গুরুর খোঁজে শ্রীশ্রী বিজয় গোস্বামী। (সূত্র : শ্রীশ্রী বিজয় ভাগবত - শ্রী মহেশ চন্দ্র দে সরকার) আমরা লক্ষ করছি, কিছু মানুষ কিছু শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ করে, বা বই পড়ে, কবিগানের আসরে কবির নাটুকে কথা শুনে, আবেগভরা গান শুনে, বা ধর্ম্মসভায় স্বামীজীর বক্তৃতা শুনে আমাদের মনে লেখকের বা বক্তার জ্ঞানের বহর সন্মন্ধে এক বিস্ময় জাগায়। কেউ কেউ আবার ইউটুবের মধ্যে বক্তার জ্ঞানগর্ভ কথা শুনে তাকে গুরুদেব হিসেবে পাবার জন্য, আবেদন করে বসেন। এই ধরনের বিভ্রান্তিকর উৎসাহ আমাদের মানসিক দুর্বলতার লক্ষণ। অথবা বলা যেতে পারে, সহজেই একজন আশ্রয়দাতার আশ্রয়ে যাবার জন্য, বা জীবন পথকে সহজ সরল করবার জন্য কিছু আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা। আসলে আমরা সবাই সমস্যা জর্জরিত। আর একটা কথা শুনুন, যাদের কথা শুনে আপনি সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন, তারা নিজেরাও সমস্যার বাইরে নয়। বরং তাদের মধ্যে সমস্যার গভীরতা অনেক বেশী। তত্ত্বকথা বলা সহজ। কিন্তু সমস্যাহীন জীবন প্রাপ্তি সহজ নয়। সমস্যাহীন জীবন বলে কিছু হয় না। সমস্যা ও সমস্যার সমাধানের মধ্যে দিয়ে মানুষ নিজেকে উন্নত করছে। দুঃখ থেকে নিবৃত্তি নয়, দুঃখ সহ্য করবার ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। দুঃখ মানুষকে তার প্রারব্ধ ভোগ সমাপ্ত করতে সাহায্য করে থাকে। আর সমস্ত মহাপুরুষকেও তার প্রারব্ধ কারনম্ভোগ সমাপ্ত করতে হয়। দুঃখ থেকে কোনো গুরুদেব-তো দূরে থাকুক, স্বয়ং ভগবানও আমাদের রেহাই দিতে পারবেন না। তাই যদি হতো, তবে মহামতি ভীষ্ম বলতেন না, যে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যাদের সহায়, তাদের এতো বঞ্চনা, বিড়ম্বনা, দুঃখ-কষ্ট কেন ? ঠাকুর রামকৃষ্ণের সন্তানসম স্বামী বিবেকানন্দ একটা চাকুরীর আশায়, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন না। আসলে, সুখে দুঃখে নিজেকে নির্লিপ্ত থাকবার শিক্ষা দিয়ে থাকে মহাজনগন। আমরা এই পথকে এড়িয়ে যেতে চাই, ফলত আমাদের দুঃখ বাড়ে।
জন্ম জন্মান্তরের সাধক ছিলেন, বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী। প্রভু অদ্বৈত গোস্বামীর বংশে তার জন্ম। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, গুরুবংশেই তার স্থুলদেহের প্রাপ্তি। ইনি ঈশ্বরলাভের তীব্র লালসা পোষণ করতেন। আর এই উদ্দেশ্যে, নানান সম্প্রদায়ের সাথে মিশতেন। এ-নিয়ে লোকে নানান কথা বলতেন। ঠাকুর রামকৃষ্ণ একবার তাকে বলেছিলেন, যে ভগবানের ভক্ত, তার কূটস্থ বুদ্ধি হওয়া চাই। সব সহ্য করবে। খেয়াল করবেন, কূটস্থ বুদ্ধি হওয়া চাই। অর্থাৎ দেহস্থিত পরমপুরুষের জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
একবার গোস্বামিজী মনের অস্থিরতা নিয়ে, মির্জাপুর স্ট্রিটে এক সাধুকে প্রণাম করলে, সাধু তাকে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। সাধুর এই করস্পর্শে, গোস্বামিজীর দেহমন শীতল হয়ে গেলো। মাথায় যেন কেউ শীতল বরফ ঢেলে দিলেন। মনে মনে ভাবলেন, স্পর্শের এমন শক্তি ? তো এই সাধুকে একদিন গোস্বামিজী জিজ্ঞেস করলেন, ধর্ম্মের কথা মুখে তো বলি, কিন্তু প্রাণের অশান্তি দুর হয় না কেন ? তো সাধু বললেন, আপন গুরুকো পুছো ? নিজের গুরুকে জিজ্ঞেস করো। এইসময় গোস্বামিজী ব্রাহ্ম সমাজ ভুক্ত। এঁরা গুরু মানেন না। গোস্বামীজীও গুরুবাদে বিশ্বাস করতেন না। তাই বললেন, "আমরা গুরু মানিনা। " সাধু গম্ভীর হয়ে বললেন, "ইছি ওয়াস্তে সব বিগার যাতা।" এইজন্যই সব বিগড়ে যাচ্ছে। এই সহজ অথচ দৃঢ় তেজস্বী সত্যবাক্যে গোস্বামীর অন্তরে তোলপাড় শুরু হলো। সাধু বললেন, "আসমানমে ইমারত বানানে কোই নাহি শক্তা, তুমকো গুরু করনে হোগা।" আকাশে কেউ ইমারত বানাতে পারে না। তোমাকে গুরু করতে হবে। গুরুবাদে অবিস্বাসী গোস্বামিজীর অন্তরে তোলপাড় শুরু হলো। তো একদিন, এই সাধুকেই গুরুপদে বরণ করতে চাইলেন। কিন্তু সাধু বললেন, আমি তোমার গুরু নোই, অন্য কেউ, সময় হলে গুরু মিলবে। ঘাবড়িও না। গোস্বামিজী পরবর্তীতে বলছেন, বিশ্বাসে অনেকদূর এগুনো যায়, কিন্তু শেষে শক্তির প্রয়োজন। তখন এই শক্তির জন্য, অন্যের কাছে যেতেই হবে। গোস্বামিজীর মধ্যে কোনো অন্ধ বিশ্বাস ছিল না। অনুমানের মধ্যে যে জ্ঞান তাতে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না. তিনি অনুভূতি লব্ধ জ্ঞানের জন্য লালায়িত ছিলেন।
