Sunday, 17 March 2019

স্বর্গলোক - পরাবিদ্যা swrgalok o manab deh

স্বর্গলোক - পরাবিদ্যা 
ওঁ সহ নাববতু।  সহ নৌ ভুনক্ত্ু। সহ বীর্যং করবাবহৈ।
 তেজস্বি নাবধীতমস্ত্ু মা  বিদ্বিষাবহৈ।।

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ।।
স্বর্গ বা স্বর্গলোক আমাদের কাছে  খুবই পরিচিত শব্দ। স্বর্গ সম্পর্কে আমাদের আগ্রহও  কম নয়।
কিন্তু স্বর্গ আসলে ব্যাপারটা কি ও কেমন তা আমরা কেউ জানিনা। আজ আমরা সেই স্বর্গ সম্পর্কে শুনবো, পরাবিদ্যা-বিদদের কাছ থেকে। আমার মতো যারা অজ্ঞানী, অবিশ্বাসী, প্রতক্ষ্য জ্ঞানে যাদের আস্থা, তাদের অপেক্ষা করতে হবে মৃত্যু পর্যন্ত এই জ্ঞান পাবার জন্য।  মৃত্যুর পরেও তা অধরা  থাকবে।  শতকোটি জন্ম-মৃত্যুর পরে, এই জ্ঞান পাওয়া সম্ভব হতে পারে ।  এই দুর্লভ জ্ঞান আমরা পরাবিদ্যাবিদদের কাছ থেকে শুনবো।  

আমরা জানি, জানিনা বলা যেতে পারে শুনেছি, যে সাতটি  লোক আছে।  আর সেগুলো হচ্ছে,  ভুর্লোক , ভুবর্লোক  , স্বর্লোক, মহর্লোক, জনলোক, তপলোক ও সত্যলোক। এছাড়া সাতটি তল আছে।  অতল, বিতল, সুতল, তলাতল, রসাতল, পাতাল, মহাতল। এর মধ্যে আমরা যেখানে বাস করছি, অর্থাৎ ভূর্লোক বাদে আর সবই আমাদের কাছে অগোচর। 

আর এই ৭টি লোক এবং ৭টি  তলের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে স্বর্গলোক। আমাদের শোনা কথা হচ্ছে, সেখানে নাকি কোনো দুঃখ নেই। অপ্সরীরা সেখানে নেচে-গেয়ে স্বর্গাবাসীদের আনন্দ দেয়।  কল্পবৃক্ষ আছে  সেখানে, তার কাছে যা চাওয়া যায়, তাই পাওয়া যায়। শ্রীকৃষ্ণ এককালে, অর্জুনকে যুদ্ধে উৎসাহ দেবার জন্য, বলেছিলো, তুমি স্বর্গে যেতে পারবে না, যদি না তুমি যুদ্ধ করো। অর্থাৎ মানুষের কাছে এটা  একটা  লোভনীয় জায়গা। এখানে নাকি যুধিষ্ঠির এই সশরীরে  চলে গিয়েছিলো। যাই হোক আমরা এই স্বর্গ সম্পর্কে শুনবো, পরাবিদ্যা-বিদদের কাছ থেকে।

কিন্তু স্বর্গ সম্পর্কে বুঝতে গেলে আগে আমাদের এই দেহটাকে একটু বুঝতে হবে।

আমাদের এই দেহ অসংখ্য স্তরে বিভক্ত। অসংখ্য বলতে আমরা যেহেতু কিছুই বুঝতে পারি না।  তাই বুঝবার সুবিধার জন্য  এই দেহকে আমরা পাঁচটি ভাগে ভাগ করতে পারি। ১. অন্নময় , ২. প্রাণময়,
৩. মনোময়, ৪. বিজ্ঞানময়, ও ৫. আনন্দময়। এর মধ্যে অন্নময় দেহ স্থুল, প্রাণময় ও মনোময় সূক্ষ্ম। এই তিনটি দেহকেই একত্রে বলা হয় ভৌতিক দেহ। বিজ্ঞানময় ও আনন্দময় দেহ অভৌতিক দেহ। আমাদের স্বর্গ ব্যাপারটা বুঝতে গেলে প্রথম তিনটি দেহ অর্থাৎ অন্নময়, প্রাণময় ও মনময় দেহ সম্পর্কে একটু ভালোভাবে বুঝতে হবে।

অন্নময় দেহ   : আমরা আমাদের যে দেহটা দেখতে পাই সেটা অন্নময় অর্থাৎ খাদ্য দ্বারা গঠিত ও খাদ্যদ্বারা পরিপুষ্টি লাভ করে। এটি স্থূল দেহ।
এর পরে আছে প্রাণময় দেহ যা আমাদের বাতাস থেকে সংগৃহিত উর্জা শক্তি দ্বারা গঠিত। সবশেষে মনোময় দেহ যা আমাদের কামনা বাসনা আবেগ দ্বারা গঠিত। এই দুটো দেহকে সুক্ষ দেহ বা লিঙ্গদেহ  বলা হয়।
এর পরে আছে কারন দেহ অর্থাৎ বিজ্ঞানময় ও আনন্দময় দেহ। আত্মা সম্পর্কে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই বললেই চলে। আত্মা আছে, এটা বুঝি বা স্বীকার করি, কিন্তু কি সে বস্তূ তা আমরা জানিনা। আমাদের বুঝবার সুবিধার জন্য একে আমরা জ্ঞান বা চৈতন্য বলতে পারি। এই আত্মার অবস্থানের জন্য বা বসবাস করবার জন্য, অদৃশ্য উপকরণে তৈরী, আমাদের একটি দেহ আছে, তাকে বলা হয় কারন দেহ। এই দেহ লিঙ্গহীন। আমাদের চিন্তা, মনের ভাব ইত্যাদির উৎপত্তি স্থান হচ্ছে এই কারন দেহ। মানুষের যে দেহ যখন সক্রিয় থাকে, তখন সে সেই ভাব পোষন করে। এবং কারন দেহে যিনি বাস করেন, তিনিই সেই অজর, অমর, শাশ্বত আত্মা। অর্থাৎ প্রতিবিম্বিত পরম-আত্মা। আবার বলি এই কারন দেহেই পরম-আত্মা প্রতিফলিত হন। সূর্য যেমন সৌরজগতের সবকিছুর মধ্যে প্রতিফলিত হন ও বিকশিত করেন, তেমনি পরম-আত্মা শতকোটি ব্রহ্মাণ্ডে প্রতিফলিত হচ্ছেন। শেষে একটা কথা বলি, আমাদের পাঁচটি দেহেরই উপকরণ সূক্ষ্ম। সূক্ষ্মের ঘনত্ত্ব যখন বৃদ্ধি পায় তখন তাকে আমরা স্থূল বলি, অর্থাৎ আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় ।

আমাদের স্থূল শরীর  যখন ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যায়, তখন আমাদের অহং অর্থাৎ আমরা  কামদেহে অবস্থান করি। অর্থাৎ স্থূল দেহের সাথে আমাদের অন্নময় ও প্রানময় দেহ লোপ পায় তখন আমরা কামদেহে অবস্থান করি। কামদেহ আর কিছু নয়, আমাদের মনোময় দেহের দুটি অংশ। একটা কামনাময় আর একটা বাসনাময়। কামদেহে আমরা ততক্ষনই অবস্থান করি, যতক্ষন আমাদের কামনা পূরণের প্রবৃত্তি থাকে।এই জগৎটাকে বলা হয় ভুবর্লোক। অর্থাৎ মৃত্যুর পরেই আমরা এই ভুবর্লোকে প্রবেশ করি।এই ভুবর্লোকের অবস্থান কাল শেষ হয়ে গেলে বা কামনা পূরণের অবস্থা না থাকলে, বা কামনা পূরণ  হয়ে গেলে, তবেই আমরা মনোময় শরীরের অন্য অংশের মধ্যে প্রবেশ করি। এই মনময় শরীরে সংকল্প সিদ্ধ করবার জন্য, অর্থাৎ বাসনা পূরণের জন্য আমাদের যে অবস্থা চলতে থাকে  তাকেই আমরা স্বর্গবাস বলি।

এখানে আমি দুটো শব্দ ব্যবহার করলাম, একটা হচ্ছে কামনা, আর একটা হচ্ছে বাসনা। আমাদের সাধারণের দৃষ্টিতে কামনা ও বাসনা একই অর্থ। আসলে কিন্তু তা নয়।  কামনা হচ্ছে আপন বা নিজের  সুখের নিমিত্ত ভোগে প্রবৃত্ত হওয়া।  আর বাসনা হচ্ছে সংকল্প বা কিছু করবার ইচ্ছে।

এবার আমরা মূল আলোচ্য বিষয়ে যাবো। পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন :

কামনার লোক হতে মানুষ  স্বর্গলোকে গমন  করে। 

আমাদের কামদেহ  যে স্তরে কাজ করে, তাকে বলা হয় কামলোক।  আর মানস দেহের্ যে অবস্থা  বা যে স্তরে সংকল্প  কাজ করে তাকে বলা হয় স্বর্গলোক। 

