জন্ম-মৃত্যু রহস্যঃ -কর্ম্মবাদ
গীতা শ্লোক : শ্রীমদ্ভাগবৎ ১০/৫৪/৪৭, ১০/১৪/৩৮, ১০/৫৪/৭২ শ্রীমৎ ভগবৎগীতা ৩/২৭, ১৮/১৪, ১৮/৬১, ৭/১৬,
উপনিষদ :
জীবের গতাগতি :
জন্ম-রহস্যঃ : তথ্যসূত্রঃ : জীবন ও মরন - শ্রী ক্ষিতিনাথ ঘোষ।
কথায় বলে, জীবের জন্ম মৃত্যু আছে, কিন্তু জীবাত্মার নেই। আবার বলা হয়ে থাকে যে জীবাত্মা পরমাত্মারই অংশ। যদি জীবাত্মা পরমাত্মার অংশ হয়ে থাকে তবে জীবাত্মা কি পরমাত্মার খণ্ডিত অংশ ? জীবাত্মা পরমাত্মা থেকে কিভাবে খণ্ডিত হয়। পরমাত্মা থেকে জীবাত্মা কখন কিভাবে আলাদা হয়ে গেল ? জীবাত্মা যখন আবার পরমাত্মার সঙ্গে লিন হয়ে যায়, তখন তো আর জীবাত্মার অস্তিত্ত্ব থাকে না। তাহলে বলা যেতে পারে, জীবাত্মার জন্ম-মৃত্যু বা জীবাত্মা পরমাত্মা থেকে অবতরণ করে ও একসময় আবার পরমাত্মাতেই আরোহন করে থাকে। জীবাত্মা কতদিন পরমাত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে ? আমরা ধীরে ধীরে এই সব প্রশ্নের জবাব খুঁজবো।
পরাবিদ্যা অনুযায়ী জীবের আরোহন ও অবতরণ (গতাগতি) বুঝতে গেলে প্রথমে একটা জিনিস মেনে নিতে হবে যে জীব ব্রহ্মের অংশ। ব্রহ্ম হচ্ছেন সৎচিৎ-আনন্দঘন, আর জীব হচ্ছে সৎচিৎ আনন্দকণা। সন্ধিনী, সম্বিৎ, ও ঽলাদিনী শক্তি ভগবানে পূর্ন ভাবে প্রকটিত, কিন্তু জীবের মধ্যে বীজ ভাবে প্রসুপ্ত। সন্ধিনী অর্থাৎ মিলিত হবার শক্তি, সম্বিৎ অর্থাৎ চৈতন্যশক্তি, ঽলাদিনী অর্থাৎ আনন্দকারী শক্তি (সৃষ্টি-শক্তি বা মাতৃশক্তি ) জীবে সুপ্ত থাকে, আর ভগবানের মধ্যে পূর্ন রূপে বিরাজ করছে। জীব প্রকৃতি ক্ষেত্রে বা কোলে উপ্ত অর্থাৎ সন্তাপজনিত দুঃখদায়ক জন্ম নিয়েছে। যাতে করে সে বিভিন্ন লোকের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে সে ব্রহ্মসারূপ্য লাভ করতে পারে।
পরমাণু জাতীয় জীব বা প্রত্যগাত্মা (monad) অর্থাৎ প্রত্যেক জীব-আত্মা আসলে পরমেশ্বর বা ব্রহ্মচৈতন্য। এই জীবাত্মা বা ব্রহ্মচৈতন্য তপলোকের বাসিন্দা। তপলোক থেকে এই পরমাণুর রশ্মি বা অংশ জনলোকে নেবে আসে। এবং এই জনলোকের তত্ত্বগঠিত হিরন্ময় কোষ গ্রহণ করে থাকে। এর পর ক্রমশ মহর্লোকে প্রবেশ করে এবং আনন্দময় কোষে পরিণত হয়, এর পরে অরূপ-স্বর্গে এসে বিজ্ঞানময় কোষে আবৃত হয়। এই তিনটি কোষ অর্থাৎ হিরন্ময়, আনন্দময় ও বিজ্ঞানময় কোষ আশ্রিত চৈতন্যকে আত্মা-বুদ্ধি-মনস বলা হয়। এটিই পরবর্তীতে পুষ্ট ও সুসংহত হয়ে জীবাত্মাতে পরিণত হবে। এখন এই আত্মা বুদ্ধি-মনসের অংশ রূপস্বর্গে নেবে আসে। ভাবনাময় ভুবর্লোকে নেবে বাসনাময়, এবং সবশেষে ভুর্লোকে নেবে ইথার-নির্মিত কোষ ও স্থুল-জড় নির্মিত কোষ গ্রহণ ক'রে স্থাবর রূপে প্রকাশিত হয়। ইথার ও কঠিন-তরল-বায়বীয় কোষকে এককোষী ধরলে কোষের সংখ্যা ছয়টি। অনন্ময়-প্রাণময়-মনোময়-বিজ্ঞানময়-আনন্দময়-হিরণ্ময়। এগুলোকেই নানাভাবে শ্রেণীবদ্ধ ক'রে, পিন্ডদেহ ও লিঙ্গদেহ, স্থূল-সূক্ষ্ম-কারন ইত্যাদি নামে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বেদান্তের মতে কঠিন-তরল-বায়বীয় পদার্থে গঠিত দেহ হচ্ছে অনন্ময়। পার্থিব আকাশে অর্থাৎ ইথারে গঠিত কোষ হচ্ছে প্রাণময়। বাসনাময় ও ভাবনাময় কোষ, এইদুই কোষ একত্রে মনোময় এবং সূক্ষ্মতর তিনটি বিজ্ঞানময়, আনন্দময় ও হিরণ্ময়।
জীবের অবতরণের সময় জীব যেমন যেমন এক-একটা কোষে আবৃত হয়েছে, তার শক্তিও ক্রমশঃ অধিক শমিত হয়েছে অর্থাৎ কমে এসেছে। এই কোষগুলোর সাহায্যে জ্ঞাতসারে প্রকৃতির সাথে জীবশক্তির আদান-প্রদান করতে সক্ষম হয় না। স্থাবর বা জড় অবস্থায়, বা স্থাবররাজ্যে বহুকাল বাস করে, অল্পপরিমানে সংহত করে (ঘনীভূত) এবং এর সাহায্যে জড়-শক্তির ক্রিয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করে পাদপরাজ্যে অর্থাৎ বায়ুর রাজ্যে আরোহন করে। এইখানে সে কীটাণুকীতে পরিণত হয়, এবং বায়ুর সাহায্যে চলাচল করে থাকে। এইখানে সে জড়দেহ ও বাসনাদেহ ধারণ করে। এর পরে পশুরাজ্যে প্রবেশ করে, সেখানে জড়দেহ-বাসনাদেহ-ভাবনাদেহ পুষ্ট ও সংহত (ঘনীভূত বা জমাটবাঁধা) ক'রে জীব মানব রাজ্যে আরোহন করে থাকে।
এই অবতরণের সময় যে কোষগুলো ধোঁয়ার মতো, অসংহত আবরণ মাত্র ছিল, আরোহনের সময় সেগুলো পুষ্ট হয়ে একে-একে দেহে পরিণত হতে লাগলো। বিজ্ঞানময় কোষ সংহত অর্থাৎ জামাটবেঁধে ক্রিয়াশীল হতে আরম্ভ হলে জীব মনুষ্যলোকে উন্নীত হয়।
মনুষ্যত্ব প্রাপ্তি দেবানুগ্রহেই সম্পন্ন হয়ে থাকে। মহেশ্বর শক্তি প্রত্যগাত্মার (অনু-জাতীয় জীব) মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিজ্ঞানময় দেহ গঠনে সহায়তা করে থাকে। কারন শরীরের স্থুলতম দেহ হচ্ছে বিজ্ঞানময় দেহ। আর এই বিজ্ঞানময় দেহে আশ্রিত চৈতন্যই জীবাত্মা। এবং জীবাত্মাই প্রকৃত মানব। ভাগবত অংশই প্রকৃত জীব বা প্রত্যগাত্মা। তার অংশ হিরন্ময়, আনন্দময়, ও বিজ্ঞানময় কোষে আবৃত হওয়ার পরে, জীব চৈতন্যের যে প্রকাশ তাহাই জীবাত্মা। আবার জীবাত্মার অংশের জড়দেহ, বাসনাদেহ ও ভাবনাদেহর আশ্রয়ে যে প্রকাশ তাকেই বলে ভূতাত্মা। মানুষের মধ্যে ভূতাত্মা ও জীবাত্মার সংগ্রামস্থল। এবং সেইজন্য মানুষ হচ্ছে দেব-মর্কট। মানুষ তার তিনটি দেহের সাহায্যে ভুলকে, ভুবর্লোকে ও স্বর্গলোকে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া বা শক্তির আদান প্রদান করে থাকে। জড়দেহ দ্বারা চেষ্টনা অর্থাৎ কিছু করবার জন্য শরীর ও মনের মধ্যে চঞ্চলতা সৃষ্টি করতে পারে। বাসনা দেহের দ্বারা সুখ-দুঃখের অনুভূতি ও কামনা করতে পারে। এবং ভাবনা দেহের সাহায্যে চিন্তা, বিচার, বিবেক ইত্যাদি বৃত্তির পরিচালনা হয়ে থাকে।
এখন কথা হচ্ছে মৃত্যুতে কি মানুষের সবই নষ্ট হয়ে যায়, না দেহাতিরিক্ত আত্মা সূক্ষ্ম জগতে বর্তমান থাকে ? মৃত্যুর সময় কি নিদির্ষ্ট ? এসব নিয়ে আমরা পরবর্তীতে আলোচনা করবো। আজ ব্রহ্মবাক্যের বিরতি দিলাম।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
গীতা শ্লোক : শ্রীমদ্ভাগবৎ ১০/৫৪/৪৭, ১০/১৪/৩৮, ১০/৫৪/৭২ শ্রীমৎ ভগবৎগীতা ৩/২৭, ১৮/১৪, ১৮/৬১, ৭/১৬,
উপনিষদ :
জীবের গতাগতি :
জন্ম-রহস্যঃ : তথ্যসূত্রঃ : জীবন ও মরন - শ্রী ক্ষিতিনাথ ঘোষ।
কথায় বলে, জীবের জন্ম মৃত্যু আছে, কিন্তু জীবাত্মার নেই। আবার বলা হয়ে থাকে যে জীবাত্মা পরমাত্মারই অংশ। যদি জীবাত্মা পরমাত্মার অংশ হয়ে থাকে তবে জীবাত্মা কি পরমাত্মার খণ্ডিত অংশ ? জীবাত্মা পরমাত্মা থেকে কিভাবে খণ্ডিত হয়। পরমাত্মা থেকে জীবাত্মা কখন কিভাবে আলাদা হয়ে গেল ? জীবাত্মা যখন আবার পরমাত্মার সঙ্গে লিন হয়ে যায়, তখন তো আর জীবাত্মার অস্তিত্ত্ব থাকে না। তাহলে বলা যেতে পারে, জীবাত্মার জন্ম-মৃত্যু বা জীবাত্মা পরমাত্মা থেকে অবতরণ করে ও একসময় আবার পরমাত্মাতেই আরোহন করে থাকে। জীবাত্মা কতদিন পরমাত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে ? আমরা ধীরে ধীরে এই সব প্রশ্নের জবাব খুঁজবো।
পরাবিদ্যা অনুযায়ী জীবের আরোহন ও অবতরণ (গতাগতি) বুঝতে গেলে প্রথমে একটা জিনিস মেনে নিতে হবে যে জীব ব্রহ্মের অংশ। ব্রহ্ম হচ্ছেন সৎচিৎ-আনন্দঘন, আর জীব হচ্ছে সৎচিৎ আনন্দকণা। সন্ধিনী, সম্বিৎ, ও ঽলাদিনী শক্তি ভগবানে পূর্ন ভাবে প্রকটিত, কিন্তু জীবের মধ্যে বীজ ভাবে প্রসুপ্ত। সন্ধিনী অর্থাৎ মিলিত হবার শক্তি, সম্বিৎ অর্থাৎ চৈতন্যশক্তি, ঽলাদিনী অর্থাৎ আনন্দকারী শক্তি (সৃষ্টি-শক্তি বা মাতৃশক্তি ) জীবে সুপ্ত থাকে, আর ভগবানের মধ্যে পূর্ন রূপে বিরাজ করছে। জীব প্রকৃতি ক্ষেত্রে বা কোলে উপ্ত অর্থাৎ সন্তাপজনিত দুঃখদায়ক জন্ম নিয়েছে। যাতে করে সে বিভিন্ন লোকের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে সে ব্রহ্মসারূপ্য লাভ করতে পারে।
পরমাণু জাতীয় জীব বা প্রত্যগাত্মা (monad) অর্থাৎ প্রত্যেক জীব-আত্মা আসলে পরমেশ্বর বা ব্রহ্মচৈতন্য। এই জীবাত্মা বা ব্রহ্মচৈতন্য তপলোকের বাসিন্দা। তপলোক থেকে এই পরমাণুর রশ্মি বা অংশ জনলোকে নেবে আসে। এবং এই জনলোকের তত্ত্বগঠিত হিরন্ময় কোষ গ্রহণ করে থাকে। এর পর ক্রমশ মহর্লোকে প্রবেশ করে এবং আনন্দময় কোষে পরিণত হয়, এর পরে অরূপ-স্বর্গে এসে বিজ্ঞানময় কোষে আবৃত হয়। এই তিনটি কোষ অর্থাৎ হিরন্ময়, আনন্দময় ও বিজ্ঞানময় কোষ আশ্রিত চৈতন্যকে আত্মা-বুদ্ধি-মনস বলা হয়। এটিই পরবর্তীতে পুষ্ট ও সুসংহত হয়ে জীবাত্মাতে পরিণত হবে। এখন এই আত্মা বুদ্ধি-মনসের অংশ রূপস্বর্গে নেবে আসে। ভাবনাময় ভুবর্লোকে নেবে বাসনাময়, এবং সবশেষে ভুর্লোকে নেবে ইথার-নির্মিত কোষ ও স্থুল-জড় নির্মিত কোষ গ্রহণ ক'রে স্থাবর রূপে প্রকাশিত হয়। ইথার ও কঠিন-তরল-বায়বীয় কোষকে এককোষী ধরলে কোষের সংখ্যা ছয়টি। অনন্ময়-প্রাণময়-মনোময়-বিজ্ঞানময়-আনন্দময়-হিরণ্ময়। এগুলোকেই নানাভাবে শ্রেণীবদ্ধ ক'রে, পিন্ডদেহ ও লিঙ্গদেহ, স্থূল-সূক্ষ্ম-কারন ইত্যাদি নামে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বেদান্তের মতে কঠিন-তরল-বায়বীয় পদার্থে গঠিত দেহ হচ্ছে অনন্ময়। পার্থিব আকাশে অর্থাৎ ইথারে গঠিত কোষ হচ্ছে প্রাণময়। বাসনাময় ও ভাবনাময় কোষ, এইদুই কোষ একত্রে মনোময় এবং সূক্ষ্মতর তিনটি বিজ্ঞানময়, আনন্দময় ও হিরণ্ময়।
জীবের অবতরণের সময় জীব যেমন যেমন এক-একটা কোষে আবৃত হয়েছে, তার শক্তিও ক্রমশঃ অধিক শমিত হয়েছে অর্থাৎ কমে এসেছে। এই কোষগুলোর সাহায্যে জ্ঞাতসারে প্রকৃতির সাথে জীবশক্তির আদান-প্রদান করতে সক্ষম হয় না। স্থাবর বা জড় অবস্থায়, বা স্থাবররাজ্যে বহুকাল বাস করে, অল্পপরিমানে সংহত করে (ঘনীভূত) এবং এর সাহায্যে জড়-শক্তির ক্রিয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করে পাদপরাজ্যে অর্থাৎ বায়ুর রাজ্যে আরোহন করে। এইখানে সে কীটাণুকীতে পরিণত হয়, এবং বায়ুর সাহায্যে চলাচল করে থাকে। এইখানে সে জড়দেহ ও বাসনাদেহ ধারণ করে। এর পরে পশুরাজ্যে প্রবেশ করে, সেখানে জড়দেহ-বাসনাদেহ-ভাবনাদেহ পুষ্ট ও সংহত (ঘনীভূত বা জমাটবাঁধা) ক'রে জীব মানব রাজ্যে আরোহন করে থাকে।
এই অবতরণের সময় যে কোষগুলো ধোঁয়ার মতো, অসংহত আবরণ মাত্র ছিল, আরোহনের সময় সেগুলো পুষ্ট হয়ে একে-একে দেহে পরিণত হতে লাগলো। বিজ্ঞানময় কোষ সংহত অর্থাৎ জামাটবেঁধে ক্রিয়াশীল হতে আরম্ভ হলে জীব মনুষ্যলোকে উন্নীত হয়।
মনুষ্যত্ব প্রাপ্তি দেবানুগ্রহেই সম্পন্ন হয়ে থাকে। মহেশ্বর শক্তি প্রত্যগাত্মার (অনু-জাতীয় জীব) মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিজ্ঞানময় দেহ গঠনে সহায়তা করে থাকে। কারন শরীরের স্থুলতম দেহ হচ্ছে বিজ্ঞানময় দেহ। আর এই বিজ্ঞানময় দেহে আশ্রিত চৈতন্যই জীবাত্মা। এবং জীবাত্মাই প্রকৃত মানব। ভাগবত অংশই প্রকৃত জীব বা প্রত্যগাত্মা। তার অংশ হিরন্ময়, আনন্দময়, ও বিজ্ঞানময় কোষে আবৃত হওয়ার পরে, জীব চৈতন্যের যে প্রকাশ তাহাই জীবাত্মা। আবার জীবাত্মার অংশের জড়দেহ, বাসনাদেহ ও ভাবনাদেহর আশ্রয়ে যে প্রকাশ তাকেই বলে ভূতাত্মা। মানুষের মধ্যে ভূতাত্মা ও জীবাত্মার সংগ্রামস্থল। এবং সেইজন্য মানুষ হচ্ছে দেব-মর্কট। মানুষ তার তিনটি দেহের সাহায্যে ভুলকে, ভুবর্লোকে ও স্বর্গলোকে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া বা শক্তির আদান প্রদান করে থাকে। জড়দেহ দ্বারা চেষ্টনা অর্থাৎ কিছু করবার জন্য শরীর ও মনের মধ্যে চঞ্চলতা সৃষ্টি করতে পারে। বাসনা দেহের দ্বারা সুখ-দুঃখের অনুভূতি ও কামনা করতে পারে। এবং ভাবনা দেহের সাহায্যে চিন্তা, বিচার, বিবেক ইত্যাদি বৃত্তির পরিচালনা হয়ে থাকে।
এখন কথা হচ্ছে মৃত্যুতে কি মানুষের সবই নষ্ট হয়ে যায়, না দেহাতিরিক্ত আত্মা সূক্ষ্ম জগতে বর্তমান থাকে ? মৃত্যুর সময় কি নিদির্ষ্ট ? এসব নিয়ে আমরা পরবর্তীতে আলোচনা করবো। আজ ব্রহ্মবাক্যের বিরতি দিলাম।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
কর্ম্মবাদ : ঈশ্বরের ইচ্ছে ব্যতীত গাছের একটা পাতাও নড়ে না।
আমাদের বিষয়টা ছিল এই রকম :
মল্লিনাথ মজুমদার লিখছেন : আমি এখন যা তা আমার পূর্বের কার্যের ফসল, এবং ভবিষৎ বর্তমান কার্যের l This is not hypothesis, but law of the Almighty.
মানিক ভট্টাচার্য লিখছেন : আমি সম্পূর্ণভাবে পূর্ব জন্মের কর্মফল এর উপর বিশ্বাস করি। আমাদের গত জন্মের অপূর্ণ ভোগবাসনা এবং কর্মফল ভোগ করার জন্য বারংবার এই পৃথিবীতে আসতে হয়। তাই চেষ্টা করেও অনেক সময় কারুর কাঙ্খিত ফল লাভ হয় না আবার অল্প চেষ্টাতেই কেউ তা লাভ করে। আমার এক বন্ধু রামকৃষ্ণ মিশন থেকে ভাল রেজাল্ট করে মাস্টার ডিগ্রী করে একটা চাকরীর জন্য কত ইন্টারভিউ দিয়ে শেষে একটা প্রাইমারী স্কুলে চাকরি পায়। আর আমি তার থেকে অনেক কমা ছাএ হয়েও স্কুল এর তিনটে চাকরি ছেড়ে(কোনো ঘুষ না দিয়ে বা নেতা না ধরে) বর্তমানে মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে অবসর প্রাপ্ত । একে আপনি কি ভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
অরিত্র সান্যাল লিখছেন : আমার মনে হয় যে প্রাণ শক্তি আমাদের মধ্যে থেকে সব কাজ করাচ্ছে বা যে চলে গেলে শরীর টা মৃত তাকে ধরে ভাবলে আদৌ কি এই সব ভালো বা খারাপ নিয়ে ভাবার প্রয়োজন আছে ?
