০৩.০২.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/২
এবং পরম্পরাপ্রাপ্ত-ইমং রাজর্ষয়ো বিদুঃ
স কালেনেহ মহতা যোগো নষ্টঃ পরন্তপ। (৪/২)
হে পরন্তপ, এইভাবে পরম্পরাগত যোগ রাজর্ষিগন অবগত ছিলেন। পরন্তু কালক্রমে এই যোগ বিনষ্ট হয়।
তো এই যোগবিদ্যা প্রথমে সূর্য, তারপরে মনু, তারপরে ইক্ষাকু, তারপরে সমস্ত রাজর্ষিগন আয়ত্ত্ব করেছিলেন। সূর্য-মনু - ইক্ষাকু অর্থাৎ আমাদের মেরুদন্ডস্থিত আদি জ্যোতিশক্তি, তার পরে মন, তারপরে ধ্যানস্থ সাধক, তারপরে রাজর্ষি। এই রাজর্ষি বলতে কি বোঝায় ? রাজা ও ঋষি। রাজা হচ্ছেন ক্ষত্রিয়শক্তির আধার। আর ঋষি হচ্ছে জ্ঞানের আধার। এই দুয়ে মিলে রাজর্ষি। অর্থাৎ সাধককে প্রথমে তেজশক্তি সম্পন্ন হতে হবে। দৃঢ় সংকল্প ধারণ করবার ক্ষমতা অৰ্জন করতে হবে। তার পরে জ্ঞান অৰ্জন করতে হবে। অর্থাৎ যথাযথ শাস্ত্রবিদ্যা - যোগবিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে, তবেই এই বিদ্যার অধিকারী হতে পারবেন। যখন আপনি যোগ্য হবেন, অর্থাৎ উপযুক্ত অধিকারী হবেন, তখন আপনি গুরুসান্নিধ্যে এসে গুরু কৃপায়, সাধন প্রক্রিয়াগুলোকে হাতে-কলমে পরীক্ষা করতে পারবেন। একেই বলে পরম্পরা। যোগবিদ্যা শুধু তত্ত্বকথা নয়। বই পড়ে, এমনকি কারুর মুখে শুনেও রপ্ত করা যায় না। এই বিদ্যা কেবলমাত্র সক্রিয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই আয়ত্ত্বে আনা সম্ভব।
তো এই বিদ্যার পরীক্ষাগারের শিক্ষক দুর্লভ, আবার উপযুক্ত আধার (শ্রদ্ধাশীল, দৃঢ়চেতা, লক্ষে স্থির) বা ছাত্র আরো দুর্লভ। কেননা এই বিদ্যা হচ্ছে শরীরের ভিতরের কারিগরি বিদ্যা, সূক্ষ্ম শরীরের চিকিৎসা-শাস্ত্র । স্থূল-সূক্ষ্ম এমনকি কারন শরীরের চিকিৎসা চলতে পারে, এই যোগক্রিয়ার মাধ্যমে।
আধুনিক যুগে আমরা সবাই বাস্তবমুখী, বহির্মুখী । সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, এই বিদ্যা আমাদেরকে বাস্তব জগৎ থেকে এক অলীক জগতে প্রবেশ করিয়ে দেয়। আর সেই জগতের সন্ধান আমাদের মতো সাধারনের কাছে নেই। তার এই অলীক জগতের বাসিন্দা আমাদের কাছে এক অদৃষ্টপূর্ব পাগল-প্রায় মানুষ বলে মনে হয়। কেননা পাগলের সংজ্ঞা তো আমরাই ঠিক করেছি।
মহাত্মা গুরুনানক যখন শিষ্যদের দুর্গন্ধযুক্ত মৃত শবের মাংস খেতে বলেছিলো, তখন সবাই ভেবেছিলো - গুরুদেবের একি অনাসৃষ্টি নির্দেশ, বীভৎস প্রস্তাব। গুরুদেব কি পাগল হয়ে গেছেন ? এর মধ্যে কি কোনো আধ্যাত্মিক দিক আছে ? তো কেউ এই কাজ করতে রাজি হয় নি। কিন্তু লহিনা নামক এক শিষ্য, (যিনি গুরু অঙ্গদ নামে পরবর্তীতে খ্যাত হয়েছিলেন ) এগিয়ে গিয়ে সেই মৃত যুবকের মাংসে যখন মুখ লাগলো, তখন সেই পচা-দুর্গন্ধযুক্ত মাংস সুখাদ্যে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। জানিনা এসব গল্প কথা কি না। তবে একথা সত্য, জগতের কতটুকুই বা আমরা জানি, যোগের আশ্চর্য্য ফল সম্পর্কে আমাদের কতোটুকুই বা জানা আছে, যে এই কষ্টকর অথচ অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের দিকে আমাদের আগ্রহ থাকবে। . তাই এই অলীক জগতের বাসিন্দাদের আমরা ঠিক বুঝতেও পারি না। তো আমরা যা বুঝতে পারি না তা হবার বাসনাও আমাদের মধ্যে জাগে না।
তাই যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, কালের বশে, উপযুক্ত অধিকারীর অভাবে, বা প্রচারের অভাবে নষ্ট হতে বসেছে। এখন কথা হচ্ছে, কী সেই বিদ্যা যা আজ আমাদের থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে ?
আমরা দেহ-সর্বস্য জীব। দেহ ভিন্ন আমদের অস্তিত্ত্বে আমাদের বিশ্বাস বা ধারণাই নেই। আসলে আমরা যখন যার মধ্যে প্রবেশ করি, তখন আমরা নিজেকে তাই ভেবে নেই। আর তাই আমরা যখন এই স্থুল দেহের মধ্যে প্রবেশ করেছি, তখন আমরা নিজেকে দেহ থেকে ভিন্ন কিছু ভাবতে ভুলে গেছি। আর ভগবান থেকে পৃথক একটা সত্ত্বার অধিকারী হয়ে, নিজের মধ্যে একটা কর্তৃত্বাভিমান জেগে উঠেছে। আর এই কর্তৃত্বাভিমান আমাদেরকে ত্রিতাপ জ্বালায় দগ্ধ করছে। আমরা ভগবানকে, অর্থাৎ সর্ব্বশক্তিমানকে দেখেও দেখতে পাই না, তাঁকে বুঝতেও পারি না। জীবনের পদেপদে হোঁচট খেয়েও, স্থূল শরীরের অন্তিম পরিণতি জেনেও, আমাদের জ্ঞানের উদয় হয় না। যোগপুরুষ এইখানে সতন্ত্র, তিনি স্থুল শরীরে থেকেও , দেহাদিকে তুচ্ছ জ্ঞান করে, ভগবানের সঙ্গে সঙ্গে থাকেন। আর এই সর্ব্বশক্তিমান ভগবানও তাকে টেনে নিয়ে চলেছেন, সেই পরমপিতার ধামের দিকে। হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে যেমন মাতা-পিতা সঠিক রাস্তার সন্ধান দিয়ে বাড়ি নিয়ে আসে। তেমনি যোগস্থ পুরুষকে স্বয়ং ভগবান রাস্তার হদিস দিয়ে থাকেন। যোগস্থ পুরুষ বিবেকবাণী শুনতে পান।
ভগবান বলছেন নিষ্কাম কর্ম্ম করতে। দেখুন, আশু সুফল দেখেও আমরা কর্ম্মে আগ্রহী হই না। আমরা জানি ভালোভাবে পড়াশুনা করলে, আমার পরীক্ষার ফল ভালো হবে। আমরা জানি, ভালো কাজ করলে, আমার মাস-মাইনে বাড়তে পারে, আমরা জানি, অন্যের জন্য কিছু করলে, সেও একদিন আমার হয়ে কাজ করে দেবে। আমরা জানি, আজ কাউকে হাসপাতালে পৌঁছে দিলে, কাল হয়তো সে আমাকে সাহায্য করবে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, আমরা তা করি না। আমরা তমসায় আচ্ছন্ন। আমরা অলস। আমাদের মধ্যে সেই ক্ষাত্র-শক্তি নেই। আমরা তেজস্বী নোই। আমাদের ধৈর্য্য কম। আমরা কোনো কাজে বেশিদিন লেগে থাকতে পারি না। তো নিষ্কাম কর্ম্ম তো দূরের কথা, ফালাকাঙ্খী হয়েও আমরা সঠিক কাজ করতে চাই না। আজ এমন একটা সময় চলছে , যেখানে মানুষ বিনা পরিশ্রমে সহজে সবকিছু পেতে চাইছে। লটারির টিকিটের বিক্রি হুহু করে বেড়ে চলেছে। আমরা বলি বেকারত্ত্ব বেড়েছে। সত্যিই আজ বেকারের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু সত্য হচ্ছে সবাই আমরা সুরক্ষা চাইছি, অল্প পরিশ্রমে বেশি রোজগার করতে চাইছি, তাই পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে। বাংলায় কাজ নেই বলে নয়, বাংলার কাজে বেশী পয়সা নেই বলে, মানুষ দূর দূরান্তে ছুটছে। অল্প পরিশ্রমে বেশী আয় করতে চাইছে। এমনকি আমাদের মধ্যে নীতিজ্ঞানের লোপ পেয়েছে। আমরা পরিশ্রম বিমুখ হয়ে পড়েছি। এই চিত্র শুধু বাংলা বা ভারতের নয়, এই চিত্র আপনি বহু দেশের মধ্যেই দেখতে পারবেন। আসলে কাজ তৈরী হয় না, কাজ তৈরী করে নিতে হয়। অলস কাজের সন্ধান পায় না, আর কাজের লোকের হাতে কাজ ফুরায় না।
এবার আমাদের আসল কথায় আসি, নিষ্কাম কর্ম্ম শুধু মুখের কথায় হয় না। আবার মনে মনে চিন্তা করলেও হয় না। আমরা দেহ-ইন্দ্রিয়ের সাথে এমন ভাবে মিশে আছি, যে আমাদের যে একটা পৃথক সত্ত্বা আছে, তা আমরা বিস্মৃত হয়েছি। আমাদের কর্তৃত্বাভিমান এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে, যে আমাদের শরীরের সহস্র নাড়ীমুখ এই কর্তৃত্ব অভিমানী স্রোত দ্বারা প্লাবিত। আজ আমাদের জ্ঞানস্রোত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। আজ যে নাড়ীমুখে এই অভিমান প্রসারিত, সেই নাড়ীমুখ শোধন করতে হবে। এই নাড়ীমুখ শোধন করাই ভূতশুদ্ধির সাধনক্রিয়া। আর ভূতশুদ্ধির জন্য আমাদের প্রাণায়াম ও ওঙ্কারের ক্রিয়ার প্রয়োজন। একেই বলে যোগ কৌশল। এই কৌশলে কুশলী হতে পারলে আমাদের প্রকৃত জ্ঞান লাভ সম্ভব। বিরল কিছু জন্মসিদ্ধ পুরুষ আছেন, যাদের আগে থেকেই ভূতশুদ্ধি করতে পেরেছেন। এঁদের সংস্কার সম্পূর্ণ আলাদা। এঁদেরকে বাদ দিয়ে, বাকিদের অবশ্যই যোগাভ্যাসে যত্ন নেওয়া উচিত। দিনের ২৪ ঘন্টার মধ্যে অন্তত ঘন্টাখানেক আসুন আমরা ভাগবৎচিন্তায় অতিবাহিত করি। ফিরে আসুক আবার সেই দিন। যেদিন মানুষে মানুষে কোনো ভেদ বুদ্ধি থাকবে না। যেদিন, আমরা সবাই আত্মা - এইবোধে নিজেকে ভাবিত করতে পারবো। আর ভগবানের সান্নিধ্য অনুভব করতে পারবো।
----------------------------------------
০৪.০২.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/৩
স এবাযং ময়া তে অদ্য যোগঃ প্রোক্তঃ পুরাতনঃ
ভক্তোঽসি মে সখা চেতি রহস্যং হি-এতৎ-উত্তমম্। (৪/৩)
তুমি আমার ভক্ত ও সখা, এইজন্য সেই বহুপুরাতন যোগের বিষয় আজ তোমাকে বললাম। এ এক রহস্যজনক উত্তম- তত্ত্ব।
এই যোগ নতুন কিছু নয়, বহু পুরাতন। জীব সৃষ্টির প্রথম থেকেই এই যোগ-এর প্রচলন শুরু হয়। সৃষ্টির প্রথমে স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির ভেদ বা অন্তর সামান্যই ছিলো। তাই যোগের শক্তি-প্রভাব বেশি ছিল। ধীরে ধীরে সন্তান বড়ো হবার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বা জীবকুল তার মাতা-পিতার কাছ থেকে দূরে সরে যায়। একসময় মাতা পিতার সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখন সে যোগ রোহিত হয়ে পড়ে। একসময় সন্তান মায়ের প্রাণের সঙ্গে একত্রে ছিল, মায়ের শরীরের সঙ্গে মিশে ছিলো, ভূমিষ্ট হবার সঙ্গে সঙ্গে সে মায়ের দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু যতদিন সে অসহায় থাকে, যতদিন সে মায়ের মুখাপেক্ষী থাকে, ততদিন সে মায়ের পরশ থেকেও বঞ্চিত হয় না। ধীরে ধীরে একদিন আসে, যখন সে বাহ্য জগতের আকর্ষনে সংসারের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে, আর মায়ের কথা তার আর স্মরণে আসে না। একেই বলে যোগ-রোহিত অবস্থা। তো পৃথিবীতে জীব সৃষ্টির কাল যত দীর্ঘায়িত হবে, জীব তত শ্রষ্টার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে। এটাই কালের নিয়ম। এই কালের প্রভাবেই মানুষের মন মলিন হয়েছে। মন থেকে ঈশ্বরপরতন্ত্রতা ভাব ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে গেছে। এখন সে প্রকৃতিকে বশ করতে শিখেছে, এখন সে আর প্রকৃতির উপরে নির্ভরশীল নয়। তাই যোগের প্রতি তার অনুরাগ কমে গেছে।
ভগবান যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ যখন জন্মেছিলেন, তখন ছিল যুগের একটা সন্ধ্যিক্ষন। দ্বাপর যুগের শেষ কলিযুগের প্রারম্ভ। এই দ্বাপরের অন্তিমকালে আর কলির প্রারম্ভে অর্জ্জুন কে অর্থাৎ সখা ও ভক্তকে এই রহস্যের কথা বলছেন। অর্থাৎ এর আগে তিনটি যুগের সমাপ্তি ঘটতে চলেছে । অর্থাৎ পৃথিবীর জীবকুল শৈশব, যৌবন, প্রৌঢ় অবস্থা কাটিয়ে এখন বৃদ্ধাবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে। অর্থাৎ অন্তিম যুগে পা রাখছে চলেছে। এইসময় অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষের বৃদ্ধাবস্থায় ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য বাড়ে। প্রাচীন কালে মানুষের চারটি আশ্রমের ব্যবস্থা ছিল, ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ, বানপ্রস্থ ও সন্যাস। এই বানপ্রস্থের মানুষ ছিল সংসারত্যাগী। এঁরাই জ্ঞানের চর্চ্চা করতেন। এঁদের দ্বারাই সমস্ত শাস্ত্রগ্রন্থ রচনা করা সম্ভব হয়েছে। এঁরা ছিলেন, সংসারত্যাগী কিন্তু শান্তিপ্রিয়। এঁরা জ্ঞানের গভীর প্রবেশ করতে পেরেছিলেন।
এখন কথা হচ্ছে, এই কলির প্রারম্ভে শ্রীকৃষ্ণ কেন এই গুহ্য রহস্যের সন্ধান দিচ্ছেন ? তার কারন হচ্ছে, এই কলিতে মানুষের শরীরে কালের প্রভাব বেশি করতে পড়বে। আর এই কালের প্রভাবে, মানুষের মধ্যে রোগ-শোক-জরা-ব্যাধির প্রকোপ বাড়বে। কিন্তু অধিকারীর অভাবে, এই যোগের প্রচার বন্ধপ্রায় হয়ে যাবে। অথচ এইসময়ই মানুষের যোগের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। তাই উপযুক্ত অধিকারী হিসেবে, অর্জ্জুনকে বেছে নিয়ে, যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এই যোগধর্ম্মের প্রচার করছেন। অর্জ্জুন একদিকে তার সখা অর্থাৎ সম-মনোভাবাপন্ন । অন্যদিকে অর্জ্জুন ভক্ত অর্থাৎ ভগবানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আপনি যদি কারুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হতে পারেন, তবে তাঁর কথায় আপনি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারবেন না। এইজন্য প্রকৃত ভক্তের কাছেই নিগুড় তত্ত্বের প্রকাশ করা উচিত। আবার সখা - অর্থাৎ যিনি সম্মনোভাপন্ন তার কাছে, সমস্ত ভাবের কথা স্পষ্ট ভাবে উন্মুক্ত হয়। সমভাবাপন্ন না হলে, ভাবের বিনিময় হতে পারে না। যিনি সাধন ক্রিয়ায় নিরন্তর লেগে আছেন, যিনি ভগবানের সঙ্গ নিরন্তর ভোগ করছেন, তিনিই ভগবানের সখা। অর্জ্জুন নিজেও জন্ম জন্মান্তরের সাধক। মহাভারতের কথা অনুযায়ী, অর্জ্জুন এর আগের জন্মে "নর" নামে এই "নারায়ণ" অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের সাথেই ধ্যান-সাধনা করতেন। কিন্তু আজ তাঁর সেই স্মৃতি নেই। কিন্তু অর্জ্জুন তো অর্জ্জুনই আছেন। তো অর্জ্জুন এই অধিকার-সম্পন্ন নরশ্রেষ্ঠ। অধিকারী ভিন্ন এই যোগের মর্মকথা বোঝা সম্ভব নয়, আর বুঝলেও এই যোগে নিজেকে নিয়োজিত করা সম্ভব নয়। তাই ভগবান যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ যোগের গূঢ় রহস্য অর্জ্জুনের কাছে উন্মুক্ত করলেন। আসলে মনি রত্নের মূল্য সে-ই বোঝে যার মনি রত্ন সম্পর্কে জ্ঞান আছে, আর গুরুবাক্যের মর্ম্ম সেই বোঝে যার গুরুবাক্যের প্রতি শ্রদ্ধা আছে। তা না হলে মনি-রত্ন অজ্ঞানীর কাছে, পাথর বই কিছু নয়। তাই তত্ত্বকথা তাকেই বলা উচিত, যার বোঝার ক্ষমতা আছে। নতুবা ভষ্মে ঘি ঢালা ছাড়া কিছু নয়। এই অমৃত কথা তাঁরই কর্ণকুহরে প্রবেশ করুক, যিনি ওঙ্কারে মত্ত হয়ে আছেন।
--------------------
০৫.০২.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/৪
অর্জ্জুন উবাচ :
অপরং ভবতো জন্ম পরং জন্ম বিবস্বতঃ
কথম-এতৎ-বিজানীয়াং ত্বমাদৌ প্রোক্তবানিতি। (৪/৪)
অর্জ্জুন বললেন, তোমার জন্ম পরে, আর বিবস্বানের অর্থাৎ সূর্য্যের জন্ম আগে হয়েছে, সুতরাং কেমন করে বুঝবো যে, তুমি আদৌ অর্থাৎ পূর্বে তাঁকে এই জ্ঞানের উপদেশ দিয়েছিলে।
আমরা শ্রী গীতার এই অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকের আলোচনায় শুনেছি, "আমাদের হৃদয় আকাশে যে কোটিসূর্য্যের প্রকাশ, যে জ্যোতির্ময় মন্ডল, যা সাধক যোগক্রিয়ার সাহায্যে অনুভব করতে পারেন, তাঁকেই বলা হয় বিবস্বান বা সবিতা বা সুর্য্য। এই সূর্য্যের প্রকাশে সাতটি লোক, অর্থাৎ ভূঃ, ভুবঃ স্বঃ, মহঃ, জনঃ, তপঃ, সত্যম ইত্যাদি প্রতিনিয়ত প্রকাশিত। এই সবিতামন্ডলের মধ্যে দৃষ্টিগোচর হয় শ্যাম বর্ণের পুরুষ। এঁকেই বলা হয় "নারায়ণ"। এই নারায়ণ স্বয়ং যোগশাস্ত্র "শ্রী-গীতার" বক্তা। ইনিই যজ্ঞেশ্বর, সর্ব্বকর্ম্মের ফলদাতা। তিনি এক, অখন্ড, সর্ব্বব্যাপী বাসুদেব হলেও সত্ত্বপ্রধান ব্রহ্মা-অনিরুদ্ধ, রজঃপ্রধান বিষ্ণু-প্রদ্যুম্ন, এবং তমঃপ্রধান শিব-সঙ্কর্ষণ রূপে জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-সংহার কার্য্য পরিচালনা করছেন। সবিতামন্ডলের সুবর্ন-কিরণরাশি এই গোলকপতির মহিমা। ইনিই নির্বিকার হয়ে সমস্ত প্রাণীর কূটস্থে অবস্থান করছেন। অথচ তাঁর প্রকাশিত জ্যোতিঃছটা সারা বিশ্বকে উদ্ভাসিত করে রেখেছে। এই জ্যোতিচ্ছটাই সূর্য্য। সৃষ্টির প্রথমে এই জ্যোতির প্রকাশ ঘটে থাকে, তাই এঁকে বলা হয়, আদিত্য। অর্থাৎ আদি সৃষ্টি। এই আদিত্য থেকেই সমস্ত বিশ্বের উৎপত্তি তাই এঁকে সবিতাও বলা হয়ে থাকে।পুরুষত্তম হতে সমস্ত জ্ঞানশক্তি প্রথম সঞ্চারিত হয় এই সূর্যমন্ডলে। তাই শ্রীগীতায় বলা হয়েছে, "প্রথম জ্ঞান দান করলেন বিবস্বান বা সূর্যকে।"
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কি অর্জ্জুন শ্রীকৃষ্ণকে চিনতে পারে নি ? অর্থাৎ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন যে শ্যামসুন্দর সারথি, সে একজন সাধারণ মানুষ নন। তাকে দেখতে তো অর্জ্জুনের মতোই একজন সুপুরুষ বই তো কিছু নয়। আসলে ভগবানকে চেনা সহজ নয়। যতক্ষন তিনি ধরা না দেন, ততক্ষন তিনি সবার কাছেই অধরা। দেখুন একজন জ্ঞানী ও একজন অজ্ঞানীর মধ্যে চেহারার কোনো পার্থক্য থাকে না। জ্ঞানী হলেই তার দশটা হাত বা পাঁচটা মাথা হয় না। আবার কেউ অজ্ঞানী হলে তার মাথায় দুটো শিং গজায় না। মানুষ দৈহিক দিক থেকে সবাই কম-বেশি একই রকম। যদিও কারুর সঙ্গে কারুর মিল নেই। তথাপি একথা বলা যেতেই পারে, সারা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে একটা সাদৃশ্য আছে। তো অর্জ্জুন ও শ্রীকৃষ্ণের চেহারার মধ্যেও একটা সাদৃশ্য আছে। এখন কথা হচ্ছে, শ্রীকৃষ্ণ যে অর্জ্জুন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, এবং শ্রীকৃষ্ণ যে যোগেশ্বর, শ্রীকৃষ্ণ যে একজন রাজর্ষি, শ্রীকৃষ্ণ যে অসীম জ্ঞানের ভান্ডার তা তার আচরণ, তার কথাবার্তা, তার চলন-বলন থেকে বুঝে নিতে হয়। এক-একটা মানুষের মধ্যে এক-এক সময় বিশেষ বিশেষ ক্ষমতার প্রকাশ ঘটে। এই যে বিশেষ ক্ষমতা, এটি তার স্বাভাবিক ক্ষমতা থেকে অধিকগুন বেশী। একজন সমাধিস্থ পুরুষ, একজন যোগীপুরুষ আর একজন সাধারণ মানুষের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। এই পার্থক্য আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে ধরা পড়ে না। কিছু যোগপুরুষ আছেন, তাদের ক্ষমতার মূল্যায়ন আমাদের মতো সাধারণ মানুষ করতে অক্ষম। আবার সাময়িক ভাবেও অনেক সময় আমাদের মধ্যে ক্ষমতার তারতম্য দেখা যায়।
একটা বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। বাড়ির সবাই ডাকাতের ভয়ে পালিয়েছে। তো বাড়িতে বারো ও চোদ্দ বছরের দুজন কিশোর কিশোরী ছিল। তাদের কি মনে হলো, বাড়ি থেকে সিন্দুকটা টেনে নিয়ে, বাড়ির পিছনের জঙ্গলে নিয়ে ঢেকে রাখলো। পরদিন সকালে যখন সবাই সেই সিন্দুকের সন্ধান পেলো, তখন সেই সিন্দুক বাড়িতে আনতে ৮/১০জন লোক লেগেছিলো। আমাকে ক্ষমা করবেন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের যারা ভক্ত, তারা এই রক্তমাংসের দেহধারী শ্রীকৃষ্ণকে স্বয়ং পরম-আত্মা পরম পুরুষ বলে পূজা করে থাকেন। এমনকি শ্রী-গীতার মর্মকথা কিছু না বুঝে লাল শালুতে মুড়ে আসনে রেখে জল-তুলসী দিয়ে পুজো করেন। গীতা জয়ন্তী পালন করে থাকেন। তাঁরা তাদের পুজোপাঠ নিয়ে থাকুন, আমরা ভগবানের মুখনিঃসৃত বাণীর যথার্থ অর্থ নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী বুঝবার চেষ্টা করছি, এখানে বাঁধ সাধবেন না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের পূজা পাবার যোগ্য এব্যাপারেও আমাদের কোনো সন্দেহ নেই। কেননা তিনি ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ। আর ব্রহ্মজ্ঞের কাছে কিছুই অজ্ঞেয় থাকে না। তিনি নিজেই তখন ব্রহ্ম হয়ে যান। কিন্তু অর্জ্জুন তা এখনো বুঝতে পারে নি। আসলে এই যে জিজ্ঞাসা, অর্জুনের মুখে আমরা শুনলাম, অর্থাৎ সূর্যের জন্ম হয়েছে আগে, আর তুমি শ্রীকৃষ্ণ অর্থাৎ তোমার এই দেহরুপী ,শ্রীকৃষ্ণ জন্মেছ পরে, তাহলে তুমি কিভাবে সূর্যকে এই যোগবিদ্যা দান করেছিলে ? এই প্রশ্ন একজন সাধারণ মানুষ করতেই পারেন। এই প্রশ্নের জবাব আছে, মহাভারতের অনুগীতা পর্বে। আমরা সেখান থেকে শ্রীকৃষ্ণের মুখের কথা শুনে নেবো। (পৃষ্ঠা - ১২৯২ - মহাভারত - শ্রী কালীপ্রসন্ন সিংহ অনূদিত)
শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, " ধনঞ্জয়, আমি তোমার নিকট নিগূঢ় ধর্ম্ম ও নিত্যলোক-সমুদয়ের বিষয় কীর্তন করিয়াছি। তুমি যে বুদ্ধিপূর্বক সে সকল বিষয় অবধারণ কারো নাই, এতে আমি যাহার-পর-নাই দুঃখিত হইতেছি। পূর্বে তোমার নিকট যাহা যাহা কহিয়াছিলাম: তৎসমুদায় এক্ষণে আমার স্মৃতিপটে উদয় হইবে না। বিশেষতঃ আমার বোধ হইতেছে ; তুমি অতি নির্বোধ ও শ্রদ্ধাশূন্য; অতয়েব আমি আর কোনোক্রমেই তোমাকে তাদৃশ উপদেশ প্রদান করিতে পারিব না। সেই ধর্ম্মোপদেশ প্রভাবে ব্রহ্মপদ অবগত হইতে সমর্থ হওয়া যায় ; এক্ষণে পুনরায় আমি তাহা সমগ্ররূপে কীর্তন করিতে পারি না। আমি তৎকালে যোগযুক্ত হইয়া সেই পরব্রহ্ম প্রাপক বিষয় কীর্ত্তন করিয়াছিলাম।" কথাটা খেয়াল করুন, যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, সেইসময় অর্থাৎ কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের প্রারম্ভে শ্রীকৃষ্ণ যা বলেছিলেন, তা আসলে যোগ অবস্থাতেই বলা সম্ভব। এই উচ্চকোটির জ্ঞান একমাত্র যোগ-সাধনার উচ্চ অবস্থায় প্রাপ্ত হয়ে থাকে।
অর্জ্জুনের সন্দেহ হবার যথেষ্ট কারন আছে। অর্জ্জুন এখনও জানেন না যে পরব্রহ্ম ভগবান নাম-রূপ বর্জিত। আবার তিনি নাম-রূপের বিবর্জিত হলেও তার চিন্ময় রূপ আছে। উহাই চিদাকাশরূপ। সমস্ত রূপের আদিরূপ হচ্ছে এই চিদাকাশ রূপ। যা আমাদের সবার ভিতরেই আছে। একেই পরাপ্রকৃতি বা শ্যামা বলা হয়ে থাকে। একেই বলে অরূপের রূপ। এর আগে সমস্ত অরূপ নিজবোধ মাত্র - অর্থাৎ চিদ্রূপ। আসলে অর্জ্জুন জানেই না যে শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে যে রূপের চ্ছটা সেটি তার নিজের মধ্যেও আছে। শুধু তাই নয়, এই চিদাকাশরূপ সকল জীবের মধ্যেই একরকম। আসলে সাধনার প্রথম অবস্থায় এই দর্শনলাভ হয় না। সাধক প্রথমে দেখে জ্যোতির্ময়রূপ সূর্য। তাই অর্জ্জুন অবাক হলো, যে সূর্য্যই তো প্রথম তাহলে তুমি কৃষ্ণ তার আগে কিভাবে হলে ? অর্জ্জুন জানে না ওই শ্যামসুন্দরের অঙ্গজ্যোতিই আসলে জ্যোতির্ময় সূর্য্যমন্ডল। সেই মহাপ্রাণের বিকশিত রূপই আসলে বিকশিত সূর্য্য। আবার এই সূর্য্যজ্যোতি থেকেই এই বৈচিত্রময় রূপ-সংসারের উৎপত্তি। আবার এই জ্যোতির্ময় মন্ডলের মধ্যে অসংখ্য তারকাসম বিন্দু জ্বলজ্বল করছে। একেই বলে জীব-চৈতন্য, আমি-রূপ অহঙ্কার। যেহেতু এই নক্ষত্রসম আলোরবিন্দুর মধ্যে অহং জ্ঞান স্ফূরিত হচ্ছে, তাই এঁকে বলে অহঙ্কার। এইযে বিন্দুরূপ অহঙ্কার এও সেই চিদাকাশের ক্ষুদ্রতম শক্তি। এঁদের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নেই, কেবল রূপের ভেদ মাত্র।
সাধকের কাছে প্রথমে প্রকাশিত হয় কূটস্থ জ্যোতি, তারপরে বিন্দু। সাধক তখনও বুঝতে পারে না যে অনন্ত চিদাকাশের মধ্যেই চিদ-জ্যোতি স্ফূরিত হচ্ছে। চিদাকাশে যে ব্রহ্মের স্ফূরণ তাই আসলে চিদ-জ্যোতি বা কূটস্থের জ্যোতি। ব্রহ্ম আসলে রূপ-বর্জিত একটা অবিকারী, অবিনাশী সত্তা মাত্র। ইনি শুদ্ধ সাক্ষীমাত্র। এঁর নাম বা রূপ আবরণ মাত্র যা আদি প্রকৃতির গুনের বৈষম্য থেকে সম্ভব হয়েছে। আবার এই নাম-রূপাত্মক আবরনের মধ্যে চৈতন্যের যখন স্ফূরণ হয়, তখন হয় জন্ম। এঁকেই বলে নামধারী। প্রকৃতির ক্ষেত্ৰস্থিত মন-বুদ্ধি-অহঙ্কার-ইন্দ্রিয়াদি ধীরে ধীরে স্থুল দেহক্ষেত্রের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। আর দেহক্ষেত্রের মধ্যেই চৈতন্য স্ফূরিত হতে থাকে। আর এর ফলেই জড়পদার্থ চৈতন্যবৎ মনে হয়। একেই প্রতিবিম্বিত চৈতন্য বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ একটা চৈতন্যের আভাস দেখা যায়।
অব্যক্ত চিদাকাশকে বলা হয় ব্রহ্মযোনি। অর্থাৎ জগতের মাতৃস্বরূপা। আর পুরুষত্তম হচ্ছেন বীজ-প্রদ পিতা। আত্মা অব্যক্ত চিদাকাশরূপ প্রকৃতির গর্ভে চৈতন্যরূপ বীজ প্রদান করে থাকেন। এই চিদাকাশে যে অতি উজ্বল জ্যোতিঃ পরিলক্ষিত হয়, তা আসলে সেই শ্যামসুন্দরের চিদ-জ্যোতি। এঁকেই বলে বিবস্বান বা সূর্য্য।
মুণ্ডক উপনিষদে শ্লোক ৩/১/২) বলা হচ্ছে জীবাত্মা ও পরমাত্মার সঙ্গে একই গাছে অর্থাৎ একই দেহে থাকলেও জীবাত্মা তার নিজ স্বরূপ সম্পর্কে অজ্ঞ। আর এই কারনে তাকে নানান দুঃখ ভোগ করতে হয়। কিন্তু যখন তার স্বরূপ জ্ঞান হয় তখন সে সুখ-দুঃখের পারে চলে যায় এবং নিজ মহিমা উপলব্ধি করে।
পরবর্তী শ্লোকে বলছেন,
যদা পশ্যঃ পশ্যতে রুক্মবর্নং কর্তারমীশং পুরুষং ব্রহ্মজনিম্।
তদা বিদ্বান পুন্যপাপে বিধূয় নিরঞ্জনঃ পরমং সাম্যমুপৈতি। মুণ্ডক উপনিষদ শ্লোক : (৩/১/৩)
যখন সাধক তার নিজ স্বরূপকে উপলব্ধি করেন, অর্থাৎ যখন তিনি এই জ্যোতির্ময় স্রষ্টা, ব্রহ্মযোনিম অর্থাৎ ব্রহ্মার কারন সেই হিরণ্যগর্ভ পরমপুরুষ ঈশ্বরকে উপলব্ধি করেন, তখন তিনি পাপ পুণ্যের উর্দ্ধে চলে যান. নির্লিপ্ত ও পবিত্র হয়ে পরম সাম্য লাভ করেন। অর্থাৎ সাধক তখন সব কিছুর সাথে এমনকি ব্রহ্মার সাথেও একত্ত্ব প্রাপ্ত হন।
আমরা জীবাত্মা ও পরমাত্মাকে পৃথক বলে মনে করি। আমাদের মনে হয়, জীবাত্মা অতি ক্ষুদ্র, আর পরমাত্মা অতিবৃহৎ। আসলে এই ধারণা আমাদের অজ্ঞানতা থেকে হয়ে থাকে। কিন্তু যিনি ব্রহ্মজ্ঞপুরুষ সত্যকে লাভ করেছেন, তার কাছে আগে-পরে, ছোট-বড়ো, জীবাত্মা-পরমাত্মা বলে আলাদা কিছু নেই। সবই এক ও অভিন্ন। তাইতো শ্রীকৃষ্ণ একসময় বলছেন, অর্জুন তুমিও যা আমিও তাই। অর্জ্জুন শ্রীকৃষ্ণকে আলাদা করে দেখছেন, ব্রহ্মজ্ঞ শ্রীকৃষ্ণ কাউকেই আলাদা করে দেখতে পারেন না। শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের মধ্যে কোনো ভেদ নেই, পার্থক্য হচ্ছে জ্ঞানের। এখন কথা হচ্ছে, এই অবস্থা কি করে হয় ? মুণ্ডক উপনিষদ বলছে, কায়মনোবাক্যে সত্যের অনুসরণ, স্বরূপ চিন্তা এবং আত্মসংযম ও ব্রহ্মচর্য অভ্যাসের দ্বারাই এই আত্মজ্ঞান লাভ করা সম্ভব। (শ্লোক -৩/১/৫ - মুন্ডক উপ:)
--------------------------
০৬.০২.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/৫
শ্রী ভগবান উবাচ :
বহূনি মে ব্যাতীতানি জন্মানি তব চ-অর্জ্জুন
তান্যহং বেদ সর্ব্বাণি ন ত্বং বেথু পরন্তপঃ। (৪/৫)
শ্রী ভগবান বললেন, হে পরন্তপ অর্জ্জুন, আমার-তোমারও বহু জন্ম অতীত হয়েছে। আমি সেই সকল জানি, তুমি কিন্তু তা অবগত নও।
পরকে যে তাপ দিতে পারে, সে-ই পরন্তপ। একে একদিকে বলা যেতে পর-পীড়ক। আবার তেজঃশক্তি, যা শত্রুকে পীড়ন করতে পারে।
ভগবান বলছেন, তোমার-আমার বহু জন্ম অতীত হয়েছে। আমি সেসব জানি, আর তুমি তা জানো না। ছোটবেলার আমি, আর এখনকার বৃদ্ধ আমি একই - এটা আমি টের পাই কি করে ? আমার স্মৃতির সাহায্যে। তো আমার যদি স্মৃতি সম্পূর্ণ লোপ পায়, তা সে যেকোনো কারণেই হোক, তাহলে আমি বা আমার বলে কিছুই মনে রাখতে পারি না।
এখন কথা হচ্ছে, পূর্ব্ব পূর্ব্ব জীবনের স্মৃতি আমাদের কেন লোপ পায় ? আমাদের ধারণা হচ্ছে, আমাদের মস্তিস্ক এই স্মৃতির আধার। আসলে এই কথাটি অর্ধসত্য। মস্তিষ্ক অবশ্যই স্মৃতি ধরে রাখে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই স্মৃতি আমাদের কারন দেহে সঞ্চারিত হয়। পরাবিদ্যা-বিদগন বলছেন, আত্ম-বুদ্ধি ও মনযুক্ত কারন-দেহই হচ্ছে স্মৃতির আধার। বার-বার জন্ম গ্রহণের ফলে জীবের যত অভিজ্ঞতা অর্জ্জিত হয়েছে, স্বর্গলোক থেকে বিদায় কালে প্রত্যেকবারই সেইসব স্মৃতি কারন-দেহকে উপহার দেওয়া হয়েছে। সুতরাং আমাদের কারন দেহে সমুদয় স্মৃতি সঞ্চিত আছে। স্বর্গ থেকে বিদায় নিয়ে, মর্তলোকে প্রবেশের প্রারম্ভে সে মানসলোকে এসে নতুন মানসদেহ ধারণ করে থাকে। সুতরাং যে মানসদেহে পূর্বজীবনের স্মৃতি সঞ্চিত ছিল, এবং যে দেহ ত্যাগ করে, জীব স্বর্গীয় উচ্চস্তরে গিয়েছিলো, তার সমুদয় উপকরণ লয়প্রাপ্ত হওয়ায় এবং নতুন উপকরণে নতুন মানষদেহ উৎপন্ন হওয়ায়, এই দেহে পূর্বস্মৃতি কিছুই থাকে না। তবে কারনদেহ চিরস্থায়ী না হলেও দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় সেখানে আমাদের সমস্ত স্মৃতি সঞ্চিত আছে। কিন্তু জীব যখন নতুন দেহ ধারন করে, তখন সেই কারন দেহ তার শরীরের মধ্যে বর্তমান থাকলেও, সূক্ষ্ম মানসদেহ ও স্থুল মস্তিস্ক নতুন হওয়ায় এবং জীবসকলের জ্ঞান স্থুলে নিবদ্ধ হওয়ায়, এই অতিসূক্ষ্ম কারন দেহের স্পন্দন তার মস্তিষ্কে কোনো ক্রিয়া উৎপন্ন করতে পারে না। এইজন্যই আমাদের পূর্ব জীবনের কোনো স্মৃতিই মনে উদয় হয় না। কোনো কারনে যদি স্থুল জগতের জ্ঞান আচ্ছন্ন হয়, বা স্থুল জগতের জ্ঞান বদ্ধমূল হবার পূর্ব্বে কখনো কখনো পূর্বস্মৃতি মানুষের মধ্যে জেগে ওঠে। অনেক সময় বিকারের ঘোরে, বা শৈশবে এই জ্ঞানের উন্মেষ দেখা যায়।
এখন কথা হচ্ছে, এতেকরে আমরা অর্জ্জুনের মধ্যে পূর্ব্ব জীবনের স্মৃতি লোপ পাবার ব্যাপারটা না হয় বোঝা গেলো। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছে, আমর সে সব মনে আছে। এটা কি করে সম্ভব ? দেখুন মানুষ যদি সাধনবলে বর্ত্তমানকে অতিক্রম করে, চিত্তকে প্রশান্ত ও নির্মল করতে পারে, তবে কারন দেহের স্পন্দন সে গ্রহণ করতে সমর্থ হয়। এই অবস্থায় পূর্বস্মৃতি তার মনে জেগে ওঠে। আসলে কারনদেহ সর্ব্ব সংস্কারের আধার। এই কারন দেহ চিরস্থায়ী না হলেও দীর্ঘস্থায়ী অর্থাৎ ব্রহ্মে লিন না হওয়া পর্যন্ত এই কারন দেহের অস্তিত্ত্ব থাকে। এই কারনদেহ লিঙ্গত্ব হীন কিন্তু মানব-আকৃতি বিশিষ্ট। ঋষি পতঞ্জলি যোগ-দর্শনের বিভূতিপাদে (শ্লোক নং - ১৮) বলছেন, "সংস্কারসাক্ষাৎকরনাৎ পূর্বজাতিজ্ঞানম" অর্থাৎ সংস্কার সাক্ষাৎ করলে পর, পূর্বজন্মের (জাতির) জ্ঞান জন্মে।
আপনার একটা বিজ্ঞাপন দেখে থাকবেন, সেখানে একজন বলছে, এই বাড়িতে দশ বছর আগে রঙ হয়েছে ? লোকটা বলছে, মিথ্যুক কোথাকার। এই তোমার ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী। লোকটা আবার বলছে, মিথ্যুক কোথাকার। তো একজন বলছে, হ্যাঁ তোমার মাথায় নারকেল পড়েছিল তো, তাই তুমি সব ভুলে বসে আছো। তো লোকটা বলছে, কিভাবে ? তখন একটা নারকোল দিয়ে তার মাথায় আঘাত করে বলছে, এইভাবে। তো মাথায় নারকোল দিয়ে আঘাত পেয়ে স্মৃতিভ্ৰংশ হয়েছে আবার সেই একই আঘাত করবার সঙ্গে সঙ্গে তার স্মৃতি ফিরে এসেছে। এবার সে বলছে, হ্যাঁ হ্যাঁ সব মনে পড়েছে। তো আমাদের স্মৃতি যদি না থাকে, তবে আমাদের কোনো কিছুই মনে থাকে না, আমরা অতীতের সব কথা ভুলে যাই। তো আকস্মিক শারীরিক আঘাতেই আমাদের স্মৃতি নষ্ট হয়ে যেতে পারে, তো স্থুল শরীরের মৃত্যু জনিত আঘাতে তা হলে কি হতে পারে, একবার ভাবুন। আমরা সব ভুলে যাই। যদিও এই স্মৃতি আমাদের কারন শরীরে বর্তমান থাকে।
সে যাই হোক, আসলে ভূত, ভবিষ্যৎ বর্তমান সবই কালের খেলা। এই কালের প্রভাবেই আমরা জন্ম-মৃত্যু দেখি। যার মধ্যে কালের প্রভাব নেই, তিনি সদা একইরকম, তার মধ্যে দৃষ্টিবিভ্রম নেই । এই কালের প্রভাব যার কাছে নেই, তাঁকে বলা হয়, মহাকাল, কূটস্থের ভগবান। আবার যিনি এই কূটস্থে থাকতে থাকতে, বা কূটস্থে স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ করে স্থির হয়ে আছেন, কূটস্থে তন্ময় হয়ে গেছেন, তিনিও জন্ম মৃত্যুর অতীত হয়ে সাক্ষী স্বরূপে অবস্থান করে থাকেন। কাল জীবের জ্ঞানকে আচ্ছাদন করে রাখে। কিন্তু যিনি মহাকালে স্থির তাঁর জ্ঞান আবৃত নয়। তাঁর স্মৃতি সর্বদা জাগ্রত। তার স্মৃতি ক্ষনিকের জন্যও মলিন হয় না। এই স্মৃতি যার সর্বদা জাগ্রত, তার হৃদয়াকাশ মহাকাশের সঙ্গে এক হয়ে যায়। এই সময় মেরুদন্ডস্থ আত্মচৈতন্য শক্তি স্ফূরিত হতে থাকে এবং পরম শিবশক্তি প্রভাবে পরমানন্দ রসে আপ্লুত হয়ে মৃত্যুকে অতিক্রম করেন।
এখন কথা হচ্ছে, ভগবান যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, তার বহু জন্ম অতীত হয়েছে। এই ব্যাপারটা একটু বোঝার চেষ্টা করি। আসলে জীবের দেহের মধ্যে আত্মার প্রকাশ ঘটে থাকে। তো আত্মা একবার স্তিমিত একবার উদ্ভাসিত। একবার আঁধারে প্রতিবিম্বিত, আবার নিষ্প্রভ। একেই ভগবান বলছেন, জন্ম-মৃত্যু। আসলে জন্ম মৃত্য বলে কিছু হয় না। কেননা কোনো বস্তুরই নাশ বলে কিছু হয় না। এমনকি এই জাগতিক কোনো বস্তুরও নাশ হতে পারে না। কেবল পরিবর্তন হয়ে থাকে। আসলে জন্ম মৃত্যু একটা কল্পনার বিষয়। এই কল্পনাই আমাদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত করছে। এই দেহের মধ্যেই আত্মবোধ জাগ্রত হচ্ছে, আবার যখন এই আত্মা স্বরূপে স্থিত হয়, তখন তার আর দেহবোধ থাকে না। তখন প্রকৃতির উর্দ্ধে দেহাভিমান বর্জিত এক চিরস্থায়ী সত্ত্বা অবস্থান করে মাত্র। কখনো প্রকাশিত কখনো বা অপ্রকাশিত। কিন্তু মূলসত্ত্বার কোনো পরিবর্তন হয় না।কেউ এই সত্য জানে, আবার কেউ জানেনা।
-------------------------
০৭.০২.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/৬
অজঃ-অপি সন্-অব্যয়-আত্মা ভূতানাম-ঈশ্বর-অপি সন্
প্রকৃতিং স্বাম-অধিষ্ঠায় সম্ভবামি-আত্মমায়য়া। (৪/৬)
আমি অজ অর্থাৎ জন্ম রোহিত ও অবিনশ্বর হয়েও সমস্ত ভূত বা প্রাণীগণের ঈশ্বর হয়েও নিজ প্রকৃতিকে বশীভূত করে নিজ মায়া দ্বারা জন্ম গ্রহণ করি।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, তিনি অনিশ্বর, জন্ম-মৃত্যু রোহিত। তো যার জন্ম-মৃত্যু আছে, তা অবিনাশী হতে পারে না আবার যা অবিনাশী তার আবার জন্ম মৃত্যু বলে কিছু আছে নাকি ? আসলে আমাদের এই যে দেহ তা ভোগায়তন দেহ। এই ভোগায়তন দেহ তৈরী হয়, কর্ম্ম অনুযায়ী, সংকল্প অনুযায়ী । আমাদের কর্ম্মের পাপ-পুন্য আমাদের বিভিন্ন যোনিতে প্রবেশ ঘটিয়ে বিভিন্ন জীবদেহ গঠন করে থাকে। যিনি ভগবান, যিনি সর্ব্বজীবের আত্মা, তার পাপ-পুন্য বলে কিছু নেই। তিনি নির্বিকার, স্বয়ং-পূর্ন। তার কর্ম্মফল বলেও কিছু হয় না। তো ভগবানের-দেহলাভ কিভাবে সম্ভব ?