মানুষ মৃত্যুর পরে,   প্রথমে কিছুদিন কামলোকে বা ভুবর্লোকে বাস করেন।  সেখানকার স্থিস্তিকাল শেষ হলে, জীব তন্দ্রাভিভূত হয়ে পড়েন। কামলোকের কোনো স্পন্দন গ্রহণ করবার উপকরণ তার দেহে না থাকার জন্য তার সংবিৎশক্তি অধিক পরিমানে অন্তর্মুখী হয়। এর ফলে কামলোকে সন্মন্ধে তার আর কোনো জ্ঞান থাকে না। মনোময় দেহের উপকরণগুলি সজ্জিত হওয়ায় মানসদেহ পরিপুষ্ট হয়, এবং জীব তখন কামদেহ ত্যাগ করে, মনোময় দেহ ধারণ করে এবং মানস লোকে উপনীত হয়। এই অবস্থাই স্বর্গলোকের নিম্নতর স্তর। 

এইখানে আমরা আবার একবার বলি  - সেটা হচ্ছে 

আমাদের দেহ পাঁচ প্রকার। অর্থাৎ অন্নময়, প্রাণময়, মনময়, বিজ্ঞানময়, আনন্দময়।   এর মধ্যে একটা স্থূল, দুটি সূক্ষ্ম  (এদের বলে ভৌতিকদেহ) মানুষের যে দেহটা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়, তা আসলে অন্ন দ্বারা গঠিত, অন্ন দ্বারাই পরিপুষ্ট। একেই আমরা স্থুল  দেহ বলি। এই দেহই  আমাদের সকল দোষ-গুনের আধার, এর পরে আর কিছু নেই এমন  ধারণা কিন্তু ঠিক নয়।মৃত্যুর পরে, আমাদের দোষ-গুন্ শেষ হয়ে গেলো, এমনটা নয়। মৃত্যুর পরেও আমাদের কর্মফল, আমাদের জ্ঞান, আমাদের স্মৃতি অর্থাৎ আমাদের সঞ্চিত দোষগুণ বা অর্জিত সংস্কার, প্রারব্ধ রূপে  আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। এসব বুঝতে গেলে আগে আমাদের দেহকে আগে বুঝতে হবে।

আমরা সবাই জানি, পঞ্চভূতের তৈরী  এই দেহ।  এই দেহ বিনষ্ট হয়ে গেলে, পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাবে। আমাদের আর একটা দেহ আছে, সেটা হচ্ছে সূক্ষ্মদেহ বা লিঙ্গদেহ। এই দেহে স্থুল কোনো উপকরণ নেই। আমাদের আবেগ, কামনা, বাসনা, প্রভৃতি সূক্ষ্ম উপকরণে এই দেহ গঠিত।

এই সূক্ষ্ম দেহের ভেতরে আছে আর একটি দেহ  তার নাম মানস দেহ।

এই মানস দেহের অভ্যন্তরে অতি সূক্ষ্ম উপকরণে  তৈরী, আরও  একটি দেহ আছে তার নাম কারণদেহ। এটাই আমাদের মন, বুদ্ধির আধার।

 আমাদের দেহ আসলে পঞ্চকোষের সমষ্টি।  এগুলো হচ্ছে, অন্নময় , প্রাণময়, মনোময়, বিজ্ঞানময়, এবং আনন্দময়। পরা-বিদ্যাবিদগন একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছন।

ধরুন  জলের মধ্যে একটা স্পঞ্জের বল - স্পঞ্জের বল হচ্ছে আমাদের এই স্থুলদেহ, আর স্পঞ্জের মধ্যে যে জল সেটা হচ্ছে সূক্ষ্ম দেহ, আর জলের মধ্যে যে বাতাস সেটা হচ্ছে মনোময় দেহ। বাতাসের মধ্যে যে ইথার আছে সেটা হচ্ছে বিজ্ঞানময় দেহ,  আর ইথারের মধ্যে আরো সূক্ষ্ম পদার্থ বা গুন্  আছে তাকে বলা হয় আনন্দময় দেহ । অর্থাৎ আমাদের শরীরের সর্বত্র পরস্পরের মধ্যে ওতপ্রোত ভাবে সব দেহ একত্রে অবস্থান করছে।

অন্নময় কোষ : অন্ন অর্থাৎ খাবার, অন্নময়  কোষ মানে খাবার দিয়ে  তৈরি যে কোষ রয়েছে আমাদের শরীরে। আমরা তৈত্তিরীয় উপনিষদে দ্বিতীয় অধ্যায়ে পাই : আমরা সংস্কৃত বলতে যাবো না। বাংলায় শুনবো।  এখানে বলছেন, এই জগতে যত  প্রাণী আছে, সব খাদ্য থেকে উৎপন্ন। খাদ্য দ্বারাই তারা পুষ্ট হচ্ছে আবার খাদ্যতেই বিলীন হচ্ছে।মৃত্যুর পরে আমরা সবাই খাদ্য হয়ে যাই।

প্রাণময় কোষ : অর্থাৎ উর্জা শরীর।  এই শরীর বায়ুর শক্তিতে তৈরী। খাদ্য দ্বারা তৈরী আমাদের যে শরীর তার ভিতরে প্রাণময় শরীর। এটি বায়ু দ্বারা গঠিত।  এর আকারও অন্নময় দেহেরই মতো। উপনিষদ এঁকে একটা পাখির সঙ্গে তুলনা করেছে।  প্রাণবায়ু, অর্থাৎ যে বায়ু আমরা গ্রহণ করছি সেটি হচ্ছে এই কল্পিত পাখির মাথা, ব্যান  বায়ু অর্থাৎ যে বায়ু আমাদের সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে আছে তা  হচ্ছে  ওই পাখির ডান ডানা, অপান  বায়ু অর্থাৎ যে বায়ু আমরা ছেড়ে দিচ্ছি বা নিশ্বাস  তা হচ্ছে পাখির  বাম  ডানা, এর পরে আছে সমান বায়ু বা  আকাশ যা আমাদের খাদ্য পরিপাক করে, তা আছে আমাদের পাখিটির  মধ্যে ভাগে, এবং সব শেষে উদান বায়ু  বা পৃথিবী যা আমাদের দেহের ভারসাম্য রক্ষা করছে তা হচ্ছে পাখিটির লেজ। প্রাণ আমাদের একটিমাত্র অংশে রয়েছে তা নয়। এর অবস্থান দেহের সর্বত্র। এই দেহ আমাদের প্রাণ বায়ুতে পূর্ন। 

মনময়  কোষ : অর্থাৎ মানসিক শরীর, মনের চিন্তার জগৎ । প্রাণময় কোষের ভিতরে আছে মনোময় কোষ অর্থাৎ মনের স্তর। প্রাণময় কোষ যেমন অন্নময় কোষকে পূর্ণ করে রাখে তেমনি মনময় কোষ প্রাণময় কোষকে পূর্ন করে রাখে।

এই তিন শরীরকে  ভৌতিক শরীর  বলে। অন্নময়  শরীর স্থূল।  প্রাণময় শরীর  সূক্ষ্ম  ও মনময়  শরীর অতি সূক্ষ্ম।  কিন্তু এই তিন শরীর-ই  ভৌতিক। এই তিন শরীরের উপরেই আমাদের কর্মের প্রভাব পড়বে। স্থূল শরীর  অর্থাৎ অন্নময় কোষ দ্বারা গঠিত শরীরের উপরে যেমন  কর্মের ছাপ পড়বে।  তেমনি প্রাণময় ও মনময় শরীরের উপরেও কর্মের প্রভাব আছে। কর্ম-বন্ধন  এই তিন শরীরকে জুড়ে রেখেছে। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, সিমেন্ট বা আঠার মতো কর্ম এই তিন শরীরকে জুড়ে রাখতে সাহায্য করে। কর্ম বন্ধন এই তিন শরীরকে জুড়ে রাখে। অর্থাৎ আমাদের কামনা বাসনা থেকে উদ্ভুত কর্ম এই শরীরকে সজীব রেখেছে।