পিয়ালী দত্তরায় লিখছেন : সুখ দুখ তো আপেক্ষিক ব্যাপার । আপাতদৃষ্টিতে ভালো মনে হলেও মনকে উচচূ স্তরে নিয়ে যেতে কি সকলে পারে ? টাকা দিয়ে সুখ কেনা গেলেও দুদিনে তার ভেঙে যায় । মানসিক উৎকর্ষতাই মানুষের কাঙ্ক্ষিত হয়া উচিত ।
সমিরন সিকদার লিখছেন : প্রসঙ্গত বলা যায় আমাদের অদৃষ্টের মূলে একমাত্র কর্ম ও তার ফলই প্রথম ও শেষ কথা। এক মুহূর্তের জন্যও কর্মছাড়া থাকা যায় না আর কর্ম হলেই তার ফলও প্রসব হয় এবং যেমন কর্ম তেমন ফল অর্থাৎ কর্ম অনুসারেই ফল পাওয়া যায়। অদৃষ্ট যেমন ভাগ্য অর্থাৎ পূর্বকৃত কর্মের ফল যা প্রাপ্য অংশ হিসাবে অবশ্যই পাওনা ছিল বলা যায় তেমনি অদৃষ্ট মানে অদেখা যা ফলেরই আলোকে তার কর্মের বিশেষণ মাত্র। ফল দেখছি কিন্তু তার কর্ম দেখিনি। সেটিই প্রারব্ধ কর্ম। এই প্রারব্ধ কর্ম ভালো হলে যেমন সৌভাগ্য বলে তার সুফল ভোগ করি তেমনি কর্মটি মন্দ হলে তা অদৃষ্টের বিড়ম্বনা বা দুর্ভাগ্য বলে মেনে নিই। কোনো কর্ম ফলই এড়িয়ে যাবার যো থাকে না। তবে শুদ্ধমন বা শুদ্ধাত্মার অধিকারী হলে দুর্ভাগ্যজনক কর্মফল যেমন লঘু করে নিতে পারা যায় তেমনই সৌভাগ্যময় কর্মফলে অপরের কল্যাণও করা যায়। আমাদের অনেকেই ইষ্টশক্তির প্রভাবে শুদ্ধাত্মা ভাব লাভ করে অদৃষ্টকে যথাসম্ভব অনুকূলে আনতে পেরেছেন তার উদাহরণ অনেক আছে। এটি এক ধরনের সাধনা বা প্রাণপণ প্রচেষ্টা। মানুষ হিসাবে আমরাই আমাদের কর্মফলের নিয়ামক। আমাদের অদৃষ্ট আমরাই গড়ে থাকি। তাই নিজের দুর্ভাগ্যের জন্য অপরকে দোষারোপ করতে পারি না। তা আমারই কৃতকর্মের ফল মাত্র। তবে একটা মজার ব্যাপার কৃতকর্মের ফল সে আশু বা সদ্যকৃত কিংবা অতীতের কৃতকর্মের ফলই হোক,তা পরবর্তী কর্মের মাধ্যমেই ভোগ করে থাকি। তাই অনেক সময় বাইরের থেকে বুঝে উঠতে পারি না যে সেটি কোন কর্মের ফল। কেমন গুলিয়ে ফেলি। এর জন্যই মনে হয় কেউ ভালো মানুষ হয়েও কষ্ট ভোগ করছে আর বদমায়েশ আরামে বা সুখে দিন কাটাচ্ছে। এই যে কর্মফলের কর্ম ও ফলভোগের কর্ম ও তার ফল এদুটির একটি শিকল তৈরী হতে হতে তা জীবনভর চলতেই থাকে নানা প্রাণী উদ্ভিদ জীব জড়কে আশ্রয় করে। জীবন মানে এখানে শুধু জন্ম মৃত্যুর মাঝে যে বিস্তার কেবল তা নয়। জীবাত্মার যতদিন মুক্তি না হয় অর্থাৎ মানুষ আত্মস্বরূপে পরমাত্মায় লীন বা একাত্ম হবার সময় পর্যন্ত। তার জন্যই কিন্তু আমাদের এত যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ রয়েছে। চরিত্র নির্মাণের মধ্যে দিয়েই নরপশু থেকে মানুষ ও মানুষ থেকেই দেবত্বে এবং ক্রমে নিজের ঈশ্বরত্বে লীন হতে পারি। সেটিই আমাদের ধর্ম। তাই ধর্মের মাধ্যমেই আমরা আমাদের অদৃষ্ট বা ভাগ্য নিজেই গড়তে পারি। বাইরের কোন জুড়ি বুটি বা জ্যোতিষীর দরকার হয় না।
এতক্ষন যা শুনলাম, তাতে আমরা বুঝে গেছি, যে আমরা আমাদের কর্ম্মফল ভোগ করছি। তা সে এই জীবনের হোক বা পূর্ব-পূর্ব জীবনের হোক। অর্থাৎ আমাদের ভাগ্য বা দুর্ভাগ্য বলতে বুঝি আমাদের পূর্ব-পূর্ব কর্ম্মফল । আর জীবন একটা কর্ম্ম ক্ষেত্র। এখানে সবাইকেই কর্ম্ম করতেই হবে। কর্ম্মহীন জীবন হয় না। আর কর্ম্ম মানেই তার ফল অবশ্যই আমাদের ভোগ করতে হবে। যদি এই জীবনে সেইসব কর্ম্মফলের সমাপ্তি না হয়, তবে আমাকে আগামী জীবনে সেই কর্ম্মফল ভোগ করতে হবে। এটাকেই আমরা বলছি প্রারব্ধ। অর্থাৎ কর্ম্ম আমাদের ছাড়ছে না, আর কর্ম্মফল ভোগ করবার জন্য, আমাদের আবার ফিরে ফিরে আসতে হবে এই মৃত্যুপুরীতে বা এই কর্ম্মক্ষেত্রে ।
তবে একটা কথা বলি, আমরা কি সবাই ব্যক্তিগত কর্ম্মফল ভোগ করি? সমষ্টিগত কর্ম্ম কি আমাদের প্রভাবিত করে না ? দেখুন আমার কর্ম্ম যেমন আমার পারিপার্শ্বিক সবাইকে প্রভাবিত করবে, ঠিক তেমনি অন্যদের কর্ম্মও আমাকে প্রভাবিত করবে। আমার ছেলে-মেয়ের কর্ম্ম, আমার স্ত্রীর কর্ম্ম, আমার পরিবারের কর্ম্ম, আমার সহ -কর্মীর কর্ম্ম, আমার রাষ্ট্রের কর্ম্ম, আমার জাতির কর্ম্ম, বৈজ্ঞানিকদের কর্ম্ম, ভালো লোকের কর্ম্ম, দুস্টু লোকদের কর্ম্ম, সবই আমাকে প্রভাবিত করে, এবং করবে। দেশ ভাগ হলে, তার দুর্ভোগ আমাকে পোহাতে হবে। দেশে দাঙ্গা লাগলে, তার দুর্ভোগ আমাদের পোহাতে হবে। দেশে মারি-মহামারী দেখা দিকে তার দুর্ভোগ আমাদের পোহাতে হবে। দেশে-দেশে রাষ্ট্র-নায়কদের যুদ্ধ ঘোষণা আমাদের প্রভাবিত করবে। দেশের রাষ্ট্র-নায়কদের তৈরি নিয়ম-কানুন আমাকে প্রভাবিত করবে। অতএব দেখা যাচ্ছে, শুধু আমার কর্ম্মই নয়, আমি যে পরিবেশে বাস করি, যাদের সাথে মেলামেশা করি, আমি যে পরিবারে বাস করি, যে রাষ্ট্রে বাস করি, এমনকি পৃথিবীর সবার কর্ম্মই আমাকে প্রভাবিত করতে পারে। শুধু তাই নয়, এই বিশ্ব-ব্রমান্ডের গ্রহ-নক্ষত্রের গতি পরিবর্তন হলে, তার প্রভাব প্রত্যেকটি জীবের মধ্যে প্রভাব ফেলতে পারে। সাতদিন যদি সূর্য না ওঠে, আমাদের ত্রাহি ত্রাহি রব উঠে যাবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়--বৃষ্টি-বন্যা হলে, আমাদের দুর্ভোগ পোহাতে হবে। অতএব, পৃথিবীর বা বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের গতি-প্রকৃতি ও তাদের সম্মিলিত কর্ম্ম আমাদের সবাইকে প্রভাবিত করবে। তাই শুধু আমি ভালো হলে, আমার কর্ম্ম ভালো হলে, আমি ভালো থাকতে পারবো, আর খারাপ কাজ করলে, আমি ভালো থাকতে পারবো না, তা কিন্তু নয়। আমার ভালো থাকার পিছনে, অনেকগুলো যদি-কিন্তু অবস্থান করছে। তাই যারা ভালো আছে, তার পিছনে যেমন অনেকগুলো কারন লুক্কায়িত আছে, তেমনি যারা খারাপ আছে, তার পিছনেও অনেক কারন লুক্কায়িত আছে। ব্যাপারটা এত সহজে নির্নয় করা যাবে না। এছাড়া একই কর্ম্ম স্থান, সময়,ও ব্যক্তি ভেদে ভিন্ন ফল প্রদান করে থাকে। তথাপি একথা বলা যেতে পারে, সবাই ভালো থাকলে, আমিও ভালো থাকবো। এটা কিন্তু সম্ভব হতে পারে। আর ঠিক এই কারণেই, মহাত্মাগণ, অবতারপুরুষগন, শুধু নিজের জন্য ভাবেন না, আমাদের সবাইকে ভালো করবার জন্য, ভালো রাখার জন্য, সবসময় চেষ্টা করে থাকেন।
এখন কথা হচ্ছে, এর থেকে আমরা রেহাই পেতে পারি কি ? এই কর্ম্মফলভোগ থেকে আমরা কিভাবে রেহাই পেতে পারি। এবারে আমরা একটু বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করবো। বা অন্যভাবে যদি একটু ঘুরিয়ে বলি, আমাদের সব কিছুর নিয়ন্তা ঈশ্বর। এটা যদি মেনে নেই, তবে, এই যে কর্ম্ম আমরা করে থাকি, তারও নিয়ন্ত্রক নিশ্চয়ই ঈশ্বর। তবে কর্ম্মের ফল বিশেষ করে খারাপ ফল আমাদের কেন ভোগ করতে হবে ? কেউ হয়তো বলবেন, আমাদের যতক্ষন কর্তৃত্ত্বাভিমান না যাবে, ততক্ষন ঈশ্বর আমাদের দায়িত্ত্ব নেবেন না। ঠিক আছে কর্তৃত্ত্বাভিমান আছে বলে আমরা আমাদের কর্ম্মফল ভোগ করছি। এই কথাটা যদি আমরা মেনে নিতে পারি, তবে আমাদের দুঃখ ভোগের একটা কারন বা উত্তর আমরা পেতে পারি। কিন্তু কোনো কর্ম্ম-ই আমাদের মৃত্যুকে রোধ করতে পারে না। আমি এই যে পৃথিবীর উপরে দাঁড়িয়ে আছি - এটা কি আমার ক্ষমতায়, নাকি মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে ? এই যে আমরা খাদ্য উৎপাদন করছি, এটা কি সূর্য্যশক্তি, জল, মাটি , বাতাস ছাড়া উৎপাদন করতে পারতাম ?পৃথিবীতে মানুষ তার পরিশ্রম দিয়ে যা কিছু তৈরি করেছে, তার মূল উপাদান কিন্তু এখানেই ছিল। নতুন কিছু সৃষ্টি আমরা করতে পারি না , আমরা কেবল নির্মাণ করতে পারি। মিশ্রণ করতে পারি।
অনেক যুক্তি ও উদাহরণ দিয়ে আমরা প্রমান করতে পারি, যে পুনর্জন্ম শুধু বিশ্বাস নয়, এটা বাস্তব। এই পুনর্জন্ম সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে আমরা যেমন কর্ম্ম করে থাকি, বা আমাদের বাসনা বা সংকল্প অনুযায়ী, আমরা উপযুক্ত ঘরে জন্ম গ্রহণ করে থাকি। দেখুন মানুষ নামক জীবটি কিন্তু লক্ষ-কোটি বছর আগে ছিল না। কালের রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে এই জীবের উৎপত্তি হয়েছে। এই যে ক্রমোন্নতি বা বিবর্তন এটা নিশ্চয়ই মানুষের ইচ্ছেয় বা জীবের কর্ম্মে হয় নি। এককোষী জীব সৃষ্টির আগে ছিল, ভাইরাস যাক কিনা বলা হয়ে থাকে বস্তু ও জীবের মধ্যবর্তী অবস্থা। এই ভাইরাসের আগে ছিল, বস্তু। তো বস্তুর কোনো কর্ম্ম ছিল না। তাহলে কর্ম্মই আমাদের বিবর্তন বা উন্নতির কারন তা কিন্তু নয়। এর পিছনে আছে বিশ্বশক্তি। যিনি প্রকৃতির মাধ্যমে এই কার্যটি সম্পাদন করে থাকেন। আমরা সবাই প্রকৃতির অংশবিশেষ। আর এই জন্যই প্রকৃতির নিয়মের দ্বারা আমরা নিয়ন্ত্রিত। আর এই প্রকৃতিই জীবের জন্ম দিচ্ছে আবার জীবের নাশ করছে। তাই তো দেখি, ঠাকুর রামকৃষ্ণ, শ্রী চৈতন্যদেব, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, ভগবান বুদ্ধ, বা ঈশ্বরের সন্তান যিশুখ্রিস্ট সবাই প্রকৃতিবধ্য। প্রকৃতির নিয়মের বাইরে কারুর যাবার উপায় নেই। তা সে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীট-পতঙ্গ বলুন, আর উন্নত মানুষ বলুন। সমস্ত জৈব শরীরই প্রকৃতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
একটু অবোধ্য হলেও একটা গভীর অনুভূতির কথা বলি, দেখুন, আমরা কেউ কর্ম্মই করি না। একথা শুনে, আপনি হয়তো একটু অবাক হচ্ছেন, কিন্তু সত্যি হচ্ছে, আমরা কোনো ঘটনা ঘটাতেই পারি না। কথায় বলে, ঈশ্বরের ইচ্ছে ব্যতীত গাছের একটা পাতায় নড়ে না। আসলে ঘটনা শুধু ঘটে আমরা তার সম্মুখীন হই মাত্র। অতীত বলুন, বর্তমান বলুন, আর ভবিষ্যৎ বলুন। সময় ও স্থানের একটা মাহাত্ম আছে। আর এই দুইটি এ'কে অন্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত। এদের অর্থাৎ সময় ও স্থানের আলাদা ভাবে কোনো অস্তিত্ত্ব নেই। এই দুটির মধ্যে একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বর্তমান। জগতে তা সে জগতের যেখানেই হোক, যখন কোনো ঘটনা ঘটে, তার একটা অবস্থান বা স্থান আছে। আর আছে একটা নির্দিষ্ট সময়, য্খন ঘটনাটা ঘটেছিলো । সুতরাং স্থান ও সময়ের মিলনে একটা ঘটনা নির্দিষ্ট হয়। জানবেন, সমুদয় ঘটনা এই রকম স্থান-সময়-এর সঙ্গে সংগঠিত হয়। আর এই সমুদয় ঘটনার সম্বলিত সত্ত্বা হচ্ছে জগৎ। এই নিখিল বিশ্বের সমস্ত ঘটনাবলী চিত্রে অংকিত আছে, এবং ভবিষ্যতেও থাকবে । কোনো একদিন আসবে, যেদিন মানুষ এই সময়ের চাকা উল্টোদিকে ঘোরাবে, আর সেসব জানতে পারবে। আমাদের সচেতন দেহ এই সকল ঘটনার অবস্থানের সংস্পর্শে আসলে, ঘটনা সম্পর্কে আমাদের একটা জ্ঞান উৎপন্ন হয়। তখন আমরা মনে করি ঘটনাটা ঘটলো। অনন্ত সময়ের অনন্ত ঘটনা চিত্র আকারে অনন্তে বিস্তৃত আছে। আর এই ঘটনার চলমান চিত্র ভবিষ্যৎ থেকে বর্তমান হয়ে অতীতের গর্ভে প্রবেশ করছে, কিন্তু তার লয় হচ্ছে না। ছবিটি ক্রমবর্দ্ধমান । বেড়েই চলেছে, বেড়েই চলেছে। প্রতিনিয়তএই চিত্রের রীল সম্প্রসারিত হচ্ছে। অতীত- ও ভবিষ্যৎ যেমন অংকিত ছিল, তেমনই আছে। ঘটনাগুলো প্রতিনিয়ত ঘটছে , আর আমরা সেই ঘটনার সামনে উপস্থিত হচ্ছি মাত্র। আমাদের জ্ঞান কেমন জানেন, ঘটনার ছবির উপরে বসা একটা মাছি বা পোকারূপ মনুষ্য মাত্র। এই পোকা যেসময়ে বসেছিল, বা বলা যেতে পারে, যখন সে বসতে বাধ্য হয়েছিল, সেই সামান্য সময়ের ছবিটি সে জানতে পেরেছিলো। সময় এই চিত্ররূপ ঘটনাগুলোকে টেনে নিয়ে চলেছে। সময় যখন মনুষ্যরূপ কীটকে প্রবাহমান ঘটনাচিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে দেয়, তখন তার ঘটনাচিত্রের জ্ঞান জন্মায়।
মানুষের স্বাধীন ভাবে কোন কর্ম্ম করবার ক্ষমতা নেই। এসম্পর্কে আমাদের মধ্যে মতের পার্থক্য থাকলেও, একটা কথা আমাদের বলতেই হবে যে স্বাধীন জীব সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। পুতুলের কোনো স্বাধীনতা থাকতে পারে না। বাজিকরের ইচ্ছেতেই পুতুল নাচে-কাঁদে-গায়।
এখন কথা হচ্ছে এর থেকে রেহাই পাবার উপায় কি ?
যেমন কর্ম্ম তেমন ফল এই প্রবাদ বাক্য মেনে নিলে, আমাদের দুটো সুবিধে হতে পারে। এক হচ্ছে সমাজকে শুভ কর্ম্মে প্রবৃত্ত করা যেতে পারে। আর হচ্ছে, মানুষকে একটা শুভ ভবিষ্যতের দিশা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, প্রকৃতির কাছে, শুভ অশুভ বলে কিছু নেই। প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে বাঁধা। প্রকৃতির রাজ্যে নিয়ম বহির্ভূত কোনো কাজ সম্পন্ন হয় না। প্রকৃতি ভালো-মন্দ বোঝে না। আর এই নিয়মের প্রবর্তক হচ্ছেন, বিশ্বশক্তি। যিনি নিজে কোনো নিয়মের ধার ধারেন না। অথবা বলা যেতে পারে, তিনি নিয়মের উর্দ্ধে। তিনিই নিয়মের শ্রষ্টা। আর এই বিশ্বশক্তি নজরুলের কথায় বিরাট শিশু, উপনিষদের ভাষায় বিরাটপুরুষ । এই শিশুর মধ্যে কার্য্য-কারন সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। যাঁকে আমরা পরম-আত্মা বলে থাকি। বা যা-কিছু বলতে পারি। আর এই বিশ্বশক্তির সামান্যতম অংশ আছে সমস্ত জীবের মধ্যে একেই আমরা বলি ইচ্ছাশক্তি। এই ইচ্ছাশক্তি কোনো নিয়মে বাধা নয়। আপনি যা কিছু ইচ্ছে করতে পারেন। আপনি যা কিছু চিন্তা করতে পারেন। আর ইচ্ছাশক্তিই পারে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে ।
জৈনধর্ম্মীগন বলে থাকেন, কর্ম্ম একটা সূক্ষ্ম জড় বস্তু। আর বিশ্বসৃষ্টিতে কর্ম্ম ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। জীবের স্বভাব হচ্ছে গতিশীলতা। অর্থাৎ জীব সবসময় মোক্ষের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আর এই চলার পথে যখন বাহ্যজগতের সংস্পর্শে আসে কর্ম্মের সুক্ষ জড়-কনা তখন আত্মার ভিতরে অনুপ্রবিষ্ট হয়। আত্মা ও কর্ম্মফলের এই বন্ধন জীবের উর্ধগতির প্রধান বাঁধা। এই বাঁধাকে অপসারণ করতে পারলেই, জীবের মোক্ষলাভ হতে পারে। তাই কর্ম্ম ও তার ফল শুভ বা অশুভ যাই হোক না কেন, আমাদের জন্ম-জন্মান্তরের ঘূর্ণিপাকে বেঁধে রাখে।
নির্দোষ মহাবীর একবার চুরির অপবাদে রাজার সান্ত্রীদের কাছে ধরা পড়েছিলেন । এতে করে মহাবীরের ভীষণ শারীরিক নির্যাতনের সন্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু এইসময় মহাবীর ছিলেন, নির্বাক। অর্থাৎ মৌনব্রত পালন করছিলেন। শেষে তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলানোর আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারনে তার ফাঁসির দড়ি বার-বার খুলে পড়ে যায়। তো যিনি নিষ্ক্রিয়, ঈশ্বরের প্রতি আস্থাবান, তার সমস্ত কাজই ঈশ্বর করে থাকেন। মারেনও তিনি বাঁচানও তিনি। আমাদের শুধু সেই বিশ্বশক্তির অনুভব করতে হবে। আত্মশক্তির অনুভব করতে হবে।
কোনো এক গুরুদেব বলেছিলেন, যা হবার তা হয়েই আছে। তুমি শুধু শুধু চিন্তা করে মরছ। তো শিষ্য বলেছিলেন, তা কি করে হয় ? আমি করছি তবেই তো হচ্ছে। তো শিষ্য কাজ বন্ধ করে দিলেন। গুরুদেব বললেন, এটাই তোমার ইচ্ছাশক্তি। এই ইচ্ছেশক্তি তোমাকে কাজ থেকে বিরত করতে পারে, আবার এই ইচ্ছেশক্তি তোমাকেকাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখতে পারে।
মহাত্মন এবং আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্য কি জানেন - মহাত্মাগণ যা চান তাই হয়, আর আমরা যা করি তাই হই। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, এইসব বিতর্কিত কথা কেন বলি ? কেউ একজন ভিতর থেকে বলে, তুমি বলো না আমি বলি।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
কর্ম্মবাদ (2) ঈশ্বরের ইচ্ছে ব্যতীত গাছের একটা পাতাও নড়ে না।
আমাদের সমস্ত কাজের সাফল্য নির্ভর করছে,দৈব ও পুরুষকারের সাহায্যে। আসলে দৈব পুরষকারকে সাহায্য করে। এই জন্য বলা হয়ে থাকে, ভগবান উদ্যোগীকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। এইজন্য বলা হয়ে থাকে, তুমি এক পা বাড়ালে ভগবান তোমাকে ১০ পা এগিয়ে এসে সাহায্য করবে। দৈব বিরূপ হলে তোমার পুরুষকার ফল প্রদান নাও করতে পারে। তবে নিয়তি, পুরুষকার থেকে অধিক শক্তিশালী। অর্জুন যার পিতা, স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যার মাতুল ও গুরু, সে কিনা চক্রব্যূহ মধ্যে আটকে নৃশংস ভাবে নিহত হলো ? দৈব বিহীন পুরুষকার আর পুরুষকার বিহীন দৈব নিষ্ফল। অর্থাৎ দৈব ও পুরুষকার মিলিত ভাবেই এই জগতের সমস্ত কার্য্য সম্পাদন করে থাকে। শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান বিষ্ণুর অবতার বলা হয়ে থাকে। তো ভগবানের ইচ্ছেতেই তো সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হতে পারতো। তিনি কিন্তু শত চেষ্টা করেও, মানুষ শ্রীকৃষ্ণ অবতার পুরুষ হয়েও, কুরুক্ষেত্রের ভয়ঙ্কর যুদ্ধ রোধ করতে পারেন নি। অতয়েব দেখা যাচ্ছে, পুরুষকার থেকে নিয়তি প্রবল।
জ্ঞানীগণ কোনো কিছু বিশ্বাস করতে বলেন না, আবার অবিশ্বাস করতেও বলেন না, কেবল অনুসন্ধান করতে বলেন। কিন্তু আমরা এই অনুসন্ধান-এর কষ্ট করতে চাই না। তাই বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় দুলি। শোনা যায়, বুদ্ধদেব জন্মের কয়েকঘন্টার মধ্যেই কথা বলতে শুরু করেন। আপনি কি বলতে পারেন, এই সৃষ্টির প্রারম্ভে, মহা-বিস্ফোরণ কেন হয়েছিল, এই মহাবিস্ফোরণের আগে কি ছিল ? বিশ্ব-সৃষ্টির সময় যে মহাতেজের প্রকাশ ঘটেছিলো, সেই তেজ বিস্ফোরণের আগে কোথায় ছিল ? জন্মের আগে আমরা সবাই কোথায় ছিলাম ? নাকি ছিলাম না। যদি না থেকে থাকি, তবে এলাম কোথা থেকে।
যদি বলেন, সবই আকস্মিক, তাহলে এই অদ্ভুত আকস্মিক শক্তির নিয়ামক কে ? আমাদের শরীরে ডিএনএ /আরএনএ এক অদ্ভুত প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির প্রবর্তক কে ? আমি জন্মের পরেই কাঁদা শুরু করেছিলাম, কে আমাকে কাঁদতে শেখালো ? মায়ের বুকের দুধ খেয়ে, আমি প্রথম হেসেছিলাম। কে আমাকে এই হাসা শিখিয়েছিলো ? আপনি বলবেন, আমরা মা-বাবার জিন থেকে এসব পেয়েছি। তো এই জিনের প্রবর্তক কে ? প্রশ্ন অনেক, কিন্তু উত্তর একটাই - এই সব কিছুর স্রষ্টা প্রকৃতি, আর নির্দেশক বা মহান শিল্পী হচ্ছেন, সেই বিশ্বশক্তি। প্রকৃতির সাহায্যে বিশ্বশক্তি আপন মনে খেলা করে চলেছেন।
এখন কথা হচ্ছে, পুরুষকার আমাদের জীবনে সাফল্য পেতে সাহায্য করে। একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই। পুরুষের চেষ্টা বা প্রযত্নকে বলে পুরুষকার। সমস্ত কর্ম্মের হেতু এই পুরুষকার। আসলে পুরুষকারের ধারাবাহিক স্রোতে ভাসাই জীবন। কথায় বলে "সুবুদ্ধি পুরুষকারে, দৈবে কি লঙ্ঘিতে পারে ?" অর্থাৎ পুরুষকার এর সঙ্গে যদি বুদ্ধি যুক্ত হয়, তবে নিয়তি একে লঙ্ঘন করতে পারে না। এইজন্য নিয়তি যখন প্রবল হয়, তখন আমাদের বুদ্ধিভ্ৰংশ হয়। অর্থাৎ তখন আমাদের বুদ্ধি আর পুরুষকারকে সাধ দেয় না। এবং আমরা নিয়তির কবলে পড়ি।
আর একটা কথা হচ্ছে, এই কর্ম্মের ফল জীব মাত্রেরই ভোগ করতে হয়। আসলে এই পুরুষকার প্রয়োগের ফলেই আমরা জন্ম-মৃত্যুর চক্রে ঘুরে ঘুরে মরছি। কেননা ভালো কর্ম্ম বলুন, বা খারাপ কর্ম্ম বলুন সব কর্ম্মের একটা ফল অবশ্যই আছে। আর তা আমাদের অবশ্য়ই ভোগ করতে হবে। যাঁরা এই জন্ম মৃত্যুর চক্র থেকে রেহাই পেতে চান, তাদের এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা এই বেরিয়ে আসার রাস্তাটা খুঁজবো।
আমরা যেমন ব্যক্তিগত কাজের সুফল-কুফল ফল ভোগ করে থাকি। ঠিক তেমনি সেটা থেকে রেহাই পেতেও পারি। দেয়ালে বল ছুড়ে মারলে সেই বল আমার দিকে ফিরে আসবে, কিন্তু আগের থেকে আমরা যদি বলের গতির দিক-নির্দেশ করতে পারি, তবে বল এসে আমার গায়ে/পায়ে নাও লাগতে পারে। সার্কাসের রিং-খেলা দেখেছেন, নিচে একটা জাল টাঙানো থাকে। হাত-ফস্কে কেউ যদি অধঃপতিত হয়, তবে সে ওই জালের সাহায্যে বেঁচে যাবে। এই জালটা হচ্ছে ঈশ্বরে সমর্পন। ঈশ্বরে ভক্তি। আর বলের গতির দিক নির্নয় করা হচ্ছে, অধ্যাত্মিক জ্ঞানলাভ অর্থাৎ জ্ঞানযোগ । অর্থাৎ সত্যকে জানা। সৎ ও অসৎ -এর মধ্যে পার্থক্য নির্নয় করতে পারা।
তিন তলা থেকে একটা বাচ্চা জানলা গলে পড়ে গিয়েছিলো। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো বস্তা বোঝাই ফুলের গড়ি। বাচ্চার শরীর সেই বস্তার উপরে পড়েছিল। বাচ্চাটা বেঁচে গেলো। অর্থাৎ এই বাচ্চাটির এই মুহূর্তে মৃত্যু নেই। অন্যদিকে দেখুন, রাস্তার পাশে তিনতলা বাড়িতে রঙের কাজ করছিলো, কিছু রঙ মিস্ত্রি। হাত ফস্কে সে নিচের দিকে পড়তে লাগলো। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো, একজন বৃদ্ধ। পড়বি তো পড় ওই বৃদ্ধের ঘাড়ে, মিস্ত্রির হাত-পা ছোড়ে গেলো বটে, কিন্তু মিস্ত্রি বেঁচে গেলো। কিন্তু ঘাড় মটকে মারা গেলো বৃদ্ধ। হ্যাঁ এগুলো ব্যতিক্রমী ঘটনা। আর এইজন্যই বলে "রাখে হরি মারে কে" ?