আসলে জীব দেহলাভ করে ভোগের কারনে, কিন্তু দ্রষ্টা, সাক্ষী, যিনি ভোগের উর্দ্ধে, যে দেহ তাঁর লাভ হয়, তা ইচ্ছাশক্তির কারনে। জীব কর্ম্মফল অনুযায়ী দেহ ধারণ করে থাকে, এখানে তার কিছু করবার নেই, কোনো স্বাধীনতা নেই অর্থাৎ জন্মগ্রহণ করতে সে বাধ্য, কিন্তু ভগবানের জন্মে কোনো পরাধীনতা নেই। এখানে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন। আমরা প্রকৃতির বশ কিন্তু প্রকৃতি ভগবানের বশে । তো প্রকৃতি যার বশে, তিনি প্রকৃতিকে আজ্ঞা দ্বারা ইচ্ছানুরূপ দেহ পরিগ্রহ করে থাকেন। অন্য জীবের জন্ম-মৃত্যু তার নিজের আয়ত্ত্বে নয়, কর্ম্ম শেষ হয়ে গেলে এই ভোগায়তন দেহের সংশ্লিষ্ট ভূত মূল ভূতে মিশে যাবে। অন্যদিকে ভগবান-দেহ ধারণ করেন স্বেচ্ছায়, আবার একসময় স্ব-ইচ্ছায় লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। আমাদের হয় জন্ম, আর ভগবানের হয় আবির্ভাব। আমাদের দেহের মৃত্যু হয়, আর ভগবানের হয় অন্তর্ধান। আমাদের দেহ বলতে বুঝি স্থুলদেহ, ভগবানের দেহ মায়িক, যা প্রকৃতির উর্দ্ধে । জগতের কল্যাণের জন্য নিজ মায়ায় দেহী-জীবের ন্যায় কেবল মনে হয়। এমনিতে সব দেহই রক্ত মাংসের তৈরী। কিন্তু ভগবানের দেহ তাঁর ইচ্ছাধীন, আমাদের দেহ প্রকৃতির ইচ্ছাধীন। ভগবানের বশে প্রকৃতি, আর আমরা প্রকৃতির বশে। সংসার তাঁর বশে, আর আমরা সংসারের বশে।
আসলে এই অবস্থাটা আমাদের পক্ষে বোঝা একটু কঠিন বটে। কেননা আকাশ থেকে কেউ হঠাৎ করে এই ধরাধামে লাফিয়ে পড়ে না। আবার হঠাৎ করে কেউ অদৃশ্য হয়েও যায় না। জন্মের যেমন একটা প্রক্রিয়া আছে, তেমনি মৃত্যুরও একটা প্রক্রিয়া আছে। জন্মের জন্য একজন পিতামাতার প্রয়োজন। আবার মৃত্যুর সময় এই দেহ ছেড়ে যাবার জন্য একটা উপায় বা প্রক্রিয়া বর্তমান থাকে। জরা-ব্যাধি ইত্যাদির দ্বারা আমাদের কাছে স্বাভাবিক মৃত্য লক্ষিত হয়। তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মের জন্যও মাতা পিতার প্রয়োজন হয়েছিল। আবার তাঁর মৃত্যুর জন্য একটা নিমিত্তের প্রয়োজন ছিল। আর তা ছিলো ব্যাধের তীর। তো প্রত্যেক জীবের তা সে ডিম্ থেকে হোক, গর্ভ থেকে হোক, বা বীজ থেকে হোক, জন্মের একটা বিশিষ্ট প্রক্রিয়া আছে। এর বাইরে আমরা কেউ নোই। তা সে অবতার ভগবান বলুন, বা কীটাণুকীট বলুন, যাই হোক না কেন, সব স্থুলদেহ প্রকৃতির অধীন। সাধারণ বুদ্ধিতে আমরা এর বেশি এগুতে পারি না।
দেখুন আগুন সর্বত্র। আমরা তাকে দেখতেও পাই না, আবার সেই আগুন আমাদের কাজেও লাগে না। কিন্তু কাঠে-কাঠে ঘর্ষন করতে করতে একসময় এই আগুন রূপ নেয়। আর ইন্ধনকে শেষ না করা পর্যন্ত সে দহনশক্তি প্রয়োগ করে থাকে। তো ইন্ধন পেলে অগ্নি রূপ নেয়। আরো একধরনের আগুন বা তেজঃশক্তি আছে যা মেঘে মেঘে ঘর্ষনের ফলে উদ্দীপ্ত হয়ে থাকে। যাকে আমরা বিদ্যুৎ বলে থাকি। এই বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ আকাশে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। আবার আকাশেই মিলিয়ে যায়। একসময় এই স্ফুলিঙ্গ কোনো গাছে বা অন্য কোথাও নিঃশেষিত হয়। তখন সেই গাছ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রাণ হারায়। এই যে বিদ্যুৎরূপ জ্যোতি এর জন্য কোনো ইন্ধনের প্রয়োজন হয় না। এটি নিতান্ত পরিবেশের দান। এটি স্বতঃস্ফূর্ত। তো রূপের জন্ম একদিকে যেমন ইন্ধনের কারনে হয়ে থাকে, আবার এই একই রূপের জন্ম পরিবেশের জন্য হয়ে থাকে। এইসব ইন্ধনহীন রূপের জন্ম কালেভদ্রে হয়ে থাকে। তাই আমরা পরের শ্লোকে শুনবো, ভগবান কখন ও কেন দেহ ধারণ করে থাকেন।
ভগবানের দেহ ধারণ মায়ার খেলা। প্রয়োজন হলে, তিনি প্রয়োজনমতো দেহ ধারণ করে থাকেন। একটা জিনিস জানবেন, শ্রীকৃষ্ণের দেহ - আমাদের মতো সাধারনের দেহের মতোই - পঞ্চভূতের সম্মিলন মাত্র। পার্থক্য হচ্ছে এই দেহের মধ্যে চৈতন্যশক্তি পূর্ণরূপে প্রকাশমান। আসলে পার্থক্য হচ্ছে জ্ঞানের। অজ্ঞানীর দৃষ্টিতে জগৎ বৈচিত্রে ভরা। সবই ভিন্ন ভিন্ন। জ্ঞানী এই স্থুল-সূক্ষ্ম-কারন সমস্ত দেহ ভেদ করে স্বরূপে শুদ্ধ চৈতন্যে লিন হয়ে যান, আর অজ্ঞানী আমার-আমি বলে সুখ-দুঃখ ভোগ করে থাকেন। জ্ঞানীর কাছে আমি-আমার বলে কিছু থাকে না। এই অবস্থাকেই বলে ব্রহ্মবিদ। এই ব্রহ্মবিদের দেহে কামনা-বাসনার লেশ মাত্র থাকে না। ব্রহ্মবিদের দেহ অপার্থিব, দেহবোধের উর্দ্ধে।
এই চৈতন্যময় জ্ঞানদেহ, যোগদেহের্ জন্ম হয়, ইচ্ছাশক্তির দ্বারা। এই ইচ্ছাশক্তি আমাদের সবার মধ্যে আছে। আমরা পিতা-মাতার কাছ থেকে একটা স্থুল দেহের অধিকারী হয়েছি মাত্র । ভগবৎ দেহ হচ্ছে, বিজ্ঞানময় দেহ, আনন্দময় দেহ। ভগবান বলতে আমরা বুঝি সৎ-চিৎ-আনন্দম। তো যে দেহ সৎ অর্থাৎ চিরস্থায়ী, অপরিবর্তনীয়, অক্ষয়, চিৎ অর্থাৎ চৈতন্যময়, আনন্দম অর্থাৎ যার মধ্যে সর্বদা আনন্দ স্ফূরিত হতে থাকে। এই দেহ অপার্থিব জ্ঞানদেহ । এই দেহ আমাদের সবার মধ্যে আছে, যা সুপ্ত আকারে আছে, এঁকে জাগ্রত করাই ভগবানের দেহ ধারণ।
যে দেহে পূর্ন চৈতন্যস্বরূপ পরমাত্মা প্রকাশমান, যে দেহ জীবসকলের ইষ্ট, যে দেহ উপাসনার যোগ্য তা-ই ভগবানের দেহ। অগ্নি ও অগ্নির শিখা যেমন অভিন্ন, তেমনি সচ্চিদানন্দের প্রকটভাব যে দেহে স্ফূরণ হয়, সেই দেহই সচ্চিদানন্দবৎ। চুম্বক সংযোগ হলে লোহা দৃশ্যত লোহাই থাকে কিন্তু চুম্বকের গুন্ থেকে যায়। জ্ঞানচক্ষু উন্মীলন, চৈতন্য সত্ত্বার জাগরণ হলে জীবদেহ ভগবানের দেহে রূপান্তরিত হয়। একেই আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে নবজন্ম বলে। আর এই নবজন্ম একমাত্র ইচ্ছাশক্তির দ্বারাই সম্ভব হতে পারে। সংকল্পের দ্বারা সম্ভব হতে পারে। এই দৃশ্যমান জগৎ ও জ্ঞানরূপ বেদ ভগবানের স্বরূপ থেকে আলাদা নয়। এই চৈতন্যময় দেহ লাভ হলে, অর্থাৎ জ্ঞানীর আত্মার সাথে তদাত্মার সংযোগ হলে মায়ার বাঁধন কেটে যায়। মায়ার উর্দ্ধে এই চৈতন্যময় শরীর। এই চৈতন্যময় দেহের প্রকাশ-অপ্রকাশ ঘটে মাত্র। জন্ম -মৃত্যু বলে কিছু নেই।
এই ভগবৎ শরীর প্রাপ্ত হতে গেলে আমাদের আমাদের অপরোক্ষ জ্ঞানের উন্মেষ ঘটাতে হবে। এই অপরোক্ষ জ্ঞানের উন্মেষ হতে পারে একমাত্র যোগক্রিয়ার মাধ্যমে। বিজ্ঞানময় ও আনন্দময় শরীরের পুষ্টি সাধন করতে হবে। ব্রহ্মে স্থিত হতে হবে। তবেই আমরা বিজ্ঞানময় শরীরে স্পন্দন অনুভব করতে পারবো। আনন্দময় শরীরের স্পন্দন অনুভব করতে পারবো।
------------------------------------
০৮.০২.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/৭-৮
যদা যদা হি ধর্ম্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত
অভুত্থানম-অধর্ম্মস্য তদাত্মানাং সৃজাম্যহম (৪/৭)
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম
ধর্ম্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে। (৪/৮)
হে ভারত যখন যখনই ধর্ম্মের গ্লানি ও অধর্ম্মের প্রাদুর্ভাব হয়, তখন আমি আপনাকে সৃজন করি। (৪/৭)
সাধুদিগের পরিত্রানের জন্য দুষ্কৃতদিগের বিনাশের জন্য এবং ধর্ম্ম সংস্থাপনের জন্য যুগে যুগে অবতীর্ন হই। (৪/৮)
সর্বভূতের মধ্যে যে মূলভূত, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যে চিৎশক্তি, যিনি সর্বভূতে অনুসৃত হয়ে আছে, যিনি অসীম, তিনি এই নশ্বর-ক্ষণভঙ্গুর দেহে অবতীর্ন হন, অর্থাৎ আমাদের মতো সাধারণ জীবদেহ ধারণ কারন, এই কথাটা বিষ্ময়কর ও রহস্যজনক। বেদে এই অবতার তত্ত্বের কোনো সমর্থন পাওয়া যায় না। যাঁরা এই অবতারতত্ত্বে বিশ্বাস করেন, তাদের মধ্যে অবতারতত্ত্বে অবিশ্বাসীদের অবজ্ঞা এমনকি অর্ব্বাচীন ইত্যাদি বলে ছোট করবার একটা প্রবৃত্তি দেখা যায়। বেদান্তবাদীগণ এই অবতারবাদে বিশ্বাসী নন। এই অবতারবাদের কথা শ্রীকৃষ্ণের আমল থেকেই শুরু হয়েছে।
কিন্তু জ্ঞাণীপুরুষ মাত্রেই জীবকেই ব্রহ্ম বলে স্বীকার করে থাকেন। তাদের মতে জীব-শিব অভিন্ন। আর সর্ব্বশক্তিমান বলে কিছু হয় না। প্রত্যেক জীবের মধ্যে যেমন ভালো-মন্দ আছে, সবল-দুর্বল আছে, জ্ঞানী-অজ্ঞানী আছে। তেমনি সমগ্র জগৎ দ্বৈত শক্তির প্রকাশ। ব্রহ্মও সগুন ও নির্গুণ ভেদে দ্বিবিধ। সাকারের মধ্যেও তিনি, আবার নিরাকারের মধ্যেও তিনি। তিনি একদিকে অনন্ত আবার শান্ত, তিনি একদিকে বিশেষ আবার নির্বিশেষ।
এখন কথা হচ্ছে, যিনি সর্ব্বশক্তিমান, তিনি সবকিছুই করতে পারেন। আক্ষরিক অর্থে একথা মানতেই হয়। কিন্তু সত্য হচ্ছে, জীবদেহে অবস্থান ক'রে, প্রকৃতিকে অবহেলা করা সম্ভব নয়। তাহলে জীবদেহের নাশ অবশ্যম্ভাবী। আপনি মহাপুরুষ হোন আর অবতার পুরুষ হোন আপনাকে এই স্থুল অনন্ময় শরীর রক্ষার জন্য অন্ন গ্রহণ করতে হবে। অন্নকে অগ্রাহ্য করলে, শরীর রক্ষা হয় না। তেমনি প্রাণময় শরীর রক্ষার জন্য প্রাণের ক্রিয়াকে স্বাভাবিক রাখতে হবে। মনময় শরীর রক্ষার জন্য, মনের পুষ্টি সাধন করতে হবে। আপনি আগুনে হাত দেবেন, আর হাত পুড়বে না, তা হতে পারে না। আপনি জলে নামবেন, আর আপনার শরীর ভিজবে না তা হতে পারে না।
এই জীবদেহের মধ্যেই আছে ভালো বা খারাপ ক্রিয়া করবার ক্ষমতা। ধর্ম্ম বা অধর্ম্ম দুই আচরণই এই স্থুল শরীরের মাধ্যমে হয়ে থাকে। আর এই ক্রিয়ার প্রকারভেদ সংস্কারবশে হয়ে থাকে। মনুষ্য শরীর একমাত্র এই সংস্কারের পরিবর্তন করতে পারে। ইতর জীবদেহে সংস্কারের পরিবর্তন করবার ক্ষমতা নেই।
যাই হোক আমাদের আলোচ্য বিষয় অবতার নয়, কেউ (ঈশ্বর) অবতার হিসেবে আসেন কি না সেই আলোচনাতেও আমরা যাবো না। আমরা শুধু শুনে নেবো শ্রীগীতায় যোগেশ্বরের মুখনিঃসৃত যোগকথা।
ভগবান বলছেন :
হে ভারত যখন যখন ধর্ম্মের গ্লানি ও অধর্ম্মের প্রাদুর্ভাব হয়, তখন আমি নিজেকে সৃজন করি। (৪/৭)
সাধুদিগের পরিত্রানের জন্য দুষ্কৃতদিগের বিনাশের জন্য এবং ধর্ম্ম সংস্থাপনের জন্য যুগে যুগে আমি অবতীর্ন হই। (৪/৮)
কালস্রোতে ধাবমান জীবকুল, যখন বিপথগামী হয়ে পড়ে, তখন তাদের পথ দেখাবার জন্য ভগবানের আবির্ভাব হয়ে থাকে। কখনো জীবদেহে অর্থাৎ গুরুরূপে, আবার কখনো জীবহৃদয়ে জ্ঞানরূপে আবির্ভূত হন। কখনো মুক্ত পুরুষের বুদ্ধিতে স্থির হয়ে জগৎ কল্যানে ব্রতী হন। ভগবান অবতরণ করেন। অর্থাৎ উপর থেকে নিচে নামেন। কোথায় সেই উপর, যেখান থেকে তিনি নিচে নামছেন ? এই উপর হচ্ছে আমাদের সাধনার সপ্তম ভূমি। এই সপ্তম ভূমিতে যখন সাধক থাকেন, তখন তার বাহ্যজ্ঞান থাকে না। সাধন-জ্ঞানভূমিতে আরূঢ় পুরুষ জগতের কোনো বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন না। তিনি দ্রষ্টা বা সাক্ষীস্বরূপ বিরাজ করেন। এই সপ্তম ভূমি থেকে তিনি একসময় পঞ্চম ভূমিতে নেমে আসেন। তখনই জীবজগৎ তার নাগাল পায়, অথবা বলা যেতে পারে, এখানে না এলে তার স্থুল জগৎ (শরীর) রক্ষা পায় না। একেই বলে জীব-ভূতের প্রতি করুনা ।
শোনা যায়, রামায়ণের রচনাকার বাল্মীকি, এককালে ছিলেন দস্যু রত্নাকর । চ্যবন ঋষির পুত্র এই দস্যু রত্নাকর। তিনি নির্বিবিচারে মানুষ খুন করতেন। খুন, ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই ইত্যাদি ছিলো তার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তো একদিন ঋষি নারদের পাল্লায় পড়ে তিনি ধ্যানমগ্ন হলেন। তার চারিদিকে বল্মিক অর্থাৎ উইয়ের ঢিপি তৈরী হলো। একসময় এই উইয়ের ঢিপি থেকে বেরিয়ে এলেন, এক জ্ঞানগম্ভীর মূর্তি, যিনি বাল্মীকি নামে খ্যাত। এগুলো সবই রূপক গল্প।
ঋষি পুত্র আমরা সবাই। অজ্ঞান অবস্থায় আমাদের কাজ হয় নিম্নমানের। দেহ ধারনের জন্য, স্বজনপোষণের জন্য, আমরা দস্যুবৃত্তি গ্রহণ করি। কিন্তু একসময় আমাদের মধ্যে বুদ্ধিদাতা ঋষি নারদের উপস্থিতি বোধ করি। তখন আমাদের কর্ম্ম ধারার পরিবর্তন হয়। স্থুলদেহের দিকে তখন খেয়াল থাকে না। আমরা সাধনক্রিয়ায় রত হই। আর এই সময় উইয়ের বাসা অর্থাৎ স্বরচিত দেওয়াল তৈরি হয় আমাদের বাহ্যিক জগৎ ও মনঃ জগতের মধ্যে। আমাদের বাহ্যিক জগৎ থেকে নিজেকে আড়াল করতে সাহায্য করে থাকে এই স্বরচিত দেওয়াল । বাহ্যিক জগৎ থেকে আমরা আড়ালে চলে যাই।
বাল্মীকি বা বল্মিক নামে আজও একটা জাতি আছে, যারা উত্তর ভারতে তপশীলি জাতি ভুক্ত, আবার দক্ষিণ ভারতে তপশীলি উপজাতি ভুক্ত ।
মানুষ যখন সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। মানুষ যখন শুভ-অশুভ কর্ম্ম সম্পর্কে নির্ভিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। মানুষ যখন আশঙ্কায় ভোগে, মানুষ যখন উদ্দেশ্যহীনতায় ভোগে, আর এই অবস্থা যখন চরম আকার নেয়, এমনকি সে বেঁচে থাকা আর মারা যাওয়ার মধ্যেও পার্থক্য করতে পারে না, তখন সে বিবেকের ডাক শুনতে পায় । একেই বলে ভগবানের অবতরণ।
এখন কথা হচ্ছে ধর্ম্মের গ্লানি বা অধর্ম্মের অভ্যুত্থান ব্যাপারটা কি ? ধর্ম্ম অর্থাৎ স্বরূপে স্থিতি, আর অধর্ম্ম হচ্ছে অনিত্য বিষয়ের পিছনে ছোটা। বিষয়ে আসক্তি যখন বিশেষভাবে বৃদ্ধিলাভ করে, তখন ধর্ম্মচক্র ঘুরতে থাকে। এক শক্তিমান পুরুষের আবির্ভাব হয়। মন তখন আবার বেঁচে ওঠার আশায় জেগে ওঠে। হৃদয় হয় উৎফুল্ল। একটা ভরসার ভোরের বাতাস বইতে থাকে। সবকিছু তখন নতুন মনে হয়। ঈশ্বর (বিশ্বশক্তি) যেন পারিষদবর্গ সঙ্গে নিয়ে, ভোরের সূর্য্যের মতো উদয় হন । একেই বলে আপনা থেকে আপনাকে সৃজন।
সাধনক্রিয়া না করলে, প্রাণের স্থিরতা আসে না। আর প্রাণের স্থিরতা না এলে, মন বিষয় লাভের জন্য উন্মত্তবৎ ছোটাছুটি করবেই। অর্থাৎ ধর্ম্মের গ্লানি হবে। অধর্ম্মের উত্থান হবে। বিষয় পেয়ে বিষয়সুখে উন্মত্ত হবে মন। প্রাণবায়ু হবে উত্তপ্ত । মন হবে উন্মাদ। আর এই উশৃঙ্খল মনকে বশে আনবার জন্য, কখনো কখনো দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সে শ্রীগুরুর চরণ বন্দনা শুরু করবে। আর এই শ্রীগুরুদেব রোগের দাওয়াই বাতলে দেবেন। উত্তপ্ত প্রাণকে ঠান্ডা করবার জন্য হাজারো বৃত্তিযুক্ত মনকে বৃত্তিহীন করে দেবার জন্য বহির্বিশ্বে বিচরণশীল মনকে অন্তর্জগতে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য, তিনি শ্রীগুরু রূপে হৃদয়মন্দিরে অবতীর্ন হবেন।
বাহ্যিক জগতেও সাধারণ মানুষকে সাধনমার্গে টেনে নামানোর জন্য মহাপুরুষ আছেন। যদিও আমরা এঁদেরকে সঠিকভাবে চিনতে পারি না। কিন্তু তাঁরা তাদের কাজ নীরবে সম্পাদন করে থাকেন। অভিমানশূন্য-নিরহঙ্কারী এইসব মহাপুরুষ হচ্ছেন ধর্ম্মের ধারক ধর্ম্মের সংস্থাপক, ধর্ম্মের প্রবর্তক।
মানুষের আয়ু অল্প, মানুষ অলস, মানুষের মধ্যে নির্বুদ্ধির প্রকোপ। সাধন দ্বারাই ধর্ম্মকে রক্ষা করা যায়। ধর্ম্ম অর্থাৎ যার বলে সমস্ত গুনকে ধারণ করা যায়। যার বলে আপনাকে আপনি আটকে রাখা যায়, তাকেই বলে স্ব-ধর্ম্ম। আমাদের দেহাভিমান, আমাদের অহঙ্কার যত বেশি থাকে, তত আমরা সেই ঐশ্বরিক শক্তি থেকে নিজেকে আড়াল করে ফেলি। এখান থেকে বেরুতে গেলে আমাদের তপঃ, সত্য, শৌচ, দয়া এই চার গুনের অনুশীলন করতে হবে। তবেই আমরা আমাদের মধ্যে "আমার" আবির্ভাব দেখতে পারবো। ওঁং শুভম।
--------------------------
০৯.০২.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/৭-৮ (পূর্ব-প্রকাশের অংশ বিশেষ-১ )
আমরা প্রবেশ করেছি, শ্রীগীতার চতুর্থ অধ্যায়ে। এর মধ্যে আমরা চতুর্থ অধ্যায়ের ষষ্ঠ শ্লোকের কথা বুঝবার চেষ্টা করছি। এইবার একটু প্রাক-কথন আমাদের স্মরণে আসা দরকার, নতুবা আমরা শ্রীগীতার মূলস্রোতে অবগাহন করতে পারবো না। আমরা যোগশাস্ত্রে দৃষ্টিতে শ্রী গীতাকে বুঝবার চেষ্টা করছি। এখানে চারটি চরিত্র গুরুত্ত্বপূর্ন। প্রথম হচ্ছে, ধৃতরাষ্ট্র - যিনি এই শরীররূপ রাষ্ট্রকে ধরে রেখেছেন। দ্বিতীয় সঞ্জয়। অর্থাৎ যিনি সংযমী পুরুষ। যিনি সমাধিস্থ অবস্থায় কুটস্থিত আত্মার কথা শুনছেন - দেখছেন অর্থাৎ সাক্ষী বা দ্রষ্টা স্বরূপ পর্যবেক্ষন করছেন। তৃতীয় হচ্ছে অর্জ্জুন, যিনি শ্রী ভগবানের মুখনিঃসৃত বাণী শুনছেন।অর্থাৎ সরাসরি যার উদ্দেশ্যে এই অমৃতবাণী ব্যক্ত হচ্ছে । সর্বশেষ চরিত্র বা মূল চরিত্র হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণের এখানে চারটি রূপ বা ভাব - প্রথমত ইনি অর্জ্জুনের সখা - দ্বিতীয়ত যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জ্জুনের সারথী, যুদ্ধ ক্ষেত্রে রথের চালক। তৃতীয়তঃ ইনি অর্জ্জুনের গুরুদেব, জীবন পথের পথনির্দেশক চতুর্থতঃ স্বয়ং পরমপুরুষ পরমাত্মা, সর্ব্ব শক্তিমান, অবিনশ্বর, অব্যয়, সর্বভূতের মধ্যে স্থিত আত্মস্বরূপ।
শাস্ত্রপাঠে কি মানুষ মূর্খ হয়ে যায়, শাস্ত্রপাঠে কি মানুষের অধঃপতন হয় ? যতদিন আমার মধ্যে কোনো জ্ঞানের উদ্ভব হয়নি, ততক্ষন আমি অজ্ঞানী হলেও সহজ-সরল ছিলাম । একটা শিশু ভালো মন্দের পার্থক্য করতে পারে না। তার কাছে বিষ্ঠা, বিষ, মিষ্টি সবই সমান বলে মনে হয়। কিন্তু পার্থিব জ্ঞানের উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে ভেদ বুদ্ধির উদয় হয়। কোনটা খারাপ আর কোনটা ভালো, সেই জ্ঞান তার মধ্যে ধীরে ধীরে জাগতে থাকে। তখন কিছু বিষয় সে বৰ্জন করে, আবার কিছু বিষয় গ্রহণ করতে উদগ্রীব হয় । দেখুন শাস্ত্র পাঠ অর্থাৎ শাস্ত্রগ্রন্থকে নিতান্ত উপন্যাসের মতো পড়ে গেলে, শাস্ত্রের তত্ত্বজ্ঞান লাভ হয় না। শাস্ত্রের তত্ত্বকথা জানবার জন্য মনের ভিতর যতক্ষন না আঁকুপাঁকু শুরু হয়, হৃদয় যতক্ষন না উৎসাহিত হয়, ততক্ষন শাস্ত্র গ্রন্থ আর পাঁচটা কাব্য গ্রন্থের থেকে বেশি কিছু দিতে পারে না। শাস্ত্র গ্রন্থের পাতা তো নিতান্ত একটুকরো কাগজ নয়, এরমধ্যে থাকে অন্তরের অন্তঃস্থিত হৃদয়গুহায় অবস্থিত সেই পরমপুরুষের ছোঁয়া। প্রথম দিকে এই শাস্ত্র পাঠে আত্মা সম্পর্কে একটা পরোক্ষ জ্ঞানের উন্মেষ হয় সত্য কিন্তু যতদিন না সেই আত্মাকে অপরোক্ষ ভাবে জানবার জন্য হৃদয় ব্যাকুল হয়, এমনকি যতক্ষণ না সেই পথে চলতে শুরু করি ততক্ষন প্রকৃত শান্তি মেলে না।
শ্রী গীতা সহজ-সরল প্রাঞ্জল ভাষায় সংস্কৃত ভাষায় লিখিত হলেও, এর মধ্যে এতো গুড় তত্ত্বের বিচিত্র সমাহার যে এঁকে আয়ত্ত্ব করা কঠিন থেকে কঠিন-তরো। এমনকি সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ব করা হয়তো অসম্ভব। আসলে ভগবান এতো বিরাট- বিশাল, আকাশও যাঁকে জায়গা দিতে পারে না। আমরাও আমাদের ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে তার পরিমাপ করতে পারি না। আবার এতটাই ক্ষুদ্র যে অনু-পরমাণু যে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ধরা পড়ে না। ঈশ্বর, ভগবান, প্রভু, ব্রহ্ম ইত্যাদি বাক্য দিয়েও তাঁকে সীমাবদ্ধ করা যায় না। বাক্য এই অসীম সত্ত্বাকে প্রকাশের ক্ষমতা রাখে না। এঁকে আমরা শাস্ত্রপাঠ করে বুঝতে চেষ্টা করছি, এর মতো মূর্খতা আর কি হতে পারে ?
শ্রী গীতার চতুর্থ অধ্যায়ে এসে আমরা সেই পরমপুরুষ সম্মুখীন হয়ে গেছি। তাই তাঁর অদ্ভুত রহস্যময় বাণী আমাদের কাছে বোধের অতীত বলে মনে হয়। অর্জ্জুনসখা থেকে যুদ্ধরথের সারথী, সারথী থেকে জ্ঞানগুরু, জ্ঞানগুরু থেকে পরম-ঈশ্বর। এই যে রূপান্তর, এটাকে আমরা যদি ধরতে না পারি, তবে গীতাপাঠ আমাদের বৃথা। যাঁর মধ্যে আমি বলে কিছু নেই, যাঁর মধ্যে আমার বলে কিছু নেই, যার আমি-বোধ লোপ পেয়েছে, তাঁকে বোঝা আমাদের মতো দেহাভিমানীর পক্ষে অসম্ভব।
শ্রীভগবান বলছেন, সাধুদের রক্ষার জন্য আমি অবতরণ করি। সাধুদের রক্ষা, যিনি স্ব-অধীন, তিনিই সাধু। এই সাধু অথাৎ সাধক যখন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন, তখন স্বয়ং ভগবান তাকে পথ দেখাতে কৃপা করে সাধকের হৃদয়ে উদ্ভাসিত হন।
অনেক সময় সাধন-পথযাত্রী সাধক সাধন করতে করতে অনেকটা অগ্রসর হয়েও, নানান রকম বিপত্তির সম্মুখীন হন। সাধনার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে, কিছু কিছু সাধনবিভুতির লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে, আর সাধকের মধ্যে একটা অহমিকার প্রকাশও দেখা যাচ্ছে। এই অহমিকার আবির্ভাব সাধককে টেনে সাধন পথ থেকে নিচে নামিয়ে আনে। এই সময় সাধক আর কিছুতেই অগ্রসর হতে পরে না। সচেতন সাধকের মধ্যে এই সময় একটা ভয়ের উৎপত্তি হয়। তিনি আবার কূটস্থের স্মরণ নেন। আর কূটস্থের স্মরণ/মনন/শরন হলেই দয়ালু ভগবান দীনার্ত্ত সাধককে কৃপা করতে উন্মুখ হন। আসলে সাধকের যদি বহু জন্মের সংস্কার থাকে অর্থাৎ শুভ বৃত্তির প্রাবল্য থাকে মন যদি শুদ্ধ থাকে, তবে সাধন জীবনের বিঘ্ন একসময় ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে। অনেক সময় বিচার বুদ্ধি আমাদেরকে বিপথে পরিচালিত করে। এইসময় নিজের মধ্যে একটা চঞ্চলতা তৈরী হয়। ঠিক এই সময় দরকার ভগবানের শরণ। আর ভগবানের শরণ নিলেই ভগবান আমাদের বিঘ্ন থেকে উদ্ধ্বারের রাস্তা অর্থাৎ জ্ঞান দান করেন। মনের শক্তি বাড়িয়ে তোলেন। একেই বলে সাধুদের পরিত্রান।
--------------------------
১০.০২.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/৭-৮ (পূর্ব-প্রকাশের বিস্তার বিশেষ-২ )
পাপকারীদের বিনাশ :
সত্যি কথা বলতে কি, ভগবানে আপনার বিশ্বাস থাকুক আর না থাকুক, ভগবানকে আপনি উপলব্ধি করতে পারুন আর নাই পারুন, ভগবান আপনার মধ্যেই আছেন। এমনকি আপনার সমস্ত কর্ম্ম ক্ষমতা আসলে তাঁরই ক্ষমতা। আপনার সমস্ত চিন্তাশক্তি তাঁরই শক্তি। আপনি তাঁর হাতের ক্রীড়নক মাত্র। তাঁকে ছাড়া আপনি জীবিত বা মৃত কোনো অবস্থাতেই থাকতে পারেন না। যারা ভগবানের অস্তিত্ত্বে বিশ্বাসী নন, অথবা মানলেও সাধন ক্রিয়া কিছুই করে না, আহার বিহারে যাদের সংযম নেই, বাক-চিন্তায় যাদের সংযম নেই, যিনি অন্য জীবের কষ্টের কারন হন, নিজের মধ্যে কোনো লজ্জ্বা নেই, বা ভগবানের শক্তি সম্পর্কে কোনো ভীতির ভাব থাকে না, এদের জ্ঞান বিদ্যার অভাব নেই বটে, কিন্তু এদের মনুষ্যত্ব নেই। আর এই স্বার্থ-সম্বলিত জ্ঞান দ্বারা সে অন্যের ক্ষতি করতে থাকে। এইসব আসুরিক প্রবৃত্তির বিনাশের জন্যও একসময় ভগবানের আবির্ভাব হয়। আসলে সবাই ভগবানেরই সন্তান, কিন্তু কিছু সন্তান তাঁর কথা মতো চলে, তাঁর কাছে-কাছে থাকতে ভালোবাসে। আবার কিছু সন্তান আছে, যারা লোভ-লালসায় আসক্ত হয়ে ভগবানের থেকে দূরে চলে যায়। এদেরকে কাছে টেনে আনাও ভগবানেরই ইপ্সিত। মহাত্মাজি বলে থাকেন, কীর্ত্তি, শ্রী, বাক, স্মৃতি, মেধা, ও ক্ষমা এগুলো আধাত্মিক শক্তি। এই শক্তি অন্তর্হিত হলে, জগৎব্যাপী আসুরিক শক্তির বৃদ্ধি পায়। প্রকৃতিশক্তি তখন ধংসলীলায় মেতে ওঠেন। আর সাধনক্রিয়া হচ্ছে, যম-নিয়ম-আসন-প্রাণায়াম-ধারণা-ধ্যান-সমাধি। এই সাধনক্রিয়াতে মন দিলে, মন স্থির হয়, শান্ত হয়, এবং স্বরূপে স্থিত থাকে। তো মানুষের মন থেকে যখন এই সাধনক্রিয়া করবার উত্তাপ, ক্ষমতা বা ইচ্ছেশক্তি লোপ পায়, তখন ভগবানের করুনা বর্ষিত হতে থাকে।
ধর্ম্ম সংস্থাপন :
দেখুন সাধুদের পরিত্রান বা পাপীদের বিনাশ এই দুটো কর্ম্ম করবার জন্য, ভগবানের আশীর্বাদ ধন্য ঋষিপুরুষগন বা আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা যথেষ্ট হলেও হতে পারে। কিন্তু ধর্ম্মসংস্থাপন একমাত্র সেই অবতার পুরুষ দ্বারাই সম্ভব হয়ে থাকে। এযুগে ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথামৃত দ্বারা এই ধর্ম্মসংস্থাপনের কাজ সম্পাদন করেছিলেন, ত্রিপিটকের মাধ্যমে ভগবান বুদ্ধ এই কাজ করেছিলেন, বাইবেলের মাধ্যমে এই কাজ করেছিলেন যীশু, কোরানের মধ্যেও আছে সেই পরমপিতার বাণী ঠিক তেমনি সেযুগে শ্রীকৃষ্ণ এই শ্রীগীতার মাধ্যমে ধর্ম্ম সংসস্থাপনের কাজ করেছেন। আমাদের যত যথার্থ ধর্ম্মশাস্ত্র দেখি, বা ধর্ম্মের বাণী শুনি তা সব এই অবতার-পুরুষদের দান। যা যুগে যুগে প্রবাহিত হয়ে আসছে। এই কাজ কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা করতে পারে না, এমনকি এই কাজ কোনো জ্ঞাণীপুরুষও করতে পারেন না। এর জন্য দরকার হয়, ঐশীশক্তির। আর এই ঐশীশক্তি নিয়েই অবতারপুরুষগন যুগে যুগে অবতীর্ন হয়েছেন।
ধর্ম্মের হানি হলে জগতের স্থিতিশক্তি বিচলিত হয়। ধর্ম্মের মূল শক্তি ঈশ্বর। সমস্ত বস্তুর কেন্দ্র থেকে শক্তি বিচ্ছুরিত হয়ে পরিধি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। আবার সেই শক্তি পরিধি থেকে কেন্দ্র দিকে ধাবিত হয়। এই আবর্তন বিবর্তনই ধর্ম্ম-চক্র। সৃষ্টি স্থিতি লয়। সবই সেই একমাত্র ঐশী শক্তির খেলা। জীবাত্মা পরম-আত্মার অংশ। তাই পরমাত্মা যেমন পূর্ন স্বাধীন, জীবাত্মা অংশত স্বাধীন। জীবাত্মার এই স্বাধীনতার অপপ্রয়োগের ফলেই আসে জীবের অধঃপতন। শুরু হয় ক্লেশকর জীবন। আবার এই ক্লেশকর জীবন থেকে জীবাত্মা অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করে, একসময় বীতশ্রদ্ধ হয়ে ঈশ্বরমুখী হয়। দুঃখভোগ জীবনের শিক্ষা, জ্ঞান সঞ্চয়ের অপূর্ব সুযোগ। আর জ্ঞান সঞ্চয় হলে, পশুবৃত্তি সম্পন্ন মনুষ্য একসময় পশুবৃত্তিকে পরিহার করবার চেষ্টায় রত হয়। একসময় দেবমানবে পরিণত হয়। এই ক্লেশকর শিক্ষাদানে হতে ভগবান কাউকেই বঞ্চিত করেন না। একেই বলে ঈশ্বরের দয়া-করুনা।
আমাদের শরীর অসঙ্খ্য স্বয়ংচালিত যন্ত্রসমষ্টি মাত্র। মানুষ স্বাধীনতার প্রভাবে, সে এই যন্ত্রগুলোকে অপব্যবহার করে থাকে। আহার গ্রহণ শরীরের পুষ্টির জন্য প্রয়োজন কিন্তু এই আহার গ্রহণে আমরা যখন স্বেচ্ছাচারী হই, তখন আমাদের অজীর্ণতা জনিত ক্লেশের ভোগ করতে হয়। ঠিক তেমনি চিন্তা আমাদের মানসিক শরীরের পুষ্টি সাধন করে থাকে, জ্ঞান সংগ্রহ আমাদের বিজ্ঞানময় শরীরের পুষ্টি সাধন করে থাকে। তো আমাদের মধ্যে নঞৰ্থক চিন্তা, আমাদের বিষয়জ্ঞান-এর জন্য অতিরিক্ত প্রয়াস আমাদের দেহ-মন-এর ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলে। শরীরের সাম্যাবস্থা ফিরিয়ে আনবার জন্য যেমন আমরা ডাক্তারের কাছে ছুটে যাই, তেমনি মনের সাম্যাবস্থা ফিরিয়ে আনবার জন্য আমাদের গুরুর শরণ নিতে হয়। শীত তাপ থেকে বাঁচবার জন্য যেমন আমাদের গায়ে বস্ত্র-বাসস্থানের প্রয়োজন হয়, তেমনি মনের সমতা রক্ষা করবার জন্য আমাদের ধ্যান ধারণার প্রয়োজন হয়। এর অভাব হলে, আমাদের শরীর মন ভেঙে পড়ে। তো শরীরের রক্ষা, পালনপোষণ আমাদের ধর্ম্ম। আবার মনের মধ্যে সদর্থক চিন্তার উদ্রেগ করাও আমাদের ধর্ম্ম। এই ধর্ম্ম রক্ষিত না হলে আমরা বহির্জগতে এমনকি অন্তর্জগতে ব্যাধিগ্রস্থ হয়ে পড়ি। এই ধর্ম্মের মানদন্ড যখন হেলে পড়ে, তখন ধর্ম্মের স্বাভাবিক যে জ্যোতি তা হ্রাস পায়। এই জ্ঞানজ্যোতিকে আবার উজ্বল করবার কারনে আবার আমাদের মধ্যে বুদ্ধিরূপ ভগবানের উদয় হয়। ভগবানের আবির্ভাব হচ্ছে, জ্ঞানের প্রকাশ, চেতন শক্তির উন্মোচন। এই জ্ঞানজ্যোতিঃ স্বরূপ ব্রহ্ম যখন মানব চিত্তে ম্রিয়মান হয়ে যায়, তখন জীবের মধ্যে তার স্বরূপের বিস্মৃতি ঘটে। আর তাঁর প্রকাশে আবার সব ধর্ম্মের কল ঠিক ঠিক মতো কাজ করতে শুরু করে। একেই বলে, ধর্ম্ম সংস্থাপন। ধর্ম্মের বৈষম্যতাকে পুনঃস্থাপন।
এই মনুষ্য শরীরে আজ্ঞাচক্রে আত্মার প্রকাশ ঘটে থাকে। মনও তখন এই আজ্ঞাচক্রে অবস্থান করে। কিন্তু মন একসময় বিষয়ে মুগ্ধ হয়ে ধীরে ধীরে ইন্দ্রিয়মুখী হয়ে নিম্নগামী হতে শুরু করে। আর আজ্ঞাচক্র থেকে বেরিয়ে মনের নিজস্ব জায়গা অর্থাৎ সে তার উৎসের কথা ভুলে যায়। সে যে দ্বিদলের বাসিন্দা সে কথা বেমালুম ভুলে বসে থাকে। এই সময় সে দেহ-ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে মশগুল হয়ে থাকে। আর কারুর কথা তার মনে পড়ে না। মন যখন আজ্ঞাচক্রে ছিল, তখন সে পূর্ন জ্ঞান সম্পন্নই ছিল, কিন্তু সেখান অবতরণ হেতু, সে প্রাণপ্রবাহের মধ্যে পড়ে দিশাহারা হয়ে গেছে। তিনি সচ্চিদানন্দ - সৎ-চিৎ-আনন্দম। আত্মা চৈতন্যময়, আত্মা জ্ঞানস্বরূপ, আনন্দস্বরূপ, পূর্ন তথাপি চিৎ-এর মধ্যে যখন প্রাণের স্পন্দন আরম্ভ হয়, তখন প্রানশক্তি অসংখ্য নাড়ীর মধ্যে দিয়ে সে বহির্মুখী হয়ে পড়ে। প্রাণশক্তির এই বহির্মুখীনতা ইন্দ্রীয়শক্তিকে বিষয় গ্রহণের জন্য উদ্দীপ্ত করে। আর ইন্দ্রিয়গণ উৎফুল হয়ে ব্যাকুলতার সাথে বিষয় সমূহের সঙ্গে রমন শুরু করে - একেই বলে নষ্ট পরন্তপঃ।
পরমাত্মা প্রভু, জীবাত্মা তার সখা । সদা সর্বদা জীবাত্মা-পরমাত্মা, একত্রেই অবস্থান করে থাকেন । জীবাত্মা জৈবিক তাড়নায় পরমাত্মাকে ভুলে গেলেও, পরমাত্মা জীবাত্মাকে কখনো ভুলে যেতে পারেন না। তাই তো তিনি সম্ভবামি যুগে যুগে। যুগে যুগে অবর্তীর্ণ হন। ধর্ম্ম যখন অস্থির হয়, তখন ভগবানের আবির্ভাব প্রয়োজন হয়ে পড়ে । মন যখন আত্মা থেকে স্খলিত হয়ে বিষয়ভোগরূপ পাপে লিপ্ত হয়, যখন দেহাত্মবোধে আপ্লুত হয়, তখন পাপের উদ্ভব হয়। এই পাপ আমরা প্রতিনিয়ত করে চলেছি। এখন আমাদের কাজ হচ্ছে, এখানে থেকে বেরিয়ে আসা, পাপের থেকে পরিত্রানের রাস্তা খোঁজা। অর্থাৎ আবার মনকে স্বস্থানে স্থাপিত করা। দেখুন যে জগতে মনের স্থিতি নেই, সেই জগতের স্থিতি বলেও কিছু নেই। তো মন যখন বহির্জগতের মধ্যে স্থিত হয়, তখন জগৎ প্রকাশিত, আবার আপনার মন যখন আত্মস্থিত হয়, তখন আত্মার প্রকাশ ঘটে। "ধৃ" অর্থাৎ ধারণ থেকে ধর্ম্ম। জগৎকে যা ধারণ করে রাখে তা-ই ধর্ম্ম। যে জগতে মন নেই, সেখানে জগৎ বলেও কিছু প্রতীয়মান হয় না। তো এই মন স্থানচ্যূত হয়ে ধর্ম্ম থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। এখন আবার সেই আজ্ঞাচক্রে নিয়ে যেতে হবে। তো চঞ্চল মন ধর্ম্মে স্থির হতে পারে না। অতয়েব জীবকে প্রয়াস করতে হবে। এই ধর্ম্মে মনকে স্থির করে রাখতে হবে।
এটাই মানুষের কর্তব্য। এখন কথা হচ্ছে, এই কাজ যদি জীবকূলকেই করতে হবে, তবে ভগবানের অবতরণের দরকারটা কি ? আবার দেখুন, ভগবানের যখন স্থুল শরীরে অবতীর্ন হন, তখন আমরা অনেকেই সেখানে, সেই সময়ে থাকতে পারি না। ভগবান তার নিজের পারিষদবর্গকে নিয়ে মর্তলোকে অবস্থান করেন। তাতে করে সমগ্র জীবকুলের কি লাভ?
