গীতায় দেবকীনন্দন শ্রীকৃষ্ণ তিন/চারটি ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। গীতার প্রারম্ভে তিনি অর্জুনের সখা। তারপরে গুরু, তারপরে স্বয়ং ভগবান। প্রথম ও শেষ অবধি তিনি ছিলেন, সারথি। মহামুনি ব্যাসদেব অর্জুনের মুখ দিয়ে নানান সন্দেহ, প্রশ্ন, ছুড়ে দিয়েছেন, শ্রীকৃষ্ণের কাছে। যে সব প্রশ্ন আমাদের সবার, এবং সর্বকালের। এইরকম একটি অসাধারন প্রশ্ন করছেন অর্জুন । বলছেন :
যে ভক্ত তোমাতে সততযুক্ত হয়ে তোমার (রূপের) উপাসনা করে, আর যারা তোমার অব্যক্ত অক্ষর রূপের সাধনা করে, তাদের মধ্যে শ্রেষ্ট যোগবিদ কে ? অর্থাৎ সাকারের উপাসনা ভালো না নিরাকারের উপাসনা ভালো ? আর এই প্রশ্নটি করেছেন তখন, যখন অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণ বিশ্বরূপ দেখানো হয়ে গেছে।
ভগবান তার উত্তরে বলছেন :
যারা আমাতে মন নিবিষ্ট করে, আমাতে নীতিযুক্ত হয়ে আমার উপাসনা করে, আমার মতে তারাই শ্রেষ্ট। অর্থাৎ সাকারের উপাসনা ভালো। এবং সেটা একমাত্র আমার, অর্থাৎ পরম-পিতার পরম-ঈশ্বরের।
শ্রীকৃষ্ণ গীতার প্রারম্ভে বলেছেন ঈশ্বর অব্যক্ত। এই অব্যক্ত ঈশ্বরের কথা পুরাতন ব্রহ্মবিদগণও, বলে গেছেন। বেশিরভাগ বিশ্ববাসী বলেন, ঈশ্বর নিরাকার, নিরালম্ব, নির্বিকার, অব্যক্ত । তো যারা অব্যক্ত পরম-ঈশ্বরের সাধনা করছে, তাদের থেকে মনুষ্যরূপী শ্রীকৃষ্ণের সাধনা করা, কি করে শ্রেষ্ট হয়। এবং আমরা এও দেখতে পাই, সারা ভারতবর্ষে, এমনকি ভারতবর্ষের বাইরেও মূর্তিপূজার প্রচলন আছে।
আমরা আজ এই প্রশ্ন-উত্তরের আলোচনায় যাবো।
আমরা আজ এই প্রশ্ন-উত্তরের আলোচনায় যাবো।
ভগবান যে জবাব দিয়েছেন - অর্থাৎ যারা আমাতে মন নিবিষ্ট করে, আমাতে নীতিযুক্ত হয়ে আমার উপাসনা করে, আমার মতে তারাই শ্রেষ্ট।
এই কথাটার দুটো অর্থ হতে পারে। প্রথমতঃ - পরম-ঈশ্বর নিরাকার। মানুষ ভগবানেরই অংশ বিশেষ। মানুষই ভগবানের শ্রেষ্ট সৃষ্টি। তো মানুষ যদি মানুষের প্রতি মনোনিবেশ করে, তার সেবা যত্ন করে , মানুষের উন্নতির জন্য চেষ্টা করে তবে সত্যিকারের ঈশ্বরের আরাধনা করাই হবে। আর একটা কথা হচ্ছে, আমাতে মন নিবিষ্ট করো। অর্থাৎ যে কেউ যদি নিজের মধ্যে অর্থাৎ স্বয়ং-দিকে আত্ম জ্ঞান লাভের চেষ্টা করে, তবে সে জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পাবে।
অন্য একটা দিক হচ্ছে
অন্য একটা দিক হচ্ছে
আমরা জানি সাধন পদ্ধতি দুই প্রকার - দ্বৈতবাদ আর অদ্বৈতবাদ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই দ্বৈতবাদের আবিস্কারক। শ্রীকৃষ্ণ একদিকে বলছেন ঈশ্বর অব্যক্ত, আবার বলছেন : যারা আমাতে মন নিবিষ্ট করে,আমাতে নিত্যযুক্ত হয়ে ঐকান্তিক ভক্তি সহকারে আমার উপাসনা করে, তারাই শ্রেষ্ট। এখন কেন শ্রেষ্ট ? প্রশ্ন এখানেই। একজন জ্ঞানী, যিনি নিরাকার ব্রহ্মের সাধনা করেন, আর এক জন ভক্ত যিনি আকারের সাধনা করেন, এর মধ্যে শ্রেষ্ট কে ?
