পণ্ডিত উইলিয়ম হেস্টি সাহেব ইংরেজী পড়াচ্ছেন। কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর "একস্কার্শন" । কিভাবে প্রকৃতির সৌন্দর্য্য অনুধাবন করতে করতে কবির মন অতীন্দ্রিয় রাজ্যে চলে যায়। ছাত্ররা এই অতীন্দ্রিয় রাজ্যটা যে কি তা ধরতে পারছেন না। আর সেখানে কি বা কিভাবে অনুভূত হয়, সেটাও বুঝতে পারছিলো না। সাহেব মাস্টার, রেগে গেলেন, ছাত্ররা বুঝতে পারছে না দেখে। বোঝাবার জন্য বললেন, আমি এই কলকাতায় এমন একজনকে দেখেছি, যিনি এই অনুভূতি সম্পন্ন। তিনি দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণ পরমহংস। নরেন, সেই ক্লাসের ছাত্র, সেও কথাগুলো শুনছিলো। তারপর ভুলেও গেছিলো।
একদিন ১৮৮১ সালের নভেম্বর মাসে, সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়ি থেকে ডাক এলো, একটা ছোট্ট অনুষ্ঠানে গান করবার জন্য। আসলে সেখানে যার গান গাইতে আসার কথা ছিল, সে আসেনি। তাই নরেনের ডাক পড়েছে। নরেনের গলা ভালো। গায়ও ভালো। ও মাঝে মাঝে ব্রাহ্ম সমাজে গান গায়। তো নরেন সেখানে একটা ভজন গাইলো। সেখানে হাজির ছিলেন, দক্ষিণেশ্বরের শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ। নরেনের গানের তন্ময়তা, আবেগ, শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণকে আকৃষ্ট করলো। নরেন, হেস্টি সাহেবের দেখা শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসকে দেখলো। এই প্রথম দেখা।
দক্ষিণেশ্বরে প্রথম দিন :
এর পর ১৮৮১ পৌষ মাস, অর্থাৎ ডিসেম্বর-এর শেষ, নরেনের বয়স তখন সবে ১৮ । ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথায় (ভাষা লেখক স্বামী সারদানন্দ কর্তৃক মার্জিত) শুনুন, " পশ্চিমের (গঙ্গার দিক) দরজা দিয়ে নরেন্দ্র প্রথম দিন এই ঘরে, ঢুকেছিলো। দেখলাম নিজের শরীরের দিকে লক্ষ্য নেই, মাথার চুল ও শরীরের বেশভূষার পারিপাট্য নেই। বাইরের কোনো পদার্থেই ইতর - সাধারণের মতো একটা আঁট নাই। সবই যেন তার আলগা, এবং চোখ দেখে মনে হলো, তার মনের অনেকটা ভেতরের দিকে কে যেন সর্বদা টেনে রেখেছে। দেখে মনে হল, বিষয়ী লোকের আবাস এই কলকাতা, এখানে এতবড় সত্ত্বগুণী আধার থাকাও সম্ভব ?গান গাইবার কথা জিজ্ঞেস করে জানলাম, বাংলা গান সে দুচারটি মাত্র শিখেছে, তাকে গাইতে বললাম।
এর পরে, নরেন কি বলছেন শুনুন, - গান তো গাইলাম, তারপরেই ঠাকুর উঠে আমার হাত ধরে, তার ঘরের উত্তরে যে বারান্দা আছে, সেখানে নিয়ে গেলেন। শীতকাল, উত্তরের হাওয়া নিবারণের জন্য, বারান্দাটি ঝাঁপ দিয়ে ঘেরা ছিলো, সুতরাং ভিতরে ঢুকে ঘরের দরজাটি বন্ধ করে দিলে, ঘরের ভিতরের বা বাইরের কোনো লোককে দেখতে পাওয়া যেত না। বারান্দায় ঢুকে, ঠাকুর দরজাটা বন্ধ করে দিলেন, ভাবলাম, আমাকে বুঝি নির্জনে কিছু উপদেশ দেবেন। কিন্তু যা বললেন, ও করলেন, তা আমার কল্পনার অতীত। সহসা আমার হাত ধরে, দরদরিতধারে, আনন্দ অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন। এবং পূর্ব পরিচিতের ন্যায় পরম স্নেহে বললেন : এতদিন পরে আসতে হয় ? আমি তোমার জন্য কিভাবে প্রতীক্ষায় রয়েছি, তা একবার ভাবতে নেই ? বিষয়ী লোকের বাজে প্রসঙ্গ শুনতে শুনতে আমার কান ঝলসে যাবার উপক্রম হয়েছে। প্রাণের কথা কাউকে না বলতে পেরে, আমার পেট ফুলে রয়েছে - ইত্যাদি অনেক কথা বললেন, ও কাঁদতে লাগলেন। এর পরেই, আবার আমার সামনে করজোড়ে দাঁড়িয়ে, দেবতার মতো আমাকে সম্মোধন করে বলতে লাগলেন, জানি আমি প্রভু, তুমি সেই সনাতন ঋষি নবরূপী নারায়ণ, জীবের দুর্গতি নিবারণ করতে, পুনরায় শরীর ধারণ করেছো। .......ইত্যাদি ইত্যাদি। .
