Saturday, 16 July 2022

মাণ্ডূক্য উপনিষদ (শ্লোক ৪৫-৭১)

আমার না আছে জন্ম, না আছে মৃত্যু। 

মূলসূত্র: মাণ্ডূক্য উপনিষদ (শ্লোক ৪৫-৭১)

আমার না আছে জন্ম না আছে মৃত্যু - আমি শুদ্ধ চৈতন্য স্বরূপ । আপনি কি এই কথাগুলো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন ? 

আমরা এই ব্যাপারটা একটু বোঝার চেষ্টা করবো। আমরা অনেকে সেই বিখ্যাত বৈদিক মন্ত্রটির কথা জানি, 

"অহং দেবো ন চান্যোস্মি ব্রহ্মৈবাষ্মিন ন শোকভাক
সচ্চিদানন্দ রুপোঽস্মি নিত্য মুক্ত স্বভাববান।"

আমি দেহ নোই, আমার জন্ম, জরা, মৃত্যু নেই, আমি নিত্য শুদ্ধ আত্মা। 

এই মন্ত্রটি আমরা অনেকেই প্রাতঃকালে পাঠ করে থাকি।  কিন্তু এর মর্মার্থ আমরা জানি না। এই সম্পর্কে আমরা মাণ্ডূক্য উপনিষদ থেকে শুনবো। আসলে, যারা অদ্বৈত বাদে বিশ্বাসী, তাঁরা এই দৃশ্যমান জগৎকে কিছুতেই সত্য বলে মেনে  নিতে চান না। তাঁরা মনে করেন, সমগ্র দৃশ্যমান এই যে জগৎ, তা সর্বৈব মিথ্যা, সত্য হচ্ছে শুধু  শুদ্ধ চৈতন্য।  কিন্তু কথা হচ্ছে, চৈতন্য বা আত্মার না আছে জন্ম না আছে মৃত্যু।  তো এই জগৎ বা আমাদের তো দেহধারীর তো জন্ম মৃত্যু আছে। চৈতন্য বা আত্মা নাকি অক্রিয় অর্থাৎ কিছুই করেন না।  কিন্তু এই জগৎ তো ক্রিয়াশীল। বলা হয়ে থাকে চৈতন্য অনাদি অনন্ত।  কিন্তু এই দৃশ্যমান জগৎ তো অনাদি অনন্ত নয়। বিশেষ করে যে সকল জীবকুল সামান্যতম হলেও  চৈতন্যের অধিকারী, তারা তো কেউ  অনাদি অনন্ত জগতের বাসিন্দা নয়।  এমনকি আমাদের পৃথিবীর উপগ্রহ, চাঁদে গেলেও এদের দেখা মিলবে না। শুধু তাই নয়, হয়তো বরফের জগতে বা মাটির নিচে, অথবা সমুদ্রের গভীরে হয়তো কোনো চৈতন্যবান জীবের, বা কোনো মানুষের  দর্শন পাবেন না। 

অদ্বৈতবাদী  পুরুষগন বলছেন, চৈতন্যের জন্ম হয় না তবু মনে হয়, জন্ম হয়েছে। যেমন আপনার একটি ছেলে হলো, তার নাম রাখলেন, চৈতন্যদেব। আসলে চৈতন্যদেবের জন্ম হয়নি, শুধু এখানে চৈতন্যদেব নাম-রূপের  জন্ম হয়েছে । লোকে মনে করে, একটা নতুন মানুষের জন্ম হয়েছে। জাদুকরের জাদুবিদ্যা প্রদর্শন দেখেছে ? সেখানে জাদুকর একটা সুন্দর ফুল, বা একটা খরগোশের দেহ ধরে আনলেন, শূন্য থেকে । কিন্তু এই যে জন্ম তা সত্য নয়।  একটু পরে, আমরা দেখছি, সেই খরগোশ মঞ্চের মধ্যে হেটে চলে বেড়াচ্ছে। আপনার ছেলে চৈতন্যদেবও হেটে চলে বেড়াচ্ছে।  আসলে দেহস্থিত শুদ্ধ চৈতন্য  হেটে চলে বেড়াচ্ছে।  আপনার ছেলের দেহের পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু শুদ্ধ চৈতন্যের পরিবর্তন নেই। যা ছিল তাই আছে। আসলে, চৈতন্যদেবের যে পরিবর্তন তা এই শুদ্ধ-চৈতন্যের উপরে আমরা আরোপ করছি। এই হলো মায়ার কার্যপ্রণালী। এই সত্য যারা জেনেছে, তারাই অদ্বৈতবাদী। এঁরা কখনও মায়ার দ্বারা অভিভূত হন না। 