অষ্টাবক্র তার সংহিতায় ব্রহ্মজ্ঞানী সম্পর্কে এক জায়গায় বলছেন :
নির্বাসন নিরালম্বঃ স্বচ্ছন্দো মুক্তবন্ধনঃ।
ক্ষিপ্তঃ সংস্কারবাতেন চেষ্টতে শুস্কপর্নবৎ।।
অর্থাৎ বাসনারহীত, কর্তব্যবুদ্ধিবিহীন, রাগদ্বেষের অনধীন বন্ধনহেতু অজ্ঞানশূন্য জ্ঞানী প্রারবদ্ধকর্মরুপ বায়ুদ্বারা প্রেরিত হয়ে পবন-সঞ্চালিত শুস্কপত্রের ন্যায় কর্ম প্রচেষ্টা করে থাকেন।
তাহলে ভাবুন তো এই ব্রহ্মজ্ঞানী কেমন আছেন। ব্রহ্মবিদ তো জড়বৎ। তার না আছে দুঃখ না আছে আনন্দ। না আছে কর্তব্যকর্ম। না আছে দ্বেষ, না আছে রাগ, না আছে মমতা, না আছে স্নেহ। উনি কাঁদেন না, হাসেন না। অথবা ওনার হাঁসা-কাঁদার সাধারণ মানুষ কি বোঝে ? ওনার থাকা না থাকা সমান। উনি স্ব -স্বরূপে স্থিত।
তাহলে ব্রহ্মজ্ঞানী হতে সময় লাগে, আর তার পরে যা হয় তা আর কোনো কম্মে লাগে না। তাহলে অদ্বৈতপথে এই ব্রহ্মজ্ঞানী হয়ে কি লাভ ? যার দেহ জ্ঞান থাকে না।
এবার আমরা সাকার সাধনা আর নিরাকার সাধনার পার্থক্যটা একবার আমরা বুঝে নেই।
ঈশ্বর নিরাকার, নির্গুণ, অব্যক্ত, অব্যয়, সর্বত্র।
ঈশ্বরকে কি দেখা যায় ? কিভাবে দেখা যায় ? ঈশ্বর কি আকার নেয় ?
ঈশ্বরকে অবশ্যিই দেখা যায়। কিভাবে ঈশ্বরকে দেখা যায় না, সেটা আগে ভাবুন। তবেই ঈশ্বরকে দেখতে পারবেন। ঈশ্বরকে না দেখার কোনো উপায় নেই। বরং ঈশ্বরকে দেখতে না পারাটাই আশ্চর্য্য। ঈশ্বর অবশ্যই আকার নেন। আপনি যেমন তাকে দেখতে চান, তেমন ভাবেই তিনি আপনাকে দেখা দেবেন। আপনি দেখছেন কিনতু সনাক্ত করতে পারছেন না। তাই ভাবছেন আমি দেখতে পারছি না। আসলে ঈশ্বর আপনি, আপনার ভিতর, বাহির, সর্বত্র যা কিছু দেখছেন সবই ঈশ্বর। তবে আমি দেখছি না, এটা কত বড়ো ভুল, বুঝতে পারছেন ? ঈশ্বর-সমুদ্রের মধ্যে বুদ্-বুদ্ আমরা । এখানেই জন্ম, এখানেই লয়। মানুষের শরীরের মধ্যে যেমন অসংখ্য কোষ, আমরাও তেমনি ঈশ্বরের বিরাট শরীরের কোষ মাত্র। ঈশ্বরের শরীরেই জন্ম, ঈশ্বরের শরীরেই মৃত্যু। যতদিন বাঁচি, ঈশ্বর থেকেই খাদ্য সংগ্রহ করি, বা ঈশ্বরই খাদ্য যোগায়। এক সময় ঈশ্বরেই লয় প্রাপ্ত হই, আমরা সবাই । আমি বা অহং বলে কিছু নেই। এগুলো আসলে মন-বুদ্ধির খেলা। মন বুদ্ধির ওপারে আমি বলে কিছু থাকে না।
