মনকে কিভাবে শুদ্ধ করবেন ?
শুদ্ধমনের অধিকারীকে আমরা সবাই শ্রদ্ধা করি। আমরা শুনেছি, একমাত্র শুদ্ধ মনের অধিকারী ভগবানের সান্নিধ্য লাভ করতে পারেন । কিন্তু কিভাবে এই শুদ্ধমনের অধিকারী হওয়া যায়, তা আমরা সবাই জানি না। যোগীপুরুষগন বলে থাকেন, যাঁরা যোগ অভ্যাস করেন, তারা নাকি ধীরে ধীরে শুদ্ধ মনের অদিকারী হয় ওঠেন। যোগক্রিয়া বলতে আমরা কি বুঝি। যোগক্রিয়া কি শুধুই শারীরিক কসরৎ আর শ্বাসের নিয়ন্ত্রণ ? নাকি আরো কিছু আছে ? আজ সেই সম্পর্কে আমরা শুনবো। আবার এটাও শুনবো, কিভাবে এই প্রক্রিয়া মন শুদ্ধিকরনে সাফল্য আনে।
প্রাচীন যুগে এক মহান আচার্য্য সনৎকুমার বলছেন :
আহারসুদ্ধৌ সত্ত্বশুদ্ধিঃ সত্ত্বশুদ্ধৌ ধ্রুবা স্মৃতি
স্মৃতিলম্ভে সর্ব্বগ্রন্থিনাং বিপ্রমোক্ষঃ।
স্মৃতিলম্ভে সর্ব্বগ্রন্থিনাং বিপ্রমোক্ষঃ।
আমরা যে আহার গ্রহণ করি তা থেকে শরীর পুষ্টি লাভ করে। এই আহার যদি শুদ্ধ হয়, তবে আমাদের শরীর শুদ্ধ হতে পারে। এমনকি এই আহার থেকেই মন শুদ্ধ হতে পারে। কেন না মন হচ্ছে খাদ্যের সূক্ষ্ম অংশ। আবার যখন আমাদের মন শুদ্ধ হয়, তখন আমাদের স্মৃতি স্থির হয়। অর্থাৎ এই অবস্থায় আমরা অধ্যাত্ম চেতনায় স্থির হতে পারি। এর ফলে আমাদের হৃদয়ের বন্ধন খুলে যেতে পারে। এমনকি আমরা মুক্তির পথে পা বাড়াতে পারি।
এখন কথা হচ্ছে, আহার কথাটার অর্থ কি ? আহার মানে কি শুধুই খাদ্য, পানীয় ? হ্যাঁ প্রাথমিক ভাবে আহার মানে খাদ্য-পানীয় তো বটেই। পবিত্র ও নিরামিষ খাবার আমাদের শরীরের পক্ষে অবশ্য়ই ভালো। কিন্তু শুধু এই খাদ্য-পানীয় আমাদেরকে শুদ্ধ করে দেবে, এমনটা ভাবার কারন নেই। তা যদি হতো, তাহলে নিরামিষ আহারভোজীদের মধ্যে এতো দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তির দর্শন পাওয়া যেত না। এতো হংসা দেখা যেত না। সাপকে আপনি যতই দুধ-কলা দিয়ে পোষেন, তার মধ্যে থেকে কখনো বিষের মাত্রা কমবে না।
ঋক্বেদের ১/৮৯/৮ নং শ্লোকে একটা সুন্দর প্রার্থনা মন্ত্র আছে। প্রশ্ন উপনিষদের মঙ্গলাচরণে এই মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়। মন্ত্রটি হচ্ছে :
ওঁ ভদ্রং কর্নেভিঃ শৃণুয়াম দেবা ভদ্রং পশ্যম-অক্ষভি-যজত্রাঃ
স্থিরৈ-অঙ্গৈ-তুষ্টুবাংস-তনুভি-ব্যশেম দেবহিতং যদায়ু।
হে দেবগন, আমরা যেন, কান দিয়ে যা কিছু ভালো তাই যেন শুনতে পাই। হে পূজ্যদেবগন, চোখ দিয়ে যা কিছু ভালো, তাই যেন দেখতে পাই। স্থির শরীর ও অঙ্গপ্রতঙ্গ দ্বারা যেন তোমাদের স্তুতি করতে পারি। দেবগন যে আয়ু আমাদের জন্য বিহিত করে দিয়েছেন, তা যেন লাভ করতে পারি। আমাদের শারীরিক ও মানসিক (আধ্যাত্মিক)শান্তি হোক, পরিবেশ ও প্রাকৃতিক (আধিদৈবিক) শান্তি হোক, কীটপতঙ্গ ও হিংস্র প্রাণীর-কৃত বিঘ্নের (আধিভৌতিক) শান্তি হোক।