স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, আমিতো তার এই আচরণে একেবারে নির্বাক-স্তম্ভিত। মনে মনে ভাবতে লাগলাম এ কাকে দেখতে এসেছি ? এতো একেবারে উন্মাদ। নাহলে বিশ্বনাথ দত্তের পুত্র আমি, আমাকে এই সব কথা বলে ?...... যাইহোক, খানিক্ষন পরে, ঘর থেকে বেরিয়ে মাখন, মিছরি ও কয়েকটা সন্দেশ এনে, আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে লাগলেন। আমি যত বলি, খাবারগুলো আমাকে দিন, আমি সঙ্গীদের সাথে ভাগ করে খাইগে, তিনি আমার কথা শুনলেন না। ওরা খাবেখন, তুমি খাও। বলে সব খাবার আমাকে খাইয়ে তবে নিস্তার।
দক্ষিনেশ্বর-এ দ্বিতীয় দিন :
বিবেকানন্দ বলছেন, জিজ্ঞেস করতে করতে দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছলাম এবং একেবারে ঠাকুরের গৃহে উপস্থিত হলাম। দেখলাম, তিনি ছোট খাটখানির উপরে, একাকী বসে আছেন। নিকটে কেউ নেই। আমাকে দেখা মাত্র সাহ্লাদে নিকটে ডেকে,খাটের একপ্রান্তে এসে বসলেন।বসবার পরেই তিনি যেন কেমন ভাবে আবিষ্ট হয়ে পড়লেন। এবং অস্পষ্টস্বরে নিজে নিজে কি বলতে বলতে স্থির দৃষ্টিতে আমাকে লক্ষ করে ধীরে ধীরে আমার দিকে সরে আসতে লাগলেন। বিবেকানন্দ বলছেন, ভাবলাম পাগল বুঝি আগের দিনের মতো আবার পাগলামি করবে। এই ভাবতে ভাবতে তিনি সহসা আমার নিকটে এসে নিজের ডান পা আমার অঙ্গে স্থাপন করলেন। সেই স্পর্শে, মুহূর্তের মধ্যে আমার এক অপূর্ব উপলব্ধি উপস্থিত হলো। চেয়ে দেখলাম দেয়ালগুলোর সাথে ঘরের সমস্ত বস্তু বেগে ঘুরতে ঘুরতে কোথায় লিন হয়ে যাচ্ছে। সমস্ত বিশ্বের সাথে আমার আমিত্ব যেন এক সর্বগ্রাসী মহা শুন্যে একাকার হতে ছুটে চলেছে। তখন দারুন আতঙ্কে অভিভূত হয়ে পড়লাম। মনে হল , আমিত্বের নাশেই মরণ। সেই মরন আমার সামনে, অতি নিকটে। সামলাতে না পেরে চিৎকার করে উঠলাম। ওগো তুমি আমার এ কি করলে ? আমার যে বাপ্-মা আছেন। বিবেকানন্দ বলছেন, অদ্ভুত পাগল আমার এই কথা শুনে, খিল খিল করে হেসে উঠলেন। এবং হাত দিয়ে আমার বুক স্পর্শ করতে করতে বললেন, তবে এখন থাক, একবারে কাজ নেই, কালে হবে। আশ্চর্য্যের বিষয়, তিনি এইভাবে স্পর্শ করে ঐ কথা বলামাত্র আমার সেই অপূর্ব প্রত্যক্ষ একেবারে চলে গেলো। আমি প্রকৃতিস্থ হলাম। ঘরের ভেতরের ও বাইরের সব জিনিষকে আবার আগের মতো অবস্থিত দেখতে পেলাম ।
একেই বলে জাগতিক অথচ অলৌকিক দীক্ষা। ভালোবাসা প্রেম ও আধ্যাত্মিকতার এক অপূর্ব মিশ্রণ।আমরা জানি স্বামী বিবেকানন্দ শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে সমস্ত বিশ্বে নিজেকে প্রতিভাত করেছেন। ভারতবাসীকে জগৎসভায় উচ্চ স্থান করে দিয়েছেন। শিবজ্ঞানে জীব সেবায় লক্ষ লক্ষ লোককে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আজ সেই ধারা সামনে চলছে।