শ্রীচৈতন্যদেব, ঠাকুর রামকৃষ্ণ, বুদ্ধদেব, যীশুখ্রিষ্ট, এমনকি শ্রীকৃষ্ণ যখন আবির্ভূত হয়েছিলেন, তখন কি আমরা কেউ ছিলাম ? আক্ষরিক অর্থে একথা সত্য যে আমরা কেউ ছিলাম না। তো যুগে যুগে ভগবানের আবির্ভাবে সমগ্র জগতের কিভাবে উপকার হবে ? আসলে যা ছিল অব্যক্ত তার প্রকাশকেই বলে আবির্ভাব। এই ভগবান বা আত্মা আমাদের সবার মধ্যেই আছেন। এই আত্মার স্বরূপকে উপলব্ধি করা, এই আত্মজ্যোতিকে স্ফূরিত করা প্রাণের স্থিরতা ভিন্ন সম্ভব নয়। প্রাণের স্থিরতা হলে মন নির্ম্মল হয়ে, বিক্ষেপশূন্য অবস্থায় স্থির হতে পারে। প্রত্যাহার দ্বারা বারবার মনকে বশীভূত করে, রজোগুণের ক্ষয় সাধন করতে হবে। এইজন্য রজোগুনকে শান্ত করতে হবে। স্থির আসনে মন দিয়ে বারবার প্রাণায়াম, ধ্যান, ধারণা, প্রত্যাহার দ্বারা প্রাণবায়ুকে স্থির করা সম্ভব। আর প্রাণবায়ু স্থির হলে, মন আত্মাতে আপনভাবে আপনি নিমজ্জিত হয়ে যাবে। একেই বলে স্বধর্ম্ম।
প্রাণের চাঞ্চল্য আসলে শ্বাসের চাঞ্চল্য। প্রাণের চাঞ্চল্য আসে অসম শ্বাস প্রশ্বাস থেকে । এই শ্বাস প্রশ্বাস কখনও বাম নাসিকায় কখনো ডান নাসিকায় প্রবাহিত হয়। এই যে ইড়া ও পিঙ্গলায় প্রবাহিত হয়, এই অবস্থায় আমরা সংসারে আবদ্ধ হই। এই যে বারবার শ্বাসের আগমন-নির্গমন, যার মধ্যে চেতনশক্তি বারবার আমাদের মধ্যে ঢুকছে আবার বেরিয়ে যাচ্ছে, একেই বলে ভগবানের বারবার বা যুগে যুগে আবির্ভাব। যুগে যুগে কথাটার অর্থ হচ্ছে যুগ্ম ভাবে। এই শ্বাস যখন ইড়া থেকে পিঙ্গলায় আসে, বা পিঙ্গলা থেকে ইড়া নাড়ীতে যাচ্ছে, ঠিক তক্ষুনি সুষুম্নার সংস্পর্শে আসে। এই যে ইড়া থেকে সুষুম্নার যোগ বা পিঙ্গলার সাথে ইড়ার যোগ, একেই বলে যুগ। যা প্রতি মুহূর্তেই আসছে, বারবার আসছে-যাচ্ছে। তাই বলা হয়ে থাকে প্রত্যেকটি যুগেই তিনি আসেন, আবার ফিরে যান। সুষুম্নার সঙ্গে যখন সংস্পর্শ হয়, তখন হয় ব্রাহ্ম মুহূর্ত। অর্থাৎ শ্বাস গ্রহণ ও স্বাস ত্যাগ - এর মধ্যক্ষণে তার আবির্ভাব ঘটে থাকে। তাই যোগসাধকে এই মুহূর্তটির দিকে খেয়াল করে বসে থাকতে বলা হয়। কেননা এইসময় সহজ মানুষের দেখা মেলে।
ঈশ্বরকে আপনি ছাড়তে পারেন, কিন্তু ঈশ্বর আমাদেরকে ছাড়েন না। তিনি আমাদের মধ্যে বারবার শ্বাসের সঙ্গে আসছেন, যাচ্ছেন। আমরা তাঁকে ধরতে পারছি না। আসলে আমরা কেউ তাঁকে ধরবার চেষ্টাও করি না। যারা ছিপ ফেলে বসে থাকেন, তারা তাঁর নাগাল পান। আমরা ধরতে না পারলেও, তিনি আমাদের আজ্ঞাচক্রে অবস্থান করছেন। আমাদের মন যদি একবার সেই আজ্ঞাচক্রে স্থিত হতে পারে, তবে তার সমস্ত স্মৃতি জেগে উঠবে। জীবকুলের এই মোহনিদ্রা ভঙ্গ করবার জন্য, যোগগুরু পথ দেখাতে পারেন। স্বধামে পৌঁছাবার ব্যবস্থা করতে পারেন। পথহারাকে সঠিক পথে সুষুম্নাকে সক্রিয় করবার নির্দেশ দিতে পারেন। আসলে এই প্রানধারার সঠিক রাস্তা হচ্ছে সুষুম্না নাড়ী। এই সুষুম্না-নাড়ী পথ ধরে যখন নির্মল, শুদ্ধ, সূক্ষ্ম প্রাণবায়ু উর্দ্ধমুখী হবেন, তখন সাধক সেই আনন্দময়ের সন্ধান পাবেন। আর এই কাজ সম্ভব হতে পারে, গুরুসান্নিধ্যে থেকে যোগক্রিয়ার মাধ্যমে। সাধনার পূর্বে মন বিষয়াসক্ত থাকে, ধীরে ধীরে সাধনার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মন বিষয় থেকে বিচ্যুত হয়ে বিষয়ীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। তখন মনে হয়, দুষ্টু বৃত্তির বিনাশ হলো, অধর্ম্মের নাশ হলো, আর ধর্ম্মেরও প্রতিষ্ঠা হলো।
----------------------
১১.০২.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/৯
জন্ম কর্ম্ম চ মে দিব্যমেবং যো বেত্তি তত্ত্বতঃ
ত্যক্ত্বা দেহং পুনর্জন্ম নৈতি মামেতি সোঽর্জ্জুন। (৪/৯)
হে অর্জুন আমার জন্ম কর্ম্ম দিব্য। এই বিষয়টি যিনি তত্ত্বগত ভাগে অবগত, তিনি দেহত্যাগ করে পুনরায় জন্মগ্রহণ করেন না, তিনি আমাকে প্রাপ্ত হন।
আমার জন্ম অলৌকিক, আমার কর্ম্ম অলৌকিক। এই দিব্যজন্ম-কর্ম্ম সম্পর্কে যিনি অবগত আছেন, তিনি শরীর ত্যাগ করে পুনর্বার জন্ম গ্রহণ করেন না, তিনি আমাকেই প্রাপ্ত হন।
কঠোপনিষদে যমরাজ বলছেন (শ্লোক নং ১/২/২২) বিভিন্ন দেহে দেহবিহীন অনিত্য বস্তুর মধ্যে নিত্য, অবিকৃত বৃহৎ সর্বব্যাপী আত্মাকে যিনি একাত্মতা অর্থাৎ "আমি সেই আত্মা" এই অনুভব করেন , সেই প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি শোক করেন না।
আত্মার কোনো রূপ নেই, আবার সব রূপই তাঁর। তিনি আমাদের ভিতরে আছেন, আবার তিনি আমাদের বাইরে আছেন। এই উপলব্ধি যার মধ্যে হয়েছে, তিনি জন্ম-মৃত্যুর পারে চলে যান।
কঠোপনিষদের শ্লোক নং ১/৩/১-এ বলছেন, জীবাত্মা ও পরমাত্মা বুদ্ধিরূপ হৃদয়গুহায় বাস করেন, এবং নিজ নিজ কৃত-কর্ম্মের ফল ভোগ করেন। ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তি জীবাত্মা ও পরমাত্মাকে আলো-ছায়ার মতো নিত্যযুক্ত বলে মনে করেন।
আকাশের রঙ নীল। আসলে এই রঙদর্শন আমাদের দৃষ্টিভ্রম মাত্র। আকাশের কোনো রং হয় না। শূন্য কথাটার অর্থ হচ্ছে যার মধ্যে কিছুই নেই। শূন্যের মধ্যে কিছু অবস্থান করলে, আর তা শূন্য থাকে না। জগৎ সংসারে শূন্য বলে কিছু হয় না। কিন্তু একমাত্র ভগবান স্বয়ং শূন্য। ঈশ্বরের সঙ্গে কিছুই লেগে থাকতে পারে না। ঈশ্বর নিঃসঙ্গ। তার কোনো সঙ্গীসাথী নেই। ঈশ্বরের জন্ম অপ্রাকৃত। তিনি অকর্তা, তার কর্ম্ম বলেও কিছু নেই। সমগ্র জীব কর্ম্মফল ভোগ করবার জন্য, জন্ম গ্রহণ করে থাকে। ঈশ্বরের কোনো কর্ম্ম নেই তাই তাঁর কর্ম্মফল বলেও কিছু নেই। সেইদিক থেকে দেখতে গেলে, ঈশ্বরের কখনো জন্ম-মৃত্যু বলে কিছু হয় না। তার জন্ম-কর্ম্ম দিব্যং অর্থাৎ আকাশীয়, স্বর্গীয়, দীপ্তিময়, মনোহর, সুন্দর। দিব্য-কাটা কথাটার অর্থ আমরা জানি কোনো প্রতিশ্রুতি রক্ষার অঙ্গীকার। তো ঈশ্বর তার নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য জন্ম গ্রহণ করেন বা কর্ম্ম সম্পাদন করে থাকেন। এই যে দিব্য জন্ম এটি তাঁরই ইচ্ছাধীন। এখানে অন্য কারুর হাত নেই। অর্থাৎ কর্ম্ম বা অন্য কোনো কারনে তাঁর জন্ম হয় না। তো জন্মগ্রহণ করবার জন্য, তিনি মায়াকে বশীভূত করে মায়ার সাহায্যেই জন্ম গ্রহণ করে থাকেন। দেখুন সমস্ত জীবই মায়াকে আশ্রয় করে জন্ম গ্রহণ করে থাকে। পার্থক্য হচ্ছে, তিনি মায়া দ্বারা বশীভূত নন, আর আমরা সবাই মায়াদ্বারা বশীভূত। আমরা সবাই মায়ার দ্বারাই জন্ম গ্রহণ করে থাকি। তো সাধারণ জীব ও ঈশ্বরের মধ্যে তাহলে পার্থক্য রইলো কোথায় ? যিনি সর্ব্বেশ্বর, যিনি কারুর ইচ্ছাধীন নন, তাকে আবার জন্ম গ্র্রহন করবার জন্য মায়ার আশ্রয় নিতে হবে কেন ?
দেখুন জীবসকল ঈশ্বরেরই অংশ কিন্তু অবিদ্যায় আচ্ছন্ন। জীব যখন এই অবিদ্যাকে জ্ঞানের দ্বারা ছিন্ন করতে পারবে, তখন সে স্বরূপতঃ বুঝতে পারবে, আমিই সেই। "অঽম ব্রহ্মাস্মিন" .কিন্তু আমি যে সেই তা অবিদ্যাজনিত কারনে বোঝা যায় না। এই যে ভববন্ধন - এও আমারই অর্থাৎ ঈশ্বরের। জ্ঞান লাভ করলে অজ্ঞান দূরীভূত হয়ে যায়। মেঘ কেটে গেলে, সুর্য্যের আবির্ভাব হয়। আবার আলোর প্রকাশ হলে, অন্ধকার দূরীভূত হয়। জীবকুল স্বরূপতঃ জ্ঞানময়। অজ্ঞান তাকে ঢেকে রেখেছে মাত্র । জীবকুলের স্বরূপটি জ্ঞানময়, আবার পরমাত্মার মতো জীবাত্মাও একইপ্রকার অজ, অব্যয়, অবিনাশী। এখন কথা হচ্ছে, তাই যদি হয়, তবে কেন জীবের জন্ম-মৃত্যুর কবলে পড়ে ? জীব যদি অমৃতস্বরূপ, চৈতন্যস্বরূপ হয়, সাক্ষীস্বরূপ হয়, তবে সে কি করে মারা যেতে পারে ? আসলে এইখানেই ভ্রান্তি। জন্ম-মৃত্যু আসলে এই দেহের, আর আমরা এই দেহকে আমি বলে ভুল করে থাকি। জীব ও জীবদেহ এক নয়। জীবদেহের নাশের সঙ্গে জীবের নাশ হয় বলে আমরা ভুল করে থাকি। এই যে দেহতে আত্মবোধ, অর্থাৎ দেহকেই আমি বলে ভাবা, একেই বলে বদ্ধাবস্থা। যিনি ভগবান অর্থাৎ ভাগবত জ্ঞান হয়েছে, তাঁর মধ্যে কখনো এই ভুল দেখা যায় না। তাই ভগবানের মধ্যে এই অজ্ঞানতা না থাকার জন্য, তার মধ্যে বদ্ধাবস্থা বলে কিছু থাকে না। জীবকুল যখন তার এই ভুল বুঝতে পারে, অর্থাৎ পরমাত্মার জন্ম কর্ম্ম সম্পর্কে জ্ঞাত হতে পারে, তখন তাঁর আত্মবিস্মৃতি কেটে যায়। আসলে আমাদের স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলাই আসল কাজ। আমি দেহ নোই, শুধু এই বোধে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পাড়লেই, আমাদের যথার্থ জ্ঞানের উন্মেষ হতে পারে। কিন্তু এককথা বলা যতটা সহজ এই উপল্বদ্ধিতে পৌঁছানো অত সহজ নয়। কেননা আমরা মামা বাড়িতে থাকতে থাকতে মামা-বাড়িকেই নিজের বাড়ি ভাবছি। দেহ আমাদের বাসস্থান মাত্র, আমি নোই। এই দেহে আমি কেবলমাত্র কর্ম্ম করবার জন্য এসেছি। দেহ কর্ম্ম সম্পাদন করবার একটা যন্ত্র মাত্র। কর্ম্ম শেষ হয়ে গেলে, বা আমার যে উদ্দেশ্য অর্থাৎ সংকল্প পূরণ করা, সেই উদ্দেশ্য যদি আমার এই দেহের দ্বারা সম্পাদন করা সম্ভব না হয়, অর্থাৎ দেহ অকেজো হয়ে গেলে, আমি আবার নতুন দেহের সন্ধানে বেরিয়ে পড়বো। তখন আর আমার এই দেহের কথা মনেও পড়বে না। নতুন দেহে স্থিত হয়ে, আমি আবার সেই দেহকেই আমি বলে ভাবতে শুরু করবো। কতকাল ধরে আমরা এই দেহে থেকে দেহান্তরে ঘুরে মরছি, তাও আমাদের স্মরণে নেই। তো কর্ম্ম-সূত্রে আমরা এই দেহের সাথে সম্পর্ক গড়েছিলাম। এই কর্ম্ম বন্ধন যেদিন কেটে যাবে, সেদিন আমরা আবার স্বরূপে স্থিত হবো। একেই বলে জন্ম-মৃত্যু রোহিত অবস্থা।
এখন কথা হচ্ছে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, আমার জন্ম-মৃত্যু সম্পর্কে সম্যক ভাবে অবহিত হলে, জীবকুল জন্ম মৃত্যুর হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে। শ্রী ভগবানের জন্ম-মৃত্যু অলৌকিক। কিরকম অলৌকিক সেটা আমরা একটু বুঝবার চেষ্টা করবো। দেখুন আমরা আগেই শুনেছি, জীবাত্মা পরমাত্মার অংশ। জীব ঈশ্বরের অংশ। শিব কিভাবে জীব হতে পারে ? বিদেহ অবস্থা থেকে কিভাবে এই স্থূল দেহ হতে পারে ? এইসব কথা বড়ো বিষ্ময়কর মনে হয়।
ভগবান বলছেন, তাঁর দিব্য জন্মের কথা, কর্ম্মের কথা জীব যদি অবগত হতে পারে, তবে সে জন্ম-মৃত্যুর দায় থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে। তবে তো ধরে নিতে পারি, এই জন্ম-মৃত্যুর অলৌকিক রহস্য আমাদের অবশ্যই জানবার চেষ্টা করা উচিত। কিন্তু নৈঃশব্দ থেকে থেকে বৈখরী কিভাবে হয়, কিভাবে শূন্য থেকে স্থুল দেহের সৃষ্টি হতে পারে, সেইসব কথা আমরা শুনবো ধীরে ধীরে।
..............
১২.০২.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/৯ (পূর্ব-প্রকাশের বিস্তার বিশেষ)
দেখুন কেউ বলেন, ব্রহ্ম একাক্ষর, কেউ বলেন ব্রহ্মর দুই অবস্থা, সগুন ব্রহ্ম আবার নির্গুণ ব্রহ্ম। কেউ বলেন, ব্রহ্মর তিন অবস্থা - এক হচ্ছে ব্রহ্মরূপে, দ্বিতীয় হচ্ছে, ঈশ্বর রূপে, তৃতীয় হচ্ছে অবতার রূপে। আবার কেউ বলেন, ব্রহ্মর চার অবস্থা জাগ্রত-অবস্থা, স্বপ্নাবস্থা, সুসুপ্তির অবস্থা শেষে তুরীয় অবস্থা। এগুলো সবই সত্য।
মুন্ডাক উপনিষদ বলছেন, ( শ্লোক : ২/১/২) ব্রহ্মের কোনো রূপ নেই, ইনি সর্ব্বব্যাপী, অর্থাৎ বাইরেও আছেন, আবার ভিতরেও আছেন। ইনি অজাত, অর্থাৎ এনার জন্ম-মৃত্যু বলে কিছ নেই। যিনি অপ্রাণ অর্থাৎ ইনি প্রাণবায়ু বর্জিত। তারমানে এনার শ্বাস-প্রশ্বাস বলে কিছু নেই, অর্থাৎ প্রাণহীন ও দেহহীন। এনার মন নেই। ইনি শুদ্ধ। এই স্থূল মায়া জগতের উর্দ্ধে তিনি। এমনকি তিনি জগতের বীজস্বরূপ অব্যক্ত প্রকৃতিরও উর্দ্ধে।
তাই যদি হয়, তবে এই ব্রহ্ম থেকে এই স্থুল জগতের সৃষ্টি হলো কি করে ? দেখুন এই জগৎকে যদি আমারা ব্রহ্মরূপে চিন্তা করি, তবে তা হচ্ছে, সগুন ব্রহ্ম। এই সগুন ব্রহ্ম থেকে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে নির্গুণ ব্রহ্ম। সগুন ব্রহ্মই এই জগৎ হয়েছেন। আর জগৎকে বাদ দিয়ে যদি আমরা ব্রহ্ম চিন্তন করি, তবে তা হচ্ছে পরঃ অর্থাৎ পরম ব্রহ্ম। আসলে দুইই অভিন্ন। ব্রহ্মকে গুনের দ্বারা বিশেষিত করলে তিনি সগুন, আবার গুন্ বর্জিত বা নির্বিশেষ অবস্থায় চিন্তা করলে ব্রহ্ম নির্গুণ। আসলে নির্গুণ ব্রহ্ম বর্ণনার অতীত। তো যে-কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে বোঝাবার জন্য যেমন আমরা তার গুনের বর্ণনা করি, তেমনি ব্রহ্মকে বোঝাবার জন্য, তার উপরে আমরা গুনের আরোপ করে থাকি। আর যখনই গুনের দ্বারা তাকে বোঝাতে চাই, তখন তাঁর যথার্থ স্বরূপ আমাদের কাছে অজ্ঞাতই থেকে যায়। আমরা যখন বলি, ঈশ্বর মঙ্গলময়, ঈশ্বর জগতের স্রোষ্টা, তখন আমরা আমাদের অজ্ঞাতসারেই ব্রহ্মের উপরে গুনের আরোপ করছি। আমরা যখন বলি বক সাদা। এর দ্বারা বককে আসলে বোঝানোই যায় না। তবুও আমরা যা বুঝি, বা যাকে বোঝানো হচ্ছে, সে যা বোঝে সেই মতো তাকে বোঝানো হচ্ছে। ব্রহ্মকে আমরা কেউ দেখিনি, এমনকি তাঁকে উপল্বদ্ধিও করিনি । কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ তার জ্ঞানের সাহায্যে তাঁকে জেনেছেন। গুণ নিজেই একটা গুন্ মাত্র। তো ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ ব্রহ্মকে অশেষ গুনের সমাবেশ বলে মনে করেন। এতেকরে আসলে ব্রহ্মকে বোঝানো সম্ভব হলো না। আমরা বলি, ঈশ্বর করুনাময়, ঈশ্বর দয়াময়, ঈশ্বর সর্ব্বশক্তির অধিকারী - এতে করে তাঁর যে স্বরূপ তা প্রকাশ পায় না। এগুলো সবই তাঁর উপরে আরোপিত গুন্ মাত্র।
আমরা আমাদের আলোচনার সুবিধের জন্য, ব্রহ্মের তিন অবস্থা থেকে ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করবো। ব্রহ্ম যখন মায়ার উর্দ্ধে তখন প্রথম অবস্থা। দ্বিতীয় অবস্থায় ব্রহ্ম মায়াকে স্বীকার করেন, একে আপনি ঈশ্বর ভাব বলতে পারেন, আর তৃতীয় অবস্থায় তিনি মায়ার অধীন।
বৈদিক সাহিত্যে বলা হয়ে থাকে আমরা সবাই নাকি ব্রহ্মের অংশ। আবার শব্দই নাকি ব্রহ্ম। তো তাহলে বলতে হয়, আমি শব্দ থেকে এসেছি। আমাদের অনেকের জপ ধ্যান করবার অভ্যাস আছে। এখানে আমাদের বলা হয়, একটা ধ্বনি বা শব্দের বারবার উচ্চারণ বা জপ করতে। আমরা জানি শব্দ চার প্রকার। পরা, পশ্যন্তি, মধ্যমা, বৈখরী। এই যে পরাবাক একেই বলে শব্দব্রহ্ম। এই পরাবাকের স্ফূরণ তিন প্রকার, প্রথমে পশ্যন্তি রূপে, তারপর মধ্যমা রূপে, এবং সবশেষে বৈখরীরূপে। যোগীদের দৃষ্টিতে বিশ্বব্রহ্মান্ড তিন ভাগে বিভক্ত একটি শব্দ, একটি অর্থ, আর-একটি হচ্ছে জ্ঞান। অর্থ হচ্ছে পদার্থ, শব্দ ও অর্থের মধ্যে সম্মন্ধ হচ্ছে বাচ্য ও বাচক। জ্ঞান ও অর্থের মধ্যে সম্মন্ধ হচ্ছে বিষয় ও বিষয়ী। বৈখরী অবস্থায় শব্দ ও অর্থ পরষ্পর অভিন্ন। শব্দ হচ্ছে বাচ্য, অর্থ হচ্ছে বস্তু বা বাচক । এই দুইয়ের ভেদ আছে। মধ্যমা অবস্থায় শব্দ ও অৰ্থের ভেদাভেদ সম্মন্ধ। পশ্যন্তি অবস্থায় শব্দ ও অর্থের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না।
আমরা জানি, মন্ত্রদাতা গুরু শিষ্যকে গোপনে অর্থাৎ কানে কানে, মন্ত্রবিজ প্রদান করে থাকেন। তিনি আসলে দেন বিশুদ্ধ চৈতন্য কিন্তু একটা মোড়কে ঢাকা। আমরা যেমন কাউকে উপহার দিতে গেলে, সুন্দর একটা প্যাকেটে ঢেকে উপহার সামগ্রী প্রদান করে থাকি, তেমনি গুরুদেব চৈতন্যশক্তিকে শব্দের মোড়কে ঢেকে শিষ্যকে গোপনে প্রদান করে থাকেন। অর্থাৎ স্থুল বস্তু শব্দের আবরনে ঢেকে চৈতন্যশক্তির প্রবাহ শিষ্যের স্থূল শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেন। সাধক এই শব্দকে অবলম্বন করে, চৈতন্যের জগতে প্রবেশ করে। শিষ্যকে বলা হয়, নিরন্তর এই শব্দের ধ্যান করতে, বা উচ্চারণ করতে। আসলে বারবার এই শব্দকে আঘাত আঘাত করতে করতে, একসময় শব্দ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। আর চৈতন্যেরশক্তি শব্দের আবরণ ভেঙে উন্মুক্ত হয়ে ওঠে শিষ্যের হৃদয়ে। এই চৈতন্য শক্তি জ্যোতিঃস্বরূপ। তাই জপের সাহায্যেই একসময় শিষ্যের চিত্ত জ্যোতির্ময় হয়ে ওঠে। একেই মহাত্মাগণ বলছেন চিত্ত শুদ্ধি। নিরবিচ্ছিন্ন জপ-এর আঘাতে গুরু প্রদত্ত মন্ত্রের বাহ্য আবরণ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায়। আর এক অশ্রুতপূর্ব নাদের ধ্বনি শ্রুতিগোচর হয়। মন হয়ে যায় অন্তর্মুখী। জ্যোতির প্রভাবে ভৌতিক জগতের অনুভব লুপ্তপ্রায় হয়ে যায়। এই হচ্ছে পশ্যন্তি অবস্থায় শব্দের খেলা। এই অবস্থাকে আপনি আত্ম-সাক্ষাৎকারের পূর্বাবস্থা বলতে পারেন।
এইবার আমরা শব্দের আরো গভীরে প্রবেশ করবো। কিভাবে এই শব্দব্রহ্ম থেকে এই স্থুল দেহের জন্ম হলো। মহাত্মাগণ বলছেন, এই শব্দব্রহ্মের গর্ভে একসময় বিশ্ব অব্যক্ত অবস্থায় ছিলো, আবার এই শব্দের গর্ভেই একসময় জগৎ প্রবেশ করবে। এই শব্দব্রহ্ম হচ্ছে ঈশ্বরের শক্তি-স্বরূপিণী। এরই আর এক নাম চিৎশক্তি। হিন্দু শাস্ত্রে বলছে, শিব-শক্তি। যিনি শিবরূপে শান্ত অক্ষয়-অব্যয়-নিস্পন্দ। আবার শক্তিরূপে ইনিই ক্রিয়াশীল। এই শিব ও শক্তি সহযোগে আত্মা নিজেকে পূর্ন অহং রূপে গ্রহণ করে থাকেন। এই পূর্ন অহংভাবই পরমাত্মার পরম-স্বরূপ। এখানে কোনো আবরণ নেই। এখানে জীব বা জগৎ বলে কিছুই নেই। আবার এই পূর্ন অহং-এর সংকোচ-বশতঃ আবরনের সৃষ্টি হয়ে থাকে। এই আবরণ নিজের স্ব-রূপের আবরণ এবং এই আবরনের উর্দ্ধে উন্মুক্ত স্বরূপ সর্বদা বিরাজ করছেন । এই আবরনের ফলে দুটো জিনিস সংগঠিত হয়। প্রথমত স্বরূপের বিস্মৃতি ; দ্বিতীয়ত এই আবরণকেই স্বরূপ বলে ধরে নেওয়া, বা গ্রহণ করা। উপনিষদ বলছে, লয় ও বিক্ষেপ। লয় তমোগুণের ক্রিয়া, আর বিক্ষেপ রজোগুণের ক্রিয়া।
আত্মস্বরূপ যখন আবরনে ঢাকা পড়ে তখন একদিকে মহাশূন্যের আবির্ভাব হয়, অন্যদিকে মায়ার উদয় হয় । একেই জীবাত্মা বা চিত্ত বলা হয়ে থাকে। শুদ্ধ দ্রষ্টা-স্বরূপ চিদাত্মক এই মায়িক প্রমাতাই জীবাত্মা। এই জীবাত্মা তখন মহাশূন্যে ভাসতে থাকে। মহাশূন্য তখন দৃশ্য, আর জীবাত্মা তখন দ্রষ্টা। এখন দ্রষ্টা অর্থাৎ জীবাত্মা তখন মহাশূন্যকে আর আপন বলে মনে করে না। শুরু হলো দ্বৈতভাবের। জীবাত্মা তখন গতিশীল জগতের অসংখ্য দৃশ্য দেখতে পায়। শুরু হলো অবিদ্যার বিক্ষেপশক্তির খেলা। জীবাত্মা পরম-পুরুষ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিলো। এরপর সম্বিৎ বা উন্মনা ভাবের মধ্যে যখন প্রাণের আবির্ভাব হয়, তখন দৃশ্য সকলের মধ্যে কোনো একটিকে সে আপন করে গ্রহণ করে। তখন দৃশ্য ও দ্রষ্টার মধ্যে একাত্ত্ববোধ তৈরী হয়। একেই বলে অভেদতত্ত্ব। এখন তার দেহ তৈরী হয়। এই দেহ স্থুল দেহ নয়। এটি আত্মার প্রাক্তন কর্ম্মজনিত সংস্কারের উত্থান। আত্মা তখন এই দেহটি-সহ স্থুল জগতে আসবার জন্য পথের অনুসন্ধান করে। এরপর কর্ম্ম-শক্তির প্রভাবে যোগ্য পিতা-মাতার সন্ধান পেলে, সে মাতৃগর্ভে প্রবেশ করে। মাতৃগর্ভে সে মাতৃকাশক্তির দ্বারা স্থুল দেহের রচনা করে। ধীরে ধীরে মায়ের কাছ থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে, সে নিজেকে পুষ্টিবর্ধন করে। একসময় দেহের পরিপুষ্টির ফলে মায়ের গর্ভ থেকেই কালের রাজ্যে প্রবেশ করে। ভূমিষ্ট হয়। একেই বলে প্রসব।
--------------------------------
১৩.০২.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/৯ (পূর্ব-প্রকাশের বিস্তার বিশেষ-২)
ধর্ম্ম রক্ষার্থে যাঁরা জন্ম গ্রহণ করেন, তাঁরাই অবতার পুরুষ। এদের বলা হয় মুক্ত পুরুষ, কিন্তু লোকশিক্ষার্থে, ধর্ম্ম রক্ষার্থে এঁরা দেহ ধারণ করে থাকেন। বলা হয়ে থাকে এঁরা সবাই ঈশ্বরের মতোই শক্তিসম্পন্ন। এইসব ঈশ্বরতুল্য পুরুষগন ঈশ্বরের প্রতিবিম্ব। এঁরা সর্বদা ঈশ্বরের ছায়ার মতো ঈশ্বরের অভিপ্রায় সম্পাদন করে থাকেন। এদের মনে কখনো ঈর্ষা দ্বেষ, হিংসা, এমনকি অহংভাব থাকে না। এঁরা মায়ার অধীন নয়, বরং মায়া এঁদের অধীন। এঁরা সাধারণ জীবের মতো বদ্ধ জীব নয়। এঁরা মুক্তপুরুষ। এঁরা ব্রহ্মে স্থিত থেকে মায়ার আশ্রয় করে জগতের কল্যাণ করে থাকেন। এদের কর্তৃত্বাভিমান নেই। এঁরা যেহেতু আত্মভাবে স্থিত থাকে, তাই এই কারনে কর্ম্ম এঁদেরকে বদ্ধ করতে পারে না। তখন তার কর্ম্ম-জনিত যে জন্ম-মৃত্যুর খেলা, তা তাঁকে আবদ্ধ করতে পারে না।
এই যে ঈশ্বর-ভাবাপন্ন অবতার এদের জন্ম-মৃত্যুর সঙ্গে সাধারণ মানুষের জন্ম-মৃত্যুর মধ্যে প্রক্রিয়াগত কোনো ভেদ নেই। ভেদ হচ্ছে আমাদের বোধের তারতম্যে। মায়ার অধীন হওয়ায় আমরা আমাদের স্বরূপের কথা ভুলে দেহসর্বস্য হয়ে গেছি। আর মায়ামুক্ত জীব স্বরূপেই স্থিত থাকেন, কিন্তু মায়ার কারনে সাধারণ লোকের মতোই আচরণ করে থাকেন। পার্থক্যটা হচ্ছে বুদ্ধির, জ্ঞানের।
আমরা আগেই শুনেছি, মন কিভাবে স্বস্থান থেকে অর্থাৎ আজ্ঞাচক্র থেকে বিচ্যুত হয়ে প্রাণ প্রবাহের সঙ্গে ভাসতে ভাসতে ছটি চক্রে অসংখ্য নাড়ীর সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে, স্থুল দেহ-ইন্দ্রিয়ের সাথে মিশে নিজেকে দেহমাত্র মনে করছে। এই দেহাভিমান তার মধ্যে এতটাই প্রখর, যে অন্য কিছু সে ভাবতেই পারে না। আর এই অজ্ঞানই তাকে জন্ম-মৃত্যুর কষ্ট (ক্লেশ) ভোগ করায়। কিন্তু সাধনক্রিয়ার ফলে অথবা গুরুকৃপায় যদি তার পূর্বস্মৃতি অর্থাৎ স্বরূপের স্মৃতি জেগে ওঠে তখন সে নিজ গৃহে ফিরে যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আর নিজভূমিতে অবস্থানের ফলে তার সমস্ত দুঃখ-কষ্ট দূরীভূত হয়ে যায়। সমস্ত ক্লেশের অবসান ঘটে। বাইরের শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ আর তাঁকে চঞ্চল করতে পারে না। মায়াকে তিনি উপেক্ষা করতে পারেন।
প্রাণক্রিয়া দ্বারা স্থিরমন তখন মহাশূন্যে প্রবেশ করে। তখন ওঙ্কারের ধ্বনি অন্য সব ধ্বনিকে ছাপিয়ে অনাহত নাদাদিতে পরিণত হতে থাকে। মনের বৃত্তি নিরুদ্ধ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে সে আজ্ঞাচক্র থেকে সহস্রারে স্থিত লাভ করে। এই মহাশূন্যে পৌঁছলে সাধক জন্ম-মৃত্যুর উর্দ্ধে স্বয়ং শিব বা ব্যোম-রূপে স্থিতি লাভ করেন।
দেখুন মহাপুরুষদের কখনো রক্ত মাংসের মানুষ হিসেবে ভাববেন না। তিনি এই রক্তমাংসের শরীরের উর্দ্ধে একটা তেজময় সত্ত্বায় অবস্থান করে থাকেন। রক্ত মাংসের শরীর তো আমাদের সবার - তা সে জ্ঞানী বলুন আর অজ্ঞানী বলুন, ভালো বলুন আর মন্দ বলুন, পাপী বলুন আর পুণ্যবান বলুন, ধনবান বলুন আর ধনহীন বলুন, ভিক্ষারী বলুন আর বড়লোক বলুন, ছোট বলুন আর বড়ো বলুন। আমরা সবাই এই রক্তমাংসের শরীরের উর্দ্ধে নয়। পার্থক্য হচ্ছে উপাধির, পার্থক্য হচ্ছে জ্ঞানের, পার্থক্য হচ্ছে বোধ-বুদ্ধির । একজন জ্ঞানী আর একজন অজ্ঞানী। পার্থক্য হচ্ছে আমাদের আচরণের। দেখুন ঐশ্বরিক শক্তি আমাদের সবার মধ্যেই আছে। কিন্তু এই ঐশ্বরিক শক্তির মাত্রার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। কারুর মধ্যে এই শক্তির প্রকাশ বেশি, কারুর মধ্যে এই শক্তির প্রকাশ কম। অবতার পুরুষ তা সে যীশু, কৃষ্ণ, বুদ্ধ, নানক, মহাবীর, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ এমনি সব মহামানবের মধ্যে জ্ঞানের প্রকাশ পূর্ণমাত্রায় দেখা দিয়েছিলো। এমন ভাববার কোনো কারন নেই, যে তিনি স্বয়ং ঈশ্বর, কিন্তু এই সময় তিনি অবশ্যই স্বয়ং ঈশ্বরের মতোই আচরণ করে থাকেন । এমনকি এইসময় এইসব মহাত্মা নিজের স্থুল দেহের উর্দ্ধে একটা ঐশ্বরিক ভাবময় সত্ত্বায় অবস্থান করে থাকেন। এইসময় তার জীবভাব সম্পূর্ণ লোপ পেয়ে যায়। সামান্য কিঁছু মানুষের মধ্যে এই ঋষিত্ব বা বুদ্ধত্ব দেখা যায়। কোনো সন্দেহ নেই যে এঁরা সবাই ব্যতিক্রমী পুরুষ। পিতা আর পুত্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আজ যে পুত্র, কাল সে পিতা। আজ যে ছাত্র কাল সে শিক্ষক। আর যে শিষ্য, কাল সে গুরু। তেমনি আজ যিনি ঈশ্বর কাল তিনি জীব। আজ যিনি জীব, কাল তিনিই ঈশ্বর। যার দেহে-মনে এই জ্ঞানের উন্মেষ হয়েছে, তিনি এই দেহ ত্যাগ ও গ্রহণের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখেন না। তার কাছে জন্ম-মৃত্যুর মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না।
আরো একটা গুরুত্ত্বপূর্ন কথা এখানে বলা আবশ্যক যে, যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, "আমার জন্ম কর্ম্ম দিব্য। এই বিষয়টি যিনি তত্ত্বগত ভাগে অবগত, তিনি দেহত্যাগ করে পুনরায় জন্মগ্রহণ করেন না, তিনি আমাকে প্রাপ্ত হন।" প্রশ্ন হচ্ছে এই আমি কে ? আসলে সাধক যখন সমাধিস্থ হন, যখন তিনি ব্রহ্মে স্থিত হন, তখন সমাধিস্থ মহাত্মার আমি-আমার বোধ বলে কিছু থাকে না। তখন তিনি স্বয়ং ব্রহ্ম। এই যে জন্ম হয় একেই দিব্যজন্ম বলা হয়, এখানে সব শূন্য অথচ সব পূর্ন। এই অবস্থায় সাধক একবার পৌঁছলে, আর তার জন্ম হতে পারে না। একেই বলে স্বধাম। শিবঽম শিবঽম। এখানেও ভগবান যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে স্বয়ং ব্রহ্ম বলে জানবেন। শ্রীকৃষ্ণ এখানে স্বয়ং শিবরূপী ব্যোম। আমরা সেই শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করি।
-----------------------------------
১৪.০২.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/১০
বীতরাগ-ভয়-ক্রোধা মন্ময়ামাং-উপাশ্রিতাঃ
বহবো জ্ঞান তপসা পূতা মদ্ভাবম আগতাঃ। (৪/১০)
আমাতে তন্ময় হয়ে, আমাকে একান্ত ভাবে আশ্রয় করে, আসক্তি ভয় ও ক্রোধ বর্জিত হয়ে বহু ব্যক্তি আমার জন্ম কর্ম্মের তত্ত্ব আলোচনা পূর্বক জ্ঞানময় তপস্যার দ্বারা পবিত্র হয়ে আমার ভাবে নিমজ্জিত হয়ে যায়।
মানুষ যখন ইচ্ছা-রহিত হয়ে যায়, যখন তার মধ্যে ক্রোধের বিন্দু মাত্র আভাস দেখা যায় না, যখন সে বোঝে যে আত্মাই সর্ব্ব-ব্যাপক, যখন সে বোঝে যে সর্বকর্ম্ম আত্মার সন্তুষ্টির জন্য হয়ে থাকে, যখন সে সর্বত্র আত্মাকেই দেখতে থাকে, তখন সেই সাধক আসলে কূটস্থে স্থিত। তিনি তখন পবিত্র আত্মা বৈ কিছু নয়। এটি হচ্ছে সাধনক্রিয়ার সর্ব্বোচ অবস্থা অর্থাৎ পরাবস্থা।
যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে সেই পথের সন্ধান দিচ্ছেন, যে পথে আত্মস্বরূপে ফিরে যাওয়া যায়। বিষয় আমাদের-কে তাড়া করে বেড়াচ্ছে সর্বদা । আমরা বিষয়ের প্রতি অনুরক্ত। ভাবতে অবাক লাগে স্বয়ং ঈশ্বর আমাদের এই ইন্দ্রিয়গুলোকে বহির্মুখী করে তৈরী করেছেন। আর একমাত্র এই কারণেই মানুষ বিষয়সমূহকে অবগত হতে পারে । আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো যদি বহির্মুখী অর্থাৎ বিষয়মুখী না হয়ে, অন্তর্মুখী হতো, তবে তো আমরা সহজেই অন্তরাত্মাকে জানতে বুঝতে পারতাম । কিন্তু তিনি তা করেন নি। সামান্য কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ ইন্দ্রিয়গুলোকে বিষয় থেকে সরিয়ে অন্তর্মুখী করে, নিজ স্থুল শরীরের মধ্যেই আত্মাকে দর্শন করে থাকেন।
এখন কথা হচ্ছে, ইন্দ্রিয়গুলো বহির্মুখী কেন ? আমরা জানি ভোগ কিন্তু আত্মাই (জীবাত্মা) করে থাকেন । এই আত্মা যখন বিষয় গ্রহণে অভিলাষী হন, তখন মন-বুদ্ধি তাঁকে সাহায্য করবার জন্য, আত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বিষয় ভোগে লিপ্ত হয়। আসলে সমস্ত বিষয়ের মধ্যেও সেই একই আত্মা আছেন। মন আত্মার ভোগ্য হিসেবে সেই আত্মাকেই খোঁজে। কিন্তু মন বিষয়ে সম্পৃক্ত হয়ে বিষয়ের বৈচিত্রে মোহিত হয়ে, বিষয়ের মধ্যেই আটকে যায়, বদ্ধ হয়ে যায়। একসময় বিষয়ের মধ্যে আত্মাকে দেখতে না পেয়ে, নিজে জ্বলেপুড়ে মরতে থাকে, ক্লেশের শেষ সীমায় পৌঁছে যায়। আর যখন এই ক্লেশের সীমায় গিয়ে দাঁড়ায়, তখন তার মধ্যে বিরক্তির উদ্রেগ হয় আর এই কারনে, যথার্থ শান্তির সন্ধানের লিপ্সা জেগে ওঠে। দেখুন, খারাপ জিনিস খেলে তো মানুষ তাড়াতাড়ি বিরক্ত হয়, কিন্তু ভালো জিনিস খেতে খেতেও একসময় খাবারের প্রতি অনীহা আসে। আর এই বিষয় অনীহা যখন তীব্র আকার নেয়, তখন সে সাধন ক্রিয়ার দ্বারা অন্তর্মুখী হয়। আর এই অন্তর্মুখী ভাব থেকেই, মানুষের মধ্যে যে ইচ্ছা-ক্রোধ-ভয় ছিল, সেগুলো ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে পেতে একসময় সম্পূর্ণ ভাবে লোপ পেয়ে যায়। বাসনা কমতে কমতে মন অন্তর্মুখী হয়ে স্থির হয়ে যায়। এই অবস্থায়, একটা প্রশান্তির শীতল বাতাস লাগে মনে। মন যখন আত্মাতে প্রবিষ্ট হয়, সেই অবস্থাকেই বলে মদ্ভাব প্রাপ্তি। তখন সব কিছু দেখেও সে আর দেখতে পায় না, সব কিছু শুনেও সে আর শুনতে পায় না।
অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের কাজ ইন্দ্রিয় করে বটে, কিন্তু ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে মন-বুদ্ধি সংলগ্ন না থাকার জন্য, বিষয়ের বিষজ্বালা তাকে আর ভোগ করতে হয় না। একসময় আত্মজ্যোতির প্রকাশ ঘটে। মধুর অনাহত ধ্বনি শুনতে পায়। আর আত্মার স্বভাব যেহেতু আনন্দ, তাই মনও আনন্দে মেতে থাকে।
যে জীব একসময় বিষয়ের মধ্যে আনন্দ অন্বেষণরত ছিলো, সে এখন স্ব-স্বরূপেই আনন্দের সন্ধান পেয়ে গেছে। প্রাণবায়ু স্থির হয়ে গেছে। আর মনের বাহ্যিক দৃষ্টি না থাকায়, মনের পবিত্রভাবের সমাহার হতে থাকে। সাধন করতে করতে একসময় সাধকের সমাধির অবস্থা আসন্ন হয়। এই সমাধি সাধককে শিবভাবে স্থিত করে। ত্রিতাপ জ্বালার সমাপ্তি হয়, পরমানন্দ সাগরে অবগাহন করতে থাকে। প্রাণায়াম ইত্যাদির অভ্যাস করতে করতে একসময় কূটস্থে স্থির হয়ে থাকা একটা আদতে পরিণত হয়ে যায়। একেই বলে জ্ঞানময় তপস্যা। এই জ্ঞানময় তপস্যা সাধককে পরমাত্মার সাথে নিজেকে অভেদজ্ঞান সম্পন্ন করে তোলে। এই অবস্থার প্রারম্ভে সাধকের মন থেকে ভয়-ক্রোধ-দ্বেষ-বিষয়ানুরাগ লোপ পায়। জ্ঞানময় তপস্যায় সাফল্যের এটাই লক্ষন।