এইসময় থেকে গোস্বামিজীর অন্তরে একটা তীব্র অভাব-বোধ জাগ্রত হলো। মনে হলো কাণ্ডারিবিহীন জীর্ন জীবন তরীর মধ্যে বসে আছেন তিনি। গুরুর খোঁজে মনের মধ্যে তীব্র ব্যাকলুতা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে চললো। আর যে পুরুষকার তার মধ্যে জাগ্রত ছিলো, সেই পুরুষকারের উপরে ভর করেই, তিনি গুরুর সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন।
সাধু বলেছিলেন, সময় হলে গুরুর সাক্ষাৎ মিলবে। এই আপ্তবাক্যে বিশ্বাস করে, নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকবার পাত্র গোস্বামীজী ছিলেন না। কিন্তু সময় না হলে যে সত্যিকারের সৎগুরুর সাক্ষাৎ মেলে না, এই রূঢ় সত্য বুঝতে তাঁর বহু নগর, প্রান্তর, গিরিকেন্দ্র, গহন কানন, হিমালয়ের পাদদেশ থেকে শুরু করে পর্ব্বতের গিরিশিখা ঘুরে পথের কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল।
যেখানেই কোনো মহাত্মা সাধুপুরুষের খবর মেলে, সেখানেই গোস্বামিজী ব্যাকলুতা নিয়ে ছুঁটে যান।
১) গুরু আসলে আমাদের ভিতরেই প্রথমে প্রকট হন। আমরা তার আগমন বুঝতে পারি না, আমরা তাঁর ডাক শুনতে পাই না । আমরা তার ধ্বনিকে (বাঁশির সুরকে) অগ্রাহ্য করি। তো বিজয় গোস্বামী শুনতে পেলেন, বিন্ধ্যাচলে ঘন জঙ্গলে এক সাধু আছেন। আর এই কথা শোনা মাত্র, তাঁর সন্ধানে চললেন, বিন্ধ্যাচলে নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে। তো খুঁজতে খুঁজতে একদিন বিকেল বেলা, সেখানে গিয়ে পৌঁছলেন। সেখানে গিয়ে সাধুসঙ্গ করলেন। সন্ধ্যা হয়ে গেলো। সাধু তাকে আশ্রমে থেকে যেতে বললেন। এদিকে বাঙালী সাধু এসেছে, তা আবার কলকাতা থেকে এসেছে। নিশ্চয়ই তার কাছে অনেক টাকা পয়সা আছে ভেবে, দুস্টু প্রকৃতির একদল লোক গভীর রাতে আশ্রমে ঢুকতে উদ্যোগী হলো। আশ্রমে ঢুকতে গিয়ে দেখে প্রবেশ দ্বারে একটা বাঘ বসে আছে। পিছন দিক দিয়ে ঢুকতে গিয়েও দেখে আরো একটা বাঘ। হঠাৎ ঝড় বৃষ্টি শুরু হলো, সঙ্গে বজ্রপাত। দুস্যুদের সর্দার সেই বজ্রের আঘাতে মারা গেলো। অন্যরা ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলো। এখন আশ্রমে ভোরবেলা শুরু হয় সাধন-ভজন। তো ভোরের জ্যোৎস্নায় গোসাঁইজী মন্দিরদ্বারে আসতেই, কয়েকজন তার পায়ে পড়লো। গোসাঁইজী তো হতচকিত হলেন। তাদের কাছে, গোসাঁইজী বাঘের গল্প কথা শুনলেন, ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রপাতের কথা শুনলেন,যার বিন্দু বিসর্গ তিনি রাতের বেলা টের পান নি। কে এই রক্ষক ? এর উত্তর পাওয়া মুশকিল। আমাদের কাছে, এই প্রশ্নের উত্তর অজ্ঞাত।
২. বাংলার দার্জিলিং পাহাড়ের নির্জন স্থানে রাত্রিতে একা-একা ভ্রমন কালে গোসাঁইজী লক্ষ করলেন, একজন ধ্যানমগ্ন যোগীর মাথা থেকে একটা শুভ্র আলোক-জ্যোতি বিকিরিত হচ্ছে। গোসাঁইজী বিস্ময়ের সঙ্গে পর্যবেক্ষন করতে লাগলেন। একসময় যোগীপুরুষের ধ্যান ভাঙলে দেখলেন, জ্যোতি মিলিয়ে গেছে। গোসাঁইজী জ্যোতিপুরুষের কাছে, এই জ্যোতির উৎস জানতে চাইলেন। যোগীপুরুষ বললেন, কুণ্ডলিনী শক্তি জাগ্রত হয়ে, ষট-চক্র ভেদ করে সহস্রারে পৌঁছুলে এমন জ্যোতির ঘনীভূত অবস্থা দৃশ্যমান হয়। যোগীর মধ্যে এই অলৌকিক শক্তি দেখে, গোসাঁইজী তার কাছেই দীক্ষা নিতে চাইলেন। কিন্তু সত্য হচ্ছে, সত্যিকারের দীক্ষা নির্দিষ্ট গুরুর কাছেই হতে পারে। যোগীরাজ বললেন, তোমাকে দীক্ষা দেবার অধিকার আমার নেই। তোমার গুরুদেব নর্মদার তটে অবস্থান করছেন। ঠিকানাও দিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বলে দিলেন - দেখো তোমার গুরু আমি নোই। তোমার গুরুদেব সময়ের অপেক্ষা করছেন। সময় হলে, তিনি নিজে থেকেই তোমাকে দীক্ষা দেবেন। গুরু পাবার জন্য নিজেকে চঞ্চল কোরো না । কিন্তু পুরুষকারে যার বিশ্বাস, তিনি কি চুপচাপ বসে, সময়ের অপেক্ষা করতে পারেন ! তার মন ব্যাকুল, চিত্ত অস্থির। তার পূর্বপূর্ব জীবনের সংস্কার তাকে গুরুসন্ধানে ঘরছাড়া করে ফেলে । অতিষ্ঠ করে তোলে।