এর পরে আছে :
বিজ্ঞানময় কোষ (বুদ্ধির স্তর ): এটি ভৌতিক নয় কিন্তু ভৌতিক শরীরের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। মনোময় কোষ আবার বিজ্ঞানময় কোষ দ্বারা পূর্ন। বিজ্ঞানময় কোষও মানব-আকৃতি সম্পন্ন। এই কোষ মস্তকের প্রতীক। এই কোষে আমাদের শ্রদ্ধা অর্থাৎ ঋষিবাক্যের প্রতি  শ্রদ্ধা, ঋষিবাক্যের অর্থ মনন করা, সত্যকে উপলব্ধি করা, এবং আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা এর কাজ। আত্মাকে উপলব্ধি করতে গেলে আমাদের এই বিজ্ঞানময় কোষকে পুষ্ট করতে হবে। বিজ্ঞানময় কোষ বলতে বুদ্ধির স্তরকে বোঝায়। এটি আমাদের সিদ্ধান্ত নেবার বা সংকল্প গ্রহণ করার স্তর। মনোময় স্তরে অর্থাৎ আমাদের মনে সবসময় "করবো কি করবো না " এই সংশয় বা দ্বিধা থাকে।  এখান থেকে আমাদেরকে  বের করে নিয়ে আসে, এই বিজ্ঞানময় কোষ অর্থাৎ বুদ্ধির স্তর।  কোনোকিছুর সঠিক তাৎপর্য আমরা বুদ্ধির দ্বারাই বুঝতে পারি। শ্রদ্ধা, আত্মবিশ্বাস, সত্য, ন্য়য়পরায়ণতা, এবং যোগ বা একাগ্রতা আর সবশেষে মহঃ, এগুলো বিজ্ঞানময় কোষের কাজ।

আনন্দময় কোষ :  পুরোপুরি অভৌতিক। বিজ্ঞানময় কোষের মধ্যে বুদ্ধিরূপ আত্মা আছেন। বিজ্ঞানময় কোষের অভ্যন্তরে আছে আনন্দময় কোষ। এখানেই আনন্দস্বরূপ আত্মা বিচরণ করছেন। বিজ্ঞানময় কোষ এই আনন্দময় কোষ দ্বারা পরিপূর্ন। উপনিষদ বলছেন, এই আনন্দময় কোষের আকৃতিও মনুষ্যদেহীর অনুরূপ। প্রিয় জিনিস দেখার আনন্দ, প্রিয় বস্তু লাভ করার আনন্দ, প্রিয় বস্তু ভোগ করার আনন্দ, এই বিশুদ্ধ অদ্বয় আনন্দই জীবাত্মা। এইখানেই পরমাত্মার প্রতিফলন। আনন্দস্বরূপ ব্রহ্মের প্রকাশ এখানেই।

বিজ্ঞানময় শরীর যা আসলে অভৌতিক, এই আনন্দময় শরীরের অর্থাৎ অভৌতিক শরীর ও ভৌতিক (মনোময়) শরীরের  সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। তার মানে বিজ্ঞানময় কোষ নিজে অভৌতিক, কিন্তু তিনি ভৌতিক ও অভৌতিক শরীরের মধ্যে সম্পর্ক জুড়ে রাখে।

ভৌতিক শরীরের রূপ বা আকার আছে। অন্নময় শরীর অতি স্থূল, তাই আমরা দেখতে পাই। প্রাণময় ও মনময় সূক্ষ্ম কিন্তু আমাদের অনুভূতির বাইরে নয়। এদুটো আসলে আউড়া বা জ্যোতি। দেখতে না পেলেও আমরা এর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি। যোগীরা এই প্রাণময় ও মনময় দেহ অর্থাৎ জ্যোতি দেখতে পান।  আর এটি আমাদের স্থূল শরীরকে ঘিরে রেখেছে।

যদি ভৌতিক শরীর নষ্ট হয়ে যায়, তবে এই বিজ্ঞানময় শরীর আনন্দময় শরীরের সঙ্গে মিশে যায় ,এবং তৎপর  আনন্দময় শরীর বিশ্বব্রমান্ডের সাথে বিলীন হয়ে যায় বা একাত্বিভূত হয়ে যায়।

ভৌতিক শরীর পঞ্চভূতের মিশ্রণ।  মৃত্যুর পরে, আমাদের ভৌতিক শরীর পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের কর্মবন্ধন, আমাদের আবার দেহধারণের জন্য উদগ্রীব হয়। ও আমরা আবার শরীরের মধ্যে প্রবেশ করি। যখন আমরা কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারি তখন আমরা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সাথে এক হয়ে যাই।  জন্মমৃত্যুর চক্রের থেকে মুক্ত হয়ে যাই। একে বলে, মুক্তি।  কেউ বলে সমাধি।

OM SHANTI

---------------

যাইহোক, আমাদের আলোচ্য বিষয় স্বর্গলোক। আমরা আবার সেই আলোচনায় ফিরে আসি। যে কথা বলছিলাম, জীব যখন কামদেহ  দেহ ত্যাগ কোরে  মানসদেহ ধারণ করে, তখন সে মানস লোকে উপনীত হয়। আর এটাই স্বর্গলোকের নিম্নতর স্তর। আমাদের পার্থিব জ্ঞান অনুযায়ী, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বা নিচ থেকে উপরে, বা কাছ থেকে দূরে যাবার কোনো ব্যাপার কিন্তু এর মধ্যে নেই। কারন সমস্ত লোকগুলোই ওতঃপ্রোত ভাবে জড়িত। জীব যেখানে স্থূল দেহ ত্যাগ করেছেন, এমন হতে পারে, সেখানেই সে ভুবর্লোকের স্থিতিকাল অতিবাহিত করেছেন , আবার সেখানেই সে স্বর্গলোক ভোগ করছেন ।  আবার এমনও হতে পারে, সে চন্দ্রলোকে চলে গেছেন । একটা কথা মনে রাখতে হবে, আমরা যখন যে লোকে অবস্থান করি, সেই লোকের  বাইরে আমরা কিছু দেখতে পাই না। ভুবর্লোকে থাকবার সময় আমরা এমনিতে স্থুল জগতের কিছুই দেখতে পাই না। কেবলমাত্র সূক্ষ্ম  অনুকৃতি দেখতে পাই।  আমরা যখন স্বর্গলোকে চলে যাই, তখন এই স্থুললোকের সঙ্গে আমাদের সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়। পুনর্বার জন্মগ্রহণ না করা পর্যন্ত আমরা আর এ জগতের কোনোকিছু জানতে পারি না।

স্বর্গের উজ্বল চিত্র :

এখন প্রশ্ন হচ্ছে  এইসব কথা কি কেবল কবি কল্পনা ? না এর মধ্যে কোনো সত্য বলে কিছু আছে ? দেখুন, অতীন্দ্রিয় ব্যাপার, আমাদের ইন্দ্রিয় উপলব্ধ নয়। তাই আমাদের ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান দিয়ে এগুলো বোঝার চেষ্টা না করা  ভালো। অতীন্দ্ৰিয় ব্যাপার আমরা কি ভাবে বুঝি ? আগমে যা পাওয়া যায়, অর্থাৎ প্রত্যক্ষদৃষ্টি সম্পন্ন মনীষিগণ যা দেখেছেন, বা উপলব্ধি করেছেন, আমাদের সেখান থেকে বুঝে নিতে হবে। আপনি বিশ্বাস করবেন কি করবেন না,সেটা আপনার ব্যাপার। আপনার আমার কাছে সবই শোনা কথা, উপল্বদ্ধির বিষয় নয়। এবং আমার আপনার সামান্য জ্ঞানের উর্দ্ধে এই বিষয়। আমাদের আগে পিছে, শব্দ/ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে একথা ১০০ বছর আগে কেউ বিশ্বাস করতো না। এখন করে, কিন্তু  যার কাছে রিসেপ্টর (TV) এবং প্রজেক্টর  বা গ্রাহক ও বাহক  যন্ত্র আছে সেই এটা  দেখতে পারে, দেখতে পারে । অন্যরা কেউ পারেনা।

যাই হোক,

কামলোকের ভোগ শেষ হলে, সে মূর্ছিত হয়ে পড়ে।  মূর্ছাভঙ্গের পরে, জীব  স্বর্গলোকে যায়, আর  তখন তার সামনে  যে মহিমময় দৃশ্য  সামনে ফুটে ওঠে, তা বর্ণনার অতীত। ভুবর্লোকের  দৃশ্য পার্থিব দৃশ্যের অনুরূপ হলেও বর্ণ ও আভার ছটায় সেগুলো অলৌকিক-ধর্ম্ম সম্পন্ন ছিলো, কিন্তু স্বর্গের দৃশ্যের সাথে তার তুলনা হতে পারে না।
মনোহারী সংগীতধ্বনি, অপরূপ আলোক ও জ্যোতিঃ, পুণ্যগন্ধ, স্নিগ্ধ শান্তির উপকরণ সব কিছু মিলে স্বর্গে যে দৃশ্যপট রচনা করা আছে তা অনির্বচনীয়, অপরিমেয়, অপরিসীম। আনন্দের সেখানে সীমা নেই। শান্তির কোনো অন্তরায় নেই। সুখ ও আনন্দের আকর, সেই চির শান্তিময়, সেই চির জ্যোতির্ম্ময় ধামের বর্ণনা করা মানুষের সাধ্য নয়। আসলে আমরা এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এক অতি ক্ষুদ্র এক কীট। আমাদের ভাষার ক্ষমতাও সীমিত। স্বর্গ দূরে থাকুক,  অনেক সাধারণ জিনিসের সম্পর্কেও আমাদের জ্ঞানের বিষয় ভাষায় ব্যক্ত করতে পারি না। এমনকি ইন্দ্রিয়লব্ধ অনেক জ্ঞান বা অনুভূতি আমরা ভাষায় ব্যক্ত  করতে অক্ষম। আমরা যে ইন্দ্রিয়সুখ ভুগে করি, তা কি সব সময় ভাষায় বলতে পারি ? ফুলের গন্ধ কি ভাষা দিয়ে কাউকে বোঝানো যায় ? এমনকি রসোগল্লার স্বাদ কি কাউকে ভাষা দিয়ে বোঝানো যায় ?  স্বর্গলোকের সবকিছুর মাধুর্য্য মানুষ তো ছাড়ো, স্বয়ং সরস্বতীও ব্যক্ত করতে পারেন না।