সহজ ভাবে বলতে গেলে, মানুষ একসময় তার সীমিত শক্তি দিয়ে সাধন ক্রিয়া শুরু করে, পরে একসময় গুরু বা আচার্য্যের সাহায্য নিয়ে শাস্ত্র-নির্দিষ্ট পথে দ্রুত অগ্রসর হয়, এরপরে, ভগবান স্বয়ং সদ্গুরুরূপে মায়াবদ্ধ জীবকূলকে আকর্ষণ করে। আর এই সদ্গুরুরূপী ভগবান, বা অবতারপুরুষ অনির্বান হন সাধকের ভিতরেই। ভগবানের এই স্পর্শ বা সাক্ষাৎ সাধকের কুণ্ডলিনী শক্তিকে একলহমায় জাগ্রত করে তোলে। এবং মুহূর্তের মধ্যে তার মধ্যে থেকে বিষয়ানুরাগ চলে যায়। সাধারণ অবস্থায়, সাধকের মধ্যে যত দুষ্প্রবৃত্তি ছিলো, তার বিলোপ সাধন হয়। কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ, ভয়-দুশ্চিন্তার অবসান হয়। সাধক তখন একটা পরম-পবিত্র মনের অধিকারী হন, এমনকি একটি শুদ্ধ নীরোগ শরীরের অধিকারী হন। আর এসব ঘটে থাকে একমাত্র অবতার পুরুষের ছোঁয়ায়। এটাই অবতারপুরুষের মহিমা, জ্ঞানসাধনার পরিণতি।
------------------
১৫.০২.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/১১-১২
যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্ব্বশঃ। (৪/১১)
হে পার্থ যে আমাকে যেভাবে ভজনা করে, আমি তাকে সেই ভাবে তুষ্ট করি। মনুষ্যগন যে যেপথের অনুসরণ করুন না কেন, সব পথই আমার পথ।
যে আমাকে টানে আমিও তাকে টানি। আকর্ষণ পরস্পর। তবে অনেক সময় একদিকের টান অনুভবে আসে, অপরদিকের টান অনুভবে আসে না। কেউ যদি নিস্কলুষ হয়ে বসে থাকে, তবে কেউ তাকে ভালোবাসলে, সেও তাকে ভালোবাসবে। এই ভালোবাসা ইচ্ছাকৃত নয়, এই ভালোবাসা আসলে স্বভাবের কারনে হয়ে থাকে। এটি বোঝা যায় যদি নিরপেক্ষ দৃষ্টি স্থাপন হয়। আলো থাকলে ছায়া থাকবে। অন্ধকারের ছায়া থাকে না। ভক্ত হলে ভগবান আসবে। ভক্তি না থাকলে ভগবান নেই।
যে সাধনক্রিয়ায় মনোযোগী হয়, তার মন তাড়াতাড়ি স্থির হয়, সাধনক্রিয়া মনে আনন্দের অনুভূতি এনে দেয় । আর যে সাধনক্রিয়ায় অমনোযোগী, তার এই আনন্দলাভ বিলম্ব হয়। সাধনার গভীরতা যার যত বাড়ে, তার মধ্যে আনন্দের প্রবাহ তত বাড়তে থাকে। শ্রী ভগবান বলছেন, যে আমাকে যেভাবে ভজনা করে, অর্থাৎ যার যেমন কর্ম্মের পথ সে সেই পথেই আমার কাছে পৌঁছাতে পারে। আসলে সূর্য্যের কাছে পৌঁছাবার জন্য নির্দিষ্ট কোনো রাস্তা নেই, আবার এমন কোনো পথ নেই, যে পথে সূর্য্যের কাছে যাওয়া যায় না। শ্রীভগবান হচ্ছেন সমস্ত কর্ম্মের ফলদানকারী। যার মধ্যে যে ফলের আকাংখ্যা তীব্র, ভগবান তার কাছে সেই ফল প্রদান করে থাকেন। এখন কথা হচ্ছে, সবাই আমরা সেই একই ভগবানের সন্তান, তাহলে আমাদের মধ্যে ভগবানের ঐশ্বর্য্য বিতরনে ভগবানেরই এই বৈষম্য কেন ? দেখুন, আমরা সবাই আনন্দের সন্ধানী। তো কেউ দুধ পান করে আনন্দ পায়, আবার কেউ মদ পান করে আনন্দ পায়। একটা শিশু খেলনা গাড়ি পেয়ে আনন্দ পায়, কিন্তু পূর্ন যুবক খেলনা গাড়িতে খুশি হতে পারে না। ঠিক তেমনি কেউ হয়তো জাগতিক বিষয়ে আনন্দ অনুভব করে, আবার কারুর মধ্যে অধ্যাত্ম জ্ঞানের চাহিদা থাকে। আবার কেউ সকামী তো কেউ নিস্কামী। বিষয়াসক্ত ব্যক্তি জানে, বিষয় ভিন্ন আনন্দ নেই কোথাও। কিন্তু সমস্ত বস্তুর দুটো দিক আছে, একটা তার বাহ্যিক দিক, আর একটা অন্তর্নিহিত দিক। যারা বিষয়াসক্ত তারা এই বাহ্যিক দিকে মশগুন। নারকোলের কঠিন আবরণ ছাড়িয়ে না নিতে পারলে, নারকোলের রসের সন্ধান পাওয়া যায় না। ফুলের সৌন্দর্যে, এমনকি ফুলের গন্ধে আমরা বিমোহিত কিন্তু ফুলের অন্তঃস্থলে আছে মধু যার সন্ধান একমাত্র মধু-মক্ষিকাই জানে। গবুরে পোকা ফুলের কাছেও যেতে চায় না। তবে যে যা-ই চাক না কেন, মূলত সবাই সেই আনন্দের খোঁজ করছে। আর সেই আনন্দ ধনে নেই, সেই আনন্দ প্রতিষ্ঠায় নেই, সেই আনন্দ নেই কোনো সম্পর্কে, অর্থাৎ স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-তে নেই। আনন্দের উৎসটি হচ্ছে সেই উত্তম পুরুষ, যিনি আমাদের সবার হৃদয়কেন্দ্রে স্থিত আছেন। মানুষ যে যাই বলুক না কেন, আর যে যা মনে করুক না কেন, এই আনন্দের উৎস সে নিজেই।
নিজেকে স্থির করতে না পারলে, তা সে শারীরিক দিকে থেকে হোক বা মানসিক দিক থেকে হোক, স্থিরতা প্রাপ্ত না হলে, আমরা এই সত্যকে উপলব্ধি করতে পারবো না। সাধন জগতেও কেউ পুজো-পাঠ করতে ভালোবাসেন, কেউ তত্ত্বজ্ঞান সংগ্রহ করতে ভালোবাসেন, কেউ আবার স্থির হয়ে অন্তরের অন্তঃস্থলে ডুবে যেতে ভালো বাসেন। কেউ যোগের ক্রিয়া করে, নিজেকে স্থির করতে চান। কেউ নির্জনে ধ্যানস্থ হয়ে অবস্থান করে থাকেন। কেউ অনাহত ধ্বনিতে বিভোর হয়ে আছেন, কেউ কূটস্থে স্থিত হয়ে চিদাকাশে বিচিত্র দর্শন করছেন। কেউ শব্দে মোহিত হচ্ছে, কেউ রূপে মোহিত হচ্ছে। যে যাই দেখুক, যে যেভাবেই দেখুক, যেখানেই দেখুক, সে সবই সেই পরমপুরুষের প্রকাশ মাত্র। বেদে বলা হয়েছে, "একং সদ বিপ্রাঃ বহুধা বদন্তি" সেই সদ্বস্তু একই, কিন্তু পন্ডিতগণ এঁকে বহুরূপে বর্ণনা করেছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন হে পার্থ, আমার রূপ, গুন্, ঐশ্বর্য্য অপার অনন্ত। তবে জীবগন যে যেভাবে আমাকে চায়, আমি সেইভাবেই তার মনঃস্কামনা পূরণ করে থাকি। আসলে এইখানে শ্রীগীতার বৈশিষ্ঠ। সাধক যেকোনো পথ অবলম্বন করুক, আন্তরিকতা ও ব্যাকুলতা যদি থাকে, তবে তিনি মনমতো কাঙ্খিত বস্তু পেতে পারেন বা সিদ্ধিলাভে সমর্থ হবেন। এই উদারতা একমাত্র সর্ব্বমঙ্গলময় ঈশ্বরের পক্ষেই দেখানো সম্ভব।
কাঙ্ক্ষন্তঃ কর্ম্মণাং সিদ্ধি যজন্ত ইহ দেবতাঃ
ক্ষিপ্ৰং হি মানুষে লোকে সিদ্ধির্ভবতি কর্ম্মজা (৪/১২)
ইহলোকে যারা কর্ম্ম-সিদ্ধি কামনা করে, তারা বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা করে. কারন, মনুষ্যলোকে এমন সকাম কর্ম্মের ফল শীঘ্রই লাভ হয়ে থাকে।
আমরা সংসারী। সংসারের অভাব অনটন লেগেই আছে। সুখ-দুঃখে কাটে এই সাংসারিক জীবন। আমাদের মধ্যে বেশিরভাব মানুষেরই সামান্য কামনা-বাসনা। আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে। আর এই সামান্য চাহিদা পূরণের জন্য, মানুষ উদয়-অস্ত খেটে মরছে। শ্রী ভগবান মানুষের এই সামান্য চাহিদা সম্পর্কেও সম্যক ভাবে সচেতন। তাই বলছেন, যারা ফালাকাঙ্খ্যার নিমিত্ত দেবতাদের পূজা-অর্চনা করছেন, ভগবান তাদের চাহিদাও পূরণ করে থাকেন।
জীবকুলের ভোগবাসনা স্বাভাবিক। এটি জীবের অজ্ঞানতার জন্য হয়ে থাকে। যোগের মূল উদ্দেশ্য ঈশ্বরের সাথে মিলিত হওয়া। সত্যকে আবিষ্কার করা। কিন্তু বহু সাধক আছেন, যার যোগ-ঐশ্বর্যের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। যোগের ঐশ্বর্য্য পাবার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এমনকি সাধারণ মানুষ যোগীপুরুষের যোগৈশ্বর্য্য প্রদর্শনের জন্য, বা প্রয়োগের জন্য যোগীর কাছে প্রার্থনা করে থাকেন। আসলে প্রকৃত যোগৈশ্বর্জ্য হচ্ছে, ইচ্ছারহিত হওয়া, সমস্ত কামনা-বাসনার উর্দ্ধে যাওয়া। এমনকি ঈশ্বরপ্রাপ্তিও তার কাছে কাঙ্খিত হয়। অর্থাৎ ফালাকাঙ্খ্যা শূন্য হয়ে অবস্থান করা। কিন্তু সত্য হচ্ছে ইচ্ছারহিত হওয়া সহজসাধ্য নয়। অজ্ঞান দ্বারা আচ্ছাদিত আমাদের চিত্তে বাসনার তরঙ্গ প্রতিনিয়ত ঢেউ তুলছে। এই বাসনার ঢেউকে প্রশমিত করা সহজ সাধ্য নয়। আমাদের বহির্মুখী মন যেমন বিষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে, তেমনি আমাদের অন্তর্মুখী মনও সেই অসীম শক্তিকে ধরতে চাইছে। শুধু চাওয়া আর চাওয়া। আর চাওয়া যতক্ষন না পূরণ হচ্ছে, ততক্ষন আমাদের মনের চঞ্চলতা দূর হতে পারে না। তাই আমাদের মনকে প্রথমে বিষয়মুখ থেকে ঘুরিয়ে অন্তর্মুখী করতে হবে। শুধু অন্তর্মুখী করলে হবে না, এই মন কে আমাদের আজ্ঞাচক্রে স্থিত করতে হবে। কিন্তু এই কাজ কি এতোই সহজ ? এই কঠিন কাজটি করে দিতে পারে, আমাদের সঠিক প্রাণায়াম ইত্যাদি যোগক্রিয়া । নিশ্চল হয়ে বসে থাকবো, এটি আপনি ভাবতে পারেন, কিন্তু আপনি কখনোই নিশ্চল হয়ে বসে থাকতে পারেন না। মন ইতস্তত ঘোরাফেরা করতেই থাকে। এখান থেকে মনকে ধরে এনে, আজ্ঞাচক্রে বসানো কঠিন থেকে কঠিনতর। দেখুন প্রাণায়াম একটা ক্রিয়া। রেচক-পূরক-কুম্ভক। এর দ্বারা মনকে শান্ত করা যায়। এটি ফলিত বিদ্যা। এগুলো শুনে কোনো কাজ হয় না। এইসব ক্রিয়া দীর্ঘকাল অভ্যাস করলে, এর সত্যতা উপলব্ধি হয়। আপনি কি কখনো প্রণবের উচ্চারণ করেছেন ? ৩-৫ বার মাত্র এই দীর্ঘ প্রণবের উচ্চারণ করার পরেই একটু বিশ্রাম নিতে চেষ্টা করুন। শ্বাসের দিকে খেয়াল করুন। দেখবেন, আপনার শ্বাস-প্রশ্বাস কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে গেছে। আবার শ্বাস-প্রশ্বাস শুরু হলেই প্রণব মন্ত্রের জপ শুরু করুন। প্রতি ৫-১০ বার দীর্ঘ প্রণব মন্ত্র উচ্চারণ করার পরে, বিশ্রামের ভঙ্গিতে বসে শ্বাস প্রশ্বাসের দিকে খেয়াল করুন। দেখবেন কয়েক সেকেন্ড আপনার মন চিন্তাশূন্য হয়ে গেছে। এই অভ্যাস চালিয়ে যেতে থাকুন। চিন্তাশূন্য মন মানেই শান্ত মন, আর শান্ত মন মানেই শান্তি।
সকাম উপাসনার মধ্যে প্রার্থনা একটা উৎকৃষ্ট উপায়। প্রার্থনায় মন শান্ত হতে পারে। এমনকি প্রার্থনা মানুষকে তার অভীষ্ট পূরণ করে দিতে পারে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে , আর রাতে ঘুমুতে যাবার আগে প্রার্থনা করলে, প্রার্থনা ফলপ্রসূ হয়। নিয়মিত শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী পূজা পাঠেও মানসিক শান্তি আসতে পারে। আসলে আত্মসমর্পনের ভাব নিয়ে, মনের একাগ্রতা সহকারে, আপনি যেকোনো কাজই করুন না কেন, সেই কাজে আপনার সাফল্য আসার সম্ভাবনা অবশ্যই বেশি থাকবে। এমনকি আপনার আচার-আচরণের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষিত হবে। আপনি মনে মনে যখন ভগবানের রাজত্বে বাস করবেন, তখন আপনার ভিতর থেকে ভয়-ভীতি দূর হয়ে যাবে। আমাদের বৈদিক শাস্ত্রে, অনেক যাগযজ্ঞ-এর উল্লেখ আছে, এই যাগযজ্ঞ-এর দ্বারা মানুষ অনেক বিষয়বাসনা পূরণ করতে পারেন। দৈনন্দিন জীবনের নানান রকম সমস্যার সমাধানের অনেক উপায় এখানে বর্ণনা করা আছে। এসবের দ্বারাও মানুষের সাংসারিক জীবনে উপকার হতে পারে। তো আপনি যাকিছুই করুন না কেন, প্রতিটি কর্ম্মের একটা ফল আছে, আর সেই ফলের দাতা হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান।
----------------
১৬.০২.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/১৩
চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুনকর্ম্ম-বিভাগশঃ
তস্য কর্ত্তারমপি মাং বিদ্ধি-অকর্তারম-অব্যয়ম্। (৪/১৩)
গুন্ ও কর্ম্ম ভেদে চতুর্ব্বর্ন আমার দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে। আমি তার সৃষ্টিকর্ত্তা হলেও আমাকে অকর্ত্তা বা বিকার রোহিত বলে জেনো।
গুন্ অর্থাৎ সত্ত্বঃ রজঃ ও তমঃ - প্রকৃতির এই তিন গুন্। ভগবান বলছেন, এই গুন্ ও তার কর্ম্ম অনুসারে আমি চারটি বর্ণ সৃষ্টি করেছি। আমি কে না আমি হচ্ছে আত্মা। আমি না থাকলে মন-বুদ্ধি ইন্দ্রিয় কাজ করতে পারে না।এই দিক থেকে দেখতে গেলে, এই যে মন-বুদ্ধি-ইন্দ্রিয়সকলের কর্তা হচ্ছেন আত্মা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এরা যে কাজ করে তার ফলভোক্তা আত্মা নন। তো যিনি ফলভোক্তা নন তাকে কর্ত্তা কিভাবে বলা যেতে পারে ? তাই ভগবান বলছেন, আমি কর্ত্তা নোই। কিন্তু আমি (আত্মা) না থাকলে এরা কোনো কাজেই সক্ষম নয়।
সত্ত্ব হচ্ছে শুভ্র বর্ণ। কূটস্থের চতুর্দিকে আছে চিদাকাশ। এই চিদাকাশে যখন শুভ্রবর্ণের জ্যোতি প্রকাশ ঘটে তখন বুদ্ধি নির্মল হয়। আর নির্মল বুদ্ধিতে সমস্ত বিষয় প্রকাশ পেয়ে থাকে। আসলে আমাদের মন যখন শান্ত হয়, তখন চিদাকাশে এই শুভ্রবর্ণের প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। একে বলা যেতে পারে সত্ত্বভাবময় অবস্থা। আবার এই মনে সত্ত্বগুণের প্রকাশ থাকা সত্ত্বেও যদি রজোগুণের আধিক্য দেখা যায়, তখন এই চিদাকাশে বা অন্তরাকাশে শ্বেত আভাযুক্ত রক্তবর্ণ অর্থাৎ গোলাপি রঙের অভ্যাস দেখতে পাওয়া যায়। এইসময় সত্ত্ব ও রজঃ দুটো গুনের মধ্যে তেজঃশক্তির প্রাবল্য দেখতে পাওয়া যায়।
আবার একসময় মনের মধ্যে যখন অস্থিরতা শুরু হয়, তখন চিদাকাশের রঙ বদলে হয়, পীতাভ। এইসময় রজঃ ও তমঃ উভয় গুনের প্রাবল্য দেখতে পাওয়া যায়। আর যখন তমোগুণের প্রভাব বেশি থাকে, তখন কূটস্থের চতুর্দিকে চিদাকাশে জ্যোতি অন্ধকার বা কালো বর্ণের বলে মনে হয়। এইসময় কোনো প্রকাশ বা জ্যোতি পরিলক্ষিত হয় না।
একেই অধ্যাত্ম দৃষ্টিতে চাতুর্বর্ন বলা হয়ে থাকে। সাধক যখন প্রাথমিক অবস্থায় চোখ বুজে ধ্যানের জন্য প্রস্তুত হয়, তখন সে চোখের সামনে অন্ধকার বৈ অন্যকিছু দেখতে পায় না। ধীরে ধীরে নীল, গোলাপি ও শুভ্র বর্ণ দর্শনের অধিকারী হয়। অর্থাৎ সাধকের মধ্যে থেকে যখন তমোগুণের রজোগুণের ক্ষয় হতে হতে সত্ত্বগুণের প্রকাশ ঘটে তখন সে শুভ্রবর্ণের জ্যোতির প্রকাশ দর্শন করে নিজেকে ধন্য করে।
সত্ত্বঃ : শুভ্র
সত্ত্বঃ ও রজঃ : গোলাপি
রজঃ ও তমঃ - পীতাভ
তমঃ - কালো
বিঃদ্রঃ : আমাদের বৈদিক শাস্ত্রে (ঋক্বেদে) এই বর্নব্যবস্থার আরো একটা ব্যাখ্যা আছে, যাকে বাহ্যিক বর্নব্যবস্থা বলা যেতে পারে। সেখানে বলা হচ্ছে :
ব্রাহ্মণোঽস্য মুখমাসীদ্বাহূ রাজন্য কৃতঃ।
ঊরুতদস্য যদ্বৈশ্যঃ পদ্ভ্যাং শূদ্র অজায়ত। (১০/৯০/১২)
আমাদের মুখ হচ্ছে জ্ঞানের প্রকাশ দ্বার। তাই এখানেই ব্রাহ্মণ স্থিত। আমাদের বাহু বা হস্তদ্বয় হচ্ছে আমাদের কর্ম্মের মূল তাই ক্ষত্রিয়। বসে-বসে যেহেতু শিল্পে-কর্ম্ম করা হয়, তাই উরুদ্বয় হচ্ছে বৈশ্য। পদদ্বয় হচ্ছে শূদ্র যা আসলে স্থূল কর্ম্ম বা গমনাদি জ্ঞাপক। অবশ্য এর মানে এই নয়, যে মুখ বা চরণ থেকে জাত বলে, কেউ ছোটো বা বড়ো। এটি একটা রূপক মাত্র। মা গঙ্গা শ্রীভগবানের পাদোদ্ভব, তাই বলে গঙ্গা কি কোনো নদীর থেকে ছোট ? বরং গঙ্গায় অবগাহন করে ব্রাহ্মণ শূদ্র সবাই কৃতার্থ হচ্ছেন। শরীরের সমস্ত অঙ্গ সমান গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে যে কোনো অঙ্গের হানি হলে, তা আমাদের সার্বিক সত্ত্বাকে বিপর্যস্থ করে।
আসলে আমাদের শরীরের মধ্যে যদি বর্নব্যবস্থার সন্ধান করতে যাই তবে দেখবো , আমাদের মস্তিস্ক ব্রাহ্মণ, কারন সেখানেই আমাদের জ্ঞানীন্দ্রিয়গুলোর অবস্থান, জ্ঞানভান্ড । বাহুদুটো আমাদের ক্ষত্রিয় - কারন এই বাহুদুটোই শরীর রক্ষার জন্য এগিয়ে আসে। বাহুদুটো আমাদের শক্তি প্রদর্শনের হাতিয়ার। পেট হচ্ছে আমাদের বৈশ্য, কেননা এই পেট হচ্ছে আমাদের সমস্ত খাদ্যের পরিপাক ও বিতরণ কেন্দ্র। এই বিতরণকেন্দ্রে যে সমাজে ঠিক ঠিক মতো কাজ করতে পারে না, সেখানে অসাম্য, অস্থিরতা, দেখা যায়। আর পা হচ্ছে আমাদের ভরকেন্দ্র বা আশ্রয়দাতা, শূদ্র।
আরো একটু অন্যভাবে ভাবলে আমরা বুঝতে পারবো, আমরা সবাই জন্ম গ্রহণ করি শূদ্র হয়ে অর্থাৎ অজ্ঞানী হয়ে। ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে নিজেকে রক্ষা করবার রজঃশক্তি জন্মায়, তখন আমরা ক্ষত্রিয় শক্তির অধিকারী হয়। এর পরে রজঃ বা তেজশক্তির সাহায্যে আমরা যখন কর্ম্ম জীবনে প্রবেশ করি তখন আমরা বৈশ্য অর্থাৎ বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন হই। এর পরে ধীরে বিষয়জ্ঞান ছেড়ে আমরা একসময় আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সন্ধানী হই অর্থাৎ বিপ্র । এই বিপ্র একসময় ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে ব্রাহ্মণ হয়।
আবার আমরা যদি সামাজিক দৃষ্টিতে দেখি - সমাজে যারা জ্ঞানসংগ্রহের বা জ্ঞান বিতরণের কাজ করেন, তারা ব্রাহ্মণ। যারা আমাদের দেশ, জাতিকে রক্ষার কাজ করেন, তারা ক্ষত্রিয়। আর যারা সংসারে সম্পদ সংগ্রহ ও বিতরণের কাজ করেন তারা বৈশ্য। যারা অজ্ঞান অবস্থায় বাস করেন, বা আমাদের সমাজকে কলুষমুক্ত করেন, তারা শূদ্র। এর মধ্যে কোন ভাবটি আপনি গ্রহণ করবেন, তা আপনার নিজের জ্ঞান ও অবস্থানের উপরে নির্ভর করবে।
কিন্তু কথা হচ্ছে আপনি যদি সাধক হোন, তবে আপনাকে সাধনক্রিয়ার যাত্রাপথে যে বর্ণের সমন্বয় আপনার চিদাকাশে ভেসে উঠবে, জানবেন, আপনি সেই অবস্থায় বা সেই গুনের অধিকারী হয়ে আছেন। এর সঙ্গে এই জন্মের সম্পর্ক না থাকলেও, পূর্ব-পূর্ব জন্মের সংস্কার তো অবশ্যই আছে। জন্ম-জন্মান্তরের সাধকগণ চক্ষু বুজলেই আলোর প্রকাশ স্বরূপ জ্যোতি দেখতে পান। যেমন দেখতে পেতেন আমাদের স্বামী বিবেকানন্দ, জন্ম-জন্মান্তরের সাধক। তিনি নাকি চোখ বুজলেই জ্যোতির দর্শন পেতেন।
তবে একটা কথা বলি, আমরা সবাই যে যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন, সবাই আমরা সেই পরম-ব্রহ্মের আশ্রয়েই আছি। কে তমোগুণ সম্পন্ন, কে সত্ত্বগুণ সম্পন্ন সেটা বড়ো কথা নয়। একটা জিনিস জানবেন, এই যে ত্রিগুন সত্ত্বঃ রজোঃ তমঃ ব্রহ্মকে আশ্রয় করেই অবস্থান করছে। আসলে তমোঃ গুনের আশ্রয়ে যিনি থাকেন, তিনি তার মধ্যে জীব ভাব বেশি থাকে। তবে সমস্ত গুনই একসময় সত্ত্ব গুনে লোপ পায় । সমস্ত বর্ণ ধীরে ধীরে কলুষমুক্ত হয়ে শুভ্র হয়ে যায়। একটা জিনিস জানবেন, জড়বস্তু থেকে ধীরে ধীরে প্রাণের উদ্ভব হয়েছে। আর এই প্রাণীদেহের বিবর্তনের ফলে ধীরে ধীরে প্রাণী মনুষ্যদেহ অর্থাৎ উন্নত দেহ প্রাপ্ত হয়েছে। এই যে বর্ণভেদ আসলে জ্ঞান বিকাশের তারতম্য মাত্র।
সাধনক্রিয়ার ফলে মানুষ স্বল্প সময়ের মধ্যেই নিজেকে উন্নত করে নিতে পারে। নাদ বা প্রণবের জপ্-সাধনার দ্বারা, ধীরে ধীরে মানুষ জ্যোতির দর্শন পেতে পারে। ব্রহ্মজ্ঞানী পুরুষ প্রথমে প্রবনরূপে নিজেকে জানতে পারেন। এই প্রণব যখন পরব্রহ্মে লয় হয়, তখনই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হতে পারে। আর ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হলে মানবশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ হওয়া সম্ভব।
প্রচলিত বর্নব্যবস্থা আমাদের সমাজের বা ব্যক্তির কোনো উপকারে আসে না। যথার্থ সাধনক্রিয়ার ফলে যখন কেউ ব্রাহ্মণ হন, তখন তিনি সমাজের উপকারে আসতে পারেন। জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা নয়, বরং গুরুসান্নিধ্যে সাধনক্রিয়াই একজন ব্রাহ্মণের জন্ম দিতে পারে, অন্যথায় আমরা সবাই শূদ্র ।
--------------------------
১৭.০২.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/১৪-১৫
ন মাং কর্ম্মাণি লিম্পন্তি ন মে কর্ম্মফলে স্পৃহা
ইতি মাং যোঽভি-জানাতি কৰ্ম্মভির্ন স বধ্যতে । (৪/১৪)
কর্ম্ম আমাকে লিপ্ত করতে পারে না। আমরা কর্ম্ম ফলে কোনো স্পৃহা নেই। আমাকে যিনি এইভাবে জ্ঞাত হয়েছেন, তিনি কর্ম্ম দ্বারা আবদ্ধ হন না।
এবং জ্ঞাত্বা কৃতং কর্ম্ম পূর্ব্বৈরপি মুমুক্ষুভিঃ
কুরু কর্ম্মৈব তস্মাৎ ত্বং পূর্ব্বৈঃ পূর্ব্বতরং কৃতম। (৪/১৫)
আমাকে এইভাবে জেনে পূর্ব্বেকার মুমুক্ষুগণ কর্ম্ম করেছেন। অতএব তুমি সেই পূর্ব্ববর্ত্তিগনের অনুষ্ঠিত কর্ম্মসকলের অনুসরণ করো।
ব্রহ্ম সগুন আবার নির্গুণ। এই সগুন ব্রহ্মই এই জগতরূপ ধারণ করে আছেন। সগুনরূপে ঈশ্বর সৃষ্টি থেকে শুরু করে, সমস্ত কর্ম্ম অনাসক্ত ভাবে পরিচালনা করছেন। ঈশ্বরের এই লীলা আমাদের দৃষ্টির অগোচরে ঘটে চলেছে। আত্মা স্বয়ংপূর্ন। আত্মাতে কোনো বাসনা নেই। সাধনক্রিয়া যোগে যিনি আপ্তকাম হতে পেরেছেন, তিনি এই তত্ত্ববোধ সম্পন্ন হতে পেরেছেন। এই আপ্তকাম ব্রহ্মজ্ঞপুরুষ দেহ-মন-বুদ্ধির উর্দ্ধে অবস্থান করেন। ক্রিয়ার এই পরাবস্থায় যিনি পৌঁছে গেছেন, তিনি সমস্ত কর্ম্মের সাক্ষীরূপে অবস্থান করেন। তাঁর মধ্যে কোনো দেহাত্মভাব থাকে না। কোনো কর্তাভাব থাকে না। ঠাকুর রামকৃষ্ণ তাঁর স্থুল দেহকে কখনো "আমি" বলতেন না। বলতেন "এইটে" ।
উপনিষদের দৃষ্টিতে আমরা সবাই ব্রহ্ম। তো আমরা যদি সবাই ক্ষুদ্র ব্রহ্ম বা ব্রহ্মের অংশ হই, তবে আমরা আত্মার ন্যায় কেন দ্রষ্টা হতে পারবো না। আত্মার মধ্যে কোনো কর্তাভাব নেই, তাকে কর্ম্মফল স্পর্শ করতে পারে না। তো আমাকে কেন কর্ম্মফল ভোগ করতে হবে ? আসলে কর্ম্মফলে আসক্ত হয় মন। আত্মার কর্ম্মও নেই, আবার কর্ম্মবন্ধনও নেই। সাধক সাধনক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে আত্মার এই নির্লিপ্ত ভাব, সম্পর্কে জানতে পারেন। আত্মা কোনোকিছুতেই লিপ্ত হন না। ঈশ্বর সমস্ত জীবের মধ্যে অবস্থান করছেন। আবার এই একই ঈশ্বর সমস্ত জগতের সঙ্গেই ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছেন। সাধক সাধনার উচ্চাবস্থায় পৌঁছুলে, আত্মার স্ব-ভাব সম্পর্কে অবহিত হন। সর্বত্র তিনি আত্মাকেই দর্শন করে থাকেন। এই অবস্থায়, সাধকের কর্ম্মফল স্পর্শ করতে পারে না।
কিন্তু এই আত্মা আবার যখন অজ্ঞান অন্ধকারে ঢাকা পড়ে, আত্মা যখন আবরনের আড়ালে চলে যায়, তখন আবার কর্তাভাব জেগে ওঠে। এই কারনে সাধক যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন, এমনকি তিনি যদি সাধনার সর্ব্বোচ অবস্থাতেও অবস্থান করেন, তথাপি তাকে সাধন ক্রিয়া করে যেতে হয়। কারন ক্রিয়া ত্যাগ করলেই সাধকের পতনের সম্ভাবনা থাকে। বিশেষ করে যিনি সাধনার পরিণতিতে পৌঁছাতে পারেন নি। ক্রিয়ার পরাবস্থায় আত্মার সাক্ষীভাব স্পষ্ট বোঝা যায় এবং এই অবস্থা স্থায়ী হলেই জীবনমুক্ত হওয়াও যায়। কিন্তু সাধন বিরতি হলে, পতনের সম্ভাবনা থাকে। তাই সাধনক্রিয়া চালিয়ে যেতে হয়। সাধনক্রিয়া যখন স্বভাবের মধ্যে ঢুকে পড়ে, অর্থাৎ সাধক বাহ্যিক দিক থেকে যাই করুক না কেন, তার ভিতরে ভিতরে নিরন্তর সাধনক্রিয়া চলছে, এই অবস্থায় না পৌঁছানো পর্যন্ত বাহ্যিকভাবে তাকে সাধনক্রিয়ার মধ্যে লিপ্ত থাকতে হয়। এমনকি তিনি যদি বাহ্যিক সাধনক্রিয়া থেকে কোনো কারনে, নিজেকে নিস্পৃহ করেন, তবে দেখা যাবে, তাঁর দেখাদেখি, তাঁর শিষ্যদের মধ্যে এর প্রভাব পড়বে।
----------------------------
১৮.০২.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/১৬-১৭
কিং কর্ম্ম কিমকর্ম্মেতি কবয়োঽপ্যত্র মোহিতাঃ
তত্তে কর্ম্ম প্রবক্ষ্যামি যজ জ্ঞাত্বা মোক্ষ্যসেঽশুভাৎ। (৪/১৬)
কর্ম্ম কি, অকর্ম্ম কি - এ বিষয়ে পন্ডিতগণ মোহপ্রাপ্ত হন। সুতরাং এই কর্ম্মরহস্য তোমাকে এখন বলছি, যা অবগত হলে তুমি অশুভ হতে মুক্ত হতে পারবে।
কর্ম্মণো হ্যপি বোদ্ধব্যং বোদ্ধব্যঞ্চ বিকর্ম্মণঃ
অকর্ম্মণশ্চ বোদ্ধব্যং গহনা কর্ম্মণো গতিঃ। (৪/১৭)
কর্ম্ম কি, বিকর্ম্ম কি এবং অকর্ম্মই বা কি - এ সম্পর্কে ভালোভাবে বোঝা প্রয়োজন। কর্ম্ম ও কর্ম্মের গতি অতি দুর্জ্ঞেয়।
কর্ম্মণ্যকর্ম্ম যঃ পশ্যেদকর্ম্মণি চ কর্ম্ম যঃ
স বুদ্ধিমান মনুষ্যেষু স যুক্তঃ কৃৎস্ন-কর্ম্মকৃৎ। (৪/১৮)
যিনি কর্ম্মে অকর্ম্ম ও অকর্ম্মে কর্ম্ম দর্শন করেন তিনিই মনুষ্য সমাজে জ্ঞানী, যোগী ও সর্বকর্ম্ম পারদর্শী।
বেদান্ত মতে ঈশ্বর সর্বময় কর্তা, আর জীব তার হাতের ক্রীড়নক। সাংখ্য দর্শন বলছেন, সমস্ত কাজ হচ্ছে পৃকৃতির দ্বারা, এখানে আত্মার কোনো কর্তৃত্ত্ব নেই। আবার জীবকুল ভাবে, কর্ম্ম করছে তারাই। ভক্তের কাছে সব কাজ ভগবানের। দেহাভিমানী, পুরুষাকারে বিশ্বাসী ভাবেন, কর্ম্ম হচ্ছে শরীরের ক্রিয়া। আবার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, "ভূত-ভাবোদ্ভবোকরো বিসর্গঃ কর্ম্মসংজ্ঞিত" অর্থাৎ ভূতের অভ্যুদয়-কারক যে প্রচেষ্টা তাকেই কর্ম্ম বলা হয়।
বিকর্ম্ম অর্থাৎ বিশেষ কর্ম্ম। অর্থাৎ শাস্ত্রের নির্দেশ যে কর্ম্ম করা হয়, তাকে বলে বিকর্ম্ম। আর অকর্ম্ম হচ্ছে কর্ম্মরহিত অবস্থা, অর্থাৎ কর্ম্ম না করা। যেমন আলস্য বা কর্ম্মে উদাসীনতা ইত্যাদি। আবার হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে কর্ম্ম করলে, কর্ম্ম অকর্ম্মে পরিণত হতে পারে।
আসলে কর্ম্মের গতি বোঝা দুঃসাধ্য। কি করলে কি হয়, কে বলতে পারে ? এই কর্ম্মই মানুষের বন্ধনের কারন। এই কর্ম্মের কারণেই মানুষের জন্ম-মৃত্যু। এই কর্ম্ম করবার জন্য এই জীবদেহ ধারণ। কোনো দেহে কর্ম্মফল সঞ্চিত হয়, আবার কোনো দেহে একই কর্ম্ম কোনো ফল প্রদান করে না। ভোগদেহে অর্থাৎ দেবতা বা পশুপাখির কোনো কর্ম্মফল সঞ্চিত হয় না। এমনকি এঁদের কর্ম্ম পাপ-পুণ্যের উর্দ্ধে। তাই কর্ম্মের রহস্যঃ বোঝা দুস্কর। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একসময় বলেছিলেন, হে অর্জ্জুন, এই যুদ্ধের পরিণতি তুমি জান না। যুদ্ধে পরাজিত হলে তুমি বীরগতি প্রাপ্ত হবে, স্বর্গ লাভ করবে। আবার জয়যুক্ত হলে, এই পৃথিবীর রাজত্ত্ব ভোগ করবে।
এখন কথা হচ্ছে, যোগের দৃষ্টিতে প্রকৃত কর্ম্ম হচ্ছে মুক্তিলাভের পন্থা। কিন্তু কর্ম্ম না বুঝে করলে, কর্ম্মবন্ধন কাটে না, মুক্তিও আসে না। এইজন্য কর্ম্ম রহস্যঃ জ্ঞাত হওয়া প্রত্যেক সাধকের পক্ষে জরুরি। দেখুন যথার্থ কর্ম্ম সম্পর্কে আপনার জ্ঞান না থাকলে, কর্ম্ম কখন যে অপকর্ম্মে পরিণত হবে, তা আপনি ধরতে পারবেন না। সাধনক্রিয়া করতে বসে, আমরা যদি সংস্কারবশতঃ বিষয়চিন্তায় মগ্ন হয়ে যাই, তখন তা অপকর্ম্ম হয়ে গেলো। আবার বিষয়কর্ম্মের মধ্যে আমরা যদি ঈশ্বরচিন্তন করতে পারি, তবে তা যথার্থ কর্ম্ম হতে পারে।
সমস্ত কর্ম্মই দেহ-ইন্দ্রিয় দ্বারা কৃত হয়ে থাকে। তো এই দেহ-ইন্দ্রিয়গুলোকে সঠিক ভাবে কর্ম্মে নিযুক্ত করবার জন্য আমাদের শিক্ষার প্রয়োজন। আমরা সাধারণত সাংসারিক প্রয়োজন বশতঃ, কামনার বশবর্তী হয়ে, এমনকি রাগ-লোভ-হিংসা-দ্বেষ ইত্যাদির বশবর্তী হয়ে কর্ম্ম করে থাকি। ভোগ লিপ্সার কারণেও আমরা কর্ম্ম করে থাকি।
আসক্তিজনিত যেকোনো কর্ম্মই আমাদের বন্ধনের কারন। এই ধরনের কর্ম্ম যেমন আমাদের জন্ম-মৃত্যুর কারন, তেমনি আমাদের সুখ-দুঃখের কারন। আসক্তির কারনে আমরা কর্ম্মে প্রবৃত্ত হই। আর এই আসক্তি থেকে যে কর্ম্ম, তা আমাদের পুনঃ পুনঃ অনুষ্ঠান করতে বাধ্য করে। ধরুন রসোগোল্লার প্রতি আপনার একটা আকর্ষণ হলো, বা সিগারেটের প্রতি আপনার কৌতূহল হলো। রসোগল্লার স্বাদ আপনাকে তৃপ্তি এনে দিলো। সিগারেট খেয়ে একটা অন্যরকম অনুভূতি হলো। তো রসোগোল্লা দেখলেই, বা রসোগোল্লার কথা মনে হলেই, আমরা মিষ্টির দোকানে জ্ঞাতসারে হোক বা অজ্ঞাতসারে হোক, ঢুকে পড়ি। কাউকে সিগারেট খেতে দেখলেই, বা খাবার পরে, একটা সিগারেটে টান দেবার কথা মনের মধ্যে জেগে উঠলো। এই যে সিগারেট খাওয়া বা রসোগল্লার স্বাদ গ্রহণ করা, বারবার কয়েকবার এই কর্ম্মে প্রবৃত্ত হবার ফলে, আমাদের আদতে পরিণত হয়ে যায়। আর ধীরে ধীরে আমাদের এই অভ্যাস সংস্কারে পরিণত হয়ে যায়। আর সংস্কার বশে আমরা কাজ করতে বাধ্য হই। একটা সময় এমন হয়, ডাক্তার নিষেধ করলেও, আমরা সিগারেট বা রসোগল্লা ছাড়তে পারি না। কলুর বলদ যেমন ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছায় কর্ম্ম করতে বাধ্য হয়, তেমনি মানুষ এমনকি জীবকুল সংস্কার বশে কাজ করতে বাধ্য হয়। আমরা বলি, ভগবান করাচ্ছেন, আর সত্য হচ্ছে, সংস্কার আমাদেরকে কর্ম্মে প্রবৃত্ত করছে।
এখন কথা হচ্ছে, আমরা কেউ উদ্দেশ্যবিহীন কর্ম্ম করি না। কর্ম্মফলের আকাঙ্খাতেই আমরা কর্ম্মে প্রবৃত্ত হই। পাগলেও উদ্দেশ্যবিহীন কর্ম্ম করে না। উদ্দেশ্য না থাকলে, আমরা কর্ম্মে উৎসাহবোধ করি না। কর্ম্ম করতে গেলে আমাদের অসংস্কৃত মনে কর্ম্মফলের উদ্দেশ্য থাকবেই। আবার কর্ম্ম না করে আমরা এক মুহূর্তও থাকতে পারি না। কেননা, এই শরীর কর্ম্ম নিমিত্ত তৈরী হয়েছে। আর কর্ম্মের মাধ্যমেই এই শরীরের রক্ষা হয়ে থাকে। কর্ম্মত্যাগ করে, কোনো মহাত্মও স্থুল দেহে অবস্থান করতে পারেন না। .................... তাই কর্ম্মতত্ত্ব সম্পর্কে ভালোভাবে জানা প্রয়োজন।
----------------------------
১৯.০২.২০২২ : অংশ - ১ (শ্লোক :১৭-১৮)
ফলাকাঙ্খ্যা রহিত হয়ে কর্ম্ম সব থেকে শ্রেষ্ঠ। এতেকরে কর্ম্মজনিত শুভ বা অশুভ কোনো ফলই ভোগ করতে হয় না। অর্থাৎ এই কর্ম্ম করা বা না করায় কোনো পার্থক্য হয় না। এখন কথা হচ্ছে আমরা কাজ করি গায়ের জোরে। আবার কর্ম্ম ত্যাগ করতে চাই গায়ের জোরে। এই যে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ না করে থাকা, বা অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাজ করা, এতে করে কর্ম্মফল থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। আসলে চিত্তে যতক্ষন মলিনতা থাকে, চিত্ত যদি অশুদ্ধ থাকে, তবে আমাদের কর্ম্মফল ভোগ করতেই হবে। তা সে আপনি কর্ম্ম করুন বা না করুন। অশুদ্ধ চিত্তে চিন্তার মালিন্য হেতু মন অশুভ কর্ম্ম সম্পাদন হয়ে থাকে। সুতরাং চিত্তের অশুদ্ধ অবস্থা যতক্ষন না যাচ্ছে, ততক্ষন আমাদের সত্যিকারের কর্ম্ম ত্যাগ হলো না। ফলাকাঙ্খ্যা শূন্য হয়ে আমাদের প্রাণকর্ম্ম নিরন্তর চলছে । তাই আমাদের শারীরিক ও মানসিক শক্তিকে এই প্রাণ-কর্ম্মে নিয়োগ করতে হবে। এই প্রাণের সাথে যখন আমরা মনকে যুক্ত করতে পারবো, তখন মন প্রাণের ন্যায় ফালাকাঙ্খ্যা শূন্য হতে পারবে। আর মনের ক্রিয়াগুলো হবে অর্থাৎ মনের চিন্তা হবে ফলাকাঙ্খ্যা রোহিত। আমরা জানি আমরা যাকিছু শারীরিক কর্ম্ম করি না কেন, তা আসলে মনের নির্দেশেই হয়ে থাকে। আর আমরা সবাই বুঝি, যার মন পরিষ্কার, তার কর্ম্ম ভালো। আর যার মনের মধ্যে প্যাঁচ, তার কর্ম্মও খারাপ। তো মন যখন প্রাণের সঙ্গে মিশে নিশ্চল হয়ে যায়, তখন আমাদের সমস্ত কর্ম্মই হবে ফালাকাঙ্খ্যা রহিত। যোগীপুরুষ তখন বাহ্যিক দিক থেকে যাই করুন না কেন, তা হবে কামনারহিত, আসক্তিহীন। আর এই আসক্তিহীন কর্ম্ম কোনো কর্ম্মবন্ধন সৃষ্টি করতে পারে না। আবার একটা জিনিস জানবেন, আমাদের মন যখন স্থির থাকবে, তখন আমাদের বুদ্ধি হবে তীক্ষ্ণ। আর বুদ্ধি যার স্বচ্ছ তার কর্ম্ম হবে বুদ্ধিযুক্ত। এইজন্য সাধন ক্রিয়ার যারা পরাবস্থায় থাকেন, তাঁরা বুদ্ধিমান। আমাদের মন, বুদ্ধি, ইন্দ্রিয়সকল, সমস্তই জড় কিন্তু সূক্ষ্ম। আত্মার চৈতন্য হেতু এদেরকে চেতনবান বলে মনে হয়।