৩. গুরুর সন্ধানে গোসাঁইজী হিমালয়ের শিখরে বরফে ঢাকা দুর্গম রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে একদিন তার শরীর ঠান্ডা বরফ হয়ে গেলো। শরীরে প্রাণবায়ু ধুক ধুক করতে লাগলো। মৃত্যু হয়তো আসন্ন। নির্জন জনমানবহীন এই পাহাড়ের পথে কোনো সাথী নেই, যে সাহায্য করবে। ক্ষুধা -তৃষ্ণা আর বরফের পাহাড়ের হিমশীতল বাতাস তাকে জীবনের প্রান্তে নিয়ে মুহ্যমান করে দিলো। মৃত্যুর সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দিলো। কিন্তু রাখে হরি, মারে কে ? গোসাঁইজীর এই স্থুল দেহে যে এখনো অনেক কাজ করতে হবে। কোথেকে হঠাৎ এক সাধুর উদয় হলো। তিনি আগুন জ্বেলে, গরম সেঁক দিয়ে গোসাঁইজীর প্রাণ রক্ষা করলেন।
৪. আরো একদিন, একই অবস্থার সম্মুখীন হলেন। এবারেও শরীর ঠান্ডায় জমে বরফের চাই হয়ে গেলো।আসলে গুরুর সন্ধানে, গোসাঁইজীর বাহ্য জ্ঞান লোপ পেয়ে যেত। উন্মাদের মতো যত্রতত্র ঘোরাফেরা করতেন। বিশেষ করে, পাহাড়ের কোনে কোনে, দুর্গম অঞ্চলে হয়তো গুরুদেবের সন্ধান পেতে পারেন, এই আশায় প্রাণের মায়া ত্যাগ করে ছুটে যেতেন। এদিন তার বাহ্য জ্ঞান লোপ পেয়ে গেলো। যখন চেতনা পেলেন, দেখা গেলো, এক লামা যোগীর কোলে শুয়ে আছেন। লামা যোগী তাকে জিজ্ঞেস করলেন, বাচ্চা - এইভাবে ঘুরছো কেন ? ঘাবড়িও না, একদিন তোমার মনোবাঞ্চনা পূরণ হবে। গোসাঁইজী উঠে লামাযোগীকে প্রণাম করলেন। লামাযোগী কিসব প্রক্রিয়া করলেন, তাতে গোসাঁইজীর এক অদ্ভুত দর্শন হলো। শরীর যেন কাঁচের মতো স্বচ্ছ হয়ে গেলো। শরীরের মধ্যে মেরুদন্ড স্থিত সমস্ত চক্র যেন খুলে গেলো। সমস্ত চক্রের অধিষ্ঠাতৃদেব-দেবীগন দৃশ্যমান হয়ে উঠলো। গোসাঁইজী আপ্লুত হলেন। এই অলৌকিক পরিবর্তনে তিনি বিস্মিত হলেন। আর লামাযোগীর কাছে দীক্ষা প্রার্থনা করলেন। কিন্তু হায়, এবারও সেই একই ধ্বনি শুনতো হলো তাঁকে। "আমি তোমার গুরু নোই। গুরু তোমার পিছু পিছু আছেন, তোমার দীক্ষার প্রতীক্ষা করছেন।
৫. এখানে লামাদের কাছে শুনলেন, উত্তুঙ্গ শৃঙ্গের উপরে আছে, এক বাঙালি সাধু। মন আবার নেচে উঠলো। এই সাধু নাকি দিন-রাত সমাধিতে মগ্ন থাকেন। এই বাঙালি সাধুর দর্শন পাবার আশায়, দুই দিন-দুই রাত্রি অনাহারে থেকে চড়াই-উৎরাই করতে করতে ক্ষুধা তৃষ্ণায় ক্লান্ত হয়ে, পাহাড়ি রাস্তায় পড়ে ছিলেন। সাধুর ডেরায় পৌঁছাতে পারেন নি । এইসময় তার কথা বলবার শক্তি ছিল না। চেতনা লুপ্তপ্রায় হয়ে গিয়েছিলো। তো উলঙ্গ এক পর্বতবাসী এইসময় তাকে সুস্থ করে তোলেন। এবং ক্ষুধা তৃষ্ণা থেকে রেহাই পাবার জন্য, একধরনের শস্যদানা দিয়ে ছিলেন। এই শস্যদানা থেকে ২/৩ টুকরো খেতেই গোসাঁইজীর ক্ষুধা-তৃষ্ণা দূর হয়ে যায়। শরীর স্বাভাবিক বোধ হয়। এবার ধীরে ধীরে তিনি বাঙালি সাধুর কাছে পৌঁছুলেন। এই বাঙালি সাধু উন্মুক্ত আকাশের নিচে, অনাবৃত অবস্থায় ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকেন। রাতের বেলা তার সমস্ত স্থুল শরীর বরফের চাদরে ঢেকে যায়। দিনের বেলায়, সূর্য্যের উত্তাপে আবার শরীর অনাবৃত হয়ে যায়। কাছেই গুহার মধ্যে বাস করেন, তার শিষ্যগণ। সকালে তারা এসে শরীরে উত্তাপ দিয়ে, মুখে গরম চা দিয়ে, তাকে স্বাভাবিক করে তোলেন। এই বাঙালি মহাত্মা গোসাঁইজীকে বলেছিলেন, সত্যরক্ষা করো, বীর্য-ধারণ করো। ভগবান একমাত্র সত্য। মস্তিষ্কের সমস্ত শক্তি দিয়ে ভগবত চিন্তা করো। আর জানবে, ভগবৎ চিন্তাই মানুষের মস্তিষ্কের শক্তিকে বৃদ্ধি করতে পারে। এখানেও গোসাঁইজী দেহধারী গুরুলাভের ইচ্ছেপূরণ হলো না।