অতয়েব একটা জিনিস পরিষ্কার যে পুরুষকার থেকে নিয়তি অধিক শক্তিশালী। আর এই নিয়তিই পারে আমাদেরকে মোক্ষের পথে নিয়ে যেতে। এবং আমরা সবাই একদিন এই নিয়তির হাতধরেই মোক্ষ লাভ করবো। আর যত আমরা পুরুষকারের বড়াই করবো, তত আমরা বার বার এই মৃত্যুপুরিতে ফিরে ফিরে আসবো আর জীব যন্ত্রনা ভোগ করবো।
সাপুড়ের ঝুড়িতে একটা বিষধর সাপকে দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ করে রেখেছিলো। সাপটি অনাহারে মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছিল। ইঁদুর ভাবলো, ঝুড়িতে নিশ্চই খাবারের দানা আছে। তো সেই ইঁদুর ঝুড়ি কেটে ঝুড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো। আর ঠিক তক্ষুনি সাপটি ইঁদুরকে খেয়ে প্রাণ বাঁচালো, আর ঝুড়ির কাটা স্থান দিয়ে, সাপটি বেরিয়ে এলো। সাপের পৌষমাস - কিন্তু ইঁদুরের সর্ব্বনাশ। ইঁদুরের পুরুষকার ব্যর্থ হলো। এমনকি সর্ব্বনাশ হলো।
মেঘনাথ সাহা একসময় মুদির দোকানে কাজ করতেন। পরবর্তীকালে বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হয়েছিলেন। একটা স্বাধীন রাষ্ট্রপতি ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন উৎসবে বলেছিলেন - আমি কোনোদিন ইউনিভার্সিটির দোরগোড়ায় পৌঁছতে পারিনি। আজ সেই আমি ইউনিভার্সিটির আচার্য্য। এসব কি পুরুষকারের দৌলতে হতে পারে ? এমনি উদাহরণ হাজার হাজার দেওয়া যেতে পারে। পুরুষকার মানুষকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু পৌঁছে দিতে পারে না।
পুরুষকার ব্যতীত জগৎ গতিহীন হয়ে পড়বে। প্রকৃতি ও পুরুষের মিলন ছাড়া যেমন জীবসৃষ্টি সম্ভব নয়, তেমনি দৈব ও পুরুষকারের মিলন ব্যতীত এই সংসারে কার্যসিদ্ধি অসম্ভব। নিয়তি প্রসন্ন থাকলে তার মধ্যে পুরুষকারের স্ফূর্তি দেখা যাবে, এবং সমস্ত কার্য্যে সাফল্য দেখা যাবে। আর যদি নিয়তি বিরূপ থাকে, তবে আমাদের বুদ্ধি কাজ করবে না, নানান রকম বাধা-বিঘ্ন দেখা দেবে কোনো কাজেই আমরা সফলতা পাবো না। এইজন্য বলা হয়ে থাকে দৈব-বিহীন পুরুষকার আর পুরুষকার-বিহীন দৈব উভয়ই নিষ্ফল। পুরুষকারকে শক্তিশালী করতে গেলে আমাদের দৈবের সহযোগিতা নিতে হবে আর তা একমাত্র ভগবৎ কৃপাতেই সম্ভব। এই ভগবৎকৃপা কিভাবে পাওয়া সম্ভব সেই সম্পর্কে আমরা পরবর্তীতে আলোচনা করবো।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
কর্ম্মরহস্যঃ (১) ঈশ্বরের ইচ্ছে ব্যতীত গাছের একটা পাতাও নড়ে না।
আগের দিন আমরা শুনেছিলাম, দৈব-বিহীন পুরুষকার আর পুরুষকার-বিহীন দৈব উভয়ই নিষ্ফল। পুরুষকারকে শক্তিশালী করতে গেলে আমাদের দৈবের সহযোগিতা নিতে হবে আর তা একমাত্র ভগবৎ কৃপাতেই সম্ভব। এই ভগবৎকৃপা কিভাবে পাওয়া সম্ভব সেই সম্পর্কে আমরা পরবর্তীতে আলোচনা করবো। কর্ম্মফল থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য, আমাদের ভাগবত কৃপা প্রয়োজন। এই কর্ম্ম কি সে সম্পর্কে আমাদের একটু বিস্তারিত জানার প্রয়োজন। তাই আজ আমরা কর্ম্ম সম্পর্কে কিছু প্রয়োজনীয় কথা শুনে নেবো।
পৃথিবীটা আসলে কর্ম্মক্ষেত্ৰ। এখানে জন্মগ্রহণ ক'রে, আমরা যা কিছু করে থাকি, সবই কর্ম্ম। আর এই কর্ম্ম আমাদের ইন্দ্রিয় দ্বারা করতে হয়। মন হচ্ছে সমস্ত ইন্দ্রিয়ের রাজা। তো মনের যা কিছু কর্ম্ম অর্থাৎ চিন্তা-ভাবনা, বা ইন্দ্ৰীয়কৃত সমস্ত ক্রিয়াই কর্ম্ম।
১) ইন্দ্রিয়ের সাথে বিষয়-সংযোগের যে ইচ্ছে তাকে বলে কামনা। রূপ,রস,গন্ধ,স্পর্শ,শব্দ প্রভৃতি উপভোগ করবার যে প্রবৃত্তি আমাদের মনে বর্তমান থাকে, যার দ্বারা ভোগ্যবিষয়ে মানুষের আসক্তি জন্মে, তা মানুষের কামনা প্রসূত। এই যে কামনা এর সঙ্গে ধর্ম্মের কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু মোক্ষলাভের জন্য যারা উদ্গ্রীব, তাদের কাছে এগুলো কখনো গ্রহণীয় নয়। একটু আত্ম-অনুসন্ধানের প্রবৃত্তি যাদের মধ্যে জেগেছে, তারা বুঝবেন, ধর্ম্মের সঙ্গে প্রবৃত্তির সবসময় সংঘর্ষ চলছে। আমাদের যাতে ন্যায্য অধিকার নেই, আমরা সেগুলো পাবার জন্য ব্যাকুল। এই বাসনা আমাদের মনকে চঞ্চল করে তোলে। তাই মহাত্মাগণ বলে থাকেন, বুদ্ধি-বিবেক-বৈরাগ্য ও অভ্যাস দ্বারা মনের এই চঞ্চলটাকে দূর করো।
২. মনের অন্য আর-এক রকম প্রবৃত্তি আছে, যাতে আমাদের কামনার কোনো প্রভাব নেই, একটা আধ্যাত্মিক বাসনা আছে। আমি আমার চরিত্রের উন্নতি করবো, চিত্তের সংযম পালন করবো। স্বার্থত্যাগ করবো। পরের ভালোর জন্য কাজ করবো। শুধু নিজের আত্মীয়-স্বজন নয়, সমস্ত মানুষের জন্য কাজ করবো। পৃথিবীর সবাইকে ভালো বাসবো সবার প্রতি আমার ক্ষমা-দয়া-করুনা থাকবে। ইত্যাদি ইত্যাদি। এছাড়া জ্ঞান অর্জন করবো, জ্ঞান বিতরণ করবো। অর্থাৎ নানান রকম পরহিতকর কাজে আমাদের জীবন দান করবো। এইযে সব ভালো ভালো আজ করবার জন্য আমাদের ইচ্ছে, এগুলোও আমাদের বাসনা এরও উৎপত্তি স্থান হচ্ছে মন।এই দুই ধরনের কর্ম্মের ভাবনা আমাদের মনের মধ্যে উদয় হয়।
৩. এখন এই যে মনের মধ্যে ভালো-মন্দ কাজের ভাব উদয় হয়েছে, এই ভাব স্থূল কর্ম্মে রূপ নিলে বা এই চিন্তা-ভাবনা কর্ম্মে রূপ না দিলেও, উভয়ই কিন্তু কর্ম্ম। মনের মধ্যে উদয় হওয়া অসম্পাদিত কর্ম্ম ও সম্পাদিত কর্ম্ম - এই দুইয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। হ্যাঁ এই দুই ধরনের কর্ম্মের ফলের মধ্যে পার্থক্য থাকতে পারে। একটা শুভ ফল প্রদান করবে, আর একটি অশুভ ফল প্রদান করবে। কিন্তু উভয় কর্ম্ম-ই অবশ্যই ফল প্রদান করবে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, মন যখন কোনো সংকল্প করে, এবং ইন্দ্রিয়ের সাথে নির্দিষ্ট বিষয়ের সংযোগ সাধন করে থাকে। তখন তাকে আমরা তাকে স্থূল দেহের কর্ম্ম বলে থাকি। আবার ধরুন, আমার মনের মধ্যে একটি কামনার সৃষ্টি হলো, কিন্তু বিষয়ের সাথে তার কোনো যোগ ঘটলো না, তখন যে কর্ম্ম সম্পাদিত হলো, সেটি হচ্ছে, আমাদের কামনা দেহের কর্ম্ম। এটি স্থূল দেহের কর্ম্ম নয়। শুভ বা উচ্চ শ্রেণীর যে ভাবনা আমাদের মনে উদয় হয় - তবে সেটি জানবেন আমাদের মানস দেহের কর্ম্ম।
ধরুন, আপনি কিছু সুস্বাদু খাবার দেখলেন, অমনি আপনার মধ্যে সেই খাবার গ্রহণ করবার জন্য, ভাবনা উদয় হলো। এটি হচ্ছে আমাদের কামনা দেহের কর্ম্ম। এরপর এই খাবার আপনি গলাদ্ধকরন করলেন। তো তখন হলো স্থুলদেহের কর্ম্ম। খাবার মুহূর্তে আপনি দেখলেন, আপনার সামনে এক শীর্ণকায়, ক্ষুধার্থ ব্যক্তি হাজির হলো, তখন আপনি ওই খাবার না খেয়ে, ওই ক্ষুধার্থ ব্যক্তিকে খেতে দিলেন। এটি আমাদের মানস দেহের কর্ম্ম।
অর্থাৎ স্থূল দেহের কর্ম্ম - কামনা দেহের কর্ম্ম - ও মানস দেহের কর্ম্ম এই তিন ধরনের দেহে আমরা কর্ম্ম করে থাকি। আমাদের মতো মতো সাধারণ মানুষ কেবলমাত্র স্থূল দেহের কর্ম্মকেই কর্ম্ম বলে আখ্যা দিয়ে থাকি। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের আরো দুটো দেহ আছে, অর্থাৎ কামদেহ ও মানসদেহ, যাদের কর্ম্ম করবার শক্তি আছে, এবং যারা সর্বদা কর্ম্ম করে থাকে।
আর একটা জিনিস আমাদের মনে রাখতে হবে যে পৃথিবী এবং এই মুহূর্তে আর একটা গ্রহ যার নাম শুক্রগ্রহ, এই দুই জায়গায় আমাদের কর্ম্ম প্রবাহ চলছে। পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন, এই মুহূর্তে শুক্রগ্রহে আমাদের থেকে উন্নতশ্রেণীর জীব বাস করছে। তারাও কর্ম্মে লিপ্ত আছে। অর্থাৎ পৃথিবী ও শুক্রগ্রহে জীবনের প্রবাহ চলছে। যাইহোক, আমরা যেহেতু পৃথিবীর জীব, আমাদের কর্ম্মভূমি এই পৃথিবী। পার্থিব জীবনে আমরা যেসব কর্ম্ম করে থাকি, সেই সমস্ত কর্ম্মের ফলভোগ আমাদের এই পৃথিবীতে থাকতেই ভোগ করতে হবে। অথবা এই কর্ম্মফল ভোগ করবার জন্য, আবার আমাদের পৃথিবীর বুকে জন্মগ্রহণ করতে হবে। যেসব কর্ম্মের ফল ভোগ করবার জন্য, আমরা এই পৃথিবীতে এসেছি, সেগুলো আমাদের প্রারব্ধ কর্ম্ম। এইসব কর্ম্ম ফলদানে উন্মুখ। একে রোধ করা যায় না। প্রারব্ধ কর্ম্মের ফল অবশ্য়ই আমাদের ভোগ করতে হবে। আবার এই পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করে আমরা যে কর্ম্ম করছি, বা করবো, তা আমাদের ক্রিয়মান কর্ম্ম। এই ক্রিয়মান কর্ম্মের ফল কর্ম্মের মান অনুযায়ী, কিছু কর্ম্মফল আমাদের এই জন্মেই ভোগ করতে হবে, আর যেসব কর্ম্ম বিলম্বে ফল প্রদান করবে, তাকে বলা হয়, সঞ্চিত কর্ম্ম। এই সঞ্চিত কর্ম্মফল আমাদের ভবিষ্যতে ভোগ করতে হবে। এছাড়া যেসব পূর্ব-পূর্ব জীবনের সঞ্চিত কর্ম্মের ফল যা এখনো আমাদের ভোগ করা সম্ভব হয় নি - সেগুলোর কিয়দংশ প্রারব্ধ রূপে এই জীবনেই ভোগ করতে হবে।
মহাত্মাগণ বলছেন - যতক্ষন আমাদের আত্মজ্ঞান না জন্মাচ্ছে ততক্ষন ভবিষ্যৎ বা ভাবি জীবনেও এই কর্ম্মের প্রভাব ভোগ করতে থাকবো।
এর পরের দিন আমরা চিন্তাদ্বারা কৃত কর্ম্মের সন্মন্ধে শুনবো।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
কর্ম্ম রহস্যঃ - চিন্তাই কর্ম্মের মূলউৎস - ২
নিজের ভবিষ্যৎ জীবনের কোনো কাল্পনিক সুখের চিত্র আঁকতে যাবেন না। অবশ্য তার মানে এই নয় যে ভবিষ্যৎ কর্ম্মের পরিকল্পনা করা হবে না। ভবিষ্যৎ কর্মধারার একটা পরিকল্পনা অবশ্য়ই করা উচিত। তার পর সব ঈশ্বরের উপরে ছেড়ে দেওয়া উচিত। তিনি আমাকে দিয়ে যা করতে চান,তাই হোক। ফলও তাঁর ইচ্ছেতে হোক। আমরা যদি আধ্যাত্মিক উন্নতি করতে চাই, আধ্যাত্মিক অনুভূতি লাভ করতে চাই, তবে খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো যেন ঈশ্বরের উপরে ছেড়ে দেই। আমরা জানি না ভবিষ্যতে কি হবে। সেই দূরদৃষ্টি আমাদের নেই। যদিও আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ সন্মন্ধে না ভেবে পারি না, কিন্তু আমাদের সেই পরিকল্পনা তো ঈশ্বরের ইচ্ছে ছাড়া পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। এই জিনিসটা আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে। এবং ধীরে ধীরে আমাদের শিখতে হবে কিভাবে আমরা ঈশ্বরের সুরে সুর মিলাবো। তার ইচ্ছেকে কিভাবে আমরা অনুসরণ করবো। যদি আমরা এই কাজে ঐকান্তিক হই, তবে তবে একসময় আমরা অবশ্যই তার ইচ্ছেকে ধরতে পারবো। এবং তার পিছু পিছু চলতে
পারবো।
আমাদের যে কর্ম্মফল যাকে আমরা ভাগ্য বলে থাকি, এই ভাগ্য বা কর্ম্মফল তিনটে দড়ি দিয়ে বাধা। এক হচ্ছে, আমাদের চিন্তা বা সংকল্প, দ্বিতীয়ত আমাদের কামনা, তৃতীয়ত আমাদের কর্ম্ম। এই তিনটাকে অবলম্বন করেই আমরা আমাদের ভাগ্য সৃষ্টি করে থাকি। কর্ম্ম-ইন্দ্রিয় দ্বারা আমরা যে কর্ম্ম করে থাকি, তা আমাদের প্রয়োজন ও প্রবৃত্তির বসে করে থাকি। এই প্রবৃত্তির বশে যখন আমরা কর্ম্ম করি, তখন আমাদের বিবেক-বুদ্ধি সবসময় কাজ করে না। আর এই সব কর্ম্মের জন্য আমাদের অনেক সময় অনুতাপে দগ্ধ হতে হয়। আমরা সাধারণত এটা ভাবতেই পারি না যে চিন্তা আবার কোনো কাজ সম্পাদন করতে পারে। শারীরিক উদ্দম বিনা, শুধু চিন্তাশক্তির দ্বারা কোনো কাজ করা যায়, তা আমরা বুঝতে পারি না। আমাদের মতো সাধারণের ধারণা হচ্ছে, যেকোনো কাজ করতে গেলে আমাদের শারীরিক উদ্দম অবশ্যই প্রয়োজন।
আমাদের ধারণা হচ্ছে, চিন্তা আমাদের মনের একটা অবস্থা বিশেষ। আসলে চিন্তা একটা বস্তু, এবং বস্তুর সমস্ত উপাদান আমাদের চিন্তার মধ্যে নিহিত আছে। এই চিন্তা দ্বারা আমরা আমাদের নিজেদের উপকার বা অপকার করে থাকি। এমনকি এই চিন্তা দ্বারা আমরা অপরের উপকার বা অপকার করতে পারি। চিন্তার কার্যকরী ক্ষমতা সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই নেই। দেখুন, একান্ত-মনে চিন্তা করাই হচ্ছে তপস্যা। তপস্যার ফল সম্পর্কে আমরা অবহিত আছি। মুনি ঋষিগণ তাদের এই তপস্যার দ্বারাই, সমস্ত জ্ঞান সংগ্রহ করে থাকেন। যা আসলে পরবর্তীতে শাস্ত্র হিসেবে খ্যাত হয়েছে। তপঃপ্রভাব সম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে কোনো কিছুই দুর্লভ নয়। জাগতিক সমস্ত কিছুই তার হস্তগত। তপস্যার দ্বারাই ঋষিগণ বা যোগীগণ অনিমা-লঘিমা ইত্যাদি ঐশর্য্য লাভ করে থাকেন।এসব কথা আমরা পতঞ্জলির যোগসূত্রে শুনেছি । এমনকি আমাদের মতো সাধারণের মানুষের চিন্তাও কখনো নিস্ফল হতে পারে না। সমস্ত চিন্তার একটা ফল আছে, তবে চিন্তা যত গভীর হবে, চিন্তার ফল তত দৃষ্টিগোচর হবে। চিন্তা তখন স্থুল আকার নেবে।
আমরা জানি, ভূলোকের সাথেই ওতপ্রোত ভাবে অবস্থান করছে অসংখ্য সূক্ষ্ম লোক। আমাদের দেহ এই লোকভেদে স্থুল ও সূক্ষ্ম ইত্যাদি হয়ে থাকে। সূক্ষ্ম দেহের জ্যোতির্বিম্ব আমাদের স্থূল দেহের চতুর্দিকে প্রায় দেড়ফুট পর্যন্ত রামধনুর মতো বিস্তৃত হয়ে আছে। গভীর ধ্যানমগ্ন ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে আপনি স্বয়ং এগুলো প্রতক্ষ্য করতে পারবেন। এই সূক্ষ্ম দেহই আমাদের কামনার আধার। এইজন্য এই সূক্ষ্ম দেহকে কামনা দেহ বলা হয়ে থাকে। মনের আবেগ ও কামনার প্রভাবের তারতম্যের জন্য, এই সূক্ষ্ম দেহের জ্যোতির্বিম্বের বর্ণ ও ঘনত্ত্বের মধ্যেও তারতম্য লক্ষ করা যায়। আমাদের মনে যে প্রবৃত্তি জেগে ওঠে, সেই অনুযায়ী আমাদের সূক্ষ্ম দেহের বর্ণের পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এবং এই বর্ণময় জ্যোতির্বিম্ব সুক্ষ জগৎ হতে সুক্ষ পরমাণু আকর্ষণ করে থাকে। এতে করে শত শত আজ্ঞাবাহী চিন্তামূর্তি সৃষ্টি হয়। এইসব চিন্তামূর্তি যেহেতু আমাদের মানসিক জগতের নিম্নস্তরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, সেইজন্য, সূক্ষ্ম উপকরণে নির্মিত এই সব পদার্থে বা চিন্তামূর্তিতে কিঞ্চিৎ পরিমানে চৈতন্যের সঞ্চার হয়ে থাকে। আমাদের প্রবৃত্তির লক্ষবস্তু যদি নিকটে থাকে, তবে সেই লক্ষবস্তুর নিকটে গিয়ে তার সূক্ষ্মদেহে একই প্রকার প্রবৃত্তির উন্মেষ ঘটাতে চেষ্টা করে। প্রেরকের চিন্তা যত গাঢ় হবে, এবং যত বেশিক্ষন স্থায়ী হবে, এইসব চিন্তাপ্রসূত জীবাণুর অস্তিত্ত্ব তত বেশি স্থায়ী ও ফলপ্রদ হবে। এই জন্য মহাত্মাগণ আমাদেরকে কুচিন্তা পরিহার করতে বলে থাকেন। কুচিন্তার প্রভাব শুধু অন্যকে ক্ষতি করে তাই নয়, এতে করে নিজের ক্ষতি সাধন করে থাকি আমরা। আমাদের চিন্তা সৃষ্ট অনুদেহ লক্ষবস্তুকে আঘাত করে আবার উৎসে ফিরে আসে, ফলত চিন্তার অধিকারীকে প্রভাবিত করে।
এখন কথা হচ্ছে, আমাদের এই কুচিন্তা বা সুচিন্তা কেন হয় ? প্রথমে বলি কুচিন্তা কেন হয়। কুচিন্তার কারন হচ্ছে আমাদের অষ্টবিধ পাশ। এগুলো হচ্ছে, ঘৃণা - লজ্জ্বা -ভয় - বিপর্যয় জ্ঞান - অজ্ঞান - কুলাভিমান - স্বভাৱ - জাতি। এই অষ্টবিধ পাশ আমাদের কুচিন্তার পথে নিয়ে যায়। এই কুচিন্তার ফলে যে রক্তবীজ উৎপন্ন হয়, তাকে বলে অসুর। এই অসুর, আমাদের নিজেদের এমনকি অন্যের ক্ষতি সাধন করবার জন্যই সৃষ্টি হয়ে থাকে। আমরা কিন্তু আমাদের চিন্তার সাহায্যে দেবশক্তির জন্মও দিতে পারি। যেমন ওম বা প্রণবের উচ্চারণ ও চিন্তন, আমাদের শ্রীগুরুর উৎসাহবাক্য - সমর্পন - জ্ঞান। মা চন্ডীর অসুর নিধন লীলা যারা জ্ঞাত আছেন, তারা এই ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পারবেন। এই ব্যাপারে আমরা বিস্তারিত আলোচনার অন্য সময় করবো।
মানুষের শারীরিক শক্তির একটা সীমা আছে। অর্থাৎ স্থূল শরীরের শক্তির একটা সীমা আছে। কিন্তু আমাদের মানসিক শরীরের অর্থাৎ আমাদের মনের ক্ষমতা অসীম। স্থূল শরীর দ্বারা আমরা যত কাজ করতে পারি, তার থেকে অধিক পরিমানে আমরা কাজ করতে পারি, আমাদের সুক্ষ দেহে। মনের গতি অপ্রতিহত। চিন্তা শক্তি অসীম। সুতরাং মনের সাহায্যে যে কাজ আমরা করতে পারি, তা সে ভালো হোক বা মন্দ হোক, তার সংখ্যা অনন্ত। আর তার কুফল বা সুফল অনন্ত। খারাপ লোক সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে এদের নিঃশ্বাসে বিষ। অর্থাৎ খারাপ লোকের চিন্তা প্রসূত জীবাণু আমাদের ক্ষতি করতে পারে। ঠিক তেমনি যে সব মহাত্মাগণ সবসময় মঙ্গল চিন্তা করে থাকেন, তাদের কাছে গেলে একটা নিশ্চিন্ত মঙ্গলময়, ভালোলাগা প্রবাহ আমরা অনুভব করতে পারি।
আমরা মনে করি, চিন্তা আমাদের মনের একটা অবস্থা মাত্র। কিন্তু আসলে চিন্তা বস্তু ও বিষয় দুইই হতে পারে। চিন্তার গভীরতা ও তারতম্য অনুসারে, চিন্তা প্রসূত বস্তু সবল বা দুর্বল হয়ে থাকে। চিন্তার স্রোত অবিরাম চলছে। সুতরাং চিন্তা প্রসূত মূর্তি, রক্তবীজের ন্যায় ঝাঁকে ঝাঁকে উৎপন্ন হচ্ছে। এরা কৃত্তিম হলেও ভৌতিক বস্তু। এদের কাজ করবার শক্তি আছে, জীবনীশক্তি আছে, এদের বুদ্ধিও আছে। আমরা চন্ডী পূরাণে দেখেছি, প্রবল শক্তি থেকে উদ্ভূত এই সকল ভৌতিক সত্ত্বা, ভীষণ রনবাহিনী-রূপে ভয়ানক সব কার্য্য সম্পন্ন করছে। আমাদের মতো সাধারণের চিন্তা শক্তি দুর্বল, তাই আমাদের চিন্তা প্রসূত সত্তা সকল দুর্বল ও স্বল্পস্থায়ী। আমাদের চিন্তা সবসময় নতুন নতুন সত্তার জন্ম দিচ্ছে, এবং একই বিষয়ে যখন চিন্তা বলবতী হয়, তখন পূর্বপ্রসূত সত্তাগুলোর জীবনীশক্তি বৃদ্ধি পায়।
হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী শ্রাদ্ধ কর্ম্মে যে সব বৈদিক মন্ত্র পাঠ করা হয়, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে, শুভ ইচ্ছা উচ্চারিত হলে বা শুভ চিন্তা যখন বাক্যে উচ্চারিত হয়, তখন সূক্ষ্ম জগতে এই মন্ত্র অসংখ্য আজ্ঞাবহ সচেতন মূর্তি সৃষ্টি করবে। এসব মূর্তি কামলোকবাসী মৃত আত্মীয়ের অনুচর রূপে তাদের বিশেষ উপকার সাধন করবে। বৈবাহিক অনুষ্ঠানেও এইসব মন্ত্র উচ্চারণ নব-বধূর ভাবি জীবনে মঙ্গলের উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকে। বধূর শরীরে যদি অশুভ শক্তি থাকে, বা স্বামীর শরীরে যদি অশুভ শক্তি থাকে যা একে অপরের মঙ্গল সাধনের পরিপন্থী তবে এই শক্তিশালী মন্ত্র বা আমাদের ইচ্ছাশক্তির শব্দরূপ শক্তিকে নিরাকৃত করবে।আমাদের চিন্তা প্রসূত অসংখ জীবাণু, সূক্ষ্ম -জগৎ-বিহারী এইসব জীবাণু জীবজগতে যে প্রভাব বিস্তার করতে পারে তা আমরা কল্পনাও করতে পারি না।
যাই হোক, কর্ম্ম সম্পর্কে আমাদের আলোচনা ভবিষ্যতে আবার করবো। আজ বাক্যের বিরাম দিলাম।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
কর্ম্ম রহস্যঃ - (তিন) ক্রিয়মান কর্ম্ম
আমরা শুনেছি, কর্ম্ম আমাদের তিন প্রকার - প্রারব্ধ, সঞ্চিত ও ক্রিয়মান। এর মধ্যে ক্রিয়মান কর্ম্ম গুরুত্ত্বপূর্ন। কারন এই ক্রিয়মান কর্ম্মই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে থাকে। ভবিষ্যৎ মানে আমি বলতে চাইছি ভবিষ্যৎ জন্ম। এই জীবনে বা বর্তমানে আমি যা কিছু কর্ম্ম করবো, তার শুভ-অশুভ আমি ভবিষ্যৎ জীবনে ভোগ করবো। অর্থাৎ আজ যে কর্ম্মের কর্তা আমি, ভবিষ্যতে আমি সেই কর্ম্মের দাস হয়ে যাবো। মানুষের স্বাধীন ইচ্ছে বলে যদি কিছু থাকে, তবে সেই ইচ্ছের প্রভাব খাটিয়ে আজ যাকিছু আমি করবো, অর্থাৎ এই জন্মে আমার ইচ্ছেকে যেভাবে প্রয়োগ করবো, আমার আগামী জন্মের ভাগ্য সেই অনুযায়ী গঠন হতে পারে।
আমরা যে কোনো কাজ করি না কেন, তার যদি কারন অনুসন্ধান করি, তবে দেখতে পাবো, বার বার চিন্তার ফলেই সেই কাজ সংগঠিত হয়েছে। শুভ বা অশুভ , ভালো বা মন্দ যেমন ধরনের কাজই হোক না কেন, এর মুলে আছে আমাদের কামনা। প্রবৃত্তির তাড়নায়, আমাদের মনে কুচিন্তা আসছে, কিন্তু বিবেক-বুদ্ধির শাসনে আমরা আমাদের কুচিন্তা কার্য্যে পরিণত করতে পারছি না। কিন্তু বার বার চিন্তা করবার ফলে, আমাদের মনের গভীরে একটা ছাপ পড়ছে, যাকে বলা হয় প্রবৃত্তি। আর সময় ,সুযোগ পেলে, এই প্রবৃত্তি বিবেক-বুদ্ধির শাসন অমান্য ক'রে, আমরা সেই কর্ম্মে লিপ্ত হয়ে যাবো। অনেক সময় এইভাবেই আমরা আমাদের অজান্তে কুকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ি।আর তার পরিণতি ভোগ করতে বাধ্য হই ।
আমাদের পূর্ব-পূর্ব জীবনের কর্ম্ম-ফলের প্রভাবে, আজকের এই দেহ, স্বভাব,মস্তিস্ক, চিন্তাশক্তি,বিবেক ও পারিপার্শিক নির্মিত হয়েছে। আর এই কর্ম্ম-ফলের প্রভাবেই, আমরা নিচ-স্বভাবের বা সৎস্বভাবের মাতা-পিতা বেছে নিয়েছি। আমাদের আধ্যাত্মিক ভাবের দৈন্যতা বা আধিক্য হেতু আমাদের স্বভাব, আমাদের মনোবৃত্তি পেয়েছি। এমনকি আমাদের পছন্দ মতো, পরিবার বা পরিবেশ পেয়েছি। এইজন্যই ছোটবেলা থেকেই একেকজনের জনের স্বভাবের মধ্যে ধ্যানের প্রতি আগ্রহ দেখা যায়, বৈরাগ্যের ভাব দেখা যায় আবার কারুর মধ্যে ভোগের প্রতি লিপ্সা, বা বিবাদের প্রতি আগ্রহ দেখা যায়। ইন্দ্রিয়াশক্তি, নিষ্ঠুরতা, ক্রূরতা দেখা যায় - আবার অন্য দিকে কিছু বালকের মধ্যে স্থিরতা, মৌনতা, জ্ঞানসংগ্রহে আগ্রহ দেখা যায়। আমার এক বন্ধুর ছেলে, মুরগি কাটা দেখলে, আনন্দে লাফাতো। আর আমার ছেলে, মাছ কাটতে দেখলেও কান্না জুড়ে দিতো। এসব তার পূর্ব-পূর্ব জীবনের সংস্কার।
আমরা আগের জন্মে কে কি করেছিলাম তা আমরা জানি না, আর এই জন্মে বা আমাদের পরবর্তী জন্মে আমাদের পূর্ব-পূর্ব কর্ম্মের ফল ভোগ করতে হবে, এব্যাপারেও আমাদের কিছু করবার নেই। কিন্তু আমাদের সবার মধ্যেই আছে ইচ্ছেশক্তি। তা সে যত ক্ষীণ হোক না কেন। এই ইচ্ছেশক্তির সাহায্যে আমাদের জ্ঞান সংগ্রহে অধিক মনোযোগ দিতে হবে। আমাদের বিবেকের নির্দেশে কাজ করতে হবে, আর এর জন্য আমাদের সাময়িক ভাবে যত দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হোক, তা আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, ইচ্ছেশক্তি কখনোই ভাগ্যের অধীন নয়। ভাগ্যফলে আমি আজ যত খারাপ অবস্থার মধ্যেই থাকি না কেন, যত হেয় প্রতিপন্ন হই না কেন, এই সব প্রতিকূল অবস্থাকে জয় করে, ইচ্ছেশক্তির দ্বারা আমাদের শুভ কর্ম্মে লিপ্ত হতে হবে। আর একেই বলে পুরুষকার। এই পুরুষকার-শক্তিকে ইচ্ছে শক্তির দ্বারা জাগ্রত করতে হবে। এই শক্তি প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই আছে। .দৃঢ়ভাবে চেষ্টা করলে, সবাই জীবনে উন্নতিসাধন করতে পারবে, এমনকি ভাগ্যসম্পদ সঞ্চয় করতে পারবে।
সঞ্চিত ও প্রারব্ধ কর্ম্ম সম্পর্কে আমাদের কিছু জানা নেই। সেই সব কর্ম্মের ফল খন্ডন করবার সাধ্যও আমাদের কারুর নেই। আমরা যে কর্ম্মফল ভোগ করবার জন্য জন্ম গ্রহণ করেছি - তাকেই বলে প্রারব্ধ। প্রারব্ধ কর্ম্মফল আমাদের ভোগ করতেই হবে। এইসব কর্ম্ম সমষ্টিই আমাদের ভাগ্য, আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখের নিদান।
এখন কথা হচ্ছে এই প্রারব্ধ কর্ম্মের ফলভোগ থেকে আমরা নিষ্কৃতি পাবো কি করে ? দেখুন, প্রারব্ধ কর্ম্মফল থেকে আমাদের নিষ্কৃতি নেই - এটা সত্য। কিন্তু এই প্রারব্ধ কর্ম্মফল ভোগের যে কষ্ট সেটাকে আমরা লাঘব করতে পারি। কচুর খাবার পরে যদি একটু তেতুল খেতে পারি, তবে আমাদের কচুর জন্য যে গলা চুলকাবে, সেটা লাঘব করতে পারি। তেতো ঔষধ খাবার পরে যদি আমরা একটু মিষ্টি খেতে পারি, তবে আমাদের ঔষধ খাবার কষ্ট লাঘব হতে পারে। ধরুন আপনার প্রারব্ধ আপনাকে শারীরিক ভাবে ভোগাবে, এটা পূর্ব নির্দিষ্ট। এখন আপনি যদি আপনার বন্ধুবান্ধবের অসুস্থতার সময় তাকে সাহায্য করেন, অর্থাৎ ডাক্তার ডেকে দেওয়া, ঔষধ জোগাড় করা বা আর্থিক ভাবে সাহায্য করা - এগুলো যদি আপনি করেন, তবে আপনি নিজে যখন অসুস্থ হবেন, তখন তারা আপনাকে অবশ্য়ই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। কেউ হয়তো স্বজন বিয়োগের ব্যথায় কাতর হয়ে আছে, এইসময় আপনি তার পাশে থেকে কিছু সহজ উপদেশ দিয়ে তার মানসিক কষ্টকে লাঘব করতে পারেন। আপনার বর্তমানের এইকাজ অর্থাৎ পরোপকার আপনার ইচ্ছাশক্তির দ্বারা হতে পারে। আর এতে আপনার নিজের প্রারব্ধ ভোগ সাহজসাধ্য হয়ে যাবে। অর্থাৎ আপনি যদি, অন্যের দুঃখের দিনে তার পাশে দাঁড়ান, আপনার দুঃখের দিনেও সে আপনার পাশে থাকে পারে। এইভাবে আমরা একে অপরের প্রারব্ধ-ভোগকে সহজ করে নিতে পারি।
একটা মানুষের কর্ম্মক্ষেত্ৰ, তার জীবিতকাল, প্রভৃতির উপরে নির্ভর ক'রে, আমাদের সঞ্চিত কর্ম্মের মধ্যে যতগুলো কর্ম্মফল এক জীবনে ভোগ করা যায়, সেই অনুযায়ী আমাদের প্রারব্ধ নির্দিষ্ট হয়। সঞ্চিত কর্ম্মের মধ্যে যদি এমন কোনো কর্ম্ম থাকে, যা হয়তো ভিন্ন দেশে ভিন্ন লোকের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, তাহলে একজন্মে সেই কর্ম্মফল ভোগ সম্ভব নয়। তাই সেইসব কর্ম্মের ভোগ সম্পন্ন করবার জন্য, আমাকে আবার ভিন্ন দেশে জন্ম গ্রহণ করতে হবে। সুতরাং কোনো এক দেশে এক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করলে, যতগুলো কর্ম্ম ক্ষয়প্রাপ্ত হতে পারে, সেই কর্ম্মসমষ্টি প্রারব্ধ কর্ম্ম রূপে জাত ব্যক্তির জীবনে ভাগ্য বিধান করে থাকে । এই সংসারে সুখ-দুঃখ-আয়ু সবই এই প্রারব্ধ কর্ম্মের ফল। কিন্তু এই জীবনে যদি আমরা আমাদের ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে শুভ কর্ম্মের জন্য উদ্যোগী হতে পারি, তবে আমরা প্রারব্ধ কর্ম্মকে লঘু করে দিতে পারি। এবং পরবর্তী জীবনের ভাগ্য নির্ধারণ করে নিতে পারি।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
কর্ম্ম রহস্যঃ - (৪) কর্ম্মের জন্য কি আমরা দায়ী ?
পরাবিদ্যাবিদগন কর্ম্ম সম্পর্কে একটা অদ্ভুত কথা বলছেন। বলছেন, শারীরিক ভাবে আমরা যে কর্ম্ম করে থাকি, তার যে প্রভাব, তার থেকে আমাদের মনের চিন্তা ও কামনার প্রভাব আমাদের জীবনে বেশি গুরুত্ত্বপূর্ন। শারীরিক যে কর্ম্ম আমরা করে থাকি তার সাথে আমাদের প্রতক্ষ্যভাবে কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পর্কে আছে অপরের সাথে, যাকে ঘিরে আমি বা আমার শরীর কর্ম্ম সম্পাদন করছে। বিষয়টি আমাদের সাধারণ জ্ঞানের বিরুদ্ধ। কিন্তু সত্য হচ্ছে, কর্ম্ম যখন ফল প্রদান করবে, তখন যাকে ঘিরে আমার শরীর ওই কর্ম্ম করেছিল, তাকে সম্পৃক্ত করেই আমার শারীরিক কর্ম্ম ফল প্রদান করবে। তাঁরা বলছেন, চিন্তা ও কামনা বিষয়ে মানুষের স্বাধীনতা আছে, কিন্তু শারীরিক কর্ম্মের উপরে আমাদের কোনো স্বাধীনতা নেই। কর্ম্ম একটা পরম্পরা, একটার পর একটা ঘটেই চলেছে। এখানে এই কর্ম্মের প্রতি আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দেখুন আপনি যখনই মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে এলেন, আপনার শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া শুরু হয়ে গেলো। এখানে আপনার কিছু করবার নেই। যদি এই ক্রিয়া শুরু না হয়, তবে জানবেন, আপনার জীবন শুরুই হতে পারবে না। আর সারা জীবন আপনাকে কিছু না কিছু করে যেতেই হবে। আপনি কখনোই নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকতে পারবেন না। আপনাকে দেখতে হবে, শুনতে হবে, খেতে হবে, শুতে হবে, এমনকি হজম করতে হবে, বাহ্য করতে হবে । এটাই জীবন। আপনাকে কেউ গালি দিলো, তো আপনি তাকে একটা ঘুষি দিলেন। আর আপনি ঘুষি দিলে তারও একটা প্রতিক্রিয়া হবে। তাই প্রতিটি কর্ম্মের সঙ্গে পূর্বকৃত কর্ম্মের সম্পর্ক আছে। এটি একটি শৃঙ্খল। এই শৃঙ্খলেই বাঁধা জীবের জন্ম-মৃত্যু। আর আমরা যা কিছু করি তার উৎস হচ্ছে, চিন্তাপ্রসূত কামনা-সংকল্প। তাই পরাবিদ্যাবিদগন স্থুল কর্ম্মের চাইতে চিন্তাকে বেশি গুরুত্ত্ব দেন।
বিবেক দ্বারা চালিত হলে, মানুষ শুভ কর্ম্মের কারন হতে পারে। আবার বিবেক দ্বারা চালিত না হলে, সে অশুভ কর্ম্মের কারন হতে পারে। অর্থাৎ বিবেক যদি আমাদের সুপথে পরিচালিত না করে, তবে কুকর্ম্মের বীজ উৎপন্ন হয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে সুকর্ম্মের জন্য বিবেকের নির্দেশ প্রয়োজন। বিবেক যেখানে নিষ্ক্রিয় বা বিবেক যেখানে কার্যক্ষম নয়, সেখানেই কুকৰ্ম্ম সম্পন্ন হয়ে থাকে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে কু-কর্ম্মের জন্য জীব দোষী বা দায়ী নয়। কর্ম্ম করতে গেলে, অপরের সাথে একটা সন্মন্ধ স্থাপন করতে হয়। আমার শারীরিক কর্ম্ম অপরের উপরে একটা প্রভাব ফেলবে। ধরুন আপনি কাউকে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করলেন , বা রেগে গিয়ে দুটো থাপ্পড় দিলেন । তো এই কাজ করবার জন্য, কারুর একজনের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়েছে। এইবার কৃত-কর্ম্মের ফল অপরের উপরে যেভাবে কার্যকর হয়েছে, পরজন্মে বা ভবিষ্যতে তার সাথে আবার আপনার সম্পর্ক স্থাপন হবে, এই কৃত কর্ম্মের ফল ভোগ করবার জন্য। কর্ম্ম দ্বারা সে যদি ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকে, বা উপকৃত হয়ে থাকে, তবে পরজন্মে বা ভবিষ্যতে সে ক্ষতিপূরণ নেবার জন্য বা দেবার জন্য, সে আবার আপনার সঙ্গে সন্মন্ধে আবদ্ধ হবে। যদি সে সুখী হয়ে থাকে, তবে পরজন্মে সে আপনার সুখের কারন হবে, যদি দুঃখী হয়ে থাকে তবে ভবিষ্যতে সে আপনার দুঃখের কারন হবে।
আসলে কর্ম্ম অপেক্ষা কর্ম্মের যে মূল অর্থাৎ কামনা সেটাই অধিক শক্তিশালী। আমাদের লৌকিক জ্ঞানে আমরা কৃতকর্ম্মকে অর্থাৎ স্থুল কর্ম্মকে বিচার্য্য হিসেবে ধরে থাকি। কিন্তু দার্শনিক বিচারে, কর্ম্মের-মূল অর্থাৎ কামনাকে অধিক পরিমানে দোষী সাব্যস্ত করা হয়ে থাকে।
জীবের জীবনে যাবতীয় ঘটনা প্রাক্তন কর্ম্মের ফল। আমাদের কামনা-বাসনার ফল স্বরূপ জন্ম হয় একটা শক্তির। বার-বার চিন্তার পরিনাম হচ্ছে, সংকল্প। এই সংকল্প যখন দৃঢ় হয়, তখন তা কার্য্যে পরিণত হয়। অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জ্ঞান সঞ্চয় করে থাকি। আর এই জ্ঞান আমাদের বিবেকের উৎপত্তির কারন। যার জ্ঞান নেই, তার বিবেক বলে কিছু নেই। এইজন্য বিবেকহীন-জ্ঞানহীন জীবের কর্ম্মের কোনো পাপ-পুন্য হয় না। আমরা শুনেছি, আমাদের জীবন প্রারব্ধ কর্ম্মফলের সমষ্টি মাত্র। ফল দিতে উদ্যত প্রারব্ধ কর্ম্মকে কখনো রোধ করা যায় না। কিন্তু এই জীবনে আমরা কামনা ও সংকল্প দ্বারা নতুন কর্ম্মের বীজ বপন করি। এর দ্বারা আমাদের স্বভাবের জন্ম হয়।
প্রারব্ধ কর্ম্মফল ভোগ করবার জন্য, জীবের প্রয়োজন অনুযায়ী দেহ ধারণ করতে হয়। অর্থাৎ প্রারব্ধ ফল ভোগ করবার জন্য, আমরা জন্ম গ্রহণ করে থাকি। আর এই প্রারব্ধ কর্ম্মফল ভোগ বিনা নাশ হতে পারে না। কিন্তু সংকল্প-সৃজনে আমাদের ইচ্ছাশক্তির স্বাধীনতা আছে। আর এই ইচ্ছাশক্তি হচ্ছে বিশ্বশক্তির একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ। মানুষ এই ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগ ক'রে, শুভ বিষয়ে নিজেকে সংকল্পে নিয়োজিত করতে পারে। কিন্তু প্রারব্ধ তাকে ভোগ করতেই হবে। ধরুন আপনি কোরোনার ঔষধ আবিষ্কার করেছেন, আর এই ঔষধের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য কিছু মানুষের মধ্যে এই ঔষধের প্রয়োগ করলেন। কিন্তু দেখা গেলো তাদের মৃত্যু হলো। একটা কথা জানবেন, এই মৃত্যুর জন্য আপনার ঔষধ দায়ী নয়। দায়ী তাদের ভবিতব্য। ধরুন আপনি অন্যের বিপদে উপকার করবার জন্য, বিনাসুদে অন্যকে টাকা ধার দিলেন। এখন তারা এই টাকা আর শোধ দিলো না। আপনি পথের ভিক্ষারী হলেন। এখানে আপনার উদ্দেশ্য মহৎ হলেও, আপনার প্রারব্ধ আপনাকে ভিক্ষারী করেছে। কিন্তু জানবেন, আপনার এই সৎ-কর্ম্ম ব্যর্থ হবে না, ভবিষ্যতে বা প্রজন্মে এরাই আপনার পরমসুখের কারন হবে।
পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন, আপনি কি করছেন, সেটা বড়ো কথা নয়, আপনি কেন করছেন সেটাই ব্ড় কথা। আপনার উদ্দেশ্য যদি মহৎ হয়, আপনার উদ্দেশ্য যদি পরোপকার হয়, আপনার উদ্দেশ্য যদি ঈশ্বরের সৃষ্টিকে সহযোগিতা হয়, তবে জানবেন, আপনার সেই কর্ম্ম ভবিষ্যতে সুফল প্রদান করবে। এইজন্য বলা হয়ে থাকে, মানুষ সব বিষয়ে ভাগ্যের অধীন নয় কিন্তু কর্ম্মের অধীন। আর এই কর্ম্ম কোনো স্থুল কর্ম্ম নয়, এই কর্ম্ম আমাদের চিন্তা প্রসূত। চিন্তা যদি আমাদের ভালো হয়, তবে সেই চিন্তাপ্রসূত কর্ম্ম শুভ ফল প্রদান করবে। অন্যথা কুফল প্রদান করবে। ডাক্তার অস্ত্রপ্রচার করে, মানুষের ভালোর জন্য, আর খারাপ ব্যক্তি অস্ত্রের ব্যবহার করে, নিজের অশুভ কামনা চরিতার্থ করবার জন্য। দুটোই অস্ত্রাঘাত কিন্তু উদ্দেশ্য ভিন্ন। শক্তির অপব্যবহারের ফলে যে কর্ম্মের উৎপত্তি হয়, আমরা তার দাস হয়ে পড়ি। এইজন্য তপঃপ্রভাবসম্পন্ন ব্যক্তি তার প্রারব্ধ কর্ম্মকে সুনিয়ন্ত্রন ক'রে, তৎ-প্রসূত ফলকে স্থায়ী মঙ্গলের কারন হিসেবে বিকাশ করে থাকেন।
জীবের ক্রমবিকাশের ফলে তার কর্ম্মের বন্ধন আর কষ্ট দায়ক হয় না, ক্রমশঃ শিথিল হতে থাকে। ত্যাগের দ্বারা মানুষ এই পরমশ্রেয় পদ লাভ করতে পারে। মানুষের এই যে কর্ম্ম-জীবন এটা ক্ষণস্থায়ী হলেও - এর সংখ্যা কিন্তু অনন্ত। জন্মের পর মৃত্যু, মৃত্যুর পর জন্ম - এই প্রক্রিয়া পৰ্য্যায়ক্রমে সংগঠিত হয়ে, ক্রমশঃ আত্মার উন্নতি সাধন হয়ে থাকে। প্রতিটি জীবের জীবনের সাথে তার পূর্ব-পূর্ব জীবনের সন্মন্ধ আছে। জীবের জীবনের প্রতিটি ঘটনার সাথে, তার পূর্ব জীবন ও পরবর্তী জীবন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। অর্থাৎ আমাদের অতীত যেমন আমাদের বর্তমানকে গড়ে দিয়েছে, তেমনি অতীত ও বর্তমান মিলে আমাদের ভবিষ্যৎ গঠন হবে। সুতরাং কোনো ঘটনা আকস্মিক ভাবে ঘটে না। আমাদের অজ্ঞতা হেতু আমরা এর কারন নির্ধারণ করতে পারি না। কিন্তু যারা দিব্যদৃষ্টি সম্পন্ন তারা জীবনের প্রত্যেকটি ঘটনার মুলে যে কারন আছে, তা তারা জানতে পারেন। আর কারন নিহিত আছে জীবের প্রাক্তন কর্ম্মে। এটা যদি আমরা ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারি, তবে সংসারের কোনো দুঃখ বা সুখ আমাদের বিচলিত করতে পারবে না, চঞ্চল করতে পারবে না । আমরা এই ফল-উন্মুখ কর্ম্মের গতি রোধ করতে পারবো না সত্য, কিন্তু কামনা ও চিন্তা যদি আমরা সংযত করতে পারি, তবে ভাবি জন্মে এমনকি এই জন্মেই ভবিষ্যতে যে কর্ম্ম ফল আমাদের ভোগ করতে হবে তাকে আমরা সুফলপ্রদ করে নিতে পারি।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
কর্ম্ম রহস্যঃ : (৫) জন্মের স্থান-কাল-পরিবার নির্বাচন রহস্যঃ
কর্ম্মের বিচিত্র গতি। আবার কর্ম্মফল সম্পর্কেও জ্ঞাত হওয়া যায় না। কিসে কি হবে, কে বলতে পারে ?