স্বর্গ এক আনন্দময় স্থান (ভূমা-আনন্দ )  :

যাইহোক, ব্যক্ত  করার যোগ্য না হলেও, স্বর্গ যে পরম সুখের জায়গা তাতে আমাদের কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। একটা কথা বুঝতে হবে, আমরা আত্মাদ্বারা সুখ দুঃখ অনুভব করি।  ইন্দ্রিয় দ্বারা নয়।  ইন্দ্রিয় একটা মাধ্যম মাত্র। ইন্দ্রিয়গন "করন" মাত্র। ইন্দ্রিয়গণ বিষয়ের সঙ্গে জীবের বা জীবাত্মার সংযোগ সাধন করে মাত্র। এবং এই সংযোগের ফলে সুক্ষ দেহে স্পন্দন অনুভূত হয়। এই স্পন্দনের মাধ্যমে মন ও বুদ্ধি দ্বারা জীবের বিষয়ের অনুভূতি হয়। সুতরাং আমাদের স্থুল  দেহে, রূপ, রস , গন্ধ, স্পর্শ, প্রভৃতি থেকে যে সুখ বা দুঃখ অনুভব করা যায় তা দুটো বহির-আবরণের (ইন্দ্রিয়, মন-বুদ্ধি) ভিতর দিয়ে জীবের কাছে পৌঁছায়। সেজন্য,তার তীব্রতা কিছু পরিমানে হ্রাস পায়। মনোজগতে অর্থাৎ মানস দেহে  এই বিঘ্ন নেই। স্থুল শরীরের ও সূক্ষ্ম শরীরের বাধা সেখানে নেই,সুতরাং সুখের মাত্রা যে সেখানে বেশি হবে তাতে আশ্চর্য্য হবার কিছু নেই। অনুভূতি মনেরই কাজ। সুতরাং যেখানে অনুভূতি সাক্ষাৎ সন্মন্ধে মনের গোচর হয়, সেখানে তার পরিমান যে অধিক হবে, তাতে সন্দেহ কি ?

প্রিয়জনদের সাথে মিলন :

সোনালী রঙের কুয়াশার মধ্য দিয়ে সুখ-স্বপ্নে অভিভূত জীবের জ্ঞান সঞ্চারের সঙ্গে সঙ্গে তার অন্তর্দৃষ্টি যখন স্বর্গলোকের উপরে পড়ে তখন এক অনির্ব্বচনীয় পারিপার্শ্বিক সৌন্দর্য্য তাকে অভিভূত করে। সেই সঙ্গে তার প্রিয়জনের আনন্দ উদ্ভাসিত মুখগুলো তার দৃষ্টিগোচর হয়। স্বর্গে কোনো সুখের অভাব নেই। প্রিয়জনরাও সেখানে আছে। তবে কি তারা পৃথিবীতে নেই ?  তা নয়, তবে কি, স্বর্গবাসী জীব যখন যা ইচ্ছা করেন, সকলই তিনি মানসদৃষ্টিতে দেখতে পান। তিনি প্রিয়জনের কথা ভাবছিলেন তাই তারা উপস্থিত হয়েছেন। এ সবই তার মানস সৃষ্ট। তাদের যে রূপ, যে ভাব, যে মনোবৃত্তি স্বর্গবাসীর প্রিয় ছিল সেই ভাবেই তারা প্রকট হন। যে শুদ্ধ আত্মা স্বর্গীয় উচ্চ স্তরে বাস করেন, স্থুল  জগতের  জীবের চৈতন্যে যিনি আংশিক প্রকাশিত, তিনি এইসব চিন্তামূর্তিগুলির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে নেন।

এই প্রসঙ্গে ছান্দোগ্য উপনিষদে আমরা একই কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পাই।  সেখানে বলছেন :

স যদি পিতৃলোককামো  ভবতি সংকল্পাদেবাস্য পিতরঃ সমুৎতিষ্ঠন্তি তেন পিতৃলোকেন সম্পন্নো মহীয়তে  (ছান্দোগ্য : ৮/২/১) 
আত্মজ্ঞ সেই ব্যক্তি যদি পিতৃপুরুষদের সঙ্গ পেতে চান, তাহলে তার ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁরা তাঁর সামনে আবির্ভূত হন।  সেই লোকে পিতৃপুরুষদের সঙ্গে মিলিত হয়ে তিনি মহিমান্বিত হন।

অথ যদি মাতৃলোককামো ভবতি সঙ্কল্পাদেবস্য মাতরঃ সমুৎতিষ্ঠন্তি  তেন মাতৃলোকেন সম্পন্নো মহীয়তে।  (ছান্দোগ্য : ৮/২/২)
আবার তিনি যদি মায়েদের সঙ্গ পেতে চান, তার ইচ্ছা অনুযায়ী মায়েরাই তার সামনে আবির্ভূত হন।

পরবর্তী শ্লোক গুলোতে একই ভাবে বলা আছে : তিনি যদি ভাইদের বোনেদের, বন্ধুদের সঙ্গ পেতে চান তবে তিনি তাই পেয়ে থাকেন। ছান্দোগ্য উপনিষদ আরো বলছেন : তিনি যদি খাদ্য, পানীয়, পেতে চান তবে তিনি তাই পেতে পারেন। যদি গান শুনতে চান, যদি স্ত্রীলোক কামনা করেন, বা যে কোনো কাম্য বস্তু পেতে চান, তবে তিনি তাই পেতে পারেন। (ছান্দোগ্য : ৮/২/৩-১০) 

শ্রূতি বলছেন, যিনি এই জীবনে আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন, তিনি এই সত্যসঙ্কল্পের অধিকারী হন।  অর্থাৎ যা ইচ্ছে তাই পেতে পারেন। 
আর পরাবিদ্যাবিদগণ বলছেন জীব যখন স্বর্গবাসী হন তখন এই ক্ষমতার অধিকারী হন।    

------
স্বর্গে প্রিয়জনদের সাথে মিলন :

জীবের  যখন ভুবর্লোকে স্থিতিকালের শেষের দিকে মনোময় দেহ গঠন হয়, তখন সে সঙ্গাহীন হয়ে পড়েন এবং পার্থিব বিষয়ের কোনো কামনা তার মনে বিশেষ থাকে না। কিন্তু উচ্চবৃত্তিগুলো নষ্ট হয় না। ভালোবাসার উৎপত্তি-স্থান ভগবান। হৃদয়ের উচ্চ বৃত্তিগুলোর মধ্যে প্রেম সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করে আছে। সুতরাং যে সব প্রিয়জনের কথা চিন্তা করতে করতে তিনি স্বর্গলোকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন, সেখানে গেলে তিনি প্রথমে এই সব চিন্তনীয় ব্যাক্তিগুলি পাবেন। তাদের যে ভাব স্বর্গীয় আত্মার ভালো লাগে সেই ভাবেই তাঁদের দেখবেন।  যে মূর্তি তার ভালো লাগতো, তিনি সেই মূর্তিই দেখবেন। পৃথিবীর সঙ্গে তার আর কোনো সম্পর্ক রাখবেন না। কিন্তু অনন্ত সুখ-শান্তি ও অপার আনন্দে তিনি নিজের জগৎ নিজেই রচনা করতে থাকবেন। সত্যি কথা বলতে কি এই সব পদার্থ জীবের হৃদয়-আকাশে অবস্থিত আছে।  আমাদের অতীত ভবিষ্যৎ সবই আমাদের হৃদয়-আকাশে নিহিত আছে। জ্ঞানীগণ এসব দেখতে পান। আমরা যারা অজ্ঞান সে সব দেখতে পাই না। ভূগর্ভের উপর দিয়ে আমরা হেটে বেড়াই। কিন্তু ভূগর্ভে নিহিত রত্নরাজির খোঁজ আমরা কজন রাখি ? তেমনি আমাদের হৃদয়-আকাশে স্থিত আমাদের ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ আমরা দেখতে পাই না। আমাদের সবারই সুষুপ্তি হয়।  এই সুসুপ্তিতে আমরা অজ্ঞান  থাকি। তাই আমাদের সুসুপ্তির অবস্থায় আমাদের কি হয়, তা আমাদের মনে থাকে না। জ্ঞানীগণ ধ্যান অবস্থায় এই সুষুপ্তি লাভ করেন। এবং চেতন থাকেন, তাই তারা সব কিঁছু জানতে বা দেখতে পারেন। আমরা সুষুপ্তি কালে, অর্থাৎ স্বপ্নহীন নিদ্রায় আমরা স্বর্গাবাসীদের সাথে মিলিত হতে পারি, এমনকি মিলিত হই, কিন্তু নিদ্রাভঙ্গে আমাদের সে সব কথা মনে থাকে না। জ্ঞানীগণ যখন সমাধিস্থ হন তখন মৃত প্রিয়জনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ করেন। হৃদয়াকাশই ব্রহ্মপুর। সুসুপ্তিকালে জীব সেখানে যান বটে, কিন্তু কর্মসূত্র যুক্ত থাকে বলে, ব্রহ্মে লীন হয়ে যান না। নিদ্রাভঙ্গে আবার আত্মস্বরূপ প্রাপ্ত হন। এর পরে আছে তুরীয় অবস্থা। এই তুরীয় অবস্থায় মানুষ সমাধি লাভ করে। এই তুরীয় অবস্থাপ্রাপ্ত মানুষ আর দেহে থাকেন না।