আসলে আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ভগবৎ লাভ। গুরুলাভের চিন্তা করে সময় নষ্ট না করে, নিজেকে ভগবৎচিন্তায় মগ্ন করে রাখা উচিত । সত্যি কথা বলতে কি, আমরা কেউ দারোয়ানের সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই না। আমরা গৃহস্বামীর সাথে দেখা করতে চাই । ভগবানের সাথে দেখা করতে চাই। দারোয়ান আমাদের হাত ধরে সেখানে নিয়ে যান । তো ভগবান যখন আমাকে দেখা দিতে চাইবেন, তখন ভগবানের নির্দেশে দারোয়ান এসে আমাকে ভগবানের কাছে নিয়ে যাবেন। আমার কথায় দারোয়ান আমাকে ভগবানের সাক্ষাৎ করাতে নিতে পারেন না। যখন, ভগবান আমাকে ডেকে পাঠান, তখন দারোয়ান, আমাকে পথ দেখিয়ে সেখান পৌঁছে দেন।
গুরুকরণের মধ্যে একটা রহস্যঃ নিহিত আছে। নিয়তির হাত আছে। আর আছে আমার কর্ম্ম, আমার চিন্তা, আমার আকুলতা। গুরুসঙ্গ পেতে গিয়ে সময় নষ্ট না করে, সাধুসঙ্গ করুন। সাধু সঙ্গ করতে করতে একসময় আমাদের চিত্ত নির্মল হবে। আমাদের পুরুষকার আত্মশক্তিতে ভরপুর। প্রথম দিকে পুরুষকার আমাদের সাহায্য করতে পারে। কিন্তু নিয়তি দৈবশক্তিতে ভরপুর। তাই দৈব বা সময়ের উপরে আমাদের নির্ভর করতে হবে, যদি আমাদের সৎগুরুর সাক্ষাৎ পেতে হয়।
চলবে। .......
ওঁং গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণু গুরুদেব মহেশ্বরঃ
গুরুরেব পরম ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রী গুরুবে নমঃ।
গুরু হচ্ছেন স্বয়ং ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। সৃষ্টি-স্থিতি-লয়-এর কর্তা হচ্ছেন স্বয়ং গুরুদেব। তো এঁকে খুঁজে পাওয়া যাবে, এমন শিষ্য কোটিতে মাত্র গুটি। এখন কথা হচ্ছে তাহলে কি আমাদের গুরু খুঁজে লাভ নেই ?
ঠাকুর রামকৃষ্ণ মন্দিরের বারান্দা দিয়ে পায়চারি করছেন। মথুরবাবু, একপাশে দাঁড়িয়ে দেখছেন। মথুরবাবু দেখছেন, যাচ্ছেন মাকালী, আসছেন শ্রীকৃষ্ণ। মথুরবাবু চোখ কচলে বোঝার চেষ্টা করলেন, তার দৃষ্টিভ্রম কি না। ঠাকুর বললেন, কী দেখছো ? মথুরবাবু, কোনো কথা না বলে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন। এগুলো আমাদের কাছে গল্পের মতো।
এখন কথা হচ্ছে, মথুরবাবু দেখলেন, না মথুরবাবুকে ঠাকুর দেখালেন, এই তত্ত্বটা বুঝতে হবে। আসলে তুমি যা তাই তুমি দেখতে পাবে, গুরুদেবের মধ্যে। গুরুদেব হচ্ছেন স্বচ্ছ আয়না। চোখ নিজেকে দেখতে পায় না। কিন্তু চোখ সবাইকে দেখে। আমার আপনার ভিতরে আছেন, সেই পরমপুরুষ, আমরা তাকে দেখতে পাই না। উপল্বদ্ধিও করি না। কিন্তু আমাদের সামনে যদি একটি স্বচ্ছ যায়না থাকে, তবে আমরা আমাদের চোখ দুটোকে দেখতে পাই। আমাদের সামনে যদি একজন শুদ্ধ-বুদ্ধ-নিত্য-মুক্ত আত্মা এসে দাঁড়ান তবে তার মধ্যে আমরা স্বয়ং ঈশ্বরকেই দেখতে পাই। এই ঈশ্বর আমার আপনার মধ্যেই আছেন, কিন্তু দেখতে পাই না। কিন্তু সামনে মুক্তপুরুষ এসে দাঁড়ালে আমাদের সব কিছু পাল্টে যায়। যেন আমি-আমার মৃত্যু ঘটে যায়। আমরা তখন এক বিরাট নিত্যপুরুষের সামনে চলে আসি। আর চোখ কচলাই, ঠিক দেখছি তো ? আর এই চোখ কচলানোর পরেই, শ্রদ্ধায় মাথা নিচু হয়ে আসে। আর আমরা গুরুদেবের যথার্থ মূর্তি - যা আসলে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর তার দর্শন পেয়ে ধন্য হই।
আর এই কারণেই আমি বলছিলাম, আমরা তো গুরুদেবকে খুঁজি না, আমরা দ্বার-রক্ষক খুঁজি, আমরা পান্ডা খুঁজি। আমরা একজন সেভিয়ার খুঁজি। এই দ্বার-রক্ষক বা মন্দিরের পান্ডা আমাকে অন্ধকার ঘরে, টিমটিমে আলোতে ঈশ্বরের মূর্তির কাছে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু ঈশ্বরের কাছে নিয়ে যেতে পারেন না। আর চৈতন্যদেবের কোনো পান্ডার দরকার পড়ে না, তিনি সরাসরি মন্দিরের গর্ভকক্ষে ঢুকে যান।