আমরা ভাবি এক আর হয় আর-এক। রাজা শুদ্ধোধন ভেবেছিলেন, সিদ্ধার্থকে শাক্যবংশের ভাবি রাজা বানাবেন । আনন্দ-স্ফূর্তি, শিক্ষা-দীক্ষা সব ব্যবস্থা করেছিলেন, এমনকি তাকে প্রাসাদের বাইরে বের হতে দিতেন না, পাচ্ছে কোনো সন্যাসীর খপ্পরে পড়ে যায়। মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিয়ে দিয়েছিলেন, এমনকি রাহুলের অর্থাৎ সিদ্ধার্থের এক পুত্রের জন্মও হয়েছিল। কিন্তু যা হবার তাই হয়েছিলো, সিদ্ধার্থ রাজা নয়, বুদ্ধ হয়েছিলেন। সংসারী নয়, সন্যাসী হয়েছিলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চেয়েছিলেন ভয়ঙ্কর মহাভারতের যুদ্ধ না হোক। তার জন্য সমস্ত রকম চেষ্টা তিনি করেছিলেন। কিন্তু যা হবার তা-ই হয়েছিল। আপনি নিজের দিকেই দেখুন, কি হতে চেয়েছিলেন, আর কি হয়েছেন। আপনি হয়তো বলবেন, ঠিক মতো কর্ম্ম করা হয় নি, তাই ইচ্ছেপূরণ হয় নি। আসলে আপনার যা হবার কথা, তাই আপনি হয়েছেন, আপনার যা হবার কথা সেই অনুযায়ী আপনাকে কর্ম্ম করতে হয়েছে। এখানে আপনার হাত বিশেষ নেই। শ্রীমদ্ভগবৎ গীতায় কর্ম্ম সম্পর্কে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অনেক কথা বলেছেন। বলছেন, কর্ম্মে তোমার অধিকার, ফলে তোমার অধিকার নেই। অর্থাৎ কর্ম্মফলের নিয়ন্ত্রক তুমি নয়, অন্য কেউ। শেষে বলছেন, আসক্তিহীন কর্ম্ম করো। তবে কর্ম্মফল তোমাকে ভোগাতে পারবে না। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, কৃতকর্মের জন্য কি কর্ম্মকর্তা দায়ী ? আর কৃতকর্ম্মের ফল কি শুধু আমি ভোগ করি ? আমার ব্যক্তিগত কর্ম্ম ছাড়াও, আমার পারিবারিক কর্ম্ম, আমার জাতীয় কর্ম্ম - ইত্যাদির ফলও আমাদের সবাইকে ভোগ করতে হয়। দেখা যাবে, আমি যে পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছি, সেখানে পরিবারের নিয়মশৃঙ্খলা আমাকে ধর্ম্মিক জীবন লাভে সহায়তা করে থাকে। এই সৎ পরিবারে, মানুষের সাত্ত্বিক গুনের প্রকাশ সহজ হয়। তাই ভগবান গীতায় বলেছেন, যোগভ্রষ্ট ব্যক্তিগণ পবিত্র-স্বভাব ও ধনী পরিবারে জন্ম গ্রহণ করে থাকেন। একথা তো অস্বীকার করবার উপায় নেই, যে মানুষের পারিপার্শিক অবস্থা, মানুষকে তার চরিত্র গঠনে সাহায্য করে থাকে। এমনকি তার আচার ব্যবহার, ও আচরিত ধর্ম্ম-কর্ম্ম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এই পরিবেশ। অতএব যে কোনো কারণেই হোক, মানুষ যখন একটা ধর্ম্মিক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করে, তখন সে পরিবারের সমস্ত কর্ম্মের দ্বারা প্রভাবিত হয়। এমনকি পরিবারের সুকর্ম্ম-ফল সে ভোগ করতে পারে। আবার যে পরিবারে, নিষ্ঠুরতা স্বার্থপরতা, নির্দয়ভাব, নিস্কর্মন্যতা, অলসতা,ইত্যাদি ভাব বিদ্যমান, সেখানে জন্ম গ্রহণ করলে, এই সব দ্বারাই সে প্রভাবিত হবে। এবং তার ফল অর্থাৎ দুর্ভোগ তাকে অবশ্য়ই ভোগ করতে হবে।
এখন কথা হচ্ছে, তাহলে কি আমরা ধরে নেবো, যে আমরা আমাদের পূর্ব-পূর্ব জীবনের কর্ম্মফল ভোগ করবার জন্য, পরিবার বেছে বেছে আমাদের জন্ম গ্রহণ করতে হচ্ছে ? আর এই জীবনে, আমরা আমাদের পরিবার বা পরিবেশের দৌলতে আমাদের উন্নতি বা অবনতি অবশ্যম্ভাবী হয়ে থাকবে। তাহলে তো আর পুরুষকারের কোনো ভূমিকাই থাকে না। পরিবেশ আমাকে ভালো মন্দ করে গড়ে দেবে। এই কথাগুলোকে যদি সম্প্রসারিত করি, তবে দেখতে পাবো, দেশ, কাল, পাত্র সমষ্টিগত ভাবেও আমাদের উপরে প্রভাব ফেলছে। এক-এক দেশের ধর্ম্ম ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, শাসন ব্যবস্থা এক-এক রকম। আর এই সব কিছুর অধীন আমরা। আমরা জন্ম থেকেই, একটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ভুক্ত হয়ে যাই। একটা নির্দিষ্ট ধর্ম্মপথের দিকে নিজেরদের অজান্তে এগিয়ে যাই। সময়ও, অর্থাৎ যে সময়ে আমি জন্ম গ্রহণ করেছি, সে সময় আমাদেরকে পরিচালিত করে থাকে। আজ থেকে ১০০ বছর আগেও আমাদের দেশে স্ত্রীজাতির শিক্ষা গ্রহণের অধিকার ছিল না। আরো একটু পিছিয়ে গেলে দেখতে পাবো, শিক্ষা কিছু নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বা জাতি/কুলের মানুষের কুক্ষিগত ছিলো। আজ সেই দিন নিশ্চই অনেক বদলে গেছে। যে প্রেসিডেন্সি কলেজে মেয়েদের শিক্ষার অধিকার ছিল না, যেখানে তথাকথিত নিচু সম্প্রদায়ের প্রবেশ অধিকার ছিল না, সেখানে আজ সেই তথাকথিত নিচু সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে থেকে শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে, অর্থাৎ এখন শিক্ষা অর্জন তো বটেই, এমনকি শিক্ষা দেবার অধিকার অর্জন করেছে সেই সব বঞ্চিত তথাকথিত নিচু জাতের মানুষেরা । অর্থাৎ কাল এই সব কুপ্রথা বা কুসংস্কার হরণ করেছে। তো দেশ বা জাতি ও কাল অর্থাৎ যখন-যেখানে আমি জন্ম নিচ্ছি, সেই দেশ-জাতি-কাল আমাকে প্রভাবিত করছে, তা সে ভালো হবার জন্য হোক, বা খারাপ হবার জন্য হোক। কেউ যদি প্রত্যন্ত গ্রামের পরিবারে জন্ম গ্রহণ করে থাকে, তবে সে যে ধরনের শিক্ষার সুযোগ সুবিধা পাবে, তার থেকে অনেক বেশী সুযোগ সুবিধা পাবে, যদি সে শহরের কোনো পরিবারে জন্ম গ্রহণ করে । ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ বিভিন্ন রকম সুবিধে বা অসুবিধের মানুষ নিজেকে গড়ে তুলছে। আবার আমেরিকায়, অব আফ্রিকায় জন্ম গ্রহণ করলে, সুযোগের তারতম্য ঘটে থাকবে।
আবার আমরা এটাও দেখেছি, পিতা মাতা অতি ঘৃণিত জীবন যাপন করছেন, বা সাধারণ দরিদ্র জীবন-যাপন করছেন, অথচ সন্তান পরম ধার্মিক -সৎ-চরিত্রবান এবং মনস্বী। তাহলে পূর্ব জীবনের কর্ম্মফলে আমাদের পরবর্তী জীবনের কর্ম্মক্ষেত্ৰ ঠিক হয়, সেই নিয়মের শৃঙ্খল এখানে দেখা যায় না কেন ?
এর উত্তরে পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন, জন্ম গ্রহণের দুটো কারন, এক হচ্ছে দ্বেষ দুই, ভালোবাসা। দ্বেষ ও হিংসা জনিত ঋণ শোধ করবার জন্য, অনেকসময় এই বৈষম্যের দেখা যায়। এই জীবনে যে ধর্ম্ম আমি পালন করছি, যে ধর্ম্মের বিকাশের জন্য আমি চেষ্টা করছি, সেই ধর্ম্মকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য, পরবর্তী জীবনে আমি দেহ-পরিবার-পরিবেশ ইত্যাদি প্রাপ্ত হবো। এইভাবেই আমাদের জন্মের স্থান-কাল-পাত্র নির্বাচন করা হয়। কিন্তু রাগ দ্বেষ ইত্যাদিও পারিবারিক বন্ধনের কারন। অর্থাৎ আজ আমি যাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে কর্ম্ম সম্পাদন করছি, এবং সেই কর্ম্মের জন্য জন্য কেউ যদি ক্ষতিগ্রস্থ হয়, বা উপকৃত হয়, তবে তার প্রতিদান গ্রহণ করবার জন্য আমাদের তাদের সাথে বন্ধনে আবাধ্য হতে হবে। আর এইসব কারণেই দেখা যায় , জীবের অসৎ-পরিবারে জন্ম হচ্ছে, অর্থাৎ এদের সাথে পূর্ব-পূর্ব জীবনে কর্ম্ম বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। কর্ম্মফলের প্রতিটি কনা আমাদের ভোগ করতে হবে। আবার ভোগ শেষ হয়ে গেলে, সেখান থেকে আমাদেরকে দেহান্তরিত হতে হবে। ধরুন আপনি আজ কাউকে কিছু দান করলেন, বা আপনি কারুর কাছ থেকে কিছু দান গ্রহণ করলেন, তো দানের প্রতিদান যদি আপনি এই জীবনে না পান তবে আপনাকে নিশ্চয়ই এদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়ে আবার পৃথিবীতে আসতে হবে। এই জন্য বলা হয়ে থাকে স্বামী-স্ত্রী চিরকালের বন্ধন। কেননা, এদের মধ্যে এতো বেশি আদান প্রদানের ঘটনা ঘটে থাকে, যে আবার তাদের এই ঋণ পরিশোধ করবার জন্য, কোনো না কোনো সম্পর্ক নিয়ে ফিরে ফিরে আসতে হয়। অবতারগন যখন আসেন, বলা হয়ে থাকে, এঁরা পারিষদ বর্গ নিয়ে অবতীর্ন হন।
তো ব্যক্তিগত কর্ম্মফল যেমন আমাদের ভোগ করতে হয়, ঠিক তেমনি সমষ্টিগত কর্ম্মফল আমাদের ভোগ করতে হয়। তাই ভূমিকম্প, অগ্নি-উৎপাৎ ঝড়-জল-প্লাবন, দুর্ভিক্ষ রাষ্ট্রবিপ্লব, মহামারী যুদ্ধ,এই যে ভানায়ক ব্যাপার, আমাদের সামনে সংঘঠিত হচ্ছে, এবং তার ফল আমাদের সবাইকে ভোগ করতে হচ্ছে, এগুলোর পিছনে আছে আমাদের সামগ্রিক কর্ম্ম। ব্যক্তি, পরিবার, দেশ, জাতি ইত্যাদি জীবন বিকাশের ক্ষেত্র। আর এই ক্ষেত্রজ কর্ম্মের ফল আমাদের সবাইকে ভোগ করতে হয়। আমরা এই সম্পর্কে পরের দিন আবার শুনবো। আজ বাক্যের বিরাম দিলাম।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
কর্মরহস্য
কেউ বলেন "যেমন কর্ম্ম তেমন ফল" । কেউ বলেন, "ভাগ্যের লিখন খণ্ডাবে কে ?" কোনটা যে ঠিক কে বলে দেবে ? কর্ম ফল নাকি কপাল - কোনটা কার্যকরী বেশী ? আজ আমাদের আলোচ্য বিষয় কর্মরহস্য।
গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, কর্মে তোমার অধিকার, ফলে কখনোই নয়। এই কথার গূঢ় অর্থ কী ?
কর্ম্ম কাকে বলে ?
পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করে আমরা যা কিছু করি সবই কর্ম্ম। সৃষ্টি এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য, যা কিছু করা হয় তাকেই কর্ম বা ক্রিয়া বলে।
কর্ম্ম কয় প্রকার ?
প্রাথমিক ভাবে, কর্ম্ম দুই প্রকার, দৈহিক কর্ম্ম ও মানসিক কর্ম্ম।
দৈহিক কর্ম্ম বা অবচেতন মনের কর্ম্ম :
দেহকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য, আমরা যে কর্ম্ম করি, বা যে কর্ম্ম সম্পাদিত হয়, তাকে দৈহিক কর্ম্ম বলে। যেমন - চোখের পাতা ফেলা, স্বাস প্রশ্বাস, পাচন ক্রিয়া, বাতাস থেকে উর্জ্বা শক্তি সংগ্রহ করা। এগুলো আমাদের দৈহিক কর্ম্ম। এগুলো অবচেতন মনের নির্দেশে হয়। এই কর্ম্মের ফল তাৎক্ষণিক। সঞ্চয়ের কোনো সুযোগ নেই।
মানসিক কর্ম্ম বা সচেতন মনের কর্ম্ম :
ইন্দ্রিয়গনের সাহায্যে বিষয় সংযোগে যে কর্ম্ম করা হয়, তাকে মানসিক কর্ম্ম বলা হয়। মানসিক কর্ম্ম আবার দুই প্রকার। প্রতক্ষ্য ও অপ্রতক্ষ্য ।
আসলে আমরা কর্ম্ম বলতে যা বুঝি তা এই এই মানসিক কর্ম্মের বহিরঙ্গ মাত্র। অর্থাৎ যে কর্ম্মের দ্বারা আমরা এক্ষুনি বা অদূর ভবিষ্যতে ফল পেতে পারি। অর্থাৎ প্রতক্ষ্য কর্ম্ম।
ইন্দ্রিয়গনের দ্বারা আমাদের কর্ম্ম করতে হয়। আর মন হচ্ছে ইন্দ্রিয়গনের রাজা। মন যখন কোনো কিছু চিন্তা করে, সেটা হচ্ছে অপ্রতক্ষ্য কর্ম্ম। এই অপ্রতক্ষ্য কর্ম্ম যখন ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বাহ্যিক রূপ নেয় তখন তাকে প্রতক্ষ্য কর্ম্ম বলা হয়। সাধারণ ভাবে একেই আমরা কর্ম্ম বলে থাকি।
তাহলে আমরা বুঝলাম, মন হচ্ছে কর্ম্মের রাজা। এই মনের আবার দুটো প্রবৃত্তি আছে। একটাকে বলি কামনা, আর একটা হচ্ছে বাসনা। এই দুটো প্রবৃত্তি আমাদের কর্ম্মে উদ্বুদ্ধ করে।
কামনা : ইন্দ্রিয়গনের সঙ্গে বিষয়-সংযোগের যে ইচ্ছে আমাদের মধ্যে জাগ্রত হয় তাকে বলে কামনা। শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ - প্রভৃতি উপভোগ করবার যে প্রবৃত্তি আমাদের মনে বর্তমান থাকে, তার দ্বারা ভোগ্য বিষয়ে আমাদের আসক্তি জন্মে। এই আসক্তিই কামনা-প্রসূত। মানুষের যাতে ন্যায্য অধিকার নেই,অথচ সেগুলো পাবার জন্য, আমরা সদাই চঞ্চল। তাই কামনা প্রসূত কর্ম্ম আমাদের সুখ-দুঃখের কারন।
বাসনা : মনের আর একটা প্রবৃত্তির নাম বাসনা বা সংকল্প। আমি সংযম পালন করবো। চরিত্রের উন্নতি সাধন করবো। পরহিতার্থে কাজ করবো। জ্ঞান অর্জন করবো, ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ একটা হচ্ছে নিজের সুখ-দুঃখের জন্য কাজ যাকে বলে কামনা আর একটা অন্যের হিত বা নিজের উন্নতি সাধনের কাজ, একে বলে সংকল্প বা বাসনা।
এই কামনা ও বাসনা দুটোরই উৎপত্তি স্থানই মন। এদুটোই মনের কাজ। এটাকে সম্পাদন করা বা না করা দুটোই কর্ম্ম। কর্ম্ম হিসেবে এর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য হচ্ছে ফলে।
কর্ম্ম বলতে আমরা স্থুল দেহের কর্ম্ম বুঝে থাকি। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের আরো দুটো লিঙ্গদেহ বা সূক্ষ্ম দেহ আছে, একটা হচ্ছে কামদেহ আর একটা হচ্ছে মানসদেহ। এই দুটো দেহেরও কর্ম্ম করবার শক্তি আছে। এবং এই দুটো দেহই সর্ব্বদা কর্ম্ম করছে। আর পৃথিবীই আমাদের কর্ম্মভূমি। আর এই পৃথিবীতে বসে আমরা যে কর্ম্ম করবো, তার ফলও আমরা এই পৃথিবীতে বসেই ভোগ করবো। এই সব কর্ম্মের ফল আমরা পরলোকে গিয়ে ভোগ করবো না। যদি এই জীবনে আমাদের কর্ম্মফল ভোগ সম্পূর্ণ না হয় তবে আমাদের আবার পৃথিবীতে এসে ভোগ করতে হবে। আর একেই বলে প্রারব্ধ কর্ম্মফল ভোগ। ফলদানে প্রবৃত্ত এই সব কর্ম্মফলের গতি রোধ করা যায় না। আর পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করে যে সব কর্ম্ম আমরা করি, সেগুলো হচ্ছে ক্রিয়মান কর্ম্ম। ভবিষ্যৎ জন্মে আমাদের আজকের ক্রিয়মান কর্মের ফল ভোগ করতে হবে। এছাড়া বহু জন্মের যে কর্ম্মফল আমাদের ভোগ করা হয় নি তাকে বলে সঞ্চিত কর্ম্ম। সেই সব সঞ্চিত কর্ম্মের ফলও আমাদের ভোগ করতে হবে। ক্রিয়মান কর্ম্মের প্রতি আমাদের আমাদের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি, কিন্তু প্রারব্ধ বা সঞ্চিত কর্ম্মফলের প্রতি আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই ক্রিয়মান কর্ম্মকে নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্য আমাদের কর্ম্ম বা কর্ম্মফল সম্পর্কে জ্ঞান সঞ্চয় করতে হবে, এবং সেই অনুযায়ী কর্ম্মে লিপ্ত হতে হবে, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনে, এই জীবনের কোনো কর্ম্ম প্রারব্ধ বা সঞ্চিত হিসেবে টেনে নিয়ে যেতে হবে না। এখন কি করে সম্ভব ?
চিন্তাদ্বারা কর্ম্ম : আমরা কৰ্ম্ম-ইন্দ্রিয় দ্বারা যে সব কাজ করি, তাদের সন্মন্ধে ভালো-মন্দ জ্ঞান আমাদের নেই। অনেক সময় আমরা না বুঝে, বা বিচার বিবেচনা না করে, খারাপ কাজ করে বসি। পরে সেটা নিয়ে আমাদের অনুতাপ হয়। আবার অনেক সময়, আমরা বুঝে শুনে, বিবেকের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে, খারাপ কাজে লিপ্ত হই। অনেক সময়, রাগের বশে, বা হিংসার বশে অনুচিত কাজ করে বসি। আর একটা ব্যাপার হচ্ছে, চিন্তা দ্বারা যে কোনো কাজ করা যায়, তা আমরা মন করি না। আমরা মনে করি, শারীরিক উদ্দম ছাড়া কোনো কাজ করা যায় না। স্বামী বিবেকানন্দ একবার এক সাধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনারা সব উন্নত মহাত্মা, এই নির্জনে, পাহাড়ের কোলে বসে সাধনা কোরছেন। এতে সাধারণ মানুষের কি কাজে লাগবে ? মহাত্মা বলেছিলেন, মনের দ্বারাও যে মানুষের উপকার করা যায়, এবং উপকার করতে চাইলে যে যে কোনো জায়গায় বসে সেটা করা যায়, তা কি তুমি জানো ? অর্থাৎ মানুষ তার শুভ চিন্তার দ্বারা কাজ করে থাকেন। আমরা মনে করি, চিন্তা মনের একটা অবস্থা-বিশেষ মাত্র। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে তা নয়। চিন্তা একটা বস্তূ। বস্তূর সমস্ত ধর্ম্মই এতে বর্তমান। এই চিন্তা দ্বারা, যেমন নিজের উপকার করা যায়, তেমনি অপরের উপকারও করা যায়। জড়-বিজ্ঞান এখনো এর আবিষ্কার করতে পারে নি বলে এটা অসত্য হয়ে যায় না। চিন্তার কার্য্যকরী শক্তি সম্পর্কে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। আমরা তপস্যার কথা শুনে থাকি, ঐকান্তিকভাবে চিন্তা করাই তপস্যা। আর এই তপস্যার ফলই আমাদের "বেদ"। তপঃ-প্রভাব-সম্পন্ন ঋষির কাছে কিছুই দুর্লভ নয়। তা সে জাগতিক বস্তূই হোক আর আধ্যাত্মিক জ্ঞানই হোক। গভীর চিন্তা দূরে থাকুক, সাধারণ চিন্তাও কখনো নিষ্ফল হয় না।
আমাদের এই ভূলোকের সঙ্গে যেমন আরো অনেক লোক ( ভূঃ , ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জনঃ, তপঃ, সত্যম ) ওতপ্রোত ভাবে অবস্থান করছে, তেমনি আমাদের এই স্থুল দেহের সঙ্গে সূক্ষ্ম দেহ ওতপ্রোত ভাবে অবস্থান করছে। আমাদের এই স্থুল দেহের চতুর্দিকে, এক-দেড় ফুট পর্যন্ত একটা জ্যোতির্বিম্ব আচ্ছাদন করে রেখেছে আমাদেরকে। এরও আকৃতি আমাদের দেহের মতোই। তবে এটি আলোর রশ্মি মাত্র। আমাদের মনের ভাবের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই আলোর রঙের পরিবর্তন হয়। আমাদের চিন্তা ধারার গভীরতার সঙ্গে সঙ্গে এই আলোর ঘনত্ত্ব বাড়ে-কমে। আমাদের মনে যখন যে প্রবৃত্তি জেগে ওঠে, সেই অনুযায়ী আমাদের এই আউড়া দেহ বা জ্যোতির্বিম্ব সূক্ষ্ম জগৎ থেকে সূক্ষ্ম পরমাণু আকর্ষণ করে থাকে। এবং তা থেকে শত শত - এমনকি হাজার হাজার আজ্ঞাবহ চিন্তামূর্তি সৃষ্ট হয়। এই সব চিন্তামূর্তি গুলো সূক্ষ্ম উপকরণে নির্মিত। এই সকল মূর্তিতে কিঞ্চিৎ চৈতন্যেরও সঞ্চার হয়। মনের প্রবৃত্তির লক্ষ্য বস্তূ কাছে থাকলে, তারা সেই বস্তূর নিকটে গিয়ে তার সূক্ষ্ম দেহে সেই রকম প্রবৃত্তির উন্মেষ করতে চেষ্টা করে। আমাদের চিন্তা যত গভীর হবে, এই চিন্তামূর্তিগুলোর স্থায়িত্ত্ব ও কর্মক্ষমতা তত বেশি হবে এবং ফলপ্রদ হবে। সুতরাং আমি যদি কারুর সন্মন্ধে, ভালো চিন্তা করি, তবে তার ভালো হবে আর আমি যদি কারুর সন্মন্ধে খারাপ চিন্তা করি তবে তার খারাপ হবে। আমার চিন্তার গভীরতা অনুযায়ী এই ফল গভীরতা ও স্থায়িত্ত্ব পাবে। এই জন্য বলা হয়ে থাকে খারাপ কাজের চাইতে খারাপ চিন্তা ভয়ঙ্কর। আমাদের শারীরিক শক্তির একটা সীমা আছে, কিন্তু মানসিক শক্তি সীমাহীন। শরীর দ্বারা কৃত, পাপকর্মের মাত্রা শারীরিক শক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু মনের গতি অপ্রতিরোধ্য, তাই চিন্তাশক্তিও অসীম। অতএব মনের সাহায্যে যত পাপ করা যায়, তা সীমাহীন। আবার মনের সাহায্যে যে ভালো কাজ করা যায় তা-ও সীমাহীন। এই জন্য সমস্ত ধর্মশাস্ত্রে মনের উপরে নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে। আমাদের শুভ-ইচ্ছা যত গভীর হবে, সূক্ষ্ম জগতে আজ্ঞাবহ সচেতন মূর্ত্তি তত মঙ্গল কর্মে লিপ্ত থাকবে। আর আমাদের অশুভ চিন্তা যত গভীর হবে, সূক্ষ্ম জগতের আজ্ঞাবহ মূর্তিগুলো তত অমঙ্গল কর্মে লিপ্ত থাকবে। বেদে যে সব মন্ত্র আমরা পাই, তা আসলে দেবতাদের স্তূতি ও প্রার্থনা। দেবতাদের অর্থাৎ এক বা একাধিক গুনের অধিকারী যারা, তাদের আমরা দেবতা বলি। দেবতাদের স্তূতি মানে গুনের স্তূতি ও গুণীর কাছে প্রার্থনা। এই সব মন্ত্র আমাদের মনকে শুভ চিন্তায় নিমগ্ন রাখে, বার বার উচ্চারণ বা জপ্ আমাদেরকে মঙ্গলের পথে নিয়ে যায়। মন্ত্রের এখানে সার্থকতা।