নিরাকারই সাকার হয়। আবার সাকার থেকে নিরাকার। জলের তিন রকম অবস্থা। বায়বীয়, তরল, কঠিন। তাপমাত্রার তারতম্যে এই প্রকারভেদ। বায়বীয় জল সর্বত্র। তরল জল নদী, নালা, পুকুরে যেমন পাওয়া যায়, তেমনি পৃথিবীর মধ্যেও পাওয়া যায়। কঠিন জল আমরা বরফের আকারে দেখতে পাই। বায়বীয় জল আমাদের ভোগ্য বস্তু নয়। কঠিন জলের আইচক্রীম খাই, তরল জলে তৃষ্ণা মেটাই। বায়বীয় জলে আমাদের তৃষ্ণা মেটায় না। বাহ্যিক কোনো কাজ বায়বীয় জলে আমাদের হয় না। অর্থাৎ নিরাকারে আমরা আনন্দ পাই না। কোনো কাজে লাগে না। তৃষ্ণা পেলে, হা করে থাকলে বায়বীয় জল, আপনার তৃষ্ণা মেটাবে না ? তাহলে বায়বীয় জল সত্য কিনতু আনন্দ দেয় না। তাই ঈশ্বর সাধনায় যদি আনন্দ পেতে চান তবে সাকারের সাধনা করুন।
নিরাকারের শক্তি সাকারের মধ্যেই প্রকাশ পায়। আকাশের একটা গুন্ - শব্দ, বাতাসের দুটো গুন্ - শব্দ, স্পর্শ। আগুনের তিনটি গুন্ শব্দ, স্পর্শ, রূপ। জলের চারটি গুন্ -শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস। মাটির পাঁচটা গুন্ - শব্দ, স্পর্শ, রূপ,রস, গন্ধ। তাহলে দেখতে পাচ্ছেন, নিরাকার থেকে সাকারের দিকে যত যাচ্ছে তত তার গুন্ বেড়ে যাচ্ছে। এবং আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো এই গুন্ গুলো থেকেই জ্ঞান সংগ্রহ করছে। কান দিয়ে আমরা শব্দ শুনছি। চোখ দিয়ে আমরা রূপ দেখছি। নাক দিয়ে আমরা গন্ধ শুঁকছি। মুখ দিয়ে আমরা রসের আস্বাদন করছি। ত্বক দিয়ে আমরা স্পর্শ করছি। এ সবই আমাদের সুখ ও দুঃখের আস্বাদন করাচ্ছে। এ থেকেই আমরা সুখ দুঃখের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছি আমাদের অজ্ঞাতসারে। দৈহিক সুখ দুঃখের কারন এই ইন্দ্রিয়গুলো।
আপনি আগুন চান। আগুন পেতে গেলে আপনাকে একটা মাধ্যম করতে হবে। আগুন সবত্র আছে। কিনতু কাঠি/কাঠ চাই। আর চাই বারুদ। এই বারুদ দেন সৎ-গুরুদেব। মাধ্যম ছাড়া আগুনের প্রকাশ হয় না। তেমনি ঈশ্বরের প্রকাশ যদি দেখতে চান তবে মাধ্যমকে আশ্রয় করুন। আর নিজেকে তৈরি করুন। অপেক্ষা করুন আকুলতা নিয়ে।
আপনার আগে পিছনে সর্বত্র, গান ভেসে বেড়াচ্ছে। নাচের ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে। আপনি দেখতে পাচ্ছেন না। কিনতু আপনার যদি এক্সপোজার অর্থাৎ টিভি থাকে তাতে যদি ইলেকট্রিসিটি থাকে, সুইচটা অন করে দিন আপনি সব দেখতে পাবেন। এক্সপোজারের, অর্থাৎ টি.ভি.র মধ্যে কিনতু কিছু নেই। ওটা ভেঙে ফেললেও ভিতরে ছবি পাবেন না. গান পাবেন না। গান আছে সর্বত্র,ছবি আছে সর্বত্র। আপনার এন্টেনা ঠিক করুন, নিজেকে যোগ্য করুন, ব্যাকুল হন, নিরন্তর তৎগতপ্রাণ হন , তবেই তাকে দেখতে পারবেন এই টি.ভি.র মধ্যে ।
আপনি ফল খেতে চান ? ফলের স্বাদ আপনি কান্ডে পাবেন না। বীজ তো বিস্বাদ। ভক্তিবাদীরা ফল খায়। নিরাকারবাদীরা মাটির মধ্যে উৎস খোঁজে, মাটির মধ্যে স্বাদ খোঁজে। আপনি কোনটা চান ?