পুরীর মন্দিরে, বাবা তারকেশ্বরের মন্দিরে, কালীঘাটের মন্দিরে, এমনকি ভারতের বেশিরভাগ বিখ্যাত মন্দিরে দেবতাকে ঘিরে রেখেছে, সব পান্ডার দল। এই পান্ডার সাহায্য পেলে আপনি ঈশ্বরের মূর্তির কাছে পৌঁছতে পারবেন। ভগবানের কাছে নয়। এই সত্য আপনাকে বুঝতে হবে। একলব্যের মতো নিজের গুরুকে মনের মধ্যে আঁকুন। আপনিও একদিন গুরুর শিক্ষায় অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠবেন। কিন্তু আপনার বিদ্যার গুরুত্ত্ব নিঃশেষ হয়ে যাবে, যখন ভন্ড গুরুদেব আপনার ডান হাতের আঙ্গুল গুরুদক্ষিণার নাম করে কেটে নেবে। তাই সাধু সাবধান। গুরু নির্বাচন কঠিনতর সাধনা। তাই কথায় বলে গুরু মেলে লাখে লাখে শিষ্য মেলে কৈ ? শিষ্যের গুরুবাছার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। অথবা সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আর নিজেকে উপযুক্ত করতে হবে।
বিজয় গোস্বামী নিজগুনে একাধিক গুরুর কৃপা পেয়েছিলেন। কিন্তু ততদিনে গোসাঁইজী মধ্যে অনেক ঐশ্বর্যের প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। অর্থাৎ সাধন পথে তিনি অনেকদূর অগ্রসর হয়ে গেছেন। আগে আমরা শুনেছি, তাকে দস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করেছিল, দুটি বাঘ, এমনকি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে এসেছিলো, দস্যু দমন করতে। শশীবাবু, যিনি তার সাধন সঙ্গী ছিলেন, বলছেন, একদিন গোসাঁইজী হাততালি দিয়ে গান গাইছেন,দুই চোখ দিয়ে অশ্রুধারা নির্গত হচ্ছে। তার শরীর বেয়ে একটা সাপ তার গলা অবধি উঠে এলো। ধীরে ধীরে নেমেও গেলো। কিন্তু গোসাঁইজীর মধ্যে কোনো ভীতির সঞ্চার হলো না। আসলে যার মধ্যে হিংসার লাশ মাত্র নেই, তার কাছে এলে হিংস্র জীবজন্তুও হিংসা ভুলে যায়। সরল বালক-সম মন যার, তাকে ভগবান রক্ষা করেন।
তো গোসাঁইজীর মধ্যে যখন যোগের বিভিন্ন ঐশ্বর্যের প্রকাশ হতে শুরু করেছে, তখন একদিন , ১২৯০ সালের ভাদ্রমাসের এক ভোরে, সবে স্নান উপাসনা সেরে গয়ার এক বাবাজির আশ্রমে বিশ্রাম করছেন। হঠাৎ খবর এলো, এক মহাত্মা , মাথায় জ্যোতির্গোলক ধারণ করে, পাহাড়ের উপরে অবস্থান করছেন। গোসাঁইজীর মধ্যে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ ছিলো, অলৌকিক শক্তির প্রদর্শক কোনো সাধুর সন্ধান পেলেই তিনি ছুঁট লাগাতেন। কিন্তু ইতিমধ্যে যে তার মধ্যেও বিভিন্ন অলৌকিক গুনের সমাহার হয়ে বসেছে, তা তিনি খেয়াল করেন নি।
রামগয়ায় অবস্থানকালে, ভ্রমন করতে করতে একজায়গায় এসে গোসাঁইজীর অন্তরে পূর্বজীবনের স্মৃতি জেগে উঠলো। মনে হলো, এই জায়গাটা যেন তার কত চেনা। কতকাল যেন তিনি এখানে কাটিয়েছেন। এখানেই তিনি পূর্বজীবনে সঙ্গী তিন সাধুকে নিয়ে ধ্যান করতেন। এই বট গাছের উত্তর দিকে শাখায় একটা চিহ্ন আঁকা ছিলো। "ওঁ রামঃ" .এখানেই তিনি পূর্বজীবনে ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকতেন। একটু খুঁজতেই সেই চিহ্ন দেখা গেলো। গাছের শাখার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অক্ষরগুলো বেঁকে গেছে। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই, সেই চিহ্ন চোখে পড়ে। এখানে একটা নৃসিংহ দেবের মূর্তি ছিল। সেটি দেখে গোসাঁইজী "এইযে এইযে" বলে প্রণাম করলেন।
যাইহোক, পাহাড়ের উপরে, মস্তকে জ্যোতি-ছটা নিয়ে সাধু এসেছেন। গোসাঁইজী ছুটলেন, তার দর্শন লাভের আশায় । হয়তো মনে মনে এমন আশা থাকতেও পারে, যদি দীক্ষা পাওয়া যায়। সাধুকে দেখে তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার দিকে একদৃষ্টিতে দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে গেলেন। এ অবস্থায়, মহাত্মা-সাধু শক্তিসঞ্চার পূর্বক গোসাঁইজীকে দীক্ষিত করলেন। কিছু যৌগিক সাধন প্রণালী শিখিয়ে দিলেন। গোসাঁইজী সাধুকে প্রণাম করতেই একেবারে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। গোসাঁইজীর যখন জ্ঞান হলো, তখন সাধু মহাত্মা প্রস্থান করেছেন। গোসাঁইজী অনেক অনুসন্ধান করলেন, কিন্তু কোথাও তার দেখা পেলেন না। এর পরে ১১ দিন নাকি গোসাঁইজীর নাওয়া-খাওয়া-ঘুম এমনকি মলমূত্র ত্যাগ করা বন্ধ রইলো। কেমন যেন, পাগল-পাগল হয়ে গেলেন, গোসাঁইজী। ,মাঝে মধ্যে চিৎকার করে উঠতেন, মাঝে মধ্যে কেঁদে উঠতেন। কখনো কখনো চোখের জলে বুক ভাসাতেন। এইসময় একটি সাপ তার ধারে কাছে থাকতো, মাঝে মধ্যে তার শরীর বেয়ে উপরে উঠতো। এই ঘটনা গোসাঁইজীর জীবনে এক আমূল পরিবর্তন এনে দিলো। গোসাঁইজী আর সেই পুরুষকারে বিশ্বাসী, গুরুবাদে অবিশ্বাসী রইলেন না। হয়ে উঠলেন ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র।