ক্রিয়মান কর্ম্ম : বর্তমানে আমরা যা করছি, সেটাই ক্রিয়মান কর্ম্ম। এই ক্রিয়ামান কর্ম্ম খুবই গুরুত্ত্বপূর্ন, কারণ, এই ক্রিয়মান কর্ম্মই আমাদের ভবিষ্যৎ গঠন করবে। আমি এই জীবনে যাকিছু করবো, তা আমার ভবিষ্যৎ জীবন গড়ে দেবে। ভবিষ্যৎ জীবনের শুভ-অশুভ ব্যাপার সংগঠিত করে দেবে, এই জীবনের কর্ম্ম। অর্থাৎ আজ আমি কর্তা, কাল কিন্তু আমি হয়ে যাবো ভোক্তা বা দাস। আমাদের পুরুষাকার বা স্বাধীন ইচ্ছে যদি কিছু থেকে থাকে, তবে তা এই জীবনে বিচারশীল হয়ে প্রয়োগ করতে হবে। তবেই আমরা আগামী জীবনের সৌভাগ্য গঠন করতে পারবো।
আমরা কুকর্ম করি কেন ? আমরা একটু স্থির হয়ে চিন্তা করলে বুঝতে পারবো, আমাদের সমস্ত কর্মই আমাদের অবিচ্ছিন্ন চিন্তার ফল। তা সে ভালো বা মন্দ, পাপ বা পুন্য যে ধরনের কাজই হোক না কেন, এর মুলে আছে আমাদের কামনা। প্রবৃত্তির তাড়নায়, আমাদের মনে ক্ষনে ক্ষনে কুচিন্তা ফুটে উঠছে। অন্যদিকে আমাদের বিবেক-বুদ্ধি এই কুচিন্তাকে কার্য্যে পরিণত করতে বাধা দিচ্ছে। কিন্তু যেসব কুচিন্তা বারবার স্ফূরণ ঘটাচ্ছে, তা আমাদের মনে চাপ ফেলছে। সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় আছে। এইসব দীর্ঘদিনের কুচিন্তা, একদিন উপযুক্ত সুযোগ পেয়ে, বিবেকের নির্দেশকে অগ্রাহ্য করে, আমাদেরকে কুকর্মে প্রবৃত্ত করবে। এইভাবে আমরা গর্হিত কাজ করে, পরে অনুতাপে দগ্ধ হই।
পুরুষাকার : একটা জিনিস মনে রাখবেন, বহু জন্মের কর্মফলে, আমাদের আজ এই মনুষ্য দেহ, আমাদের স্বভাব, মস্তিস্ক, চিন্তাশক্তি, বিবেক, এবং এই পারিপার্শ্বিক অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছি। আমাদের মধ্যে এই যে দৈন্যতা, এও আমাদের পূর্ব পূর্ব জন্মের কর্মফল। আমাদের মধ্যে যে আধ্যাত্মিক ভাবের দৈন্যতা, আমাদের ইন্দ্রিয়াসক্তি, আমাদের নিষ্ঠূরতা, এগুলো সবই আমাদের পূর্ব পূর্ব জন্মের মজ্জাগত স্বভাব। এর মধ্যেও আছে আমাদের ক্ষীণ বিবেকশক্তি। আমরা যদি আমাদের ইচ্ছাশক্তিকে বিবেকের নির্দেশ অনুযায়ী চালিত করতে পারি, তবে ক্রমশঃ উন্নতির দিকে যেতে পারবো। ভাগ্য ইচ্ছার অধীন নয়, ভাগ্য কর্মের অধীন। স্বাধীন ইচ্ছেই পুরুষকার। তাই বিবেকের দ্বারা পরিচালিত স্বাধীন ইচ্ছা আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। স্বাধীন ইচ্ছেকে শক্তিশালী করতে হবে। ইচ্ছেকে বিবেক দ্বারা পরিশীলিত করতে হবে। এই ভাব যখন আমাদের দৃঢ় হবে, তখন আমাদের জীবনের গতি উর্দ্ধমুখী হবে। দেখুন জীবন একটা যাত্রা। এই পথে চড়াই উৎরাই আছে, আপনাকে লক্ষ্য স্থির রেখে, দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলে আপনি সঠিক সময় লক্ষে পৌঁছতে পারবেন, তা না হলে পথে পথে ঘুরতে হবে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ সময়। ঈশ্বরের ইচ্ছেয় লক্ষে আপনাকে যেতেই হবে, যেখান থেকে ঈশ্বর আপনাকে কোলে তুলে নেবেন। কিন্তু আপনি যত বিপথে যাবেন, তত আপনার বার বার জন্ম নিতে হবে, এবং আপনি জন্ম-মৃত্যুর চক্রে সুখ-দুঃখের আবর্তে ঘুরপাক খাবেন।
ভাগ্য : আমরা আগেই শুনেছি, কর্ম্ম তিন রকম, সঞ্চিত, প্রারব্ধ, এবং ক্রিয়মান। এর মধ্যে ক্রিয়মান কর্ম্ম হচ্ছে - এখন করছি। সঞ্চিত কর্ম্ম হচ্ছে, আমরা যে কর্ম্ম করেছিলাম, আর প্রারব্ধ কর্ম্ম হচ্ছে - যে সব কর্ম্ম ফল দানে উম্মুখ বলে আমাকে জন্ম গ্রহণ করতে হয়েছে। অর্থাৎ প্রারব্ধ কর্ম্মফল আমাকে ভোগ করতেই হবে। এই প্রারব্ধ কর্মফলের সমষ্টি হচ্ছে আমার ভাগ্য। তাই ভাগ্য আমাদের ঈশ্বরের নিদান। এই জীবনে আমাকে সেই সব সুখ-দুঃখ ভোগ করতেই হবে। সঞ্চিত কর্ম্মের যেগুলো এই জীবনে ভোগ করা সম্ভব নয়, সেগুলো থেকে যাবে ভবিষ্যৎ জন্মের জন্য। অর্থাৎ আমাদের এমন কিছু কর্ম্ম আছে যার ফল এই জীবনে ভোগ করা যাবে না। অর্থাৎ আমি এখন যেখানে জন্ম গ্রহণ করেছি, সেখানে, আর আমার সঞ্চিত কর্ম্ম যাদের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত তার হয়তো সেখানে জন্ম গ্রহণ করেন নি। অন্য কোনো দেশে আছেন, বা আদৌ জন্ম গ্রহণ করেন নি, তবে তার কাছে আমার যা ঋণ তা পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। তাই সঞ্চিত কর্মের অবলুপ্তি এক জীবনে সম্ভব নয়। আমরাশুধু প্রারব্ধ কর্মের দাস, এই জীবনে। আমাদের জন্ম, মৃত্যু, সুখ দুঃখ এই প্রারব্ধ কর্মের ফল, জেক আমরা ভাগ্য বলি। এবং এটি এড়িয়ে যাবার কোনো উপায় নেই। প্রারব্ধ কর্ম্ম ক্ষয়ের একমাত্র উপায়, ভোগ। এর কোনো অন্যথা নেই।
----------
----------
কামনা অনুসারে আমাদের দেহলাভ : কামনা মনের একটা ক্রিয়া। আবার এই কামনা থেকেই আমাদের কামদেহ পুষ্টি লাভ করে। কামনার শুচিতার উপরে আমাদের পরের -জন্মের কাম দেহের উৎকর্ষ নির্ভর করছে। এবং সেই অনুযায়ী আমাদের জন্মের স্থান, আমাদের মাতৃস্থান নির্দিষ্ট হয়। কামনা চরিতার্থ করবার জন্য আমাদের শরীর, এবং শরীর অনুযায়ী আমাদের কর্ম্ম। আবার কর্ম্ম অনুযায়ী ফল লাভ করে থাকি আমরা। কামনা দ্বারাই আমরা ঐহিক সম্পর্ক স্থাপন করি। আমাদের ভাব-বন্ধনের আকর্ষণ পরজন্মে তাদের সাথে সন্মন্ধে আবদ্ধ করে। এই ভাবেই তৈরি হয় আমাদের শত্রূ - মিত্র। আমরা কর্ম্মের দোষ গুন্ সন্মন্ধে ধারণা করতে পারি। কিন্তু মনের মধ্যে যে কামনা উঠে তা আমাদের মনের মধ্যেই নিহিত থাকে, বাইরে প্রকাশ পায় না। কিন্তু এর দ্বারা যে কর্ম্ম উৎপন্ন হয় - তার ফল আমরা ভোগ করি। চিন্তা ও কামনা যদি সুপথে প্রবাহিত হয়, তবে আমাদের যে শক্তি ও ক্ষমতা অর্জিত হবে, তা আমাদের সুখের কারন হতে পারে।
আমরা অনেকে মনে করি, আমাদের মনের গভীরে যে চিন্তা স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে, সেতো মনের মধ্যেই আছে, তাতো কারুর কোনো ক্ষতি করে নি, তবে তার জন্য আবার ফল ভোগ করতে হবে কেন ? আমার মনে ভাব তো মনের মধ্যেই লয় প্রাপ্ত হয়ে গেছে - তবে তার আবার ফল কি ? লৌকিক জগতে সুপ্ত চিন্তার কোনো বিচার নেই। কিন্তু আপনার সুপ্ত চিন্তাই আপনার ভবিষ্যৎ কর্ম্মের নির্ধারক হিসেবে কাজ করবে। আপনার চিন্তাই আপনাকে সুকর্ম-দূরকর্মে লিপ্ত করবে। এটাই কর্ম্ম পদ্ধতি। তাই লৌকিক জগতে চিন্তার প্রতিফলন যতক্ষন না হচ্ছে ততক্ষন সেই চিন্তার বিষয় বিচার্য্য হয় না। কিন্তু সূক্ষ্ম জগতে, এই চিন্তার অপরিসীম গুরুত্ত্ব। কারন এগুলো হচ্ছে কর্ম্মের বীজ। তাই কুচিন্তা কুকর্মের বীজ। তাই আমাদের উচিত এই কুকর্মের বীজকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করা।আর আমরা আগেই শুনেছি, চিন্তাও সূক্ষ্ম বস্তূ দ্বারা নির্মিত, এবং তার অসীম শক্তি এবং এদের সামান্য চৈতন্যশক্তিও আছে। এবং এই চিন্তা শক্তি লক্ষ্য বস্তুর উপরে প্রভাব বিস্তার করে। অতএব চিন্তা কিছু করছে না, তা নয়, এর প্রভাব সাধারণ কর্ম্মের থেকেও অনেক বেশী। এমনকি, এই চিন্তা সময় সুযোগ পেলে আপনাকে অবশ্য়ই কর্ম্মে অনুপ্রাণিত করবে।
কর্ম্মের বিচিত্র গতি। বিষয়টি অতিশয় দুর্জ্ঞেয়। প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, যে যেমন কর্ম্ম করবে, সে তেমনি ফল ভোগ করবে। ব্যাপারটা কিছু এতটা সহজ নয়। কর্ম্মের আরো একটা দিক আছে। আর তা হলো, আমরা অনেক সময় দেখি, আমরা ভালো কাজ করতে গিয়েও অনেক দুর্নামের ভাগিদার হই। বা অন্যের দোষে আমাদের ক্ষতি হয়ে যায় । এর কারন কী ?
আমাদের ব্যক্তিগত কর্ম্ম ছাড়াও আমাদের চারিদিকে যে সব কর্ম্ম সম্পাদিত হচ্ছে তার প্রভাব থেকে আমি মুক্ত হতে পারবো না। আমি যে পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছি, সেই পারিবারিক কর্ম্মফল আমাকে প্রভাবিত করবে। আমি যে সমাজে জন্ম গ্রহণ করেছি, তার প্রভাব আমার উপরে পড়বে। আমি যে দেশে জন্ম গ্রহণ করেছি - সেই দেশের শাসন কর্তার কর্ম্মের প্রভাব আমাদের উপরে পড়বে। আমি যে জাতিতে জন্ম গ্রহণ করেছি, তার প্রভাব আমাদের উপরে পড়বে। অর্থাৎ আমাদের পারিবারিক কর্ম্ম, সামাজিক কর্ম্ম, দেশজ কর্ম্ম, জাতিগত কর্ম্ম সবই আমার উপরে প্রভাব পড়বে। তাই বলা হয়েছে, একা ভালো থাকা যায় না। আমাদের সবাইকে নিয়েই ভালো থাকতে হবে। পরিবারের চিন্তা, সমাজের চিন্তা, জাতির চিন্তা, দেশের চিন্তা সবই আমার সুখভোগ বা দুঃখভোগের কারন হতে পারে। তাই সমাজে যখন মহাত্মারা আসেন, তারা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন না, শুধুমাত্র নিজের মুক্তির চেষ্টা করেন না। তারা আমাদের সবার বিচারের শুদ্ধতা আনবার জন্য সচেষ্ট হন। এই প্রসঙ্গে গীতার কথা আসে। যোগীশ্রেষ্ঠ শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যোগভ্রষ্ট ব্যাক্তিগন পবিত্র স্বভাব ও ধনী পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। এবং আমাদের সবাইকে বলছেন, আসক্তি-হীন ভাবে কর্ম্ম করতে। অর্থাৎ শুদ্ধ কর্ম্মে যেমন আমাদের লিপ্ত থাকতে হবে, তেমনি আসক্তিহীন হয়ে কর্ম্ম করতে হবে। ব্যষ্টির কল্যাণ নয়, সমষ্টির কল্যাণের জন্য আমাদের কর্ম্ম করতে হবে।
কর্ম্মের বিচিত্র গতি। বিষয়টি অতিশয় দুর্জ্ঞেয়। প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, যে যেমন কর্ম্ম করবে, সে তেমনি ফল ভোগ করবে। ব্যাপারটা কিছু এতটা সহজ নয়। কর্ম্মের আরো একটা দিক আছে। আর তা হলো, আমরা অনেক সময় দেখি, আমরা ভালো কাজ করতে গিয়েও অনেক দুর্নামের ভাগিদার হই। বা অন্যের দোষে আমাদের ক্ষতি হয়ে যায় । এর কারন কী ?
আমাদের ব্যক্তিগত কর্ম্ম ছাড়াও আমাদের চারিদিকে যে সব কর্ম্ম সম্পাদিত হচ্ছে তার প্রভাব থেকে আমি মুক্ত হতে পারবো না। আমি যে পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছি, সেই পারিবারিক কর্ম্মফল আমাকে প্রভাবিত করবে। আমি যে সমাজে জন্ম গ্রহণ করেছি, তার প্রভাব আমার উপরে পড়বে। আমি যে দেশে জন্ম গ্রহণ করেছি - সেই দেশের শাসন কর্তার কর্ম্মের প্রভাব আমাদের উপরে পড়বে। আমি যে জাতিতে জন্ম গ্রহণ করেছি, তার প্রভাব আমাদের উপরে পড়বে। অর্থাৎ আমাদের পারিবারিক কর্ম্ম, সামাজিক কর্ম্ম, দেশজ কর্ম্ম, জাতিগত কর্ম্ম সবই আমার উপরে প্রভাব পড়বে। তাই বলা হয়েছে, একা ভালো থাকা যায় না। আমাদের সবাইকে নিয়েই ভালো থাকতে হবে। পরিবারের চিন্তা, সমাজের চিন্তা, জাতির চিন্তা, দেশের চিন্তা সবই আমার সুখভোগ বা দুঃখভোগের কারন হতে পারে। তাই সমাজে যখন মহাত্মারা আসেন, তারা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন না, শুধুমাত্র নিজের মুক্তির চেষ্টা করেন না। তারা আমাদের সবার বিচারের শুদ্ধতা আনবার জন্য সচেষ্ট হন। এই প্রসঙ্গে গীতার কথা আসে। যোগীশ্রেষ্ঠ শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যোগভ্রষ্ট ব্যাক্তিগন পবিত্র স্বভাব ও ধনী পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। এবং আমাদের সবাইকে বলছেন, আসক্তি-হীন ভাবে কর্ম্ম করতে। অর্থাৎ শুদ্ধ কর্ম্মে যেমন আমাদের লিপ্ত থাকতে হবে, তেমনি আসক্তিহীন হয়ে কর্ম্ম করতে হবে। ব্যষ্টির কল্যাণ নয়, সমষ্টির কল্যাণের জন্য আমাদের কর্ম্ম করতে হবে।
কর্ম্ম বন্ধন থেকে মুক্তি পাবার উপায় : শুধু মানুষ নয়, যে কোনো জীব-জন্তু কর্ম্ম না করে বাঁচতে পারবে না। আর কর্ম্ম থাকলে তার ফল থাকবে। তাহলে আমরা এই জন্ম-মৃত্যু চক্র থেকে রেহাই পাবো কি করে ? দেখুন দৈহিক কর্ম্ম থেকে আমাদের বেরোবার কোনো উপায় নেই। অর্থাৎ দেহকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য আমরা যে সব কর্ম্ম করে থাকি, তাকে বলে দৈহিক কর্ম্ম । যেমন, খাওয়া, শোয়া, নিঃস্বাস -প্রশ্বাস নেওয়া, হজম করা, বাহ্য ত্যাগ করা ইত্যাদি ইত্যাদি । আর এর জন্য কোনো পাপ বা পুন্য হয় না। সঞ্চিত কর্মের মধ্যে এর কোনো আশ্রয় নেই। সচেতন মন, যে চিন্তার অনুশীলন করে, তা থেকেই কর্ম্মের উদ্ভব। আর এই কর্ম্ম-ই আমাদের পাপ-পুণ্যের ভাগিদার করে। পূর্ব্ব জীবনে আমরা যেমন ও যে পরিমান চিন্তার অনুশীলন আমরা করেছি, এবং সেই অনুযায়ী কর্ম্ম করেছি, মানসিক শক্তি লাভ করেছি , আজ তারই ফল আমরা এখন ভোগ করছি।
গাঢ় চিন্তাই হচ্ছে ধ্যান। যে অবস্থায় চিত্তবৃত্তি এক বিষয়ে নিবদ্ধ থাকে, জ্ঞানবৃত্তির সেই একতানতাকে বলে ধ্যান। প্রতিদিন এই ধ্যানের অভ্যাস করলে ক্রমশঃ একাগ্রতা শক্তি বৃদ্ধি পাবে। এবং আমরা বাহ্য বিষয় থেকে মনকে ইষ্ট বিষয়ে আবদ্ধ করতে পারবো। মনের উচ্চতর স্তরে, যে চিন্তার উদ্ভব হয়, তাতে কামনার লেশমাত্র থাকে না। স্বার্থসিদ্ধির কোনো কল্পনা তখন থাকে না। তাই
কামনা-জাত কোনো কর্ম্মও থাকে না। আমরা জানি, মানুষ প্রয়াণকালে যেমন চিন্তা করে, বা যে ভাবে তন্ময় থাকে, পরবর্তী জন্মে সে সেই মত দেহ ধারণ করে। তাই ধ্যানের মধ্যে থাকতে পারলে, আমরা পার্থিব বিষয় থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারি, এবং জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকেও মুক্ত থাকতে পারি। আমরা আজ যাদের সঙ্গে সন্মন্ধে আবদ্ধ হয়েছি, পূর্ব্বে বা পূর্ব্ব জন্মে নিশ্চই তাদের উদ্দেশ্য আমাদের চিন্তাস্রোত প্রবাহিত হয়েছিল, তাই আমরা তাদের সঙ্গেই, বা তাদের ঘরেই জন্ম গ্রহণ করেছি। তাই বন্ধন মুক্তির একমাত্র পথ ধ্যান যা আমাকে বিষয় থেকে মুক্ত রাখবে। কর্ম্ম বন্ধন থেকে মুক্তি দেবে, আর জন্ম মৃত্যুর চক্র থেকে রেহাই দেবে।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি ওম
পুনশ্চ :
গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, কর্ম্ম তিন রকম :কর্ম্ম, অকর্ম্ম, ও বিকর্ম্ম। শাস্ত্র অনুযায়ী কর্ম্ম করাকেই আসল কর্ম্ম বলে। আর শাস্ত্রনিষিদ্ধ যে কাজ তাকে বলে বিকর্ম্ম। আর কর্ম্ম থেকে বিরত থাকা অর্থাৎ কর্ম্ম সন্যাস - এর নাম হচ্ছে অকর্ম্ম।
কর্ম্ম : আমাদের সমস্ত কর্ম্ম-ই শাস্ত্র অনুযায়ী হওয়া উচিত। এখন কোন শাস্ত্র অনুযায়ী আমাদের কর্ম্ম করা উচিত। যে শাস্ত্র আমাদের যজ্ঞে পশুবলি দিতে বলছে ? যে শাস্ত্র মানুষকে অস্পৃশ্য করে রেখেছে। যে শাস্ত্র মানুষকে ঘৃণা করে শেখায়। প্রাচীন ঋষিরা, এমনকি রাজ্-রাজারা যজ্ঞ করতেন, বিভিন্ন ধরনের যজ্ঞ করতেন। এবং প্রত্যেকটি যজ্ঞের এক একটা উদ্দেশ্য ছিল। এবং এর সবই কামনা প্রসূত। মন মন ঘি ঢালা হতো। তাহলে কি আমাদের সেই যজ্ঞকর্ম করতে হবে ? না, যজ্ঞ হচ্ছে, ব্রহ্মাগ্নিতে অহংকে আহুতি দেওয়া। আমাদের অহংকে আহুতি দিতে হবে, মন মন ঘি ঢালা নয়, বা পশুবলি দেওয়া নয়। আর দিতে হবে কোথায়, না ব্রহ্মাগ্নিতে, অর্থাৎ বেল কাঠের বা ডুমুর কাঠের অগ্নিতে নয়, জ্ঞান দ্বারা প্রজ্বলিত যে ব্রহ্ম সেখানে আহুতি দিতে হবে। শাস্ত্র বলতে বোঝায় - স্ব-অস্ত্র। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য যার সাহায্য নিতে হয়, তাই আমাদের শাস্ত্র। এখন এই শাস্ত্র যারা রচনা করেছেন, তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য যা বলে গেছেন, তাইই কি শাস্ত্র ? না মানব জাতির স্বার্থে যা রচিত হয়েছে, তাইই শাস্ত্র। তথাকথিত ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের রচনামাত্রই শাস্ত্র নয়। পশুবলি , বা হিংসায় প্রেরণা, বা মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করা শাস্ত্রের উদ্দেশ্য নয়, শাস্ত্রের উদ্দেশ্য, সর্বেষাং মঙ্গলম ভব, সর্ব্বে সন্তু সুখিনঃ । সবার যাতে মঙ্গল হয়, অন্ততঃ বেশিরভাগের যাতে মঙ্গল হয়, সেই আপ্তবাক্যই শাস্ত্র।
বিকর্ম্ম : শাস্ত্র অনুযায়ী কাজ না করাই বিকর্ম্ম। এখন শাস্ত্র বলছে, মিথ্যে কথা বলবে না। কিন্তু যদি মহৎ কাজের জন্য, বা কারুর প্রাণ রক্ষার জন্য, বা কোনো মায়ের সন্মান রক্ষার জন্য যদি মিথ্যে বলতে হয়, তবে সেটা কর্ম্ম হতে পারে। কাউকে আঘাত করবার জন্য অস্ত্র চালানো, আর ডাক্তারের অস্ত্র চালানো এক ব্যাপার নয়। ডাক্তারের অস্ত্র চালানো কর্ম্ম, কিন্তু ডাকাতের অস্ত্র চালানো বিকর্ম্ম। আসলে আমরা কি করছি সেটা বড় কথা নয়, কেন করছি সেটা বড়ো কথা। তাই উদ্দেশ্য বিহীন হয়ে কর্ম্ম নয়, সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কর্ম্ম করতে হবে আমাদের।
অকর্ম্ম : কর্ম্ম সন্যাসকে বলে অকর্ম্ম। কিন্তু তাই বলে, কোনো কাজ না করে, চুপ চুপ বসে থাকাকে, অকর্ম্ম বলে না। দেহ কর্ম্মহীন থাকতে পারে না। কর্ম্ম সন্যাস তাকেই বলে, যিনি কর্ম্মের দ্রষ্টা হতে পারেন, কর্তা নয়। কর্ম্ম আমাদের জ্ঞানের আলো এনে দিতে পারে। আর জ্ঞান মানে ঈশ্বর জ্ঞান। আর ঈশ্বর সম্পর্কে যখন আমাদের জ্ঞান হবে, তখন আমাদের ঈশ্বরভক্তি হবে। অতএব অকর্ম মানে আলসেমী নয়। অকর্ম মানে অকর্তা জ্ঞানে কর্ম করা।
এখন কর্ম্ম ফলের বন্ধন কার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর কার ক্ষেত্রেই বা প্রযোজ্য নয়। আসলে কর্ম্ম কর্তাকেই বন্ধন করে, কর্মচারীকে নয়। যার কর্তৃত্ব-অভিমান আছে, সেই কর্তা। তেমনি, ভোগে যার অভিলাষ আছে, তিনিই ভোক্তা। আসলে কর্ম্ম যেমন আমাদের চিন্তার ফল, ভোগও চিন্তার ফল। সেই জন্য, কি করছেন সেটা বড় কথা নয়, কেন করছেন, সেটা বড় কথা। আপনার বিচার আপনার কর্ম্মকে প্রভাবিত করবে, এবং আপনাকে ফল ভোগ করাবে। সেই জন্য বলা হয়ে থাকে, যিনি কর্তৃত্বাভিমানহীন তিনি নিরাশ্রয়, নিত্যতৃপ্ত। এনাদের কর্ম্মে কোনো ফালাকাঙ্খা নেই, আমি করছি, সেই ভাবও নেই। তাই ভোগ বা দুর্ভোগ এদের প্রভাবিত করতে পারে না।
এখন কথা হচ্ছে, জীব পুনঃ পুনঃ জন্মাচ্ছে, পুনঃ পুনঃ মরছে, জন্মালে কর্ম্ম করতে হচ্ছে, আবার কর্ম্মফল ভোগ করবার জন্য আবার জন্মাতে হচ্ছে। এই গোলক ধাঁধায় জীব অবিরত ঘুরছে। এর থেকে অব্যহতি পাবার কি কোনো উপায় নেই ?
