। তাই আমি তাকে বলেছি, না ঈশ্বর নেই। এখন সে তার বিশ্বাসের উপরে সন্দিহান হবে, এবং দেখবে, আবার একদিন সে আমার কাছে আসবে।
সত্যি সত্যি সে একদিন আবার বুদ্ধদেবের কাছে এলো। এবং এসে বললো, হে ভগবন, আমি আমার পুজো-অর্চনায় মন বসাতে পারছি না। মন্দিরের কোনো দেবতাকে আমি আর দেখতে পারছি না। কেবলি মনে হচ্ছে একটা মাটির মূর্তি। সেই থেকে আমার মনে হচ্ছে, ঈশ্বর থাকা না থাকা আমার অন্ধ বিশ্বাস মাত্র, এর মধ্যে কোনো সত্য নেই। আপনি শ্রেষ্ঠ পুরুষ, মহাত্মা , আপনি যদি বলেন, ভগবান নেই, তবে আমি কে (?) যে বলতে পারে, ভগবান আছেন। আপনার কথাই সত্য। এখন আমার মধ্যে আর বিশ্বাস বলে কিছু নেই, আমি আজ সত্যের অনুসন্ধানে এসেছি। এখন আমার মধ্যে কোনো বিশ্বাস নেই, আছে প্রশ্ন।
বুদ্ধদেব বললেন, আনন্দ, দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিল নাস্তিক। সে বিশ্বাস করে যে ঈশ্বর বলে কিছু নেই। দ্বিতীয় ব্যক্তিও এসেছিলো, প্রথমজনের মতো, নিজের ধারণাকে আমার সমর্থনের মাধ্যমে দৃঢ় করতে। প্রথমজন ও দ্বিতীয়জন দুইজনই অন্ধ বিশ্বাস ও অন্ধ অবিশ্বাসের উপরে দাঁড়িয়ে আছে। ঈশ্বর কোনো বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের বিষয় নয়। এটা তোমার নিজের উপলব্ধি - অনুভূতি - অভিজ্ঞতা। এই জায়গায় যিনি আসতে পেরেছেন, তার পুর্নজন্ম হয়েছে। এটা না হিন্দু, না মুসলমান, না খ্রিষ্টান, না ইঁহুদি, না জৈন না শিখ -দের ব্যাপার। এটা সম্পূর্ণ নিজস্ব অভিজ্ঞতা। সারা বিশ্ব যদি বলে, ঈশ্বর বলে কিছু নেই, বা আছে, তাতে তার কিছুই আসে-যায় না। কিছুতেই সে এঁকে অস্বীকার করতে পারে না। কারন তার আস্থা এসে গেছে। তোমার যখন কোনো বিষয়ে সম্পূর্ণ আস্থা এসে গেছে, তখন অন্যদের থেকে আলাদা একটা মানুষ হয়ে গেছো।
বুদ্ধদেব আবার বললেন, তৃতীয় ব্যক্তি না ছিলেন বিশ্বাসী না ছিলেন অবিশ্বাসী। তাই তার কোনো উপদেশ বা সমর্থনের প্রয়োজন ছিল না। সে ছিল নিরীহ, নিষ্পাপ, পবিত্র আত্মা। শুদ্ধ অন্তঃকরনের অধিকারী। তার প্রশ্ন কোনো পূর্বার্জিত জ্ঞানের সমর্থনে নয়। তার প্রশ্ন ছিল অনুসন্ধানের। আর অনুসন্ধান নীরবেই হতে পারে। আমি তাই নীরব ছিলাম। কেননা এটাই আমার উত্তর ছিল। আর সেও বুঝেছিলো। তুমি কি খেয়াল করেছিলে (?) আমি যখন নীরবে চোখ বুজে ছিলাম, সেও তার চোখ দুটোকে বন্ধ করেছিল, এবং একটা গভীর নীরবতা উপভোগ করছিলো। তুমি কি খেয়াল করেছিলে (?) সে যখন চলে যায়, তার আগে সে আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছিল (?), আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছিলো এবং বলেছিলো, আপনি ঠিকই বলেছেন। তার চোখের তারাদুটো জ্বলজ্বল করছিলো। সে আমার নীরবতা আস্বাদন করছিলো। এই মানুষটি ছিল সত্যিকারের অনুসন্ধানী।
একজন সত্যিকারের অনুসন্ধানীর জবাব তার নিজের মধ্যে ভেসে ওঠে। তাকে ব্যাখ্যা-বাক্য দিয়ে বোঝানো প্রয়োজন পড়ে না। নির্মল আত্মা আর একটা নির্মল আত্মার সন্মন্ধে এলে, আপনা-আপনি সম্পর্কযুক্ত হয়ে যায়। নির্মল অন্তর-আত্মা যখন ঘুমিয়ে থাকে, শুদ্ধ গুরু-আত্মা তাকে জাগিয়ে তোলে মাত্র। বোঝানোর কিছু নেই, বুঝে নেয় সে।
তাই ভালো থাকতে গেলে, আত্মাকে নির্মল করো, ঈশ্বরকে জানতে গেলে আত্মাকে নির্মল করো। এটাই গুরুশিক্ষা, গুরুবানী করে থাকে।
তস্মাদগ্নিঃ সমিধো যস্য সূর্যঃ।
সোমাৎপর্জন্য ওষধয়ঃ পৃথিব্যাম।
পুমান্ রেতঃ সিঞ্চতি যোষিতায়াং
বহী্ঃ প্রজাঃ পুরুষাৎসংপ্রসূতাঃ।।
তাঁর থেকে অগ্নি যার সমিধ কাঠ হচ্ছে সূর্য। অর্থাৎ অগ্নির ইন্ধন সূর্য। এই অগ্নি এসেছে সেই মহান পুরুষ থেকে।
ভগবান বুদ্ধ বলছেন,
দুর্ভুদ্ধির পাঁচটি ফল : দারিদ্র, অখ্যাতি, শঙ্কা, মৃত্যুভয়, দুঃখি-মন।
সুবুদ্ধির পাঁচটি ফল : সম্পত্তি লাভ, সুখ্যাতি, নিরাশঙ্কা, মৃত্যুভয়রহিত, সুখী মন।
এক গরিব কাঠুরে, নদীর পাড়ে কাঠ কাটছিলো। হঠাৎ হাত ফস্কে তার কুড়ালটি নদীর জলে পড়ে গেলো। তো কাঠুরে, গাছের তলায়, নদীর পাড়ে , মাথায় হাত দিয়ে, কাঁদতে লাগলো। হায় ভগবান, আমার কি হবে ? কুড়াল ছাড়া তো আমি কাঠ কাটতে পারবো না। আমার বৌ ছেলেমেয়েরা নিশ্চয়ই না খেতে পেয়ে মারা পড়বে। তো কাঁদতে কাঁদতে ঝাপসা নয়নে হঠাৎ সে দেখলো, এক অপূর্ব সুন্দরী দেবীমূর্তি, তার সামনে হাজির। তো তাকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার কি হয়েছে ? তুমি কাঁদছো কেন ? তো কাঠুরে তাকে তার কুড়াল নদীর জলে পড়ে যাবার কথা বললো। আর দেবীর কাছে, আকুতির স্বরে দুঃখ জানালো, এখন আমার সংসার না খেতে পেয়ে মারা যাবে। তো দেবী বললেন, ঠিক আছে, দেখছি কি করা যায়। বলে অন্তর্ধান হলেন। কিছুক্ষন পড়ে দেবীমূর্তি জল থেকে আবার আবির্ভূত হলেন, হাতে একটা রুপার কুড়ুল। কাঠুরেকে জিজ্ঞেস করলেন, এটি তোমার কুড়ুল ? কাঠুরে অবাক হয়ে দেখলো, দেবীর হাতে একটা রুপোর কুড়ুল, - বললো, না দেবী এটি আমার নয়। দেবী আবার জলে অন্তর্ধান করলেন, এবং কিছুক্ষন পরে, হাতে একটা সোনার কুড়ুল নিয়ে এলেন, বললেন, দেখতো,এটি তোমার কুড়ুল কি না ? কাঠুরে বললেন, না দেবী, এটিও আমার কুড়ুল নয়, আমার কুড়ুল তো লোহার। তো দেবী আবার জলে ডুব দিলেন, এবং হাতে তিনটি কুড়ুল নিয়ে এলেন, সোনা-রুপো ও লোহার কুড়ুল। কাঠুরের মনে এবার হাসি ফুটলো, বললেন, হ্যাঁ ওই লোহার কুড়ুলটি আমার বটে। তো দেবী সত্যবাদী কাঠুরের কথায় সন্তুষ্ট হয়ে, তিনটে কুড়ুল অর্থাৎ সোনা, রুপা ও লোহার কুড়ুলগুলোকে কাঠুরেকে দিয়ে অন্তর্ধান করলেন।
তো এই গল্প সারা গ্রামে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো। আর এই অলৌকিক কাহিনী শুনে, এক দুস্টু বুদ্ধি কাঠুরে, সেই নদীর পাড়ে কাঠ কাটবার ভান করে, ইচ্ছে করে, হাতের ভাঙা লোহার কুড়ুলটাকে জলের মধ্যে নিক্ষেপ করলো। এবং নদীর পাড়ে বসে, মরাকান্না জুড়ে দিলো। দেবী কিন্তু এবারও আবির্ভূত হলেন। এবং দুস্টু কাঠুরের কান্না থামাবার জন্য, হাতে তিনটে কুড়ুল, অর্থাৎ সোনা, রুপো, ও লোহার কুড়ুল নিয়ে হাজির হলেন। দেবীর হাতে সোনার কুড়ুল দেখে, দুস্টু কাঠুরে, উৎফুল্ল হয়ে উঠলো এবং দৌড়ে দেবীর হাত থেকে সোনার কুড়ুলটা নেবার জন্য উদগ্রীব হলো। দেবী কুড়ুল সহ অন্তর্ধান করলেন। আকাশবাণী হলো, রে মিথ্যাবাদী, লোভী কাঠুরে, তোর লোহার কুড়ুলটাও আর রইলো না।
গল্পকথা। কিন্তু এটাই বাস্তব জীবনে সত্যি।
মানুষের ভাগ্য তিনটি অবলম্বনের উপরে নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে থাকে। সংকল্প, কামনা, ও কার্য্য। মন থেকে উদ্ভূত হয় চিন্তা। আর চিন্তার মধ্যেই জন্ম নেয়, সংকল্প বা কামনা। আমাদের মানসিক শক্তি চিন্তা থেকে উদ্ভূত হয়। তাই চিন্তার অনুশীলন যে যত বেশি করেছে, তা সে এই জন্মে হোক, বা পূর্ব-পূর্ব জীবনে হোক, সে সেইমত মানসিক শক্তি লাভ করছে, এবং নিজের ভাগ্যকে দ্রুত পরিবর্তন করতে পারছে। গাঢ় চিন্তাই ধ্যান। ধ্যানাবস্থায় চিত্ত বৃত্তি এক বিষয়েই নিবদ্ধ থাকে। জ্ঞানবৃত্তির এই একতানতাকেই ধ্যান বলে। ধ্যানের নিরন্তর অভ্যাসে মন অসীম শক্তিশালী হতে পারে। শক্তিশালী মনের উচ্চতর স্তরে, কামনার সংস্রব থাকে না। উচ্চ শ্রেণীর চিন্তা জীবের আধ্যাত্মিক সম্পদ। প্রত্যেক মানুষেরই সংকল্প থাকে। আর জীবাত্মা যখন দেহ ধারণ করে, তখন সে সংকল্পের অধ্যবসায় সম্পন্ন হয়। দেহ ত্যাগের পর বা প্রয়ানের পর, আবার সে সেই চিন্তার স্তরে বা জগতে বাস করে। কিন্তু চিন্তার প্রয়োগ বা চিন্তাকে কার্য্যে পরিণত করতে পারে না। তাই আবার সে তার চিন্তাকে কার্যকরী রূপ দেবার জন্য, সেইমতো দেহ ধারণ করে থাকে।
উপাসনা, ধ্যান, তপঃ দ্বারা ঈশ্বর পিয়াসীগন, ঈশ্বরের মতোই পরম সুন্দর আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারেন। একে বলা হয়, সারূপ্য। এই সারূপ্যের ফলে ঈশ্বরভক্তের মধ্যে শক্তি, ঐশ্বর্য, স্মৃতি, এমনকি ইন্দ্রিয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। এবং এতসব এই জীবনেই ঘটে থাকে। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বিভিন্ন সাধনশক্তি সম্পন্ন যোগীদের মধ্যে একটা আকর্ষণ শক্তি জন্মায়। এর ফলে বহু স্ত্রী-পুরুষ এদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। বেশিরভাগ গুরুদেবদের মধ্যে এই শক্তি প্রকট হয়। সাধনমার্গে যতক্ষন থাকেন, ততক্ষন এই সারূপ্যকে তারা উপেক্ষা করেন, এবং সাধনমার্গে বিচরণ করে থাকেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ কিছু পতনউন্মুখ সাধক এই সারূপ্যকে উপভোগ করতে চান, আর অনিবার্যভাবে ধংসের দিকে এগিয়ে যান।
প্রত্যেক সাধকের একটা দিন আসবে, যে দিন সে অনুভব করবে সেই অনন্ত চৈতন্যের। সেই "অবাঙমনসগোচরম" অনুভূতি পেতে গেলে, আমাদের এই দৃশ্যমান জগৎ থেকেই শুরু করতে হবে। প্রথমে পবিত্র কোনো রূপ বা নামের স্মরণ করতে হবে। আসলে এই রূপ বা নাম যাই ধরুন না কেন, এটিও চৈতন্যেরই অভিব্যক্তি। সাধনার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে, সাকার একসময় নিরাকার হয়ে যায়, নাম এক সময় নামহীন হয়ে যায়। আমরা আমাদের রূপকে সত্য বলে ভাবি, আমরা আমাদের ব্যাক্তিত্ত্বকে সত্য বলে ভাবি। আরো একটু এগুলে, আমরা আমাদেরকে আত্মা বলে ভাবতে পারি। এই আত্মার পেছনে আছে পরমাত্মা। অর্থাৎ পরমাত্মা রূপ সমুদ্রে, জীবাত্মারূপ নৌকা। জীবাত্মা রূপ নৌকার মধ্যে আমাদের ব্যক্তিত্ত্ব। ব্যাক্তিত্ত্বের মধ্যে জড়দেহ। জীবাত্মা ভৌতিক দেহে আছে, মানসিক দেহে আছে। আবার অভৌতিক দেহে, বা সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর দেহে আছে। এই সমস্ত দেহের কর্ম্ম আছে। জাগতিক কর্ম্ম, চিন্তা-ভাবনা, জ্ঞানসংগ্রহ, আনন্দের অনুভূতি গ্রহণ, এই সবের মধ্যে দিয়ে নৌকা ভেসে বেড়াচ্ছে। চৈতন্যের (সমুদ্রের) জল ধীরে ধীরে জীবাত্মার (নৌকার) মধ্যে প্রবেশ করে। নৌকার (জীবাত্মার) মধ্যে যা কিছু, (ব্যক্তিত্ত্ব, মনস ইত্যাদি) সব একদিন চৈতন্যময় (জলে ভিজে টইটম্বুর) হয়ে যাবে। এই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি কারুর এক জন্মেই হতে পারে, আবার হাজার জন্মের পরেও হতে পারে। কিন্তু আমাদের সবার শেষ পরিণতি এটাই, যার গতি রোধ করা যাবে না।
মুক্তি কিসে হবে ? কামনা কামনা কামনা ! বাসনা বাসনা বাসনা ! কিসের কামনা-বাসনা ? আমাদের যেন অভাব না হয়। আমাদের যেন বিলুপ্তি না ঘটে। কামনা নিত্য কিন্তু জীবাত্মার স্বাভাবিক ধর্ম্ম নয়। যা স্বাভাবিক তার কোনো কারন থাকতে পারে না। যা অস্বাভাবিক তার একটা নিমিত্ত থাকে। শরীরের সুস্থতা স্বাভাবিক, কিন্তু যখন কোনো নিমিত্ত বা কারন দেখা দেয়, তখন তা অসুস্থ বা অস্বাভাবিক হয়। আবার নিমিত্ত বা কারন দূর হয়ে গেলে, শরীর স্বাভাবিক সুস্থ হয়ে ওঠে। নিজেকে, বা শরীরকে বাঁচিয়ে রাখবার বাসনা থেকে আসে মরনভয়। নিজেকে হারিয়ে ফেলার পিছনে আছে বিদ্বেষ, আছে দুঃখ। এই দুঃখ আমাকে গ্রাস করে। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর প্রতি আমাদের বিদ্বেষ জন্মায়। প্রাণভয়ে আমরা মাকে আশ্রয় করি। আসলে এই মরন-ত্রাস আমাদের পূর্ব-পূর্ব জন্মের অভিজ্ঞতার ফল। মরন কি জিনিস তা আমরা আগে থেকেই জানি। তাই মরনকে আমরা ভয় পাই। দেহের পর দেহ ধরেছি আবার ছেড়েছি, তাই আমাদের মধ্যে দেহাত্মবোধ কায়েম হয়ে রয়েছে। দেহের সঙ্গে আমরা এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবধ্য করে ফেলেছি নিজেকে। কিন্তু সত্য হচ্ছে দেহের মধ্যেই দেহের নিস্পত্তির কারন লুকিয়ে আছে। দেহকে ধরে রাখবার অদম্য বাসনা থেকেই আসে ক্লেশ। ক্লেশের ঘনীভূত রূপ হচ্ছে দুঃখ, যা আমাদের মনের অতলে লুকিয়ে আছে। এরই নাম সংস্কার। এই সংস্কারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, আমাদের স্মৃতি। এই স্মৃতি ও সংস্কার দুইয়ের অচ্ছেদ্য সম্মন্ধই আমাদের উদ্বুদ্ধ কর্ম্ম। আমি কবে কোন দেহে আশ্রয় করে ছিলাম, তা আমরা কখনোই ভুলি না। সময়-পরিস্থিতি-কারন দেখা দিলেই সেই স্মৃতি জেগে ওঠে। এই আবর্তনই চলছে অবিরাম। অনুভব থেকে সংস্কার, সংস্কার থেকে স্মৃতি, আবার স্মৃতি থেকে সংস্কার - এ এক আবর্তনশীল চক্র। এই চক্রকে আমাদের ছিন্ন করতে হবে, তবেই আমাদের মুক্তি।
ভগবানের মুখে বসানো বাঁকা কথা।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের একটা নতুন কথা শুনিয়েছিলেন, তা হচ্ছে ক্ষত্রিয় ক্ষত্রিয়কে হত্যা করতে পারে। এতে কোনো পাপ বা দোষ হয় না। হাজার বছর ধরে গীতার বাণী মান্যতা পেয়েছে। গীতার কথা এখনো প্রচারে ঘাটতি নেই। আমরা এইসব কথা শুনি কিন্তু মানি না, অথচ বিশ্বাস করি। অদ্ভুত
স্ব-বিরোধিতা। ভগবান বলছেন, হত্যা, হত্যাই নয়। কারণ যা হত্যা হয়, তা শরীর মাত্র - অর্থাৎ শরীরটি মানুষ নয়। যে মানুষ তাকে হত্যা করা যায় না. আর তা হচ্ছে আত্মা। এইসব কথা শুনলে আমাদের শরীরে শিহরন জাগে। আতঙ্কের জন্ম হয়। আমরা তো আত্মা আর আমি বা শরীরকে আলাদা করে দেখি না। আমরা এখনো মনে করি, কাউকে হত্যা করা অপরাধ, তা সে ক্ষত্রিয় হোক বা ব্রাহ্মণ। এমনকি আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি হিন্দু-সমাজ গীতার এই অমৃতবাণীকে অগ্রাহ্য করে থাকে। এবং ভগবানের কথায় আপ্লুত হয়ে যদি কেউ কাউকে মারে অর্থাৎ কোনো ক্ষত্রিয় অন্য ক্ষত্রিয়কে দৈহিক ভাবে আঘাত করে, তবে তাকে এই জীবনেই শাস্তির বিধান আছে। সমাজ - রাষ্ট্র কখনোই খুনিকে ক্ষমা করবে না। আর ভাবুন তো বিচারক যদি ভগবানের এই কথায় বিশ্বাস করেন ও অপরাধীকে মুক্তি দেন, তবে বিচারককে নিশ্চয়ই পাগলা-গারদে যেতে হবে।
ভগবানের মুখে বসানো বাঁকা কথা।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, গুন্ ও কর্ম্ম অনুসারে, মানুষ চার ভাগে বিভক্ত - ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র।
এই ধরনের কর্ম্ম ও গুনের বিভাগ আগে কোনো ঋষি মহাপুরুষ বলেন নি। শ্রীকৃষ্ণ একটা নতুন কথা বললেন। গুন্ বলতে আমরা জানি সত্ত্ব, রজঃ ও তম। অর্থাৎ তিন রকম গুন্। চতুর্থ গুনের কথা কোথাও কেউ বলেননি। আর কর্ম্ম হচ্ছে তিন প্রকার - প্রারব্ধ কর্ম্ম, ক্রিয়মান কর্ম্ম, ও সঞ্চিত কর্ম্ম। পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করে আমরা যে সব কর্ম্ম করে থাকি তাকে বলা হয়, ক্রিয়মান কর্ম্ম। আবার পৃথিবীতে এসে যে সব কর্ম্মফল আমাদের ভোগ করতেই হবে, তাকে বলা হয়, প্রারব্ধ কর্ম্ম। আবার ভবিষ্যৎ জন্মে যে সব কর্ম্ম আমাদের ভোগ করতে হবে, তাকে বলা হয় সঞ্চিত কর্ম্ম। তো কর্ম্ম তিন প্রকার, আবার গুণও তিন প্রকার। তাহলে চার রকম কর্ম্ম বা চার রকম গুন্ - এর কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা নেই। আবার শেষে (১৮/৪১-৪৮) এসে বলছেন, প্রত্যেকেই যেন স্ব-স্ব বর্ণের জন্য নির্ধারিত কর্ম্ম করে, অন্য কোনো কাজ নয়।বলছেন, স্ব-স্ব বর্ণের নির্ধারিত কর্ম্ম এবং তার সাথে উপাসনা মানুষকে মুক্তি প্রদান করতে পারে। অর্থাৎ কোনো শূদ্রের যদি পড়াশুনা ভালো লাগে, কোনো ব্রাহ্মণের যদি চাষবাস ভালো লাগে, কোনো বৈশ্যের যদি প্রহরীর কাজ ভালো লাগে, বা সেই কাজে সে যদি দক্ষও হয়, তথাপি তার সেগুলো করা উচিত নয় ? তাহলে আচার্য্য দ্রোণের যুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ম বহির্ভূত ? আজ অবশ্য এই নিয়ম আর নেই। এখন ব্রাহ্মণ-সন্তান সার্ভিস সেক্টরে কাজ করছে, চাকরি করছে, ব্যবসা করছে । আজকাল আর কেউ ভগবানের কথায় কানই দিচ্ছে না।শুদ্ররাও জ্ঞান সঞ্চয় করবার চেষ্টা করছে। স্ত্রীজাতির কন্ঠে বেদ-মন্ত্রধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এইজন্যই কি সমাজটা গোল্লায় গেলো ? নাকি কলিতে এমনটি হবারই কথা ?