এই হচ্ছে যথার্থ গুরুদীক্ষা। নিজেকে উপযুক্ত করে তুলুন, গুরু আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে, দীক্ষা দেবার জন্য। আপনি তখন শত চেষ্টা করেও, স্থির থাকতে পারবেন না। আপনি তখন গুরুঅন্ত প্রাণ হয়ে যাবেন। তথাকথিত ধর্ম্মের আসরে, ইউটুবে গুরু খুঁজে নিজের সঙ্গে আত্মপ্রবঞ্চনা করবেন না।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
গুরুদীক্ষা
প্রশ্ন হচ্ছে, গুরুদেবের স্থুল দেহত্যাগের পরেও কি শিষ্যকে গুরুদেব সাহায্য করতে পারেন ? বা করে থাকেন ? আর একটা কথা হচ্ছে সৎগুরু কি করেন ? যার জন্য শিষ্যের মধ্যে মুহূর্তের মধ্যে তার স্বভাবের পরিবর্তন হয়ে যায় ?
দেখুন আমি প্রথমেই বলেছি, গুরুদেব হচ্ছেন সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের কর্তা। গুরুদেব মানুষ নন। গুরুদেব হচ্ছেন স্বয়ং ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর।একটা শক্তি। গুরুদেব পরমপিতা পরমেশ্বরের শক্তির বাহক। গুরুগীতাতে বলা হয়েছে :
ওঁং গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণু গুরুদেব মহেশ্বরঃ
গুরুরেব পরম ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রী গুরুবে নমঃ। গুরু কোনো দেহধারী মানুষ নন। বলা হয়ে থাকে, গুরুকে মানুষ ভেবো না। গুরু হচ্ছেন, একটা সত্তা। একটা শক্তি। যে শক্তি কখনো কখনো কোনো কোনো মহাত্মার মধ্যে প্রকট হন। তাই আমরা ভাবি গুরু একজন দেহধারী মানুষ। এই সত্তা বা শক্তি চলে গেলে, তিনি আমাদের মতো সাধারণ মানুষ বড়োজোর একজন জ্ঞানী মহাত্মা হয়ে যান। যোগী-মহারাজ হয়ে যান। তার বেশি কিছু নয়।
আমাদের মধ্যে একটা ধারণা আছে, দীক্ষা গ্রহণ মানে মন্ত্র গ্রহণ। মন্ত্র গ্রহণ বা মন্ত্রদান, মানুষকে ভগবৎ অনুসন্ধানের একটা পথের সন্ধান দিতে পারে, একথা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এতে করে প্রাণের যে আকুতি, প্রাণের মধ্যে যে অভাব বোধ, সত্যিকারের সাধকের মধ্যে জেগে থাকে তার মোচন হয় না। গোসাঁইজী গুরুদীক্ষা সম্পর্কে বলছেন, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে মন্ত্র গ্রহণ, শ্রী মন্মহাপ্রভুর দীক্ষাদান, এমনকি স্বামী ত্রৈলঙ্গ স্বামীর কাছ থেকে মন্ত্রদীক্ষা গ্রহণ, তাকে তৃপ্ত করতে পারে নি। গোসাঁইজী বলছেন, গয়াতে আকাশগঙ্গা নামক পর্বতে যে দীক্ষালাভ হয়েছে, এতে করে আমি দেবতা হয়ে গেছি তা নয়, কিন্তু আমার অভাব মোচন হয়েছে। আমি যেন এক অনন্ত রাজ্যের দ্বারে এসেছি। আর আমার সম্মুখে যা কিছু দেখছি, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।
গোসাঁইজীর দীক্ষাদাতা এই গুরুদেব কে ? তিনি কি কোনো ব্যক্তি ? না কোনো ব্যক্তিতে অব্যক্ত শক্তি তা নির্ণয় করা কঠিন। শোনা যায় তাঁর নাম ব্রহ্মানন্দ পরমহংস। মানস সরোবরের বাসিন্দা। আসলে এরা বিদেহমুক্ত অবস্থায় যত্রতত্র প্রয়োজন মতো দেহ ধারণ করে বা সূক্ষ্মদেহে সর্বত্র গমনাগমন করেন, ও নির্দিষ্ট কার্য্য সাধনে রত থাকেন। সাধকদের সাহায্য করেন। এই সব মহাত্মাগণ আসলে জ্ঞানগঞ্জের বাসিন্দা। জগতের মঙ্গল সাধনের জন্য এঁরা নিয়ত কর্ম্মে রত। এঁরা পূর্বাশ্রমে হয়তো কোনো পরিচয় বহন করতেন, কিন্তু সেই পরিচয় ছাপিয়ে এখন এঁরা উর্দ্ধলোকের বাসিন্দা হয়ে গেছেন। এদের বয়সের কোনো গাছ-পাথর নেই। এঁরা নির্দিষ্ট দেহে স্থিত থাকতে পারেন না। প্রয়োজন মতো দেহ পছন্দ করে থাকেন। এঁরা সময় ও স্থানের উর্দ্ধে। এই পরমহংসজি নানারূপে, নানা ভাবে গোসাঁইজীর নিকটে আসতেন, অন্যকেউ চিনতে বা বুঝতে পারতো না।