এখন কথা হচ্ছে, আমরা যেন ভালো কথা শুনি, ভালো কথা বলি, আমরা যেন ভালো কাজ করি। এই যে ভালো, এই ভালো বলতে কি বোঝাচ্ছেন ? যা কল্যাণকর, যা আমাদের পক্ষে অনুকূল - তাই ভালো। দর্শন-শাস্ত্র, যোগশাস্ত্র কঠিন বিষয়। এই বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে গেলে, আমাদের অধিক মনোযোগী হতে হবে। তাই বাজে কথায়, অর্থাৎ অপ্রয়োজনীয় কথায় আমাদের সময় নষ্ট করা উচিত নয়। যা আমাদের পক্ষে যা কল্যাণকর তাই আমরা দেখবো, শুনবো । এতে করে আমাদের জ্ঞান অৰ্জনের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। আমরা আমাদের মনুষ্য শরীর ধারনের উদ্দেশ্যকে সার্থক করতে পারবো। প্রার্থনায় আরো একটা কথা বলা আছে, সেটি হচ্ছে, আমাদের অঙ্গাদি স্থির থাকুক। এই অঙ্গাদি বলতে যেমন স্থূল শরীরকে বোঝাচ্ছে, তেমনি আমাদের মনকেও বোঝাচ্ছে। তো আমাদের মন যদি স্থির হয়, তবে শরীর সুস্থ থাকবে। আবার আমাদের শরীর যদি সুস্থ থাকে তবে আমাদের মন ভালো থাকবে। শরীর অসুস্থ থাকলে, মন বিক্ষিপ্ত হবে। মন সুস্থ থাকলে দেখবেন, শরীরে স্ফূর্তি থাকবে। অর্থাৎ আমাদের মনে ও শরীরে যেন জড়তা না থাকে। দেবতাদের কাছে প্রার্থনা, শরীর ও মন দুইই যেন স্থির থাকে, আমাদের আয়ত্ত্বে থাকে। তো আমাদের এমন ভাবে চলতে হবে, যাতে বিধাতা প্রদত্ত যে আয়ু, তা যেন সম্পূর্ণ করতে পারি।
তো এগুলো আমাদের অভ্যাস করতে হবে। অর্থাৎ মন ও শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য আমাদের এই অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। কিছুদিন এভাবে চললে, দেখবেন, মন কিছুটা শান্ত ও শুদ্ধ হয়েছে। বাজে কথায় সময় অতিবাহিত না করে, কিছুটা সময় ঈশ্বরের নাম-কীর্তন করুন। যেকোনো মহৎ পুরুষের মূর্তির ধ্যান করুন। তাঁর বাণীর কথা, কর্ম্মের কথা স্মরণ মনন করুন। দেখবেন মন শুদ্ধ হয়ে আসছে। ঈশ্বরের নামের জপ করুন। প্রণবের জপ করুন। দেখবেন ধীরে ধীরে আপনার মনের শুদ্ধিকরণ শুরু হয়েছে।
যদি অধিক ফলের প্রত্যাশী হন, তবে ঋষি পতঞ্জলি প্রদত্ত অষ্টাঙ্গ যোগের অভ্যাস করুন। অর্থাৎ যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা,ধ্যান, সমাধি। এগুলোর অভ্যাস করুন।
যম - অহিংসা, সত্যপথে চলা, চুরি না করা, ইন্দ্রিয় সংযম এবং অন্যের দান গ্রহণ না করা। এগুলোকে একত্রে বলা হয় যম।
নিয়ম - দেহ-মনের পবিত্রতা রক্ষা করা, যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা, পরের দোষ না দেখা, নিজেকে একটা কঠোর নিয়মের মধ্যে বেঁধে ফেলা, নিয়মিত সদগ্রন্থ পাঠের অভ্যাস তৈরী করা। সদগ্রন্থের বিষয় নিয়ে মনন করা। এইগুলোকে বলে নিয়ম।
আসন - স্থির হয়ে বিশেষ ভঙ্গিমায় স্থির হয়ে বসে থাকবার অভ্যাস করা।
প্রাণায়াম - যোগগুরুর নির্দেশ মেনে প্রাণকে নিয়ন্ত্রণের কৌশল আয়ত্ত্ব করুন। অর্থাৎ পূরক , কুম্ভক ও রেচক , (৪:৮:১৬) অভ্যাস করুন।
প্রত্যাহার - অর্থাৎ অনাসক্তি। সমস্ত বস্তু বা বিষয় থেকে মনকে সরিয়ে এনে নিজের লক্ষ বস্তুর মধ্যে মনকে স্থির করাকে বলে প্রত্যাহার ।
ধারনা : মনকে অন্তত ক্ষাণিক্ষনের জন্য একটি বিশেষ চেতন-কেন্দ্রে স্থির রেখে মনের মধ্যে ঈশ্বর চিন্তার স্ফূরণ ঘটানো।