বেদের নির্যাস হচ্ছে শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা। বেদ কথাটার অর্থ হচ্ছে জ্ঞান। তো উচ্চতর জ্ঞানের বীজ নিহিত আছে গীতায়। তো গীতা বুঝেছি, এই ঔদ্ধত্ত্ব যেন আমাদের কোনো দিন না আসে। গীতা বুঝতে আমাদেরকে কয়েক জন্ম নিতে হবে। গীতাজ্ঞানও বহু পুরাতন। গীতা বুঝতে গেলে, অর্জুন হতে হবে, অর্থাৎ মুমুক্ষু, বীর, ধীর, অকপট, অনলস, উদ্যমী, অধ্যবসায়ী, সমচিত্ত, সন্তোষী, দক্ষ, দয়ালু, পরোপকারী, সমর্পিতচিত্ত, স্বধর্ম্মনিষ্ঠ, স্বদেশপ্রেমী, সর্বোপরি জিজ্ঞাসু। এতো সবের পরেও, স্বয়ং ভগবানের শ্রীমুখে গীতার অমৃতকথা শুনেও, অর্জুন একসময় শ্রীকৃষ্ণকে বলেছিলো, তুমি ওই যুদ্ধের প্রাগমুহূর্তে যেসব তত্ত্বকথা আমাকে শুনিয়েছিলে সেসব আমার স্মৃতিতে নেই। যদি দয়া করে, আমাকে সেইসব তত্ত্বকথা পুনরায় বিধৃত করো। শ্রীকৃষ্ণ একথা শুনে বলেছিলেন, আমি আর সেইসব কথা বলতে পারবো না। তোমাকে অন্য কিছু কাহিনী শোনাচ্ছি, যাতে তোমার গীতাজ্ঞান হতে পারে। তো ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে তত্ত্বকথা নিজের শ্রীমুখে বলেছিলেন, সেই কথা আর তিনি (সখা শ্রীকৃষ্ণ) বলতে সক্ষম ছিলেন না। তো এই হচ্ছে শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা। অর্জুনের সংশয়ের নিরসনের জন্য, অর্জুনের প্রশ্নের উত্তরেই গীতা প্রকাশিত হয়েছিলো। ভগবান বলছেন, গুরুসান্নিধ্যে থেকে, গুরুসেবা করে, গুরুকে বারবার প্রশ্ন করে তত্ত্বকথা জেনে নাও। তো তত্ত্বকথা জানতে অন্তরের প্রশ্ন অনিবার্য, কিন্তু প্রশ্ন যেন অন্যকে যাচাই করবার জন্য না হয়। মহাত্মাগান্ধীর মতো কিছু মহাপুরুষ মনে করতেন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কোনো ঐতিহাসিক ভূমিকা নেই। শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুন, প্রভৃতি ঐতিহাসিক পুরুষ আদৌ ছিলেন না। মানুষের ভিতরে দৈবী ও আসুরী প্রবৃত্তির সংঘর্ষ নিত্য বিদ্যমান, রূপকচ্ছলে গীতায় তাই বর্ণনা করা হয়েছে। আর এর পিছনে আছে আধ্যাত্মিক রহস্য। আবার লোকমান্য তিলক, ঋষি অরবিন্দ প্রভৃতি এই মতকে যুক্তিযুক্ত বলে স্বীকার করতেন না। তবে যে যাই বলুক না কেন, এতে গীতার মর্য্যাদা ক্ষুন্ন হয় না। আসলে গীতা এমন একটা শাস্ত্র গ্রন্থ যা কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের নয়, যা মানব ধর্ম্মের প্রয়োগকৌশল। আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক, আধিভৌতিক সমস্ত স্তরের জীবন যুদ্ধে উত্তীর্ন হবার জন্য, এখান থেকে জ্ঞান-উৎসাহ-প্রেরণা লাভ করা যেতে পারে। লোকমান্য তিলক গীতার মধ্যে ভক্তির ভাবটি নিয়েছেন, আবার আচার্য্য শঙ্কর গীতার মধ্যে জ্ঞানের প্রাধান্য দেখতে পেয়েছেন। যার যেমন ভাব, তার তেমন লাভ।
আজ থেকে একশত বারো আগে প্রকাশিত স্বামী নিগমানন্দের লেখা একটা বই হাতে এসেছে "জ্ঞানীগুরু"। এই বইয়ের ফুটনোটে একটা অবিশ্বাস্য কাহিনী আমার দৃষ্ট আকর্ষণ করেছে। ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র কৃষ্ণচরিত ও ধর্মতত্ত্ব নামে দুটো প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এই বইয়ে, স্বামী নিগমানন্দের মতে হিন্দু ধর্ম্মের গৌরব রক্ষা করতে পারেন নি ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র। ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র ইতিমধ্যে দেহ রক্ষা করেছেন। তাই তাঁকে অর্থাৎ বঙ্কিমচন্দ্রকে ১৩১৪ সালের উনিশে চৈত্র বুধবার রাত্রি দেড় ঘটিকার সময় যোগনিদ্রায় বঙ্কিমচন্দ্রের আত্মাকে আনয়ন করেছিলেন স্বামী নিগমানন্দ ।
এবং তার সাথে এইরূপ কথোপথন হয়েছিলো।
প্রো : আপনি কেমন আছেন ?
উঃ - সুখে আছি। পৌরাণিক ভাষায় স্বর্গভোগ করিতেছি।
প্রো ; আপনার আর জন্ম হইবে কি ?
উঃ : ভোগান্তে জন্ম অবশ্যম্ভাবী।
প্রো : আপনার লিখিত "ধর্ম্মতত্ত্ব" পড়িয়া আপনার নিকট ধর্ম্মজ্ঞান ঠিক করতে পারি কি ?
উঃ : না-না, আমি ধর্ম্মোপদেষ্টা গুরু বা ধর্ম্মপ্রচারক নোই। সুতরং কোনো ধর্ম্মম্ত প্রচারও আমার উদ্দেশ্য নয়। কেবল একশ্রেণীর লোকের হিন্দুধর্মে দৃষ্টি আকর্ষণ করাই আমার উদ্দেশ্য। ............................................... শিক্ষিত গর্দভগনের অভিমানের বোঝা নামাইবার চেষ্টা করিয়াছি মাত্র। ................ইত্যাদি ইত্যাদি। .....
ভাবতে অবাক লাগে, হিন্দুধর্ম্মে এমন উচ্চমানের মহাপুরুষ আছেন, হয়তো আজো আছেন, যিনি মৃত ব্যক্তিকে ডেকে এনে জবাবদিহি চাইতে পারেন। সাধু সাবধান।
হে মহাত্মা মানবের কবে মুক্তি হবে ?
মহাত্মা বলছেন - জলের সমুদ্রে আগুন লাগলে মানুষের মুক্তি হবে। সাগরে মিলতে যাওয়া নদীর জলে যখন আগুন লাগবে, তখন মানুষের মুক্তি হবে। নদীর মাছ যখন গাছের উপরে চড়বে, তখন মানুষের মুক্তি হবে।
ভক্ত কবীর বলছেন - সমুদ্র অর্থাৎ এই মানব শরীর। আগুন অর্থাৎ জ্ঞান। নদী অর্থাৎ ইন্দ্রিয়। মাছ অর্থাৎ জীবাত্মা। গাছ অর্থাৎ পরমাত্মা।
সূর্য্যকিরণ পড়লে নদী শুকিয়ে যাবে। নদী শুকিয়ে গেলে, নদীতে খেলতে থাকা মাছ তখন গাছের উপরে উঠবে, আর ঠিক তক্ষুনি মানবমন যাঁকে দেখতে চায়, তাকে খোলা চোখে দেখতে পারবে।
শরীর যখন জ্ঞানের আলোতে মধ্যে লুপ্ত হয়ে যায়, ইন্দ্রিয় তখন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়. আর জীবাত্মা তখন পরমাত্মায় লিন হয়ে যায়। একেই বলে মুক্তি - কবীর
-----------
আমার্ কাছে মাঝে মধ্যে এক ভদ্রলোক আসেন, যার মুখে সব সময় হাসি লেগে আছে। সফল জীবন। নিজে কেন্দ্রীয় সরকারী চাকুরী থেকে অবসরপ্রাপ্ত, কিন্তু কলেজে প্রতিদিন ক্লাশ নিতে যান। একটা NGO-র সঙ্গে কাজ করেন, এদের দাতব্য চিকিৎসালয় আছে। প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা সেখানে চিকিৎসককে সাহায্য করেন। ভারত সেবাশ্রমের মিলন মন্দিরে মাঝে মধ্যে তাকে কীর্তনে অংশ গ্রহণ করতে দেখা যায়। ছেলে প্রতিষ্ঠিত চাকুরে । বৌমা কলেজের প্রফেসর। একটা ফুটফুটে নাতি আছে।একদিন তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনার সফল জীবনের মূলমন্ত্র কি ?
তিনি বললেন দেখুন, আমি মনে করি সবই ঈশ্বরের কৃপায় সম্ভব হয়েছে। এর জন্য আমার কোনো কৃতিত্ত্ব নেই। আমার আলাদা কোনো গুন্ নেই, যার জন্য আমি এই ব্যস্ত অথচ শান্তিপূর্ণ জীবন লাভ করতে পেরেছি। একটা কথা ছোটবেলায়, সন্তোষ মাস্টার-মহাশয়ের কাছ থেকে শুনেছিলাম, যা কিছু করবে, মনোযোগ দিয়ে করবে, একাগ্র চিত্তে করবে। দায়িত্ত্ব পালনে কখনো অবহেলা করবে না। প্রলোভনে কখনো পা দেবে না। নিন্দা, বকুনি ও সমালোচনা সবসময় বিচার করে দেখবে। নিজের মধ্যে যদি কিছু ভূলত্রূটি দেখতে পাও, তাকে সংশোধন করতে চেষ্টা করবে, কখনো নিজেকে লুকোবে না। নিজের মনের কথা প্রত্যয়ের সাথে, আত্মবিশ্বাসের সাথে প্রকাশ করবে। কে কি ভাবলো তাতে তোমার কিছু যায় আসে না। প্রসংশা আমাদের কাজে উদ্দীপনা এনে দিতে পারে ঠিকই কিন্তু সত্যিকারের প্রশংসা ও চাটুকারীর মধ্যে পার্থক্য নিৰ্ণয় করতে শিখতে হবে। কোনো রকম গর্ব, অভিমান, অহংবোধ যেন তোমার মধ্যে না জাগে। সবাইকে তার প্রাপ্য সন্মান দেবে। সবচেয়ে বড় কথা নিজেকে চিনতে হবে। নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। দিন দিন নিজেকে জ্ঞানসমৃদ্ধ করতে হবে। সবার কাছ থেকে শিখতে হবে। আর এই শেখাটা কাজের মাধ্যমেই হতে পারে। সবথেকে বড় কথা সবাইকে ভালোবাসতে হবে, কাজকেও ভালোবাসতে হবে । কাউকে বিচার করতে গেলে তার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে দেখতে হবে। সবশেষে আবার বলি - ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখতে হবে। ঈশ্বর প্রত্যেকটি মানুষকে ভালো দেখতে চান। আমরা যেন এই কথা মন-প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতে পারি।
পদার্থ-বিজ্ঞান ও জীব-বিজ্ঞান, সজীব বস্তুর মধ্যে মনের অস্তিত্ত্ব অস্বীকার করছে না, কিন্তু তার অস্তিত্ত্ব আজও তারা খুঁজে বের করতে সক্ষম হয় নি। মনোবিজ্ঞানীগন মনের চিকিৎসা করছেন, কিন্তু মনের হদিস পান নি। পদার্থ-বিজ্ঞানীগন বলছেন, মন অপার্থিব বস্তু। কিন্তু সত্যিই কি তাই ? মন যদি অপার্থিব হয়, তবে খাদ্য গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে মনের পরিবর্তন হয় কি করে ? মাদক দ্রব্য আমাদের মনের পরিবর্তন করতে সক্ষম, এতো আমাদের সবার জানা । ক্ষুধার্ত ব্যক্তির জ্ঞানসংগ্রহের ক্ষমতা কমে যায়। আসলে মন পদার্থের সূক্ষ্মতম অংশ কিন্তু স্থান-কালের উর্দ্ধে। আর এই স্থান কালের উর্দ্ধে মনের যে অংশ তা সাধারণভাবে আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে না হলেও তথাকথিত বিজ্ঞান এর নাগাল পেতে পারে না। কিন্তু সংযম-সমাধির অধিকারী পুরুষ এই মনের সাহায্যেই, মনকে অবলম্বন করেই স্থান-কালের উর্দ্ধে উঠতে পারেন । সংযম-সমাধি আসলে একটা উচ্চ পর্যায়ের অনুসন্ধানক্রিয়া - যা নিরন্তর অভ্যাস ও বৈরাগ্যের মাধ্যমে লাভ হতে পারে।
ভগবান মানুষকে দুটো হাত দিয়েছেন।গরু ছাগলের হাত নেই। আমরা যখন এই হাতের সাহায্যে কাজ করি, তখন আমাদের হাত দুটো আলাদা হয়েই থাকে। কিন্তু আমরা যখন অপরাধ করি, তখন আমাদের হাতদুটো বেঁধে দেওয়া হয়। আবার আমরা যখন ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, তখন আমাদের হাতদুটো জোড়া লেগে যায়। জোড়া হাতের অপূর্ব ক্ষমতা। জোড়া হাতেই প্রার্থনা হয়। প্রার্থনার মাধ্যমে এমনসব অসম্ভব সম্ভব হতে পারে, যা সারা বিশ্ব কখনো কল্পনাই করতে পারেনি। মনুষ্য জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা হচ্ছে, চিন্তা, ভাষা, ও প্রার্থনা। চিন্তা,ভাষা ও প্রার্থনা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আনুগত্যের সাথে বুদ্ধিদীপ্ত প্রার্থনা মানুষকে সমস্ত কিছু পাইয়ে দিতে পারে। আপনিও পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
শ্রীমৎ ভগবৎ গীতায়, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন,
আদিত্যানাং-অহং বিষ্ণুর্জ্যোতিষাং রবিরংশুমান।
মরীচিঃ-মরুতাং-অস্মি নক্ষত্রণাম-অহং শশী।
আদিত্যাদির মধ্যে অর্থাৎ অদিতির পুত্রদের মধ্যে আমি বিষ্ণু। জ্যোতিষ্কদের যত জ্যোতিস্মান বস্তু আছে, মধ্যে আমি রবি। মরুৎগণের মধ্যে আমি মরীচি। নক্ষত্রগণের মধ্যে আমি চন্দ্র।
আদিত্য হচ্ছেন বারোজন - ধাতা, মিত্র, অর্যমা , সূর্য্য, রুদ্র, বরুন, ভগ, বিবস্বান, পুশ, সবিতা, তুষ্ট ও বিষ্ণু। আসলে এগুলো বারোটি মাস - আর কার্তিক মাসের সূর্যকে বলা হয় বিষ্ণু।
মরুৎগন বা বায়ু - যার অভাবে মৃত্যু হয়, তাকে বলা হয় মরুৎ। হচ্ছেন - ঊনপঞ্চাশ জন (৭*৭)। , সত্বজ্যোতি, আদিত্য, হরিৎ, ইত্যাদি।
নক্ষত্র - রবিবার - উত্তরফাল্গুনী, উত্তরাষাঢ়া, উত্তরভাদ্র, রোহিনী, পুষ্যা, মুলা, ও রেবতী।
সোমবার - শ্রবণা, ধনিষ্ঠা, রোহিনী, মৃগশিরা, পূর্বফাল্গুনী, উত্তরফাল্গুনী, পূর্বভাদ্রপদ, উত্তরভাদ্রপদ, হস্তা ও অশ্বিনী।
মঙ্গলবার - পুষ্যা, অশ্লেষা,কৃত্তিকা, স্বাতী, উত্তরভাদ্র ও রেবতী।
বুধবারে - কৃত্তিকা, রোহিনী , শতভিষা ও অনুরাধা।
শুক্রবারে - পূর্বভাদ্রপদ, উত্তরভাদ্রপদ, অশ্বিনী, শ্রবণা ও অনুরাধা।
শনিবার - স্বাতী, রোহিনী।
স্বাতী, রোহিনী, অনুরাধা, শ্রবণা, অশ্বিনী, উত্তরভাদ্র, পূর্বভাদ্র,
উত্তরভাদ্রপদ, শতভিষা, রোহিনী, রেবতী, স্বাতী, অশ্লেষা ,পুষ্যা,
হস্তা, ভরনী, কৃত্তিকা, ধ্রূব, রেবতী, রোহিনী, শ্রবণা,
জ্যেষ্ঠা, উত্তর-ফাল্গুনী, পূর্ব-ফাল্গুনী, মৃগশিরা, ধনিষ্ঠা, শ্রবণা
- ইত্যাদি ২৭টি নক্ষত্র - এই নক্ষত্রগুলোর মধ্যে চন্দ্র হচ্ছেন সভাধিপতি।
নক্ষত্রদের নিজস্ব আলো আছে, কিন্তু চন্দ্রে নিজস্ব আলো নেই।, তাহলে চন্দ্রকে কেন নক্ষত্র বলা হচ্ছে ? আসলে এখানে নক্ষত্র কথাটা অর্থ হচ্ছে, না-ক্ষি-ত্র অর্থাৎ যার ক্ষয় নেই বা পতিত হয় না।
সত্যকে সত্য বলে জানা, আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলে চেনা, এই হলো মোক্ষের পথ। যারা মিথ্যাকে সত্য বলে মনে করে, আর সত্যকে মিথ্যা বলে ভাবে তাদের জন্ম জন্মান্তরের দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হয়। জন্ম যেমন সত্য, মৃত্যুও সত্য। ঈশ্বর এই জন্ম-মৃত্যু নামক বলদুটো নিয়ে লোফা লুফি করছেন । জগতে কোনো কিছুই নতুন আসে না। তাই জন্ম না হলে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে না। আবার মৃত্যু না হলে জন্ম হবে কোথা থেকে ? তবে কথা হচ্ছে, আপনি মাছের কারবার করলে, আপনার গা-থেকে মাছের গন্ধ আসতেই পারে, আবার আপনি সুগন্ধির ব্যবসা করলে আপনার শরীর থেকে সুগন্ধ আসতেই পারে। অবশ্য এথেকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া ভুল হবে, যে মাছের ব্যবসায়ী আর সুগন্ধের ব্যবসায়ী আলাদা। দুই জনেরই উদ্দেশ্য ব্যবসা। তবে বিজ্ঞ ব্যক্তি জীবনধারায়, অর্জিত অর্থ নিজের প্রয়োজন মতো রেখে, বাকিটা সৎ কাজে করেন, আর অজ্ঞান ব্যক্তি অর্জিত অর্থ নিজের বা নিজের পরিবারের জন্যই ব্যায় করে থাকেন। আপনি জানবেন, আপনার অর্জিত অর্থ আপনি ব্যয় না করলে, আপনার পরবর্তী প্রজন্ম তা তার ইচ্ছে মতো ব্যয় করবেন। আর আপনি ব্যয় করলে তা আপনি আপনার ইচ্ছে মতো ব্যয় করতে পারবেন।
মহামতি ভীষ্মর ইচ্ছামৃত্যু বর ছিল। কিন্তু কি প্রক্রিয়াতে তিনি নিজের প্রাণবায়ু ত্যাগ করেছিলেন, তা আমরা অনেকে জানি না। যোগশাস্ত্রে দেহমধ্যস্থ সুষুম্নানাড়ীতে ছয়টি চক্রের কথা বলা আছে। মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞা। ভীষ্ম প্রথমে মৌনতা অবলম্বন করলেন। মূলাধারে চিত্তকে সন্নিবেশিত করে যোগ অবলম্বন করলেন। এর পর তিনি অন্তর-কুম্ভক করলেন। বায়ুকে নিরুদ্ধ করার ফলে প্রাণবায়ু নিরুদ্ধ হলো। এরপর বায়ু উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হলো। এবার যে যে অঙ্গ বা চক্র পরিত্যাগ করে বায়ু ক্রমশ উর্দ্ধে উঠিত হতে লাগলো, তাঁর সেই সেই অঙ্গ শরশুন্য ও ব্রণরহিত হতে আরম্ভ হলো। সামনে ছিলেন, ব্যাসদেব, অন্যান্য মহর্ষিগন, পান্ডবগন ও স্বয়ং বাসুদেব। কিছুক্ষনের মধ্যেই ভীষ্মের গাত্র থেকে সমস্ত শরব্রণো উপনীত হলো, এবং প্রাণবায়ু ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে উল্কার ন্যায় আকাশপথে উত্থিত হলো।ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে আকাশে উত্থিত তেজোরাশি সবার সামনে বিলীন হয়ে গেলো। - মহাভারত - অনুশাসন পর্ব্ব।
বি:দ্রঃ :শর শব্দের অর্থ অগ্নি আর ব্রণ কথাটার অর্থ গ্রন্থি আবার অন্য অর্থে চেতনা।
মহাত্মাগণ বলে থাকেন, পরমাত্মার দ্বার সর্বদা আমাদের কাছে ধোঁয়াশায় ঢেকে আছে। দেওয়ালের কোথায় দরজা আছে, তা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। তাই আমাদের কাজ হচ্ছে দেওয়ালে-দেওয়ালে ধাক্কা দেওয়া। আর দেওয়ালে ধাক্কা দিতে দিতে একদিন নিশ্চই নিজের অজ্ঞাতসারেই সেই দরজায় ধাক্কা লেগে খুলে যাবে পরমাত্মার দ্বার । তাই নিরন্তর আমাদের সেই চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। মুক্তির তীব্র ইচ্ছা যাকে মহাত্মাগণ বলছেন, মুমুক্ষুত্ব। এই মুমুক্ষুত্ব যখন মানুষের মধ্যে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়, তখন পথের সন্ধান আসে। আর এই পরম উপলব্ধির দ্বারে আমাদের পৌঁছে দেয় । এর জন্য কোনো নির্দিষ্ট রাস্তাতেই যেতে হবে তার কোনো মানে নেই। সূর্য্যের কাছে যেমন যে কোনো রাস্তাতেই, যাওয়া যেতে পারে। আসলে আপনি কোথায় আছেন, তার উপরে নির্ভর করছে, আপনার গতিপথ। আর তীব্র মুমুক্ষুতাই আপনার গতিকে বাড়িয়ে দেবে। আপনি নিশ্চই এই দুর্লভ অনুভবের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন।