একটা ঘটনা বলি। শিরডির সাঁইবাবা - নাম শুনেছেন নিশ্চই। তো তাকে এক ভদ্রলোক দুপুরে খাবার জন্য নিমন্ত্রণ করেছেন। খাবারের সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ। ভদ্রলোক অপেক্ষা করছেন। এই বুঝি বাবা আসে। বাবা আর আসছেন না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। বাবা আর আসেন না। সন্ধ্যে হয়ে গেল। বাবা আর আসেন না। একটা কুকুর ঘুর ঘুর করছে। ভদ্রলোক খাবার রেখে উঠতে পারছেন না। কুকুরটাকে যতই তাড়ানো হচ্ছে, কুকুরটা একটু দূরে গিয়ে অপেক্ষা করছে। ভদ্রলোক, লোক পাঠালেন, বাবার কাছে। বাবা বললেন - আমিতো গেছিলাম রে। কিন্তু তোর মনিব তো লাঠি দিয়ে তারা করলো। লোকটি বললো - সে কি বাবা কখন গেছিলেন ? আমার বাবু তো সারাক্ষন আপনার অপেক্ষায় বসে আছেন। বাবা বললেন - তোর বাবুতো লাঠি নিয়ে বসে আছে। আমি যাই কি করে ? খাই-ই বা কি করে ?
ভগবানকে না চিনলে এই হয় দশা। ভগবান এসে বসে থাকেন । আর আমরা লাঠি নিয়ে বসে থাকি। ভগবান আসতে চান , আমরা তাকে তাড়াতে চাই। যারা জীবের মধ্যে ঈশ্বর দেখতে পান না, তারা ঈশ্বরকে চেনেন না।
অতএব শ্রীকৃষ্ণ বলছেন : আমার মতে তারাই শ্রেষ্ট যারা ভক্তি সহকারে আমার রূপের অর্থাৎ সমগ্র জীব জগতের উপাসনা করে। ভক্তিবাদেই আনন্দ, জ্ঞানী নিরস।
ধ্যানে সাধকেরা তার ইষ্ট বা গুরুদেবের প্রতিচ্ছবি কল্পনা করে ধ্যান করেন। তখন গুরুদেবকে বা তার ইষ্টকে জ্যান্ত বলে মনে হয়। তখন সেই ইষ্টদেবতার সঙ্গে বা গুরুদেবের সঙ্গে কথা বলা যায়। এবং সাধকরা কথা বলেন । সেই প্রতিচ্ছবিও কথা বলে। আপনারা নিশ্চয় শুনেছেন আমাদের আজ্ঞা চক্র বা তৃতীয় নয়ন বলে একটা কথা আছে। এটি একটি শক্তিশালী বার্তা প্রেরণ কেন্ত্র।এই বার্তা প্রেরণ কেন্দ্রে নিজের মনকে স্থির করে আপনি যদি কাউকে আদেশ বা নির্দেশ দেন, তবে সে তা পালন করতে বাধ্য হবে। এটি একটি অসাধারন গতিশীল শক্তি। কোনো ব্যক্তির ছবি, বা প্রতিমাকে মনের মধ্যে রেখে, তার ক্ষুদ্র প্রতিমাকে ধ্যানে নিয়ে আজ্ঞা চক্র থেকে যদি মাটির মূর্তির উপরে, বা ছবির উপরে নিবিষ্ট করা যায় তবে সেই মাটির মূর্তি আর সাধারণ থাকে না। সেটা আপনার আজ্ঞা দ্বারা সঞ্চারিত চলমান শক্তিতে পরিণত হয়ে যায়। তখন আপনি যা স্নরন করবেন, সেটা গতিশীল হয়ে যাবে। মূর্তিপূজা এই প্রক্রিয়ার গভীর প্রয়োগ । ঈশ্বর তো বিরাট। আর এই সর্বত্র বিরাজমান বিরাটের কাছে পৌঁছেতে আমরা মূর্তির মাধ্যমে যেতে পারি। একটা কথা আছে, যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তাই আছে এই ভান্ডে অর্থাৎ মানব শরীরে। । আপনার মস্তিস্ক আর পরমাত্মার মস্তিষ্কের সঙ্গে একটা সম্পর্ক আছে। এই দুই সন্মন্ধকে যুক্ত করার জন্য একটা সেতু চাই। এই সেতু নির্মিত হতে পারে মূর্তি দিয়ে। কেননা আপনি নিরাকার কিছুর সঙ্গে সোজাসুজি সম্পর্ক স্থাপিত করতে পারবেন না। আপনি আকারে বর্তমান। নিরাকার সম্পর্কে তো আপনার কিছু জানা নেই। তাই যে যাই বলুক না কেন পরমাত্মা নিরাকার, অপ্রকাশিত। সেটা শুধু শুধু কথার কথা হয়ে যাবে আপনার কাছে। আপনার অনুভবের মধ্যে কিন্তু আসবে না। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে যত অনুভব আছে, সেগুলোর সবই আকৃতির অনুভব। রূপের অনুভব। আমাদের কারুর মধ্যে নিরাকারের একটাও অনুভব নেই। কারুর কথা ভাবা মানে তার রূপের কথা ভাবা । অবয়বের কথা ভাবা । তার সূক্ষ্ম গুনের কথাতেও আমরা তার রূপ কল্পনা করি। আর যার সন্মন্ধে কোনো ধারণা নেই তার সম্পর্কে কোনো শব্দ আপনাকে তার স্মরণ করাতে পারবে না। তাই আপনি নিরাকারের কথা বলতে থাকবেন আর সাকারের মধ্যে বাস করবেন। যদি সত্যি সত্যি আপনি নিরাকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে চান তবে আপনাকে এমন একটি মূর্তি নির্মাণ করতে হবে যার একদিকে সাকার আর এক দিকে নিরাকার। একটু ভাবুন, আমরা যেখানে রয়েছি, সেখানে তার সীমা প্রকাশিত। আর অন্যদিকে পরমাত্মা যেখানে আছেন সেটা সীমাহীন অপ্রকাশিত। তাই মূর্তিকে দুটো কাজ করতে হবে আমরা যেখানে সেখানে সে প্রকাশিত হবে, আর পরমাত্মা যেখানে আছেন সেখানে নিরাকারের মধ্যে হারিয়ে যাবেন।
একটা কথা শুনুন যে ব্যক্তি পূজা করে, সে ওই মাটির মূর্তিকে পূজা করে না। সে ওই ছবিকে পূজা করে না। সে পূজা করে ওই ছবির মধ্যে তার পিতাকে, মাতাকে, গুরুকে, দেবতাকে, ইষ্টকে, পরমাত্মাকে। মূর্তির কখনো পূজা হয় না। মূর্তির মধ্যে আমি যাকে দেখতে চাই তার পূজা করা হয়। আর যার কাছে মূর্তি দৃশ্যমান, সে কখনো পূজা শেখেনি, সে পূজা করে না। তার পূজা সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। পূজা আর মূর্তি দুটো আলাদা কথা।মূর্তি মাধ্যম মাত্র। পূজা মূর্তির হয় না, পূজা হয় ভাবনার। যে পূজা করে, সে কখনো মূর্তি দেখতে পায় না।আর যে মূর্তি দেখতে পায়, সে কখনো পূজা করে না। পূজা মূর্তিকে মুছে ফেলার কৌশল। আমরা তো আকৃতি সম্পন্ন, সেই আকৃতিকে মুছে ফেলার কৌশলই পূজা। দেহাতীত হয়ে যাওয়াই পূজা। পূজায় দৃশ্যমান আকৃতি, আকৃতিবিহীন হয়ে যায়। তবেই পূজা সম্পন্ন হয়। প্রকাশিত অংশে পূজা আরম্ভ হয়, অপ্রকাশিতে পূজা সম্পন্ন হয়। পূজা সাধককে গ্রাস করে নেয়। যারা পূজা করেনি তারা ভাবেন পাথর রেখে কি হবে ? আর যারা পূজা করেছেন তাদের পাথর হারিয়ে যায়, সীমা হারিয়ে যায়, অসীমে প্রবেশ করেন আর তখন পরমাত্মা প্রকট হয়ে যান ।
ভগবান শ্রীচৈতন্য যখন দুহাত তুলে কৃষ্ণনাম করেন , মিরাদেবী যখন পূজার ছলে নাচ করেন , মতুয়ারা যখন হরিবোল হরিবোল করেন, বাউলরা যখন নেচে নেচে গানের মধ্যে ডুবে যান, তখন তারা নিজেরা পূজার মধ্যে বিলীন হয়ে যান । এদের জন্য সেখানে কোনো মূর্তির অস্তিত্ব থাকে না। পূজা শুরু হলে মূর্তি বিলীন হয়ে যায়। মূর্তি তো প্রারম্ভ মাত্র। আমরা যারা পূজার কিছু বুঝি না, তারা মূর্তি দেখতে পাই। তাই আমার মনে হয় - সত্যিকারের পূজা শুরু হলে মূর্তি অন্তর্হিত হবে।