কিন্তু বিবেকানন্দ কি ভেবেছিলেন বা তখন কি চিন্তা করেছিলেন, শুনুন - স্তব্ধ হয়ে ভাবতে লাগলাম, এটা কি হলো ? নিজেই দেখলাম তো, এই অদ্ভুত দর্শন, এই অদ্ভুত পুরুষের প্রভাবে একবার সহসা উপস্থিত হলো, আবার সহসা লয় হয়ে গেলো। মেসমেরিজিম বা মোহিনী বিদ্যা এবং হিপ্নোটিজম বা সন্মোহন বিদ্যা সন্মন্ধে পড়েছি। ভাবতে লাগলাম, এটা কি সেই রকম একটা কিছু ? কিন্তু ঠিক মেনে নিতে পারলাম না। কারন দুর্বলচিত্তর মানুষের উপরেই এইসব বিদ্যা প্রয়োগ করা যায়। আমি তো দুর্বল নোই। আমি তো বুদ্ধিমান, মানসিক বলসম্পন্ন। সাধারণ মানুষেরা গুণশালী পুরুষের সঙ্গলাভে মোহিত হয়, এবং তাদের হাতের পুতুল হয়ে পড়ে, আমি তো তা নোই। বরং প্রথম থেকেই এঁকে অর্ধউন্মাদ বলেই নিশ্চিত করেছি। তাহলে এমনটি হবার কারন কি ? কিছুই ভেবে স্থির করতে পারলাম না। মনের মধ্যে প্রাণের মধ্যে একটা গোল বেঁধে রইলো। কিন্তু প্রতিজ্ঞা করলাম, ভবিষ্যতে যেন আমার মনের উপরে, এই অদ্ভুত পাগল যেন প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। আবার ও ভাবলাম, ইচ্ছা মাত্রই এই পুরুষ যদি আমার মতো প্রবল ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন মানুষকে ভেঙেচুরে কাঁদার তালের মতো নিজের ভাবে ভাবিত করতে পারে, তবে এঁকে পাগলই বা বলি কি করে ?
তাহলে বুঝুন, বিশ্বনাথের শ্রেষ্ট সন্তান, যারা জন্ম নেন লোকশিক্ষার জন্য, তার মনেই গুরু সম্পর্কে সন্দেহ। ব্রহ্মজ্ঞানী পুরুষকে চেনা কত শক্ত। তো শঙ্করাচার্য যে বলছেন, গুরু হবে ব্রহ্মজ্ঞানী। তাকে চেনা আমাদের মতো সাধারণের পক্ষে কত শক্ত।
আরো আশ্চর্য্যের ব্যাপার হচ্ছে, এই বিবেকানন্দ একসময় পাওহারীবাবার কাছে দীক্ষা নেবার জন্য গিয়েছিলেন। সেই ঘটনাটা একটু বলবো।
আমরা জানি শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের তিরোধানের পরে, স্বামী বিবেকানন্দ উত্তরভারতে বেশ কিছুদিন পরিভ্রমন করেছিলেন। ঠাকুর রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পারে, বিবেকানন্দের অন্তরে এক বিষম বিরহ জ্বালা ভোগ করছিলেন। কোথাও শান্তি পাচ্ছিলেন না। ১৮৯০ সালের শীতকালে, একদিন স্বামীজী কাশী থেকে যাত্রা করে গাজীপুর পৌঁছলেন। উদ্দেশ্য পওহারী বাবার দর্শন। তখন উত্তর ভারতে পওহারীবাবার খুব নামডাক। স্বামীজীও ভাবলেন, যদি পওহারীবাবার চরণতলে বসে অমৃতময় জীবন লাভ করা যায়।