জগৎকে জ্ঞানের দ্বারা অর্থাৎ তথ্যের দ্বারা জানা সম্ভব নয়। জগৎকে জানতে গেলে আমাদের চৈতন্যের দ্বারাই জানতে হবে। তাই চেতনাই ধর্ম্ম আর অচেতনতাই অধর্ম্ম। আমরা যত ধর্ম্মিক হতে পারবো, যত আমরা ধর্ম্মকে ধরতে চেষ্টা করবো, তত আমরা চেতন হতে পারবো। যে মহাচৈতন্য সমস্ত জগৎকে অনুপ্রাণিত করছে, যে চৈতন্য বিশ্ব চরাচর অনুরণিত হচ্ছে, আমাদের মধ্যে দিয়ে সেই চৈতন্যস্রোত প্লাবনধারায় প্রবাহিত হতে শুরু করবে। তখনই আমরা সত্যিকারের জগৎকে জানতে পারবো। আর এই জানায় কখনো ভ্রান্তি থাকবে না।
উপনিষদ বলছে, "অহম ব্রহ্মাস্মি" "তত্বমসি" অর্থাৎ আমি ব্রহ্ম, তুমিও সেই। এই কথাগুলোকে কেউ বলেন, কথার-কথা, কেউ বলেন এটি অহংকারের কথা। মানুষ কখনো ব্রহ্ম হতে পারে না। উপনিষদ বলছে, তুমিই নারী, তুমিই পুরুষ, তুমিই বালক তুমিই বালিকা, তুমিই যুব-যুবা, তুমিই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। তুমিই কখনো মেরুদণ্ডে ভর করে চলছো, কখনো চারপায়ে ভর করে চলছো, কখনো দুই পায়ে ভর করে চলছো। আবার কখনো লাঠিতে ভর করে চলছো, তো কখনো ডানায় ভর করে চলছো। এখন সত্যিই কি আমাদের পক্ষে কখনো এই অনুভূতি সম্পন্ন হওয়া সম্ভব ? যদি হওয়া যায়, তবে তা কিভাবে ? স্বামীজী বলছেন, "অহম ব্রহ্মাস্মি" "তত্বমসি" এই মহাবাক্যটি বারবার নিজেকে শোনাতে থাকুন। এতে করে দেখবেন, একসময় আপনার মধ্যে একটা দৃঢ় প্রত্যয় হবে, যে আপনিই ব্রহ্ম। বারবার একই কথা ভাবতে ভাবতে আপনার জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে। আপনি দিনরাত এই দিব্য স্বরূপের কথা ভাবতে ভাবতে আপনার গোটা চরিত্র বদলাতে শুরু করবে। নিজেকে তখন মনে হবে, আমি শুদ্ধ-মুক্ত আত্মা। আসলে অধ্যাত্ম জীবনের রহস্যঃ হচ্ছে, নিজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা। আমরা সাধারণত নিজেকে বিচার করি, অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। কে আমাকে কি বললো, অন্য আমাকে কি চোখে দেখলো, সেটাকে আমরা বেশি গুরুত্ত্ব দেই । এইজন্য, আমি আমাকে চিনতে পারি না। নিজেকে যখন ব্রহ্ম অর্থাৎ নিত্যশুদ্ধ মুক্ত আত্মা বলে সর্বক্ষণ ভাববেন, তখন আপনি আপনার স্ব-রূপে স্থিত হতে পারবেন আবার আপনি অন্যকে যখন দেখছেন, তখন আপনি মনে করুন, আপনি একটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। অর্থাৎ আপনি আপনাকেই দেখছেন। আসলে আপনাকে আপনিই ধরতে হবে। যখন অন্য কেউ আপনাকে বিচার করবেন, তখন আপনি তার মতো হয়ে যাবেন। আর নিজেকে যখন নিজেই বিচার করবেন, তখন আপনি নিজের রূপকে স্পষ্ট দেখতে পারবেন। জীবন আপনার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গে, বদলাতে শুরু করবে। সত্য হচ্ছে আমরা সবাই এক-একজন ক্ষুদ্র ঈশ্বর। এটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো যায় না। নিজের চোখে নিজেকে দেখুন। সমুদ্রের জল আর সমুদ্রের বুদ্বুদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, পৃকৃতি ও পুরুষের মধ্যে কোনো ফারাক নেই, পার্থক্য হচ্ছে নাম ও রূপের মধ্যে, পার্থক্য হচ্ছে, সীমাবদ্ধ ও সীমাহীন, অন্ত আর অনন্তের। একসময় আপনার উপল্বদ্ধিতে অবশ্যই আসবে "অহম ব্রহ্মাস্মি" "তত্বমসি" ।
ধর্ম্ম কথাটার অর্থ যা ধরে রাখে। ইংরেজিতে religion শব্দের অর্থ যা বেঁধে ফেলে। তাহলে ধর্ম্ম মানে কি বন্ধন ? বাস্তব ক্ষেত্রেও দেখেছি, ধর্ম্ম মানুষকে সীমাবদ্ধ, এমনকি সংকীর্ণ করে তোলে। ধর্ম্ম মানেই কিছু বিধি নিষেধ। ধর্ম্ম মানে সংযম। ধর্ম্ম মানে তপস্যা অর্থাৎ নিজেকে তাপিত করা। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে, মানুষ ধর্ম্ম বলতে বন্ধনকে স্বীকার করে নিয়েছে। অসীম যখন সীমার মধ্যে আবদ্ধ তখন হয় সৃষ্টি, অবয়ব। নিরাকার যখন আকার নেয়, তখন সে সীমাবদ্ধ হয়। ধর্ম্ম মানে ঈশ্বরের নিয়মের মধ্যে নিজেকে বেঁধে ফেলা। ধর্ম্ম মানে প্রকৃতির নিয়মের বেড়াজালকে অতিক্রম না করা। ধর্ম্ম মানে নিজেকে সত্যে প্রতিষ্ঠিত করা। অর্থাৎ সত্য-মিথ্যার যে অসীমতা তার মধ্যে একটা স্পষ্ট সীমারেখা টানা। ধর্ম্মের সাহায্যে মানুষ তার নিজের সীমারেখাকে খুঁজছে। অথচ মানুষ এই ধর্ম্মের সাহায্যেই অসীমকে খুঁজে বের করতে চাইছে। কেমন যেন স্ব-বিরোধী একটা আশ্চর্য্য উপায়। মানুষ মুক্তি চায়, অথচ নিজেকে ধর্ম্ম দিয়ে বেঁধে চিৎকার করছে, আমি মুক্তি চাই। অসীম কখনো সীমাকে নির্দিষ্ট করতে পারে না। ধর্ম্ম স্ব-ঘোষিত সীমাকে অসীম করতে চায়। ধর্ম্মের এই সীমানা মানুষকে বেঁধেছে, আবার একদিকে ছাড়িয়ে দিতে চাইছে। মানুষ তার চিন্তাকে ধর্ম্ম দিয়ে বাঁধতে চায়। ভাবে বাঁধতে পারলেই বন্ধন-মুক্তির জন্য সে চেষ্টা করবে। বলা হয়, ধর্ম্মের পথ দুর্গম। এই পথে চলা কঠিন। ধর্ম্মের পথ দুঃখের। আবার ধর্ম্মই দুখনিবারক, মানুষকে চিরস্থায়ী শান্তি দিতে পারে এই ধর্ম্ম । দুর্বোদ্ধ এই ধর্ম্ম। মানুষ সেই ধর্ম্মের পথে চলুক যা ধর্ম্মকে অস্বীকার করতে পারে। মানুষ সেই অসীমের পূজারী হোক, যা তার প্রকৃত সত্ত্বা।
মহর্ষি কপিলের দৃষ্টিতে এই বিষয় সংসার সৃষ্টির মূল কারন হচ্ছে, পুরুষ ও প্রকৃতি। প্রকৃতি দুই ধরনের এক ব্যক্ত, আর একটি হচ্ছে অব্যক্ত। ব্যক্ত সংসার দুঃখময়। আর এই দুঃখ ত্রিবিধ। ত্রিতাপে দগ্ধ হয় সংসারীগণ। এই তিন ধরনের দুঃখ নিবৃত্তিই পরম পুরুষার্থ। এই দুঃখ মোচনের একমাত্র উপায় হচ্ছে জ্ঞান, আত্মজ্ঞান, আত্মদর্শন। জীবের যা অন্তর-জ্যোতি তাই আত্মা। আত্মা অনাদি। প্রকৃতি নিয়মে আবদ্ধ। প্রকৃতির গুনেই সমস্ত কার্য্য সংগঠিত এবং সম্পন্ন হয়। এখানে পুরুষের কোনো ভূমিকা নেই। পুরুষ সাক্ষী মাত্র। মায়ার প্রভাবে দেহের ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে আত্মাভিমান বশত পুরুষের কর্তৃত্বাভিমান জন্মে। কিন্তু পুরুষ কর্তা নন, পুরুষ সাক্ষী মাত্র। কিন্তু এই কর্তৃত্বাভিমানে জন্ম-মৃত্যু-ধারায় কর্ম্মপাশের বন্ধনে পরাধীন হয়ে যায় পুরুষ । আর তখন সুখ দুঃখ ভোগের কারন হয়ে যান পুরুষ । তাই উপনিষদ দুটি পুরুষরূপী পাখির উদাহরণ দিয়েছে, একজন গাছের ফল আস্বাদন করছে, আর একজন নির্বিকার হয়ে দেখছে। পুরুষের কর্তৃত্বাভিমান চলে গেলে, সুখ-দুঃখ ভোগের উর্দ্ধে দ্রষ্টা হয়ে যান তিনি। মহর্ষি কপিল পঁচিশটি তত্ত্বের কথা বলেছেন। এই তত্ত্বগুলো সম্পর্কে জ্ঞানই দুঃখ নিবৃত্তির উপায়। এগুলো হচ্ছে, পাঁচটি জ্ঞান-ইন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক) পাঁচটি কর্ম্ম-ইন্দ্রিয় (হস্ত, পদ, বাক, পায়ু, উপস্থ ) পাঁচটি তন্মাত্র (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ) পাঁচটি ভূত ( ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম) এছাড়া অহংকার, মহত্তত্ব, প্রকৃতি, পুরুষ এই ২৪টি তত্ত্ব ও পরম-পুরুষ।
মহাত্মাগণ বলে থাকেন আমাদের যখন আহার শুদ্ধ হয়, তখন আমাদের মন শুদ্ধ হয়, আর মন যখন শুদ্ধ হয়, তখন আমাদের স্মৃতি স্থির হয়, অর্থাৎ তখন আমরা আমাদের স্বরূপ সম্পর্কে চিন্তন করতে পারি। এবং স্বরূপ-চিন্তন ক্ষমতাই আমাদেরকে অধ্যাত্ম-চেতনায় প্রতিষ্ঠিত করে। ধীরে ধীরে সমস্ত গ্রন্থি আলগা হয়ে পড়ে। আমরা মুক্তির পথে ধাবিত হই।
এখন কথা হচ্ছে অধ্যাত্ম পথের প্রথম শর্ত হচ্ছে শুদ্ধ আহার। এই আহার বলতে আমরা কি বুঝি ? নিরামিষ সাত্ত্বিক পবিত্র খাদ্য ? নিরামিষাশী অথচ বিষয়ী এমনকি দুস্টুপ্রকৃতির লোকের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। সাপকে দুধকলা দিয়ে পুষলেও বিষ উৎপাদনের ক্ষমতা তার কমে না। গরু-ছাগল নিরামিষাশী এবং নিরীহ, কিন্তু আধ্যাত্মিক নয়। বানর মাংস খায় কিনা জানি না, কিন্তু বড্ড চঞ্চল। তাই আহার বলতে আমাদের বুঝতে হবে, আমাদের পাঁচ-ইন্দ্রিয়ের আহার। শুধু খাদ্য নয়। অন্ন বা খাদ্য যা আমরা শরীরের পুষ্টির জন্য, গ্রহণ করে থাকি, সেসব আমাদের অনন্ময়, মনময় দেহের পুষ্টি সাধন করে থাকে। বায়ু আমাদের প্রাণময় দেহকে পুষ্টি দিয়ে রক্ষা করছে।
আসলে আহার শুদ্ধি কথাটার যথার্থ অর্থ হচ্ছে, আমাদের মস্তিস্ক যেন সর্বদা ঈশ্বরের চিন্তায় মগ্ন থাকে। আমাদের কান যেন সর্বদা কল্যাণ বচন শুনতে আগ্রহী হয়। চোখ যেন শুভবস্তুর দিকে দৃষ্টিপাত করে। মুখ যেন সর্বদা ঈশ্বরের স্তুতিতে মুখরিত হয়। কন্ঠে যেন ঈশ্বরের সুর ধ্বনিত হয়। এই হৃদয়কেন্দ্রে যেন ঈশ্বরের স্পন্দন অনুভূত হয়। অর্থাৎ যা কিছু আমরা গ্রহণ করছি, তা যেন ঈশ্বরের ছোঁয়ায় ঈশ্বরের প্রসাদ হয়। আমরা যেন আমাদের স্থুল দেহে অবস্থানকালে দেববিহিত জীবন যাপন করতে পারি। নিরন্তর এই ঈশ্বর চিন্তনের অভ্যাসই আমাদের শুদ্ধ-পবিত্র আহার, যা আমাদের মনুষ্য জীবনকে মানবিক করে তুলতে পারে।
স্বামীজী বড্ড বিচিত্র মানুষ। সাধারনতঃ কোনো কাজই করেন না। অথচ সুস্থ-সবল দেহ, বুদ্ধিমান, এমনকি কর্ম্মক্ষম। স্বভাব তার বালকের মতো, জড়ের মতো, কখনো উন্মত্ত্ববৎ আচরণ করেন। তাকে একবার সুযোগ বুঝে এক জিজ্ঞাসু জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি এমন আচরণ করেন কেন ? আপনার যা শরীর, আপনার যা বুদ্ধি, আপনার যা মেধা, তাতে করে, আপনি নিশ্চিত একজন সন্মানীয় ধনী ব্যক্তি হতে পারতেন। আপনাকে কারুর উপরে নির্ভরশীল হতে হতো না। তো স্বামীজী বললেন, আমি তোমার আশ্রয়ে থাকি, তাই তুমি এই কথা বলছো ? তবে শোনো, সাপ কখনো নিজের গৃহ নির্মাণ করে না, অন্যের গর্তে বাস করে, কিন্তু সাবধানে থাকে।
একজন উন্নত সাধক কিভাবে মানুষের উপকার করতে পারেন ? আসলে যতক্ষন আমাদের দেহবোধ আছে, ততক্ষন আমাদের এই জড় জগতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। দেহকে রক্ষা করবার জন্য, যাকিছু দরকার সবই করতে হবে। এবং সেইমতো সবাইকে সাহায্য করতে হবে। আমরা যখন মনের জগতে বিচরণ করবো, তখন আমাদের সেই বিরাট মন অর্থাৎ সমষ্টি-মনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। এবং সমস্ত মনকেই আমাদের বুঝবার চেষ্টা করতে হবে, এবং আমরা চাইবো, সবাই মানসিক শান্তিতে থাকুক, এবং তার জন্য আমার মন যেন সক্রিয় হয়ে ওঠে । শেষে আমরা যখন আধ্যাত্মিক জগতের শিখরে পৌঁছুতে পারবো, অর্থাৎ চৈতন্যের জগতে নিজেকে মেলে ধরতে পারবো, তখন আমাদের কাজ হবে, সবার চৈতন্যবোধ জাগিয়ে তোলা। চেতনশক্তির প্রবাহ সর্বত্র। এই চেতন শক্তিকে সবার মধ্যে প্রবেশ করানো উন্নত সাধকের কাজ। শুধু নিজের শরীর, নিজের মন, নিজের চেতনা নিয়ে থাকলে চলবে না। আমাদের দৃষ্টি থাকবে, সমস্ত জীব-দেহের দিকে, সমষ্টি মনের দিকে, সামগ্ৰিক চেতন শক্তির দিকে। জানবেন, লোক মঙ্গলের জন্য, আপনার জন্ম। লোক মঙ্গলের জন্য, আপনার জীবন প্রবাহ, লোক মঙ্গলের জন্য আপনার জীবনপাত করতে হবে। ব্যক্তি নয়, সমষ্টিই ঈশ্বর।
কথায় বলে ভালো কাজে বহু বাধা। অধ্যাত্ম জীবনে এই কথাটা ভীষণভাবে সত্য। মানুষ সাময়িক ক্ষোভের বসে, দুঃখের বসে, কিংবা নিতান্ত কৌতূহলের বসে, সংসার জীবন থেকে সরে এসে, সাধনার পথ বেছে নেয়, পরম শান্তিলাভের আশায়। পুঁথিগত বিদ্যা তাকে শুনিয়েছে, ধ্যানের মাধ্যমে কতনা শান্তি পান সাধকগন। কিন্তু কিছুদিন চেষ্টা করবার পরে, সে বুঝতে পারে, সাধন-প্রয়াস বজায় রাখা সম্ভব নয়। এর চেয়ে সংসারের মধ্যে থাকা সহজ, সংসারের কাজ অনেক সুখপ্রদ। যারা জন্ম-জন্মান্তরের সাধক নন, তাদের সংসারে থেকেই সাধন পথে পা বাড়াতে হয়। একবারে সংসার ত্যাগ হঠকারী সিদ্ধান্ত ছাড়া কিছু নয়।
ধ্যান-জপ করলে কি হয় ? ধ্যান-জপ করলে কি হয়, যারা ধ্যান জপ করেন নি, তাদের বোঝানো খুব কঠিন। ধ্যান জপ করলে, আমাদের মনের যে বিভিন্ন স্তর আছে, অর্থাৎ চেতন-অবচেতন-অতিচেতন স্তর, এগুলোর মধ্যে একটা সামঞ্জস্য বজায় রাখে। ধ্যান-জপ হচ্ছে মনের কাজ। তো মনকে ধ্যান-জপে নিযুক্ত করলে, মন তখন একটা কাজ পায়। এখন কথা হচ্ছে, ধ্যান-জপ না করলে কি মন কোনো কাজ করে না ? করে, তবে তখন মন যে কাজ করে, সেই কাজের মধ্যে এই তিন মনের মধ্যে কোনো শৃঙ্খলা থাকে না। তাই যারা ধ্যান-জপ করেন না, তাদের মধ্যে বিশৃঙ্খল চিন্তার উদয় হয়। ধ্যান-জপে আমরা কি করি, মনকে অন্তরে ধরে রাখি আর ঈশ্বরীয় রূপ-ভাব-প্রেমকে কেন্দ্রীভূত করতে থাকি। এইসময়, বাইরের বিষয়ের থেকে ধ্যান-জপের বিষয়ে আমাদের বেশি আগ্রহ তৈরী হয় । এবং দেখবেন, ধ্যান-জপের বিষয় ধীরে ধীরে বাস্তবে পরিণত হবে। অন্তত খানিক্ষণের জন্য হলেও মন পরমাত্মায় - দিব্য আনন্দে অর্থাৎ মহৎ গুণাবলীতে স্থিতি লাভ করবে। এইসময় সাধক একটা কিছুর দিব্য-উপস্থিতির অনুভব লাভ করে থাকেন । ধ্যানে ঈশ্বরীয় সত্তা নিজেকে কোনো না কোনো রূপের মধ্যে প্রকাশ করেন। তাই বলা হয়ে থাকে ধ্যান-জপে আমাদের অন্তরগুরুকে জাগিয়ে তুলতে পারি এবং তার সান্নিধ্য লাভ করতে পারি।
আমরা এক দেহ থেকে আর এক দেহে যখন স্থানান্তরিত হই, ততই চেতনার পরিবর্তন হতে থাকে। আমরা যখন চেতনার উচ্চ স্তরে থাকি, তখন আত্মাকে সত্য বলে মনে হয়। ধীরে ধীরে আমাদের যখন চেতনার মাত্রা কমতে থাকে তখন আমরা দেহচেতনা বৃদ্ধি পায়। আবার যখন চেতনার মাত্রা আরো কমে যায়, বাহ্য জগৎকে সত্য বলে মনে হয়। অধ্যাত্ম সাধনায়, এই চেতনার স্তরকে উন্নত করতে হয়, তবেই আবার নিজেকে আত্মা বলে বোধ হতে থাকে।
শিবসংহিতায় বলা হয়েছে, সন্ধিকালে অর্থাৎ সূর্য উদয়ের সময়, সূর্য অস্ত যাবার সময়, দুপুরে, ও মধ্যরাত্রে, এই চারবার প্রাণায়াম করলে অবিলম্বে (তিনমাসের মধ্যে) আমাদের নাড়ীশুদ্ধি হবে। আর নারী শুদ্ধি হলে, আমাদের জঠরাগ্নি উদ্দীপ্ত হবে। আমদের শারীরিক বল, মানসিক বল, উৎসাহ-উদ্দীপনা, বৃদ্ধি পাবে, আমরা সুভোগী ও সুখী হতে পারবো।
প্রক্রিয়া :
১) পরিষ্কার পরিছন্ন খোলামেলা স্থানে সুখাসনে বসুন।
২) অঞ্জলিবদ্ধ হয়ে গুরুদেবকে প্রণাম করুন, বিঘ্ননাশক শ্রীগণেশ ও রুদ্রদেবকে প্রণাম করুন। সবশেষে মা-দুর্গাকে প্রণাম করুন।
৩) এরপর ডান হাতের বৃন্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে ডান নাসিকা (পিঙ্গলা নাড়ী) রুদ্ধ করে, বাম নাসিকা দিয়ে (ইড়া নাড়ী) বায়ুকে যথাশক্তি ভিতরে টেনে নিন।
৪)এবার যথাশক্তি কুম্ভক করুন।
৫)এবার ধীরে ধীরে অর্থাৎ বেগের সঙ্গে নয়, বাম নাসিকা অর্থাৎ ইড়া নাড়ীকে অনামিকা দ্বারা বন্ধ করে, পিঙ্গলা দ্বারা অর্থাৎ ডান নাক দ্বারা বায়ু ত্যাগ করবেন।
এবার ঠিক উল্টোটা করুন, অর্থাৎ ডান হাতের অনামিকা দ্বারা বাম নাক বন্ধ করে, ডান নাক দিয়ে শ্বাস নিন, কুম্ভক করুন, আবার ডান নাক বন্ধ করে, বাম নাসিকা দিয়ে শ্বাস ছেড়ে দিন।