মাণ্ডূক্য উপনিষদ, এই বিষয়কে একটা সুন্দর উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন। বলছেন, আলোর রেখা সবসময় সোজা।  কিন্তু যখন আলোর উৎস সেই মশালকে যদি ঘোরানো হয়, তখন আলোর রেখার অন্য রকম দেখায়।  কিন্তু তার মানে এই নয়, যে আলোর রেখা বক্র হতে পারে। আসলে  আলোর রেখার যে ধর্ম্ম অর্থাৎ সোজা থাকা, তার কিন্তু কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। কিন্তু আলোর রেখার মধ্যে যে পরিবর্তন আমাদের মনে হচ্ছে, যা আমাদের ভ্রান্ত দর্শন। একই চৈতন্য কখনো জ্ঞাতা, কখনো জ্ঞেয়, কখনো দ্রষ্টা কখনো দৃশ্য, কখনো কার্য্য কখনো কারন। এই ভাবে জন্ম-মৃত্যু আসলে আরোপিত সত্য, প্রকৃত সত্য নয়। আলো যখন স্থির তখন সেই আলোকে দেখতে পাই না।  যখন যে বস্তুতে প্রতিভাত হয়, তখন সেই বস্তু দেখি মাত্র। আমরা আলোকে দেখতে পাই না। এই যে আলোর রশ্মি, এর মধ্যে কোনো বস্তু নেই। এই আলো  কোনো বস্তু বা বাতি থেকে উৎপন্ন হতে পারে না। আমরা যে সিনেমা দেখি, এগুলো আসলে আলোর প্রতিফলন মাত্র।  এর মধ্যে  কোনো আকার থাকতে পারে না।  কিন্তু আমাদের মন এই আলোর মধ্যে দৃশ্যের এমনকি চরিত্রের কল্পনা করে, বিষয় উপভোগ করছে। এগুলো সবই আমাদের চোখের ভ্রম বৈ  কিছু নয়।  মনের কল্পনা বৈ কিছু নয়। সমস্ত বস্তু সম্পর্কেও এই একই কথা প্রযোজ্য।  আমরা মনে করছি, এগুলোর অস্তিত্ত্ব আছে, তাই সেগুলো আছে। মনের এই রচনা যখন থাকে না তখন সমস্ত বস্তুর অস্তিত্ত্ব বিলোপ হয়।  সাধনক্রিয়ার উচ্চ অবস্থা যাঁরা প্রাপ্ত করেছেন, অর্থাৎ আত্মজ্ঞানী পুরুষ  আত্মার বা চৈতন্যের অপ্রকাশিত অবস্থা সম্পর্কে অর্থাৎ আত্মার স্বরূপকে জানতে পারেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা জানি, কারন বিনা কার্য্য হতে পারে না।  মানুষ থেকে মানুষের জন্ম  হয়, গাছ থেকে গাছের জন্ম হয়, মাছ থেকে মাছের জন্ম হয়। তো একমাত্র বস্তু থেকে আর একটি বস্তুর উৎপত্তি হতে পারে। তো আত্মা বা চৈতন্য থেকে কিভাবে বস্তুর উৎপন্ন হলো ? তো আত্মার স্রষ্টা কে ? আত্মা নিশ্চই আত্মাকে সৃষ্টি করেন নি। আবার বাহ্য বস্তু থেকেও আত্মার সৃষ্টি হয় নি। দেখুন, যতক্ষন আমরা কার্য্য-কারন সম্পর্ককে  গুরুত্ত্ব দেই, ততক্ষন এই যে কার্য-কারন সম্পর্ককে  সত্য বলে মনে হয়। এই কার্য্য-কারন সম্পর্ককে যারা সত্য বলে মনে করেন, তাঁরা দ্বৈতবাদী। কিন্তু সত্য হচ্ছে,  সৃষ্টির গোড়ার দিকে যদি আমরা একটু  দৃষ্টিপাত করি, তবে আমরা স্বীকার করতে বাধ্য হবো, যে একটা সময় ছিল, যখন এই মনুষ্যকুল, জীবকুল, উদ্ভিদকুল, কিছুই ছিল না। তো তখন তাদের অর্থাৎ দ্বৈতবাদীর  দৃষ্টিতেও  নিশ্চয় কিছুই ছিল না। তো এলো কোথেকে ? কাজেই  আমাদের স্বীকার করতেই  হবে, আমাদের স্মরণে আনতেই   হবে, যে একটা সময় ছিল, যখন এক বৈ দুই ছিলই না। আর সেই এক হচ্ছে ব্রহ্ম বা আত্মা বা চৈতন্য, যে নামেই আপনি তাকে ডাকুন না কেন. সেই এক বৈ দুই অবশ্য়ই ছিল না।  