গাজীপুরে,সময় বিবেকানন্দ দশ/বারো দিন কাটানোর পরে, স্বামীজী লিখছেন, " বহু ভাগ্যফলে বাবাজির সাক্ষাৎ হয়েছে। ইনি অতি মহাপুরুষ - বিচিত্র ব্যাপার, এই নাস্তিকতার দিনে ভক্তি এবং যোগের অত্যাশ্চার্য্য ক্ষমতার নিদর্শন। আমি এনার শরণাগত হয়েছি, আমাকে আশ্বাসও দিয়েছেন, যা সকালের ভাগ্যে জোটে না। "
শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ ঠাকুরের কথা পওহারীবাবা জানতেন। তারই প্রধান শিষ্যকে পেয়ে, পওহারীবাবাও কম পুলকিত নন। কিছুদিনের মধ্যেই উভয়ের মধ্যে অন্তরঙ্গ ভাব সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পওহারীবাবা যে মাটির গুহার মধ্যে থাকতেন, তার সামনে গিয়ে বিবেকানন্দ বসে থাকতেন। আসলে অধ্যাত্ম জীবনে স্থিত হবার আগেই স্বামীজী ঠাকুরকে হারিয়েছেন। ভাবছেন, নিশ্চয়, ঠাকুরের কৃপাতেই তার পওহারীবাবার দর্শন হয়েছে। বাবাজির কাছে থেকে নিগূঢ় যোগ সাধনায় দিন কাটাবেন বলে ঠিক করে ফেললেন। দীক্ষার জন্য, বাবাজির কাছে নিবেদন করতে, বাবাজি রাজি হয়ে গেলেন। দিন ক্ষণ ঠিক হয়ে গেলো।
গভীর রাতে, স্বামীজী বাবাজির গুহাতে বসে ধ্যান ধারণা করতেন। কিন্তু নিজের মনের দ্বন্দ কাটেনি। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ না পওহারীবাবা ? কে পথ দেখাবে ? এমনি এক সন্ধ্যায় সহসা অন্ধকারময় ঘর দিব্যালোতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো শ্রী শ্রী ঠাকুরের মুখখানি । স্বামীজী তাকিয়ে দেখলেন, শ্রীশ্রী ঠাকুরের মুখ অশ্রুসিক্ত। যেন ভর্ৎসনা করছেন। পরপর কয়েক রাতে, একই দৃশ্য দেখতে লাগলেন তিনি। এর পর আর তার পওহারীবাবার কাছ থেকে দীক্ষা নেওয়া হয়নি। কিন্তু স্বামীজী পওহারীবাবাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতেন। এবং স্বামীজীর কাছে ঠাকুরের পরেই স্থান ছিল পওহারীবাবার।
যেটা বলছিলাম, দেহধারী গুরু পাওয়া যেমন ভাগ্যের ব্যাপার, তেমনি তাকে ঠিক ঠিক চেনা আমাদের কথা ছাড়ুন, বিবেকানন্দের মতো মহাপুরুষের পক্ষেও কতটা শক্ত ছিল, তা বুঝতে পারছেন নিশ্চয়। তাই আমরা বলবো, বিবেকের নির্দেশে চলুন, পরমপিতা, আপনার বিবেকের মাধ্যেমেই গুরুবাক্য শোনাবেন।
আজ এই পর্যন্ত।
ও নমঃ শিবায়ঃ,
ওম নমঃ শ্রী ভাগবতে বাসুদেবায়ঃ,
ওম পরমপিতা পরমেশ্বরায়ঃ নমঃ।