এইভাবে বিশবার কুম্ভক করবেন। খেয়াল করবেন, বাম নাসিকা দ্বারা শ্বাস নিতে হবে, আর ডান নাসিকা দ্বারা শ্বাস ছাড়তে হবে। আবার ডান নাসিকা দ্বারা শ্বাস নিতে হবে, এবং বাম নাসিকা দ্বারা ছাড়তে হবে। মাঝে কুম্ভক করতে হবে। শ্বাস নেবার জন্য যে সময় ব্যায় করবেন, শ্বাস ছাড়ার সময় তার দ্বিগুন এবং কুম্ভক তার দ্বিগুন সময় যাবৎ করবেন। (১:৪:২)
শিব সংহিতায় বলা হয়েছে, প্রতিদিন, দিনে চার বার। আর প্রতিসন্ধিক্ষনে বিশবার করে, এই প্রাণায়ামের অভ্যাস করলে, অবিলম্বে সাধকের নাড়ী শুদ্ধি হবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
কি করে বুঝবেন, যে আপনার নাড়ীশুদ্ধি হয়েছে ? শিব সংহিতা বলছে, নাড়ী শুদ্ধি হলে, যোগীর শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য বজায় থাকবে। দেহ হবে সুগন্ধময়। দেহ সুন্দর ও কান্তিযুক্ত হবে। কন্ঠস্বর হবে সুমধুর ও সংগীত সাধনার যোগ্য । জঠরাগ্নি উদ্দীপ্ত হওয়ায়, যাকিছু আহার করবেন, তা সহজে হজম হয়ে যাবে। ফলত স্বল্প বা পরিমিত আহারেই শরীর সুস্থ সবল থাকবে। আর সর্বাঙ্গ সুস্থ-সুন্দর শরীরে আত্মা হবে সুভোগী ও সুখী।
আমরা জানি, কর্ম্মই জীবন। আমাদের সবাইকেই কোনো না কোনো কর্ম্ম করতেই হয়। এখন কথা হচ্ছে, এই কর্ম্মে যারা নিপুন, তারা যে কাজেই হাত দিক না কেন, সেই কাজ তারা স্বল্প সময়ের মধ্যে, ভালোভাবে করতে পারে। আর যারা কর্ম্মে দক্ষ নয়, তাদের কাজে অনেক ক্ষুদ থেকে যায়, সময় অনেক বেশি লাগে । এই কর্ম্ম দক্ষতা, এটি যেমন আমরা জন্মসূত্রে পেয়ে থাকি, আবার এই কর্ম্মদক্ষতা আমরা অর্জন করতে পারি । এখন কথা হচ্ছে, সব ধরনের কাজে দক্ষতা অর্জন সাধারণ ভাবে আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কেউ ভালো, অভিনেতা হতে পারেন, কেউ ভালো নেতা হতে পারেন। কেউ ভালো গান গাইতে পারেন, কেউ ভালো ডাক্তার হতে পারেন, আবার কেউ ভাল ইঞ্জিনিয়ার হতে পারেন। কিন্তু একই ব্যক্তি সমস্ত কাজে পারদর্শী হতে সাধারনতঃ পারেন না।
কেউ বিশ্বাস করেন আর না-ই করেন, আমাদের সমস্ত কর্ম্মের একজন নিয়ন্তা আছেন। তিনিই বিশ্বের সমস্ত কর্ম্মের নিয়ন্তা। এই কর্ম্মের নিয়ন্তা সম্পর্কে আপনি যদি জ্ঞাত থাকেন, তবে তার সঙ্গে আপনার একটা সখ্যতা হতে পারে। আর তার সাথে সখ্যতা হলে, তিনি কিভাবে এই বিশ্বের সমস্ত কর্ম্মকে নিয়ন্ত্রণ করছেন, তিনি কিভাবে সমস্ত জীবজগৎকে পরিচালনা করছেন, তিনি কিভাবে বিশ্বব্রহ্মান্ডকে পরিচালনা করছেন, তিনি কোন কৌশলে এই বিশ্বজগৎকে নিয়মের মধ্যে বেঁধে রেখেছেন, এগুলো আপনি তখন, কাছথেকে পর্যবেক্ষন করতে পারবেন। আর কাছ থেকে দেখে, যদি আপনি এই সম্পর্কে জ্ঞান সঞ্চয় করতে পারেন, তবে আপনি তার কর্ম্মপদ্ধতি সম্পর্কেও জ্ঞাত হতে পারবেন। আর তাঁর কর্ম্মপদ্ধতি সম্পর্কে আপনার জ্ঞান হলে, এবং সেইমতো তার নিয়মে বা কৌশলে কাজ করলে, আপনি সমস্ত কাজে সাফল্য পেতে পারেন। এইভাবে আপনি একদিন বিশ্বাত্মার সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। আর এই কৌশলই শেখায় যোগ।
যোগের শুরু বায়ু, বায়ু থেকে বাক বা শব্দ। আর বাকের উৎস ঋতকর্ম্ম বা সত্যকর্ম্ম । এই জগতের সমস্ত ঋতকর্ম্মই বিশ্বশক্তির বা বিশ্বাত্মার বিভূতি বা ঐশ্বর্য। মানুষ যখন ঋতকর্ম্মে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন সে বাকের সন্ধান পায়। এই বাক আর কিছু নয়, আদিধ্বনি "ওঁং" । এই অনাহত বা বাধাহীন ধ্বনি সবার দেহমধ্যে প্রতিনিয়ত ধ্বনিত হচ্ছে। যিনি যথার্থ যোগী তিনি এই ধ্বনির সন্ধান পান। আর এই ধ্বনি বা প্রণব জানবেন, বিশ্বাত্মা থেকেই উদ্গিত হচ্ছে। এই প্রণবের সন্ধান যিনি পেয়েছেন, তিনি প্রতিনিয়ত নতুনের মতো উজ্বল, সুন্দর। যিনি সমস্ত কাজে সমান দক্ষ। যে কাজেই হাত দেন, সেখানে সাফল্যের সোনা ফলে। তাই মহাযোগীগণ সমস্ত কাজেই সিদ্ধ হন। বলা হয়ে থাকে সুষ্ঠভাবে কর্ম্ম করার কৌশলই যোগ।
বিধাতা পুরুষকে পুরুষ, আবার নারীকে নারী করে কেন সৃষ্টি করলেন, তা আমাদের বুদ্ধির গোচর নয়। বিধাতার এ এক আশ্চর্য্য উদ্ভাবন। পন্ডিতগণ বলে থাকেন, তা না হলে সৃষ্টিকর্ম্ম ব্যাহত হতো। যদি তাই হয়, তবে জীবলোকে এই ভেদ সৃষ্টি করলেন, কিন্তু উদ্ভিদ্লোকে এই ভেদ নেই কেন ? উদ্ভিদ-লোকে কি সৃষ্টি ব্যাহত হয়েছে ? আসলে এই যে ভেদ ঘটেছে, বা বিধাতা এই যে ভেদ ঘটিয়েছেন, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে, এক পরমানন্দের প্রবল শক্তি। অদ্বৈতে মিলনের আনন্দ নেই। আবার দেখুন মেয়েদের প্রকৃতি ও পুরুষের প্রকৃতি স্বতন্ত্র। বিশুদ্ধ জ্ঞানে নারী পুরুষে কোনো ভেদ নেই। কিন্তু ব্যবহারিক জ্ঞানে নারী পুরুষে ভেদ বিস্তর। মমতাময়ী স্ত্রী হওয়া, স্নেহময়ী মা হওয়া মেয়েদের স্বভাব। স্নেহ আছে বলে মা সন্তানের সেবা করে থাকে। না একে আমি দায়িত্ত্ব বলবো না, এটা তার স্বভাব। আবার প্রেম আছে বলে সে স্বামীর যত্ন করে থাকে, এরমধ্যেও কোনো দায় নেই। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, যখন আমরা এগুলো তার কাছে দাবি করে বসি।
জীব-জন্তু আহার-নিদ্রা-রমনে খুশী। আহার পেলে বাঁচে, আবার আঘাত পেলে মারা যায়। আর এই ভবিতব্যকে সে মেনে নিয়েই বাঁচতে চায়। এরা কখনো তর্ক করে না, কখনো এই নিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে না। কিন্তু একজন মানুষের স্বভাব হচ্ছে, কোনো কিছুকেই সে মেনে নিতে পারে না। যা করতে তাকে নিষেধ করা হয়, সেই কাজেই তার ঝোক বেশী। মানুষের জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যাতে তার কোনো হাত নেই। আর যে ঘটনায় সে সায় দিতে পারে না, সেই ঘটনাকে সে চূড়ান্ত বলে স্বীকার করতেও চায় না। আর এই জন্যই জীব জগতে সে প্রভুত্ত্ব বিস্তার করতে পেরেছে। তাই মানুষ কখনো ভালো-মানুষ হতে পারেনি। মনুষ্য সৃষ্টির আদিকাল থেকে, বিশ্বের সমস্ত ঘটনার উপরে সে নজর রেখেছে। কেন হয়, কেমন করে হয়, এই প্রশ্ন তাকে তাড়া করে নিয়ে বেরিয়েছে। মানুষের মনে প্রশ্ন জেগেছে, কে এই ঘটনার প্রেরণা দিচ্ছে ? কে এই ঘটনা ঘটাচ্ছে ? আর এই প্রেরণা শক্তির সঙ্গে সে একটা রফা করতে চেয়েছে, কখনো-কখনো সে এই প্রেরণাশক্তিকে আয়ত্ত্বে আনতে চেয়েছে। এরফলে মধ্যে জন্ম হয়েছে, সাধনার প্রবৃত্তির। তা সে বাহ্যিক জগতের ঘটনা বলুন, আর অন্তর্জগতের ঘটনা বলুন। সব ঘটনার পিছনে কে আছে, সেই পর্দা সে খুলে দেখতে চেয়েছে। এই ঘটন-পটীয়সী-জাদুকরের জামা খুলে দেখতে চেয়েছে, কে ইনি ? কিভাবে কোন ঘটনা ঘটান। কি আছে তার জাদুবাক্সে ? সব সে জানতে চায়, দেখতে চায়। . শুধু সে জানতে চায় না, সে এইসব ঘটনাকে আয়ত্ত্বে আনতে চায়। এই প্রবৃত্তি থেকেই সে সাধনা শুরু করেছে। আর সাধনার পরিণতি হচ্ছে, বহির্জগতে বিজ্ঞানশাস্ত্র, অন্তর্জগতে অধ্যাত্মশাস্ত্র। তাই ভালোমানুষী মানুষকে এগিয়ে দিতে পারে না। জিজ্ঞাসু মানুষই ভালো-মানুষ হয়।
ভগবান কোথায় কিভাবে আছেন ? তাঁকে কিভাবে জানা যায় ? ঠিক এইরকম একটা প্রশ্ন করেছিলেন, অর্জুন যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে। ঈশ্বর সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, তিনি আমাদের স্রষ্টা, তিনি আমাদের পালনকর্তা, তিনি আমাদের সংহারকর্তা। আবার তাঁকে বলাহয়ে থাকে, ভূতপাবন, ভূতেশ, দেবদেব, জগৎপতে, পুরুষোত্তম। দেখুন ঈশ্বরকে ঈশ্বরভিন্ন অন্যকেউ জানতে পারে না।
কোনো ঘটনা ঘটলে সেটা আমরা চোখের সামনে দেখতে পারি। কিন্তু সেই ঘটনার পরে যে সব প্রতিক্রিয়া হয়, তার সংখ্যা অসংখ্য। সেই অসংখ্য ঘটনা আমাদের চোখের সামনে ঘটে কিন্তু তা আমরা দেখতে পাই না। কিন্তু ঘটে। প্রত্যেক ঘটনার অসংখ্য পরিণতি, কিন্তু তার কোনো না কোনো একটিকে আমরা দেখতে পাই। কিন্তু তাই-বলে ঘটনার পরিণতি একটা নয়, বহু, অগুনতি। এই পরিণতি আদৌ বিনষ্ট হয় না। সমান্তরাল ভাবে চলতে থাকে। ভবিষ্যৎ হচ্ছে একটা সম্ভাবনা মাত্র। এই সম্ভাবনার জন্ম অনেক আগেই হয়ে রয়েছে। আপনি আজ যেভাবে চিন্তা করছেন, জীবনযাপন করছেন, কাজকর্ম্ম করছেন, তার উপরে নির্ভর করছে, জীবনের অসংখ্য সম্ভাবনার মধ্যে আপনার চোখের সামনে কোনো ঘটনা ফুটে উঠবে। একটি শিশু জন্ম গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য সম্ভাবনার জন্ম হয়েছে। এর মধ্যে শিশুর পরিবেশ, পরিস্থিতি, শিশুর পারিপার্শিক বা সম্পর্কিত সমস্ত মানুষের বা জীবের, ইচ্ছেশক্তি-জনিত কর্ম্ম, প্রকৃতির গতাগতি ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে শিশুর ভবিষ্যতের চিত্র স্পষ্ট হতে থাকবে। আর সেটাই তার জীবনে ঘটতে থাকবে।সে কতদিন বাঁচবে, কি করবে, কি হবে, সব সম্ভাবনার জন্ম শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে জন্ম নিয়েছে। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন, যা ঘটছে, সেটাই শেষ নয়, আরো অনেক কিছুই ঘটতে পারতো, বা ঘটে থাকে যা আমরা দেখতে পাই না । এখনো সেই সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায় নি, ভবিষ্যতেও শেষ হয়ে যাবে না। কেউ গাছ থেকে পড়ে গেলে, সে মারা যেতে পারে, হাত-পা ভেঙে যেতে পারে। সুচিকিৎসায় সে ভালো হয়ে যেতে পারে। আবার এমনও হতে পারে, যে তার শরীরে সামান্য আঘাত লেগেছে মাত্র। অল্পতেই সুস্থ হয়ে গেলো। এর সবগুলোই ঘটতে পারে। কিন্তু এর মধ্যে আমরা যেকোনো একটিকেই দেখতে পাই । বাকি ঘটনাগুলো আমাদের কাছে দৃশ্যমান থাকে না। যারা এই অসংখ্য দৃশ্য দেখতে পারেন, তিনিই যোগীশ্রেষ্ট, যোগেশ্বর । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে দিব্যদৃষ্টি দান করে এই অসংখ্য ঘটনা দেখিয়ে ছিলেন। যা দেখে অর্জুন, ভীত, সন্ত্রস্ত,আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার করে, এই সিনেমা বন্ধ করতে বলেছিলেন । যা ঘটতে চলেছে, তা ঘটেই রয়েছে। যা ঘটছে, তার জন্ম অনেক আগেই ঘটেছিলো। কেউ সেই বিষয়ে জ্ঞাত, আর কেউ সেই বিষয়ে অজ্ঞাত।
বিজ্ঞান বলছে, ঈশ্বর একটি অনুমানের বিষয়, যাকে বিশ্বাস না করলেও চলে। বিজ্ঞান অংকে বিশ্বাস করে। একের সঙ্গে এক যোগ করলে দুই হয়। এর অন্যথা হবার কোনো উপায় নেই। কিন্তু বিজ্ঞানের ছাত্র এটা কি জানে, যে এটা একটা সিদ্ধান্ত মাত্র, যা কল্পনা বা অনুমান করে নেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞানের এই যে দর্শন তা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না। এরা কিন্তু আবার কর্ম্মবাদে বিশ্বাস করে থাকে। অর্থাৎ কর্ম্মের একটা ফল আছে এটাকে সে বিশ্বাস করে থাকে। আসলে কর্ম্মের সঙ্গে ঈশ্বরের কোনো সম্পর্ক নেই। কর্ম্মের সঙ্গে সম্পর্ক আছে ঈশ্বরের ইচ্ছেশক্তির। এই প্রসঙ্গে একটা পুরোনো গল্প শোনাই। ক্লাসে অংক শেখানো হচ্ছে। অংকটি হচ্ছে, ধরো এক মেষপালক বারোটি মেষ নিয়ে মাঠে যাচ্ছে। তো রাস্তায় একটা বেড়া পড়লো। তো সাতটি মেষ বেড়া টপকে চলে গেলো। তাহলে কটি মেষ পড়ে থাকবে ? তো অংকে যারা ভালো, তারা সহজেই বলে দিলো, আর পাঁচটি মেষ পড়ে থাকবে। তো মাস্টার মহাশয় খুব খুশী হলেন, ছাত্রদের বুদ্ধি দেখে। ছাত্রদের মধ্যে একজন মেষপালক ছিল, সে উঠে দাঁড়ালো, আর শান্ত ভাবে বললো, স্যার একটাও ভেড়া পড়ে থাকবে না। মাস্টারমহাশয় খানিকটা বিরক্ত হলেন। আর সেই বিরক্তি নিয়ে, ব্ল্যাকবোর্ডে ১২-৭ = ৫ লিখে বললেন, এবার বুঝেছো ? ছেলেটি আবার শান্তভাবে বললো, স্যার আপনি অঙ্ক জানেন, কিন্তু ভেড়ার আচরণ জানি আমি । অঙ্কফল পাঁচ হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে একটা ভেড়াও বেড়ার এপারে থাকবে না। আপনি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। আপনি কর্ম্মে যদি বিশ্বাস করেন, তবে জানবেন এই কর্ম্ম ঈশ্বরের ইচ্ছেশক্তি ভিন্ন কিছু নয়। আর ঈশ্বরের ইচ্ছেশক্তিকে যদি মেনে নিতে হয়, ঈশ্বরকে না মেনে উপায় থাকে না।
অন্ধকার ঘরে কেরোসিনের আলো জ্বাললে, অন্ধকার দূর হবে। কিন্তু ঘর যদি বদ্ধ হয়, তবে বাইরের প্রভাত আলো ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না। আর এই বদ্ধ কেরোসিনের বাতি জ্বেলে বসে ঘুমুলে, একসময় আপনার দম বন্ধ হয়ে আসবে। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় আমাদেরকে বদ্ধ ঘরে আলোর সন্ধান দেয়। কেরোসিনের বাতি জ্বেলে দেয়। তাতে আমরা আলোকিত হই। কিন্তু একসময় ঘর হয়ে ওঠে দূষিত। তখন যদি আমরা বদ্ধ আকাশকে অসীম আকাশের সঙ্গে যুক্ত করতে পারি, তাহলে আমাদের সমস্ত তাপ-গ্লানি-কলুষতা দূর করতে পারি। তেমনি আমাদের বদ্ধ চিত্তকে ধীরে ধীরে ভূলোক থেকে ভুবর্লোক, ভুবর্লোক থেকে স্বর্গলোক, স্বর্গলোক থেকে মহঃ, মহঃ থেকে জনঃ, জনঃ থেকে তপঃ, তপঃ থেকে সত্যম লোকে পরম চৈতন্যের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, তবে এই ব্যাপ্তি আমাকে সর্বত্রে অনুভূত সম্পন্ন করে দেবে।
২৯-০৩-২০২১ : আজকাল চোখের সামনে কিছু অপদার্থ সন্তানকে দেখতে পাই, যারা পিতা-মাতা বেঁচে থাকতেই সম্পত্তির ভাগ নিয়ে আলাদা থাকতে চায়। এই ধরনের অপদার্থ সন্তান ঈশ্বরেরও অনেক আছেন । অর্থাৎ অধ্যাত্ম জগতে এই ধরনের সাধকের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। এঁরা সবসময় ঈশ্বরের কাছে বসে নিজের জীবনের দুঃখের কথা শোনান। এরা স্বভাবে দুঃখী, অতৃপ্ত । আর ঈশ্বরের কাছে, কিছু না কিছু চাইতেই থাকেন।
একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, পিতার সম্পত্তি রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য, মালিক হবার কথা মনে করা মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়। একটা কথা মনে রাখবেন, আমাদের দাতা হতে হবে, ভিক্ষারী হবার জন্য আমাদের জন্ম নয়। যদি আপনি সত্যিকারের অধ্যাত্মিক পথ অনুসরণ করে চলতে চান, তবে আপনাকে হতে হবে, কম-অহং-কেন্দ্রিক কিন্তু বেশী নিঃস্বার্থ। অন্যের প্রতি আপনার দয়া থাকবে, সহানুভূতি থাকবে। কিন্তু মোহ থাকবে না। আর এই কাজটি আপনি যত বেশি বেশি করে করতে পারবেন, ততই দেখবেন, নিজেকে হালকা মনে হচ্ছে, নিজেকে মুক্ত মনে হচ্ছে। নিজের মধ্যে একটা শান্ত-ভাব বিরাজ করছে। একটা প্রশান্তির বাতাবরণ আপনাকে সবসময় ঘিরে থাকবে। আপনি যত নেবেন, আপনি তত ছোটো হবেন। আপনি যত দেবেন, আপনি তত মহান হবেন । উজাড় করে প্রেম দিন ঈশ্বরকে। ঈশ্বর আপনাকে প্রেমধনে আপ্লুত করে দেবে। ঈশ্বর বড্ড একা। তিনি সবসময় আপনাকেই কাছে পেতে চান। ঈশ্বরের কাছে বসে ঘ্যানর ঘ্যানর না করে, একটু প্রেমের কথা বলুন।
নিভৃতে নির্জনে যোগসাধন অবশ্যম্ভাবী ফলপ্রদ। কিন্তু এই শারীরিক ও মানসিক যোগসাধন সবার পক্ষে করা সম্ভব নয়। একটা সহজ-সরল যোগ আছে যাকে বলা যেতে পারে শুধুই মানসিক যোগ। এই মানসিক যোগের কথা আমরা জানতে পারি ঋষি অষ্টাবক্রের সংহিতা থেকে। আর এই মানসিক যোগ আয়ত্ত্ব করতে পারলে, আমাদের শারীরিক যোগের আর প্রয়োজন থাকে না। যদিও শারীরিক যোগ সুস্থ থাকার একটা চাবি-কাঠিও বটে। এই সহজ-সরল যোগ হতে পারে সৎ বস্তু সম্পর্কে সঠিক ধারণা, সত্যের পথে চলা, আর বিষয়ে নির্বিকার থাকা। এর জন্য আপনাকে কোথাও যেতে হবে না, কোনো কায়িক পরিশ্রম করতে হবে না, কোনো তীর্থ ভ্রমন করতে হবে না, আবার উপবাস থাকতে হবে না। কেবলমাত্র চিত্তবৃত্তিকে নিজের বশীভূত রাখুন। লক্ষে স্থির থাকুন। এমন মানুষ বা স্থান এড়িয়ে চলুন, যেখানে গেলে, আপনার চিত্ত উদ্বেগপূর্ন বা আশঙ্কার সৃষ্টি হয়। নিজের মনের মধ্যে একটা কাল্পনিক চিন্ময় মূর্তির স্থাপন করুন। আর তাতেই মগ্ন থাকুন। সৎ বৃত্তির আলোচনা, সৎ বৃত্তির অনুশীলনে স্বল্পসময়ে যা ফল হয়, তা বছরের পর বছর যোগসাধনাতেও নাও মিলতে পারে। কথায় বলে, যার কোনো উৎকণ্ঠা নেই, তিনিই বৈকুণ্ঠবাসী। যার হৃদয় আনন্দপূর্ণ তিনিই গঙ্গাস্নাত। যার বিবেক জাগ্রত, তার আত্মজ্ঞান হবেই। এই বিবেক আর আত্মজ্ঞান হচ্ছে আমাদের শরীরে গঙ্গা যমুনা (ইড়া -পিঙ্গলা)। আর এই গঙ্গা যমুনার সঙ্গমস্থল হচ্ছে হৃদয়ের নিম্নে অনাহত চক্রে। এখানে নিজেকে নিমজ্জিত করুন। আর সঙ্গমের রসামৃত পান করতে থাকুন ।