গোসাঁইজী শ্রী মন্মহাপ্রভুর কাছে থেকে গয়াধামে দীক্ষা লাভের পর থেকে গুরুদেবের সাক্ষাৎ করতে পারেন নি। নানান স্থানে গুরুদেবকে খুঁজে বেড়াতেন। একদিন রামশীলায় বসে তার গুরুদর্শন স্পৃহা তীব্র আকার ধারণ করে। আর এই অদর্শন-ব্যথা সহ্য করতে না পেরে, পাহাড় থেকে লাভ দিয়ে প্রাণত্যাগে উদ্যত হলেন। আর ঠিক সেই সময় গুরুদেব মন্মহাপ্রভু হাত দুটো ধরে বললেন, ঘাবড়াও মৎ, ভজন করো বখৎ মে সব মিল যায়েগা।" গুরুদেবের কথায় গোসাঁইজীর মন শান্ত হলো।
যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ আর সখা অর্জুনকে নিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত মানুষদের দেখে, অর্জুনের হৃদয় কেঁদে উঠলো। অর্জুনের মধ্যে দয়া, মায়া করুনা, মোহ, জাগতিক ভালোবাসা, সম্পর্কের টান ইত্যাদি গুন্ জাগ্রত হয়েছে। অর্জুনের মধ্যে এক দ্বন্দ সৃষ্টি হয়েছে। সামনে বা পিছনে যারা যুদ্ধের জন্য উপস্থিত হয়েছেন, তারা সবাই আত্মীয়-পরিজন, মাতুল, শ্বশুর, পুত্র, পৌত্র, শ্যালক এমনকি স্বয়ং অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য, পিতামহ ভীষ্ম। এদের শিক্ষায়,এদের কোলেপিঠে, এদের স্নেহছায়ায় বড়ো হয়েছেন অর্জুন। এদের সবাইকে নিয়েই তো জীবনে সুখ শান্তি । এরা সবাই, বা এদের মধ্যে যে-কেউ যদি যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যান, তবে জীবন হবে বিষময়। আর আজ তাদেরকে হত্যা করবার জন্য, ধনুর্বান নিক্ষেপ করতে হবে, আমাকে ? কি লাভ ? যে রাজ্যের আশায়, যে অপমানের প্রতিবাদে এই মরন-পণ যুদ্ধ করতে চলেছি, এর পরিণতি কখনো ভালো হতে পারে না। হয়তো অর্জুনের মনের কোনে ভীতির সঞ্চারও হতে পারে, যুদ্ধে তো আমিও মারা যেতে পারি। যুদ্ধ তো একটা রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম মাত্র। যুদ্ধ থেকে শুভফল প্রাপ্তি হতে পারে না কখনো ।
আবার ভাবছেন, যুদ্ধ তো ঘোষণা হয়ে গেছে। যুদ্ধের দামামা বেজে গেছে, এখন এখান থেকে ফিরে যাবার উপায় কোথায় ? যদি যুদ্ধ থেকে রেহাই পেতে চাই, তবে হয়তো শত্রুপক্ষ কাপুরুষ ভাববে, অথবা তাকেই মেরে যুদ্ধ সমাপ্তি হবে। এতে করে, অর্জুনের বা অর্জুনপক্ষের কি লাভ কবে ?
মানুষ যখন কোনো দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে, মানুষ যখন কোনো অভাবের মধ্যে পড়ে, মানুষ যখন কোনো কঠিন সমস্যার মধ্যে পড়ে, তখন সে আরো একজনের সাহায্য যাঞা করে। এই সময় মানুষ অসহায় হয়ে যায়। কোনো রাস্তা খুঁজে পায় না। দ্বন্দ্বের নিরসন করতে আরো একজনের সাহায্য প্রার্থনা করে। আর ঠিক এই সময় অর্জুনের সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন, নিত্যসখা শ্রীকৃষ্ণ, যিনি এই মুহূর্তে অর্জুনের সবচেয়ে কাছের মানুষ, যিনি এখন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। অর্জুনের কথা শুনছেন নীরবে, শ্রীকৃষ্ণ । শ্রীকৃষ্ণ এই যুদ্ধে একজন রথের সারথি মাত্র। তো তার কাছেই নিজেকে সমর্পন করলেন। বললেন, : আমি হৃদয়দৌর্বল্যে আক্রান্ত। আমি ধর্ম্মা- ধর্ম্ম জ্ঞানহারা, আমি বিমূঢ় চিত্ত। আমি তোমার শিষ্য, আমি তোমার শরণাগত, আমাকে উপদেশ দাও। আমার পক্ষে যা কল্যাণকর তা তুমি আমাকে বলো।
শ্রীকৃষ্ণ কখনো আধ্যাত্মিক গুরুগিরি করেননি। তার কোনো শিষ্যও ছিল না। কিন্তু এইসময় শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে গুরুসত্তা জাগ্রত হয়ে উঠলো। শ্রীকৃষ্ণ হয়ে উঠলেন আচার্য্য, উপদেষ্টা। ধীরে ধীরে শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে এক পরাশক্তি জাগ্রত হয়ে উঠলো। যে শক্তিবলে শ্রীকৃষ্ণ হয়ে উঠলেন, পরমেশ্বরের প্রতিভূ। এবং এমন সব তত্ত্বকথা শোনালেন, যা সর্বকালের কথা হয়ে উঠলো। আমাদের কাছে দেবকী নন্দন শ্রীকৃষ্ণ হয়ে উঠলেন, স্বয়ং ভগবান।