এখন দেখা যাক এই কর্ম্মের কর্তা কে ? আমরা সৎ-অসৎ যে কর্ম্মই করি না কেন, এই কর্ম্মের কর্তা হচ্ছে আমাদের অহঙ্কার । আর এই অহঙ্কারের উৎপন্ন হয়, আত্মার সাথে বুদ্ধির মিলন হেতু। এই অহঙ্কার সমস্ত কর্ম্মের সম্পাদক। কিন্তু কর্ম্ম করবার সময় এই করণগুলোর দ্বারা আমাদের মধ্যে একটা ভ্রমের উৎপন্ন হয়। আমাদের মনে হয়, আত্মাই সমস্ত কর্ম্ম করছে। চেতন ধর্ম্ম আত্মার নিজস্ব। এই চেতন ধর্ম্ম বুদ্ধিতে আরোপিত হয়। বুদ্ধি তখন মন-ইন্দ্রিয়ের দ্বারা কর্ম্ম করে থাকে। আর আমাদের মনে হয় এই কর্ম্ম আত্মাই করছেন । এই ভাবের মধ্যে দিয়ে আমরা যত কর্ম্ম করি, তত আমাদের অহংকারের বৃদ্ধি হয়। আর অহংকার যত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে, জীবের কর্ম্ম বন্ধন তত দৃঢ় হতে থাকে। তো একটা জিনিস বুঝতে হবে, কর্ম্ম কখনো আত্মার নয়। তাই আত্মারূপী শ্রীকৃষ্ণের মুখে আমরা শুনেছি, আমার (আত্মার) কোনো কর্ম্ম নেই। কিন্তু আমরা জানি আত্মা-ভিন্ন চরম সত্য আর কিছুই নেই। তো বলা যেতে পারে কর্ম্ম ও তার কর্তা বলেও কিছু নেই। এগুলো আমাদের ভ্রম মাত্র। আর এই ভ্রমের বশবর্তী হয়েই জীবকুলের যত যন্ত্রনা। এই জ্ঞান যার মধ্যে জাগ্রত হয়েছে, তার কর্ম্ম করা আর না করার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কর্ম্মের এই গূঢ়তত্ত্ব যিনি জেনেছেন, তারাই কর্ম্ম ও অকর্ম্ম-এর মধ্যে পার্থক্য ধরতে পেরেছেন। আবার আত্মা কোনো কর্ম্মের কর্তা নন এই সত্যও তাঁদের কাছে দৃঢ় হয়েছে। এই ধারণা দৃঢ় হলে, অহংকার বলে কিছু থাকে না। আর অহংকার না থাকলে, কোনো কর্ম্ম বন্ধন থাকতে পারে না। জীব এই অহংকারের বশেই কর্ম্মফল ভোগ করে থাকে। যখন অহংকার মিটে যায়, তখন আর ফলপ্রাপ্তি থাকে না।
আত্মাতে যোগযুক্ত পুরুষ অহঙ্কারশূন্য হয়ে কর্ম্ম-ইন্দ্রিসকল দ্বারা যখন কর্ম্ম সম্পাদন হয় তখন কর্ম্মবন্ধন থাকে না। তাই অহংকার-বিহীন যোগীর পক্ষে ভালো-মন্দ বলে কিছু থাকে না। একদল মানুষ আছেন, যারা কর্ম্ম বন্ধনের ভয়ে কর্ম্ম থেকে বিরত থেকে আত্মপ্রসাদ লাভ করে থাকেন। তারা ভাবেন, বাহ্যিক কর্ম্ম ত্যাগ করলেই বোধহয় কর্ম্ম ত্যাগ হয়ে গেলো আর তিনি মহাত্যাগী হয়ে গেলেন। এদের অহংকার নষ্ট হয়নি, এরা অহংকারের বশেই কর্ম্মত্যাগ করতে চান। আসলে এই যে কর্ম্ম না করা, এটা আলসেমি ছাড়া কিছু নয়, এরা কর্ম্মশূন্য হবার কারনে যে প্রকৃতিবিরুদ্ধ কার্য করছেন, তার ফল এদেরকে ভোগ করতে হয়। এই কর্ম্ম না করা, এরমধ্যেও যারা কর্ম্ম দেখছেন, এঁরাও বুদ্ধিমান।
আমরা আগেই শুনেছি, প্রাণ স্থির না হলে মন স্থির হয় না। আর মন স্থির না হলে, বুদ্ধি স্থির হয় না। আর বুদ্ধি স্থির না হলে, আত্মার নিশ্চল বা অক্রিয় অবস্থা সম্পর্কে কোনো জ্ঞান জন্মায় না। এই মন-বুদ্ধিকে স্থির করবার জন্য, আমাদের প্রাণের সাধনা করা উচিত। প্রাণের সঙ্গে একাত্ম হবার চেষ্টা করা উচিত। যোগের উচ্চ অবস্থায়, আত্মার এই নিশ্চল অবস্থা বেশ উপলব্ধ হয়। এই সমস্ত উচ্চস্তরের সাধক তখন সংসারের কাজে বিমুখ হন না। আবার হাতে কাজ না থাকলেও, তারা বিমর্ষ হন না। এঁদের মধ্যে সাধনক্রিয়ায় একাগ্রতার গভীরতা এতো বেশি থাকে যে, এঁদের মন থাকে নিরোধ, মনে থাকে না কোনো সংকল্প, এদের চিত্ত থাকে বিশুদ্ধ। আর চিত্তের বিশুদ্ধ অবস্থাতেই এদের আত্মসাক্ষাৎকার রূপ জ্ঞানলাভ হয়ে থাকে। এঁকে আপনি যোগারূঢ় অবস্থা বলতে পারেন। এই অবস্থায় তিনি কর্ম্ম-ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যতই কর্ম্ম করুন না কেন, কর্ম্ম তাকে আবদ্ধ করতে পারে না। একেই বলে ফলাকাঙ্খ্যা রহিত কর্ম্ম। .........
------------------------------------------
১৯.০২.২০২২ অংশ-২ (শ্লোক ১৭-১৮)
ফালাকাঙ্খ্যা রহিত হয়ে কর্ম্ম না করতে পারলে আমরা ভালো মন্দ যেমন কর্ম্মই করি না কেন, কর্ম্মবন্ধন থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। সুতরাং যারা ভাবছেন, কর্ম্ম না করে চুপ করে থাকলেই হয়তো কর্ম্মবন্ধন থাকবে না, তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। কর্ম্ম নিজের জন্য নয়, সমস্ত কর্ম্ম ভগবৎকর্ম্ম - এই ভাবনা যার মধ্যে জেগেছে, তার কর্ম্ম বন্ধন নেই। ভগবৎ সান্নিধ্যে থেকে কর্ম্ম করতে হবে। ভাগবত ইচ্ছেয় কর্ম্ম করতে হবে, ভগবানের প্রীতার্থে কর্ম্ম করতে হবে। এই ভাবনা নিয়ে যিনি কর্ম্ম করতে পারেন, তিনি বুদ্ধিমান। বুদ্ধি যার যোগযুক্ত, তীক্ষ্ণ, তিনি ভগবানের সঙ্গেই যোগযুক্ত আছেন। এই হচ্ছে কর্ম্মের অবস্থা। ছান্দোগ্য উপনিষদ বলছে, সাধকের সমস্ত কর্ম্মই যজ্ঞ। আর যজ্ঞাদি কর্ম্মে কখনো বন্ধন নয়, মুক্তি সম্ভব। যজ্ঞে যজ্ঞাধিপতি উপস্থিত থেকে যজ্ঞফল গ্রহণ করে থাকেন। তাই যজ্ঞের আয়োজক কখনো যজ্ঞের ফলের অধিকারী নন। আবার যজ্ঞাদি কর্ম্ম আমাদের ইন্দ্রিয়াদি সাধ্য। কিন্তু যজ্ঞকারী যোগী জানেন, তিনি ইন্দ্রিয়াদির অতীত আত্মা। সুতরাং তিনি যজ্ঞের আয়োজক হলেও, এই আগের ফল যজ্ঞাধিপতির প্রাপ্য।
আবার আপনারা জানেন, পশুবধ ব্যাতিত যজ্ঞ সম্পূর্ণ হয় না। এই পশু হচ্ছে আমাদের অশুভ প্রবৃত্তি। যজ্ঞ যদি এই প্রবৃত্তিরূপ পশুবধ ব্যতিরেকে হয়, তাহলে যজ্ঞ নিষ্ফলা। জপ্ হচ্ছে, সর্বশ্রেষ্ঠ যজ্ঞ। জপের মধ্যে আবার অজপা জপ শ্রেষ্ঠতর। এই অজপা জপেও পশুবধ করতে হয়। প্রবৃত্তিরূপ পশুকুল, আমাদের মহা অনিষ্ট সাধন করছে। এই পাশবিক প্রবৃত্তিকে আমাদের যজ্ঞে বলি দিতে হবে। কাম-ক্রোধ, অর্থাৎ ছাগ-মহিষ বলি দিতে হবে। বলি বটে বলি দিতে হবে, কিন্তু ছাগ-মহিষকে (কাম-ক্রোধ) আয়ত্ত্বে আনতে পারি না, তাই বলির কাজও সম্পাদন হয় না। এই কাম-ক্রোধরূপ অশুভ প্রবৃত্তিকে আয়ত্ত্বে আনতে গেলে আমাদের জ্ঞানের দ্বারা বিচার শুরু করতে হবে। শুধু বিচার করলে হবে না, বুদ্ধিকে শুদ্ধ করে বিচার করতে হবে। বুদ্ধিকে শুদ্ধ করতে হলে, মনকে স্থির করতে হবে । আর মনকে স্থির করতে গেলে, প্রাণবায়ুকে স্থির করতে হবে। ধ্যানাদির অভ্যাস করতে হবে। বাহ্যপদার্থ থেকে মনকে সরিয়ে সংকল্প শূন্য করতে হবে। মনের চিন্তাকে নিষ্ক্রিয় করতে হবে। এই লক্ষে স্থির থেকে ব্যবহারিক কর্ম্ম করে যেতে হবে। এই হচ্ছে সাধন-ক্রিয়ার মূল কথা। এই সাধনায় কর্ম্মে অকর্ম্ম দর্শন ঘটবে। এই সাধনায় কর্ম্মে অকর্ম্ম জ্ঞান হবে। এই হচ্ছে কর্ম্মফল থেকে নিষ্কৃতি পাবার উপায়। মন যখন থাকবে কূটস্থে, কর্ম্ম ইন্দ্রিয় তখন স্বভাব বশতঃ যাকিছু করুক না কেন, তার ফল সাধককে স্পর্শ করতে পারবে না। একেই বলে চিৎস্বরূপে অবস্থান করে কর্ম্ম সম্পাদন করা।
-----------------------
২০.০২.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/১৯-২০
যস্য সর্ব্বে সমারম্ভাঃ কামসঙ্কল্প বর্জ্জিতাঃ
জ্ঞানাগ্নি দগ্ধ কর্ম্মানং তমাহুঃ পণ্ডিতং বুধাঃ। (৪/১৯)
যাঁর সমস্ত প্রচেষ্টা কামনা ও সংকল্প বর্জ্জিত, জ্ঞানরূপ অগ্নি দ্বারা যাঁর কর্ম্মসকল দগ্ধ হয়েছে - এমন ব্যক্তিকে জ্ঞানীগণ পণ্ডিত বলে মনে করেন।
আমরা যখন গীতা পাঠ করি, আমরা যখন শ্রীচন্ডী পাঠ করি, এমনকি রামায়ন-মহাভারত পাঠ করি, তখন আমাদের মধ্যে একটা পুন্য অর্জনের ভাবনা কাজ করে। গীতায় শ্রীভগবানের উক্তিকে উপলব্ধি করতে পারি না। আমরা মৃতদেহের বুকের উপরে গীতা গ্রন্থখানি রেখে ভগবানের কাছে, মৃতব্যাক্তির আত্মার শান্তি কামনা করি। এতেকরে কোনো কাজ হয় কি হয় না, তা আমরা জানি না। কিন্তু শ্রীগীতার মধ্যে যে নির্দেশ আছে, শ্রীগীতার মধ্যে যে অসীম জ্ঞানের ভান্ডার আছে, তার ধারে কাছেও আমরা যেতে চাই না। আমাদের মধ্যে এই জ্ঞান অর্জনের স্পৃহাও নেই। হিন্দু শাস্ত্র বলছে, আপনি যতোবড়ো পুণ্যবান ব্যক্তি হোন না কেন, আপনার জন্ম-মৃত্যুর যন্ত্রনা সহ্য করতেই হবে। আপনি যত পুন্য সঞ্চয় করবেন, সেই পুন্য ভোগ করবার জন্য, আপনাকে দেবদেহে স্বর্গবাস করতে হবে। আবার পুণ্যফল শেষ হয়ে গেলে, আপনাকে আবার এই মৃত্যুপুরীতে জীবদেহ ধারণ করে আসতে হবে। আমরা অনেকসময় অপ্রয়োজনীয় বিষয় কামনা করে থাকি। পুন্য সঞ্চয়ের চেষ্টা করি। কাল কি হবে, অতীতে কেন এমন ঘটেছিলো, অমুক কেন আমাকে এসব কথা বললো, ইত্যাদি ইত্যাদি বহু অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে চিন্তা করি। আর এতে করে, আমাদের বর্তমানের যে কর্ম্ম, বা বর্তমানের যে কর্তব্য তা করতে ভুলে যাই। আমরা অনেক সময় লোভের বশে বস্তুর কামনা করে থাকি। আমরা অন্যের দেখাদেখি নিজেকে সাজাতে চাই। এর কোনোটাই প্রয়োজনীয় বিষয় নয়। তথাপি, এই অপ্রয়োজনীয় কাজে আমরা গর্ববোধ করি।
যিনি এইসব অপ্রয়োজনীয় কর্ম্মকে দদ্ধ করতে পেরেছেন, যিনি এইসব কর্ম্মে উদাসীন, যিনি বৃথা চিন্তা করেন না, যিনি লোভের বশে কোনো ভবিষ্যৎ কর্ম্ম সন্মন্ধে সংকল্প করেন না, তিনিই পণ্ডিত, তিনিই দগ্ধকর্ম্মা। বিষয়ে কৌতূহল, কৌতূহল থেকে অভিমান, অভিমান থেকে আসক্তি, আসক্তি থেকে কামনার উদ্ভব হয়। প্রকৃত পণ্ডিতের মধ্যে এই কৌতূহলের নিবারণ হয়েছে। তাই তার মধ্যে অভিমান জাগে না। এই অভিমানই সাধনক্রিয়ার পথে অন্তরায়। কেননা সাধন করতে করতে যদি কোনো সময় মনের মধ্যে উদয় হয়, যে কবে যোগৈশ্বর্য্য লাভ হবে, কতদিনে মুক্তি হবে, কবে ভাগবত সাক্ষাৎকার হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি ভাবনা জাগে তবে বুঝতে হবে, এই সাধনক্রিয়া সঙ্কল্পরহিত নয়। এই ধরনের সাধকের সাধন ফল হবে না, এমনটা নয়, কিন্তু এই সাধনক্রিয়া তাকে পরাবস্থাতে পৌঁছতে দেবে না। এমনকি এই সাধনফল তাকেই ভোগ করতে হবে। তাই এই সাধনক্রিয়া নিস্কর্ম হলো না। চরম জ্ঞানলাভের ক্ষেত্রে এই সাধনা ফলপ্রসূ হবে না। এমনকি এই সাধনার ফলে তাকে আবার উপযুক্ত পরিবেশে দেহ ধারণ করতে হবে। ঋষি-পুরুষ-এর সংসারে জন্ম নিতে হবে।
কিন্তু যিনি কোনো লাভালাভের কথা চিন্তা না করে, ফলাফলের কথা চিন্তা না করে, গুরুবাক্য অনুসারে, সাধনক্রিয়ায় চালিয়ে যান, তার কোনো সংকল্প করবার দরকার পরে না। কেননা কর্ম্ম করলে তার একটা ফল হবে, গুরুবাক্য অনুসারে কর্ম্ম করলে, ফল অবশ্য়ই শুভ হবে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তাই সন্দেহাতীত হয়ে, ধৈর্য্যের সাথে সাধনক্রিয়া যার ধর্ম্ম তিনি সঙ্কল্পরহিত হয়ে কর্তৃত্বাভিমান শূন্য হয়ে লক্ষে পৌঁছে যান। এর জন্য কোনো সংকল্প করবার প্রয়োজন হয় না। বিড়ালছানাকে দেখেছেন, মা যেখানে রেখে যায়, বা মা যেখানে নিয়ে যায়, সেখানে সে নির্বিবাদে অবস্থান করে। কখনো প্রশ্ন করে না, কেন রেখেছো ? কখনো সেখানে থেকে বেরিয়েও পড়ে না। কখনো সুরক্ষার অভাববোধ করে না। তো সাধকের গুরুপ্রদত্ত সাধনক্রিয়ার প্রবাহ একসময় সাধককে উৎকৃষ্ট ফল প্রদান করে থাকে। এর জন্য তাকে কর্ম্মফলের তৃষ্ণা জাগাতে হয় না। সংকল্পও করতে হয় না। এই জ্ঞান যে সাধকের মধ্যে জাগ্রত হয়েছে, তিনিই সাধকশিরমনি পণ্ডিত।
ত্যক্ত্বা কর্ম্মফলাসঙ্গং নিত্যতৃপ্তো নিরাশ্রয়ঃ
কর্ম্মণ্যভিপ্রবৃত্তোঽপি নৈব কিঞ্চিৎ করোতি সঃ। (৪/২০)
কর্ম্মফল ত্যাগ করে যিনি নিত্যতৃপ্ত ও নিরাশ্রয়, তিনি কর্ম্মে নিযুক্ত হলেও তিনি কিছুই করছেন না।
ফলের আকাঙ্খ্যা থাকলে তৃপ্তির সম্ভাবনা নেই। কেননা ফলের তৃষ্ণা যেমন মিটাবার নয়, তেমনি তৃপ্তি কখনো চিরস্থায়ী হতে পারে না। যার মন থেকে ফলের আকাঙ্খ্যা নির্মূল হয়ে গেছে, তিনি সদা তৃপ্ত।
সাধারনের মন, সারাক্ষন সংকল্প-বিকল্প কিছু-না-কিছুকে অবলম্বন করে থাকে। কিন্তু সাধনক্রিয়ার পরাবস্থায় এই সংকল্প-বিকল্প কিছুই থাকে না। তখন বিষয়স্পৃহা বলেও কিছু থাকে না। মন তখন নিজেকে নিয়েই মেতে থাকে। তখন মনের আর কোনো অবলম্বন বলে কিছু থাকে না । মন তখন নিরালম্ব। একেই বলে মনে নিরাশ্রয় অবস্থা। বিষয় বা কর্ম্মে আসক্তি থাকলে একটা আশ্রয় থাকতো। কিন্তু কর্ম্মে বা বিষয়ে আসক্তি এমনকি অনাসক্তি না থাকার জন্য, সে আশ্রয়হীন হয়ে নিজধামে সাম্য অবস্থায় বিরাজ করে। এই সময় তার কর্ম্ম করা বা কর্ম্ম না করার মধ্যে কোনো পার্থক্য লক্ষিত হয় না। এই সময় মনের আশ্রয় হচ্ছে আত্মা। আর সেই আত্মানন্দেই মন বিভোর। এই সময়ও সাধককে প্রারব্ধ ভোগ করতে হয়। প্রারব্ধ বসে কিছু কাজ করতে হয়। কিন্তু কর্ম্ম বা কর্ম্মফলে তার আসক্তি-অনাসক্তি না থাকবার জন্য, ক্রিয়মান কর্ম্মের ফল সঞ্চিত হতে পারে না। এখন তার মধ্যে আর কোনো কর্তৃত্ত্বাভিমান না থাকার জন্য, অদৃষ্ট বলে কিছু থাকে না। প্রারব্ধ কর্ম্মফল ভোগ শেষ হয়ে গেলে, তিনি কর্ম্মফল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে যান। জন্ম-মৃত্যুর পারে চলে যান। এই হচ্ছে কর্ম্মফল ত্যাগে মহিমা।
---------------------------
২১.০২.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/২১-২৩
নিরাশিঃ যতচিত্তাত্মা ত্যাক্ত-সর্ব্ব-পরিগ্রহঃ
শারীরং কেবলং কর্ম্ম কুর্ব্বণ-ন-আপ্নোতি কিল্বিষম্। (৪/২১)
যিনি কামনাত্যাগী, সংযত ইন্দ্রিয়, যিনি দেন গ্রহণ করেন না, তেমন ব্যক্তি কেবল শরীর দ্বারা কর্ম্ম অনুষ্ঠান করেও ফলভোগী হন না।
যে কাজ করে, তার কাজে ভুল ত্রুটি থাকতেই পারে। আর কাজে ভুল হলে, আমাদের ভুগতেই হবে। কিন্তু যিনি নিরাশি অর্থাৎ আশারহিত, মন যার কূটস্থে স্থিত, এমন ব্যক্তি শরীরের দ্বারা যা কিছুই করুন না কেন, তার কাজের ত্রুটি তাকে স্পর্শ করতে পারে না। মন যখন যে বিষয়ে আসক্ত হয়, মন তখন সেই বিষয়ের রঙে রেঙে ওঠে। তো মন যদি কূটস্থে স্থিত হয়, তবে মন কূটস্থের স্বভাবে প্রভাবিত হবে। সাধন ক্রিয়া করতে করতে সাধকের চিত্ত ও দেহের সংযম অভ্যাস হয়ে যায়। তো সংযমিত দেহ ও চিত্ত যখন কোনো দৈহিক বা মানসিক কাজে লিপ্ত হয়, তখন কেবল নিষ্কাম ক্রিয়া সাধিত হয়ে থাকে। তাই এই শারীরিক ক্রিয়া বা মনের ক্রিয়া আত্মস্থ পুরুষের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। বিষয় জনিত কোনো পাপ তাকে স্পর্শ করতে পারে না। প্রাণায়াম ইত্যাদি করতে করতে একসময় শ্বাস-প্রশ্বাস ধীর হয়ে আসে। উর্ধমুখী হয়ে প্রাণবায়ু আজ্ঞাচক্রে স্থির হয়। , এমনকি সহস্রারে উপস্থিত হয়। একেই কৈবল্যপদ লাভ বলে। এইসময় শারীরিক ক্রিয়া অবদমিত হয়ে আসে। তথাপি স্থুল শরীর রক্ষার্থে শারীরিক ক্রিয়া যতটুকু চলে, তার তার কোনো সঞ্চিত ফল থাকে না।
যদৃচ্ছালাভসন্তুষ্টো দ্বন্দ্বাতীতো বিমৎসরঃ
সমঃ সিদ্ধাবসিদ্ধৌ চ কৃত্বাপি ন নিবধ্যতে। (৪/২২)
যিনি আপনাতেই তুষ্ট যিনি দ্বন্দ্বসহিষ্ণু, যিনি মাৎসর্য্য ও শত্রুভাবশূন্য, যিনি সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে সমবুদ্ধি সম্পন্ন তিনি কর্ম্ম করেও কর্ম্মফলে আবদ্ধ হন না।
যোগীপুরুষ যখন সমাধিস্থ থাকেন, তখন তার মধ্যে কোনো বাহ্যচেষ্টা দেখা যায় না। কিন্তু যখন তার সমাধি ভঙ্গ হয়, অর্থাৎ বুত্থিত অবস্থায় যোগীর বাহ্য ক্রিয়া থাকে। যোগীপুরুষ যখন বাহ্য ক্রিয়াতে থাকেন, তখনও তার মন বিষয়ে লিপ্ত হয় না। মন কূটস্থেই স্থির থাকে। এই অবস্থায়, তিনি তাঁর প্রয়োজনীয় সামগ্রী লাভের জন্য কখনোই ব্যাকুল হন না। এই সময় কেউ কেউ আকাশ বৃত্তি অবলম্বন করে থাকেন। অর্থাৎ অযাচিত ভাবে কেউ যদি কিছু দেন, তা দিয়েই তাঁর জীবন নির্বাহ হয়ে থাকে। তার মধ্যে কোনো অভাববোধ থাকে না। সঞ্চয় থাকে না। তবে দৈবের এমনই কৃপা যে সময়মতো তার সমস্ত আবশ্যিক সামগ্রী জুটে যায়। না আকাশ থেকে আসে না। কারুর না কারুর হাত দিয়েই সেই সামগ্রী আসে। পাহাড়ের নির্জন গুহায়, যেখানে তীর্থ যাত্রীদেরও যাতায়াত নেই, এমন জায়গায় আজও বহু যোগীপুরুষ বাস করেন। এদের না আছে শত্রু, না আছে মিত্র। এদের না আছে আয় না আছে সঞ্চয়। এদের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, শীত, উষ্ণ,প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহ্য করবার অসীম ক্ষমতা। এঁদের না আছে অভিমান, না আছে অহঙ্কার। এঁদের কাছে জগতের সবকিছুই চাওয়া-পাওয়ার উর্দ্ধে। কোনো চাহিদা নেই। হলেও ভালো, না হলেও ভালো।
এমনি এক পাহাড়বাসী সাধক একসময় আমাকে বলেছিলেন, তিনি নাকি ৫ কেজি আটার রুটি খেতে পারেন। যদিও তাকে রুটি খেতে দেখিনি, তিনি আটা জলে গুলে হয় লবন বা গুড় দিয়ে গলাদ্ধকরন করতেন। মন তার স্থির। একটা সাম্যাবস্থায় অবস্থান করেন। জগতের সবকিছুকেই যেন তিনি নির্দ্বিধায় অবজ্ঞা করতে পারেন। তার মধ্যে হর্ষ বা বিষাদের ছায়া পড়তে পারতো না। এই মহাযোগী কিছুই করেন না, তা কিন্তু নয়, দূর থেকে জল সংগ্রহ করতেন। তাঁর গুহার মধ্যে একটা শিবলিঙ্গ। মাঝে মধ্যে দেখতাম, সেটিকে পরিষ্কার করা, স্নান করানো, এমনকি তার একটা লোটা ছিলো, নেংটি ছিল, সেগুলোকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতেন। এই যে সামান্য কর্ম্ম যা তার জীবনযাত্রার জন্য করতেন, এতে তার মধ্যে কোনো সংস্কারের জন্ম হতে পারে না। এমনকি এনার মধ্যে ঈশ্বরকে পাবার ইচ্ছে বা অনিচ্ছার কোনো প্রকাশ, এমনকি সিদ্ধপুরুষ হবার জন্য, কোনো আকুতি দেখা যেতো না। নিজেকে সিদ্ধপুরুষ বলে কখনো ভাবতেন কি না সন্দেহ। তার মধ্যে যেটা আমাকে আকর্ষণ করতো, তা হচ্ছে, তার নির্লিপ্ততা, একটা সারল্য, অথচ গভীর অনুভূতি শক্তি। তাঁর এই অনুভূতি শক্তি, তাকে ভূত-ভবিষ্যতের সংকেত দিতো। অনেক সময় যাত্রীর আগমনের আগেই, তিনি তা আগাম জানতে পারতেন। তো এইসব যোগী পুরুষের হারাবার কোনো ভয় নেই, নতুন করে পাবারও কিছু নেই। এঁরা উচ্চকোটির সাধক। এদের কোনো কর্ম্মবন্ধন না থাকাটাই স্বাভাবিক বলে মনে হয়। আর এটা বোঝার জন্য, কোনো উচ্চতর জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না। দরকার শুধু অনুভূতির ।
গতসঙ্গস্য মুক্তস্য জ্ঞানাবস্থিতচেতসঃ
যজ্ঞায়াচরতঃ কর্ম্ম সমগ্রং প্রবিলীয়তে। (৪/২৩)
যিনি আসক্তি শূন্য, রাগ দ্বেষাদি মুক্ত, যার চিত্ত আত্মজ্ঞাননিষ্ঠ, যিনি যজ্ঞার্থে কর্ম্ম করেন, তার কর্ম্মসমূহ ফলসহ বিনষ্ট হয়ে যায়।
যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যিনি অনাসক্ত, যার মধ্যে থেকে রাগ দ্বেষাদি চলে গেছে, যার চিত্ত আত্মজ্ঞান সম্পন্ন , তার সমস্ত কর্ম্ম যজ্ঞে পরিণত হয়ে যায়। আর যিনি যজ্ঞার্থে কর্ম্ম করেন, তার সমস্ত কর্ম্ম ফলসহ নষ্ট হয়ে যায়। আসলে আত্মায় স্থিত যোগী, কাম-অভিলাষশূন্য। তিনি সমস্ত কর্ম্মের মধ্যেও ব্রহ্মে স্থিত থাকেন। সর্বভূতে যিনি বিরাজ করছেন, তিনি আত্মা। এই আত্মার প্রীতার্থে যা কিছু কৃত হয়ে থাকে, তাকেই বলা হয়ে থাকে যজ্ঞ। এই যজ্ঞের ফল প্রাপক হচ্ছেন স্বয়ং বিষ্ণু। জগতের হিতের জন্য যাকিছু করা হয়, তাকে বলা হয় যজ্ঞ। জগৎ হচ্ছে পঞ্চভূতের সংমিশ্রণ। তো ভূতাদির জন্য যা কিছু কর্ম্ম করা হয়, তাকে বলা হয় যজ্ঞ। এই যজ্ঞেশ্বর হচ্ছেন স্বয়ং বিষ্ণু। বিষ্ণু অর্থে পঞ্চভূতময় এই বিশ্ব যাতে প্রবেশ করে, তাকেই বলা হয় বিষ্ণু। "বিষ" ধাতুর সঙ্গে "ণুক" যোগ করে বিষ্ণু। বিষ কথার অর্থ ব্যাপন করা। তো যিনি বিশ্ব ব্যপি বিরাজ করছেন, তাকে বলা হয় বিষ্ণু।
আত্মা সৎ-চিৎ-আনন্দম। তো আত্মা সর্ব্বদাই আনন্দময়। সাধকের কাজ হচ্ছে, আত্মা যে নিত্য, চেতন ও প্রসন্নতা যুক্ত, এই ভাবের উপলব্ধি করতে পারা। আর এই অবস্থাকে উপলব্ধি করতে গেলে, আত্মস্থ হতে হয়, ব্রহ্মময় হতে হয়। আর এই ভাব যার মধ্যে এসেছে, তার আবার ক্রিয়া থাকে নাকি ? তাঁর সমস্ত কর্ম্মই ব্রহ্মে অর্পিত। তিনি বন্ধনহীন, মুক্ত পুরুষ। এঁরা অনেকসময় জগতের কল্যাণের জন্য, ধর্ম্ম সংস্থাপনের জন্য কর্ম্মরূপ যোগের প্রচার করে থাকেন। কিন্তু কর্ম্মফলের ভাগিদার হন না।
----------
২২.০২.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/২৪
ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্মহবির্ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণা হুতম
ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্ম্ম সমাধিনা। (৪/২৪)
যজ্ঞে আহুতি দেবার হাতা ব্রহ্ম, যজ্ঞ সামগ্রী ব্রহ্ম, হুত অর্থাৎ অগ্নি ব্রহ্ম, যজ্ঞের হোতাও ব্রহ্ম, - এই জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে যিনি ব্রহ্মকর্ম্ম করছেন, তিনি ব্রহ্মকেই প্রাপ্ত হন।
বাহ্যিক দৃশ্যমান জগৎ বলুন আর অদৃশ্য জগৎ যা আমাদের দৃষ্টির বাইরে সমস্তই ব্রহ্ম। আমরা সবাই ব্রহ্মময়। আমরা যাকিছু শরীরের নিমিত্ত প্রদান করছি, তাও আসলে ব্রহ্ম। এই যে অন্ন তা ব্রহ্ম, এই যে হস্ত যার দ্বারা শরীরকে অন্ন অর্পণ করছি, তা ব্রহ্ম, যেখানে অর্পণ করছি অর্থাৎ জঠরাগ্নি তা ব্রহ্ম। অর্থাৎ ব্রহ্ম থেকে আবার সেই ব্রহ্মে যাচ্ছেন। এ এক অদ্ভুত প্রক্রিয়া। যেখান থেকে আসছে সেখানেই যাচ্ছে। যেই যে জ্ঞান অর্থাৎ যার থেকে উৎপন্ন তাতেই নিস্পত্তি, যেখান থেকে আসছে সেখানেই যাচ্ছে, এই জ্ঞান যার উপলব্ধ হয়েছে, তিনি স্বয়ং ব্রহ্মত্ব প্রাপ্ত হন। তিনি নিজে ব্রহ্ম বৈ কিছু নয়, - এই অনুভূতি, এই প্রতক্ষ্য জ্ঞান তার মধ্যে সদা জাগ্রত থাকে। সমস্ত কর্ম্মই ঈশ্বরের আরাধনা। এই ভাবনা নিয়ে যিনি কর্ম্ম করেন, তার কর্ম্মে কোনো বন্ধন থাকতে পারে না।
সাধনক্রিয়া করতে করতে যখন প্রাণবায়ু ব্রহ্মনাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করে, উচ্চগতি সম্পন্ন হয়, তখন মনের মধ্যে কোনো চিন্তা প্রবাহিত হতে পারে না। মন থাকে নিরুদ্ধ। এইসময় যে জ্যোতিঃ দর্শন ঘটে, জ্ঞানজ্যোতির দর্শন ঘটে, সেই জ্ঞানজ্যোতির সঙ্গে সাধক নিজেকে মিলিয়ে দেন। নিজের আলাদা সত্ত্বা বলে তখন কিছু অনুভবে আসে না। আবার আমাদের শরীরে আছে অগ্নিশক্তি। এই অগ্নিশক্তির উত্তাপ আমাদের শরীর যন্ত্রকে পরিচালনা করছে। এখানে প্রাণরূপ হবি অর্পিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত । মন সাধনক্রিয়ার প্রক্রিয়া স্বরূপ প্রাণের পিছু পিছু ধাবিত হয়। এই প্রাণকে সাধকের মন যখন ব্রহ্মে সন্ধান করেন, তখন সাধকের মন ব্রহ্মে সমাহিত হয়ে যায়। আর মন যখন ব্রহ্মে সমাহিত হয়ে যায়, তখন সাধক ব্রহ্মময় হয়ে যান। তখন কোনো কর্ম্মবন্ধন থাকে না। সাধক তখন দ্রষ্টা হয়ে যান। আর তার সামনে চলতে থাকে এই জগৎক্রিয়া - যেখান থেকে আসছে, সেখানেই চলে যাচ্ছে। ব্রহ্ম থেকে আসছে আবার ব্রহ্মে চলে যাচ্ছে। সাধক কেবলমাত্র সাক্ষী।
আসলে সমস্ত জগৎক্রিয়া এইভাবেই চলছে, কিন্তু আমাদের মন সেটা ধরতে পরে না। সমস্ত ইন্দ্রিয়ের রাজা হিসেবে মন ভাবছে, সে-ই সমস্ত কর্ম্মের কর্তা। যখনই মনের মধ্যে এই ভাবনার উদয় হচ্ছে, তখন জীব বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে। তো মনকে ব্রহ্মে অর্পণ করতে পারলেই অর্থাৎ মনটাও যে ব্রহ্ম বা ব্রহ্মের সমধর্ম্মী এই বোধ জাগ্রত হলে, সাধকের আর কিছু করবার থাকে না। তাই মনে যদি ব্রহ্মময়ী বৃত্তি ভিন্ন অন্য কিছু না ওঠে, তাহলে মনের যে মনন শক্তি তা ব্রহ্মময়ী হতে পারে।
এই মনের স্থিরতা তা সাধনক্রিয়ার দ্বারা সহজে সম্ভব হতে পারে। দেখুন, কর্ম্মের জন্য এই দেহধারন। কর্ম্মের মাধ্যমেই এই দেহ রক্ষা করতে হয় । তো কর্ম্ম না করে আমাদের উপায় নেই। আবার কর্ম্ম করলে, কর্ম্মের ফল উৎপন্ন হবে। এইজন্য অর্থাৎ এই আবশ্যিক কর্ম্মকে আমরা যদি ব্রহ্মার্পিত করতে পারি, তবে কর্ম্ম করেও আমাদের কর্ম্মফলের ভাগিদার হতে হয় না। আমরা জানি, যে কর্ম্ম যার জন্য কৃত হয়ে থাকে, কর্ম্মফল তারই প্রাপ্য হয়ে থাকে। আপনি যদি ছেলের নামে ব্যাঙ্কে টাকা জমান, তবে সেই টাকার মালিক হবে আপনার ছেলে, আপনি নন। অর্থাৎ আপনি ছেলের নাম করে যদি কিছু সঞ্চয় করেন, তার ভোগ ছেলেই করবে। তেমনি যদি কোনো কর্ম্ম আপনি ভগবানের জন্য করেন, তবে সেই কর্ম্মের ফল হবে ভগবানের। এইজন্য আমরা যদি কর্ম্মফল থেকে রেহাই পেতে চাই, তবে আমাদের সমস্ত কর্ম্ম ব্রহ্মে অর্পণ করতে হবে। তা না করে যদি আমরা নিজের তৃপ্তির জন্য কর্ম্ম করি, তবে তার ফল আমাকেই ভোগ করতে হবে।
তো ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, কর্ম্মকে যজ্ঞে পরিণত করতে হবে। আর যজ্ঞ বলতে আমরা বুঝি ভুতগনের প্রগতির জন্য যে কর্ম্ম তাকে বলে যজ্ঞ। আর এই ভূত-ই জগতের কারন। তো জগতের যা কারন, তার প্রগতির জন্য যে কর্ম্ম তাকে বলা হচ্ছে যজ্ঞ।
আসলে বন্ধন আমাদের মনের। আত্মার কোনো বন্ধন নেই। এই আত্মার দুটো ভাব, একটা সেই স্থির পাখি, যে দ্রষ্টা মাত্র। আরেকটা হচ্ছে সেই চঞ্চল পাখি, যে জগৎকে ভোগের নিমিত্ত ফলের আস্বাদন করছে। তো আত্মার একটা ক্রিয়াশূন্য ভাব যা স্থির ভাব, আর আত্মার আরো একটা ভাব হচ্ছে, চঞ্চল ভাব যা মনের সঙ্গে মিশে জগৎস্রষ্টা হয়েছেন। যাকে শাস্ত্র বলছে হিরণ্যগর্ভ। আর এই দুই ভাবই আসলে একে অন্যের পরিপূরক মাত্র, রূপান্তরিত অবস্থা মাত্র । আত্মার সক্রিয় ভাবটি অজ্ঞান দ্বারা আচ্ছন্ন। এই যে অজ্ঞান দ্বারা আচ্ছন্ন আত্মার ভাব, একে বলা হয় তমভাব। এই অজ্ঞান বা তমসাচ্ছন্ন ভাব একসময় মুক্তির জন্য ছটফট করে। একেই সাধকের মুক্তি চিন্তা বলা হয়ে থাকে।
সাধন ক্রিয়ার ফলে, মনের এই চঞ্চলভাব ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। একেই ব্রহ্মার্পণ বলে। প্রকৃতপক্ষে তখন সাধকের সমস্ত কর্ম্ম ব্রহ্মার্পিত হয়। সাধনার প্রথম দিকে আমরা আত্মার এই অমৃত স্বরূপ চিরস্থির ভাবকে ধরতে পারি না। আসলে আমরা সাধারণ ভাবে আমাদের জীবসত্ত্বার মধ্যে সূক্ষ্মতম অংশ বলতে কেবলমাত্র এই চঞ্চল মনকেই অনুভব করতে পারি। আত্মার যে একটা চিরস্থির ভাব আছে, তা আমাদের বোধের অতীত থাকে। কিন্তু সাধনক্রিয়া করতে করতে একসময় মনের ক্রিয়ার সঙ্গে সাধনক্রিয়া একাত্মতা অনুভব করে। তখন সমস্ত বস্তুর মধ্যে আত্মদর্শন হয়। সবকিছুকেই সেই সত্য ব্রহ্ম বলেই মনে হয়। এই কারণেই প্রথমে সাধনার পদ্ধতিতে কল্পনার আশ্রয় নিতে বলা হয়ে থাকে। মন ব্রহ্ম, এই ভাবকে কল্পনা করতে বলা হয়। কারন মনের চঞ্চল ভাবটি যতক্ষন থাকে, ততক্ষন বুদ্ধি তীক্ষ্ণ হতে পারে না, আর যথার্থ জ্ঞানেরও উদয় হতে পারে না। আর জ্ঞানের উদয় না হলে অভিমানশূন্য অবস্থায় স্থিত হওয়া যায় না। মনের এই চঞ্চল অবস্থায় যে কর্ম্মময় জগতে ঘোরাফেরা করে তাকেই বলে সংসার। মনের এই চঞ্চল অবস্থায় সংসারের বাইরে অবস্থিত আত্মার স্থিরভাব জ্ঞাত হওয়া যায় না। এইজন্য যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, মনের চঞ্চল ভাবসুমহকে অক্রিয় অবস্থায় নিতে গেলে, আমাদের সমস্ত কর্মকে যজ্ঞে পরিণত করতে হবে। আর এই যজ্ঞে হবি, অগ্নি, হোতা সবাইকেই ব্রহ্মরূপে কল্পনা করতে বলা হয়েছে। আর সাধনক্রিয়ার শেষে যখন এই উপল্বদ্ধিতে সাধক মুহ্যমান হয়ে যান, তখন তিনি ব্রহ্মকেই প্রাপ্ত হন ।
--------------------
২৩.০২.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/২৫-২৬
দৈবমেবাপরে যজ্ঞং যোগিনঃ পর্য্যুপাসতে
ব্রহ্মাগ্নাবপরে যজ্ঞং যজ্ঞেনৈবোপজুহ্বতি। (৪/২৫)
কোনো কোনো যোগীগণ দৈব যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। আবার অন্য যোগীগণ ব্রহ্মরূপ অগ্নিতে ব্রহ্মার্পণ যজ্ঞের দ্বারাই যজ্ঞরূপ আত্মাকে আহুতি প্রদান করেন।
এর আগের শ্লোকে (৪/২৪) আমরা একধরনের যজ্ঞের কথা শুনেছি। যাকে ব্রহ্মার্পণ যজ্ঞ বলা হয়েছে। সেখানে আমরা দেখেছি, যোগেশ্বর বলছেন, সমস্ত কিছুই ব্রহ্ম। যজ্ঞে যা কিছু আহুতি দেওয়া হচ্ছে, সবই ব্রহ্ম। অর্থাৎ সমস্ত বস্তুর মধ্যে আমাদের ব্রহ্ম দর্শন করতে বলা হয়েছে। এই শ্লোকে দৈবযজ্ঞ সম্পর্কে বলা হচ্ছে। দৈবযজ্ঞ বলতে দেবতাদের উদ্দেশ্যে যে যজ্ঞ করা হয়। বেদের মধ্যে এই দৈবযজ্ঞের নানান পদ্ধতির কথা উল্লেখ আছে। ইন্দ্র, বরুন, বায়ু, সোম, বৃহস্পতি প্রভৃতি দেবতাদের উদ্দেশ্য যজ্ঞের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু যথার্থ জ্ঞানী ব্যক্তি, যজ্ঞের অগ্নিকে ব্রহ্মাগ্নি এবং সমস্ত যজ্ঞ কর্ম্মকে ব্রহ্মকর্ম্ম বা আত্মজ্ঞান লাভের উপায় হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন।
সাধারণ যোগী কূটস্থে জ্যোতিঃ দর্শন করে থাকেন। এই যজ্ঞের জন্য বাইরের কোনো বস্তুর দরকার পড়ে না। দেবতা অর্থাৎ বিশেষ বিশেষ গুনের অধিকারীকে বলা হয় দেবতা। তো বিশেষ গুনের সাধনকে বলা হয়, দৈবযজ্ঞ। আবার এমনকিছু মুদ্রা আছে, যেমন খেচরী মুদ্রা, যোনিমুদ্রা, ইত্যাদি যা গুরুমুখে শুনে সাধন করতে হয়। এই ধরনের সাধন ক্রিয়ায় প্রাণশক্তিকে ব্রহ্মজ্যোতিতে হবন দেওয়া হয়। আর এই হবনের সাহায্যে প্রাণবায়ুকে মূলাধারে নিয়ে গিয়ে, সুষুম্নাপথে উর্দ্ধগামী করে প্রবাহিত করা হয়। একেই বলে ব্রহ্মযজ্ঞ। অর্থাৎ ব্রহ্মরন্ধ্রে প্রাণবায়ুকে প্রবেশ করানো। এই ব্রহ্মযজ্ঞের ফলে গ্রন্থিসকল খুলে ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। এই যজ্ঞক্রিয়ায়, জীবভাবের আহুতি দিতে হয় তৎ স্বরূপ ব্রহ্মাগ্নিতে। এই সাধনা যোগগুরুর সান্নিধ্যে থেকে সমাপন করতে হয়।
শ্রোত্রাদীনি-ইন্দ্রিয়ানি-অন্যে সংযমাগ্নিষু জুহ্বতি
শব্দাদীন বিষয়ানন্য ইন্দ্রিয়াগ্নিষু জুহ্বতি। (৪/২৬)
অপরে সংযমরূপ অগ্নিতে শ্রোত্রাদি ইন্দ্রিয়গণ আহুতি দেন , আবার কেউ শব্দাদি বিষয়সমূহকে ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে আহুতি দেন।