ষঠ্চক্র ভেদ।
পঞ্চকোষের সমষ্টি এই জীবদেহ। অনন্ময় কোষ ঘিরে আছে মনোময়কোষ, মনোময় কোষ ঘিরে আছে প্রাণময় কোষ। আবার প্রাণময় কোষ ঘিরে আছে বিজ্ঞানময় কোষ। আবার বিজ্ঞানময় কোষে ঘিরে অবস্থান করছে আনন্দময় কোষ। অঙ্গুষ্ঠ পরিমিত এই জীবাত্মা এই আনন্দময়কোষ কে অবলম্বন করে অবস্থান করছে। এই যে বিভিন্ন কোষের অবস্থান ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে, আর এর গতিধারা নিস্পন্ন হয় আমাদের চার অবস্থার মধ্যে দিয়ে, জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি ও তুরীয়। একেই কেউ কেউ বলেন, জাগ্রতে চৈতন্য অবস্থা, স্বপ্নাবস্থায় তৈজস, সুসুপ্তিতে প্রজ্ঞা, আর তুরীয় অবস্থায় ব্রহ্ম। এই চার অবস্থা সমস্ত জীবের শরীরে উপলব্ধ হয়। আর এই চার অবস্থা, বলা হয়ে প্রণব দ্বারা সাধিত হয়।
নাড়ীসমূহের মধ্যে নিরন্তর বায়ুরাশি প্রবাহিত হচ্ছে। একে অবলম্বন করেই পাঁচটি প্রধান বায়ু সহ দশ বায়ুর অবস্থান। প্রাণ ও অপান বায়ুর সংঘর্ষে বায়ুর গতি উর্দ্ধমুখী হয়। আর যদি সাধনবলে এই বায়ু, সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে অবস্থিত ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়ে উর্দ্ধগামী হয়, তাহলে মূলাধার থেকে এই বায়ুশক্তি জীবাত্মাকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন চক্র স্বাধিষ্ঠান-মনিপুর-অনাহত-আজ্ঞা-সহস্রারে হয়ে জ্ঞান ও অনন্তময় আকাশে, অর্থাৎ বিন্দুতে পদ্মমধ্যে যে আত্মা অবস্থান করছেন, সেখানে গিয়ে মিলিত হন। এখানেই ভূ-ভুব-স্বঃ-মহঃ-জনঃ-তপঃ-সত্যম অর্থাৎ সমস্ত লোকের অধিষ্ঠানভূমি। জীবাত্মার সঙ্গে আত্মার এই সম্মিলনই ষঠ্চক্রভেদ নাম দিয়েছেন যোগী-মহাপুরুষগন।
ঈশ্বর আছেন কি নেই, এই কুতর্কের মধ্যে যাবেন না। এতে আপনার জীবনের অহেতুক সময় নষ্ট হবে।বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় নিজেকে দোলাবেন না। আপনি বরং নিজেকে জানার চেষ্টা করুন। আপনি নিশ্চই আছেন, এই বিশ্বাসে আপনি দৃঢ় হোন। এরপর ধীরে ধীরে নিজের মধ্যে অনুসন্ধান করতে চেষ্টা করুন। প্রথমে আপনার দেহকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করুন। কি দিয়ে, কিভাবে আপনার এই দেহ তৈরী হয়েছে, কিভাবেই বা এই দেহ ক্রিয়াশীল থাকছে, সেই বিষয়ে ভালোভাবে বুঝবার চেষ্টা করুন। দেহে যে ইন্দ্রিয়শক্তি, অর্থাৎ জ্ঞান ইন্দ্রিয়, ও কর্ম্ম ইন্দ্রিয় এরা কিভাবে কার সাহায্যে কাজ করছে, সেদিকে খেয়াল করুন। এর পর, এক-এক করে আপনার মন, আপনার বুদ্ধি, আপনার চিত্তকে বুঝবার চেষ্টা করুন। এবং সবশেষে আপনার মধ্যে যে চিন্তার উদয় হচ্ছে, আপনার মধ্যে যে বাসনা-সংকল্প ইত্যাদির উদয় হচ্ছে, সেটাকে ভালোভাবে লক্ষ করতে থাকুন। সবশেষে আপনার মধ্যে যে মায়া-মমতা-ভক্তি-শ্রদ্ধার উদয় হচ্ছে সেগুলোকে বিচার করতে শুরু করুন। কোথা থেকে আসছে এই চিন্তা, বাসনা, মায়া, ভক্তি, শ্রদ্ধা। এসব করতে করতে যার কাছে আপনি আপনার অজ্ঞাতসারে পৌঁছে যাবেন, তিনিই ঈশ্বরনামক বিশ্বশক্তি।
১০-০৪-২০২১
জীবন অস্থির। আমরা প্রতিনিয়ত মৃত্যুর দিকে ধেয়ে চলেছি। যার জন্ম আছে, তার বৃদ্ধি আছে, আবার একসময় তার নাশ অবশ্যম্ভাবী। আবার যার বন্ধন আছে, তার মুক্তিও আছে। শৈশবকে আমরা ধরে রাখতে পারিনা। যতই যত্নশীল হই না কেন, যৌবন আপনাকে একদিন ছেড়ে চলে যাবে। জরা শরীরকে জড়িয়েই অবস্থান করছে। যার শরীর নেই, তার শৈশব নেই, যৌবন নেই, জরা নেই, বার্ধক্য নেই। এগুলো সবই কালের পরিণতি। কাল কাউকে রেহাই দেয় না। যোগসিদ্ধ পুরুষের শরীরও বিনষ্ট হয়, ধ্রুবের জীবনও চিরস্থায়ী নয়। স্বয়ং ব্রহ্মার একটা আয়ুষ্কাল আছে। এমনকি আকাশ, বায়ু, জল, অগ্নি, মৃত্তিকা একসময় ছিল না আবার একসময় থাকবে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবাই জন্ম থেকে বিনাশের দিকে ধাবিত হচ্ছে। স্বর্গের দেবকুল,, পৃথিবীর জীবকুল, পাতালের নাগকুল, সবারই কোনো না কোনো কল্পে সৃষ্টি হয়েছে, আবার কোনো না কোনো কল্পে বিনষ্ট হয়ে যাবে।
কিন্তু কথা হচ্ছে এই যে পরিবর্তন, এর মধ্য দিয়ে আমরা কোথায় চলেছি ? আমাদের পরিণতি কি ? দেখুন, নদীতে ঝাঁপ দেব, আর আমার গায়ে জল লাগবে না, এমনটা হতে পারে না। আমরা সংসারে বিচরণ করবো, আর আমাদের কামনা, বাসনা, সংকল্প, এমনকি আমাদের কর্ম্ম থাকবে না তা হতে পারে না। সংসারের অস্তিত্ত্ব যতক্ষন আমাদের মধ্যে বিরাজ করবে, ততক্ষন আমাদের মধ্যে স্ব-রূপের জ্ঞান হবে না। এই অসার সংসার অজ্ঞান থেকে উৎপন্ন হয়েছে, আবার এই অজ্ঞানের নাশেই সংসারের অবসান হয়। এর জন্য কিছুই ত্যাগ করতে হয় না, কিছুই সঞ্চয় করতে হয় না । শুধু সত্যজ্ঞান এই সংসারের নাশের কারন হতে পারে। পরমাত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন, নিছক এই ভাবনা থেকেই আমরা সাংসারিক হয়েছি। আবার এই ভাবনা যখন আমাদের দূরীভূত হবে, তখন আমরা আবার সেই পরমাত্মাতেই স্থিত হবো। এবং এটাই আমাদের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি।
উপনিষদ বলছে, জ্ঞান যার বল, আত্মবিদ্যা যার সম্বল, মননশীলতা যার ধর্ম্ম, তিনিই ব্রাহ্মণ। যিনি ব্রাহ্মণ যার ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে, যার মনে শুভসংস্কার সুদৃঢ় হয়েছে, তিনি অশুভকর্ম্মে নিযুক্ত হতে পারেন না। যিনি ক্ষুধা-পিপাসা-শোক-মোহ-জরা-মৃত্যুর অতীত, সেই আত্মার না আছে, পুত্র কামনা, না আছে বিত্ত কামনা, এমনকি না আছে লোক-হিত কামনা। ইনি যথেচ্ছাচারী। এনার আচরণ মাত্রই শুভফলপ্রদ।
১৫/০৪/২০২১ - ১লা বৈশাখ।
আমাদের সমাজ পুরুষ-শাসিত। এমনকি এই যে সাধু সমাজ সেটিও পুরুষশাসিত। ফলতঃ এই পুরুষ-প্রবল ব্যক্তিত্ত্ব হুকুম জারি করে থাকে যে কামিনী-কাঞ্চন থেকে সাবধান। অর্থাৎ মেয়েমানুষ ও স্বর্ণাদি থেকে সাবধান থাকবে। পারতপক্ষে এদেরকে এড়িয়ে চলবে। আর তা যদি না পারো, তবে তোমার দ্বারা ধম্ম-কম্ম হবে না। তো আমরা যে মায়ের কোলে বড়ো হয়েছি, যে বোনের সেবাযত্নে নিজেকে ভালো রাখতে পেরেছি, তাদের দিকে আমার মুখ ফিরিয়ে রাখতে হবে ? এই কথাটা আমরা একটু ভালো করে বুঝতে চেষ্টা করবো।
দেখুন, যাদের চিন্তায়, কথায় ও কাজে পবিত্রতা নেই, তারা সংসার জগতে যতই উন্নতি করুক না কেন, আধ্যাত্মিক জগতে তাদের উন্নতি হওয়া সম্ভব নয়। তাই রামকৃষ্ণের মতো মহাপুরুষ বলতেন, কামিনী-কাঞ্চন থেকে সাবধান থাকবে। আর এটা তিনি বলতেন তাদেরই যারা নিজেকে পুরুষ ভাবে অর্থাৎ পুরুষ মানুষ। এই রামকৃষ্ণের কাছে কিন্তু অনেক মেয়ে-মানুষ আসতেন, তাদেরকে তিনি বলতেন, পুরুষ মানুষের ফাঁস থেকে সাবধান থাকবে, তা সে নিকট আত্মীয় হলেও। এইসব মায়েরা কিন্তু রামকৃষ্ণকে কখনো একজন পুরুষমানুষ বলে ভাবতেন না। বরং তাদের একজন আপনজন বলেই ভাবতেন। তাই তারা ঠাকুরের কাছে ছিলেন স্বচ্ছন্দ, সাবলীল।
পুকুরে স্নান করছেন, কয়েকজন যুবতী নারী। ১৮ বছরের পরীক্ষিত তাদের পাশ কেটে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। যুৱতীগণ চেয়ে চেয়ে দেখলো। ব্যাসদেব পুত্র পরীক্ষিত, যুবক । ঋষি ব্যাসদেবের বয়ঃবৃদ্ধ। তিনি পরীক্ষিতের খোঁজে ওই পুকুরের পাশ দিয়ে ছুটলেন। যুবতী নারীগণ ব্যাসদেবকে দেখে আঁচলে মুখ ঢাকলেন। আসলে পরীক্ষিত স্নানরত নারীদের দেখে উপেক্ষা করবার স্বভাবে রপ্ত ছিলেন। কিন্তু ব্যাসদেব হয়তো তা ছিলেন না।
ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব নিজে বিয়ে করে সংসার করেছিলেন। কিন্তু বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যে আকর্ষণ তাকে তিনি দমন করতে পেরেছিলেন। দেখুন, সন্তানের কামনায় বা বংশ রক্ষায়, সৃষ্টি রক্ষায়, প্রকৃতির সঙ্গে ক্রিয়ারত হওয়া, আবশ্যিক শুধু নয়, এটি প্রত্যেক জীবের ধর্ম্ম। কিন্তু নিজের শারীরিক সুখের আশায়, বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে মিলিত হওয়া, শুধু অনভিপ্রেত নয়, গর্হিত কাজ । তাই ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলতেন, দু-একটি সন্তান হবার পরে, স্বামী-স্ত্রীর উচিত ভাই-বোনের মতো থাকা।
আসলে প্রত্যেক জীবের তা সে উন্নত বলুন বা অনুন্নত বলুন, সবাই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে থাকে। এই আকর্ষণ যদি শারীরিক হয়, তবে তাকে পরিহার করুন। কেননা শরীর হচ্ছে ঈশ্বরের মন্দির। শরীর ঈশ্বর-সাধনার মাধ্যম, আর এই শরীরের রজঃ-বীর্য শক্তি আমাদেরকে তেজস্বী করে, বলবান করে, উন্নত চিন্তার অধিকারী করে। তো এই অমিতশক্তি যদি আপনি নিতান্ত শারীরিক সুখের জন্য ব্যয় করেন, তবে তা হচ্ছে, ভষ্মে ঘি ঢালা। শরীরকে শক্তিহীন করা মানে ঈশ্বর সাধনায় ব্যাঘাত। সুস্থ-সবল শরীরেই যোগ সাধনা সম্ভব। তো নারী-বর্জিত জীবন, বা পুরুষ-বর্জিত জীবন নয়, জীবন হবে পবিত্র-সুন্দর-উন্নত চিন্তার অধিকারী।
১৮-৪-২১
জীব যখন অস্থির, অনিশ্চিত, উত্তেজনায় ভোগে, মানুষ যখন স্বাধীনতার অভাবে, আলো-বাতাসহীন মনের কারাগারে আবদ্ধ হয়, তখন সেই কারাগারে জন্ম নেয়, শ্রীকৃষ্ণ। মনের অন্ধকারকে দূর ক'রে, প্রেম-আলোর সন্ধান, মনের অন্ধকার দূর করে সীমাহীন মুক্তির আলো, দেখা দেয় তখন। মানুষ তখন তামসিক অলসতা দূর করে, আত্মবিশ্বাস, অসীম উদ্যোম, ও বুদ্ধির কৌশলের উপরে নির্ভর করে, জীবনপথে চলবার স্বচ্ছন্দতা অনুভব করে। নিদ্রিত সত্তা তখন জাগ্রত হয়। কৃষ্ণ আবির্ভাবে জীবনের ভীরুতা দূর হয়ে যায়, দ্বিধা-দ্বন্দ দূর হয়ে জীবন গতিশীল ও ছন্দবদ্ধ হয়ে ওঠে। কৃষ্ণ যেন প্রাণের বীণায় সুর ভরিয়ে দেয়। মানুষ তখন জাতি, বর্ণ, আচার, প্রথা, বঞ্চনা, ঘৃণা, অবহেলা, লাঞ্ছনা, অপমান, বিড়াম্বনা ইত্যাদিকে পিছনে ফেলে, এক গৌরবময় মর্যদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে নিজেকে। এই মানুষ তখন সমদর্শী, সকলের মনি হয়ে ওঠে। জাতি-ধর্ম্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে সে কোলে টেনে নেয়। এই পথই বিপ্লবের পথ, সাফল্যের পথ।
অধ্যাত্ম জীবনে গুরুর নির্দেশ ভীষণ ভাবে দরকার। কিন্তু শুধু গুরুর নির্দেশ হলেই হবে না, সাধককে হতে হবে গুরুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কেননা গুরুবাক্য প্রথম দিকে বিনাবাক্যে মেনে নিতে হয়। অনেকসময় আমরা আমাদের বুদ্ধির প্রয়োগে গুরুবাক্যকে বিচার করে থাকি। কিন্তু আমাদের একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, যে আমাদের সবার বুদ্ধি কেবলমাত্র আমাদের অভিজ্ঞতার ফসল, যা আমি আগে অর্জন করেছি। কিন্তু গুরুবাক্য বিচারের উর্দ্ধে। গুরুবাক্য একমাত্র পরীক্ষা সাপেক্ষ। আর এই পরীক্ষায় তারাই সাফল্য পায় , যারা আন্তরিক ও অনুভূতিসম্পন্ন। আর এই অনুভূতিসম্পন্ন হতে গেলে আমাদের কঠোর সাধনা করতে হবে। সত্য়বস্তু জানতে গেলে, আমাদের ব্যাকুলতা চাই। একটা জিনিস জানবেন, আপনার কাছে যা আছে, তা আপনি নিশ্চই অন্যকে দিতে পারেন। কিন্তু গুরুদেব কাকে কি দেবেন, সেটা নির্ভর করছে, সাধকের চাহিদা, ব্যাকুলতা ও গুরুদেবের দয়ার উপরে। একটা জিনিস জানবেন, আপনি যদি আনন্দে থাকেন, তবে নিশ্চই আপনি অন্যকে আনন্দ দিতে পারবেন। আর আপনি যদি নিজেই নিরানন্দে দিন কাটান, তবে আপনি অন্যদের নিরানন্দই দিয়ে যাবেন। আমাদের শরীরের মধ্যে একধরনের হরমন নিঃসৃত, যা কাছাকাছি যারা থাকেন, তাদেরকে উদ্দীপ্ত করতে পারে। উত্তম আচার্য্য তার শিষ্যের মধ্যে অধ্যাত্ম স্পন্দনসমূহ সঞ্চারণ করে থাকেন। এটি আর কিছু নয়, আমাদের শরীরের এই বিশেষ হরমোনের ক্রিয়া।
২০-০৪-২০২১
আজ আমাকে পাগলে পেয়েছে। তাই আজকের কথাগুলো পাগলের প্রলাপ বই কিছু নয়। আসলে সকালে আনন্দবাজারের একটা প্রতিবেদন তাং ২০-৪-২০২১, আমাকে পাগলপ্রায় করে দিয়েছে। নিবেদিতা সিংহ নামে এক শোককাতুর মেয়ে, মালদহ - ইংলিশবাজার থেকে লিখছেন :
"মাত্র দু'সপ্তাহ আগে করোনায় বাবাকে হারিয়েছি। বয়স হয়েছিল ৫৭ বছর। সুগার ও রক্তচাপ জনিত সমস্যা ছিল। তবে বাবা খুব স্বাস্থ্য সচেতন ছিলেন, রোজ সকালে হাটতে যেতেন। শরীর চর্চা করতেন। মাস্ক পড়তেন। নিয়মিত স্যানিটাইজার ব্যবহার করতেন। অফিস থেকে ফিরে জামা-কাপড় বাইরে রেখে তবেই ঘরে ঢুকতেন। তার পর স্নান করেই ঘরে আসতেন। এতো স্বাস্থ্যবিধি মানা সত্ত্বেও বাবা কারোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন। মালদহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি করেও তাকে বাঁচাতে পারিনি।"
এই খবর আমাকে বিভ্রান্ত করেছে। করোনা শুরুর প্রথম দিকে আমরা একটা ভিডিও প্রকাশ করেছিলেন, তাতে কোরোনার প্রতিষেধক হিসেবে আমরা বাবা রামদেব প্রদত্ত কিছু প্রাণায়াম (যদিও এগুলো আমাদের প্রাচীন মুনি ঋষিগণ-এর বিদ্যা ) প্রকাশ করেছিলাম। আমরা বলেছিলাম, লকডাউন কোনো দীর্ঘস্থায়ী সমাধান নয়, এতে মানুষের দৈনন্দিন জীবন-যাপন সমূহ বিপদের মধ্যে পড়বে । সাময়িক ভাবে, স্বাস্থ্যব্যবস্থার বা চিকিৎসা পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য, এটির প্রয়োজন আছে। কিন্তু এটি কোনো স্থায়ী সমাধান দিতে পারে না।
আমাদের যেটা করতে হবে, তা হচ্ছে, আমাদের শরীরের ভিতরে ভগবান প্রদত্ত যে দুই ডাক্তার আছেন, অশ্বিনীকুমার-দ্বয়, তাদের শরণ নিতে হবে। এতে করে উপরতলা থেকে আপত্তি আসে, প্রাণায়াম বাচ্চাদের ক্ষতি হতে পারে, ইত্যাদি ইত্যাদি। তো ভিডিওটি ভাইরাল হাওয়া সত্ত্বেও এটি আমরা youtube থেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হই । তবে আমাদের মনে হচ্ছে, ভিডিওটি তুলে না নিলে, মানুষের উপকার হতে পারতো।
করোনা মোকাবিলায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা, তার স্নেহের পরশ, তার নির্ভীকতা আমাকে স্পর্শ করেছে। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আসলে বিশেজ্ঞের পরামর্শ না নিয়ে, নিজেকে বিষেশজ্ঞ ভাবা মূর্খামি ছাড়া আর কিছু নয়। তার একগুঁয়েমি, ক্ষমতার দম্ভ, আগ্রাসী মনোভাব, হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নিজেকে প্রশ্নাতীত ভাবা, দেশের মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। আপনি বলতে পারেন, প্রধানমন্ত্রী কি করোনার আমদানি করেছেন ? না কেউ আমদানি করেননি, কিন্তু আমদানিজাত দ্রব্য মজুত করবার দায়িত্ত্ব পালন করেছেন তিনি, একথা শুনতে খারাপ লাগলেও অপ্রিয় সত্য।
এখন, এক প্রশ্নের মুখে, মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, লকডাউন, নাইট কার্ফু কোনও সমাধান নয়। .....