স্বর্গে জীবের বিষয়ের স্মৃতি অক্ষুন্ন থাকে  -

স্বর্গলোকে যাবার পরে জীবের পার্থিব জীবনের সমস্ত কথাই মনে থাকে। কারুর পার্থিব জীবন যদি দীর্ঘ হয় তবে বিকশিত জীবনের কথা অনেকদিন পর্যন্ত তার স্মৃতি হতে বিলুপ্ত হয় না। কিন্তু সেখান থেকে পৃথিবীর সঙ্গে তার সংস্রব রাখা চলে না। পৃথিবীর আত্মীয়স্বজন সুসুপ্তিকালে তার কাছে আসতে  পারে মাত্র। স্বর্গবাসী মানে হচ্ছে মানস দেহধারী। আত্মা, বুদ্ধি ও মন এই তিন দ্বারা মানস দেহ গঠিত। আত্মা কোন ব্যক্তির নিজস্ব সম্পত্তি নয়।  সর্বভূতে একই আত্মা বিরাজিত। প্রত্যেক জীবের মধ্যে যা প্রবেশ  করে, তা ওই আত্মার জ্যোতিঃ রশ্মি মাত্র। সেই জন্য এক দেহের বিনাশে অন্য দেহের বিনাশ হয় না। একের কর্মফলও অন্যকে আশ্রয় করতে পারে না। এমনকি মিশ্রণ ঘটতে পারে না। বেদান্তেও আমরা দেখেছি, পরমাত্মা যখন জীবের মধ্যে প্রতিফলিত হয়, তাকে জীবাত্মা বলে। আবার সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডে যখন প্রতিবিম্বিত হয় তখন তাকে আমরা আত্মা বলি।  এগুলো আসলে সবই পরম-আত্মার  প্রতিবিম্ব মাত্র। যেমন সূর্য সবেতেই প্রতিফলিত হচ্ছে। তেমনি পরম-আত্মাও সবকিছুর মধ্যেই প্রতিবিম্বিত হচ্ছে এমনকি সূর্যের মধ্যেও প্রতিবিম্বিত হচ্ছে । এবং এই জ্যোতিঃ রশ্মিই  আমাদেরকে  ব্যক্ত করছে। আমাদের চেতন শক্তির বিকাশ এই জ্যোতিরশ্মি  থেকেই হয়। জীব যখন স্বর্গের নিম্নস্তরে বাস করে, তখন সে মায়ায় আচ্ছন্ন থাকেন। তার অতীত জীবনের কথাই তখন কেবল মনে  পড়ে । সেখানে যা তিনি অর্জন করেছিলেন, যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন, সেগুলোই স্বর্গে এসে তিনি ভোগ করেন। স্বর্গলোক আসলে ভোগ ভূমি।  পৃথিবী যেমন কর্মভূমি স্বর্গ তেমনি ভোগ ভূমি। কর্মদ্বারা যে বীজ তিনি পৃথিবীতে বপন করে ছিলেন, স্বর্গে এসে তিনি তারই ফল ভোগ করেন। এই সময় তিনি কর্ম থেকে দূরে থাকেন। এবং স্বর্গ সুখ ভোগ করেন।

স্বর্গবাসী প্রিয়জনদের সঙ্গসুখ ভোগ করেন :

স্বর্গবাসী, জ্ঞানের উন্নত স্তরে বাস করেন। জীব যখন স্থূল দেহে বর্তমান  থাকেন, তখন কর্মের মাধ্যমে তিনি জ্ঞান সঞ্চয় করেন। কামলোকে তার বাসনাদেহ কাজ করে।অর্থাৎ এই বাসনা দেহে তিনি সুখ-দুঃখ ভোগ করেন।  এর পরে তিনি মানসলোকে, মানস দেহ অবলম্বন করেন। এই মানস দেহ দ্বারাই তখন তার সুখ ভোগ হয়। আমরা যারা বেঁচে আছি, তাদের সবারই এই তিন দেহ আছে। আমাদের প্রিয়জন বিয়োগে যে দুঃখ ভোগ করি, তা এই কামদেহের কাজ।  অর্থাৎ আমাদের প্রিয়জন বিয়োগ হলে কামদেহে এক তীব্র স্পন্দন আরম্ভ হয়, এটাই আমাদের দুঃখের কারন। মানস দেহ তখন স্থিতাবস্থায় থাকে।  সেখানে এই স্পন্দন পৌঁছায় না। তাই মানস দেহে আমাদের কোনো সুখ-দুঃখ অনুভূত হয় না। ধীরে ধীরে কামদেহের এই স্পন্দন মৃদু থেকে  মৃদুতর  হয় এবং শোকের প্রভাব চলে যায়। মানসদেহে কিন্তু সুখ-দুঃখের কোনো অধিকার নেই। সেখানে জ্ঞানের উন্নতস্তরে কোনো বিচ্ছেদ নেই, কোনো শোক নেই, কোনো দুঃখ নেই।  সেখানে আছে শুধু চির শান্তি, নির্মল আনন্দ।  তাই স্বর্গবাসী জীব তাঁর আত্মীয়-স্বজনের জ্ঞানের নিম্ন স্তরের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখেন না।  তাই, পৃথিবীতে তারা যে ভাবেই থাকুক না কেন স্বর্গবাসী তা জানতেও পারেন না। জ্ঞানের উচ্চস্তরের সাথে তাদের সম্পর্ক থাকে। সেইজন্য স্বর্গবাসী সর্ব্বদা তার প্রিয়জনকে সুখ শান্তির মধ্যে অবস্থিত দেখেন।
স্বর্গবাসীরা মৃত্যু কি তা জানে না। তারা মানস দেহধারী। আর তাদের সম্পর্কও আমাদের মানসদেহের সঙ্গে। আর এই মানস দেহের কাছে মৃত্যু বলে কিছু নেই। আসলে স্থুল জড়ের আবরণ অনিত্য, বিনশ্বর।  এই অনিত্য বস্তুই আমাদের বিচ্ছেদের কারন। তাই অনিত্য বস্তুর যেখানে অস্তিত্ব নেই, সেখানে মৃত্যুও নেই। পুরানে আমরা দেখি নারদ ব্রহ্মার মানসপুত্র। এই মানসদেহের যেহেতু বিনাশ নেই, তাই নারদেরও  মৃত্যু নেই।

দাম্পত্য প্রেম সব বাসনার মূল :