যতক্ষন আমাদের দ্বৈত-বোধ থাকবে, ততদিন দ্বন্দ থাকবে, ততদিন দুঃখ থাকবে। ততদিন আমাদের আসক্তিও  থাকবে। .আর অজ্ঞানতার কারনে,  এই দ্বৈতবোধের ভ্রমজ্ঞান  যখন আমাদের মন থেকে দূর হয়ে যাবে, তখন আমরা সুখী হবো। আর জীবনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে,  এই আত্মজ্ঞান লাভ। 

অজ্ঞ মানুষ মনে করে, মানুষ জন্ম গ্রহণ করে।  আর মানুষ যদি জীবাত্মা হয়, তবে অবশ্যই  জীবাত্মা জন্ম গ্রহণ করে থাকে। আর এই জীবাত্মার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কেননা আমাদের চোখের সামনে জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। এইসব ঘটনা বাহ্যিক ভাবে সত্য হলেও, এ আসলে সেই ভোজবাজির খেলা। জীবাত্মার কখনো জন্ম হয় না। সুতরাং জীব  মরণশীল, বা কেউ অমর এই কথাগুলোর কোনো সত্যতাই  নেই। 

দেখুন, স্বপ্নে আমরা অনেক কিছু দেখি, শুনি।  কিন্তু সেখানে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। এখানে একই মন দুই বা ততোধিক দেখছে। ঠিক তেমনি আমরা জাগ্রত অবস্থায় অবিদ্যার প্রভাবে দুই বা ততোধিক দেখছি। এই দেখার মধ্যে কোনো সংশয় জাগে না।  তো স্বপ্ন  বা জাগ্রত অবস্থায় আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয়, তা আসলে দৃষ্টিভ্রম ছাড়া কিছু নয়। 