করোনা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে নানান রকম ভুল ধারণার জন্ম হয়েছে। আসলে আমাদের দৃষ্টিশক্তির বাইরে, যে বস্তু আছে, তার সম্পর্কে আমরা যা কিছু বলতে পারি। সেটি আমাদের দৃষ্টিভ্রম হতে পারে, আবার আমার কাল্পনিক ভয় থেকেও উৎপন্ন হতে পারে, আবার অতি উৎসাহের বশে ভয়ঙ্কর রূপ-বর্ণন হতে পারে।
দেখুন, শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য প্রাণায়াম। অর্থাৎ প্রাণশক্তিকে উজ্জীবিত রাখবার জন্য প্রাণায়াম। শরীর চর্চা, মূলত সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি, ও শারীরিক ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য করা হয়ে থাকে। এতে করে কিছু কিছু রোগের প্রতিকার সম্ভব, কিন্তু প্রাণশক্তিকে উজ্জীবিত রাখবার জন্য, অর্থাৎ সুস্থ শরীরে বেঁচে থাকবার জন্য প্রাণায়ামের কোনো বিকল্প নেই।কথায় বলে, যারা মানসিক দিকে থেকে দুর্বল, সবসময় ক্ষুৎখুঁৎ করেন, যারা অতি সাবধানী, তাদের মধ্যে রোগপ্রতিরোধ শক্তি কমে যায়। ফলে তাদের রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
ভ্যাকসিন বা টিকা বেরিয়ে গেছে, আপনি হয়তো সেই ভ্যাকসিনের দুটি-দুটো ডোজ নিয়ে নিয়েছেন, এবার আপনি নিশ্চিত যে আপনাকে আর করোনায় ছুঁতে পারবে না। দেখুন, আমরা সবাই নিয়তি-বধ্য। নিয়তি আমাদেরকে পরিণতির দিকে অবশ্যই টেনে নিয়ে যাবে। এর জন্য আমাদেরকে আলাদা করে কিছু করবার প্রয়োজন নেই। পৃকৃতি তার নিজের নিয়মে যেমন জীবের জন্ম দেয়, তেমনি প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মেই শরীরকে নাশ করে থাকে। ভ্যাকসিন সম্পর্কে শেষ কথা বলবার সময় এখনো আসেনি। আসলে টিকা হলো প্রতিষেধক মাত্র। টিকা হচ্ছে নির্দিষ্ট ভাইরাসের জীবিত বা মৃত কোষ এমন পরিমানে মানুষের দেহে প্রবেশ করানো হয়, যাতে সে রোগ সৃষ্টি করতে পারে না, কিন্তু প্রতিরোধশক্তি তৈরী করতে পারে। অর্থাৎ এন্টিবডি তৈরী করতে পারে। ভ্যাকসিন নেবার পরে, যদি আপনার শরীরে সেই একই ভাইরাস নতুন করে প্রবেশ করে, তবে তাকে ভ্যাকসিন ভাইরাস চিনে ফেলে, এবং নতুন প্রবেশকারীকে ধংশ করে দেয়। কুকুর তাড়াবার জন্য, কুকুর পোষা আর কি। বিষ দিয়ে বিষ নাবানো। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। নভেল করোনা ভাইরাস এক্কেবারে নতুন প্রজন্ম। তাই আমাদের শরীরে অর্থাৎ আমাদের রক্তের লিম্ফোসাইটে তার (নতুন ভাইরাসের) কোনো এন্টিবডি নেই। তাই এটি আমাদের শরীরে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তার সন্ধান আমাদের জানা নেই। জানতে গেলে আমাদের আরো অনেকদিন অপেক্ষা করতে হবে, এমনকি বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে। যেকোনো ভ্যাকসিন তৈরী করা একটা জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। জটিলকে বিভিন্ন পরীক্ষার-নিরীক্ষার সাহায্যে হয়তো সহজ করা যেতে পারে, কিন্তু সময়কে কেউ এগিয়ে নিতে পারে না। সময়কে কেউ গুটিয়ে আনতেও পারে না।ভবিষ্যৎ কখনো বর্তমান হতে পারে না। বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও তার ফলাফলকে নিরীক্ষণ করে, ভুল সংশোধন করতে করতে এগুতে হয়। বহু ও বিভিন্ন ধরনের মানুষের মধ্যে, এমনকি ভৌগলিক সীমা ছাড়িয়ে এগুতে হয় এই পথে। তবেই সন্তোষজনক উত্তর মিলতে পারে। আমাদের বাজারে যে সব ভ্যাকসিন এসেছে, এটা কতটা কার্যকরী হবে, বা আদৌ কার্যকরী হবে কি না, সময়ে তার উত্তর মিলবে। তবে, কিছুকিছু ক্ষেত্রে যে কার্যকরী না হবার কথা কানে আসছে, তা উদ্বেগের। তাই ভাসিন প্রয়োগের বা সাময়িক ভাবে প্রয়োগ বন্ধের জন্য কঠিন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে কি না তা এখনই বলা যায় না। কারন ভাইরাসের গতি প্রকৃতি, এমনকি তার পরিবর্তনের ধারা আমাদের কাছে এখনো অজ্ঞাত। ভারতসহ বহু দেশের বিখ্যাত বিজ্ঞানীগন অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, এই মহামারী থেকে রেহাই পাবার জন্য। কিন্তু একটা জিনিস সত্য যে ম্যাজিক্যালি কিছু হবার নয়। ভরসা এখন সাবান, মাস্ক ও দৈহিক দূরত্ত্ব, সর্বোপরি প্রাণায়াম।
তবে আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, করোনা একটা নিরীহ ভাইরাস। এটি কোনো রোগের সৃষ্টি করতে পারে না। কেবলমাত্র আপনার মধ্যে যদি কোনো রোগ থাকে তাকে সে বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে মাত্র। আসলে ভাইরাস নিজেকে বাঁচাতে চায়। তাই আপনার শরীরে যদি কোনো রোগ আগে থেকে, থেকে থাকে, তবে আপনি সেই রোগের বা সেই উপসর্গের চিকিৎসা করান। করোনা ভাইরাস-এর সংক্রমণ ঠেকানো অসম্ভব নয়। এই সংক্রমণের মৃত্যুহার মাত্র তিন শতাংশের কাছাকাছি। আবার শতকরা ৮০ ভাগ সংক্রমিত ব্যক্তি বিনা চিকিৎসাতেই সেরে উঠতে পারেন, যদি বিশ্রাম নিতে পারেন, সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে দূরে থাকেন, ও নিভৃতে বাস করতে পারেন। প্রাণায়াম - প্রাণায়াম- প্রাণায়াম ভবিষ্যতে যে কোনো সংক্রমণ থেকে আপনাকে রেহাই দিতে পারে। অহেতুক আতঙ্কিত হবেন না। আতঙ্ক ছাড়াবেন না। মানুষ বহু মহামারী পেড়িয়ে আজ এই অবস্থায় এসেছে। ঈশ্বরের শ্রেষ্ট সৃষ্টি মনুষ্য। তাই ঈশ্বরকে অনুভব করবার জন্য, আমাদের এই মনুষ্য দেহে বারবার আসতেই হবে। ভালো থাকবেন। অবশ্য়ই ভালো থাকবেন। স্বয়ং ভগবান বলতেই পারেন, ভয় কি রে পাগল, আমি তো আছি।
২২-০৪-২০২১
আমার এক বন্ধু ফোনে জানালো, "আমার মুখে কোনো স্বাদ নেই। আমাকে ডাক্তারবাবু বললেন, কোভিড টেস্ট করুন, শীঘ্র। কোভিড টেস্টে নেগেটিভ এসেছে। আচ্ছা আমার কি করোনা হয়েছে ?আমার ভীষণ ভয়-ভয় করছে, কিন্তু কি করবো, বুঝতে পারছি না। "
কোভিড টেস্ট করে নেগেটিভ এসেছে, তথাপি আমার বন্ধু নিশ্চিত হতে পারছেন না। কারন তাকে বলা হয়েছে, বা তিনি শুনেছেন, করোনা হলে নাকে গন্ধ-বোধ লোপ পায়, জিভে কোনো স্বাদবোধ থাকে না। যখন দেশে কোরোনার প্রভাব পড়ে নি, এই রোগ দুটো তখনও ছিলো কিন্তু তখন কোরোনার আতঙ্ক ছিলো না। তাই এই রোগের চিকিৎসা ডাক্তারবাবুগন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে করতে পারতেন। এখন আর পারেন না। যেন চিকিৎসা শাস্ত্রকে নতুন করে লিখতে হবে। আগে যে চিকিৎসাবিদ্যা তিনি আয়ত্ত্ব করেছিলেন , তাতে কোথায় যেন একটা চিড় ধরেছে।
দেখুন স্বাদবোধ কমে যেতে পারে নানান কারনে। আমাদের যে স্বাদবোধ তা আসে, আমাদের জিভের পিছনে থাকা স্বাদকোরক বা টেস্ট বাড্স থেকে। এই টেস্ট বাড্স নানান কারনে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে, যেমন জিভের অসুখ, মাড়ির অসুখ, টনসিলের গোলমাল, এমনকি নানানরকম নেশা থেকেও আমাদের স্বাদবোধ কমে যেতে পারে। এই রোগে আক্রান্ত রুগীর কাছে তখন টক-মিষ্টি-লবন তখন একই রকম লাগে। তবে ঝালবোধ সহজে কিন্তু যায় না। এর জন্য নির্দিষ্ট চিকিৎসা আছে, এমনকি কিছুদিন অপেক্ষা করলেও, দেখা যায় স্বাভাবিক ভাবেই এই স্বাদবোধ ফিরে আসে, অর্থাৎ আমাদের মধ্যে যে রোগপ্রতিরোধ শক্তি আছে, সেই শক্তি আমাদেরকে নিরাময় করে থাকে।
আবার দেখুন, আমরা গন্ধ পাই স্নায়ু থেকে, এই স্নায়ুকে বলা হয় অলফ্যাক্টরি নার্ভ। এখন আমাদের নাকে যদি অতিরিক্ত প্রদাহ হয়, সাইনোসাইটিস হয়, এমনকি নাকের হাড় বেশী বেঁকে গেলে, নাকে শ্লেষ্মা জমলে, ঝিল্লি ও গ্রন্থি কোনো কারনে শুকিয়ে গেলে, আমাদের ঘ্রাণশক্তি বাধাপ্রাপ্ত হয়। সময়মতো চিকিৎসা করলে, অবশ্য়ই আপনি ঘ্রাণশক্তি ফিরে পাবেন। এছাড়া, ব্রেন টিউমার হলে, এমনকি মানসিক রুগীর ক্ষেত্রেও এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। আবার দেখুন, আপনি যদি দীর্ঘকাল থেকে নস্যি নেবার অভ্যাস করেন, মদ্যপান করেন, বিড়ি-সিগারেট পান করেন, তবেও আপনার নাকের গন্ধ অনুভব করে যে স্নায়ু তা স্বাভাবিক ক্রিয়া করতে বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে। আর আপনি ঘ্রাণশক্তি হারাতে পারেন। তবে এই উপসর্গের উৎস খুঁজে চিকিৎসা করতে হয়। করোনা হয়েছে ভেবে আতঙ্কগ্রস্থ হওয়া মানে নিজেকে ভুল পথে পরিচালিত করা। দেখুন এলোপ্যাথিতে রোগ নিরাময়ের চিকিৎসা নেই , কিন্তু রোগের উপশম করবার চিকিৎস, আছে, আছে উপসর্গের চিকিৎসা। আর এতেই আমরা ভালো থাকতে পারি। তাই বলছি, ভয় নয়, আতঙ্ক নয়, উপযুক্ত চিকিৎসাই মানুষকে ভালো রাখতে পারে। তবে, আমি বলি, সব উপসর্গ চলে যাবে, আপনি শুধু প্রাণের আয়াম করুন। সমস্ত রকম নেশা থেকে বিরত থাকুন। প্রতিদিন যেমন বেঁচে থাকবার জন্য, খাবার খান, জল পান করছেন, বাহ্য-প্রস্রাব করছেন, তেমনি জীবনের সঙ্গে জুড়ে নিন আর একটা জিনিস তা হচ্ছে, আমাদের প্রাচীন ঋষিদের দেওয়া যোগবিদ্যা, যার প্রবেশ পথ হচ্ছে প্রাণায়াম ও সঠিক চিন্তা। সবাই ভালো থাকুন। ভগবান অবশ্য়ই সবাইকে ভালো রাখবেন।
ভস্ত্রিকা, কপালভাতি, বাহ্য, অগ্নিসার, অনুলোম-বিলোম, ভ্রামরী, উদ্গীথ, এই সাতটি প্রাণায়াম। এর মধ্যে কপালভাতি (সেকেন্ডে ১ বার) ১০-১৫ মিনিট, ও অনুলোম-বিলোম ধীরে ধীরে ১০-১৫ মিনিট, অন্যগুলো ২ মিনিট করে।
২৩.০৪.২০২১।
ধ্যানের প্রথম স্তর হচ্ছে প্রাণায়াম। প্রাণায়াম সম্পর্কে আজ একটা গুহ্যকথা বলি। আমরা জানি প্রাণায়াম হচ্ছে অধ্যাত্ম জগতে প্রবেশের দ্বার বিশেষ। এই প্রাণায়ামের সিঁড়ি বেয়ে আমাদের অধ্যাত্ম জগতে প্রবেশ করতে হয়। এই প্রাণায়ামের উপরি পাওয়া হিসেবে আমরা পাই, শারীরিক সুস্থতা-পবিত্রতা। এই প্রাণায়াম ত্রিপদ বিশিষ্ট । রেচক, পূরক, কুম্ভক। কুম্ভকের আবার দুই-পদ। অন্তর-কুম্ভক ও বাহ্য কুম্ভক। এগুলো আমরা সবাই জানি। এখন কথা হচ্ছে এর মধ্যে আবার গুহ্য তত্ত্ব কি আছে ? দেখুন, আমাদের এই মনই পারে মনকে দমন করতে। আবার মনই মনকে সুপথে বা কুপথে পরিচালিত করতে পারে। মন সবসময় বহির্মুখী। এই মনকে অন্তর্মুখী করবার নাম পূরক। আবার মন যে মিথ্যা জ্ঞান সংগ্রহ করছে, তাকে পরিত্যাগ করা হচ্ছে রেচক। অর্থাৎ বাহ্যিক জ্ঞানকে অথবা বলা যেতে পারে অজ্ঞানকে দূরীভূত করবার নামই রেচক। মনের কালিমা দূর করতে হয় এই রেচকের মাধ্যমে। আবার একই ব্রহ্ম অনন্ত জগতে বিরাজিত, এই জ্ঞানকে সংগ্রহ করবার নাম পূরক। আর মনে যখন কোনো বৃত্তি থাকবে না, সেই অবস্থাকে বলা হয়, কুম্ভক। অর্থাৎ মন যখন আত্মাতে স্থিতি লাভ করবে, তখন আসল কুম্ভক হবে। বাহ্য কুম্ভক অনাত্মা থেকে বিরত করে থাকে, অর্থাৎ অনাত্মাকে বাইরে বের করে দিয়ে, স্থিতি লাভ করা হয়ে থাকে। আর অন্তর-কুম্ভক আত্মাতে স্থিতি লাভ করা।
ধ্যানের দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে প্রত্যাহার। প্রত্যাহার হচ্ছে, ইষ্ট চিন্তা করতে করতে যখন অন্য বিষয়ে ধাবিত হয়, তখন তাকে টেনে নিয়ে ইষ্টে নিবিষ্ট করাকে বলে প্রত্যাহার। এটুকু আমরা জানি। আসলে প্রাণায়ামের ফলে দেহ যখন স্বচ্ছ হয়ে যায়, শুদ্ধ হয়ে যায়, তখন আমাদের চিত্তে বিষয়বর্জিত আনন্দের সন্ধান পায়। আর এই বিষয়বর্জিত আনন্দের সন্ধান মিলে গেলে, মন তখন আত্মানন্দে বিভোর হয়ে যায়। রসে-বশে থাকো রে মন যেও নাকো বাহির ঘরে। যাবো তো কুম্ভে, যাত্রাপথের দৃশ্যে মজে গেলে কুম্ভে যাওয়া হবে না। এই যাত্রাপথের দৃশ্যকে পরিত্যাগ করে আমাদের লক্ষে স্থির থাকাকেই বলে প্রত্যাহার। দেহের ক্ষুধা সীমিত, দেহের কষ্টও সীমিত। পেটের আকার ছোট, তিনটে রুটি খেলেই, পেট ভোরে যায়। কিন্তু মনের ক্ষিধে সীমাহীন, তাকে মেটানো সহজ নয়। এই আসন-প্রাণায়াম-ধ্যান-ধারণা-প্রত্যাহার আমাদের মনের ক্ষিধে মিটিয়ে দিতে পারে।
২৪.০৪.২০২১
০৪-০৫-২০২১।
ঠাকুর রামকৃষ্ণের সঙ্গে স্বামী ত্রৈলঙ্গের সাক্ষাৎ হয়েছিল, বেনারসে। সেখানে তাদের দুজনের কি কথা হয়েছিল, তা আমরা জানি না। মৌন অবস্থায় ভাবের বিনিময় হয়, এটা আমরা জানি। বাবা বা মা যদি রাগত অবস্থায় আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন, তখন একটা ভাবের বিনিময় হয়, এটা আমরা বেশ বুঝতে পারি। প্রেমের বিনিময় মৌনঅবস্থায় থেকেও সম্পন্ন হতে পারে। কিন্তু দার্শনিক তত্ত্বকথা কিভাবে মৌন অবস্থায় বিনিময় হতে পারে তা বুঝতে আমাদের বেশ কষ্ট হয়।
ভগবান বুদ্ধের কাছে এক জিজ্ঞাসু সাধনতত্ত্ব জানতে এসেছিলেন। বুদ্ধ নীরব ছিলেন। ক্ষাণিক্ষণ পরে জিজ্ঞাসু বললেন। আমি বুঝেছি। এই বলে তিনি বুদ্ধকে প্রণাম করে চলে গেলেন। এই ঘটনা বুদ্ধশিষ্য আনন্দ দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলো। সে ভাবলো, কি বুঝলো লোকটা যে "আমি বুঝেছি" বলে প্রণাম করে চলে গেলো ? আনন্দের মনে কৌতুহল হলো, বুদ্ধের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল - ও কি পেলো ? বুদ্ধদেব উত্তরে বললেন,ভালো ঘোড়াকে চাবুক মারতে হয় না, সে চাবুকের ছায়া দেখেই ছোটে।
তো কিছুদিন পরে আবার সেই জিজ্ঞাসু এলেন, মঠে। তো আবার আনন্দের সাথে দেখা। আনন্দ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আগে একদিন এসেছিলেন, বুদ্ধের উপদেশ শুনতে । তো সেদিন বুদ্ধ যা বলেছেন, তা আপনি মেনে চলেন ? জিজ্ঞাসু বললেন, হ্যাঁ আমি মেনে চলি। আনন্দ বললেন, কি রকম ? তো জিজ্ঞাসু বললেন, আমার যখন ক্ষিদে পায়, তখন আমি খাই। আমার যখন ঘুম পায়, তখন আমি ঘুমাই।
আনন্দ - এতো তো সবাই করে।
জিজ্ঞাসু - না তা করে না, যখন তাদের ক্ষিদে পায়, তখন তারা ঠিকমতো খায় না। হাজার চিন্তায়, তাদের খাওয়াই নষ্ট হয়ে যায়। তেমনি যখন তাদের ঘুমুতে যাবার কথা, তখনো সে নানান চিন্তায় ঘুমুতে পারে না। এখানেই তফাৎ।
৬.৫.২১
করোনায় আক্রন্ত হয়ে দেহ ত্যাগ করা, কি সামাজিক অপরাধ ? শ্মশানঘাটে বা কবরখানায় গেলে সেই রকমটাই মনে হতে পারে। শব দেহের পাশে পড়ে থাকা রক্ত চাটছে কুকুর। ভয়ানক দৃশ্য। লাইন দিয়ে শুয়ে আছে প্লাস্টিকের বস্তার মধ্যে কারুর আদরের মা-বাবা-স্ত্রী-পুত্র-কন্যা। একটা মধ্যযুগীয় বর্বরীয় আইন চালু হয়েছে, "করোনায় মারা যাওয়া মনুষ্যদেহ প্রিয়জনদের দেখা বারণ । এমনকি শেষকৃত্যও করবার অধিকার নেই। আশাকরি এই আইন প্রয়োগ করবার সময় ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য মহাশয়ের কথাগুলো, একবার দয়াকরে মনে করবেন। তিনি বলছেন : (সাপ্তাহিক বর্তমান - ৫-৯-২০২০)
"মৃত্যুর ৪ থেকে ৬ ঘন্টা ভাইরাস সক্রিয় থাকতে পারে। জীবিত কোষ না পেলে ভাইরাস বাঁচতে পারে না। যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নেই যে ভাইরাস বেঁচে থাকে, তাহলে প্রটেকশন নিয়ে প্রিয়জনের শেষকৃত্য করা যাবে না কেন ? যে কাজ কর্পোরেশনের স্বাস্থা বন্ধুরা করেন, সে কাজে তাদের সঙ্গে বাড়ির লোক থাকতে পারবে না কেন ?
