আমরা সবাই সংস্কার বদ্ধ জীব। পূর্ব্ব জীবনের সংস্কার নিয়ে আমাদের এই জীবন শুরু করেছি। হাঁস জন্ম থেকেই সাঁতার কাটতে শুরু করে দেয়। গাভীবৎস জন্মের কিছক্ষন পরেই, হাটতে শুরু করে দেয়। এগুলো নাকি সবই তাদের পূর্ব্ব জীবনের সংস্কার। মনুষ্য শিশু জন্ম থেকেই নাকি মায়ের দুধ খোঁজে। কি অদ্ভুত। কিন্তু সংস্কার ব্যাপারটা কি ? কিভাবে এই সংস্কারের জন্ম হয় ? সংস্কার কিভাবে আমাদের প্রতি প্রভাব খাটায় ? সংস্কার কোথায় থাকে ? ইত্যাদি নানান প্রশ্ন নিয়ে আজ আমরা শুনবো।
প্রথমে শুনবো সংস্কার কাকে বলে ?
সংস্কার আর কিছুই নয়, সংস্কার হচ্ছে আমাদের স্মৃতি, বা আমাদের কর্ম্ম থেকে উদ্ভুত অভিজ্ঞতার ছাপ, যা আমাদের মনে গেথে রয়েছে। একটা উদাহরণ দিয়ে বলি। ধরুন, আপনার জন্ম দিনে আপনাকে আপনার মা পায়েস খেতে দিলেন । আপনি খেলেন, মাকে প্রণাম করলেন, তার পরে কাজে বেরিয়ে গেলেন। অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সাময়িক ভাবে, এই ঘটনার কথা ভুলেও গেলেন। কিন্তু সত্যিই কি ভুলে গেলেন ?
পরের বছর, জন্ম দিনে আপনি বদলি হয়ে বোম্বে চলে গেছেন। জন্ম দিন এলো, অফিসের সবাই আপনাকে মিষ্টি বা কেক খাওয়ালো। যখন এই ঘটনাটা ঘটেছিলো, তখন আপনার মনে, মায়ের কথা মনে পড়ছিলো, পায়েসের কথা মনে পড়ছিলো। মায়ের মুখখানা মনে পড়ছিলো। আপনার মনে তখন এক বিশেষ ধরনের অনুভূতি বা তরঙ্গ বা বৃত্তি উঠছিলো। কেন এমন হয় ?
আসলে, মায়ের পায়েস খাওয়ানো, আশীর্বাদ, ইত্যাদি যখন ঘটেছিলো তখন আপনার মনে এক ভালোলাগার অনুভূতি বা আপনার গ্রন্থি চক্রে এক তরঙ্গের সৃষ্টি করেছিল। এই তরঙ্গ উঠেছিল আপনার চেতন স্তরে বা উর্দ্ধতন মস্তিষ্কে। এর পরে আপনি অন্য কাজে চলে যান। তখন অন্য চিন্তা আপনার আগের তরঙ্গকে চেতন স্তর থেকে অবচেতন স্তরে বা নিম্নতর মস্তিষ্কে পাঠিয়ে দিয়েছে। এবং তখন সেটা স্মৃতিতে পরিণত হয়ে গেল। পরে কোনো কারণে পরবর্তী জন্মদিনে অর্থাৎ অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে স্মৃতির স্তর থেকে অর্থাৎ অবচেতন মনের স্তর থেকে চেতন মনের স্তরে উঠে এলো।
এই ধরনের অসংখ্য স্মৃতি বা সংস্কারে ভরা আমাদের মন। এই সংস্কারের দুটো দিক একটা ভাবগত, আর একটি বস্তুগত। পায়েসের স্মৃতি বস্তুগত। আর মায়ের সান্নিধ্য স্নেহ-আচরণ ভাবগত।
সংস্কার কি ভাবে কাজ করে ?