এইখানে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, "পরমাং গতিম" (৮/২১) . বা "মে পরমং ধাম" আমার পরমধাম, যা পেলে আর প্রত্যাবর্তন হয় না। এখন সেই পরম ধামে পৌঁছিবার উপায় কি ? এইখানে ভগবান বলছেন, " ভক্ত্যা লভ্যস্ত্ব অনন্যয়া" - অর্থাৎ কেবল ঐকান্তিক ভক্তি দ্বারা তিনি প্রাপ্য। এবং এই অনন্য ভক্তি দ্বারা জীবের গতাগতি শেষ হতে পারে।
দেখুন দুটো পথ, দুই ধরনের ভক্ত। একটা সরল-সোজা পথ। যে পথে গেলে আর ফিরে আসতে হয় না। আর একটা পথ হচ্ছে, চক্রাকারে, যেটা ঘুরে ফিরে আবার একই জায়গায় মিলিত হয়। একদল বলছেন, ভগবান আমি মুক্তি চাই না। আমি যেন তোমার দাসানুদাস হয়ে থাকতে পারি। তোমার স্মরণাগতি নিয়ে থাকতে পারি। এই চক্রটি বিশাল। ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জনঃ, তপঃ ও সত্যম। এই সত্যম বা ব্রহ্মলোক পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরতে হয়।
আর সরলরেখা ধরে যারা যান, অর্থাৎ সেই বিরাট পুরুষের লীলালোকে, তারা আর ফিরে আসেন না। এই দুটো পথই সাধকদের জন্য। অর্থাৎ এই জীবনে আপনি যে পর্যন্ত সাধনায় অগ্রসর হলেন, পরবর্তী জীবনে আপনি সেখান থেকে শুরু করবেন, এবং সাধনার উপুযুক্ত সময় ও পরিবেশ পাবেন।
আর একটা উপায় হচ্ছে, স্থান বা ক্ষণ মহত্ত্ব। পাণ্ডবেরা, স্বর্গারোহন করবার জন্য, উত্তরদিকে যাত্রা করেছিলেন । আমাদের অনেকের ধারণা হচ্ছে কাশীতে মৃত্যু বরন আর মরজগতে ফিরে আসতে হয় না। বা দেবস্থানে মৃত্যু করলে জন্ম মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। আবার সময় ভেদ মানুষকে জন্ম মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেতে পারে। ভীষ্মদেব, উত্তরায়ণে মৃত্যু কামনা করেছিলেন । কিন্তু কেন ?
আমরা জানি সূর্য্য পুব থেকে পশ্চিমে যায়। যে সব জীব মাত্র এক দিন বাঁচে, এই বিশ্বাস নিয়েই তারা মারা যায়। সূর্য্যের আর একটা গতি আছে, সেটা হচ্ছে উত্তর-দক্ষিণ। যারা এক বছর বা তার বেশি বাঁচে, তারা এটা খেয়াল করলেই ধরতে পারবে। সূর্য্য যখন, উত্তর দিকে যায়, অর্থাৎ পৌষসংক্রান্তি থেকে আষাঢ়মাসের সংক্রান্তির দিন পর্যন্ত সূর্য্যের গতি উত্তর দিকে থাকে। আবার আষাঢ়মাসের সংক্রান্তির দিন থেকে পৌষমাসের সংক্রান্তি পর্যন্ত দক্ষিণ অভিমুখী থাকে। ভারতের উত্তর দিকে হিমালয়, যেখানে দেবতাদের বাস। এবং উত্তর দিক উচ্চ অবস্থান, আমাদের দক্ষিণে সমুদ্র, অর্থাৎ নিম্ন ভূমি। সাধক সব সময় উর্দ্ধগতি প্রাপ্ত হতে চান । তাই নিম্নগতির সঙ্গে দক্ষিণ, আর উর্দ্ধ গতির সঙ্গে উত্তর গমনের একটা ভাবনা আমাদের প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে।
আমরা দেহ-মন ও আত্মার সম্মিলিত সত্ত্বা। আমরা যখন দেহভুমিতে থাকি, তখন আমরা পশুবৎ। যখন আমরা মনোভূমিতে থাকি তখন, আমরা মননশীল বা মানুষ । আর যখন আমরা আত্মভূমিতে থাকি, তখন আমরা দেবতা বা মহামানব । আত্মা যখন সাধনা আরম্ভ করলো, তখন সে উত্তরের দিকে চললো। ধ্রুব নক্ষত্র তখন আমাদের মাথার উপরে। ধ্রুব অর্থাৎ অচল সত্য তখন আমাদের মাথার উপরে। উত্তরদিকে গেলে সনাতন সত্য শিবে আরোহন করি আমরা। এর বিপরীতে চললে, ধ্রুব নক্ষত্র নিচের দিকে নাবতে লাগলো। সূর্য্য দক্ষিণের দিকে যেতে লাগলো। আমরা ভোগাভিমুখী হতে লাগলাম। সুতরাং ঈশ্বর বিমুখ হয়ে গেলাম।
আবার বলা হয়ে থাকে, আমাদের মন চন্দ্র দ্বারা প্রভাবিত। শুক্লপক্ষে চাঁদের উদয়ে মন আত্মমুখী। আর কৃষ্ণপক্ষে আমাদের মন দেহমুখী। রাতে চাঁদের রাজত্ব, মানসিক উন্নতির সময় । তাই সাধকরা রাতে জেগে থাকেন। আমরা রাতে নিদ্রিত থাকি । বলা হয়ে থাকে রাতে যারা সাধনার জন্য জেগে থাকেন, তারা দেবযানে যাতায়াত করেন, আর যারা নিদ্রা যান তার পিতৃযানে যাতায়াত করেন। পিতৃযান মানুষকে চক্রাকারে ঘোরায়। অর্থাৎ জ্জন্মমৃত্যুর চক্র তার পরিক্রমার পথ। আর দেবযান দিব্যলোকে নিয়ে যায়। যেখানে গেলে, ফিরে আসতে না চাইলে, আর ফিরে আসতে হয় না।
এই দুই পথের সন্ধান যার জানা আছে, তিনি মোহগ্রস্থ হন না। তবে বই পড়ে জানা, বা কারুর কাছ থেকে শুনে জানা, জানা নয়, বিবেকগুরুর কাছ থেকে জানাই জানা। তাই ভগবান অর্জুনকে বলছেন, যোগযুক্ত হও হে অর্জুন। "যোগযুক্ত ভবার্জ্জুন " ।
এবার আমরা আলোচনার শেষ দিকে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, একমাত্র অনন্য ভক্তির দ্বারাই আমাকে অর্থাৎ পরম পুরুষকে জানা যায়। এখন ভক্ত কে ?
ভক্ত হচ্ছেন তিনি যিনি : ১. সর্বদা আমার নাম কীর্ত্তন করেন ; ২. যিনি সর্ব্বদা আমাকে পাবার জন্য চেষ্টা করেন। ৩. আমাকে পাবার জন্য সাধনমার্গে দৃঢ়ভাবে লেগে থাকেন ; ৪. যিনি সর্ব্বদা আমাকেই নমস্কার করেন। ৫. সব সময় আমাতে যুক্ত থেকে আমারই উপাসনা করেন। এর থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি, যিনি কর্ম্মে, চিন্তনে, মননে সর্ব্বদা শ্রীহরিতে যুক্ত থাকেন তিনিই ভক্ত।
শ্রী ভগবান বলছেন, প্রাপ্য বস্তু হচ্ছে ভগবান আর প্রাপ্তির উপায় হচ্ছে ভক্তি। ভাগবত তত্ত্ব জ্ঞাত যে ভক্ত তিনি সেই পরমধামে নিত্য বিরাজ করেন। তার আর এই মর জগতে ফিরে আসতে হয় না ।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ ; হরি ওং। .....
কামনা-জাত কোনো কর্ম্মও থাকে না। আমরা জানি, মানুষ প্রয়াণকালে যেমন চিন্তা করে, বা যে ভাবে তন্ময় থাকে, পরবর্তী জন্মে সে সেই মত দেহ ধারণ করে। তাই ধ্যানের মধ্যে থাকতে পারলে, আমরা পার্থিব বিষয় থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারি, এবং জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকেও মুক্ত থাকতে পারি। আমরা আজ যাদের সঙ্গে সন্মন্ধে আবদ্ধ হয়েছি, পূর্ব্বে বা পূর্ব্ব জন্মে নিশ্চই তাদের উদ্দেশ্য আমাদের চিন্তাস্রোত প্রবাহিত হয়েছিল, তাই আমরা তাদের সঙ্গেই, বা তাদের ঘরেই জন্ম গ্রহণ করেছি। তাই বন্ধন মুক্তির একমাত্র পথ ধ্যান যা আমাকে বিষয় থেকে মুক্ত রাখবে। কর্ম্ম বন্ধন থেকে মুক্তি দেবে, আর জন্ম মৃত্যুর চক্র থেকে রেহাই দেবে।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি ওম
পুনশ্চ :
গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, কর্ম্ম তিন রকম :কর্ম্ম, অকর্ম্ম, ও বিকর্ম্ম। শাস্ত্র অনুযায়ী কর্ম্ম করাকেই আসল কর্ম্ম বলে। আর শাস্ত্রনিষিদ্ধ যে কাজ তাকে বলে বিকর্ম্ম। আর কর্ম্ম থেকে বিরত থাকা অর্থাৎ কর্ম্ম সন্যাস - এর নাম হচ্ছে অকর্ম্ম।
কর্ম্ম : আমাদের সমস্ত কর্ম্ম-ই শাস্ত্র অনুযায়ী হওয়া উচিত। এখন কোন শাস্ত্র অনুযায়ী আমাদের কর্ম্ম করা উচিত। যে শাস্ত্র আমাদের যজ্ঞে পশুবলি দিতে বলছে ? যে শাস্ত্র মানুষকে অস্পৃশ্য করে রেখেছে। যে শাস্ত্র মানুষকে ঘৃণা করে শেখায়। প্রাচীন ঋষিরা, এমনকি রাজ্-রাজারা যজ্ঞ করতেন, বিভিন্ন ধরনের যজ্ঞ করতেন। এবং প্রত্যেকটি যজ্ঞের এক একটা উদ্দেশ্য ছিল। এবং এর সবই কামনা প্রসূত। মন মন ঘি ঢালা হতো। তাহলে কি আমাদের সেই যজ্ঞকর্ম করতে হবে ? না, যজ্ঞ হচ্ছে, ব্রহ্মাগ্নিতে অহংকে আহুতি দেওয়া। আমাদের অহংকে আহুতি দিতে হবে, মন মন ঘি ঢালা নয়, বা পশুবলি দেওয়া নয়। আর দিতে হবে কোথায়, না ব্রহ্মাগ্নিতে, অর্থাৎ বেল কাঠের বা ডুমুর কাঠের অগ্নিতে নয়, জ্ঞান দ্বারা প্রজ্বলিত যে ব্রহ্ম সেখানে আহুতি দিতে হবে। শাস্ত্র বলতে বোঝায় - স্ব-অস্ত্র। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য যার সাহায্য নিতে হয়, তাই আমাদের শাস্ত্র। এখন এই শাস্ত্র যারা রচনা করেছেন, তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য যা বলে গেছেন, তাইই কি শাস্ত্র ? না মানব জাতির স্বার্থে যা রচিত হয়েছে, তাইই শাস্ত্র। তথাকথিত ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের রচনামাত্রই শাস্ত্র নয়। পশুবলি , বা হিংসায় প্রেরণা, বা মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করা শাস্ত্রের উদ্দেশ্য নয়, শাস্ত্রের উদ্দেশ্য, সর্বেষাং মঙ্গলম ভব, সর্ব্বে সন্তু সুখিনঃ । সবার যাতে মঙ্গল হয়, অন্ততঃ বেশিরভাগের যাতে মঙ্গল হয়, সেই আপ্তবাক্যই শাস্ত্র।
বিকর্ম্ম : শাস্ত্র অনুযায়ী কাজ না করাই বিকর্ম্ম। এখন শাস্ত্র বলছে, মিথ্যে কথা বলবে না। কিন্তু যদি মহৎ কাজের জন্য, বা কারুর প্রাণ রক্ষার জন্য, বা কোনো মায়ের সন্মান রক্ষার জন্য যদি মিথ্যে বলতে হয়, তবে সেটা কর্ম্ম হতে পারে। কাউকে আঘাত করবার জন্য অস্ত্র চালানো, আর ডাক্তারের অস্ত্র চালানো এক ব্যাপার নয়। ডাক্তারের অস্ত্র চালানো কর্ম্ম, কিন্তু ডাকাতের অস্ত্র চালানো বিকর্ম্ম। আসলে আমরা কি করছি সেটা বড় কথা নয়, কেন করছি সেটা বড়ো কথা। তাই উদ্দেশ্য বিহীন হয়ে কর্ম্ম নয়, সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কর্ম্ম করতে হবে আমাদের।
অকর্ম্ম : কর্ম্ম সন্যাসকে বলে অকর্ম্ম। কিন্তু তাই বলে, কোনো কাজ না করে, চুপ চুপ বসে থাকাকে, অকর্ম্ম বলে না। দেহ কর্ম্মহীন থাকতে পারে না। কর্ম্ম সন্যাস তাকেই বলে, যিনি কর্ম্মের দ্রষ্টা হতে পারেন, কর্তা নয়। কর্ম্ম আমাদের জ্ঞানের আলো এনে দিতে পারে। আর জ্ঞান মানে ঈশ্বর জ্ঞান। আর ঈশ্বর সম্পর্কে যখন আমাদের জ্ঞান হবে, তখন আমাদের ঈশ্বরভক্তি হবে। অতএব অকর্ম মানে আলসেমী নয়। অকর্ম মানে অকর্তা জ্ঞানে কর্ম করা।
এখন কর্ম্ম ফলের বন্ধন কার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর কার ক্ষেত্রেই বা প্রযোজ্য নয়। আসলে কর্ম্ম কর্তাকেই বন্ধন করে, কর্মচারীকে নয়। যার কর্তৃত্ব-অভিমান আছে, সেই কর্তা। তেমনি, ভোগে যার অভিলাষ আছে, তিনিই ভোক্তা। আসলে কর্ম্ম যেমন আমাদের চিন্তার ফল, ভোগও চিন্তার ফল। সেই জন্য, কি করছেন সেটা বড় কথা নয়, কেন করছেন, সেটা বড় কথা। আপনার বিচার আপনার কর্ম্মকে প্রভাবিত করবে, এবং আপনাকে ফল ভোগ করাবে। সেই জন্য বলা হয়ে থাকে, যিনি কর্তৃত্বাভিমানহীন তিনি নিরাশ্রয়, নিত্যতৃপ্ত। এনাদের কর্ম্মে কোনো ফালাকাঙ্খা নেই, আমি করছি, সেই ভাবও নেই। তাই ভোগ বা দুর্ভোগ এদের প্রভাবিত করতে পারে না।
এখন কথা হচ্ছে, জীব পুনঃ পুনঃ জন্মাচ্ছে, পুনঃ পুনঃ মরছে, জন্মালে কর্ম্ম করতে হচ্ছে, আবার কর্ম্মফল ভোগ করবার জন্য আবার জন্মাতে হচ্ছে। এই গোলক ধাঁধায় জীব অবিরত ঘুরছে। এর থেকে অব্যহতি পাবার কি কোনো উপায় নেই ?
এইখানে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, "পরমাং গতিম" (৮/২১) . বা "মে পরমং ধাম" আমার পরমধাম, যা পেলে আর প্রত্যাবর্তন হয় না। এখন সেই পরম ধামে পৌঁছিবার উপায় কি ? এইখানে ভগবান বলছেন, " ভক্ত্যা লভ্যস্ত্ব অনন্যয়া" - অর্থাৎ কেবল ঐকান্তিক ভক্তি দ্বারা তিনি প্রাপ্য। এবং এই অনন্য ভক্তি দ্বারা জীবের গতাগতি শেষ হতে পারে।
দেখুন দুটো পথ, দুই ধরনের ভক্ত। একটা সরল-সোজা পথ। যে পথে গেলে আর ফিরে আসতে হয় না। আর একটা পথ হচ্ছে, চক্রাকারে, যেটা ঘুরে ফিরে আবার একই জায়গায় মিলিত হয়। একদল বলছেন, ভগবান আমি মুক্তি চাই না। আমি যেন তোমার দাসানুদাস হয়ে থাকতে পারি। তোমার স্মরণাগতি নিয়ে থাকতে পারি। এই চক্রটি বিশাল। ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জনঃ, তপঃ ও সত্যম। এই সত্যম বা ব্রহ্মলোক পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরতে হয়।
আর সরলরেখা ধরে যারা যান, অর্থাৎ সেই বিরাট পুরুষের লীলালোকে, তারা আর ফিরে আসেন না। এই দুটো পথই সাধকদের জন্য। অর্থাৎ এই জীবনে আপনি যে পর্যন্ত সাধনায় অগ্রসর হলেন, পরবর্তী জীবনে আপনি সেখান থেকে শুরু করবেন, এবং সাধনার উপুযুক্ত সময় ও পরিবেশ পাবেন।
আর একটা উপায় হচ্ছে, স্থান বা ক্ষণ মহত্ত্ব। পাণ্ডবেরা, স্বর্গারোহন করবার জন্য, উত্তরদিকে যাত্রা করেছিলেন । আমাদের অনেকের ধারণা হচ্ছে কাশীতে মৃত্যু বরন আর মরজগতে ফিরে আসতে হয় না। বা দেবস্থানে মৃত্যু করলে জন্ম মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। আবার সময় ভেদ মানুষকে জন্ম মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেতে পারে। ভীষ্মদেব, উত্তরায়ণে মৃত্যু কামনা করেছিলেন । কিন্তু কেন ?
আমরা জানি সূর্য্য পুব থেকে পশ্চিমে যায়। যে সব জীব মাত্র এক দিন বাঁচে, এই বিশ্বাস নিয়েই তারা মারা যায়। সূর্য্যের আর একটা গতি আছে, সেটা হচ্ছে উত্তর-দক্ষিণ। যারা এক বছর বা তার বেশি বাঁচে, তারা এটা খেয়াল করলেই ধরতে পারবে। সূর্য্য যখন, উত্তর দিকে যায়, অর্থাৎ পৌষসংক্রান্তি থেকে আষাঢ়মাসের সংক্রান্তির দিন পর্যন্ত সূর্য্যের গতি উত্তর দিকে থাকে। আবার আষাঢ়মাসের সংক্রান্তির দিন থেকে পৌষমাসের সংক্রান্তি পর্যন্ত দক্ষিণ অভিমুখী থাকে। ভারতের উত্তর দিকে হিমালয়, যেখানে দেবতাদের বাস। এবং উত্তর দিক উচ্চ অবস্থান, আমাদের দক্ষিণে সমুদ্র, অর্থাৎ নিম্ন ভূমি। সাধক সব সময় উর্দ্ধগতি প্রাপ্ত হতে চান । তাই নিম্নগতির সঙ্গে দক্ষিণ, আর উর্দ্ধ গতির সঙ্গে উত্তর গমনের একটা ভাবনা আমাদের প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে।
আমরা দেহ-মন ও আত্মার সম্মিলিত সত্ত্বা। আমরা যখন দেহভুমিতে থাকি, তখন আমরা পশুবৎ। যখন আমরা মনোভূমিতে থাকি তখন, আমরা মননশীল বা মানুষ । আর যখন আমরা আত্মভূমিতে থাকি, তখন আমরা দেবতা বা মহামানব । আত্মা যখন সাধনা আরম্ভ করলো, তখন সে উত্তরের দিকে চললো। ধ্রুব নক্ষত্র তখন আমাদের মাথার উপরে। ধ্রুব অর্থাৎ অচল সত্য তখন আমাদের মাথার উপরে। উত্তরদিকে গেলে সনাতন সত্য শিবে আরোহন করি আমরা। এর বিপরীতে চললে, ধ্রুব নক্ষত্র নিচের দিকে নাবতে লাগলো। সূর্য্য দক্ষিণের দিকে যেতে লাগলো। আমরা ভোগাভিমুখী হতে লাগলাম। সুতরাং ঈশ্বর বিমুখ হয়ে গেলাম।
আবার বলা হয়ে থাকে, আমাদের মন চন্দ্র দ্বারা প্রভাবিত। শুক্লপক্ষে চাঁদের উদয়ে মন আত্মমুখী। আর কৃষ্ণপক্ষে আমাদের মন দেহমুখী। রাতে চাঁদের রাজত্ব, মানসিক উন্নতির সময় । তাই সাধকরা রাতে জেগে থাকেন। আমরা রাতে নিদ্রিত থাকি । বলা হয়ে থাকে রাতে যারা সাধনার জন্য জেগে থাকেন, তারা দেবযানে যাতায়াত করেন, আর যারা নিদ্রা যান তার পিতৃযানে যাতায়াত করেন। পিতৃযান মানুষকে চক্রাকারে ঘোরায়। অর্থাৎ জ্জন্মমৃত্যুর চক্র তার পরিক্রমার পথ। আর দেবযান দিব্যলোকে নিয়ে যায়। যেখানে গেলে, ফিরে আসতে না চাইলে, আর ফিরে আসতে হয় না।
এই দুই পথের সন্ধান যার জানা আছে, তিনি মোহগ্রস্থ হন না। তবে বই পড়ে জানা, বা কারুর কাছ থেকে শুনে জানা, জানা নয়, বিবেকগুরুর কাছ থেকে জানাই জানা। তাই ভগবান অর্জুনকে বলছেন, যোগযুক্ত হও হে অর্জুন। "যোগযুক্ত ভবার্জ্জুন " ।
এবার আমরা আলোচনার শেষ দিকে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, একমাত্র অনন্য ভক্তির দ্বারাই আমাকে অর্থাৎ পরম পুরুষকে জানা যায়। এখন ভক্ত কে ?
ভক্ত হচ্ছেন তিনি যিনি : ১. সর্বদা আমার নাম কীর্ত্তন করেন ; ২. যিনি সর্ব্বদা আমাকে পাবার জন্য চেষ্টা করেন। ৩. আমাকে পাবার জন্য সাধনমার্গে দৃঢ়ভাবে লেগে থাকেন ; ৪. যিনি সর্ব্বদা আমাকেই নমস্কার করেন। ৫. সব সময় আমাতে যুক্ত থেকে আমারই উপাসনা করেন। এর থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি, যিনি কর্ম্মে, চিন্তনে, মননে সর্ব্বদা শ্রীহরিতে যুক্ত থাকেন তিনিই ভক্ত।
শ্রী ভগবান বলছেন, প্রাপ্য বস্তু হচ্ছে ভগবান আর প্রাপ্তির উপায় হচ্ছে ভক্তি। ভাগবত তত্ত্ব জ্ঞাত যে ভক্ত তিনি সেই পরমধামে নিত্য বিরাজ করেন। তার আর এই মর জগতে ফিরে আসতে হয় না ।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ ; হরি ওং। .....