এর পরে, নরেন কি বলছেন শুনুন, - গান তো গাইলাম, তারপরেই ঠাকুর উঠে আমার হাত ধরে, তার ঘরের উত্তরে যে বারান্দা আছে, সেখানে নিয়ে গেলেন। শীতকাল, উত্তরের হাওয়া নিবারণের জন্য, বারান্দাটি ঝাঁপ দিয়ে ঘেরা ছিলো, সুতরাং ভিতরে ঢুকে ঘরের দরজাটি বন্ধ করে দিলে, ঘরের ভিতরের বা বাইরের কোনো লোককে দেখতে পাওয়া যেত না। বারান্দায় ঢুকে, ঠাকুর দরজাটা বন্ধ করে দিলেন, ভাবলাম, আমাকে বুঝি নির্জনে কিছু উপদেশ দেবেন। কিন্তু যা বললেন, ও করলেন, তা আমার কল্পনার অতীত। সহসা আমার হাত ধরে, দরদরিতধারে, আনন্দ অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন। এবং পূর্ব পরিচিতের ন্যায় পরম স্নেহে বললেন : এতদিন পরে আসতে হয় ? আমি তোমার জন্য কিভাবে প্রতীক্ষায় রয়েছি, তা একবার ভাবতে নেই ? বিষয়ী লোকের বাজে প্রসঙ্গ শুনতে শুনতে আমার কান ঝলসে যাবার উপক্রম হয়েছে। প্রাণের কথা কাউকে না বলতে পেরে, আমার পেট ফুলে রয়েছে - ইত্যাদি অনেক কথা বললেন, ও কাঁদতে লাগলেন। এর পরেই, আবার আমার সামনে করজোড়ে দাঁড়িয়ে, দেবতার মতো আমাকে সম্মোধন করে বলতে লাগলেন, জানি আমি প্রভু, তুমি সেই সনাতন ঋষি নবরূপী নারায়ণ, জীবের দুর্গতি নিবারণ করতে, পুনরায় শরীর ধারণ করেছো। .......ইত্যাদি ইত্যাদি। .
স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, আমিতো তার এই আচরণে একেবারে নির্বাক-স্তম্ভিত। মনে মনে ভাবতে লাগলাম এ কাকে দেখতে এসেছি ? এতো একেবারে উন্মাদ। নাহলে বিশ্বনাথ দত্তের পুত্র আমি, আমাকে এই সব কথা বলে ?...... যাইহোক, খানিক্ষন পরে, ঘর থেকে বেরিয়ে মাখন, মিছরি ও কয়েকটা সন্দেশ এনে, আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে লাগলেন। আমি যত বলি, খাবারগুলো আমাকে দিন, আমি সঙ্গীদের সাথে ভাগ করে খাইগে, তিনি আমার কথা শুনলেন না। ওরা খাবেখন, তুমি খাও। বলে সব খাবার আমাকে খাইয়ে তবে নিস্তার।
দক্ষিনেশ্বর-এ দ্বিতীয় দিন :
বিবেকানন্দ বলছেন, জিজ্ঞেস করতে করতে দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছলাম এবং একেবারে ঠাকুরের গৃহে উপস্থিত হলাম। দেখলাম, তিনি ছোট খাটখানির উপরে, একাকী বসে আছেন। নিকটে কেউ নেই। আমাকে দেখা মাত্র সাহ্লাদে নিকটে ডেকে,খাটের একপ্রান্তে এসে বসলেন।বসবার পরেই তিনি যেন কেমন ভাবে আবিষ্ট হয়ে পড়লেন। এবং অস্পষ্টস্বরে নিজে নিজে কি বলতে বলতে স্থির দৃষ্টিতে আমাকে লক্ষ করে ধীরে ধীরে আমার দিকে সরে আসতে লাগলেন। বিবেকানন্দ বলছেন, ভাবলাম পাগল বুঝি আগের দিনের মতো আবার পাগলামি করবে। এই ভাবতে ভাবতে তিনি সহসা আমার নিকটে এসে নিজের ডান পা আমার অঙ্গে স্থাপন করলেন। সেই স্পর্শে, মুহূর্তের মধ্যে আমার এক অপূর্ব উপলব্ধি উপস্থিত হলো। চেয়ে দেখলাম দেয়ালগুলোর সাথে ঘরের সমস্ত বস্তু বেগে ঘুরতে