পরম-আত্মা পরম-ঈশ্বর সমস্ত রসের উৎপত্তি স্থান।  তিনিই রস।  আমাদের মনের যে ভাব তাকে আমরা মনোভাব বলি। এই মনোভাবকেই বাক্যান্তরে বলা হয় রস। কথায় বলে "রসবৈ সঃ" অর্থাৎ তিনিই রস। ভালোবাসার মূল তো সেই অনন্ত অনন্ত অনন্ত পরম-ঈশ্বর পর্যন্ত বিস্তৃত।  এবং এই প্রেম রসের দ্বারা অনুপ্রাণিত। প্রেমই সংসার বন্ধনের প্রধান উপকরণ। কিন্তু সংসার ক্ষণস্থায়ী হলেও প্রেম ক্ষণস্থায়ী নয়। প্রেম অবিনশ্বর।  প্রেমের উপরে কালের কোনো আধিপত্য নেই। প্রেম সবকিছুকে জয় করতে পারে। মৃত্যুকেও সে জয়  করেছে। প্রেম শাশ্বত, অনন্তকালস্থায়ী। মানুষের এই স্থুল দেহের মৃত্যু হলেও আত্মাকে আশ্রয় ক'রে "প্রেম" তার নিজের ধর্ম রক্ষা করে। স্বর্গবাসীর প্রেমিক বা স্বজনদের সাথে মিলনের জন্য প্রেম সেতু হিসেবে কাজ করে। নির্মল, পবিত্র স্বার্থহীন প্রেমের কখনো ক্ষয় নেই। তা সে স্বর্গে গেলেও সেই প্রেম অক্ষুন্ন থাকে। তাই স্বর্গবাসী তার প্রেমাস্পদদের নিয়ে সেখানেও বাস করেন। এ কেবল কল্পনার কথা নয়।  স্বর্গবাসী মাতা তার সন্তানদের নিয়ে, অর্থাৎ মায়ের অন্তঃকরনে অনুভূত যে প্রেম, সেই প্রেমই সন্তানদের স্বর্গলোকে বাস্তব করে তোলে। একথা তো সত্য যে মাতা তখন স্থূল দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন, কিন্তু  মায়ের প্রকৃত সত্ত্বা সন্তান থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হয় না। কারুর কথাই তিনি ভোলেন না। স্বামী, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, আত্মীয়স্বজন,  যখনই যার কথা তার মনে আসে, তখনি তাদের উপস্থিতি তিনি প্রত্যক্ষ করেন। আমাদের দাম্পত্য প্রেম নিতান্তই স্বার্থ জড়িত, এমন ভাবার কোনো কারন নেই। প্রেমই প্রেমের উৎস, প্রেমই প্রেম রাজ্যের অধীশ্বর। প্রেমের ফল স্বরূপ যে তথাকথিত ধর্মাবিরুদ্ধ কাম, তাও ভগবানের দেওয়া। স্বয়ং বিষ্ণু এই রসের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই আমাদের  পুত্র লাভের  ইচ্ছে জাগ্রত হয়। বিত্ত-কামনাও তারই ইচ্ছা। সেই বিরাট পুরুষ একাই ছিলেন। তার কামনার ফলে জায়া অর্থাৎ স্ত্রী  উৎপন্ন হল। আমাদের তিনটি কামনা - পুত্র, বিত্ত, ও হিত (নিজের ও অপরের )।  এর বাইরে কোনো কামনা নেই।

স্বর্গলোকের মিলন, হৃদয় ও মনের মিলনের উপর নির্ভর করে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, যাদের সঙ্গে অন্তরের সহানুভূতির অভাব বা কেলমাত্র বাহ্যিক বা দৈহিক সম্বন্ধ থাকে, তাদের সাথে স্বর্গে মিলনের কোনো সম্ভাবনা নেই। বিচ্ছেদ তাদের সাথেই হয়, যাদের সঙ্গে স্বর্গবাসীর সহানুভূতির অভাব ছিল।

স্বর্গের সাতটি  স্তর  :  

কামনার লোকের মতো বা কামলোকের মতো স্বর্গলোকেও সাতটি স্তর।  নিচের চারটি স্তরকে  বলে "রূপভূমি" । মানস দেহ ধারণ করে, জীব এখানে বাস করে।  এখানে তাদের মূর্তি আছে, স্ত্রী-পুরুষ ভেদ আছে।  পৃথিবীর আত্মীয়স্বজনদের এখানে এসে আমরা চিনতে পারি।  পৃথিবীর স্মৃতিও এখানে সম্পূর্ণ রূপে বজায় থাকে। সাধারণের স্তরের মানুষেরা সাধারণত এখানেই অতিবাহিত করে। উচ্চস্তরে যেতে পারে না। এছাড়া আছে "অরুপভূমি" । এই অরুপভূমিতে জীবের কোনো রূপ থাকে না। কারণ-দেহ অবলম্বন করে, জীব এখানে অল্প সময়ের জন্য বাস করে।  আমরা জানি, পরম-আত্মার জ্যোতি বা রশ্মি জীবের মধ্যে প্রবেশ করে, এবং একে আমরা চৈতন্য বলি। জীব যেখানেই যান না কেন, এই আত্মজ্যোতি তার সঙ্গে থাকে। পরম-আত্মা কিন্তু কোথাও যান না। জ্যোতি সর্বত্র। তাই "যথা জীব তথা জ্যোতিঃ"।

স্বর্গে পার্থিব জীবনের অভিজ্ঞতা শক্তিতে পরিণত হয়। 

স্বর্গে জীব কেবল সুখ ভোগ করে, তাই নয়।  পার্থিব জীবনে, যে অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান সে সঞ্চয় করেছিল, এখানে সেই জ্ঞান শক্তিতে পরিণত হয়। এই শক্তি নিয়েই পুনরায়  মানুষ হয়ে জন্ম গ্রহণ করে। মানুষের মধ্যে ৭টি বৈশিষ্ঠ দেখা যায়। ১. দর্শনিক ভাব  ২. বৈজ্ঞনিক ভাব ৩. কলাবিদ  ৪, ভক্তিভাব  ৫ অনুষ্ঠান প্রিয় ৬. তত্ত্বজিজ্ঞাসু ৭. বীর। মানুষের উন্নতির ধারা, এই ৭টি ভাব বা আদর্শের কোনো না কোনো একটিকে লক্ষ্য করে প্রভাবিত হয়। স্বর্গবাস কালে মানুষ তার অর্জিত জ্ঞান  ও বুদ্ধি দ্বারা চালিত হয়ে পরিণতি লাভ করবার শক্তি সঞ্চয় করে।

এবার আমরা স্বর্গের ৭টি স্তর সম্পর্কে আলোচনা করবো। কিন্তু তার আগে স্তর বলতে কি বোঝায় তা একবার একটু দেখে নেই। প্রাচীন মুনিঋষিগন দিব্যদৃষ্টি বলে  ত্রিলোক (স্বর্গ-মর্ত-পাতাল) এবং ত্রিলোকের বিষয় সম্পর্কে জানতে পারতেন। মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ হলে অনেক রকম বিভূতি লাভ সম্ভব হয়। পতঞ্জলি যোগসূত্রে আমরা সে সব পড়েছি। এই যুগেও অনেক মহাপুরুষ এই শক্তি লাভ করেছেন। তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানই পরাবিদ্যা। স্বর্গের সমস্ত স্তরের সমস্ত বিবরণ ভাষায় প্রকাশ করা শুধু কষ্টকর নয় অসম্ভব। অনির্বচনীয় ব্যাপার সকল বচন  দ্বারা ব্যক্ত  করা  যায় না। সুতরাং বিষয়টি বুঝতে গেলে বিষয়ের গভীরে আমাদের চিন্তাশক্তিকে প্রবেশ করাতে হবে। স্তর মানে একটার পর একটা সাজানো এমনটা নয়। ভিন্ন ভিন্ন লোক, ভিন্ন ভিন্ন দেহ, এগুলোকে আলাদা করা যায় না। সর্ব্বলোক, সর্ব্বস্তর, এবং সবকয়টি দেহ একে অন্যের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। এক স্তর থেকে অন্য স্তরে যাওয়া মানে এই নয় যে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া। জ্ঞানের প্রসার-সংকোচ যেমন স্থানান্তর বা দেহের পরিবর্তন নয়, তেমনি এক স্তর থেকে অন্য স্তরে আমাদের যে জ্ঞান হয় তাকেই এক স্তর থেকে অন্য স্তরে যাওয়া বলে।

 প্রথম স্তর  : মানুষের কাম দেহ ত্যাগ করার পরে, তার স্ব-অর্জিত জ্ঞান ও কর্ম অনুসারে, স্বর্গের নির্দিষ্ট স্তরে গমন করে। মোটা মুক্তি ভাবে বলা যেতে পারে, যিনি সৎ ভাবে জীবন যাপন করেছেন।  নিজের কর্তব্য পালন করেছেন নিঃস্বার্থ ভাবে মানুষকে ভালো বসেছেন, তিনি স্বর্গের নিম্ন স্তরে, কিছুকাল অবস্থান করতে পারেন।  এখানে তিনি মাতৃ স্নেহ, পিতৃস্নেহ, দাম্পত্য জীবনের ভালোবাসা, উপভোগ করেন। এবং সংকল্প সিদ্ধির জন্য শক্তি সঞ্চয় করেন। পরবর্তী মানব জীবনে যা তার সহায় হতে পারে। নিতান্ত দুরাত্মা না হলে  স্বর্গের এই স্তরে সবারই আগমন ঘটে।

এইখানে একটা কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, এই সব স্বর্গবাসী অনেকসময় আমাদের মতো পার্থিব জগতের মানুষের কাছে ইষ্ট  হতে পারেন। আমরা অনেক সময় বাবা-মায়ের মূর্তি বা ছবি নিয়ে উপাসনায় বসতে পারি। এই সময় সেই অরূপ-স্তর স্বর্গবাসীর আত্মার যে বিকীর্ণ জ্যোতিঃ এই সব সংকল্পিত মূর্তি বা ছবিগুলোতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে। এবং আমাদের উপাসনায় তিনি অংশ গ্রহণ করেন।