"যেকোনো শ্মশানে করোনা মৃতদেহ দাহ করা যাবে না কেন ? বহু ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে রোগ এবং কাটাছেঁড়া করা বীভৎস দেহ তো শ্মশানেই দাহ করা হয়ে থাকে। ............
"এতো অপমান, অবহেলার মৃত্যুও কোরোনার দৌলতে আমাদের দেখতে হচ্ছে ?
০৯-০৫-২০২১
কোরোনার প্রধান উপসর্গ হচ্ছে শ্বাসকষ্ট। বয়স্করা তাদের শ্বাস কষ্টের কথা বুঝতে পারেন, কাউকে বলতেও পারেন, কিন্তু শিশুরা তাদের কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারে না। তা সে শ্বাস কষ্ট হোক বা অন্য কষ্ট হোক। তাই শিশুদের শ্বাস কষ্টের কথা বাবা-মাকেই বুঝতে হবে। কিন্তু কিভাবে ? শিশুরোগ বিশেষজ্ঞারা বলছেন, (আনন্দবাজার পত্রিকা -০৯-০৫-২০২১) প্রতি মিনিটে স্বাভাবিক শ্বাসগ্রহণের মাপকাঠি হচ্ছে :
শিশুর বয়স ২ মাস - ৬০
শিশুর বয়স ১২ মাস - ৫০
এক থেকে পাঁচ বছরের শিশুর - ৪০,
পাঁচ বছর বা তার বেশী - ৩০ - তার বেশী হলে বুঝতে হবে, তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
শিশু যখন শুয়ে আছে, তখন তার পেট ওঠা-নামার দিকে খেয়াল করলেই, এটি বুঝতে পারবেন।
সন্তানকে স্তনপান থেকে বঞ্চিত করবেন না। সন্তানকে মায়ের কোলছাড়া করবেন না। এমনকি দাদু-দিদার কাছেও দেবেন না। এতেকরে শিশু অসহায় হয়ে যায়, ভয় পায়। আর ভয় পেলে, ওদের শ্বাসকষ্ট হতে পারে, জ্বর আসতে পারে, এমনকি পেট খারাপ হতে পারে। ডাক্তারের পরামর্শ নিন, কিন্তু উদ্বিগ্ন হবেন না।
মানসিক দিক থেকে সুস্থ থাকার জন্য :
করোনা সংক্রান্ত উত্তেজনা খবর থেকে দূরে থাকুন।
স্বামী-স্ত্রী-পরিবার-প্রিয়জনদের খবরাখবর রাখুন, এবং কাছাকাছি থাকবার চেষ্টা করুন।
সদর্থক চিন্তা করুন।
মনকে স্থির রাখবার জন্য, দুশ্চিন্তামুক্ত রাখবার জন্য, ধ্যান করুন।
প্রতিদিন নিয়ম করে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করুন।
সহজপাচ্য খাবার খান ।
সৃজনশীল কাজে মনোযোগ দিন।
মনকে আনন্দে রাখুন।
সর্বোপরি, ঈশ্বরের শরণে থাকুন।
10.05.2021
পাখিকে বলা হয়, দ্বিজ। কারন প্রথমে তার জন্ম হয় ডিম্ হিসেবে। এর পর সে পাখির আকৃতি নেয়। ভগবান এদেরকে আকাশচারী করেছেন। জীবজগতের মধ্যে পাখিই একমাত্র যারা জগৎকে দেখে উচ্চস্থান থেকে। তো জীবনকে যারা সার্বিকভাবে দেখতে চান, তাদেরকে মনের উচ্চস্তরে অবস্থান করতে হবে। আর তাই তো তাকে হতে হবে দ্বিজ। যীশু বলেছিলেন, আবার জন্ম না নিলে, মানুষ ঈশ্বরের রাজ্য দেখতে পাবে না। ভারতেও দুইবার জন্মগ্রহণের একটা আদর্শ আছে। লোক-সমাজে যাকে দীক্ষা গ্রহণ বলা হয়ে থাকে। তবে প্রাচীন ভারতের সমাজকে একটু গভীরে প্রবেশ করলে দেখতে পাবেন, তারা মানুষকে চারবার জন্মগ্রহণের কথা বলেছেন। আর এই চতুর্থ বারেই মনুষ্ ব্রহ্মবিদ নামে খ্যাত হয়ে থাকেন ।
"জন্মনা জায়তে শূদ্রঃ সংস্কারাদ্ দ্বিজ উচ্চতে।
বেদপাঠী ভবেৎ বিপ্রঃ ব্রহ্ম জানাতি ব্রাহ্মণ। " - অত্রি-স্মৃতি।
স্বাভাবিকভাবে মানুষ শুদ্র বা অজ্ঞান হয়েই জন্মায়। শুদ্ধকরণের পর অর্থাৎ সংস্কারের দ্বারা সে হয় দ্বিজ। শাস্ত্র অধ্যয়ন করতে করতে যখন তার শাস্ত্রের জ্ঞান অর্থাৎ শাস্ত্রের গুড় তত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞান হলে তিনি হন বিপ্র বা বিশেষ জ্ঞানী। এর পর যখন শাস্ত্র অনুযায়ী সাধনার ফলে তাঁর পরমাত্মা সম্পর্কে অপ্রতক্ষ্য অনুভূতি জন্মায়। তখন তিনি হন, ব্রহ্মবিদ বা ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ অক্ষরপুরুষকে জেনে ইহলোক ত্যাগ করেন। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলতেন, "বিকারহীন, মরনহীন, সদ্বস্তুকে জানতে হলে অন্তরাত্মাকে জাগাতে হবে।" আসলে শাস্ত্রাদি পাঠ করে পণ্ডিত হওয়া ভালো, কিন্তু যার অন্তর-আলোকের প্রতক্ষ্য অনুভূতি নেই, সে মুঢ়।
--------------------------
অনেক সাধ্যসাধনা করে, কোরোনার সাথে লড়াই করবার জন্য, ভ্যাকসিনের আবিষ্কার করা গেছে। অনেক ভাগ্যবান ভ্যাকসিন নিয়ে নিয়েছেন। আমরা সবাই ভেবেছিলাম, এবার রেহাই পেলাম। কিন্তু রেহাই পেলাম কি ? ভ্যাকসিন নেবার পরেও, কোরোনার আক্রমন থেকে রেহাই নেই। এমনকি আমার এক বন্ধু ভ্যাকসিন (দুটো ডোজ) নেবার পরেও, কোরোনার সাথে লড়াইয়ে হেরে শ্মশানবাসী হয়েছে। তাহলে আমরা যাবো কোথায় ?
এদিকে WHO - বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা - এর মুখ্য বিজ্ঞানী সৌম্য স্বামীনাথন বলছেন, " কোরোনার বি.১.৬১৭ প্রজাতিটি ভারতে সক্রিয়। এটি ক্রমাগত চরিত্র পাল্টে নিজের সংক্রমণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করছে। ভবিষ্যতে হয়তো টিকা বা স্বাভাবিক কারনে তৈরী হওয়া অ্যান্টিবডিকেও রুখে দিয়ে পারে এটি"
"এই গতিতে টিকাকরন চললে, সবাইকে টিকা দিতে দিতে বছর পেরিয়ে যাবে। ততদিনে ভাইরাস চরিত্র বদল করে ফেললে এখনকার টিকার আর কার্যকারিতা থাকবে না।"
(আনন্দবাজার পত্রিকা ১০.০৫.২০২১ )
এখন কথা হচ্ছে, তাহলে আমরা সাধারণ মানুষরা কি করবো ? আপনি বলবেন, কেন চিকিৎসা করবো। হ্যাঁ সাধারণ ভাবে এটাই তো মনে হয়, যে কোনো রোগে আমরা যেমন ডাক্তারবাবুর কাছে যাই, হাসপাতালে ছুটে যাই, এখানেও তেমনটি করবো। ডাক্তার অমিতাভ চক্রবর্তী বলছেন, কোনো ভাইরাস ঘটিত রোগেরই জুতসই কোনো চিকিৎসা নেই। আর করোনা হচ্ছে, একেবারেই একটা নতুন ভাইরাস, তার উপরে আবার এই ভাইরাস তার শক্তি বৃদ্ধি করতে করতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তো যার কোনো চিকিৎসা নেই, তার জন্য ১০-১৩ দিনের মধ্যে লক্ষ লক্ষ টাকার বিল হচ্ছে। আসলে কোরোনার জূজূ দেখিযে লুটতোরাজ্ শুরু হয়েছে।
আসলে এই রোগ উপসর্গহীন হতে পারে, আবার একেকজনের ক্ষেত্রে হচ্ছে, এক-একরকম উপসর্গ।
----------------
১৪.০৫.২০২১
ধূপের ধোঁয়া কি ফুসফুসের পক্ষে ক্ষতিকর ?
ধূপের কথা যখন এলো তখন বলি ধূপ-দ্বিবিধ অর্থ বহন করে, অথবা বলা যেতে পারে, ধুপ দুটো জিনিস বহন করে থাকে । এক হচ্ছে তাপ অন্যটি হচ্ছে, ধোঁয়া। "ধূপের মধ্যে যাস না", কথার অর্থ হচ্ছে, রোদের তাপের মধ্যে যাস না। ধূপ বলতে সাধারণত আমরা বুঝি পূজার উপাচার। এটি অবশ্য়ই পূজার উপাচার, এব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু একটা জিনিস জানবেন, অনেক লোকাচার আছে, যার ভিতরে অন্তর্নিহিত বিজ্ঞান আছে। মোটকথা মানুষ কিভাবে ভালো থাকতে পারে, তার বিভিন্ন উপায়, মহাপুরুষগন আমাদের রূপকের মাধ্যমে বলে গেছেন। তাই মহাত্মাদের কথার সঠিক অর্থ বুঝলে, এবং সেই মতো আচরণ করলে, আমরা আমাদের জীবনকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করতে পারি । অবজ্ঞা নয়, অনিসন্ধিৎসু মন নিয়ে বিচার করুন। বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করুন। পরীক্ষা নিরীক্ষা করুন। তবে একদিন সত্য আপনার কাছে ধরা পড়বে ।
ধূপ কথাটার আর একটা অর্থ হচ্ছে, বিশেষ ভাবে সন্তপ্ত করা। অর্থাৎ যা আমাদের অন্তরের সন্তাপকে বিনষ্ট করতে পারে। ধুপ হচ্ছে, গন্ধদ্রব্য নির্মিত বর্ত্তিকা যা তাপের সংস্পর্শে এলে সেখান থেকে উত্থিত সুগন্ধযুক্ত ধুম উদ্গিরণ করে থাকে । ধূপে আছে কৃত্তিম পরাগ, যার নির্যাস হচ্ছে ধুম। পরাগ হচ্ছে জাতি-কোষের চূর্ন বা অনু। এই জাতিকোষই জীবনের ধারা বহন করে নিয়ে চলেছে।
নানান রকম গন্ধদ্রব্য দ্বারা তৈরী হচ্ছে, এই বর্ত্তিকা। ধূপ নানান রকম। পঞ্চাঙ্গ, ষড়ঙ্গ, অষ্টাঙ্গ, দশাঙ্গ, দ্বাদশাঙ্গ, ও ষোড়শাঙ্গ ইত্যাদি ।
পঞ্চাঙ্গ - চন্দন, কুমকুম, কর্পূর, গুগগুল, ও অগুরুঘৃত সংযুক্ত করে নির্মিত হয়।
ষড়ঙ্গ - চন্দন, গুগগুল, উশীর, শর্করা ও মধু মিশ্রিত।
অষ্টাঙ্গ - তেজপাতা, সুগন্ধ বালা, কুড় ও পঞ্চাঙ্গের সমস্ত কিছু মিশ্রিত।
দশাঙ্গ - মধু, মুস্তক, ঘি, গন্ধক, গুগগুল, অগুরু, শৈলজ, সরল (বিড়) শিলারস ও ও শ্বেত-সরিষা মিশ্রিত।
দ্বাদশাঙ্গ - গুগগুল, চন্দন। তেজপাতা, কুড়, অগুরু কুমকুম, জায়ফল, কর্পূর, জটামাংসী, সুগন্ধ বালা, দারুচিনি, এবং উশীর মিশ্রিত ।
ষোড়শাঙ্গ - মুস্তক, দেবদারু, এলাচ ও মুরামাংসী এবং দ্বাদশাঙ্গ ধূপের উপকরণ মিশ্রিত ।
এই ধুপ আমাদের সন্তাপহারি। এই ধূপের ধোঁয়া আমাদের পরিবেশকে বিশুদ্ধ ও নির্দোষ করে থাকে। আর বিশুদ্ধ পরিবেশ থেকে যখন আপনি বাতাস গ্রহণ করবেন, বা এই বিশুদ্ধ বাতাস থেকে যখন ফুসফুস তার ইনটেক পাবে, তখন সে সহজেই বায়ুকে যে পঞ্চিকরন বা দশবিধ করতে পারবে, অর্থাৎ ফুসফুসের যে ক্রিয়া তা ফুসফুস সহজেই সম্পাদন করতে পারে। অর্থাৎ কাঁচামাল যদি ভালো হয়, তবে, উৎপাদিত দ্রব্য অবশ্য়ই ভালো হবে। মুখের মধ্যে ভাতের সঙ্গে সঙ্গে কাঁকর গেলে, আপনার দাঁতের ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু ভাত রান্নার আগে, চাল বেছে নিতে পারলে, দাঁতের কাজে বাধা পড়বে না । তাই যারা ভাবছেন, সাধারণ ধোঁয়া আর ধূপের ধোঁয়া একই ফলপ্রদ, তারা আরো একটু ভাবুন।
২৩-০৫-২১
আত্মা কি দেহের মধ্যে আছে ? নাকি দেহ আত্মার মধ্যে আছে ? উপনিষদ বলছে, হৃদয় গুহায় আত্মার বাস। অর্থাৎ ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রের মধ্যে যে আকাশ আছে, সেখানে আত্মার বসতি।
আবার সাধকের প্রতক্ষ্য অনুভূতি হচ্ছে, সমস্ত জৈব ও অজৈব পদার্থকে ঘিরে রেখেছে একটা আলোর গোলক। এই দেহের বাইরেও আছে, একটা আউড়া (aura) বা আলোর প্রভা, যা সবসময় দেহেকে ঘিরে রেখেছে। যা গভীর ধ্যানের সময় প্রতক্ষ্য হয়। স্থুল দেহের নাশকালে, এই আউড়া-দেহ স্থুল দেহকে ছেড়ে, প্রথম দিকে এই ভূমন্ডলে, বা আকাশে বিচরণ করে থাকে। এবং ধীরে ধীরে নিষ্প্রভ হয়ে যায়। তখন যা থাকে তা হচ্ছে, অতিসূক্ষ্ম আবার অতি উজ্জ্বল আলোর কনা। যা আমাদের দৃষ্টিশক্তির বাইরে। এমনকি অণুবীক্ষণ যন্ত্রতেও যা ধরা পড়ে না।
আর ওই হৃদয় গুহায় থাকে আমাদের প্রাণশক্তি, যা আমাদের এই স্থুল দেহকে বাঁচিয়ে রাখে। দেহের মধ্যে প্রাণশক্তির প্রবেশ ঘটে মায়ের গর্ভে। এবং সেটি ভ্রূণ অবস্থাতে থাকে না । এই প্রাণশক্তির প্রবেশ ঘটে ৪৪-৪৮ দিনের মধ্যে। অনেক সময় এটি ৮৪-৯০ দিনের মধ্যেও আসতে পারে। প্রাণ আসার আগে পর্যন্ত, শিশুর দেহ একটা মাংসপিন্ড বই কিছু নয়। এবং মায়ের গর্ভে যে প্রাণশক্তি শিশুর শরীরকে বাঁচিয়ে রাখে সেই প্রাণশক্তি আসলে মায়ের প্রাণশক্তি। শিশু ভূমিষ্ট হলে, সে তার নিজস্ব প্রাণশক্তি সংগ্রহ শুরু করে, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে। সাধকের এই প্রত্যক্ষ অনুভূতি অর্থাৎ আত্মার মধ্যে দেহ, দেহের মধ্যে আত্মা নয়, প্রচলিত নয়। কিন্তু এই ধারণা আমরা বিবেকানন্দের মধ্যেও লক্ষ করেছি। আমরা শরীর, এই ধারণা যেমন ভ্রান্ত, আমরা মানবাত্মাও বা আলাদা কোনো জীবাত্মা এই ধারণাও ভ্রান্ত । আমরা সেই পরমাত্মা বা ঈশ্বর যা একমাত্র সত্য।
২৯-০৫-২০২১
একটা পোকা (কেন্নো) ঘরের মধ্যে তার অসংখ্য পা দিয়ে হাটছিলো। ইঞ্চি দুই লম্বা হবে। গাঢ় লাল তার গায়ের রঙ। পোকার গায়ে আমার পা পড়ে গেলো। পোকাটা একটা পয়সার মতো কুন্ডলি পাকিয়ে গোল আকার নিলো। নিজেকে গুটিয়ে ছোট করে নিলো। এই ব্যাপারটা আপনারা সবাই লক্ষ করেছেন, পোকার গায়ে একটু আঘাত লাগলেই, বা আঘাতের সম্ভাবনা দেখলেই, সে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। অর্থাৎ আপনার সংযোগক্ষেত্র যদি গুটিয়ে নিয়ে আসতে পারেন, তবে, আপনার আঘাতের সম্ভাবনা বা বাঁচার সম্ভাবনা বেশী থাকবে। মানুষের চেতনার সংযোগক্ষেত্র যত গুটিয়ে আনা যায়, পরম-আত্মার অবতরণ তত সহজ হয়ে যায়। পৃথিবীতে বিচরনের জন্য সংয়োগক্ষেত্র বাড়াতে হয়। আর পরমাত্মার সঙ্গে বিচরনের জন্য, সংয়োগক্ষেত্র গুটিয়ে আনতে হয়।
আমাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো বিশ্বাস করেন, সব কিছুর একটা সময় আছে। আপনি যখন পৃথিবীতে অবতরণ করেছিলেন, তা একটা সময় ধরে সংগঠিত হয়েছিল। তবে সম্ভাবনা কিন্তু ধীরে ধীরে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছিল। জীবনের সমস্ত ব্যবস্থা পূর্বানুসারী। নির্দিষ্ট সময়ে বর্ষা আসে। আর যদি তা না আসে, জানবেন, কিছু উল্টোপাল্টা হয়েছে। নারীর শরীর যদি ঠিক থাকে, তবে মাতৃত্ত্বের বর্ষা ঠিক সময় মতো শরীরে প্রবেশ করে। এটি চাঁদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ঠিক ২৮ দিনে চাঁদের সঙ্গে সঙ্গে এটি আসে। কিন্তু শরীরের চক্র যদি ভেঙে যায়, তবে তা ২৮ দিনে আসে না।
সমস্ত ঘটনাই এমনিতর চক্রের মধ্যে আবর্তিত হয়। তা আমরা কেউ ধরতে পারি, আবার কেউ ধরতে পারি না। পরমাত্মার ধারাও একটা নির্দিষ্ট ব্যবধানে প্রবাহিত হয়। যেমন কুম্ভ মেলা একটা সময়ের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত হয়। আর এই সময় যে কুম্ভস্নান করতে পারে, সে কুম্ভের সুফল পেতে পারে। প্রত্যেকের জীবনে যেমন শৈশব, কৈশোর, যৌবন, বার্ধক্য আসে, এবং একটা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে আসে।
তেমনি প্রত্যেকের জীবনে একটা সময় আসে, যখন একটা বিদ্যুতের ঝলকানির মতো, পরমাত্মার অবতরণ ঘটে তার জীবনে। চমকাবে, আবার হারিয়ে যাবে। সেই সময়ে আপনি যদি উন্মুক্ত থাকেন, সেই মুহূর্তে আপনি যদি জেগে থাকেন, তো আচমকা ঘটনা ঘটে যাবে। প্রত্যেকের জীবনেই এই মহৎ মুহূর্ত আসে। তা সে চরম দুঃখের দিনে হতে পারে, আবার চরম সুখের দিনে আসতে পার। তবে জানবেন, এই মুহূর্ত অবশ্য়ই চরম মুহূর্ত। ঝিনুক যেমন নিজেকে উন্মুক্ত করে রাখে বর্ষার জল ধরবার জন্য, চাতক পাখি যেমন চিতিয়ে থাকে, বর্ষার জল পান করবার জন্য, আপনাকেও তখন খালি করে তাখতে হবে নিজেকে পরমাত্মার অবতরণ কালে তাকে গিলে নেবার জন্য। তাই নিজেকে শূন্য করুন। পরম-আত্মাকে বসবার জায়গা করে দিন, তার জন্য আসন পেতে রাখুন। না হলে, তিনি কখান আসবেন, আর ফিরে যাবেন, তা আপনি জানতেও পারবেন না। ঝলক আসে, ঝলক যায়। ঝলকের ঝিল্লি যে ধরতে পারে, সে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
৬-৬-২১
দেখুন, আমি ডাক্তার নোই। অতয়েব ডাক্তারি পরামর্শ দেওয়া আমার আমার পক্ষে গর্হিত কাজ। তবে আমি ডাক্তারের কাছেও যাই না। কারন ডাক্তারের পরামর্শ আমার দরকার পরে না।
আমি আগেও বলেছি, করোনা কোনো রোগ নয়, করোনা একটা ভাইরাস। ভাইরাস কথাটার অর্থ হচ্ছে বিষ। অর্থাৎ শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর কোনো বস্তু। ভাইরাস আসলে বস্তু থেকে জীব সৃষ্টির প্রক্রিয়ার মধ্যাবস্থা। ভাইরাস হচ্ছে জীবের পূর্বাবস্থা। তো বিষ আপনার শরীরে প্রবেশ করলে আপনি কি করেন ?