সংস্কার নিজে থেকে কোনো কাজ করতে পারে না। এর জন্য দরকার আমাদের ইচ্ছাশক্তি। ইচ্ছাশক্তি আবার কাজ করে, আমাদের ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। এই ভাবনার মধ্যে একটা বিশেষ রূপ হচ্ছে বাসনা। দেশের বাড়ি যাচ্ছি। স্টেশনে নেবে হাটছি, হঠাৎ দেখি মাধবমামার মিষ্টির দোকান। এক সময় এখানে মিষ্টি দই আর রসোগোল্লা মিশিয়ে খেতাম। সেই স্মৃতি ভেসে উঠলো মনে, মাধবমামার দোকান দেখে, এই মুহূর্তে আমার চেতন স্তরে মাধবমামার দোকান, সেখানে তরঙ্গ উঠতেই, আমার অবচেতন স্তর থেকে, পুরোনো দিনের সেই স্মৃতি ভেসে উঠলো। এই হলো সংস্কারের ক্রিয়া। এখন আমি কি করবো ? যদি আমার ইচ্ছা প্রবল ইচ্ছা হয়, তবে আমি মাধব মামার দোকানে ঢুকতে পারি। দই-মিষ্টি খেতে পারি। এই যে তীব্র ইচ্ছা একেই বলে বাসনা। এখন আমার ইচ্ছাশক্তি যে দিকে ঝুঁকবে, অর্থাৎ যদি বাসনার দিকে ঝোকে, তবে আমি মামার দোকানে ঢুকবো। এইসময় কোনো কোনো সময় ঢুকে পড়ে বিবেক, বিবেক বলতে থাকে, এখন মিষ্টি খাবার সময় নয়। এই বয়সে মিষ্টির প্রতি লোভ ভালো নয়। ...ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন আর আমি মিষ্টির দোকানে ঢুকবো না। তাহলে আমরা বুঝতে পারলাম, সংস্কার হচ্ছে পূর্ব্ব স্মৃতি। আর বাসনা হচ্ছে, একটা শক্তি, যা আমাদের কর্মে, বা লক্ষ্যপূরণে উদ্দীপ্ত করে। স্মৃতি অতীত অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত। আর বাসনা বর্তমান উদ্যোগের জননী, যা আমার ভবিষ্যৎ গড়ে দেবে। অর্থাৎ আমাকে সুখ বা দুঃখ ভোগ করাবে।
অভ্যাসের মাধ্যমে আমরা আমাদের সংস্কারকে বদলাতে পারি। যেমন খাওয়ার পরে, আমার একটু দুধ খাওয়া আমার অভ্যাস। এখন খাওয়ার পারে, যদি দুধ না পাই পেট ভরে গেলেও আমার মন খুঁত খুঁত করে। বা খাওয়ার পরে, একটা সিগারেট খাওয়া আমার অভ্যাস বা সংস্কার। সিগারেট না খেতে পারলে, কেমন যেন একটা নাই নাই ভাব। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে, অর্থাৎ , যেখানে আমি দুধ পাই না। বা আমি যখন পাহাড়ে যাই, সেখানে আমি দুধ পাই না, আবার আশ্রমে সিগারেট নিষিদ্ধ । সেখানে আমি মাসের পর মাস দুধ না পাবার জন্য, দুধ না খেয়েই থাকি। সিগারেটটাও বন্ধ থাকে। তাতে আমার কোনো অসুবিধা হয় না। কিন্তু আবার যখন বাড়িতে আসি, আমি আবার দুধের ভক্ত হয়ে যাই। সিগারেট খেতে শুরু করি। তাই অভ্যাস ও ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে, সংস্কার থেকে উদ্ভূত বাসনাকে যেমন বাড়ানো যায়, তেমন কমানো যায়। আশ্রমে বেশিরভাগ সময় শাস্ত্র আলোচনা, ধ্যানধারণা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। খাবার ব্যাপারটা তখন গৌণ। তা সে দুধ বলুন বা সিগারেট। তখন মনেই হয় না, যে এগুলো দরকার। আসলে তখন আমার স্নায়ু তরঙ্গে অধ্যাত্ম্যিকতার ঢেউ, বা বলা যেতে পারে, ভালো সংস্কার, খারাপ সংস্কারকে চেপে রেখেছে। আর যদি ক্রমাগত এই অভ্যাস রপ্ত করা যায়, তবে ভালো সংস্কারগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠে, আর খারাপ সংস্কারগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে।
ঠিক একই ভাবে আমরা বাসনাকেও দুর্বল করে দিতে পারি। বাসনার সঙ্গে সংস্কারের একটা সম্পর্ক আছে। বাসনা না জাগলে যেমন সংস্কার কোনো কাজ করতে পারে না, তেমনি আমাদের সংস্কার যতই ভালো বা খারাপ হোক না কেন, বাসনার গুনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা আমাদের শুভ সংস্কার গড়ে তুলতে পারি।
সংস্কার কি ভাবে গড়ে ওঠে ?