কেউ ইন্দ্রিয় সংযমরূপ অগ্নিতে জ্ঞান-ইন্দ্রিয়গুলোকে আহুতি দেন। সাধনক্রিয়ার ফলে সাধকের ইন্দ্রিয়সকল থেকে মন প্রত্যাহৃত হয়। এই প্রত্যাহার ক্রিয়া করতে করতে এমন একটা সময় আসে, যখন বাহ্যিক শব্দ, বা স্পর্শ অনুভবের বাইরে চলে যায়। গভীর ধ্যানে যোগী মশার কামড়, বা রাস্তার হট্টগোল সম্পর্কে কিছুই অনুভব করতে পারেন না। প্রাণায়াম করবার পরে কিছুক্ষনেই মধ্যেই মনটা স্থির হয়ে যায়। অর্থাৎ মনের মধ্যে তখন ধারণার বা ইষ্টের প্রভাব চলতে থাকে। সাধন ক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধারণা যখন দৃঢ় হয়, তখন মনের মধ্যে একটা অহেতুক আনন্দের অনুভূতি আসে। কিন্তু এই আনন্দ গভীর বা স্থায়ী হয় না। সাধনার অভ্যাস যখন আদতে পরিণত হয়, অর্থাৎ স্বতঃস্ফূর্ত হয়, তখন মন অন্তর্মুখী হয়। চিত্তবৃত্তি যখন বিষয়বিমুখ হয়ে ব্রহ্মে স্থিত হয়, তখন ধ্যান সম্পন্ন হয়। আর এই অবস্থা যখন দীর্ঘকাল চলতে থাকে, অর্থাৎ চিত্তবৃত্তি বিজাতীয় বৃত্তি দ্বারা বিচলিত না হয়, তখন সাধকের সমাধি হয়। কিন্তু আমরা জানি ধ্যান আয়ত্ত্ব করতে গেলে, প্রথম দিকে অবশ্যই একটা অবলম্বন চাই। প্রাথমিক সাধকগণ এক্ষেত্রে বাহ্যবস্তু, অর্থাৎ গুরুদেবের ছবি, প্রভাতের সূর্য্যের ছবি, ইত্যাদি নিয়ে একাগ্রতার অভ্যাস করতে হয়। ভালো হয় যদি আমরা অন্তরের বস্তু অবলম্বন করতে পারি। শ্বাসপ্রশ্বাসের দিকে লক্ষ স্থির করেও ধারণার অভ্যাস করা যায়। তবে ঠিক ঠিক প্রাণায়ামের অভ্যাসের ফলে যখন সাধকের প্রাণবায়ু স্থির হয়, তখন নিজের মধ্যে একটা ভ্রমরের গুঞ্জন ধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। এঁকে অনাহত ধ্বনি বলা হয়। ওঙ্কারের ধ্বনি অর্থাৎ প্রণব উচ্চারণ করতে করতে একসময় নিজের মধ্যে এই ওঙ্কারের ধ্বনি স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে উৎসারিত হতে থাকে। এই ধ্বনিতে মন রেখে ধ্যান করলে, ধ্যানের গভীরতা বৃদ্ধি পায় । এই অনাহত ধ্বনি শুনতে শুনতে একসময় চিত্ত বৃত্তিশূন্য হয়। তখন সমাধির রাস্তা প্রশস্ত হয়। এই ধারণা ধ্যান ও সমাধিতে যখন সিদ্ধি লাভ হয়, তখন সাধকের সংযম সম্পন্ন হয়। অর্থাৎ সাধক তখন হন সংযমী পুরুষ। প্রাণায়ামের ফলে, বা বিভিন্ন মুদ্রার অভ্যাসের ফলে, আমাদের কূটস্থে বিচিত্র সব দৃশ্যের দর্শন মেলে, আবার অনাহত ধ্বনি শ্রুতিগোচর হয়। কখনো জ্যোতিঃ দর্শন হয়। এগুলো সমাধি লাভের আসন্ন অবস্থা। আর বারংবার এই ধারণা-প্রত্যাহার-ধ্যান-সমাধির মধ্যে দিয়ে আসে সাধকের সংযম। তখন যেকোনো বিষয়ের গভীরে প্রবেশ সহজসাধ্য হয়। অর্থাৎ বিষয়ের সূক্ষ্ম জ্ঞান - উৎস-স্থিতি-পরিণতি সম্পর্কে জ্ঞান উৎপন্ন হয়। এইসময় বস্তুর গ্রহণ ঘটে বটে, কিন্তু চিত্তের বিক্ষেপ বলে কিছু থাকে না। যোগেশ্বর বলছেন, জ্ঞানযোগীগণ ইন্দ্রিয়সংযমরূপ অগ্নিতে শ্রবণ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের আহুতি দেন। আবার মুমুক্ষ সাংসারিক ব্যক্তি, ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে শব্দাদিরূপ বিষয়সমূহকে আহুতি দেন।
--------------------------------------------------
২৪.০২.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/২৭
সর্ব্বাণী ইন্দ্রিয়কর্ম্মাণি প্রাণকর্ম্মাণি চাপরে
আত্ম-সংযম-যোগাগ্নৌ জুহ্বতি জ্ঞানদীপিতে। (৪/২৭)
অন্য যোগীগণ ইন্দ্রিয়বর্গের ও প্রাণ ইত্যাদি কর্ম্মরাশিকে জ্ঞানের দ্বারা উদ্দীপ্ত আত্মসংযম যোগরূপ অগ্নিতে আহুতি দেন।
আমরা জানি ইন্দ্রিয় দুই প্রকার কর্ম্ম ইন্দ্রিয়, ও জ্ঞান ইন্দ্রিয়। এই কর্ম্ম ইন্দ্রিয় আবার পাঁচ প্রকার : বাক, পানি, পাদ, পায়ু, উপস্থ। এদের কাজ হচ্ছে, যথাক্রমে বচন, গ্রহণ, গমন, ত্যাগ ও আনন্দ। বাক বা মুখ দিয়ে আমরা কথা বলি, পানি - অর্থাৎ আমাদের হস্তদ্বয় দ্বারা আমরা গ্রহণ করে থাকি। পাদ অর্থাৎ পদদ্বয় দ্বারা আমরা গমন করে থাকি। পায়ু অর্থাৎ গুহ্যদ্বার দ্বারা আমরা শরীরের বর্জ পদার্থ ত্যাগ করে থাকি। উপস্থ - অর্থাৎ জনন-ইন্দ্রিয়, যার দ্বারা আমরা সৃষ্টির আনন্দ উপভোগ করে থাকি।
আবার জ্ঞান ইন্দ্রিয় পাঁচ প্রকার - চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক। এদের কাজ হচ্ছে যথাক্রমে - রূপ, শ্রোত্র, গন্ধ, রস, স্পর্শ। চক্ষু দ্বারা আমরা রূপের জ্ঞান সংগ্রহ করে থাকি। কর্ন বা কান দ্বারা আমরা শব্দের জ্ঞান সংগ্রহ করে থাকি। নাসিকা দ্বারা আমরা গন্ধ জ্ঞান সংগ্রহ করে থাকি। জিহ্বা দ্বারা আমরা রস আস্বাদন করে রসের জ্ঞান লাভ করে থাকি। ত্বক দ্বারা আমরা স্পর্শের জ্ঞান সংগ্রহ করে থাকি।
প্রাণ কর্ম্মভেদে হচ্ছে দশ প্রকার। প্রাণ, অপান, ব্যান, সমান, উদান, নাগ্, কূর্ম্ম, কৃকর, দেবদত্ত, ধনঞ্জয়। এদের কাজ হচ্ছে: প্রাণ- বহির্গমন, অপান-অধোগমন, ব্যান-আকুঞ্চন, প্রসারণ, সমান-সমুন্নয়ন, উদান-ঊর্ধউন্নয়ন, নাগ্-উদ্গার, কূর্ম্ম-উন্মীলন, কৃকর-ফুৎকার, দেবদত্ত- জৃম্ভন (হাইতলা), ধনঞ্জয়-হিক্কা। এইভাবে সমস্ত শরীরের সংস্থান সংরক্ষণ স্বরূপ বায়ু ক্রিয়া করে থাকে । এই দশটি প্রাণবায়ু নিজ নিজ কর্ম্মের দ্বারা চালিত হয়ে, জীবের শরীরের ক্রিয়াগুলোকে সম্পাদন করে থাকে।
শিব সংহিতায় স্বয়ং শিব বলছেন, (তৃতীয় পটল -শ্লোক : ) মানুষের হৃদয়ের মধ্যে একটা দিব্য মনোহর পদ্ম আছে। সেই মনোহর পদ্মটি শিবলিঙ্গের দ্বারা অলংকৃত। সেই দ্বাদশ পদ্ম মধ্যে বাস করেন প্রাণ। এই প্রাণ আদি-অন্তহীন কৃতকর্ন্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে, কর্ম্মফল হেতু লভ্য অহঙ্কার যুক্ত হয়ে, নানা বাসনার দ্বারা অলংকৃত হয়ে আমাদের হৃদয়পদ্মে বাস করছেন।
যে দশটি বায়ুর কথা আমরা শুনলাম, এর মধ্যে পাঁচটি বায়ু প্রধান ; সেগুলো হচ্ছে প্রাণ, অপান, সমান, উদান,, ব্যান। এই প্রাণবায়ুর স্থান হচ্ছে আমাদের হৃদয় কেন্দ্র। গুহ্যদেশ হচ্ছে অপান বায়ুর ক্রিয়াক্ষেত্র । নাভিমণ্ডল সমান বায়ুর ক্রিয়াক্ষেত্র। কণ্ঠদেশে উদান ও সমস্ত শরীর জুড়ে ক্রিয়া করছে ব্যান বায়ু।
এই যে বায়ুর ক্রিয়াসমূহ এঁকে যিনি সম্যকরূপে উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তিনি সাধন-জগতের উচ্চে অবস্থান করে থাকেন। একটা কথা জানবেন, এই যে সূর্য (বৃহদারণ্যক ১/৫/২৩) এই সূর্য প্রাণ থেকে উদিত হয়ে প্রাণেই অস্ত যায়। আর যথার্থ জ্ঞান হচ্ছে আমাদের উপলব্ধি-জাত। তথ্যভিত্তিক বা বইপড়া জ্ঞান যথার্থ জ্ঞান নয়। যদিও প্রথম দিকে আমাদের এই শাস্ত্রীয় জ্ঞানের দ্বারাই নিজেকে সমৃদ্ধ করতে হয়। পরবর্তী কালে সাধনক্রিয়ার সাথে সাথে এই যথার্থ জ্ঞানের উন্মেষ ঘটে। তা না হলে শুষ্ক জ্ঞানের দ্বারা পান্ডিত্য ফলাতে পারা যায় সত্য, কিন্তু জ্ঞানের মধ্যে যে অমৃতরস নিহিত আছে, তার স্বাদ পাওয়া যায় না।
প্রাণ সম্পর্কে আলোচনায় আরো একটা জিনিস আমাদের জানা দরকার সেটি হচ্ছে - "অন"। প্রাণ শব্দে আমরা শ্বাস-প্রশ্বাসকে বুঝে থাকি। "অন" ধাতুর অর্থ হচ্ছে বাঁচা, চেষ্টা করা। "অন" এর সঙ্গে "প্র" উপসর্গ যোগ করে প্রাণ হয়েছে। আবার উদ+অন, সম+অন, অপ+অন, বি+অন ইত্যাদি ইত্যাদি। যার সাহায্যে প্রাণী বেঁচে থাকে তাকে বলা হয় প্রাণ। অর্থাৎ যা গ্রহণ করে বা খেয়ে প্রাণী বেঁচে থাকে তাকে বলা হয় "অন" । এখন এই শ্বাসপ্রশ্বাস কি খেয়ে বেঁচে থাকে ? সবরকম খাদ্য যে গ্রহণ করতে পারে, তাকে বলা হয় "অন" । এইজন্য বলা হয়ে বায়ু সর্ব্বভূক। আর এই প্রাণের আচ্ছাদন হচ্ছে, জল।
যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যোগীগণ ইন্দ্রিয়বর্গের ও প্রাণ ইত্যাদি কর্ম্মরাশিকে জ্ঞানের দ্বারা উদ্দীপ্ত আত্মসংযম যোগরূপ অগ্নিতে আহুতি দেন। এখন সংযম দ্বিবিধ। প্রথম হচ্ছে ইন্দ্রিয়সংযম, দ্বিতীয় হচ্ছে, আত্মসংযম। প্রাণায়াম ইত্যাদি করতে করতে একসময় ক্রিয়ার পরাবস্থা প্রাপ্ত হওয়া যায়। এখন প্রাণায়াম বলতে আমরা কি বুঝি ? রেচক, পূরক, কুম্ভক অর্থাৎ শ্বাস বায়ুকে টেনে নেওয়া, ছেড়ে দেওয়া ও বায়ুকে রুদ্ধ করা, সহজ ভাবে বলতে গেলে, একেই বলে প্রাণায়াম। ডান হাতের বুড়ো আঙুলের দ্বারা ডান নাসিকাকে (পিঙ্গলা) রুদ্ধ করে বাম নাসিকা (ইড়া) দ্বারা বায়ুকে যথাসাধ্য টেনে নিয়ে কুম্ভক করবেন। এর পর ধীরে ধীরে পিঙ্গলা অর্থাৎ ডান নাসিকা দ্বারা বায়ু ত্যাগ করবেন। আবার ডান নাসিকা দ্বারা বায়ু টেনে নিয়ে সাধ্যমতো কুম্ভক করবেন। এবং বাম নাসিকা দিয়ে বায়ুত্যাগ করবেন। এইভাবে সকাল-দুপুর, সন্ধ্যা-মধ্যরাত্রি মোট চারবার প্রতিবারে বিশবার কুম্ভক করবেন। (বাহ্য কুম্ভব নয়, অন্তর কুম্ভক - অর্থাৎ কুম্ভক যখন করবেন তখন বায়ু শরীরের মধ্যে রুদ্ধ করে রাখতে হবে। বায়ু যখন শরীর থেকে বের করে দেবেন, সেই অবস্থায় কুম্ভক করতে যাবেন না। ) শিব সংহিতা (শ্লোক-২৬) বলছেন, এইভাবে তিন মাস গুরুসান্নিধ্যে থেকে প্রতিদিন অনলস ভাবে প্রাণায়াম করলে, অবিলম্বে নাড়ীশুদ্ধি অর্থাৎ আমাদের নাড়ীর মধ্যে যে মলাদি আছে, তা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
এই প্রাণায়াম ক্রিয়া বহুদিন যাবৎ করতে করতে যে অবস্থায় যোগী পৌঁছে যান, তাকেই আত্মসংযমরূপ অগ্নি বলে। এতে করে আমাদের কর্ম্ম-ইন্দ্রিয়, জ্ঞান-ইন্দ্রিয়, অন্তর-ইন্দ্রিয় অর্থাৎ মন-বুদ্ধি, ও পাঁচটি প্রাণের ক্রিয়া নিরুদ্ধ হয়ে যায়। উত্তমরূপে নিরুদ্ধ হলে, জ্ঞানপ্রদীপ প্রজ্বলিত হয় - অর্থাৎ সমস্ত জগৎ ব্রহ্মময় হয়ে যায়। তখন কোনো ধরনের বিক্ষেপ থাকে না। মনের চঞ্চলতা দূর হয়। মন তখন বিষয়মুখী ভাব পরিত্যাগ করে ব্রহ্মে স্থিত হয়। কিন্তু এই অবস্থা দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় না। অর্থাৎ সংযমাগ্নিতে মন কিছুক্ষনের জন্য নিরুদ্ধ হলেও, মনন ক্রিয়া একেবারে নষ্ট হয় না। কারন জ্ঞান-ইন্দ্রিয়ের অনুভব তখনও থাকে অর্থাৎ অহংভাব বজায় থাকে । তো এই অবস্থা সারাক্ষন/সর্বদা না থাকলেও সাধনার উচ্চ অবস্থার একটা রেশ তার মধ্যে থেকে যায়। একটা যেন নেশার মতো লাগে। অর্থাৎ যে বস্তুর সন্ধান পেয়েছিলো, সেই অবস্থাকে আবার প্রাপ্তির জন্য, সে ইহ জগতের সমস্ত কিছুকে সে বৰ্জন করতে প্রস্তুত হয়ে যায়। এই বাহ্যজগৎ তখন তার কাছে তুচ্ছ, ক্ষণস্থায়ী বলে মনে হয়। তবে তখনও তার মধ্যে সত্যের সন্ধান মেলেনি। বিষয়ের সম্পূর্ণ বিরাগ না জন্মালে এই অবস্থা প্রাপ্ত হওয়া যায় না। সংযম-সমাধির গভীরতা যত বাড়তে থাকে, তত ইন্দ্রিয়-প্রাণ-মন-বুদ্ধি নিঃশেষিত হতে থাকে। আর প্রজ্ঞার উদয় হয়। এই প্রজ্ঞার অর্থাৎ চরম জ্ঞান-এর উদয় হলে সাধকের আর কিছুই চাওয়ার বা পাওয়ার থাকে না। এঁকেই বলে আত্মভাব। তখন দেহ-ইন্দ্রিয় ইত্যাদিতে আর আত্মভ্রম বা আমি-আমার বলে কিছু থাকে না। এইসব অতীন্দ্রিয় অবস্থায় জন্ম-জন্মান্তরের সাধকের পক্ষেই পৌঁছানো সম্ভব। এই অবস্থা কখনও বিচার-বুদ্ধি দ্বারা লাভ করা সম্ভব নয়।
-------------------------------
২৫.০২.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/২৮
দ্রব্যযজ্ঞাঃ-তপোযজ্ঞা যোগযজ্ঞাঃ তথা অপরে
স্বাধ্যায়-জ্ঞানযজ্ঞাঃ চ যতয়ঃ সংশিতব্রতাঃ। (৪/২৮)
কেউ দ্রব্যযজ্ঞ পরায়ণ, কেউ বা তপঃযজ্ঞ পরায়ণ, . কেউ যোগযজ্ঞ পরায়ণ, কেউ বা জ্ঞানযজ্ঞ পরায়ণ, আবার সংযত চিত্ত হয়ে ব্রতরূপ যজ্ঞের স্বাধ্যায় করেন।
দ্রব্য-যজ্ঞ, তপঃ-যজ্ঞ, যোগ-যজ্ঞ, জ্ঞান-যজ্ঞ, ব্রত-যজ্ঞ। এই পাঁচ প্রকার যজ্ঞের কথা বলছেন, যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। উপনিষদ বলছে, সমগ্র জীবনটাই একটা যজ্ঞ।
ছান্দোগ্য উপনিষদে, কিভাবে আমরা জীবনের চরম লক্ষের দিকে এগিয়ে যেতে পারি, তার একটা রূপ রেখা এখানে পাওয়া যেতে পারে। এই উপনিষদে দুটি উপায়ের কথা বলা হয়েছে, প্রথমটি হচ্ছে সকাম উপাসনা। আর একটি হচ্ছে পরব্রহ্মের ধ্যান। দুটোই ভালো, কিন্তু অধিকাংশ মানুষের পক্ষে প্রথমটি শ্রেয়। কারন যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, তার সমন্ধে কোনো ধারনা করা আমাদের মতো সাধন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে ব্রহ্ম যিনি বাক্য মনের অতীত সেই ব্রহ্ম আমাদের কাছে অর্থহীন। বেশিরভাগ মানুষকেই বাসনা তাড়া করে নিয়ে বেড়ায়। বাসনা পূরণ হলেই সে খুশী। আবার এঁরা শারীরিক রোগ-ব্যাধিতে কষ্ট পায়। এমনকি বাসনা পূরণের আগেই এদের অকাল মৃত্যু হয়ে থাকে। আর এই কারণেই, এখানে অর্থাৎ ছান্দোগ্য উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ে ষোড়শ খন্ডে জীবনকে একটা যজ্ঞ রূপে ধ্যান করতে বলা হয়েছে। এখানে জীবনের স্বাভাবিক আয়ু বলা হয়েছে ১১৬ বছর। এই একশ ষোলো বছরকে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়েছে ২৪+৪৪+৪৮ বছর।
জীবনের প্রথম ২৪ বৎসরের মধ্যে যদি কোনো ব্যাধি তাকে যন্ত্রনা দেয় তবে সে বলবে :
"প্রাণা বসব ইদং মে প্রাতঃসবনং মাধ্যন্দিনং সবনম অনুসন্তনুতেতি মাহং প্রাণানং বসূনাং মধ্যে যজ্ঞো বিলোপ্সীয় ইতি। " (৩/১৬/২) হে প্রাণগন, হে বসুগন, আমার এই জীবনের প্রথম অংশকে মধ্যজীবন পর্যন্ত বিস্তৃত করে দিন. যজ্ঞরূপী আমি যেন, আমার প্রাণরূপী বসুগনের মধ্যে বিলীন না হই।
জীবনের মধ্যবর্তী ৪৪ বছর, যদি কোনো ব্যাধি বা অন্য কিছু তাকে পীড়া দেয় তাহলে সে বলবে :
"প্রাণা রুদ্রা ইদং মে মাধ্যন্দিনং সবনং তৃতীয়সবনমনুসন্তনুতেতি। মাঽহং প্রাণনাং রুদ্রাণাং মধ্যে যজ্ঞো বিলোপ্সীয় ইতি।" (৩/১৬/৪) হে প্রাণগন, হে রুদ্রগন, আমার এই জীবনের মধ্যবর্তী অংশকে (মাধ্যন্দিন সবনকে) পরবর্তী আটচল্লিশ বছর (তৃতীয় সবন) পর্যন্ত বিস্তৃত করুন। যজ্ঞ রূপে আমি যেন আমার প্রাণরূপ রুদ্রের মধ্যে বিলীন না হয়।
এর পরে যে ৪৮ বছর আয়ু তাই তৃতীয় সবন। এই শেষ ৪৮ বছরে যদি রোগাক্রান্ত হয়, তবে সে বলবে :
"প্রাণা আদিত্যা ইদং মে তৃতীয় সবনম আয়ুঃ অনুসন্তনুত ইতি। মাঽহং প্রাণায়াম আদিত্যানাম মধ্যে যজ্ঞো বিলোপ্সীয় ইতি।" (৩/১৬/৬) হে প্রাণগন হে আদিত্যগণ আমার এই সায়ংকালীন সবনকে পূর্ণায়ু পর্যন্ত বিস্তৃত করুন। যজ্ঞরূপী আমি যেন প্রাণরূপ অদিতীগণের মধ্যে বিলীন না হই।
দ্রব্য যজ্ঞ : সমিধ কাষ্ঠে অগ্নি প্রজ্বলিত করে, তাতে ঘি, বেলপাতা, ইত্যাদি দ্রব্য আহুতি দেওয়াকে বলা হয় দ্রব্য যজ্ঞ। বেদশাস্ত্রে এই ধরনের বহু যজ্ঞের প্রণালীর কথা বর্ণনা করা আছে। এই দ্রব্য যজ্ঞ সাধারণত মনোবাঞ্ছা পূরণ করবার জন্য করা হয়ে থাকে। পিতা মাতার কর্তব্য সন্তানের লালন-পালন-রক্ষা করা। তেমনি সন্তানের কর্তব্য পিতা-মাতাকে সুখ স্বাচ্ছন্দে রাখা। রাজার কর্তব্য প্রজাকুলের সুখ স্বছন্দ ও শ্রীবৃদ্ধির চেষ্টা করা।দেবতাদের কর্তব্য জীবকূলকে ভালো রাখা, আবার মানুষের কর্তব্য দেবতাদের সন্তুষ্ট করা। এগুলো সবই যজ্ঞস্বরূপ। বিভিন্ন দেবতাদের উদ্দেশ্য অনুষ্ঠিত দ্রব্যদানরূপ এই যজ্ঞকে দ্রব্যযজ্ঞ বলা হয়ে থাকে।
তপঃ যজ্ঞ : সংসার থেকে দূরে কোথাও নির্জনে ঈশ্বর-সন্ধানের মন নিয়ে, শারীরিক ক্লেশ স্বীকার করে, ধ্যানাদির ক্রিয়াকে তপঃযজ্ঞ বলা হয়ে থাকে।
যোগ যজ্ঞ : শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়া, ধ্যান-ধারণার অনুশীলন করাকে যোগ-যজ্ঞ বলা হয়ে থাকে।
জ্ঞান যজ্ঞ : বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ, তার শ্রবণ, মনন, ইত্যাদিকে জ্ঞানযজ্ঞ বলা হয়ে থাকে।
ব্রত যজ্ঞ: কঠোর ব্রত পালন, উপবাস পরায়ণ হয়ে শারীরিক ও মানসিক ক্লেশ বরণ করাকে বলা হয় ব্রতযজ্ঞ।
স্বাধ্যায় যোগ : স্বাধ্যায় কথাটার অর্থ হচ্ছে, আবৃত্তিপূর্বক বেদ অধ্যায়ন। ব্রত পরায়ণ হয়ে, নিয়মিত জ্ঞানের চর্চা অর্থাৎ বেদাদির অনুশীলনকেই স্বাধ্যায় যজ্ঞ বলা হয়। এই স্বাধ্যায় যজ্ঞের দ্বারা প্রাচীন কালে শাস্ত্রবাক্য গুরু-শিষ্য-প্রশিষ্য পরম্পরায় কণ্ঠস্থ রাখার প্রথা প্রচলিত ছিল। এইসময় শাস্ত্রের জ্ঞান বা বোধ থেকে বেশি গুরুত্ত্ব দেওয়া হতো শাস্ত্রশ্লোকের আবৃত্তির উপরে। আসলে সেযুগে শাস্ত্র গ্রন্থের বাণীপ্রবাহের ধারাকে এইভাবে অক্ষুন্ন রাখা হতো। জ্ঞান যজ্ঞ ও স্বাধ্যায় যজ্ঞ পৃথক নয়। তথাপি যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বাধ্যায় যজ্ঞের কথা আলাদা ভাবে উল্লেখ করেছেন। কারন হচ্ছে, শাস্ত্রবাক্য বা শাস্ত্রজ্ঞান যতক্ষন দৈনন্দিন জীবনে, আমাদের আচরণে কার্যকরী ভূমিকা না নিতে পারে, ততক্ষন শাস্ত্রজ্ঞান আমাদের হিত সাধন করতে পারে না। তাই জ্ঞানযজ্ঞ ও স্বাধ্যায়যজ্ঞ এক ও অভিন্ন। এই দুই যজ্ঞ একসাথেই সম্পাদন করা কর্তব্য।
আসলে, প্রজ্বলিত হোমাগ্নিতে ঘৃতসংযুক্ত বেলপাতা-ঘি ইত্যাদি নিক্ষেপ, ও মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে দ্রব্যাদি দানকে যজ্ঞ বলা হয়। এতে করে হয়তো বাঞ্চিত বস্তু পাওয়া যায়, বা বৈষয়িক বাসনার তৃপ্তি হয়, কিন্তু যাঁরা কূটস্থে চিদাকাশে নানান দৃশ্য দর্শন করেন, তা আরো ভালো। আবার যারা আজ্ঞাচক্রে মনকে স্থির করে, বিভিন্ন নাদের শ্রবণ করেন, অর্থাৎ নানান অশ্রুত বিষয় শ্রবণ করেন, তাদের অবস্থা আরো ভালো। আবার কেউ বেদ-বেদাঙ্গ ইত্যাদির অর্থ-জ্ঞান ও তত্ত্ব আলোচনা করেন, এমনকি বিভিন্ন চক্রের অবস্থান ক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করেন, এমনকি এই চক্রে মন স্থির করে বসে থাকেন, তাঁরাও ভালো। কিন্তু যে যোগীপুরুষ বিষয়বিমুখ হয়ে, সংযত চিত্তে মনকে কূটস্থে স্থিররেখে, আমি-আমার বোধ রোহিত হয়ে, চৈতন্যের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করেন, তাঁরা সাধনার পরাবস্থায়, অর্থাৎ উচ্চ অবস্থায়, জ্ঞানাতীত অবস্থায় পরম আনন্দে অবস্থান করেন।
--------------------------------------------------
২৬.০২.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/২৯
অপানে জুহ্বতি প্রাণং প্রাণে অপানং তথাপরে।
প্রাণ-অপান-গতী রুদ্ধা প্রাণায়াম-পরায়ণাঃ।
অপরে নিয়তাহারাঃ প্রাণান্ প্রাণেষু জুহ্বতি।। (৪/২৯)
কেউ কেউ পরিমিতাহারী হয়ে, অপান বায়ুতে প্রাণকে, প্রাণ বায়ুতে অপানকে হোম করেন। আবার কেউ কেউ প্রাণায়াম-পরায়ণ হয়ে প্রাণ অপানের গতি রোধ পূর্বক প্রাণবায়ু সকলকে প্রাণেতে হোম করেন।
১) কেউ অধোগতিসম্পন্ন অপান বায়ুতে উর্দ্ধগতি সম্পন্ন প্রাণবায়ুকে পুরকের দ্বারা আহুতি দেন। অর্থাৎ শ্বাস গ্রহণ বা পূরক কালে, প্রাণ ও অপানকে মিলিত করেন।
২) কেউ বায়ু রুদ্ধ করে অর্থাৎ কুম্ভক করে, এই প্রাণ ও অপানের গতিকে অর্থাৎ উর্দ্ধ বা অধোগতিকে রোধ করে, শ্বাস ত্যাগের সময় অর্থাৎ রেচকের সময়, অপান বায়ুকে প্রাণে হোম করেন। এইভাবে অর্থাৎ পূরক-রেচক-কুম্ভক ক্রিয়ার দ্বারা প্রাণায়াম পরায়ণ হন।
৩) কেউ আবার আহারের সঙ্কোচ অভ্যাস করে, ইন্দ্রিয়সকলকে তাদের স্ব-স্ব কর্ম্ম থেকে অর্থাৎ ইন্দ্রিয়বৃত্তি-লয় রূপ হোম করে থাকেন।
এখানে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ সরাসরি যোগক্রিয়ার ধরন সম্পর্কে বলছেন। যোগ সাধনার সমস্ত ক্রিয়াই প্রাণায়াম অর্থাৎ রেচক-পূরক-কুম্ভক এর উপরে নির্ভর করে করতে হয়। এখন কথা হচ্ছে, পরমাত্মা বা পরব্রহ্ম নির্গুণ, নিরাকার, বাক্যের অতীত, এমনকি অবাঙ-মানসগোচর। তো সেই ভগবৎ সাক্ষাৎকারের শ্রেষ্ঠ ও প্রধান উপায় হচ্ছে প্রাণায়াম। এই ব্যাপারটা আমাদের একটু বিশেষভাবে বুঝে নেওয়া দরকার। তা না হলে, এই শ্বাসের ক্রিয়া, যা স্থুল ভাবে বলতে গেলে, এই শারীরিক-মানসিক ক্রিয়া, তা কিভাবে সেই অবাঙ-মানসগোচর বিষয়কে আমাদের গোচরীভূত করতে পারে, তা আমরা বুঝতে পারবো না। আর এটা না বুঝলে, প্রাণায়ামের বিষয়ে আমাদের আগ্রহ সৃষ্টি হতে পারে না। আমরা সবাই জানি, বোকার মতো কাজ না করে, যদি আমরা বুদ্ধিসহযোগে কাজ করতে পারি, তবে সেই কাজে আমরা তাড়াতাড়ি সুফল পেতে পারি। তাই প্রাণায়ামের ক্রিয়া ও ব্রহ্মের সঙ্গে তার সম্পর্ক কি, সেটা যদি আমরা ধরতে পারি, তবে প্রাণায়ামের যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা আমাদেরকে প্রাণায়ামে অনুপ্রাণিত করতে পারে।
আমরা জানি ব্রহ্ম সগুন ও নির্গুণ ভেদে দুই অবস্থায় আছে। আবার ব্যক্ত ও অব্যক্ত ভেদে দুই অবস্থায় আছে। বলা হয়ে থাকে ব্রহ্মের ষোলোটি কলার মধ্যে মাত্র একটি কলা ব্যক্ত। আর বাকি সমস্ত কলাই অব্যক্ত অবস্থায় আছে। এখন এই যে ব্যক্ত একটি কলা, এই অংশটি ত্রিগুণময়ী প্রকৃতি। অর্থাৎ সত্ত্ব, রজ, তম - এই তিন গুনের খেলাই এই জগৎসংসার, এই স্থুল জগৎ, এই জীব শরীর। এখন এইযে তিনটে গুন্, সত্ত্বঃ, রজঃ, তমঃ, এই তিনটে গুন্ই ইড়া-পিঙ্গলা-সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে দিয়ে, প্রাণবায়ুরূপে প্রবাহিত হয়ে এই সংসারের সমস্ত ক্রিয়া সম্পাদন করছে। তো প্রকৃতিকে উপলব্ধি করতে গেলে, এই তিনগুণের সমন্নয়সাধন-ক্রিয়াকে বুঝতে হবে। শ্বাসের যাত্রাপথকে ধরতে হবে। আর এই শ্বাসের যাত্রাপথের সঙ্গে যদি আমরা শ্বাসের ক্রিয়াকে লক্ষ করি, তবে আমরা বুঝতে পারবো, শ্বাস কখন কোন গুনের নিঃসরণ করছে। আর শ্বাসের যদি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তবে আমরা শ্বাসের বিশেষ গুনের ব্যবহার সহজসাধ্য হতে পারে।
জীবন হচ্ছে শ্বাসের খেলা। শ্বাসের শুরুতে জীবনের শুরু, আবার শ্বাসের শেষে জীবনের শেষ। এই শ্বাসের সাথে চেতনশক্তি ঘোরাফেরা করছে, এটা আমরা বেশ বুঝতে পারি। কেননা এই শ্বাসের অন্তর্ধানের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের সমস্ত চেতনা লোপ পায়, ক্রিয়াশক্তি লোপ পায়।
হিন্দু শাস্ত্র বলছেন, ব্রহ্মের বহু হবার ইচ্ছেতেই এই জগৎ সৃষ্ট হয়েছে। জগতে ভিন্নতার সৃষ্টি হয়েছে। এই যে ইড়া-পিঙ্গলা-সুষুম্না নাড়ী এর মধ্যে যখন সূক্ষ্ম প্রাণশক্তি প্রবাহিত হয়, তখন অব্যাকৃত প্রকৃতির, অর্থাৎ যথার্থ প্রকৃতির সন্ধান মেলে। এই সূক্ষ্ম প্রাণশক্তি যাকে বলা হচ্ছে প্রকৃতি, এর থেকেই এই ত্রিগুণাত্মক জগৎ ক্রিয়াশীল হচ্ছে, অর্থাৎ একবার জন্মাচ্ছে, একবার মারা যাচ্ছে, বা বলা যেতে পারে মুহুর্মুহু জগতের পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। প্রাণশক্তি যখন ব্যাপকভাবে বিচরণশীল হলো, অর্থাৎ বিস্তার লাভ করলো, তখন জীবের সংসার বাসনার উদ্ভব হলো। এই যে প্রাণের চঞ্চলতা যার দ্বারা আমাদের সংসারবাসনার উদ্ভব হচ্ছে, তার শান্তভাব না এলে, আমাদের সংসার বাসনার নিস্পত্তি হবে না। আর সংসার বাসনার বিলোপ সাধন না হলে, আমাদের যথার্থ জ্ঞান উৎপন্ন হতে পারে না, বা ভগবৎ দর্শন হতে পারে না। মন বহির্মুখী হয়ে বিষয়ে লিপ্ত হচ্ছে। জীবের এই যে বিষয় গ্রহণস্পৃহা, এটাই জীবের অজ্ঞান অবস্থা। বিষয় স্পৃহার কারনে মন বিক্ষিপ্ত ভাবে ঘোরাফেরা করছে, বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে। চঞ্চল মন কখনও বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। আর সমস্ত বিষয়ের গভীরে অবস্থান করছেন, সেই ভগবৎ শক্তি। তো মন যেমন চঞ্চলতার কারনে, বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে অক্ষম সেই একই কারনে সে ভগবৎ সত্ত্বা থেকে দূরে অবস্থান করে। যোগশাস্ত্র বলছে, প্রাণকে রুদ্ধ করতে পারলে, মন রুদ্ধ হবে। আর প্রাণায়ামের প্রথম ও প্রধান কাজই হচ্ছে, প্রাণবায়ুকে রুদ্ধ (কুম্ভক) করা।
দেখুন আপনি যদি বিষয়কাজে মনোযোগী হতে চান, আপনি যদি পড়াশুনায় মনোযোগী হতে চান, অর্থাৎ আপনি যদি সাংসারিক কাজে অধিক ফল স্বল্প সময়ে পেতে চান, এমনকি আপনি যদি মনের শান্তি চান, তবে স্বল্পক্ষন প্রাণায়াম অনুশীলন করে দেখবেন, আপনার ব্যবহারিক জীবনে যে কাজ. তা আগে যে সময় নিতো, বা যত নির্ভুল ভাবে আগে হতো, এখন তা স্বল্প সময়ে অধিক নিখুদ ভাবে আপনার দ্বারা করা সম্ভব হচ্ছে। এমনকি আপনি যদি পুজো-পাঠ, বা ধ্যানে বসবার আগে, স্বল্পক্ষন প্রাণায়ামের অভ্যাস করে নেন, তবে আপনার পূজা-পাঠ বা ধ্যান অধিক ফলপ্রসূ হবে। অর্থাৎ আপনার কাজের গুণমান বৃদ্ধি পাবে। আসলে প্রাণায়াম আমাদের মনকে অধিক একাগ্রতা এনে দিতে পারে। এর কারন হচ্ছে, প্রাণায়ামের সাহায্যে প্রাণবায়ু নির্ম্মল বা সূক্ষ্ম হতে থাকে। ফলতঃ প্রাণবায়ু উর্দ্ধগতিসম্পন্ন হয়ে আমাদের আজ্ঞাচক্রে বা সহস্রারে স্থির হয়ে অবস্থান করে। আর প্রাণবায়ু যখন স্থির হয়, তখন আমাদের বুদ্ধি ক্ষুরধার হয়। আর ক্ষুরধার বুদ্ধিতে সমস্ত বিষয় জ্ঞান তা সে বাহ্যিক বিষয়জ্ঞান বলুন বা অন্তরের বিষয়জ্ঞান বলুন, সবই স্পষ্টতর হয়।
বাইরের বায়ু যাকে আমরা পঞ্চবায়ু বলি, তা হচ্ছে প্রাণ,অপান, সমান, ব্যান, ও উদান । এগুলোকে আপনি প্রাণশক্তির মহিমা বলতে পারেন। প্রাণশক্তি বিভিন্ন বায়ুরূপে আমাদের দেহ-মনকে সঞ্জীবিত করে রেখেছে। যোগের ভাষায় একেই অর্থাৎ প্রাণশক্তিকেই বলে কুল-কুণ্ডলিনী শক্তি। আমরা যাকে জীবনীশক্তি বলি তা আসলে এই কুলকুন্ডলিনী শক্তি। এই শক্তি দ্বারাই জড় বা অজড় সমস্ত পদার্থই বিধৃত। এই শক্তি আমাদের পায়ের পাতা থেকে মাথা পর্যন্ত বিস্তৃত। আমরা যে ইন্দ্রিসকলের সাহায্যে শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধের অনুভব করে থাকি, তা আসলে এই প্রাণশক্তির দ্বারাই অনুভব হচ্ছে। আমাদের মেরুদন্ডের নিম্নস্থিত কুণ্ডলিনী হতে এই শক্তি উৎসারিত হয়ে দেহের সর্বত্র সঞ্চারিত হচ্ছে। গুহ্যদেশে পিন্ডের আকারে এই শক্তি সুপ্ত অবস্থায় আছে। আবার আমাদের আজ্ঞাচক্রে মণ্ডলাকারে অবস্থান করছে এই শক্তি। আর এই দুই স্থানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করছে তিনটি নাড়ী ইড়া , পিঙ্গলা ও সুষুম্না। যা আমাদের মেরুদন্ডকে বেষ্টন করে আছে। এই নাড়ী সকলের মধ্যে বায়ুর স্পন্দন বা পঞ্চপ্রানের স্পন্দনই আসলে আমাদের মনের ক্রিয়া। এখানেই আমাদের বিভিন্ন ইচ্ছেশক্তির স্ফূরণ হচ্ছে। এই বায়ুকে আমরা পাঁচ ভাগে ভাগ করে বুঝবার চেষ্টা করছি বটে, কিন্তু এই বায়ুর ক্রিয়া পঞ্চাশ বা তার কাছাকাছি। এটা কেউ বলেন, ৪৯, কেউ বলেন ৫১। আমরা যে শ্বাস গ্রহণ বা শ্বাস ত্যাগ করছি, তা এই শক্তির ক্রিয়া। আর এই ক্রিয়ার ফলে আমাদের জীবন প্রবাহ একবার উর্দ্ধমুখী, আবার একবার নিম্নমুখী হচ্ছে। একবার বহির্মুখী একবার অন্তর্মুখী হচ্ছে। এরফলে আমাদের জীবনপ্রবাহ ধারাবাহিক ভাবে গতিশীল হচ্ছে। এই ক্রিয়া যখন থেমে যায়, তখন জীবের মৃত্যু ঘটে। তাহলে আমরা বুঝলাম, কুলকুন্ডলিনী শক্তিই আমাদের জীবনপ্রবাহের কান্ডারী। জীব-জগতের বীজ নিহিত আছে, এই কুলকুন্ডলিনী শক্তির মধ্যে।
এই কুলকুন্ডলিনী শক্তিকেই বলে পিন্ড। আমাদের শরীরের যাবতীয় শক্তি বা ক্ষমতা এমনকি আমাদের এই যে অবয়ব (স্থুল-দেহ) তা এই শক্তির জোরেই স্থির আছে। আসলে স্থির নয়, এই শক্তি প্রতিনিয়ত গতিশীল, কিন্তু আমরা তা ধরতে পারি না, কারন এর গতি এতোটাই সূক্ষ্ম বা এর গতি এতটাই দ্রুত, যা আমাদের অনুভবের বাইরে। কিন্তু একটা অবয়ব আমাদের চোখের সামনে ভাসছে মাত্র। যা এই আছে - এই নাই অবস্থায় গতিসম্পন্ন। সিনেমার পর্দার ছবি দ্রুত সরে সরে যাচ্ছে, আমরা কিন্তু ঘটনার প্রবাহ দেখছি, মনে হচ্ছে স্থির। তেমনি জীবন প্রবাহ দ্রুত সরে সরে যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের কাছে মনে হচ্ছে স্থির।
যাইহোক, এই শক্তি যখন আমাদের হৃদয়ে স্থির হয়, জানবেন তখন তা সূক্ষ্ম। আবার এই শক্তি যখন আজ্ঞাচক্রে স্থির হয়, তা জ্যোতিঃবিন্দু স্বরূপ। এই জ্যোতিঃবিন্দুই হচ্ছে সগুন ব্রহ্মের প্রথম প্রকাশ, বা আদিরূপ। প্রাণায়াম বা যোগসাধনার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই বিন্দুস্বরূপ হওয়া, বা এই বিন্দুতে স্থিত হওয়া।
এখানে থেকেই প্রাণশক্তি অজস্র নাড়ীর ভিতরে প্রবেশ ক'রে, শরীরকে ক্রিয়াশীল করে তোলে। জীবকুলের তখন বাহ্য কর্ম্ম-প্রচেষ্টা শুরু হয়, ইন্দ্রিয়গণ তখন বহির্বিশ্বে বিষয় অন্বেষনে বেরিয়ে পড়ে। শুরু হয়, সুখ-দুঃখ, হর্ষ-বিষাদ। শুরু হয় মনের বৃত্তিসমূহের উথাল-পাথাল, সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রবাহ। শুরু হলো, জীবনপথ যাত্রা। যার পরিণতি হচ্ছে, মৃত্যু।
এই যে জীবনপথ যা শেষ হয়েছে শ্মশানে গিয়ে অর্থাৎ যার পরিণতি হচ্ছে মৃত্যু, এই পথের উল্টোদিকেই আছে, সুতিকাগৃহ। তো যে পথে গেলে আমরা শ্মশানে যেতে পারি, ঠিক সেই একই পথ ধরে যদি আমরা উল্টো দিকে যাই, তবে আমরা জন্মভূমিতে পৌঁছতে পারি। যেখান থেকে এসেছি, সেখানে যেতে পারি। আমরা আমাদের উৎসে ফিরে যেতে পারি। আবার বলা যেতে পারে, যে শ্বাসের হাত ধরে, আমরা নেমে এসেছি, সেই শ্বাসের হাত ধরেই আমরা অজ্ঞান লোক থেকে জ্ঞানের লোকে যেতে পারি, মৃত্যু লোক থেকে আমরা মৃত্যুঞ্জয়ী হতে পারি। এইজন্য যার হাত ধরে আমাদের যাতায়াত, তাঁর গতিমুখ পরিবর্তন করাই প্রাণক্রিয়ার বা প্রাণায়ামের উদ্দেশ্য। আর এই মহাবিদ্যার সাধনপীঠ হচ্ছে মেরুদন্ড স্থিত সুষুম্না নাড়ী। প্রাণবায়ু যখন সুষুম্না নাড়ীতে প্রবেশ করে, তখনই আমাদের অমৃত লাভের পথ উন্মুক্ত হয়। জীব ভূমিষ্ট হবার আগে, (অর্থাৎ মায়ের গর্ভে থাকাকালীন ) তার মধ্যে বায়ুর ক্রিয়া সুষুম্না দিয়েই প্রবাহিত হতো, কিন্তু ভূমিষ্ট হবার সঙ্গে সঙ্গে তার সুষুম্না নাড়ীপথ রুদ্ধ হয়ে যায়, আর ইড়া-পিঙ্গলা দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস ক্রিয়া শুরু হয় ।
তাই প্রাণের সাধনাই ব্রহ্ম সাধনা। সমস্ত মুনিঋষগন এই সাধনাই করতেন, এখনো করে থাকেন। প্রাণের স্থিরতা না এলে, আমাদের কাছে আধ্যাত্মিক জগতের আলো প্রস্ফুটিত হবে না। আর প্রাণের মধ্যে মনের লয় হলেই সমাধিস্থ হওয়া যাবে ।
.....................