আমরা বিশ্বাস করি, স্বপ্নে আমরা যা কিছু প্রতক্ষ্য করছি, তা মিথ্যা, কারন জেগে উঠে আমরা আর সেগুলোকে  দেখতে বা শুনতে পাই না। তাই স্বপ্নে দৃষ্ট ঘটনা সহজেই অবাস্তব বলে মনে করতে পারি। এগুলোকে আমরা আমাদের মনের ভ্রম, বা আমাদের মনের সৃষ্টি বলে উড়িয়ে দিতে পারি। ঠিক তেমনি জাগ্রত অবস্থায় আমরা যা কিছু দেখছি, বা শুনছি, তা কেবল মাত্র জাগ্রত ব্যক্তিরাই দেখতে বা শুনতে পারেন। এইসব ঘটনা বা দৃশ্য কেবলমাত্র জাগ্রত ব্যক্তিই  দেখতে পারেন। একটা ঘরের মধ্যে, এক বিছানায়, আপনি ভাইকে নিয়ে  শুয়ে আছেন। আপনার চোখে ঘুম আসছে না।  আপনার ভাই ঘুমিয়ে পড়েছে।   আপনার ভাই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে, যা আপনি একই বিছনায় শুয়ে থাকলেও দেখতে পারছেন না। কেননা আপনার চোখে ঘুম নেই।  আবার আপনি চেয়ে চেয়ে যে কড়িকাঠ দেখছেন, তা আপনার ভাই দেখতে পারছে না। তো দেখুন, একই বিছানায় শুয়ে আছেন দুইজন। কিন্তু দুজনের দর্শন-অভিজ্ঞতা দুই রকম। জাদুকর একজনকে অস্ত্র দিয়ে দুই টুকরো করে দিলো।  ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে বেরুচ্ছে। দর্শকের আসনে আপনি বসে প্রত্যক্ষ করছেন।  জাদুকর এমনকি জাদুকরের সঙ্গীরা সবাই জানে। যাকিছু দেখছি, তা সত্য নয়। কাউকে মারা বা কাটা হয়নি, আর রক্তও বেরুচ্ছে না। কিন্তু আপনার কাছে, সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছে সব সত্যি। 

তো আমরা পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে যাকে  মারা যেতে দেখছি, বা জন্মাতে দেখছি, তা সত্য নয়। আসলে আমরা যে জন্ম-মৃত্যু পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে জাগ্রত অবস্থায় দেখছি, তা আসলে সত্য নয়। এই জন্ম-মৃত্যু কৃত্তিম, জাদুকরের ভেলকি মাত্র - যা আমাদেরকে বিব্রত করছে, দুঃখী করছে, বা সুখী করছে। বস্তুত কেউ জন্মায় না, কারুর জন্মাবার সম্ভাবনা নেই, বস্তুত কোনো কিছুর জন্ম হবার সম্ভাবনাই নেই। এই হলো পরম সত্য।  আর যার জন্ম নেই, তার মৃত্যুও হতে পারে না। এই হচ্ছে পরম-সত্য। এই চরম সত্যকে উপলব্ধি করতে সাধক যোগক্রিয়াতে লিপ্ত হন। 

সবশেষে ঠাকুর রামকৃষ্ণের একটা গল্প দিয়ে শেষ করি।  এক চাষীর একমাত্র ছেলে মারা গেছে।  স্ত্রী অঝোরে কাঁদছে। চাষী কিন্তু নির্বিকার। তো সবাই জিজ্ঞেস করলো, তোমার মনটা তো শক্ত, তোমার একমাত্র ছেলে মারা গেছে, বাড়ির সবাই শোকাহত, এমনকি পাড়ার সবাই হা হুতাশ করছে, আর তোমার চোখে জল নেই ? কি পাষন্ড তুমি ! তো চাষী বললো, দেখো, ঘুমের মধ্যে আমি স্বপ্ন দেখছিলাম, আমার ৭/৭টি জোয়ান ছেলে, আর আমি এক মস্তবড়ো  দেশের রাজা। তো হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেলো, চোখ মেলে দেখি, কোথায় আমার রাজত্ব, কোথায় আমার সেই সৎগুণের অধিকারী, যুবক ৭টি ছেলে ? ঘুম ভেঙে গেলো, স্বপ্ন ভেঙে গেলো, এখন আমি কার জন্য কাঁদবো ? একটা পুত্রের জন্য না ৭টি পুত্র আর রাজ্ বৈভবের জন্য। আসলে, জ্ঞানীর কাছে, স্বপ্ন আর জাগ্রত অবস্থার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দুটোই মিথ্যে।  

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

----------------       

 










   

No comments:

Post a Comment