অদৃষ্ট ও কর্ম্ম।
আমরা সবাই ভালো থাকতে চাই। কিন্তু ভালো থাকতে চাইলে কি হয়, আমরা কেউ সারাজীবন ভালো থাকতে পারি না। কথা থেকে কোন বিপর্যয় যে এসে ঘরে চাপে তার ঠিক নেই। যাকে আমরা বলি অদৃষ্ট। এই অদৃস্ট থেকে কারুর রেহাই নেই। আজ আমরা এই অদৃষ্ট কিভাবে সৃষ্ট হয়,আর কিভাবেই বা আমরা অদৃস্ট থেকে রেহাই পেতে পারি, সেই সম্পর্কে শুনবো।
অদৃষ্ট কথাটার অর্থ হচ্ছে, যা দেখা যায় না। দৃষ্ট কথাটির আর একটা অর্থ হচ্ছে জ্ঞান। তো যা আমাদের জ্ঞানের বাইরে, তাকে বলা হয়, অদৃষ্ট। অদৃস্ট আসলে আমাদের পূর্ব-পূর্ব কর্ম্মফল, যেসব কর্ম্মের কথা আমাদের স্মৃতিতে নেই। কর্ম্মফল অর্থাৎ কর্ম্ম করলে যে ফল হয়, তাকে বলে কর্ম্মফল। বীজ লাগালে গাছ হবে। আগুনে হাত দিলে হাত পুড়বে। ঠান্ডা বরফে হাত দিলে, হাত ঠান্ডা হবে। এগুলো প্রতক্ষ্য জ্ঞান। এই জ্ঞানের বাইরেও কিছু ফল আমাদের ভোগ করতে হয়, তা সে ভালোও হতে পারে, আবার খারাপ হতে পারে, যেমন আপনার প্রিয়জন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলো, বা কেউ অকালে মরা গেলো, তো আপনাকে দুর্ভোগ পোহাতে হবে। অথবা আপনার ছেলে পরীক্ষায় ভালো, রেজাল্ট করলো, বা ভালো চাকরি পেলো, এর সঙ্গে আপনার নিজস্ব কর্ম্মের সরাসরি কোনো যোগাযোগ নেই, তথাপি, এর থেকে আপনার ভালো লাগা বা খারাপ লাগা অনুভব হতে পারে। তো এই যে অদৃষ্ট কর্ম্মফল যা আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না, সেখান থেকে আমরা রেহাই পাবো কি করে।
এই কথা বিশদভাবে বুঝতে গেলে আমাদের প্রথমে বুঝতে হবে। আমি কে ? এবং কিভাবে কর্ম্মফল আমাকে প্রভাবিত করে।
আমি কে ? প্রথমত আমি এই দেহ। এর পরে আছে, আমার একটা মন, যেখানে বুদ্ধি-স্মৃতি সঞ্চিত আছে। আর আছে আমাদের প্রত্যেকের কিছু সংস্কার - যাকে বলা হয়, চিত্ত বৃত্তি। সব শেষে আছে আমাদের একটা আত্মা, যাকে কেউ কেউ বলেন, জীবাত্মা । এই জীবাত্মার কথা আমরা শুনে থাকি বটে, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, এটা আমরা অনুভব করতে পারি না। কিন্তু আত্মা বলে একটা কিছু আছে, সেটা আমরা লোকমুখে শুনে শুনে বিশ্বাস করে নিয়েছি। এই আত্মা নাকি নশ্বর, পরিবর্তনহীন, অজন্মা।
এখন কথা হচ্ছে আমরা এই যে দেহটাকে দেখছি। এই দেহকে পরাবিদ্যাদিদগন ৫ ভাগে ভাগ করেছেন। এর মধ্যে তিনটে-কে বলছেন, ভৌতিক, আর দুটোকে বলছেন, অভৌতিক। ভৌতিক বলতে অনন্ময়, প্রাণময়, মনময়। আর অভৌতিক দেহ হচ্ছে বিজ্ঞানময়, ও আনন্দময়। ভৌতিক অর্থাৎ পঞ্চভুতের দ্বারা তৈরী। অর্থাৎ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। আর অভৌতিক, অর্থাৎ জ্ঞান ও আনন্দ - যার অনুভব আমাদের আছে, কিন্তু অধরা-অবস্তু ।
অনন্ময় - আমরা যা কিছু আহার হিসেবে গ্রহণ করছি, তা সে জল বা খাদ্য, যাই হোক না কেন, সবই আমার এই দেহকে পুষ্টি যোগাচ্ছে, আমাদেরকে বেঁচেবর্তে থাকতে, বেড়ে উঠতে সাহায্য করছে। অতএব আমি যা কিছু খাচ্ছি তাই দিয়ে তৈরী এই অনন্ময়ময় দেহ। আমি একটা পেয়ারা খেলে ক্ষাণিক্ষণ পরেই, সেই পেয়ারা আর পেয়ারা থাকে না, আমি হয়ে যায়।
প্রাণময় : এই যে বাতাস যা আমি গ্রহণ করছি, তাও আমি। কেননা, এই বাতাস যা আমি গ্রহণ করছি, ক্ষাণিক্ষণ পরেই, সেই বাতাস আমার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। আমার শরীরের সমস্ত অঙ্গ-কোষ এই বাতাস থেকেই তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য অর্থাৎ জীবনীশক্তি সংগ্রহ করছে।
মনময় : আমাদের সবার একটা করে মন আছে। এই মনের সাহায্যেই আমরা চিন্তা করি, এই মনের সাহায্যেই আমরা সুখ-দুঃখ অনুভব করছি। আমাদের মন নামক পদার্থটি যদি না থাকতো, তবে আমি বলে কেউ আছে, সেটা আমরা ভাবতেই পারতাম না। অতয়েব এই মনটাও আমি।
এই যে তিনটে দেহের কথা বললাম, এগুলো সবই আমি। আর এই তিনটি দেহকে কর্ম্মবন্ধন নামক আঠা একত্রিত করে রেখেছে। এই কর্ম্ম বন্ধন যদি আমাদের না থাকতো, তবে এই তিন আমি আর একত্রে থাকতো না। আর এই স্থুল আমি বলতে আমরা যা বুঝি, তা আর থাকতো না।
বিজ্ঞানময় : আমরা জানি, আমাদের পাঁচটি জ্ঞান-ইন্দ্রিয় আছে। আর এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমাদের মন বহির্জগতের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে থাকে। এই পাঁচটি ইন্দ্রিয় যদি আমাদের নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, তবে অর্থাৎ চোখ যদি না দেখতে পায়, কান যদি না শুনতে পায়, মুখ যদি কথা বলতে না পারে বা জিহ্বা যদি স্বাদ গ্রহণ করতে না পারে, ত্বক যদি স্পর্শসুখ অনুভব না করতে পারে, নাক যদি শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ করতে না পারে, তবে আর আমি বলে কিছু থাকবে না। আমি তখন একটা জড় পদার্থে পরিণত হবো - যার কোনো আমি বোধ নেই। তো আমার যে জ্ঞান আহরণ হচ্ছে তাই দিয়ে একটা অভৌতিক দেহ তৈরী হয়েছে, যাকে বলা হয়, বিজ্ঞানময় দেহ। এটি অভৌতিক, কিন্তু ভৌতিক দেহের সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে। অর্থাৎ স্থুল দেহের সাহায্যেই সে তার শরীর গঠন করে থাকে।
আনন্দময় : আমরা যে আনন্দ অনুভব করি, এই আনন্দটুকু দিয়ে যদি একটা দেহের কল্পনা করা যায়, তাকে আনন্দময় দেহ বলা যেতে পারে। আসলে এই আনন্দময় দেহের মধ্যেই পরমাত্মা প্রতিফলিত হন।
যাই হোক, এই যে আমাদের তিনটি ভৌতিক দেহ, একে জুড়ে রেখেছে আমাদের কর্ম্মবন্ধন। তাই বলা হয়ে থাকে, কর্ম্মফল ভোগ করবার জন্য আমরা বারবার জন্ম গ্রহণ করে থাকি। অর্থাৎ এই ভৌতিক দেহের মধ্যে প্রবেশ করি।
মহাত্মাগণ বলছেন, কর্ম্মফল তিন প্রকার। ১. অতিক্রম্য। ২. দুরতিক্রম্য ৩. অনতিক্রম্য। অর্থাৎ কতকগুলো কর্ম্মফল অতিক্রম করা যায়, কতকগুলো কর্ম্মফল অতিক্রমন করা যায় না, আর কতকগুলো কর্ম্ম ফল অতিক্রমন করা যায় তবে তা কষ্টসাধ্য। এছাড়া আমাদের জানা আছে, কর্ম্ম তিন প্রকার। বর্তমান কর্ম্ম, প্রারব্ধ কর্ম্ম ও সঞ্চিত কর্ম্ম। বর্তমান কর্ম্ম অর্থাৎ যা এখন আমরা করছি, এই বর্তমান কর্ম্মের কিছু ফল তাৎক্ষণিক ভাবে প্রাপ্ত হয়, আবার কিছু ফল ভবিষ্যতে ফলবে। এই যে ভবিষ্যতে যে কর্ম্মের ফল ফলবে, তাকে বলা হয়, সঞ্চিত কর্ম্ম। অর্থাৎ এই সঞ্চিত কর্ম্মফল আমাদের ভবিষ্যতে ফল দেবে। এছাড়া অতীতে যে কর্ম্ম আমরা করেছিলাম, যার ফল ভোগ করা সম্ভব হয় নি, এখন সেগুলো, ফল দিতে উন্মুখ তাকে বলা হয়, প্রারব্ধ কর্ম্মফল। এই প্রারব্ধ কর্ম্মফলকেই আমরা দৈব বলে থাকি।
প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা বলে থাকি, কর্ম্মফল কিন্তু নিতান্তই ব্যক্তিগত সঞ্চয় নয়। আপনার নিজের কর্ম্ম, আপনার পরিবারের কর্ম্ম, আপনার দেশনায়কদের কর্ম্ম, আপনি যে জাতিভুক্ত সেই জাতির কর্ম্ম, এমনকি সারা বিশ্বের মানুষের কর্ম্মও আপনাকে প্রভাবিত করবে। আপনি যে পরিবেশে বাস করেন, সেই একই পরিবেশে যারাই বাস করেন, তাদের সবার কর্ম্ম আপনাকে প্রভাবিত করবে। যেমন আপনি ধরুন, জঙ্গলে বাস করেন, তো সেখানে যারা বাস করে, অর্থাৎ জঙ্গলের জীবজন্তু, তাদের কর্ম্ম আপনাকে প্রভাবিত করবে। ধরুন আপনি একটা নদীর তীরে বাস করেন, তো নদীর গতিপ্রকৃতি আপনাকে প্রভাবিত করবে। এছাড়া, প্রকৃতির কর্ম্ম, যেমন ধরুন, ঝড়, জল, অনাবৃষ্টি, এমনকি মারি-মহামারি ইত্যাদি আপনাকে প্রভাবিত করবে। এমনকি আমাদের যে বিশ্বব্রহ্মান্ড তার প্রতিটি গ্রহ-নক্ষত্র যে ক্রিয়াযুক্ত হবে, তার ফল আমাদের সবার ভোগ করতে হবে। অর্থাৎ উল্কাপাত, মেঘলা দিন, অথবা সূর্য্যের প্রখর উত্তাপ, সবই আমাদের শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্য রক্ষার বা বিঘ্ন করবার সম্ভাবনা থাকবে। এমনকি আপনি যে প্রতিষ্ঠানে কর্ম্ম করেন, সেই প্রতিষ্ঠানের ভালো মন্দ আপনাকে ভোগ করতে হবে। আপনি কেন্দ্রীয় সরকারি কর্ম্মচারী হলে, পে-রিভিশন এর সুবিধা ভোগ করবেন, আবার আপনার সরকারি সিদ্ধান্ত - ডি-এ বন্ধ হতে পারে। আপনি রেলে বা ব্যাংকে চাকরি করলে, সেখানকার প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত আপনাকে ভালো বা মন্দ ভোগ করাবে। তাই বলছি, এমনটা ভাবার কোনো কারন নেই, যে আমি ভালো কাজ করলে, আমি ভালো, থাকবো, আর খারাপ কাজ করলে, আমি খারাপ থাকবো। আসলে আমার আপনার ভালো থাকার পিছনে অনেকগুলো কারন বর্তমান। তবে, একটা কথা ঠিক, সবাই যদি ভালো থাকে, অর্থাৎ সবার কর্ম্ম যদি ভালো থাকবার উপযুক্ত হয়, তবে আমরা সবাই ভালো থাকতে পারি। অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত কিছুর গতি-প্রকৃতি ও ক্রিয়াশীলতা আমাদের ভালো বা মন্দ থাকবার কারন। এইজন্য, মহাত্মাগণ আমাদের সবাইকে সৎ পথে চলাবার জন্য, উপদেশ দিয়ে থাকেন, অনুপ্রাণিত করে থাকেন। জীবনে একটা ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে হবে।
এখন কথা হচ্ছে, এই অদৃষ্ট বা ভাগ্য কেউ স্বীকার করেন, আবার কেউ করেন না। মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন, স্নান করলে শরীর শীতল হবে, পুষ্টিকর পরিমিত আহার করলে শরীর সবল হবে আবার আগুনের কাছে গেলে শরীরের শীতলতা .কেটে যাবে। দেখুন, ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করলে, শরীরে ক্ষত দেখা দেবে, এমনকি মারাও যেতে পারেন, কেউ গালাগাল করলে, বা আমি কাউকে গালাগালি দিলে, একটা ভালো না লাগার অনুভূত তৈরী হবেই। তাই কর্ম্মফল স্বীকার না করে আমাদের উপায় নেই। অর্থাৎ আমাদের কাজ আমাদের কর্ম্মের পরিণতির কাছে নিয়ে যাবে, এটা নিশ্চিত। এবং প্রত্যেকটি কর্ম্মেরই একটা আবশ্যিক পরিণতি আছে, এটাই প্রকৃতির অলঙ্ঘনীয় নিয়ম। এর থেকে আমরা কিছুতেই রেহাই পেতে পারি না।
এখন কথা হচ্ছে, আমরা আমাদের বর্তমান কর্ম্মকে ভালো পথে পরিচালিত করতে পারি। কিন্তু যে কর্ম্ম আমাদের দ্বারা পূর্বেই সম্পাদিত হয়ে গেছে, তাকে তো আমরা পরিবর্তন করতে পারবো না। তাহলে কি আমাদের পূর্ব-পূর্ব জীবনের কর্ম্ম আমাদের ভোগ করতেই হবে, এর থেকে পরিত্রানের উপায় কি ? এ ক্ষেত্রে একটা কথা বলতেই হয়, যে পূর্বার্জিত অর্থাৎ বর্তমান জীবনের প্রথম দিকে যে কর্ম্ম করা হয়েছে, আবার এই জীবনের আগের-আগের জন্মে যে কাজ করেছেন, আবার এই জীবন ও পূর্ব-জীবন মিলিয়ে যে কর্ম্ম সম্পাদন হয়েছে, সেই সব মিলিয়েই আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের ফল ভোগ করতে হবে। মহাত্মা বলছেন, তুমি ঠান্ডা জলে স্নান করে এসে, বা বৃষ্টিতে ভিজে এসে যদি গরমের কাছে বা রোদ্দুরে বসো, তবে তোমার শরীর আরাম বোধ করতে পারে। আবার ধরো তুমি যে কোনো কারণেই হোক, অসময়ে বৃষ্টিতে ভিজলে, এতে করে তুমি জানো যে তোমার শরীরে ঠান্ডা লাগবেই, এমনকি তোমার জ্বর হতে পারে। কিন্তু তুমি বাড়িতে এসে, একবার স্নান করে নিলে, অর্থাৎ তোমার মাথায় যে বৃষ্টির জল লেগেছিলো, সেটি ধুয়ে ফেললে, তবে তোমার বৃষ্টিতে ভেজার জন্য যে পরিণতি হতে পারতো, তা নাও হতে পারে। ধরো তুমি অপরিমিত আহার করলে, বা শরীরের পক্ষে খারাপ এমন কোনো জিনিস খেয়ে ফেললে, এরপরে যদি তুমি বমি করে, সেই খারাপ বা অতিরিক্ত খাবার পেট থেকে বের করে দিতে পারো, তবে তুমি শরীর খারাপের হাত থেকে রেহাই পেতে পারো। অর্থাৎ কর্ম্মফলকে আমরা বন্ধ করতে পারিনা বটে, কিন্তু আমাদের বর্তমান কর্ম্ম প্রারব্ধ কর্ম্মফলের গতি পরিবর্তন করে দিতে পারে । সুতরাং পূর্বকর্ম্মফল বা অদৃষ্টকে আমাদের পুরুষাকারের দ্বারা প্রতিহত করতে পারি।
আমরা জানি, আগে করা কর্ম্মফলকেই তা সে এই জীবনে হোক বা পূর্ব-পূর্ব জীবনেই হোক, পূর্বকর্ম্মের ফালকেই অদৃষ্ট বলে। আর আমরা এখন যে কর্ম্ম করছি, তাকেই পুরুষকার বলা হয়ে থাকে। এখন পুরুষকারের প্রয়োগের কার্যকাল সম্পর্কে সাময়িক ভাবে অবহিত থাকতে হবে। দেখুন, ভালো জমি, বীজও ভালো, কিন্তু ভালো ফসল হলো না, কারন অসময়ে বীজ বপন করা হয়েছিল। অতয়েব একটা কথা মনে রাখতে হবে, অদৃষ্ট-পুরুষকার-কাল এই তিনের সমন্নয়ে ফল উৎপন্ন হয়। অতয়েব শুধু ভালো বীজ হলে হবে না, শুধু ভালো ক্ষেত্র হলে হবে না, কখন বীজ লাগানো হচ্ছে সেটিও বিচার করতে হবে। আপনি শুধু পরিশ্রম করলেই, ফল ভালো হবে, তার কোনো মানে নেই। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, অসময়েও ভালো ফসল উৎপাদন করা যেতে পারে, যদি আমরা বুদ্ধি যোগে কাজ করতে পারি। যেমন ধরুন, কাঁচা আম পেড়েছেন, পাকছে না। একটু কার্বাইট আমগুলোর কাছে রেখে ঢেকে দিন, অসময়ে আমি পেঁকে উঠবে। তাই বলছি, পুরুষকারের সঠিক প্রয়োগে অর্থাৎ আমাদের বুদ্ধির দ্বারা আমরা কালশক্তিকে প্রতিহত করতে পারি। এখন বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অসময়ে বিভিন্ন ফসলাদি উৎপন্ন হচ্ছে। আসলে বুদ্ধির সাহায্যে আমরা কালকে বিধ্বস্ত করতে পারি। এইজন্য বলা হয়ে থাকে একমাত্র পুরুষকার আমাদের পূর্বকৃত কর্ম্মফলকে প্রভাবিত করতে পারে, এমনকি প্রারব্ধ কর্ম্মফলকেও পরিবর্তন করে দিতে পারে। তবে হ্যাঁ, আমরা যেমন আগে শুনেছি, কর্ম্মফল তিন প্রকার। অতিক্রম্য, অনতিক্রম্য, দূরতিক্রম্য। ঠিক তেমনি, আমরা যাকে অদৃষ্ট বলি, এই অদৃষ্টও তিন রকম - অর্থাৎ কিছু অদৃষ্ট একটু চেষ্টা করলেই, পরিবর্তন করা যেতে পারে, কিছু অদৃষ্ট পরিবর্তন করতে গেলে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়, আর কতকগুলো অদৃষ্ট যা পরিবর্তন একদমই সম্ভব নয়। অর্থাৎ যে অদৃষ্ট পুরুষকারের প্রয়োগে খন্ডন সম্ভব নয়, তাকে অনতিক্রম্য অদৃষ্ট বলে। অদৃষ্টের এই যে প্রকারভেদ এটা আমাদের ভালো করে বুঝতে হবে, তবে কোথায় আমরা নিষ্ক্রিয় হয়ে, ভবিতব্যকে মেনে নিয়ে, সহ্য করবো, আর কোথায় আমরা পুরুষকারকে প্রয়োগ করে আমাদের দুর্ভাগ্যকে সৌভাগ্যে পরিণত করবো। যেমন ধরুন, কেউ বিড়াল-চক্ষু, কেউ নীল চক্ষু, কারুর গায়ের রঙ কালো, কেউবা ফর্সা, কেউ ব্রাহ্মণ পিতার ঘরে, কেউ বা শুদ্র মাতার গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেছেন। এক্ষেত্রে আপনার কিছুই করবার নেই। কিন্তু আপনি গরিবের ঘরে জন্ম গ্রহণ করেছেন, সেক্ষেত্রে আপনি আপনার পুরুষকারের প্রয়োগে অবশ্য়ই ধনী হতে পারেন। ছোটবেলায় আপনি স্কুল-কলেজে যেতে পারেন নি, কিন্তু পরবর্তীতে আপনি নিজের আগ্রহে শিক্ষার সুযোগ নিয়ে, অবশ্যই আপনি জ্ঞান-সমৃদ্ধ হতে পারেন। তো মোদ্দা কথা হচ্ছে, পুরুষকারের প্রয়োগেই মানুষ তার অদৃষ্টকে কিছুকিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন করে নিতে পারেন। কথায় বলে, উদ্যোগী পুরুষকে লক্ষী আশ্রয় করে থাকে। অদৃষ্ট মানুষকে কখনোই সৌভাগ্যশালী করতে পারে না। অলস, উদ্যমহীন, নির্বোধ, পুরুষেরা ভাগ্যের দোহাই দেয়। আর নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকে। আত্মশক্তি দ্বারা দৈবকে বিধ্বস্ত করাই পুরুষকার। হ্যাঁ কোনো কোনো সময় যত্নসহযোগে কাজ করেও আমরা সাফল্য পাই না। কিন্তু অধ্যবসায়, ধৈর্য্য, এবং সহনশীলতা মানুষকে সফলতা এনে দেয়। যে বলে পারবো না, সে পারে না, যে বলে পারবো, সে একদিন না একদিন অবশ্য়ই পারে। মহাত্মাগণ বলে থাকেন, যা কিছু তোমার ইচ্ছে করবে, তার প্রতি তুমি তোমার বুদ্ধি সহযোগে সর্বশক্তি নিয়োগ করে, ধৈর্য্যের সাথে লেগে থাকলে, একদিন না একদিন এই কার্য্যে সফলতা পাবেই। যারা ভাগ্যের দোহাই দিয়ে নিস্কর্মা হয়ে বসে থাকে, তাদের জীবনে দুঃখই দুঃখ।
মহামতি ভীষ্মকে একবার যুধিষ্ঠির জিজ্ঞেস করেছিলেন, দৈব ও মানুষের কর্ম্ম এর মধ্যে কোনটা শ্রেষ্ট ? তো মহামতি ভীষ্ম ব্রহ্মার বাক্যের উল্লেখ করে বলেছিলেন, অবীজ কোনো দ্রব্য উৎপন্ন হয় না। বীজবিহীন কোনো ফল হতে পারে না। বীজ থেকে বীজ হয়, বীজ থেকেই ফল হয়। যে যেমন ক্ষেত্রে বীজ বপন করে থাকে, সে তেমনি ফল পেয়ে থাকে। অর্থাৎ প্রথমে ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হয়, সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়, সময়মতো বীজ বপন করতে হয়, পরিচর্য্যা করতে হয়, তবেই ফল উৎপাদন হয়ে থাকে। ক্ষেত্র প্রস্তুত না করে, বীজের উৎকর্ষতা বিচার না করে, সময়ের অপেক্ষা না করে, যদি শুধু খামখেয়ালির বশে পরিশ্রম করে, তবে সেই পরিশ্রম পন্ডশ্রম বই কিছু নয়। দৈব আর কিছুই নয়, দৈব অর্থাৎ বীজ। আমরা এই জগতে দেখতে পাই যে, ক্ষেত্র-বীজ-সময় যোগে শস্য সমৃদ্ধ হয়। কৃত কর্ম্মই সর্বদা ফলবতী। অকৃত কর্ম্ম কখনো ফলবতী হতে পারে না। কৃতি-পুরুষকেই ভাগ্য সহযোগিতা করে থাকে। নিস্কর্মাকে ভাগ্য প্রত্যাখ্যান করে থাকে।
আপনি যা কিছু চান, তা সে রূপ বলুন, রত্ন বলুন, সমস্তই একমাত্র কর্ম্ম দ্বারা প্রাপ্ত হওয়া যায়। কর্ম্ম না করলে, কেবলমাত্র দৈব হতে কিছুই পাওয়া যায় না। আপনি যত মনীষীদের কথা শুনেছেন, বা ভবিষ্যতে শুনবেন, জানবেন তারা সবাই তাদের কর্ম্মের জন্যই মনীষি-পদবাচ্য হয়েছেন। কে মনে রাখতো কৃষ্ণকে যদি না তিনি কোনো কাজ করতেন। কে মনে রাখতো রবীন্দ্রনাথকে যদি না তিনি কর্ম্ম করতেন ? আপনি যদি যথার্থ ব্রাহ্মণ হতে চান, তবে শৌচতা পালন করুন, আপনি যদি ক্ষত্রিয় হতে চান, তবে আপনার মধ্যে বিক্রম থাকা চাই,আপনি যদি বৈশ্য হতে চান, তবে বৈষয়িক কর্ম্ম করুন, আপনি যদি শুদ্র হতে চান, তবে শুশ্রূষা দ্বারা তা লাভ করতে পারেন। যে পুরুষকারের সাধনা করে, দৈব তাকেই অনুসরণ করে থাকে।
স্বামীজী বলছেন, একটা জিনিস মনে রাখবেন, দৈব কর্ম্মের অধীন। কর্ম্ম কখনো দৈবের অধীন নয়। পুরুষকারের প্রকাশ না হলে দৈব কাউকেই কিছু দিতে পারে না। আগুন যেমন বাতাসের সংস্পর্শে এসে, প্রজ্জ্বলিত হয়, তেমনি দৈব পুরুষকারের সাথে মিলিত হয়ে উত্তমফল প্রদান করে থাকে। তেলের অভাবে যেমন প্রদীপ নিভে যায়, তেমনি কর্ম্মক্ষয়ে দৈবও হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। পুরুষাকারবিহীন মানুষ এমনকি জীবজন্তু, কখনো তৃপ্তি পেতে পারে না। শিষ্য যেমন গুরুর অনুগামী হয়, তেমনি দৈব পুরুষকারের অনুগামী হয়।
কিন্তু আমরা তো মাঝে মধ্যে দেখেছি, অযাচিত ভাবে মানুষ অনেক কিছু অনুগ্রহ লাভ করে থাকে। সেটি কিভাবে সম্ভব ? আসলে আপনার পূর্বকৃত কর্ম্মই আপনাকে এই জীবনে এইসময়ে ফল প্রদান করেছে। বিনা কর্ম্মে আপনি কিছুই পেতে পারেন না, পাননি। তা সে ভালো ফল হোক বা খারাপ ফল হোক। দৈব অনুগ্রহ বলে কিছু নেই, জগৎ নিয়মে বাঁধা। এর থেকে একচুল বাইরে যাবার উপায় নেই। ফল ভাবতেই যেমন পূর্বের বীজের অস্তিত্ত্ব বোঝায়, তেমনি দৈবপ্রাপ্তি মানেও পূর্বকৃত কর্ম্মফল। যে পুন্যকর্ম্মে রত, দৈব তার কোনো অনিষ্ট করতে পারে না। আবার যে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে, তাকে দৈব কোনো ফল প্রদান করতে পারে না। আবার যে দুষ্কৰ্ম্মে লিপ্ত, তাকে দৈব কখনো ভালো ফল প্রদান করতে পারে না। কালের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কর্ম্ম ফল ধাবিত হয়। যে কালে কর্ম্ম, ফল প্রসবে উন্মুখ হয়, তখনই কর্ম্মফল আমাদের কাছে প্রকাশিত হয়। তার আগে কর্ম্মফল অব্যক্ত অবস্থায় কালের সঙ্গে মিশে থাকে। তাই আমরা বলে থাকি কাল কাউকে রেহাই দেয় না। আসলে কালের সঙ্গে মিশে আছে আমাদের পূর্ব-পূর্ব কর্ম্মফল। যখনি সময় হবে, সে ফল প্রসব করবে। তাই যাকে আমরা দৈব অনুগ্রহ বলে থাকি, তা আসলে আমাদের দ্বারা কৃতকর্ম্ম বই কিছু নয়।
যাই হোক, দৈব-অদৃষ্ট-ভাগ্য যাকে আমরা অনিয়ন্ত্রিত বলে বোধ করি, তা আসলে আমাদেরই কর্ম্মজনিত। এই দৈব যেমন আমাদের পূর্ব-কর্ম্মদ্বারা সৃষ্ট, তেমনি আমাদের বর্তমান-কর্ম্মই এই দৈবকে নতুন রূপে আমাদের কাছে ধরা দিতে পারে। আসলে দৈব নয়, পুরুষকারই শ্রেষ্ঠ এই কথাটা আমাদের ভালোভাবে মনে রাখতে হবে।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
No comments:
Post a Comment