আমাদের প্রত্যেকটি কাজ, তা সে আমি নিজে থেকেই করি, বা অন্যের নির্দেশে করি, সবই আমাদের মনে একটা ছাপ ফেলে। অর্থাৎ ছোটবেলা থেকেই আমাদের সংস্কার তৈরির কাজ শুরু হয়ে যায়। একটি শিশুর মা-বাবা যখন তাকে শিক্ষা দীক্ষা দিয়ে বড় করে তোলেন, তখন তাকে ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, পারিবারিক রীতি নীতি, পারিবারিক ধর্মীয় বিশ্বাস, দেশাচার, দেশের নীতি বা আইন ইত্যাদি সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করে দেন। এর পরে, যখন সে স্কুল কলেজে পড়াশুনা করতে গেল, সেখানেও সে কিছু জ্ঞান ও আদবকায়দা শিখলো। এগুলো তার মনে গভীর ছাপ তৈরী করে দিলো। এছাড়াও, তার নিজের বিচারবুদ্ধি, রুচি-অরুচি, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আশা-আকাঙ্খা এসবই তার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। এই ভাবেই একটা মানুষের ব্যক্তিত্ত্ব গড়ে ওঠে। একজন ব্যক্তি মানুষের দুটি সত্ত্বা। একটা তার বিশ্বাস আর একটা তার অভ্যাস। আর এ দুটো জিনিসই তার কর্ম্মকে প্রভাবিত করে। তার খাদ্যাভ্যাস, তার ধর্মীয় বিশ্বাস, তার রাজনৈতিক বিশ্বাস বা মত, দেশাত্ত্ববোধ ইত্যাদির অধিকারী হয়ে, সে পরিণত হয় এক স্বতন্ত্র মানুষে। আবার বিশেষ পেশায় যখন সে আসে, সেই পেশাও তাকে তার ব্যক্তিত্ত্ব গড়ে তুলতে প্রভাবিত করে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে যেমন সংস্কার-আবদ্ধ মানুষে পরিণত হয়ে যায় তেমনি, সে একটা নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ হয়ে দাঁড়ায় । তখন, যা কিছু তার গোচরে আসে, তাকে সে তার পূর্ব্ব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বিচার করতে চায়। একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সে সব কিছুর বিচার করে। এইটাই বদ্ধ জীবের লক্ষণ। সব ঘটনাকে, সব মানুষকে সে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করতে আরম্ভ করে। এখন সে আর শিশুদের মতো প্রশ্ন করে না, জানতে চায় না, ঘটনার বিচার করতে শুরু করে দেয়। আসলে সে এখন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চায়। জীবন সম্পর্কে সে তখন একটা নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি বেছে নিয়েছে। কোনটা প্রয়োজনীয়, আর কোনটা অপ্রোজনীয়, সেটা সে তার নিজের মতো করে বুঝে নিয়েছে। এইভাবে সে তার অভ্যাস ও বিশ্বাসের আবর্তে বাধা পরে যায়। মন তখন তার অভ্যাস আর বিশ্বাসে ভরে গেছে। নতুন কিছু আর তাকে আকর্ষণ করে না। নতুন চিন্তা বা উদার চিন্তা উদার দৃষ্টিভঙ্গি তাকে আর আকর্ষণ করে না। এখন সে নিজেকে আমি বলে ভাবতে শুরু করেছে। এইযে আমি বা অহং, এগুলো সংস্কারের প্রভাব। আমি এবং আমার সংস্কার তখন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তাই আমরা যাকে "আমি" বলি সেগুলো হচ্ছে আমাদের সংস্কার, আমাদের অভ্যাস, আমাদের বিশ্বাস, ইত্যাদির একটা মিশ্রণ মাত্র। আমরা যে চেতন সত্ত্বা তা আমরা একদম ভুলেই গেছি।
এখন আমরা আলোচনা করবো, সংস্কার কি ভাবে আমাদের এক জন্ম থেকে আর এক জন্মে প্রবাহিত হয়। সেখানে তো আমাদের নতুন দেহ তৈরি হয়। নতুন মা-বাবা পাই। নতুন পরিবেশ পাই। তাহলে গত জন্মের সংস্কার আমাদের কি ভাবে প্রভাবিত করে ?