২৭.০২.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/২৯ (বর্ধিত অংশ -১)
ইন্দ্রিয় সংযমের অভ্যাস দৃঢ় না হলে সমাধির অবস্থায় পৌঁছনো যায় না। যার ইন্দ্রিয়সকল মনের বশীভূত তাঁর প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন এই ইন্দ্রিয়সকলকে দোষমুক্ত করতে হলে, আমাদের প্রাণকে নিগ্রহ করতে হবে। অর্থাৎ আমাদের ক্রিয়া যোগের অভ্যাস করতে হবে। যোগ অর্থাৎ শ্বাসবায়ুকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। শ্বাসবায়ুকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে, আমাদের মনকেও আমরা স্থির করতে পারবো। প্রাণায়ামের সাহায্যে আমরা প্রাণবায়ুকে সুষুম্নামুখী করতে পারবো। শ্বাস ও প্রশ্বাসের যে স্বাভাবিক গতি তার মধ্যে ছেদ আনতে হবে। অর্থাৎ কুম্ভকের সাহায্যে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতির মধ্যে একটা ছেদ টানতে হবে। শ্বাস যখন আমরা বাইরে ছেড়ে দেবো, তখন আমাদের বাহ্য কুম্ভকের সাহায্যে বায়ুকে বাইরে রুদ্ধ করে দেবো। আবার শ্বাস যখন আমাদের ভিতরে প্রবেশ করবে, তখন আমরা অন্তর কুম্ভকের অভ্যাস করে শ্বাসবায়ুকে ভিতরে রুখে দিতে হবে। এইযে কুম্ভকক্রিয়া একেই বলে, প্রকৃত যজ্ঞ বা হবন-ক্রিয়া।
আমাদের মন-বুদ্ধি সদা বিভিন্ন বিষয়ক্রিয়ায় নিযুক্ত থাকে। এই যে মন-বুদ্ধির বিষয়ক্রিয়া করবার শক্তি তা আসে এই প্রাণশক্তি থেকে। প্রাণের ক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে গেলে, কোনো ইন্দ্রিয় বিষয় গ্রহণে সমর্থ হয় না। তো শ্বাস যখন ইড়া-পিঙ্গলাবাহিনী হয় তখন সংসারক্রিয়া চলতে থাকে, অর্থাৎ বিষয়বোধ জাগে। আবার এই শ্বাস যখন সুষুম্নাবাহিনী হয়, তখন আমাদের ব্রহ্মজ্ঞান বা ভাগবত তত্ত্ব বোধ জাগ্রত হয়। যোগশাস্ত্র অনুসারে প্রাণাদি সংযমের দ্বারা নাড়ীচক্র সক্রিয় হলে, প্রাণবায়ু সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করে উর্দ্ধমুখী হয়। আর এর ফলে মন শূন্যতায় বিরাজ করে ও যোগী কর্ম্মবন্ধন থেকে মুক্ত হন। মন হবে স্থির আর প্রাণ হবে অচঞ্চল তবেই আমাদের জ্ঞানের উন্মেষ ঘটবে। এই হচ্ছে, যথার্থ জ্ঞানলাভের পন্থা। আমরা ভাবি বই পড়ে বা আচার্য্যের কাছ থেকে শুনে আমরা জ্ঞানী হতে পারি। আসলে এই জ্ঞান শুষ্ক জ্ঞান, তথ্যভিত্তিক জ্ঞান। যদিও এই জ্ঞানেরও উপযোগিতা আছে, তথাপি এই জ্ঞান হচ্ছে, রসোগোল্লা না খেয়ে, রসোগোল্লার রচনা মুখস্ত করবার মতো। বিরাট বক্তৃতা এই শুষ্ক জ্ঞান থেকে হয়তো দেওয়া তো যায়, কিন্তু রসোগল্লার স্বাদ রচনা মুখস্ত করে পাওয়া যায় না। তাই যোগাচার্য্যগণ আমাদেরকে সতর্ক করে বলেছেন, প্রাণবায়ু যতক্ষন না সুষুম্নামার্গে প্রবেশ করছে, ততক্ষন জ্ঞানের সাক্ষাৎ হয় না। আর শুষ্ক জ্ঞানের কথা বলা, নিতান্ত দাম্ভিকতা প্রকারান্তরে মিথ্যা বলার সামিল। জ্ঞানের আবরণ হচ্ছে চঞ্চল মন ও প্রাণ। ঠাকুর রামকৃষ্ণ শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ করেননি, কিন্তু তিনিই ছিলেন যথার্থ জ্ঞাণীপুরুষ।
যদিও ঋষি পতঞ্জলি তার যোগদর্শন গ্রন্থে অষ্টাঙ্গ যোগের কথা বলেছেন। এখন ঠাকুর রামকৃষ্ণ অবতারপুরুষ, জন্ম জন্মান্তরে সাধক। তার সঙ্গে আমাদের মতো সাধারনের তুলনা করলে চলবে না। আমাদের হয়,আচার্য্যের শ্রীমুখে, এমনকি গুরুসান্নিধ্যে থেকে যোগের অভ্যাস করা শ্রেয়। কিন্তু সৎ গুরুর অভাবে অন্তত যোগশাস্ত্রগুলো পড়লে, যথাযথ ভাবে তার অর্থ বুঝে, আমরা খানিকটা যোগের পথে পা বাড়াতে পারি। তাতে যেমন আমাদের যেমন উপকার হতে পারে, তেমনি শাস্ত্র রচনার উদ্দেশ্য ফলপ্রসূ হতে পারে। তা না হলে, এই যোগশাস্ত্র বা ধর্ম্মগ্রন্থ রচনাই বৃথা হয়ে যায়।
ঋষি পতঞ্জলি তাঁর যোগদর্শন গ্রন্থে বলছেন :
তস্মিন সতি শ্বাসপ্রশ্বাসয়োর্গতিবিচ্ছেদঃ প্রাণায়ামঃ (সাধনপদ-৪৯)
আসন জয় হলে পরে, নিশ্বাস-প্রশ্বাস ও তাদের গতির যে রোধ তা হলো প্রাণায়াম। বাইরের বায়ু গ্রহণ হচ্ছে শ্বাস,আর ভিতরের বায়ুকে ত্যাগ করাকে বলে প্রশ্বাস, এই দুটোর গতি রোধ হচ্ছে প্রাণায়াম। অর্থাৎ শ্বাস নেওয়া ও শ্বাস ফেলা ও এই দুটোর রোধ, এই তিনি মিলে প্রাণায়াম। আবার কোনো কোনো যোগগুরু বলে থাকেন, শ্বাস গ্রহণ করে তার রোধ করা (অন্তর-কুম্ভক), একপ্রকার প্রাণায়াম, আবার শ্বাস ছেড়ে দিয়ে বায়ু রোধ করা (বাহ্য-কুম্ভক) আর একপ্রকার প্রাণায়াম এই দুয়ে মিলে প্রাণায়াম ক্রিয়া। প্রাণায়ামকে আরো গভীরে বিশ্লেষণ করে ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, পূরক হলো অন্তর্বৃত্তি, রেচক হলো বাহ্যবৃত্তি, আর কুম্ভক হলো আন্তর্বৃত্তি স্তম্ভক।
স্থুল শরীরে প্রাণের প্রথম প্রকাশ হয় ফুসফুসের ক্রিয়ার শুরুতে। জীবনের প্রথম লক্ষণ হচ্ছে শ্বাস। দেখুন সূক্ষ্মকে ধরতে গেলে স্থুলের সাহায্য নিতে হবে। প্রাণশক্তি দৃষ্টিগোচর নয়। ফুসফুসের ক্রিয়া শুরু হলে, আমরা প্রাণের স্পন্দন অনুভব করি। কিন্তু কথা হচ্ছে, ফুসফুসকে কে চালাচ্ছে ? প্রাণের প্রথম কাজ হচ্ছে, সংকোচন-সম্প্রসারণ। জীবনের শুরুতে আমরা প্রাণের এই গতি লক্ষ করি। যেখানে যত প্রাণী আছে, তা সে প্রোটোপ্লাজম বলুন, আর মানুষ বলুন, এরা যতক্ষন জীবিত থাকে, ততক্ষন এদের মধ্যে প্রতিক্ষণ সংকোচন ও প্রসারণ ক্রিয়া চলছে।ফুসফুসের এই যে গতি, এর ফলেই নিশ্বাস-প্রশ্বাস ঘটছে। যে শক্তি এই ফুসফুসকে গতিশীল করছে, তারই স্থুল প্রকাশকে আমরা শ্বাস-প্রশ্বাস বলছি। প্রাণের এই স্থুল ক্রিয়াকে অবলম্বন করে, আমরা এর কারন স্বরূপ যে সূক্ষ্ম শক্তি, তাকে আমরা ধরতে পারি। প্রাণায়ামের উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই যে প্রাণশক্তি আমাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে তাকে আয়ত্তে আনা । এই প্রাণ আয়ত্তে এলে, শরীরের মধ্যে এর যে ক্রিয়া, তাও ধীরে ধীরে আমাদের আয়ত্তে আসবে। এখন আমাদের বোঝা দরকার যে এই প্রাণশক্তি সবর্ত্র বিরাজ করছে। স্থুল জগতে যত স্পন্দন ক্রিয়া তা সবই প্রাণের কার্য্য। স্থুল জগতের সমস্ত কার্য্য, তা সে মানসিক হোক বা আধ্যাত্মিক হোক, সমস্ত ক্রিয়ার সংগঠক হচ্ছে এই প্রাণ।
এখন প্রতেকটি পরমাণুতে আছে প্রাণশক্তি। আবার প্রত্যেকটি জীবকোষের মধ্যেও আছে পরমাণু। তো শরীরের ভিতরে যে প্রাণের স্পন্দন চলছে, তাকে যদি উত্তেজিত করতে পারি, তবে আমাদের জীবকোষের পরমানুগুলোকে স্পন্দনের উচ্চমাত্রায় নিয়ে যেতে পারি। এইভাবে আমরা অধিক শারীরিক, মানসিক, এমনকি ইচ্ছাশক্তির বিকাশ ঘটাতে পারি। আমাদের অনুভূতি শক্তি বাড়াতে পারি। এই ইচ্ছাশক্তি ও প্রাণশক্তি পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে আমরা প্রাণের স্পন্দনকে উচ্চতর স্তরে উন্নীত করতে পারি। আবার প্রাণের স্পন্দন বাড়িয়ে আমরা ইচ্ছাশক্তিকে সমৃদ্ধ করতে পারি।
---------------------------
২৮.০২.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/২৯ (বর্ধিত অংশ -২)
নিজের যা আছে তাকে আগে দেখুন। নিজের মধ্যে যে সুপ্ত অসীম শক্তি আছে, তার দিকে খেয়াল করুন। বাইরের শক্তি সংগ্রহের দিকে না হয়, পরে মনোযোগ দেওয়া যাবে। তো আমাদের শরীরে যে শক্তি আছে, তাকে কি করে আয়ত্তে আনা যায়, তার চেষ্টা করতে হবে। যে নিজের শক্তিকে ধরতে পারে না, সে বাইরের শক্তিকেও ধরতে ব্যর্থ হয়। যা আমার নিজস্ব তা আমাদের সহজে বশে আসতে পারে। তো ফুসফুস আমাদের নিজস্ব, হৃদ যন্ত্রের ক্রিয়াও আমাদের নিজস্ব। আমার মধ্যেই প্রাণের অভিব্যক্তি। আর এই প্রাণ হচ্ছে সমগ্র জগতের মূল শক্তি । বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের যে জীবনপ্রবাহ তা আমাদের শরীরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই সত্যকে উপলব্ধি করবার চেষ্টা করতে হবে। বিশ্বশক্তির একটা ক্ষুদ্র অংশ আমার সত্তার সঙ্গে সন্মন্ধযুক্ত। আমাদের মনকে সংযত করে এই শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। আমাদের মনকে সংযত করতে হবে, আমাদের শ্বাসকে সংযত করতে হবে। একে সত্তর বের করে দিও না। একে তাড়াহুড়া করতে দিও না। শ্বাসকে ধীর করো। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে প্রাণশক্তি ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। এই প্রচন্ড শক্তিশালী প্রাণকে বিপথে চালিত হতে দিও না। বেসামাল হতে দিও না। আমাদের সবসময় স্মরণে রাখতে হবে, এই প্রাণরূপী জীবনীশক্তি আমাদের সমস্ত কর্ম্ম শক্তির উৎস। এই প্রাণই আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়শক্তির কর্তা। তো প্রাণের আয়াম করতে হবে, প্রাণায়াম করতে হবে। আর এই ক্রিয়ায় মনোযোগ দিলে, নিজের শরীরতন্ত্রে সাম্য ভাব আসবে, শরীর-মনে একটা ছন্দ আসবে।
আমরা সবাই প্রকৃতির অঙ্গ, আমাদের সবার প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলা উচিত। এই প্রাণায়ামের অভ্যাস আমাদেরকে সেই প্রকৃতির নিয়ম সম্পর্কে সতর্ক করবে। বিশ্বে এমনকিছু নেই যা তোমার মধ্যে নেই। একটা সূক্ষ্ম বস্তু কণার মধ্যে যে কি আছে, এটা বুঝতে পারলে, সারা বিশ্বের রহস্যঃ তোমার কাছে উন্মোচিত হবে। একটা জিনিস জানবে, যে শক্তি চন্দ্র-সূর্যকে পরিচালিত করছে, সেই একই শক্তি, একই নিয়ম ক্রিয়াশীল আছে, তোমার আমার সবার মধ্যে। এই মূল তত্ত্বের উপরে দাঁড়িয়ে নিজেকে জানতে চেষ্টা করতে হবে। আমরা সবাই স্থুল শরীরেই অবস্থান করছি। তাই স্থূল শরীর থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু করতে হবে। মনকে একাগ্র করে, আগে এই স্থূল শরীরকে ভালোভাবে জানতে হবে। শুধু শরীর নয়, শরীরতন্ত্রের উপরে আমাদে মন কিভাবে ক্রিয়া করছে, কিভাবে আমাদের অনুভূতিগুলো সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হতে পারে, আমাদের উপলব্ধি কিভাবে গভীরে প্রবেশ করছে সেদিকেও খেয়াল করতে হবে। আমাদের শরীরের ৮৬ ভাগ অন্ত্র শুধু অক্সিজেন থেকে খাবার সংগ্রহ করছে। তো আমাদের শরীরে যত অক্সিজেন প্রবেশ করাতে পারবো, এবং তাকে ধরে রাখতে পারবো, তত আমাদের শরীর প্রাণবন্ত থাকবে। এতেকরে আমাদের শরীরে একটা ছন্দবদ্ধ তালের ঝঙ্কার উঠবে, একটা মিলনের সুর ধ্বনিত হবে। আর এটা শুধুমাত্র বিধিবদ্ধ প্রাণায়ামের সাহায্যেই সম্ভব হতে পারে। সেই কথাই যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন। সেই প্রাণায়াম বিধির কথাই এইখানে উল্লেখ করা হয়েছে।
সমস্ত বিশ্বের মুলে যে শক্তি তা হচ্ছে প্রাণশক্তি। প্রাণ যখন বহির্মুখী হয়, তখন জগৎ উদ্ভাসিত হয়। আবার প্রাণ যখন অন্তর্মুখী হয়, তখন জগৎক্রিয়া স্থির হয়ে যায়। এই প্রাণের দুটো অবস্থা, একটা স্থির, আর একটা চঞ্চল। চঞ্চলভাবটি আমরা সবাই সহজে ধরতে পারি । কিন্তু প্রাণের এই স্থির ভাব আমাদের গোচরীভূত হয় না। প্রাণের এই চঞ্চল অবস্থাকে ধরেই প্রাণের স্থির অবস্থায় পৌঁছতে হয়। আবার এই প্রাণের অস্থিরতার কারণেই মন অস্থির হয়, প্রাণের স্থিরতায় আমাদের মন স্থির হয়। মনের উৎপত্তি চঞ্চল শ্বাস থেকে, আবার মনের লয় এই স্থির শ্বাসেই। মন এই শ্বাস প্রশ্বাস অর্থাৎ অস্থির বায়ুতে আছে, এঁকে প্রাণায়াম ক্রিয়া দ্বারা স্থির করতে পারলেই, মন বাহ্যজগৎ থেকে জগতের উৎস সেই ওঙ্কারের সঙ্গে মিলিত হবে।
বিধিবদ্ধ প্রাণায়ামের দ্বারা অপানবায়ুকে মূলাধার থেকে আকর্ষণ করে, আর প্রাণবায়ুকে মূলাধার পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে ক্রিয়া করতে করতে একসময় প্রাণ ও অপান একত্রে মিলিত হয়ে, উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হয়। চন্দ্রনাড়ী (ইড়া) ও সূর্যনাড়ী (পিঙ্গলা) হয়ে বায়ু যখন সুষুম্নার মধ্যে প্রবেশ করে। তখন ইড়া-পিঙ্গলা-সুষুম্নার মিলনহেতু শরীর-তীর্থ মহাপ্রয়াগে পরিণত হয়। অপান বায়ু যখন বহিরাকাশ থেকে অন্তরাকাশে প্রবেশ করে, তখন সে প্রাণবায়ুকে গ্রাস করে। এঁকেই যোগের ভাষায় বলে সূর্যগ্রহন। আবার একসময় প্রাণ বায়ু অন্তর-আকাশ থেকে আকৃষ্ট হয়ে বহিরাকাশে আসে, তখন সে অপানকে গ্রাস করে। এঁকেই বলে চন্দ্রগ্রহণ। গ্রহণকালীন অবস্থায় যেমন সব অন্ধকার হয়ে যায়, তেমনি আমাদের অভ্যন্তরে যখন গ্রহণ লাগে, তখন আর কোনো বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ত্ব থাকে না। জাগতিক সমস্ত দৃশ্য তখন সৎ-চিৎ-আনন্দ সত্ত্বায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। একেই ক্রিয়ার উচ্চতর অবস্থা বলা হয়ে থাকে, কেউ বলেন, সমাধির অবস্থা।
-------------------------
০১.০৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/৩০-৩২
সর্ব্বে-অপি-এতে যজ্ঞবিদো যজ্ঞক্ষয়িত কল্মষাঃ। (৪/৩০)
যজ্ঞশিষ্টামৃতভুজো যান্তি ব্রহ্ম সনাতনম্
নায়ং লোকোঽস্ত্যযজ্ঞস্য কুতোহন্যঃ কুরুসত্তম। (৪/৩১)
এইসকল যজ্ঞকারিগন যজ্ঞ সম্পাদন ক'রে, নিষ্পাপ হয়ে যজ্ঞাবশিষ্ট অমৃত ভোজন ক'রে, সনাতন ব্রহ্মকে লাভ করে থাকেন। হে কুরুসত্তম, যজ্ঞানুষ্ঠান বিহীনের ইহলোক নেই, অন্য লোক কোথায় ?
এখানে অর্জ্জুনকে কুরুসত্তম বলে সম্ভাষণ করা হয়েছে । কুরুসত্তম কথার অর্থ যিনি ক্রিয়ার উচ্চ বা উত্তম অবস্থায় অবস্থান করছেন। ক্রিয়ার পরাবস্থা। শাস্ত্রবিহিত কর্ম্ম, শাস্ত্রজ্ঞান, অর্থাৎ ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে যা কিছু করা হয়, সমস্তই যজ্ঞ। এই যজ্ঞ তত্ত্ব জেনেবুঝে যিনি সেই অনুযায়ী সাধনক্রিয়া করেন, তিনি নিষ্পাপ হয়ে যান। শেষে যজ্ঞের অবশিষ্ট অর্থাৎ অমৃত ভোজন করে সনাতন ব্রহ্মকে লাভ করেন। এই যে যজ্ঞ, এর অগ্নি হচ্ছে পরব্রহ্ম, মন্ত্র হচ্ছে প্রান, স্তোত্র হচ্ছে অপান, মন হচ্ছে অধ্বর্য্যু (অর্পিত বস্তু, ঘি ইত্যাদি), বুদ্ধি হচ্ছে উদগাতা, আর অহংকার হচ্ছে হোতা। সমস্ত কিছু ত্যাগ হচ্ছে এই যজ্ঞের দক্ষিণা। বিহিত কর্ম্ম, অর্থাৎ নিষ্কাম কর্ম্ম, শ্বাস-প্রশ্বাস হচ্ছে উপাসনা। একেই বলে আত্মক্রিয়া। আর এই আত্মক্রিয়া বা উপাসনা ব্যাতিত জ্ঞানলাভ সম্ভব নয়। আত্মা জন্ম-মৃত্যুর অতীত। এই আত্মক্রিয়া বা শ্বাসপ্রশ্বাস ক্রিয়া নিয়েই জীবের জন্ম। শ্বাস প্রশ্বাসক্রিয়া ভিন্ন জীবের অস্তিত্ত্ব বিপন্ন। আর এই প্রাণক্রিয়াকে অনুসরণ করেই জীব ব্রহ্মের অমৃতপদ লাভ করতে সক্ষম হয়। এই অমৃত-পদলাভই ক্রিয়ার উত্তম অবস্থা, কুরুসত্তম। এই প্রাণযজ্ঞের অনুষ্ঠানের দ্বারা সমস্ত মলের ক্ষয় হয়। আর এই মল হচ্ছে মনের চঞ্চলতা। মনের এই বিক্ষেপ বা চঞ্চলতা একমাত্র প্রাণায়াম যজ্ঞের দ্বারা বিনষ্ট হতে পারে। মনের এই বিক্ষেপমল দূরীভূত হ'লে, মনের যে স্থিরতা প্রাপ্ত হয়, তাকেই বলে যজ্ঞের অবশেষ। এই যজ্ঞফল ক্রিয়ার পরাবস্থা, অমৃতস্বরূপ পরম শান্তি। প্রাণক্রিয়াদি না করলে, যেমন জীবের নাশ হয়, তেমনি এই প্রাণক্রিয়ার অনুশীলনেই আত্মজ্যোতির সন্ধান মেলে। এই প্রাণ-মনের স্থিরতাই আমাদের শারীরিক মানসিক শান্তি। আমাদের যে দুঃখ, তার মুলে আছে, আমাদের চিত্তের চঞ্চলতা। তো স্থুল দেহ-মনের শান্তি যার আসেনি, অর্থাৎ যার ইহলোকের শান্তি আসেনি, তার পরলোকে শান্তি হবে, এমন কল্পনা না করাই ভালো। দেহাতীত কৈবল্যপদ সুদূর পরাহত।
এবং বহুবিধা যজ্ঞা বিততা ব্রহ্মণো মুখে
কর্ম্মজান বৃদ্ধি তান সর্বানেবং জ্ঞাত্বা বিমোক্ষ্যসে। (৪/৩২)
বহুপ্রকার যজ্ঞের কথা ব্রহ্মোক্ত বেদের দ্বারা বিহিত করা হয়েছে। সে সকল আসলে কর্ম্মোদ্ভব বলে জানবে। এইরূপ জেনে জ্ঞাতা মুক্ত হতে পারবে।
বেদবাক্যকে বলা হয় অপৌরুষেয়। বেদোক্ত যজ্ঞ সম্পাদন করলে, যজ্ঞেশ্বরের তৃপ্তি হতে পারে। কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞ গুরুমুখে যে সাধনক্রিয়ার উপদেশ প্রাপ্ত হওয়া যায়, এবং সেইমতো সাধনক্রিয়ায় প্রবৃত্ত হলে, সাধনক্রিয়ার উচ্চাবস্থায় আরোহন করা সম্ভব হয়। আসলে সব সাধনার চরম প্রাপ্তি হচ্ছে স্থিরতা। এই স্থিরতা প্রাপ্তি না হলে,জীবের মুক্তি ঘটে না। আর এই ব্রহ্মজ্ঞ গুরুদেবের নির্দেশ অনুযায়ী সাধন ক্রিয়ার ফলে চিদাকাশে বহুবিধ দর্শন, এবং নাদের শ্রবণ ঘটে থাকে। এর পরে, মূলাধারস্থিত প্রাণশক্তি যাকে যোগের ভাষায় বলা হয় কুণ্ডলিনী শক্তি, এই শক্তি মেরুপথে সুষুম্নার ভিতর দিয়ে আজ্ঞাচক্রে স্থিতি লাভ করলে, তবেই সেই কর্ম্মাতীত নিষ্ক্রিয় স্থিরপদ লাভ করা সম্ভব হয়। আবার নিষ্ক্রিয় হতে গেলে, কর্ম্মের সাহায্যেই সেখানে পৌঁছনো যায়। ক্রিয়া করতে করতে একসময় ক্রিয়ারহিত অবস্থায় স্থিত হওয়া যায়। কাল থেকে কর্ম্মের সৃষ্টি, আবার কালেই বিলুপ্তি। কাল কারুর বশে নয়, আমরা সবাই কালের বশে। আবার এই কাল একসময় মহাকালে বিলীন হয়ে যায়। এই অবস্থাই আসলে ক্রিয়ার পরাবস্থা। এইসময় কাল অর্থাৎ প্রাণশক্তি মহাকালের সঙ্গে এক হয়ে যায়। বিশ্বব্যাপক সেই বিরাট পুরুষ সকলের ভ্রূমধ্যে থেকে ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে আছেন .ইড়া ও পিঙ্গলা তার দুই পদ, যার উপরে তিনি স্বমহিমায় স্থিত। আর তাঁর তৃতীয় পদ হচ্ছে, সুষুম্না। এই সুষুম্নার মধ্যে যখন সমান বায়ুর প্রবেশ ঘটে, তখন সেই অমৃত্পদকে প্রাপ্ত হওয়া যায়। একেই পরম-ব্যোমে স্থিতি বলা হয়ে থাকে।
-----------------------------
০২.০৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/৩৩-৩৪
শ্রেয়ান দ্রব্যময়াদ্ যজ্ঞাজ্ জ্ঞানযজ্ঞঃ পরন্তপ
সর্ব্বং কর্ম্ম-অখিলং পার্থ জ্ঞানে পরিসমাপ্যতে। (৪/৩৩)
হে পরন্তপ, দ্রব্যযজ্ঞ থেকে জ্ঞানযজ্ঞ শ্রেষ্ঠ। হে পার্থ সমস্ত কর্ম্মই জ্ঞানে পরিসমাপ্ত হয়।
যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন অনিত্যবস্তুর দ্বারা দেবতাদের উদ্দেশ্যে যে যজ্ঞ করা হয়, তার থেকে জ্ঞানযজ্ঞ শ্রেষ্ট। আবার আমাদের যে সাধারণ জ্ঞান তা মনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু আত্মস্বরূপ যে জ্ঞান তার প্রকাশ ঘটে মনের বিলোপের সঙ্গে সঙ্গে। অর্থাৎ মনের পরিনাম স্বরূপ ব্রহ্মে স্থিত হলে তবেই প্রকৃত জ্ঞান অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞান জন্মে।
যোগের যে অঙ্গক্রিয়া, এগুলোর অনুষ্ঠান থেকে জ্ঞানযজ্ঞ অর্থাৎ উপল্বদ্ধিজাত যে ব্রহ্মজ্ঞান তা শ্রেষ্ঠ। যদিও যোগাঙ্গের অনুষ্ঠান করা কর্তব্য। কারন এগুলো না করলে, চিত্তের শুদ্ধাবস্থা আসে না। আর চিত্তের শুদ্ধি না হলে চিত্তের স্থিরতাও আসে না। প্রথম দিকে যোগ-অভ্যাসকারীর মনে নানান সকাম ভাবনা ব্যাপৃত থাকে। যোগের ফল কি হবে ? জ্যোতিদর্শন, নাদশ্রবণ, যা সে গুরুমুখে শুনেছে, তার একটা কামনা তার অস্থির চিত্তে উদ্ভব হতে থাকে। এইযে সাধকের মধ্যে সকাম অবস্থা একেই বলে দ্রব্যযজ্ঞ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাধনার অগ্রগতিতে সাধকের মন থেকে এইসব স্পৃহা বিনষ্ট হয়ে যায়। যতক্ষন এই সব স্পৃহা বলবতী থাকে, ততক্ষন যোগাগ্নিতে এই স্পৃহারূপ দ্রব্য আহুতি দিতে হয়। একেই দ্রব্যযজ্ঞ বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ সাধনার অগ্রগতিতে যতক্ষন ভোগবাসনা থাকে ততক্ষন জানবেন মনের নাশ হয়নি। এই যে জ্যোতিঃদর্শন, বা নাদধ্বনি শ্রবণ এগুলো আসলে মানসিক ক্রিয়া মাত্র। এই মানসিক ক্রিয়ার সমাপ্তি না হলে, শান্তি আসে না। স্থিরতা আসে না। অর্থাৎ মন তখনও ব্রহ্মে স্থিত হতে পারে নি। তো সাধকের উদ্দেশ্য হতে শান্তি, স্থিরতা। মন যখন ব্রহ্মে স্থিতি লাভ করে, তখন মনের মধ্যে আর কোনো বাসনার উদ্রেগ হয় না। সমস্ত বাসনার বিলুপ্তিতে, মনের ব্রহ্মে স্থির অবস্থায়, আনন্দ সমুদ্রে অবগাহনের তৃপ্তি অনুভব হয়। ক্রিয়ার পরাবস্থাতেই এই আনন্দ-সমুদ্রের সন্ধান মেলে।
শ্রীগুরুর নির্দেশে, শাস্ত্রসম্মত উপায়ে প্রাণ-সংযমের দ্বারা নাড়ীচক্র বিশুদ্ধ হলে, সুষুম্না নাড়ীর দ্বার খুলে যায়। আর তৎক্ষণাৎ উর্দ্ধমুখী প্রাণবায়ু সহজে সেখানে প্রবেশ করতে থাকে। আর এই সুষুম্নার মধ্যে প্রাণবায়ুর প্রবেশে প্রাণ সমান অর্থাৎ সাম্যাবস্থা প্রাপ্ত হয়। আর এই সুষুম্নাতে প্রাণের প্রবেশ ঘটলেই, প্রাণ-মনের স্থিরতা আসে।
এই স্থিরতা লাভের জন্যই সাধনক্রিয়ার অভ্যাস করতে হয়, অর্থাৎ প্রাণায়াম, (কুম্ভক) ওঙ্কারের ক্রিয়া, আবশ্যক। একেই তপস্যা বা তপযজ্ঞ করতে হয়। এইসময় শরীরের মধ্যে তাপের উৎপাদন হয়। এই তাপ-ই বায়ুকে শুদ্ধ করে, উর্দ্ধমুখী করে তোলে। আর এই তপস্যার ফলেই, সাধক তপঃলোকের বাসিন্দা হয়। অর্থাৎ আজ্ঞাচক্রে স্থিতি লাভ করে। এই আজ্ঞাচক্রে স্থিতি লাভ করতে পারলেই, স্ব-স্বরূপে স্থিতি লাভ হয়। একেই যোগসিদ্ধি বলা হয়। একেই যোগ-যজ্ঞ বলে। হৃদয় থেকে মস্তক পর্যন্ত প্রাণবায়ুর লীলাক্ষেত্র। এখানে ইড়ানাড়ী বাহিনী শক্তি। আবার নাভিমন্ডলে পিঙ্গলার সাহায্যে অপান বায়ুর সঞ্চরণ ক্ষেত্র। অপান বায়ু নিম্নগামী। এই উর্দ্ধগামী প্রাণবায়ু ও অধোগামী অপান বায়ুর সংঘর্ষে সমান বায়ুর ক্রিয়া শুরু হয়। আর সমান বায়ু স্থির। ইনিই সুষুম্নাবাহিনী। নাভিস্থল তিন বায়ুর অর্থাৎ প্রাণ-অপান-সমান বায়ুর মিলনক্ষেত্র। প্রাণ-অপানের গতি অর্থাৎ প্রাণের উর্দ্ধগতি ও অপানের নিম্নগতি যখন স্থিরতা প্রাপ্ত হয়, তখন অনুভবশক্তির একটা উচ্চ অবস্থা প্রাপ্ত হওয়া যায়। তখন একান্তে নিজেকে নিঃসঙ্গ করা সম্ভব হয়। আর এই একান্ত ভাব থেকেই সাধকের মধ্যে একটা নিস্পৃহ ভাব, একটা ইচ্ছেশূন্য ভাব বজায় থাকে। আর এই ইছারহিত অবস্থায় পরম-শান্তি লাভ হয়ে থাকে।
অর্থাৎ উর্দ্ধগতি সম্পন্ন প্রাণ বায়ু যখন প্রাণায়ামের সাহায্যে নিম্নগতিসম্পন্ন অপান বায়ুর সঙ্গে মিলিত হয়ে স্থিরতা প্রাপ্ত হবে অর্থাৎ সমানবায়ু রূপে স্থির হবে তখন মধ্যশক্তি অর্থাৎ সুষুম্নার মুখ খুলে, সুষুম্নার মধ্যে প্রবেশ করবে, তখন জ্ঞানের প্রকাশ ঘটবে। আর যাবতীয় কর্ম্মের সমাপ্তি ঘটবে। সাধক হবে, নিঃসঙ্গ, স্পৃহাশূন্য, ইচ্ছাশক্তিরহিত। একেই সাধনক্রিয়ার পরাবস্থা বা উত্তম অবস্থা বলা হয়ে থাকে। এই অবস্থা আয়ত্ত্ব করা অসম্ভব কিছুই নয়, তবে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ হয়ে নিরন্তর অভ্যাসসাধ্য।
তদ্বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া
উপদেক্ষ্যন্তি তে জ্ঞানং জ্ঞানিনঃ তত্ত্বদর্শিনঃ। (৪/৩৪)
প্রণিপাত, পরিপ্রশ্ন ও সেবার দ্বারা জ্ঞান লাভ হয়। সেই জ্ঞান শিক্ষা করো। তত্ত্বদর্শী জ্ঞানীগণ তোমাকে জ্ঞান উপদেশ দেবেন।
প্রণিপাত, পরিপ্রশ্ন ও সেবার দ্বারা গুরুদেবের কাছ থেকে প্রকৃত সত্যকে জ্ঞাত হওয়া যায়। প্রণিপাত অর্থাৎ আত্মসমর্পন। নিজের মধ্যে পর্বজ্ঞাত সমস্ত জ্ঞানকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে, গুরুর কাছে যেতে হয়। অর্জিত সমস্ত সংস্কারকে ত্যাগ করে, শুদ্ধ মনে গুরুদেবের কাছে আত্মসমর্পন করতে হয়। গুরুদেবের মুখে তত্ত্বজ্ঞান লাভের পরে, মনের মধ্যে কোনো সংশয় থাকলে, তা গুরুদেবকে খুলে বলতে হয়, একেই বলে পরিপ্রশ্ন। আমি যা আগে থেকে জানি, তার প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, গুরুদেব যা বলছেন, সেই জ্ঞানে নিজেকে প্রতিষ্টিত করবার জন্য, মনের মধ্যে প্রশ্ন তুলতে হয়। আমি আমাকে দেখতে পাই না। এই আমিকে, যিনি যথার্থ রূপে জেনেছেন, তার কাছ থেকেই জেনে নিতে হয়, আমি কে ? শিশু অবস্থায়, যেমন আমি মা-বাবার কাছ থেকে নিজের নাম-ধাম মুখস্ত করি, তেমনি গুরুদেবের কাছ থেকে প্রথমে নিজেকে অর্থাৎ "আমি"কে জেনে নিতে হয়। এর পর আমার উৎস কোথায়, আমি কোথা থেকে এসেছি, পরিণতিতে আমি আবার কোথায় চলে যাবো। সেই পথই বা কি, সেই সব জেনে নিতে হয়। আবার এখানে কেন আমি এসেছি, এখানে আমার কি কাজ, কি করা উচিত, আর কি করা উচিত নয়, সমস্ত কিছু সম্পর্কে জেনে নিতে হয়। আমি কেন এই মৃত্যুপুরীতে এলাম, এই মৃত্যুপুরী থেকে চিরতরে উদ্ধারের উপায় কি ? বিনয়পূর্বক বারবার এই প্রশ্নের সম্মুখীন করতে হয় নিজেকে। শুধু প্রশ্ন জাগলে হবে না, গুরুদেবকে সে প্রশ্নের সম্মুখীন করতে হবে। আর গুরুদেবকে আকৃষ্ট করবার জন্য, নিজের মধ্যে গুরুসেবার প্রবৃত্তি জাগ্রত করতে হবে। গুরুদেবকে আকর্ষণ করতে হবে। মা সন্তানকে দুগ্ধ দান করবার জন্য ব্যাকুল। কিন্তু সন্তানের মধ্যে দুগ্ধ পানের তৃষ্ণা, না জাগলে, সন্তানের মধ্যে দুধ হজমের গোলযোগ হতে পারে। তাই সন্তানের মধ্যে ব্যাকুলতা জাগলে, সন্তানের মধ্যে দুধ পানের জন্য আহ্বানের অর্থাৎ কান্নার প্রকাশ থাকা চাই। অর্থাৎ সাধকের মধ্যে সত্যিকারের আধ্যাত্মিক ক্ষুধার উদ্রেগ হওয়া চাই।
গুরুদেব, এই আত্মসমর্পিত, জিজ্ঞাসু, সেবাপরায়ণ, ব্যাকুল শিষ্যের কাছে, সমস্ত তত্ত্বজ্ঞানের ভান্ডার খুলে দেন। একটা জিনিস জানবেন, গুরু কোনো দেহধারী মানুষ নন। মনুষ্যদেহে ঐশী শক্তি মাত্র। তিনি যেন এই জগতের মানুষ নন। তিনি এক আশ্চর্য্য পুরুষ। এই কথা মন-প্রাণ দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে। তার সমস্ত কর্ম্ম ঈশ্বরের উদেশ্যে, আবার তার সমস্ত কর্ম্ম নিজের মধ্যে যে ঐশ্বরিক শক্তি বিরাজ করছেন, তাঁর উদ্দেশ্যে অর্পিত। এই গুরুদেব সমস্ত শাস্ত্রপারঙ্গম। যেন কোনো না কোনো কালে, তিনিই এই শাস্ত্রগ্রন্থের প্রণেতা। আবার তিনি ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ। তিনি সর্বদা ব্রহ্মে স্থিত। তিনি ব্রহ্মময়। তাই তিনি স্বয়ং ব্রহ্ম। তিনি শাস্ত্রজ্ঞানে রূঢ় পণ্ডিত, আবার ভগবৎ সেবায় সমর্পিত প্রাণ । এই গুরুদেবের চরণ বন্দনায়, শিষ্য যদি সার্থক হয়, তবে উপদেশলাভের পরে, গুরুর নির্দেশে নির্দ্বিধায় সাধনক্রিয়ায় মনোযোগ দিলে, একদিন এই শিষ্য গুরুময় হয়ে যান। গুরুদেব আর যথার্থ শিষ্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকেনা।