স্বর্গে আমাদের পূর্বস্মৃতি অক্ষুন্ন থাকে এবং স্বর্গের নিম্নস্তরে তার পার্থিব দেহের অনুরূপ মানস দেহ থাকে। এই মানস দেহে স্বর্গবাসকালে মানুষ তার অর্জিত জ্ঞান ও বুদ্ধি সম্পদ স্বীয় স্বীয় আদর্শের পথে চালিত করে পরিণতি  লাভ করবার শক্তি সঞ্চয় করে। ভগবান কথিত গীতায় আমরা শুনেছি, যারা জ্ঞান মর্গে সাধনা করেছেন, বা ধ্যান মর্গে সাধনা করেছেন, তারা পরবর্তী জীবনে সেই জ্ঞান বর্ধিত করবার সুযোগ পায়। কিন্তু মানুষ যখন স্বর্গের উচ্চ স্তরে যায়, অর্থাৎ যখন তার জ্ঞান, কারন দেহকে আশ্রয় করে, তখন ব্যক্তিত্ব সত্ত্বায় পর্য্যবসিত  হয়। পুনরায় জন্ম গ্রহণ করবার অল্প আগে জীব এই অবস্থা প্রাপ্ত হয়। এখানে দিন রাতের কোনো প্রভেদ নেই।  কামলোকের ভোগ শেষ হয়ে গেলে, তার বাসনা দেহের সমাপ্তি হয়। তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, ও মানস দেহ আশ্রয় করে,স্বর্গলোকে উপস্থিত হয়। নতুন পারিপার্শ্বিক দেখতে পান এবং এক অনির্বচনীয় সুখের অনুভব হয়।  এই আনন্দের মধ্যেই তার স্বর্গের জীবন অতিবাহিত হয়।

স্বর্গবাসী ভাবের আদানপ্রদান করতে পারে।  কিন্তু তা আমাদের মতো বাক্যের দ্বারা নয়। চিন্তাই এই ভাব আদান-প্রদানের মাধ্যম হয়। আমরা শুনেছি, এই পার্থিব জগতেও, চিন্তার মাধ্যমে মহাপুরুষগন ভাবের আদান প্রদান করে থাকেন।  ঠাকুর রামকৃষ্ণ যখন ত্রৈলঙ্গ স্বামীর সাথে দেখা করেছিলেন, তারা মৌন থেকে ভাবের আদান প্রদান করেছিলেন।

দ্বিতীয় স্তর  : স্বর্গের এই দ্বিতীয় স্তরে, ভক্তিমার্গের ভক্তরা বাস করেন। ইহলোকে যারা যে মূর্তিতে আকৃষ্ট ছিলেন, তা সে কৃষ্ণ, বিষ্ণু, শিব, বুদ্ধ, চৈতন্যদেব, বা অন্য যেকোনো মূর্তি হোক।  স্বর্গের এই দ্বিতীয় স্তরে নিজ নিজ উপাস্য দেবতার পূজায় ব্যাপৃত থেকে পরমসুখে সময় অতিবাহিত করেন। ভক্তিমার্গের লোকেরা, ধর্মের সূক্ষ্মতত্ত্ব জানবার দরকার মনে করেন না, এইজন্য তাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি হয় না। কিন্তু স্বর্গলোকে স্বজনগনের সাথে পরম সুখে বাস করেন।  মূর্তিপূজা স্বর্গপ্রাপ্তির অন্তরায় নয়, বরং সাহায্য করে, কিন্তু আত্মার উন্নতির জন্য জ্ঞানমার্গের আশ্রয় নিতে হয়। যারা জড়বাদে বিশ্বাসী, তারা মহা জ্ঞানী হলেও স্বর্গলোকে তাদের জ্ঞানের উন্মেষ হয় না। জড়বাদী মৃত্যুর পরে, কোথায় গেছেন তা বুঝতে পারেন না। এসময় তার শুভানুধায়ী যদি কেউ থাকে, তারা এসে তাকে প্রকৃত অবস্থা বুঝিয়ে দেন। তাই জড়বাদ, স্বর্গবাস বা স্বর্গসুখের অন্তরায়।

তৃতীয় স্তর : যারা ইহলোকে ঈশ্বরে মন সমর্পন ক'রে, বিশ্বমানবের হিত  কামনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন, তারা স্বর্গের এই তৃতীয় স্তরে বাস করেন। বেঁচে থাকা কালীন অবস্থায়, তার যে সব পরিকল্পনা লোকহিতার্থে করবেন বলে ভেবেছিলেন, অথচ করে উঠতে পারেন নি, তার সেই কাজ তিনি এখানে বসে করতে পারেন। কারন সঙ্কল্প দ্বারা এখানে সব উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়। এখানে বসে যে সব সংকল্প করবে, আগামী মনুষ্য জন্মে, স্থূল দেহে জগতে এসে তিনি তা সিদ্ধ করতে পারবেন। কলাবিদ্যার চর্চ্চাকারী  অর্থাৎ সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী এখানেই স্থান পান। অনুন্নত শ্রেণীর মধ্যে  যারা ধর্ম প্রচার করেন, বা অনুন্নত জাতির জন্য যারা প্রাণপাত করেন, তাঁরাও স্বর্গের এই তৃতীয় স্তরে বাস করার অধিকারী হন।

চতুর্থ স্তর :  স্বর্গের এই চতুর্থ স্তরে সাহিত্যিক আচার্য্য , বৈজ্ঞনিক, ঋষিগণ, কলাবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী, ভাস্করগন, এমনকি পরাবিদ্যা অনুশীলনকারী ছাত্র বা তাদের গুরুদেবগন এখানে বাস করেন। এখানে থেকে নিজ নিজ বিষয়ের অনুশীলনে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করছেন। যেসব ছাত্র গুরুকৃপা লাভ করেছেন, বা পৃথিবীতে বাসকালীন, চেষ্টা করেও গুরুকৃপা লাভ কৃপা লাভ করতে পারেন নি, এখানে এসে তাঁরা গুরুদেবের চরণতলে বসে জ্ঞানলাভ করতে পারেন।

পঞ্চম স্তর : এখানে সাধারণ মানুষের স্থিতিকাল অতি সামান্য। জ্ঞানমার্গীরাই এখানে আসতে  পারেন। পৃথিবীতে থাকার সময়, যে যতটুকু জ্ঞান সঞ্চয় করেছেন, এখানে তার অনুশীলন দ্বারা, অর্জিত জ্ঞানকে মানসিক শক্তিতে পরিণত করে, তিনি মানস দেহ ত্যাগ করে কারন দেহ ধারণ করেন। জ্ঞানী জীবের এটাই প্রকৃত বাসভূমি। কিন্তু যতদিন তাদের কর্ম-জীবনের অবসান না হয়, ততদিন এখানে বসবাসের কাল সীমিত থাকে। এখানে এসে জীব তার সমগ্র অতীত জীবনের দৃশ্যপট দেখতে পান। যুগ যুগান্তর ধরে, কি কাজ তিনি করেছে, কোন কোন জন্ম তিনি অতিক্রম করেছেন, তার সঞ্চিত কর্ম কত আছে, এবং তার জন্য তাকে কি করতে হবে, এসবই  অর্থাৎ তিনি তার নিজের অতীত, ভবিষ্যৎ সবই তিনি দেখতে পান। এবং এখানেই তার পুনর্জন্ম গ্রহণের সূচনা হয়। ইহলোকে যারা আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করেছেন, কেবলমাত্র তাঁরাই এখানে  কিছু সময় অতিবাহিত করতে পারেন। এখানে তাঁরা ভৌতিক দাসত্ত্ব মুক্ত হয়ে, মানব জীবনের প্রকৃত মূল্য বুঝে, তার সদ্ব্যবহার করেন।

এই পঞ্চম স্তরে, পৃথিবীর শুরু থেকে বা বলা যেতে পারে সৃষ্টির শুরু থেকে বর্তমান মানব জাতির ক্রমবিবর্তনে যে লক্ষকোটি জীব যোগদান করেছেন, তাদের প্রায় সকলকেই এখানে পাওয়া যায়।  স্বচ্ছ ডিম্বাকৃতি অতি সূক্ষ্ম পদার্থে নির্মিত এইসব জীব প্রথমে বর্নহীন থাকে।  ধীরে ধীরে জন্মে পর জন্ম গ্রহণ করে উন্নত হতে হতে ক্রমশঃ জ্যোতিস্মান হন।  যে সব মহাপুরুষ এই পঞ্চমস্বর্গের মহাপুরুষদের দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছেন, তাঁরা বলেন যে বর্ণনা দ্বারা সে জ্যোতির চ্ছটা বর্ণনা করা যায় না।