ঘুরতে কোথায় লিন হয়ে যাচ্ছে। সমস্ত বিশ্বের সাথে আমার আমিত্ব যেন এক সর্বগ্রাসী মহা শুন্যে একাকার হতে ছুটে চলেছে। তখন দারুন আতঙ্কে অভিভূত হয়ে পড়লাম। মনে হল , আমিত্বের নাশেই মরণ। সেই মরন আমার সামনে, অতি নিকটে। সামলাতে না পেরে চিৎকার করে উঠলাম। ওগো তুমি আমার এ কি করলে ? আমার যে বাপ্-মা আছেন। বিবেকানন্দ বলছেন, অদ্ভুত পাগল আমার এই কথা শুনে, খিল খিল করে হেসে উঠলেন। এবং হাত দিয়ে আমার বুক স্পর্শ করতে করতে বললেন, তবে এখন থাক, একবারে কাজ নেই, কালে হবে। আশ্চর্য্যের বিষয়, তিনি এইভাবে স্পর্শ করে ঐ কথা বলামাত্র আমার সেই অপূর্ব প্রত্যক্ষ একেবারে চলে গেলো। আমি প্রকৃতিস্থ হলাম। ঘরের ভেতরের ও বাইরের সব জিনিষকে আবার আগের মতো অবস্থিত দেখতে পেলাম ।
একেই বলে জাগতিক অথচ অলৌকিক দীক্ষা। ভালোবাসা প্রেম ও আধ্যাত্মিকতার এক অপূর্ব মিশ্রণ।আমরা জানি স্বামী বিবেকানন্দ শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে সমস্ত বিশ্বে নিজেকে প্রতিভাত করেছেন। ভারতবাসীকে জগৎসভায় উচ্চ স্থান করে দিয়েছেন। শিবজ্ঞানে জীব সেবায় লক্ষ লক্ষ লোককে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আজ সেই ধারা সামনে চলছে।
কিন্তু বিবেকানন্দ কি ভেবেছিলেন বা তখন কি চিন্তা করেছিলেন, শুনুন - স্তব্ধ হয়ে ভাবতে লাগলাম, এটা কি হলো ? নিজেই দেখলাম তো, এই অদ্ভুত দর্শন, এই অদ্ভুত পুরুষের প্রভাবে একবার সহসা উপস্থিত হলো, আবার সহসা লয় হয়ে গেলো। মেসমেরিজিম বা মোহিনী বিদ্যা এবং হিপ্নোটিজম বা সন্মোহন বিদ্যা সন্মন্ধে পড়েছি। ভাবতে লাগলাম, এটা কি সেই রকম একটা কিছু ? কিন্তু ঠিক মেনে নিতে পারলাম না। কারন দুর্বলচিত্তর মানুষের উপরেই এইসব বিদ্যা প্রয়োগ করা যায়। আমি তো দুর্বল নোই। আমি তো বুদ্ধিমান, মানসিক বলসম্পন্ন। সাধারণ মানুষেরা গুণশালী পুরুষের সঙ্গলাভে মোহিত হয়, এবং তাদের হাতের পুতুল হয়ে পড়ে, আমি তো তা নোই। বরং প্রথম থেকেই এঁকে অর্ধউন্মাদ বলেই নিশ্চিত করেছি। তাহলে এমনটি হবার কারন কি ? কিছুই ভেবে স্থির করতে পারলাম না। মনের মধ্যে প্রাণের মধ্যে একটা গোল বেঁধে রইলো। কিন্তু প্রতিজ্ঞা করলাম, ভবিষ্যতে যেন আমার মনের উপরে, এই অদ্ভুত পাগল যেন প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। আবার ও ভাবলাম, ইচ্ছা মাত্রই এই পুরুষ যদি আমার মতো প্রবল ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন মানুষকে ভেঙেচুরে কাঁদার তালের মতো নিজের ভাবে ভাবিত করতে পারে, তবে এঁকে পাগলই বা বলি কি করে ?