প্রথমত যেখান থেকে বিষ আপনার শরীরে প্রবেশ করছে, সেই স্থানকে সুরক্ষিত করা। তো করোনা আপনার শরীরে প্রবেশ করছে আপনার নাক, মুখ, চোখ থেকে। বিশেষ করে মুখ ও নাক আমাদের প্রোটেক্টেড রাখতে হবে। অর্থাৎ শ্বাসনালী যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হয়, তার জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে। এইজন্য বলা হয়ে থাকে ঈষৎ উষ্ম গরম জল দিয়ে কুলিকুচি করা, পান করা, ভালো । ঘন্টায়-ঘন্টায় এটি করুন। ঠান্ডা খাবার খাবেন না।
দেখুন করোনা আপনার সারা শরীরে আটকে থাকলেও, এমনকি আপনার পেটে চলে গেলেও, আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আপনি লক্ষ করেছেন, জীবজন্তু ক্ষত স্থানে জীভ দিয়ে চাটছে। অর্থাৎ জীবাণুকে সে পেটের মধ্যে নিয়ে নিচ্ছে, এতে তার কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। তো আপনার দরকার শ্বাসনালীকে পরিষ্কার রাখা। অথবা শ্বাস নালীর মধ্যে এমন কোনো দাহ্য পদার্থ রাখা যা ভাইরাসকে দাহ করতে পারে। কাবাব চিনি, এক্ষেত্রে ভীষণ উপকারী। এক টুকরো কাবাব চিনি মুখে রাখুন। দ্বিতীয়ত আপনি এখন দুর্বল, এই অবস্থায় আপনি প্রাণায়াম করতে পারবেন না। তো আপনার কাজ হচ্ছে, শ্বাস-প্রশ্বাসের দিকে মনকে নিবদ্ধ করা। খেয়াল করুন, কোন নাক দিয়ে আপনার শ্বাস বইছে, সেটাকে পরিবর্তন করবার চেষ্টা করুন। অর্থাৎ যে নাক বন্ধ সেটিকে উপরে রেখে কাত হয়ে ক্ষাণিক্ষণ শুয়ে থাকুন। দেখবেন, সাময়িক ভাবে আপনার উপসর্গ কেটে যাবে। যদি আপনি দুই নাকে সমান বায়ু প্রবাহিত করতে পারেন, আপনার সমস্ত উপসর্গ কেটে যাবে। আমাদের শরীরে দুজন ডাক্তার, অশ্বিনীকুমারদ্বয়। সেই ডাক্তারের স্মরণ নিন। অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাসের দিকে খেয়াল রাখুন। ভালো থাকবেন, আপনি ভালো আছেন, এই ভাবনা নিজের মধ্যে জাগিয়ে তুলুন। তাহলে আপনি অবশ্য়ই ভালো থাকবেন।
১৩-৬-২০২১
প্রশ্ন করা মানুষের সহজাত। জন্মের পর থেকে মানুষ বহির্বিশ্বকে জানতে চায়। আর প্রথম দিকে প্রশ্নের বিষয় থাকে বহির্জগৎ সম্পর্কে। কিন্তু মানুষের এই মনোভাব বেশিদিন থাকে না। একটা সময় আসে, যখন সে আর এই বহির্বিশ্ব সম্পর্কে জানতে চায় না। তখন তার মধ্যে প্রশ্ন জাগে অন্তর্জগৎ সম্পর্কে। যখন মৃত্যু সম্পর্কে সে নিশ্চিত হয়, সন্দেহের উর্দ্ধে উঠে যায়, তখন সে নিজের সম্পর্কে প্রশ্ন করতে থাকে। জীবন সন্মন্ধে প্রশ্ন জাগে, জীবন কি ? জীবনে সত্য কি ? এইসব প্রশ্ন আমাদের সবার মধ্যেই জাগে। তবে মানুষ যতদিন বাহ্য জীবনের চাপের তাড়নায়, ছুটতে থাকে, বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে বাঁচার তাগিদে ঘুরে বেড়ায়, তখন সে অন্তর্জগৎ সম্পর্কে চোখ বুজে থাকে। কিন্তু অন্তর্জগৎ সম্পর্কে যখন প্রশ্নের পর প্রশ্ন জগতে থাকে, আর এই প্রক্রিয়া যখন দীর্ঘস্থায়ী হয়, তখন তার মনোভাবের পরিবর্তন হয়, তখন সে দার্শনিক হয়ে পড়ে ও আধ্যাত্বিক জগতের গভীরে প্রবেশ করে। প্রশ্নের জবাব যদি না পায়, তা সে বিষয় ভিত্তিক প্রশ্ন হোক বা সত্যানুসন্ধানী প্রশ্ন হোক, জবাব না পেলে সে হতাশ হয়ে যায়, উদাসী হয়ে যায়, জীবনে সে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে । এমনকি সে পাগল হয়ে যেতে পারে।
আমরা জানি, মানুষের চিন্তার একটা রূপ আছে, এই রূপ তখন রুগী হয়ে যায়। তাই মানুষের স্থুল-শরীরের বেঁচে থাকবার জন্য যেমন খাদ্য-বাসস্থান দরকার, তেমনি এই চিন্তা-শরীরের পুষ্টির জন্য চাই, চিন্তার খোরাক। তাই আমাদের উচিত চিন্তাকে বিধিবদ্ধ রাখা। সদা পরিবর্তনশীল এই শরীর, মন থেকে নির্লিপ্ত হয়ে ভয়হীন পরিণতির অনুসন্ধান করা। আর এই অনুসন্ধানের প্রয়াসকে প্ৰণালীবদ্ধ রাখতে হবে। সংযত-মনা হয়ে, আচার্য্যের নির্দেশে সত্য়বস্তু নিয়ে মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করতে হবে। আমাদের বেদ উপনিষদ এই মানব চিন্তার উৎকর্ষ বৃদ্ধির জন্য, খোরাক দিতে পারে। আমাদেরকে সমৃদ্ধ করতে পারে। নির্ভিক করতে পারে। আমাদের অস্তিত্ত্বের সন্ধান দিতে পারে।
ভূত ভবিষ্যৎ
আমরা যা কিছু দেখছি, সবই বর্তমান। আর বর্তমান মানে কার্য্য। কার্য্যের আগে আছে কারন, আর কার্য্যের পরে আছে ভবিষ্যৎ বা পরিণতি। সকালে উঠে দেখি, একটা বিড়াল ঘাস খাচ্ছে। বিড়াল শরীরের পুষ্টির জন্য, বা খিদে মেটানোর জন্য দুধ-ভাত-মাছ খায়, কিন্তু এখন সে খাস খাচ্ছে। একটু পরে দেখলাম, সে বমি করলো। তো প্রথমে দেখলাম খাস খাওয়া যা কার্য্য। আর এর পরিণতি হলো বমি করা। এই পরিণতির কারন হচ্ছে পূর্বের কাজ। এই ঘটনার কথা যদি একটু গভীরে ভাবি, তবে অনুমান করতে পারবো, বিড়ালের পেটে কোনো অস্বস্তি হচ্ছিলো, তাই সে ঘাস খেয়ে বমি বা পেটের অস্বস্তিকর বস্তুর নির্গমন করবার জন্য, ঘাস খাবার কাজে উদ্যোগী হয়েছিল। তো প্রত্যেকটি কাজের একটা পরিনাম আছে, আবার প্রত্যেকটি কাজের একটা কারন আছে।
জগতে যা কিছু আপনি দেখছেন, সে সবই কোনো না কোনো কাজ । কাজের উৎস কারন। কাজের ফল পরিণতি। পরিণতিতে কারনের বিলুপ্তি। কিন্তু পরিণতিও একটা কার্য্য। তো কারন-কাজ-পরিণতি চক্রাকারে ঘুরছে। পরিণতি একসময় কারনে পরিণত হয়। আপনি যখন যাকিছু চোখের সামনে দেখছেন, বা ইন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধি করছেন, সেগুলো নিয়ে যদি আপনি নিজের মধ্যে প্রশ্ন তোলেন, তবে আপনি সমস্ত কাজের ভূত-ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটা ধারণা করতে পারবেন। একটা গাছ দেখে আপনি কারন হিসেবে, বীজ আবার পরিণতি হিসেবে ফল সম্পর্কে আপনি একটা ধারণা করতে পারবেন। তেমনি আপনার সামনে ঘটা সমস্ত ঘটনা এমনকি আপনার নিজের কাজের কারন ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনি একটা ধারণা করতে পারবেন, যদি আপনার সময় জ্ঞান থাকে।
আবার জগতের প্রত্যেকটি কাজ অসংখ্য সম্ভবনাময় পরিণতির জন্ম দেয়। এর মধ্যে যেটি ঘনত্ত্ব পেয়ে রূপ গ্রহণ করে, সেগুলোকে আমরা প্রতক্ষ্য করতে পারি। অন্য সমস্ত সম্ভাবনার অস্তিত্ত্ব থাকলেও সেগুলো আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। যেমন ধরুন, একটি শিশুর জন্ম হলো। এই শিশু জন্মাবার সময় অসংখ্য সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিলো। সে ভালো ছেলে হতে পারে, আবার খারাপ হতে পারে, ডাক্তার হতে পারে, আবার ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে। এর মধ্যে যে সম্ভাবনাটি পরিবেশ-পরিস্থিতে ঘনত্ত্ব পাবে, আমরা সেই সম্ভাবনাকে সামনে দেখতে পারবো। ধরুন, আপনি বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন কর্ম্মস্থলে যাবেন বলে। তো আপনি কর্ম্মস্থলে নির্বিগ্নে সময়মতো পৌঁছে যেতে পারেন, আবার নাও পারেন। রাস্তায় কোনো বন্ধুর সাথে দেখা হলে, রাস্তায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে, আপনার গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব নাও হতে পারে, আবার দেরিতে পৌঁছাতে পারেন। এই যে অসংখ্য সম্ভাবনা এগুলো আকার পায় নি সত্য, কিন্তু এই সম্ভাবনাগুলো কখনোই শেষ হয়ে যায় না। এইজন্য বলা হয়ে থাকে, আপনি আজ যা চিন্তা করছেন, সেগুলো কোনো না কোনোদিন রূপ গ্রহণ করবে। তা সে ভালো চিন্তা হোক, বা খারাপ চিন্তা হোক। দেখবেন, পিতা যা ভেবেছিলেন, কিন্তু চোখে দেখতে পান নি, সন্তান সেই সম্ভাবনাকে বা পিতার চিন্তাকে রূপ পেতে দেখেছে।
যেসব মহাত্মন সময়, ধর্ম্ম ও পরিণতির সঙ্গে সম্যক ভাবে পরিচিত, তাঁরা বিচারের সাহায্যে বুঝতে পারেন, কোন সম্ভাবনাটি কার্য্যে পরিণত হবে আর কোনটি কার্য্যে পরিণত হবে না। এঁরাই ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। এরাই ভবিষ্যৎ দেখতে পান, এঁরাই ভবিষ্যতের কথা বলতে পারেন । এমনিকি এঁরা কারনের অনুসন্ধান করে অতীত সম্পর্কেও জ্ঞাত হতে পারেন। সেইসব ভূত-ভবিষ্যৎ দ্রষ্টাদের আমরা প্রণাম জানাই । ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, (বিভূতিপাদ-১৬) "পরিনাম-ত্রয় সংযমাৎ অতীত-অনাগত জ্ঞানম" । বস্তুর ধর্ম্ম, বস্তুর লক্ষণ, ও বস্তুর অবস্থা এই তিনটি পারিনামেতে সংযম করলে যোগীগণ অতীত ও অনাগত বা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারেন। সংযম অর্থ ধ্যান, ধারণা ও সমাধি।
বুদ্ধি কারে কয় ?
আধ্যাত্মিক জগতে বুদ্ধির প্রয়োজন। কিন্তু কেন ? শুধু আধ্যাত্মিক জগৎ কেন, বাহ্যিক জগতেও বুদ্ধিমানের কদর সর্বত্র। কথায় বলে বুদ্ধির জোরে নাকি সব কিছু করা যায়। আবার চোর পালালে নাকি বুদ্ধি বাড়ে ? একজন জ্ঞানী ব্যক্তির কি সবসময় বুদ্ধি থাকে ? কারুর কারুর নাকি উপস্থিত বুদ্ধি অর্থাৎ হঠাৎ বুদ্ধি বেশি থাকে। আসলে আমরা সবাই বুদ্ধি কথাটা শুনে থাকি। সবাই বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করতে বলে। কিন্তু বুদ্ধিটা যে কি সেই সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই নেই। কোথায় থাকে এই বুদ্ধি, মাথায় না পেটে। তোর পেটে পেটে বুদ্ধি, বা তোর মাথায় কোনো বুদ্ধি নেই, এইসব কথা আমরা হামেশাই বলতে শুনি। এমনকি এই বুদ্ধি বাড়াবার নাকি অনেক দাওয়াই আছে। সেই দাওয়াই খেলে নাকি আমাদের বুদ্ধির বৃদ্ধি হতে পারে। এই বুদ্ধি নিয়ে ঋষি পতঞ্জলি তার যোগসূত্রে কৈবল্যপাদে কি বলেছেন, সেই সম্পর্কে আমরা শুনবো। তার আগে আমরা দেখে নেই, বুদ্ধি ব্যাপারটা কি ?
প্রথমেই বলি, ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে জানার নাম হচ্ছে জ্ঞান। তাহলে দর্শন শ্রবণ ইত্যাদি আমাদের জ্ঞান দিতে পারে। এখন কথা হচ্ছে ভুয়ো কিছু দেখলাম বা শুনলাম। সেটাও কি আমাদের জ্ঞান দিতে পারে ? শাস্ত্র বলছে, বিশেষভাবে বা বিচারের সাহায্যে যে জানা তা আমাদের অভিজ্ঞতা। আবার ধ্যান-লব্ধ যে জ্ঞান তাকে বলে প্রজ্ঞা। ধ্যান ও ধারণার যে শক্তি তাকে বলে ধী-শক্তি। কোনো বিষয়ে মনন করবার যে শক্তি বা প্রবৃত্তি তাকে মনঃশক্তি বা মনোবৃত্তি। নিশ্চয়াত্মিকা মনোবৃত্তির নাম হচ্ছে বুদ্ধি।
অতএব বুদ্ধির ধর্ম্ম হচ্ছে নিশ্চয়াত্মিকা মনোবৃত্তি। অভিজ্ঞতা যখন সংরক্ষিত হয়, তখন তাকে বলে স্মৃতি। এখন স্মৃতিতে বা আমাদের অভিজ্ঞতাতে যে জ্ঞান সংরক্ষিত নেই, সেই জ্ঞান যখন আমাদের চিত্তে প্রবেশ করে, তখন আমাদের স্মৃতিতে শঙ্করতা আসে। অর্থাৎ দ্বিবিধ জ্ঞানের প্রবাহ চলতে থাকে। এই দ্বিবিধ বা শঙ্কর জ্ঞানকে বা মিশ্র জ্ঞানকে পরিশুদ্ধ যিনি করেন তিনি আমাদের বুদ্ধি। ঋষি পতঞ্জলি কৈবল্যপাদে এসে বলছেন, (শ্লোক - ২১) আমরা যখন পরমপুরুষ অভিজ্ঞতা লাভ করি, অর্থাৎ যে অভিজ্ঞতা আমাদের স্মৃতিতে নেই, সেই ধরনের কোনো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়, তখন যিনি আমাদের স্মৃতির শঙ্করদোষকে পরিশুদ্ধ করেন, তিনি আমাদের বুদ্ধি। তাই আধ্যাত্মিক সাধনার জগতে বুদ্ধির গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়েছে।
-
No comments:
Post a Comment