ধ্যান : মনকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে ঈশ্বর চিন্তনে স্থায়ী করা।
সমাধি : যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা,ধ্যান, - এই ৭টি ধাপ ঠিক ঠিক মতো পেরিয়ে আসতে পারলে, যে অবস্থা হবে, তাকে বলা হয় সমাধি।
এই সমাধিবান পুরুষ হচ্ছেন যথার্থ শুদ্ধ মনের অধিকারী। তো আমাদের শুদ্ধ মনের অধিকারী হতে গেলে, যেমন আহারাদিতে সংযমী হতে হবে, তেমনি ঋষি পতঞ্জলি প্রদত্ত অষ্টাঙ্গ যোগের অভ্যাস করতে হবে। সব শেষে একটা কথা বলি, বেদ, উপনিষদ, গীতা মুখস্ত করে কিছু হবে না, যতক্ষন না আপনি যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বা ঋষি পতঞ্জলির উপদেশ অনুযায়ী, যোগক্রিয়ায় যুক্ত হচ্ছেন, ততক্ষন আপনার কাছে, সব শোনা কথা হয়ে থাকযে । আপনার মন শুদ্ধ হবে না। আপনার উপল্বদ্ধিতে ঈশ্বর ধরা পড়বে না।
এই যে কতগুলো কথা বললাম, মনকে শুদ্ধ করনের জন্য, এটি কিভাবে কাজ করে ?
প্রথমে বলেছি, আমাদের আহারকে শুদ্ধ করতে হবে, তা সে শরীরের আহার হোক, বা মনের আহার হোক। কথায় বলে, হাতি যেমন খায়, তেমনি হাগে। আপনি যেমন গ্রহণ করবেন, তেমন জিনিসই আপনি ত্যাগ করবেন। এর কখনো অন্যথা হতে পারে না। বিবেকানন্দ বলছেন, তুমি যেমন চিন্তা করবে, তুমি তেমন হয়ে যাবে। চিন্তা হচ্ছে আমাদের মনের আহার, চিন্তার বিষয় বিভিন্ন ইন্দ্রয়ের সাহায্যে গ্রহণ করে থাকে আমাদেরমন । তো আহারে শুদ্ধি এবং চিন্তার মধ্যে শুদ্ধি আনতে পারলে, আমাদের মন শুদ্ধ হবে।
দ্বিতীয়ত : প্রার্থনা। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করুন, প্রার্থনা করুন নিজের শুভবুদ্ধির কাছে, প্রার্থনা করুন নিজের বিবেকের কাছে। যাতে আমাদের ইন্দ্রিয়সকল শুভ বিষয়ে দৃষ্টিপাত করে, শুভ জিনিসে কর্নপাত করে, এবং বাক্যের সংযম আসে। বাজে কথায় সময় নষ্ট করবেন না। বাজে কথায় কান দেবেন না। এতে করে মন আজেবাজে বিষয় মনসংযোগ করবে না, এমনকি সত্ত্বর বৰ্জন করবে। ফলত মন অবশ্যই শুদ্ধ হবে।
তৃতীয়ত : অষ্টাঙ্গ যোগের অভ্যাস করতে হবে। অষ্টাঙ্গ যোগ আসলে আর কিছুই নয়, জীবনকে একটা নতুন ধারায় বইতে দেওয়া। নিয়মিত এই অভ্যাস আপনার প্রাণবায়ুকে স্থির করবে, আর প্রাণবায়ু স্থির হলে, মন স্থির হবে। আর মন স্থির হলে, মনের মধ্যে যে কুবৃত্তি সকল আছে, অশুভ সংস্কার আছে, তার বিলোপ সাধন হবে। নতুন সংস্কারের জন্ম হবে। আপনি হয়ে উঠবেন, একজন নতুন মানুষ। আপনার বুদ্ধি তীক্ষ্ণ হবে, স্মৃতিশক্তি প্রখর হবে, আপনার ধীশক্তি অর্থাৎ বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করবার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। আপনার মধ্যে বিশ্বশক্তির স্ফূরণ হতে থাকবে। তখন আপনি এক শুদ্ধ মনের অধিকারী হয়ে, নির্ভয়ে বিশ্বচরাচরে বিচরণ করবেন।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
No comments:
Post a Comment