এই গুরুদেব শিষ্যের কাছে কিছুই চান না, আবার এই শিষ্যের কাছে গুরুদেবকে দেবার মতো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। গুরুদেবের কাছে যদি সমর্পিত হতে না পারা যায়, গুরুদেবের কাছে যেতে যদি সঙ্কোচ বোধ হয়, গুরুদেবকে প্রশ্ন করতে যদি দ্বিধা জাগে মনে, তবে বুঝতে হবে, সে শিষ্য হবার যোগ্য হয়ে উঠতে পারে নি, এবং তাকে আরো অপেক্ষা করতে হবে। তখন সৎসঙ্গ, সৎগ্রন্থপাঠ ইত্যাদির মধ্যে যে অমৃতবাণী আছে, তার মর্মার্থ উপলব্ধি করবার চেষ্টা করতে হবে। নিজেকে এই ভাবনায় ভাবান্বিত করে তুলতে হবে। এতে করে আমাদের চিত্ত ধীরে ধীরে নির্মল হবে। ধীর ধীরে আমরা শিষ্য হবার যোগ্য অধিকারী হয়ে উঠবো।
----------------------------
০৩.০৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/৩৫-৩৬
যজ্জ্ঞাত্বা ন পুনঃ-মোহং-এবং যাস্যসি পান্ডব
যেন ভুতানি-অশেষণ দ্রক্ষসি-আত্মনি-এথো ময়ি। (৪/৩৫)
হে পাণ্ডব যা জানলে, পুনরায় মোহপ্রাপ্ত হবে না, যা জ্ঞাত হলে, সর্বভূতে আত্মাতে ও আমাতে দর্শন করতে পারবে।
মুণ্ডক উপনিষদের শুরুতে শৌনক নামে একজন বিশিষ্ট গৃহীপুরুষ, ঋষি অঙ্গিরসের কাছে একটা চমৎকার প্রশ্ন করেছিলেন, বলছেন "প্রভু কি জানলে, কোন বস্তুকে জানলে, সবকিছু বিশেষ রূপে জানা যায় ?" (শ্লোক ১/১/০৩)
তো তার উত্তরে ঋষি অঙ্গিরস বললেন : জ্ঞান দুই প্রকার, একটা হচ্ছে পরমজ্ঞান, আর একটা হচ্ছে আপেক্ষিক জ্ঞান। একটা হচ্ছে পরাবিদ্যা আর একটা হচ্ছে অপরাবিদ্যা। একটা হচ্ছে ব্রহ্মজ্ঞান আর একটা হচ্ছে আপেক্ষিক জ্ঞান। একটা হচ্ছে বহুর জ্ঞান আর একটা হচ্ছে একের জ্ঞান। একটা হচ্ছে জাগতিক জ্ঞান আর একটা হচ্ছে আধ্যাত্মিক জ্ঞান। একটা হচ্ছে খন্ডের জ্ঞান, আরেকটা হচ্ছে অখণ্ডের জ্ঞান।
কথামৃতের লেখক শ্ৰীম (শ্রী মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত ) একবার ঠাকুর রামকৃষ্ণকে তার স্ত্রী (যিনি লেখাপড়া জানেন না) সম্পর্কে বলেছিলেন, আমার স্ত্রী এমনিতে ভালো, কিন্তু অজ্ঞান। তখন ঠাকুর বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, "তা সে অজ্ঞান আর তুমি বুঝি খুব জ্ঞানী ?" আসলে আমরা সবাই ভাবি, আমি লেখাপড়া শিখেছি, স্কুল-কলেজের ডিগ্রি অর্জন করে আমি জ্ঞানী হয়েছি। অনেক শাস্ত্র পাঠ করে, আমি জ্ঞানী হয়ে গেছি। কিন্তু সত্য হচ্ছে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করাই জ্ঞান। আর সব অজ্ঞান। আমি গীতা মুখস্ত করতে পারি, শ্রীগীতার শ্লোকগুলোকে নিয়ে নানান রকম ব্যাখ্যা করতেও পারি , কিন্তু যতক্ষন না আমি শ্রীগীতার বাণী অনুযায়ী কর্ম্ম করে সাফল্য অর্জন করছি, ততক্ষন আমি অজ্ঞান। শ্রীগীতার কোনো কথাই আমার বোধগম্য হয়নি।
যা জানলে অর্থাৎ ব্রহ্মকে জানলে, ব্রহ্মদর্শন হলে, জগৎদর্শন নিভে যাবে। আমি তুমি বোধ, বস্তুর বোধ, যাকে ভিন্ন ভিন্ন বোধ হচ্ছে, তা আর ভিন্ন মনে হবে না। সমস্ত অলঙ্কার সোনা দিয়ে তৈরী, সমস্ত মূর্তি পাথর বা মাটি দিয়ে তৈরী। লবন দিয়ে গড়া পুতুল সমুদ্রে মিশে জল হয়ে যায়। ভগবান বলছেন, আত্মস্বরূপের জ্ঞান হলে, তুমিও সেই পরমাত্মা থেকে যে অভিন্ন নও, সেই বোধ তোমার মধ্যে জেগে উঠবে। সমস্ত জীবকুলের কূটস্থে যিনি স্থির তার রূপেই সমস্ত বিশ্ব প্রতিভাত হচ্ছে, এই অভ্রান্ত জ্ঞান তোমার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হবে । বহু ভান্ডে বহু চন্দ্র-সূর্য প্রতিভাত হচ্ছে, ভান্ড ভেঙে গেলে দেখবে, সে একটাই সূর্য, একটাই চন্দ্র। এক বৈ দুই নেই। সমস্ত জীবকুলের দেহের যখন বিলোপ সাধন হবে, তখন তুমি কোথায় থাকবে ? যখন তোমার দেহাভিমান চলে যাবে, যখন সমস্ত উপাধি বর্জিত হতে পারবে, তখন কূটস্থ জ্যোতি সেই এক অসীম চিদাকাশের জ্যোতির মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে। তখন সর্বভূতে আপনাকেই দর্শন করবে। এই দর্শনই প্রকৃত জ্ঞান। এই জ্ঞানের উন্মেষ হলে আত্মার মধ্যে নিজেকে দর্শন করবে। আবার নিজের মধ্যে সমস্ত আত্মাকে দর্শন করবে। তখন তোমার সমস্ত মোহ অর্থাৎ আমি-তুমি জ্ঞানের বিলোপ সাধন হবে।
অপি চেদসি পাপেভ্যঃ সর্ব্বেভ্যঃ পাপকৃত্তমঃ
সর্ব্বং জ্ঞানপ্লবেন-এব বৃজিনং সন্তরীিষ্যসি। (৪/৩৬)
যদি তুমি সকল পাপী থেকেও বেশি পাপাচারী হও, তথাপি তুমি জ্ঞানরূপ নৌকার দ্বারা পাপসমুদ্র উত্তীর্ন হতে পারবে।
ব্রহ্ম থেকে বিচ্যুত হওয়াই পাপ। আবার ব্রহ্মে স্থিত হওয়াই পাপস্খলন। যে কাজ আত্মস্থিতি থেকে বিচ্যুত করে, তা সে ভালো মন্দ যাই হোক না কেন তা পাপ। এইজন্য মনের চঞ্চলতা জনিত যে চিন্তা তা সে ভালো মন্দ যাই হোক না কেন, তা মুমুক্ষু সাধকের জন্য পাপ কর্ম্ম। এখন কথা হচ্ছে চিন্তা মনের ধর্ম্ম। আর সমস্ত চিন্তা যদি পাপ হয়, তবে আমরা সেখানে থেকে বেরুবো কি করে ? তাই যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, কেউ যদি জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, অর্থাৎ সাধন ক্রিয়া করতে করতে বায়ুকে স্থির করতে পারে, আর বায়ুর স্থিরতা হেতু মনকে অচঞ্চল, করতে পারে, তখন মনের নিশ্চল ভাব সাধককে এক অন্য জগতে নিয়ে যেতে পারে। যতক্ষন আমাদের দেহজ্ঞান আছে, যতক্ষন ইন্দ্রিয় বহির্মুখী আছে, মনের মধ্যে সুখ-দুঃখের বুদ্বুদ উঠছে, ততক্ষন আমাদের পাপ-পুন্য দুইই আছে। স্বর্গ-নরক আছে। কিন্তু মন যখন অন্তর্মুখী হয়ে দেহাতীত হয়ে যায়, দেহের সঙ্গে সন্মন্ধহীন হয়ে যায়, তখন আর মনের মধ্যে পাপ-পুণ্যরূপ কোনো চিন্তার উদ্রেগ হতে পারে না।
প্রাণ যখন সুষুম্নাবাহিনী হয় তখন আজ্ঞাচক্রে নিশ্চল হয়ে যায়, তখন তাকে আর পাপ-পুন্য স্পর্শ করতে পারে না। সুতরাং পাপী বলো, আর পুণ্যবান বলো, কেউ যদি সাধনক্রিয়া করতে করতে অবিচল অবস্থা প্রাপ্ত হতে পারে, তবে তিনি পাপপুণ্যের উর্দ্ধে আত্মস্বরূপে স্থিত হতে পারেন। দেহে-ইন্দ্রিয়ে অবস্থানই পাপ। যিনি দেহাতীত তার পাপ-পুন্য বলে কিছু থাকে না। তার কাছে স্বর্গ-নরক বলেও কিছু থাকে না। তাই যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, তুমি জ্ঞানরূপ নৌকার দ্বারা পাপসমুদ্র উত্তীর্ন হতে পারবে। যার ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়েছে, তার কর্ম্মের বিলুপ্তি হয়েছে। একেই বলে প্রকৃতি থেকে পুরুষের মুক্তি।
-----------------------------------
০৪.০৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/৩৭-৩৯
.যথা-এধাংসি সমিদ্ধঃ-অগ্নি-ভস্মসাৎ কুরুতে অর্জ্জুন
জ্ঞানাগ্নিঃ সর্ব্বকর্ম্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে তথা। (৪/৩৭)
হে অর্জ্জুন, যেমন প্রদীপ্ত অগ্নি কাষ্ঠসমূহকে ভস্মীভূত করে, তেমনি জ্ঞানরূপ অগ্নি সকল প্রকার কর্ম্মকে ভস্মীভূত করে।
কর্ম্মের ফলেই এই শরীরের প্রাপ্তি হয়েছে। আবার প্রারব্ধ কর্ম্ম ফলদানে উন্মুখ হয়েছে। তো ভোগের দ্বারাই এই কর্ম্মফলের নিস্পত্তি সম্ভব। কিন্তু যে কর্ম্ম এখনো ফলদানে উন্মুখ হয় নি, তাকে জ্ঞানাগ্নির দ্বারা ভস্মীভূত করা সম্ভব। আমরা জানি কর্ম্ম তিন প্রকার এক - প্রারব্ধ কর্ম্ম। যে কর্ম্ম ফল দিতে শুরু করেছে। এই যে শরীর আমরা প্রাপ্ত হয়েছি, তা আমাদের প্রারব্ধ কর্ম্মের ফলস্বরূপ উৎপন্ন হয়েছে। দুই : ক্রিয়মান কর্ম্ম - এই শরীরে অবস্থানকালে, যে কর্ম্ম সম্পাদন করা হচ্ছে, বা ভবিষ্যতে করা হবে তাকে বলা হয় ক্রিয়মান কর্ম্ম। এখন এই ক্রিয়মান কর্ম্মের মধ্যে কিছু কর্ম্ম তাৎক্ষণিক ফল প্রদান করবে, এবং তা আমাদের এই জীবনেই ভোগ করতে হবে। তিন : এই ক্রিয়মান কর্ম্মের মধ্যে যেগুলো ফলভোগ অসমাপ্ত থাকবে, তাকে বলা হয় সঞ্চিত কর্ম্ম। সাধক যখন জ্ঞানী হন, তখন তার এই ক্রিয়মান কর্ম্ম ও সঞ্চিত কর্ম্ম কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। প্রারব্ধ কর্ম্মের ফল ভোগ তারা এই শরীরে থাকতেই ভোগ করে থাকেন। এইজন্য জ্ঞানী বলুন আর অজ্ঞানী বলুন, কেউ যখন দেহপ্রাপ্ত হয়েছে, জানবেন তার অবশ্যই প্রারব্ধ কর্ম্ম আছে, এবং সেই প্রারব্ধ কর্ম্ম ভোগ করবার জন্যই এই দেহ ধারণ করেছেন। জ্ঞানী আর অজ্ঞানীর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, অজ্ঞানীর কর্ম্মফল সঞ্চিত হতে পারে। কিন্তু জ্ঞানী কোনো কর্ম্মফল সঞ্চয় করেন না। ফলতঃ তিনি জন্ম-মৃত্যু রোহিত হতে পারেন । দেখুন যার গর্ভস্থলী বিনষ্ট হয়েছে, তার সন্তান উৎপাদন হতে পারে না। তেমনি জ্ঞানীর কর্ম্মস্থলী জ্ঞানের আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তার কর্ম্মফল সঞ্চিত হতে পারে না। কর্ম্মফলের স্পৃহাকে বলা হয় কর্ম্মস্থলী বা কর্ম্মাশয়। লিঙ্গশরীরের হৃদয়গ্রন্থিকে বলা হয় কর্ম্মাশয়। এই হৃদয়গ্রন্থি ভেদ করবার জন্য, সাধক সাধনক্রিয়া করে থাকেন। আমরা শুনেছি, আমাদের অজ্ঞানের মূল হচ্ছে, আমাদের দেহাভিমান। এই দেহাভিমান যখন থাকে না, তখন আমরা দেহকে ভুলে আত্মস্বরূপে স্থিত হতে পারি। সাধন ক্রিয়ার উচ্চ অবস্থায়, এই দেহাভিমান থাকে না। এর ফলে সমস্ত অজ্ঞানের নাশ ঘটে থাকে। আর অজ্ঞানই যেহেতু পাপের উদ্রেগ করে থাকে, তাই অজ্ঞানের নাশ হলে, সমস্ত পাপের নাশ হয়ে যায়।
তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, অগ্নি সর্বভুক। কাঠ হচ্ছে এই অগ্নির ইন্ধন। অগ্নি এই কাঠকে মুহূর্তে ভস্মিভূত করে ফেলে। আত্মজ্ঞানকে তুমি সেই মহাপাবক অগ্নিরূপে জানবে। আর এই জ্ঞানাগ্নি একবার অন্তরে প্রজ্বলিত হলে জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কাররূপ পাপ- কাষ্ঠ ভস্মিভূত হয়ে যায়।
ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে
তৎ স্বয়ং যোগসংসিদ্ধঃ কালেন-আত্মনি বিন্দতি। (৪/৩৮)
ইহলোকে জ্ঞানের ন্যায় শুদ্ধিকর আর কিছুই নেই। কালক্রমে কর্ম্মযোগসিদ্ধ পুরুষ আপনা থেকেই সেই জ্ঞানলাভ করে থাকেন।
বাহ্যজগতে বলুন আর অন্তর জগতে বলুন, জ্ঞানের মূল্য কারুর পক্ষেই অস্বীকার করা সম্ভব নয়। অজ্ঞানীও জ্ঞানীকে উপেক্ষা করতে পারে না। পড়াশুনা করলে জ্ঞান হয়, তীর্থ ভ্রমন করলে জ্ঞান হয়, শাস্ত্রের অধ্যায়ন করলে জ্ঞান হয়, নিয়মাদি পালন করলে জ্ঞান হয়। এগুলো সবই পার্থিব জ্ঞান। এই জ্ঞান আমাদের সাংসারিক জীবনে কাজে লাগে। কিন্তু এই জ্ঞান আসলে ভ্রম বৈ কিছু নয়। অনিত্যবস্তুর জ্ঞান অর্থাৎ অনিত্য বস্তুকে নিত্য বলে মনে হওয়া আসলে ভ্রম বৈ কিছু নয়। এগুলো সবই বিক্ষিপ্ত অশুদ্ধচিত্তের জ্ঞান। এই অনিত্যবস্তু যেমন স্থায়ী হয় না কোনোদিন, তেমনি এই পার্থিব বস্তুর জ্ঞান কোনো স্থায়ী জ্ঞান নয়।
প্রানায়ামাদির দ্বারা চিত্ত শুদ্ধ হলে, তবেই সত্যিকারের জ্ঞানের উদয় হতে পারে। ক্রিয়ার পরাবস্থায় যথার্থ জ্ঞানের উদয় হয়। এই জ্ঞান ধীরে ধীরে স্থায়ী হয়। দীর্ঘকাল সাধনক্রিয়ার অভ্যাস করতে করতে ক্রিয়ার অভ্যাস অনায়াসলভ্য হয়। কিন্তু প্রথমে এই অবস্থা লাভের জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। নিজেকে তৈরী করতে হবে। সাধনক্রিয়ার অভ্যাসের ফলে মন সংকল্প শূন্য হয়ে স্থিরাবস্থা প্রাপ্ত হবে। আর ঠিক তখনই ঘটবে আত্মসাক্ষাৎকার। এই আত্মসাক্ষাৎকারই জ্ঞান। প্রথম দিকে এই অবস্থা এক ঝলকের জন্য আসে। কিন্তু সাধনক্রিয়া নিরন্তর চলতে থাকলে, অর্থাৎ বারবার আত্মসাক্ষাৎকার একসময় স্থিরতা প্রাপ্ত হয়। তখন সংসারের যে মূলবীজ অর্থাৎ অজ্ঞান তা সমূলে বিনষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু সাধনক্রিয়া চালিয়ে যেতে হয়। কারন চিত্তের অশুদ্ধ অবস্থা অর্থাৎ আমি-আমার ভাব তখন যায় না। আমি দেখছি, এই ভাব তখনও যায় না। তাই মহাত্মাগণ বলে থাকেন, ঈশ্বরের সাধনায় শেষ বলে কিছু নেই। ঈশ্বরের শেষ বলে কিছু হয় না। মনের মধ্যে থেকে কামভাব কমতে কমতে একসময় মন পবিত্র হবে। শুদ্ধ থেকে শুদ্ধতর হবে। কামভাবের নিষ্পত্তিতে নিশ্চিতভাবে জ্ঞানানন্দময় অবস্থায় সাধককে স্থাপন করবে। তাই যোগাচার্য্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, কালক্রমে কর্ম্মযোগসিদ্ধ পুরুষ আপনা থেকেই পরম-জ্ঞান লাভ করে থাকেন।
শ্রদ্ধাবান-লভতে জ্ঞানম তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়
জ্ঞানম লব্ধা পরাং শান্তিম-অচিরেণ-অধিগচ্ছতি। (৪/৩৯)
শ্রদ্ধাবান অর্থাৎ আস্তিক্যবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি জ্ঞানলাভ করে থাকে। এরপরে ইন্দ্রিয়-সংযমে অধিকারী ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করে পারেন। আর জ্ঞান লাভ করে, অচিরেই পরম শান্তি প্রাপ্ত হন।
যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, জ্ঞানলাভের জন্য তিনটে গুনের সমাহার প্রয়োজন, শ্রদ্ধা, নিষ্ঠা ও ইন্দ্রিয়সংযম। সাধনক্রিয়ার জন্য প্রথমেই দরকার শ্রদ্ধা। যার শ্রদ্ধা বিশ্বাস নেই, তার পক্ষে সাধনক্রিয়ায় অগ্রসর হওয়ার প্রবৃত্তি জাগ্রত হতে পরে না। গুরু বলুন, আর ভগবান বলুন, এঁদের প্রতি যার শ্রদ্ধা জাগে নি, তার পক্ষে গুরুবাক্য বা ভগবানের অস্তিত্ত্বে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়। আর শুধু সাধন পথ নয়, যেকোনো কাজই শ্রদ্ধা, ও বিশুদ্ধ মন নিয়ে না করতে পারলে, সেই কাজে সাফল্য, বা সেই কাজের মান উন্নত হতে পারে না। মহাত্মাগণ বলে থাকে শ্রদ্ধাহীনের অন্ন পর্যন্ত ভোজন করতে নেই। শ্রদ্ধাই পারে, আমাদের অজ্ঞানের নাশ করতে। আর যার যে কাজে শ্রদ্ধা নেই, তার মধ্যে সেই কাজে নিষ্ঠা আসতে পারে না। অনেকসময় আমরা দেখি, সাধনক্রিয়া হয়তো করছি, গুরুবাক্যঃ অনুসারেই হয়তো সাধনক্রিয়া করছি, কিন্তু মনের মধ্যে একটা দন্দ্ব রয়ে গেছে। গুরুবাক্যে নিঃসন্দেহে হতে পারছি না। এক গুরু ছেড়ে আর-এক গুরুর সন্ধান করছি। এইভাবে পাঁচ জায়গায় ঘুরে, সময় নষ্ট করে, শেষ জীবনে খালি হাতে ফিরছি। এর কারনই হচ্ছে, আমার মধ্যে শ্রদ্ধা বোধ জাগ্রত হয়নি।
আমরা আচার্য্য শঙ্করের শিষ্য তোটকাচার্যের কথা শুনেছি। সবাই যখন এই আনন্দগিরিকে বোকা-হাবা বলে অগ্রাহ্য করতো, তখন আচার্য্ শঙ্কর বলতেন, গিরি কিছু বোঝেনা সত্য, কিন্তু সে অতি অভিনিবেশ ও শ্রদ্ধাসহকারে শোনে সব কিছু। এই গিরির মুখ থেকেই গুরুশিষ্য-সংবাদ নামক দ্বাদশ-অক্ষরী তোটক ছন্দে কবিতা বেরিয়েছিল। অদ্ভুত তার কাব্যগুন। কিন্তু তার চেয়ে অদ্ভুত তার আকুতি। সেই বোকাহাবা শ্রদ্ধাবান লিখছেন,
শিষ্য : জন্ম-মরন যে সমুদ্রের জল, সর্বদুঃখ যে সমুদ্রের মিন, হে ভগবন ! সেই ভবসমুদ্রে পতিত হয়ে, আমি দুঃখ ভোগ করছি। অনন্যগতি হয়ে, আমি তোমার শরণ নিলুম। কৃপাকরে শরণাগতকে উদ্ধ্বার করো. আমায় উপদেশ দান করো।
গুরু : বিষয়াশক্তি সর্ব দুঃখের কারণ। বিষয়াসক্তি জয় করে, এই মায়াময় দেহাত্মবুদ্ধি ত্যাগ করো এবং পরমাত্মপদে নিয়ত অনুরক্ত হও। হে তত্ত্বপিপাসু ! মোহজনিত ভ্রম পরিত্যাগ করো।
তো শ্রদ্ধাশীলের জ্ঞান ভগবান প্রদত্ত হয়ে থাকে। তবে একটা কথা বলি, শুধু শ্রদ্ধা নয়, আমাদের আলস্য ত্যাগ করতে হবে, আমাদের কর্ম্মে তৎপর হতে হবে। ইন্দ্রিয়ের সংযম থাকা চাই। সাধনক্রিয়ার প্রথমেই ইন্দ্রিয়সংযম শিক্ষা দেওয়া হয়। কেননা যার ইন্দ্রিয় সংযম নাই , তার মধ্যে আলস্য, কর্ম্ম বিমুখতা, এমনকি বিষয়স্পৃহা প্রবল থাকে। তাই ইন্দ্রিয়সংযম নাহলে জ্ঞানলাভ হয় না। তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, শ্রদ্ধা-তৎপরতা-ইন্দ্রিয়সংযম - এই তিনটি থাকলে তবেই যথার্থ জ্ঞানলাভ হয়। অর্থাৎ সাধনক্রিয়ায় সাফল্য আসে। আর সাধন ক্রিয়ায় সাফল্য মানেই অপার শান্তি, ও অসীম জ্ঞানসাগরে ডুব দেওয়া ।
-----------------------------------
০৫.০৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগঃ
শ্লোক নং ৪/৪০- ৪৩
অজ্ঞঃ অশ্রদ্দধানশ্চ সংশয়াত্মা বিনশ্যতি
ন্যায়ং লোকোঽস্তি ন পরো ন সুখং সংশয়াত্মনঃ। (৪/৪০)
অজ্ঞ, শ্রদ্ধাহীন, সংশয়ী ব্যক্তির বিনাশ হয়। এমন ব্যক্তির না আছে ইহলোক, না আছে পরলোক, না আছে সুখ।
অজ্ঞানী ব্যক্তির পদেপদে মৃত্যু। শ্রদ্ধাহীন ব্যক্তির মরন পায়ে-পায়ে ঘোরে। আর সংশয়ী ব্যক্তির প্রতিক্ষনে মৃত্যু।
তিন ধরনের মানুষ সাধনক্রিয়ার অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকে। একদল আছেন, যারা কিছু না বুঝে অভ্যাসের বসে কাজ করে। এরা হতে পারে নিরীহ, কিন্তু এরা গরু-ছাগলের মতো জীবন ধারণ করে। অভ্যাস বশে খায়, অভ্যাস বশে ঘুমায়, মৈথুন ক্রিয়া করে। এই হচ্ছে তাদের জীবন ধারা।
দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে, এরা হয়তো কিছু পুঁথিগত বিদ্যা আয়ত্ত্ব করেছে। এরা নিজেকে বোদ্ধা ভাবে। এরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, আবার ঈশ্বরের সন্ধানও করে না। নিজেকে পণ্ডিত ভাবার জন্য, এরা শাস্ত্র কথায়, গুরুবাক্যে শ্রদ্ধাহীন। এরা সাধনক্রিয়া সম্পর্কে শুনে থাকবে, কিন্তু সাধনক্রিয়ায় শ্রদ্ধাশীল না হবার জন্য, সাধনক্রিয়া সম্পর্কে বিমুখ হয়ে থাকে।
তৃতীয় প্রকার হচ্ছে সংশয়াত্মা। এদের সমস্ত কিছুতেই সন্দেহ। এরা কাউকে বিশ্বাস করে না। বরং সন্দেহপ্রবন হবার জন্য, এরা সমস্ত কাজের মধ্যে খারাপ দিকগুলো দেখতে পায়। আর সারাক্ষন নঞৰ্থক চিন্তা করে নিজেকে উদ্বিগ্ন করে। এরা এইভাবে শুধু নিজের জীবনে দুঃখ ডেকে আনে তাই নয়, এরা অন্যের জীবনকেও অতিষ্ট করে তোলে। ওরা মহাজনের বাক্যে সন্দেহ করে, এরা পরলোক সম্পর্কে সন্দিহান। এরা এমনকি নিজের স্ত্রী-সন্তান-আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধবদের দোষ খুঁজে বেড়ায়। এরা নিজেরা যেমন পশুবৎ, তেমনি এরা সবাইকেই পশু মনে করে। এরা নিজের থেকে অন্যকে পার্থক্য করতে পারে না। এরা গুরুকে ভাবে - উনিতো আমারই মতো খায়, ঘুমায়। আর লোক ঠকিয়ে খায়।
এই তিন ধরনের লোকই সাধন ক্রিয়া থেকে বিমুখ থাকে। এদের মধ্যে যারা অজ্ঞ, তারা অনেকসময় সহজসরল হয়। এমনকি এদের মধ্যে একটা অন্ধ ভক্তির লক্ষণ দেখা যায় । তাই ভাগ্যক্রমে, যদি এরা সৎগুরুর আশ্রয় বা কৃপা পায়, তবে এদের পরমগতি গুরুকৃপা থেকে হয়ে থাকে। তাই এদের সদ্গতি লাভ সুসাধ্য। অন্যদিকে শ্রদ্ধাহীনের গতিলাভ বহু শ্রম ও সময়সাপেক্ষ। কিন্তু সংশয়াত্মাক ব্যক্তির সদ্গতি হওয়া কখনোই সম্ভব নয়। সংশয়াত্মক ব্যক্তি পরলোক তো দূর থাকুন, ইহলোকেও সুখী হতে পারে না । কারন, সে কাউকেই বিশ্বাস করে না। আর এই অবিশ্বাসের কারনে সে সবসময় নঙ্গর্থক চিন্তা করতে থাকে। এরা সংসারের কাউকেই সন্দেহের উর্দ্ধে রাখতে পারে না। তাই এদের মধ্যে ভয় ভীতি, রাগ, দ্বেষ হিংসা - প্রভৃতি কুপ্রবৃত্তি সক্রিয় থাকে। এরা নিজেরাও অশান্তিতে জীবন কাটায়, আবার এদের পরিবার-পরিজনদের শান্তিতে থাকতে দেয় না। এরা যেহেতু পরলোকে বিশ্বাস করে না, তাই এদের ধর্ম্ম-কর্ম্মে মতি দেখা যায় না। তাই এরা শুধু পরলোকে ও ইহলোকে কষ্ট পায় তাই নয়, এরা এমনকি রাতের ঘুমে যখন স্বপ্নলোকে অবস্থান করে, তখনও এরা দুঃস্বপ্নে রাত কাটায়।
যোগ-সংন্যস্ত-কর্ম্মাণং জ্ঞান-সংচ্ছিন্ন-সংশয়ম
আত্মবন্তং ন কর্ম্মাণি নিবধ্নন্তী ধনঞ্জয়। (৪/৪১)
হে ধনঞ্জয় কর্ম্মসকল যোগ দ্বারা ভগবানে অর্পিত হয়েছে, জ্ঞান দ্বারা যার সমস্ত সংশয় ছিন্ন হয়েছে, এইরূপ আত্মজ্ঞ পুরুষকে কর্ম্মসমূহ আবদ্ধ করতে পারে না।
যতক্ষন দেহ আছে, ততক্ষন তার কর্ম্ম আছে। কর্ম্মহীন দেহ বলে কিছু হয় না। আর কিছু সে না করুন, শ্বাসক্রিয়া তাকে করতেই হয়। কিন্তু যোগীপুরুষ যখন সাধনক্রিয়ার সাহায্যে কর্ম্মাশয়ের নাশ ঘটায়, তখন তার সমস্ত কর্ম্ম ভগবৎ চরণে অর্পিত হয়। তখন তাঁর কাছে, ব্রহ্মভিন্ন সমস্ত কিছুর বিয়োগ সাধন হয়েছে। তার মধ্যে আর কোনো সংশয় অবশিষ্ট থাকে না। তার কাছে হ্যাঁ বা না বলে কিছু থাকে না। আসলে দেহাত্মবুদ্ধি থেকেই কর্ম্মকে আমার বলে মনে হয়। কিন্তু যখন যোগী দেহাত্মবুদ্ধির উর্দ্ধে উঠে যান, তখন তার দেহের কর্ম্ম থাকলেও, মনের কোনো কর্ম্ম থাকে না। কেননা মন তখন ব্রহ্মময় হয়ে গেছে। নিত্যতৃপ্তঃ এই নিঃসঙ্গ নিরাশ্রয় পরুষ সমস্ত কর্ম্মফলের উর্দ্ধে উঠে যান। তাই বলে কি তিনি খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ করেন না তা নয়, তবে তাঁর মধ্যে খাদ্যের জন্য বা পানীয়ের জন্য কোনো স্পৃহা থাকে না।
আসলে এই যে অবস্থা এটি সাধনক্রিয়ার সর্ব্বোচ অবস্থা। এই অবস্থা সাধক নিজেও প্রকাশ করতে পারেন না। ঠাকুর রামকৃষ্ণ কতবার চেষ্টা করেছেন, এই অবস্থার করা প্রকাশ করতে কিন্তু বলছেন, কে যেন তার মুখ চেপে দেয়। ভাষা দিয়ে এই অবস্থার বর্ণনা করা সম্ভব নয়। এঁদের না আছে, কর্ম্ম, না আছে কর্ম্মবন্ধন, না আছে এদের কোনো সংশয়। শিশু যখন মাতৃক্রোড়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাসে-কাঁদে, তখন সেই শিশু যে কি দেখে বা কি শোনে তা মা-ও বুঝতে পারে না। আত্মা বলে কিছু আছে কি নেই, ঈশ্বর বলে কিছু আছে কি নেই, এইসব প্রশ্ন তার মধ্যে জাগে না। তখন সমস্ত জগৎ ব্রহ্মময়। তিনি আত্মাতেই স্থিত। জগতের কাছে তার কিছু চাওয়া পাওয়া নেই। আমি আমার বলেও কিছু নেই। আছে শুধু আত্মবৃত্তি যা সংশয়ের অতীত।
তস্মাদ-জ্ঞান-সম্ভূতং হৃৎস্থং জ্ঞানাসিন-আত্মনঃ
ছিত্ত্বৈনং সংশয়ং যোগম-আতিষ্ঠ-উত্তিষ্ঠ। (৪/৪২)
হে ভারত, তোমার অন্তঃকরণস্থ অজ্ঞান জনিত সংশয়, সন্দেহ জ্ঞানরূপ অস্ত্রের দ্বারা ছিন্ন করে উত্থিত হও ও কর্ম্মযোগের আদর্শ অবলম্বন করো।
ব্রহ্মে স্থিত হলে, জন্ম-মৃত্যুর ভয় থাকে না। হৃদয়ের সমস্ত সংশয় দূর করে দাও। আত্মরূপ গুরুর কাছে আত্মসমর্পন করো। অন্তরের সমস্ত সংশয় দূর হয়ে যাক। সাধনক্রিয়ায় দৃঢ়তার সঙ্গে লেগে পড়ো। শ্রীগুরুর নির্দেশে নিরন্তর সাধনক্রিয়ার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দাও। নিজের মধ্যে যে ক্ষাত্রশক্তি আছে, তাকে জাগিয়ে তোলো। নিজ ধর্ম্ম পালন করো। একটা জিনিস জানবে, এই যে দেহ, এটি কর্ম্ম নিমিত্ত প্রাপ্ত হয়েছো। তুমি এই দেহের ধর্ম্ম পালন করো। কর্ম্মবিনা নিষ্কৃতি নেই। ক্ষত হতে ত্রাণ করাই তোমার ধর্ম্ম। আত্মজ্ঞান লাভের জন্য, দেহ-ইন্দ্রিয়াদির ধর্ম্মের সাথে যে উঠে-পড়ে লাগতে পারে, সেই যথার্থ ক্ষত্রিয়। কখনো কি ভেবে দেখছো, কত জন্ম-জন্মান্তর ধরে, তুমি এই মৃত্যুপুরীতে যাতায়াত করছো ? কখনও ভেবে দেখছো, তোমার জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কার তোমার মধ্যে কতো ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। দুর্লভ মনুষ্য দেহের আয়ু সীমিত। এই স্বল্পায়ু দুর্লভ মনুষ্য জীবনের প্রথম ও প্রাথমিক কাজই হচ্ছে, জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কারকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা। নতুন শুভ সংস্কারের জন্ম দেওয়া। বৃথা বাক্যব্যয় করে, সময় নষ্ট করো না। সময়ের কাজ সময়ে করো। সময় চলে গেলে, শরীরের সামর্থ চলে যাবে। যেটুকু সময় আছে, মোহের নিমজ্জ থেকে সেই অমূল্য সময়কে চলে যেতে দিও না। উঠে পড়ো, সাধনায় লেগে যাও। আর জানবে, এই সাধনক্রিয়াই তোমাকে তোমার স্ব-স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত করবে। তখন জীবন রহস্য তোমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। আত্মজ্ঞান লাভ করবে। তুমি কে, এই দেহ কি, কেন তুমি এই দেহের মধ্যে প্রবেশ করেছো, এখানে কি তোমার কর্তব্য - সব তোমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। তোমার সাথে দেহের কি সম্পর্ক, আর এই সম্পর্কই বা কেন হয়, সমস্ত প্রশ্নের উত্তর মিলে যাবে। তুমি সেই পরমপিতার সন্তান। তুমি সেই বিশ্বস্রষ্টার সর্ব্বোত্তম সৃষ্টি। নিজের সামর্থের প্রতি যেন তোমার কোনো সংশয় না আসে। তুমি ঈশ্বরের অংশ, তুমি স্বয়ং ঈশ্বর, তোমার ক্ষমতা অসীম। তোমার মধ্যে সেই আদি-অনাদি পুরুষের লীলা চলছে। একবার জেগে উঠে দেখো, সেই লীলা রহস্যঃ। এই লীলাকে বুঝবার চেষ্টা করো।
গুরুবাক্যের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, গুরুর নির্দেশে সাধনক্রিয়ায় অংশ নাও। এই সাধনক্রিয়া একসময় তোমার মধ্যে জ্ঞানের আলো প্রজ্বলিত করে দেবে। আর এই আলোরমধ্যে প্রবেশ করে, তুমি স্থির হয়ে যাবে। সমস্ত দ্বিধা, সমস্ত অনৈক্য দূর হয়ে যাবে। জগতে এক ভিন্ন দুই বলে কিছু থাকবে না। সব সংশয় দূর করে, সমস্ত দুর্বলতা দূর করে, এগিয়ে যাও। চেষ্টা বা যুদ্ধ করা তোমার কর্তব্য। সংসারের বন্ধন ছিন্ন করে, মায়া, মোহ, ত্যাগ করে, নিজের কর্তব্যে দৃঢ় হও। সাধনক্রিয়া ভিন্ন গতি নেই। সুখ-দুঃখ সমজ্ঞান করে, ঈশ্বরের প্রতি আত্মসমর্পনের মাধ্যমে নিষ্কাম কর্ম্মে লিপ্ত হওয়াই কর্ম্মযোগ। এই জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হয়ে, স্থিরচিত্ত হয়ে, বুদ্ধিকে স্থির করে কর্ম্মে তৎপর হও। সাধনক্রিয়া করো। এতেই জ্ঞান, এতেই মুক্তি।
ইতি - শ্রীমদ্ভগবৎ গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণ-অর্জ্জুন-সংবাদে জ্ঞানযোগো নাম চতুর্থ-অধ্যায়ঃ।সমাপ্ত হলো - শ্রী ভগবান উক্ত শ্রীগীতা নামক উপনিষদ-রূপ যোগশাস্ত্রের চতুর্থ অধ্যায় শ্রীকৃষ্ণ-অর্জ্জুন সংবাদে জ্ঞানযোগ।
------------------------------
No comments:
Post a Comment