তাহলে বুঝুন, বিশ্বনাথের শ্রেষ্ট সন্তান, যারা জন্ম নেন লোকশিক্ষার জন্য, তার মনেই গুরু সম্পর্কে সন্দেহ। ব্রহ্মজ্ঞানী পুরুষকে চেনা কত শক্ত। তো শঙ্করাচার্য যে বলছেন, গুরু হবে ব্রহ্মজ্ঞানী। তাকে চেনা আমাদের মতো সাধারণের পক্ষে কত শক্ত।
আরো আশ্চর্য্যের ব্যাপার হচ্ছে, এই বিবেকানন্দ একসময় পাওহারীবাবার কাছে দীক্ষা নেবার জন্য গিয়েছিলেন। সেই ঘটনাটা একটু বলবো।
আমরা জানি শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের তিরোধানের পরে, স্বামী বিবেকানন্দ উত্তরভারতে বেশ কিছুদিন পরিভ্রমন করেছিলেন। ঠাকুর রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পারে, বিবেকানন্দের অন্তরে এক বিষম বিরহ জ্বালা ভোগ করছিলেন। কোথাও শান্তি পাচ্ছিলেন না। ১৮৯০ সালের শীতকালে, একদিন স্বামীজী কাশী থেকে যাত্রা করে গাজীপুর পৌঁছলেন। উদ্দেশ্য পওহারী বাবার দর্শন। তখন উত্তর ভারতে পওহারীবাবার খুব নামডাক। স্বামীজীও ভাবলেন, যদি পওহারীবাবার চরণতলে বসে অমৃতময় জীবন লাভ করা যায়।
গাজীপুরে,সময় বিবেকানন্দ দশ/বারো দিন কাটানোর পরে, স্বামীজী লিখছেন, " বহু ভাগ্যফলে বাবাজির সাক্ষাৎ হয়েছে। ইনি অতি মহাপুরুষ - বিচিত্র ব্যাপার, এই নাস্তিকতার দিনে ভক্তি এবং যোগের অত্যাশ্চার্য্য ক্ষমতার নিদর্শন। আমি এনার শরণাগত হয়েছি, আমাকে আশ্বাসও দিয়েছেন, যা সকালের ভাগ্যে জোটে না। "
শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ ঠাকুরের কথা পওহারীবাবা জানতেন। তারই প্রধান শিষ্যকে পেয়ে, পওহারীবাবাও কম পুলকিত নন। কিছুদিনের মধ্যেই উভয়ের মধ্যে অন্তরঙ্গ ভাব সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পওহারীবাবা যে মাটির গুহার মধ্যে থাকতেন, তার সামনে গিয়ে বিবেকানন্দ বসে থাকতেন। আসলে অধ্যাত্ম জীবনে স্থিত হবার আগেই স্বামীজী ঠাকুরকে হারিয়েছেন। ভাবছেন, নিশ্চয়, ঠাকুরের কৃপাতেই তার পওহারীবাবার দর্শন হয়েছে। বাবাজির কাছে থেকে নিগূঢ় যোগ সাধনায় দিন কাটাবেন বলে ঠিক করে ফেললেন। দীক্ষার জন্য, বাবাজির কাছে নিবেদন করতে, বাবাজি রাজি হয়ে গেলেন। দিন ক্ষণ ঠিক হয়ে গেলো।
গভীর রাতে, স্বামীজী বাবাজির গুহাতে বসে ধ্যান ধারণা করতেন। কিন্তু নিজের মনের দ্বন্দ কাটেনি। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ না পওহারীবাবা ? কে পথ দেখাবে ? এমনি এক সন্ধ্যায় সহসা অন্ধকারময় ঘর দিব্যালোতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো শ্রী শ্রী ঠাকুরের মুখখানি । স্বামীজী তাকিয়ে দেখলেন, শ্রীশ্রী ঠাকুরের মুখ অশ্রুসিক্ত। যেন ভর্ৎসনা করছেন। পরপর কয়েক রাতে, একই দৃশ্য দেখতে লাগলেন তিনি। এর পর আর তার পওহারীবাবার কাছ থেকে দীক্ষা নেওয়া হয়নি। কিন্তু স্বামীজী পওহারীবাবাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতেন। এবং স্বামীজীর কাছে ঠাকুরের পরেই স্থান ছিল পওহারীবাবার।
যেটা বলছিলাম, দেহধারী গুরু পাওয়া যেমন ভাগ্যের ব্যাপার, তেমনি তাকে ঠিক ঠিক চেনা আমাদের কথা ছাড়ুন, বিবেকানন্দের মতো মহাপুরুষের পক্ষেও কতটা শক্ত ছিল, তা বুঝতে পারছেন নিশ্চয়। তাই আমরা বলবো, বিবেকের নির্দেশে চলুন, পরমপিতা, আপনার বিবেকের মাধ্যেমেই গুরুবাক্য শোনাবেন।
আজ এই পর্যন্ত।
ও নমঃ শিবায়ঃ,
ওম নমঃ শ্রী ভাগবতে বাসুদেবায়ঃ,
ওম পরমপিতা পরমেশ্বরায়ঃ নমঃ।
No comments:
Post a Comment