এটা বুঝতে গেলে আমাদের এই পঞ্চভূতের দেহের বিনাশের পরে, কি হয় সেটা একটু সংক্ষেপে বুঝে নিতে হবে । আমাদের তিনটি দেহ। স্থুল, সূক্ষ্ম, ও কারন। স্থূল দেহ পঞ্চভূতের তৈরি। আমাদের দেহের মৃত্যুর পরে, এই দেহ, পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়। বাকি থাকে সূক্ষ্ম দেহ ও কারন দেহ। সুক্ষ দেহ অর্থাৎ মানস দেহও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিলোপ প্রাপ্ত হয়। বাকি থাকে কারন দেহ। এই কারন দেহের বিলোপ হয় না। এই কারন দেহই সংস্কারের মূল আধার। অর্থাৎ আমাদের কর্ম্ম অভিজ্ঞতা স্থূল দেহ থেকে সূক্ষ্ম দেহে এবং সূক্ষ্ম দেহ থেকে কারন দেহে স্থানান্তরিত হয়। বার বার জীবের জন্ম গ্রহণের ফলে, জীবের যত অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছিল, পুনর্জন্মের সময় এই কারন দেহ তা সঙ্গে করে নিয়ে আসে। মানসলোকে এসে জীব নতুন মানসদেহ ধারণ করে। সুতরাং আগের মানসদেহে যেসব অভিজ্ঞতা বা সংস্কার সঞ্চিত ছিল নতুন মানসদেহে সে সব কিছুই থাকে না। অর্থাৎ নতুন মানস দেহে পূর্ব্ব স্মৃতি কিছুই থাকে না। এই মানসদেহ সম্পূর্ণ নতুন উপকরণে তৈরি। কিন্তু কারন দেহ চিরস্থায়ী। সেখানে সকল স্মৃতি সঞ্চিত থাকে। জীব যখন নতুন দেহ ধারণ করে,তখন সেই একই কারন দেহ বর্তমান থাকলেও মানস দেহ ও স্থূলদেহ নতুন হওয়ায় এবং জীবের জ্ঞান স্থুলে নিবদ্ধ হওয়ায়, অতি সূক্ষ্ম কারনদেহের স্পন্দন তার মস্তিষ্কে কোনো ক্রিয়া উৎপন্ন করতে পারে না। সেজন্য তার মনে কোনো পুরোনো স্মৃতি উদয় হতে পারে না।
কিন্তু যে সব সংস্কার আমরা আমাদের কারন দেহের সঙ্গে করে এই জগতে নিয়ে এসেছি, সেগুলো আমাদের অজ্ঞাতসারে অনুভব করে থাকি। অনেক সময়, আমাদের পূর্বজন্মের বাঞ্ছিত বস্তুর কথা আমাদের স্মরণে আসে। আবার বিশেষ গুনের স্বল্প স্বাধ্যায়ে সংস্কারের সাহায্যে সেই গুনের উন্মোচন ঘটে অত্যধিক মাত্রায়। এগুলো সবই আগের জীবনের কর্ম-অভিজ্ঞতার জন্যই হয়ে থাকে। ধ্যান সাধনার সাহায্যে যে সব মহাত্মা, এই সুক্ষ ও কারন দেহের উপস্থিতি অনুভব করেন, তারা তাদের পূর্ব জীবনের কথা জানতে ও বলতে পারেন। যেমন জানতেন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, ভগবান বুদ্ধ ইত্যাদি মহাপুরুষেরা।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ - হরি ওম
No comments:
Post a Comment