এই জ্যোতিই  উন্নত জীবের কারন দেহ । এই জ্যোতিই জীবের প্রকৃত স্বরূপ। এবং এই পঞ্চম স্তরই জীবের প্রকৃত বাসভূমি। স্বর্গের উচ্চস্তরের উপকরণ দ্বারা গঠিত এই কারনদেহধারী আত্মাই "জীব"  নামে  প্রসিদ্ধ। জ্যোতির্ময় আবেষ্টনের মধ্যে এই মানব দেহের আকৃতি দেখা  যায়। মাথা এবং কাঁধ সুস্পষ্ট  এবং পার্থিব জীবনের সুপরিচিত মুখখানি মহিমার আলোকে উদ্ভাসিত, নয়ন জ্যোতি কেন্দ্রীভূত, এবং বুদ্ধিও মানসিক শক্তির পরিচায়ক । এখানে এই পঞ্চম স্তরে, মনের সাথে মনের  অপূর্ব মিশ্রণ, একত্ত্ব-সম্পাদন, ভেদহীন-বিচ্ছেদহীন-বিরামহীন মিলনের চরিতার্থতা এই অরূপ স্বর্গে কারন দেহধারী জীবের পক্ষে সম্ভবপর হয়ে থাকে।

ষষ্ঠ স্বর্গ  বা ষষ্ঠ স্তর : এখানে  কেবলমাত্র জ্ঞানমার্গে যারা উচ্চস্থান অধিকার করেছেন, তাঁদেরই এখানে সজ্ঞানে  থাকা সম্ভবপর। সাধারণ মানুষের এই স্তরে স্থিতিকাল অতি অল্প। তাছাড়া তাঁদের জ্ঞানের লক্ষ্মণ বিশেষ থাকে না। জ্ঞানীগণ এখানে তাদের সঞ্চিত কর্ম ও অতীত জীবন দেখে, ভাবি জীবনের পথ ঠিক করেন। এছাড়া, এখানে কিছু মহাত্মন আছেন, যারা এখানে দীর্ঘকাল বাস করেন, এবং যারা এখানে স্বল্প সময়ের জন্য আসতে পেরেছেন, তাদেরকে সুপথের নির্দেশ দিয়ে থাকেন।

সপ্তম স্বর্গ : সমস্ত স্বর্গলোকের  মধ্যে এটাই সর্ব্ব উচ্চ স্তর। আচার্য্যগণ ও তাদের দীক্ষিত ছাত্রদের আবাসস্থান। পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন, দীক্ষা গ্রহণ না করলে, এখানে কেউ আসতে  পারে না।  জগতে যা কিছু উন্নত ভাব, উন্নত মানসিক শক্তি, আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উৎকর্ষ তা এই সর্বোচ্চ  সপ্তম স্বর্গ থেকে উৎপন্ন।  এই স্তরবাসীগণ  মায়ার বন্ধন  অতিক্রম করেছেন। এঁরা  বার বার ইহলোকে  জন্ম গ্রহণ করলেও, এঁরা  অতীত বিস্মৃত হন না।

এতক্ষন আমরা স্বর্গে জীবের অবস্থান সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। কিন্তু আমরা তো শুনেছি, স্বর্গে সব দেবতা থাকে। স্বর্গের রাজা হচ্ছেন ইন্দ্র। এটা কি গল্পকথা ?  আট রকম  দৈব স্বর্গের কথা দর্শন শাস্ত্রে আমরা দেখতে পাই। এগুলো সাধারণের জন্য আলোচ্য বিষয় নয়।

জ্ঞানমার্গের  শীর্ষে যারা পৌঁছেছেন, যারা জ্ঞানমার্গের আচার্য্য, তারাই দেবযোনি প্রাপ্ত হন। জীব যখন সূক্ষ্ম দেহ ত্যাগ করে স্বর্গলোকে উপস্থিত হন তখন একটা বর্ণচ্ছটা দেখতে পান। এই বর্ণচ্ছটা আর কিছু নয় দেবতাদের ভাবের আদানপ্রদান জনিত বর্ণচ্ছটা।  এই বর্ণচ্ছটা বা রঙ্গিন আলোর আভা আর কিছুই নয়, দেবতাদের  ভাষা। এখানে আর একটা নীহারিকাপুঞ্জ দেখা যায়, যা আসলে স্বর্গাবাসীর চিন্তা বিশেষ।এগুলো জীবনীশক্তি বিশিষ্ট।  স্বর্গবাসী ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগে এই নীহারিকাপুঞ্জকে একত্রিত করে, মূর্তিতে রূপান্তরিত করে, এবং স্রষ্টার  প্রয়োজন সাধন করে।

স্বর্গলোকের প্রধান বৈশিষ্ঠ হচ্ছে, জীবজগতের সমস্ত অতীত ঘটনা এখানে অঙ্কিত থাকে। পৃথিবীর সমুদয় ইতিহাস এখানেই সংরক্ষিত আছে। আকাশ তো শুন্য, যাদের জ্ঞানচক্ষু খুলে গেছে, তারা একে প্রকৃতির স্মৃতিপট মনে করেন। মহর্ষিগন অতীত যুগের সমস্ত ঘটনা এখানে দেখতে পান। অতীত যুগের সমস্ত জ্ঞান এখানথেকে  থেকে সংগৃহিত হয়েছিল, এখনো হচ্ছে। কেবল মানুষ নয় সৃষ্টির প্রথম থেকে যত জীব, জন্তু, কীটপতঙ্গ, উদ্ভিদ ইত্যাদি জন্মেছে, প্রকৃতির এই জাদুঘরে সব সজ্জিত আছে। দিব্যদৃষ্টি সম্পন্ন মহাপুরুষ যে কোনো সময় ইচ্ছা করলে, এখান থেকে সমস্ত ঐতিহাসিক তত্ত্ব সংগ্রহ করতে পারেন।

পৃথিবীতে মানুষের স্থিতি কাল মোটামুটি ৮০ থেকে ১০০ বছর।  কামনা লোকে ২০ থেকে ৩০ বছর, কিন্তু স্বর্গলোকে সহস্র বা ততোধিক বছর অতিবাহিত করেন। কামনার লোকে জ্বালা যন্ত্রণার অবসানে, শান্তিতে দীর্ঘ সময় স্বর্গে বাস করেন। সাধারণ মানুষের এই স্বর্গলোকে অবস্থানের কাল খুব কম। কিন্তু যারা পৃথিবীটিতে থেকে জ্ঞানের উর্দ্ধসীমা বর্দ্ধিত করেছেন, তাদের স্বর্গবাসের সময়সীমা ততো বর্দ্ধিত হয়। এখান থেকে  জীব আবার নতুন যোনিতে ফিরে আসেন।

উদ্ভিদ থেকে মনুষ্যতর জীব ক্রমবিকাশ বলে মানব জন্ম প্রাপ্ত হয়।  মানব জন্মের অভিজ্ঞতা যাদের কম, তারা সাধারণত পাশবিক প্রবৃত্তি অর্থাৎ পূর্বাপর জীবনের প্রবৃত্তি  আঁকড়ে থাকে। ধীরে ধীরে, দীর্ঘকাল ধরে, বার বার মনুষ্য জন্ম লাভের  পর, তার সভ্য হতে পারে। এমনকি সিদ্ধ পুরুষ হতে পারে। আমাদের মধ্যে যারা হিংস্র স্বভাবের তার এই শ্রেণীর মানুষ। এই মানুষেরা স্বর্গের নিম্নস্তরে অধিক সময় অতিবাহিত করে।  এবং ধীরে ধীরে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান সঞ্চয়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা উন্নত মানুষ হয়ে যায়। এই ক্রমবিকাশই সৃষ্টির ধর্ম। ঈশ্বরের রাজত্ত্বে সবারই উন্নত হতেই হবে।  এর কোনো অন্যথা হবে না।

এবার একটা গল্প দিয়ে শেষ করবো। এক বর্ব্বর  সারা দিন খাবার জোগাড় করতে না পেরে, তার স্ত্রীকে খুন করে, তার মাংস খাচ্ছিলো। একজন সভ্য মানুষ  তাকে তার জন্য তিরস্কার করাতে, সে  বলেছিলো, খারাপ কি হলো ? মাংস তো ভালো। তো ভাবুন, স্ত্রীর মাংস যে খাওয়া উচিত নয়, তাকে মারা যে উচিত নয়, এই ভালো মন্দ জ্ঞান ওই বর্ব্বরের নেই। পশুর যেমন ভালো মন্দ জ্ঞান থাকে না। মানুষেরও  জীবনের প্রথম দিকে এই জ্ঞান থাকে না। ধীরে ধীরে মানুষের জ্ঞান উন্মোচনের পরে, সে ভালো মন্দ বুঝতে পারে। সে বিচার করতে শেখে। এই বিচার শক্তি যার যত সূক্ষ্ম সেই-ই তত উন্নত মনুষ্য, সেই স্বর্গবাসের সুযোগ ও সময় বেশি পায়।

ওম সর্ব্বেসাম স্বস্তির ভবেতু। 
ওম সর্ব্বেসাম শান্তির ভবতু।  
ওম সর্ব্বেসাম পূর্নম ভবেতু। 
ওম সর্ব্বেসাম মঙ্গলম ভবতু। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম। ।            
 





           




        





















    

No comments:

Post a Comment