মূর্তি তো পরমাত্মাকে দেখবার জানলা মাত্র। আমি দেহের মধ্যে থেকে পরমাত্মাকে দেখতে চাই। আমার তো দেহ আছে। অর্থাৎ আমি আকৃতি সম্পন্ন। তো জালনাও তো আকৃতি সম্পন্ন হবে , কিন্তু জানলা খুলে যখন আকাশের দিকে তাকাবো তখন নিরাকারের মধ্যে প্রবেশ করবো। এই দেহের মধ্যে জানলা আছে, সেটাকে খুলতে হবে। আকাশকে দেখতে হবে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে জানলা ছোট্ট। কিন্তু আকাশ তো বড়ো। কিন্তু ছোট্ট জানলা দিয়েইতো বড়ো আকাশকে দেখা যায়। এটা বোঝানো কঠিন কিন্তু সত্যি। যে জানলা কখনো খোলেনি, যুক্তি দিয়ে তাকে বোঝানো কঠিন হবে যে বৃহৎ আকাশকে, আয়তনে ছোট্ট জানলা দিয়েও দেখা যায়। মূর্তি পূজা এই জানলা খোলার প্রক্রিয়া। আপনি মন্দিরের কাছে যেতে পারেন। মূর্তির কাছে যেতে পারেন। কিন্তু পূজার কাছে যেতে পারেন না। কতকগুলো বিষয় আছে যার অভিব্যক্তি সম্ভব নয়। এগুলো অন্তরের ব্যাপার। আন্তরিক বস্তু প্রদর্শন সম্ভব নয়।
সাকার নিরাকার দুটি পৃথক নয়। একটি অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। যাকে আমরা সাকার বলি সেটা নিরাকারের অংশ। আবার যাকে আমরা নিরাকার বলি সেটিও সাকারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আমরা সাকারে আছি। আমার দেহ সাকার। আমরা সম্পর্ক গড়ি সাকারের সঙ্গে। এই সত্য তো অস্বীকার করলে চলবে না যে আমরা সাকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। আর আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি আমাদের সেখান থেকেই যাত্রা শুরু করতে হবে। যেখানে আমাদের যাওয়া উচিত, সেখান থেকে যাত্রা শুরু করা যায় না। যেখানে আছি সেখান থেকেই যাত্রা শুরু করতে হয়। যেখানে আমরা নেই সেখান থেকে যাত্রা শুরু করা যায় না। আমরা যা কিছু জেনেছি আকারের মধ্যেই জেনেছি। আমরা প্রেম করেছি - আকারে। আমরা রাগ করেছি আকারে। আমরা ঘৃণা করেছি আকারে। আসক্ত হয়েছি তাও আকারে। বন্ধুত্ব করেছি আকারে। শত্রূতা করেছি তাও আকারে। ঈশ্বরের নিরাকারত্ব যেমন সত্য। আমাদের আকারত্ব তেমনি সত্য। আমাদের মন যখন কিছু ধরে রাখে সেটা আকারেই ধরে রাখে।
তাই শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ বা কথা যখন আমরা স্মরণ করি, তার গুনের কথা যখন আমরা স্মরণ করি, তখন তার আকারের কথাই আমাদের চোখে ভাসে। আর এই জন্য নিরাকারের দিকে যদি যাত্রার জন্য আমাদের বেরোতে হয়, তবে আমাদের নিরাকারের জন্য আকার সৃষ্টি করতে হবে।এই আকারটা যদি শ্রীকৃষ্ণের হয়, গুরুদেবের হয় বা অন্য্ কারুর হয়, যা আমাদের কাছে দৃষ্টিনন্দন, তবে আমাদের সাধনপথ সহজ হবে।
তাই সাধারণের জন্য, নিরাকারের চেয়ে আকারের সাধনা সহজ ও সঠিক।
তাই সাধারণের জন্য, নিরাকারের চেয়ে আকারের সাধনা সহজ ও সঠিক।
No comments:
Post a Comment