এই শক্তি আমার আপনার সবার মধ্যেই আছে, কিন্তু তা সুপ্ত। দেখবেন, অনেক সময় নিজের শিল্প সত্তা, নিজের কর্ম্ম ক্ষমতা, স্বাভাবিক সীমা ছাড়িয়ে যায়। একএকসময়, নিজের উদ্ভাবনী শক্তি বিস্মিত করে নিজেকেই । আমরা ভেবে পাই না, এসব আমি কি করে করলাম । আসলে এইসময় একটা বিশেষ শক্তি আমাদের মধ্যে জাগ্রত হয়, এবং আমাকে দিয়ে সেই শক্তি তার ইচ্ছেপূরণ করে থাকে। আমরা তখন বিষয়ের গভীরে তন্ময় হয়ে যাই। আমরা তখন নিমিত্ত মাত্র। আবার একসময় এই শক্তির লোপ পায়। তখন, আর আমাদের মধ্যে সেই প্রতিভার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় না। একসময় কলম নিয়ে বসলেই যার মধ্যে কবিতার লাইন ভেসে উঠলো, এখন সারাদিন ভেবেও একটা লাইন কবিতা বেরোয় না।
শ্রীগীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের যে রূপ আমরা দেখতে পেয়েছি, যে কথা আমরা তার শ্রীমুখ থেকে শুনতে পেয়েছি তা আর কোথাও মেলে না। আসলে শ্রীকৃষ্ণের দুটো রূপ। ঐতিহাসিক শ্রীকৃষ্ণ দেহধারী। কিন্তু পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ দেহাতীত। এই ঐতিহাসিক দেহধারী শ্রীকৃষ্ণকে যখন পরবর্তীতে অর্জুন, কথাচ্ছলে বলেছিলেন, সখা কৃষ্ণ তুমি যে সব মূল্যবান কথা যুদ্ধের প্রারম্ভে আমাকে বলেছিলে, আমি সেসব নিজ বুদ্ধিদোষে ভুলে গেছি। তুমি যদি দয়া করে আবার একবার সেই উপদেশের কথাগুলো বলো। তখন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের এই কথায়, মর্মাহত হয়েছিলেন। অর্জুনের এই হেলাফেলা ভাব কৃষ্ণকে কষ্ট দিয়েছিলো। তিনি বললেন, এই কথাগুলো আমি আর বলতে পারবো না। সেইসময় যে কথাগুলো আমি বলেছিলাম, সেসব তত্ত্ব কথা আমার স্মৃতিপটে আর উদয় হবে না। বিশেষ করে আমার মনে হচ্ছে, তুমি অতি নির্বোধ ও শ্রদ্ধাহীন। আর নির্বোধ ও শ্রদ্ধাহীনের কাছে, সেই উপদেশ আমি আর দিতে পারবো না।
খেয়াল করুন কথাটা, শ্রীকৃষ্ণ আজ অর্জুনকে বলছেন, নির্বোধ ও শ্রদ্ধাহীন অর্জুন। যাকে একসময় এই শ্রীকৃষ্ণ তার স্বরূপ দেখিয়েছিলেন। তো আমাদের নির্বোধ হলে চলবে না, আমাদের বুদ্ধিমান হতে হবে। নির্বোধের কাছে তত্ত্বকথা গুরুত্ত্বহীন হয়ে যায়। আর একটি কথা হচ্ছে, শ্রদ্ধা। ভগবান অন্য জায়গায় বলেছিলেন, শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানম। তো শ্রদ্ধা না থাকলে, গুরুর উপদেশ কোনো ভাল ফল প্রসব করে না।
তো যে কথা বলছিলাম, গুরুতত্ত্ব একটা গতিশীল শক্তি। যা এক দেহ থেকে আর দেহে সঞ্চারিত করা যায়। যে শক্তি আমরা প্রবাহিত হতে দেখি ঠাকুর রামকৃষ্ণ থেকে নরেন্দ্রের মধ্যে। যার নিদর্শন পাই আমরা গোসাঁইজীর দীক্ষার সময়। যা দেখি আমরা বাবাজির কাছ থেকে লাহিড়ী মহাশয়ের মধ্যে সঞ্চার হতে। এই শক্তি কোনো ব্যক্তির শক্তি নয়, এই শক্তির জন্ম মৃত্যু নেই। এই শক্তি আসলে সেই পরমাত্মা পরমেশ্বরের শক্তি। যা গতিশীল হয়ে, গুরুদেবের মাধ্যমে শিষ্যের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে থাকে।
শোনা যায়, যোগী বরদাচরণের কাছে, অনেক সূক্ষ্ম-দেহধারী মহাত্মা যাতায়াত করতেন। এমন একদিনের কথা, বরদাচরণ তখন এক বন্ধুর বাড়ির সামনে গল্পে মত্ত। হঠাৎ সেখানে এলেন এক সাধু। বরদাচরণকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। সাধুকে নিয়ে বরদাচরণ নিজ কক্ষে দ্বার রুদ্ধ করে কি সব করলেন। এর পর সাধুকে বিশ্রামের জন্য, সাধুর ইচ্ছে অনুযায়ী ভৃত্য ভগবান দাসকে দিয়ে লোকালয়ের বাইরে কাঞ্চনতলা হাইস্কুলে পাঠানো হলো। কিন্তু রাস্তাতেই সাধু অদৃশ্য হয়ে গেলেন । ভগবান দাস ভয়ে বিষ্ময়ে দৌড় লাগলো বাড়ির দিকে।
এখন কথা হচ্ছে সৎগুরু কি করেন ? যার জন্য শিষ্যের মধ্যে মুহূর্তের মধ্যে তার স্বভাবের পরিবর্তন হয়ে যায় ?
দেখুন যোগগুরুর কৃপাভিন্ন কেউ কখনো যোগী অর্থাৎ ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হতে পারেন না। যোগী অর্থাৎ যার ঈশ্বরের সঙ্গে মিলন হয়েছে। প্রকৃত অধ্যাত্মজীবন লাভ করতে গেলে, সারাক্ষন গুরুপ্রদত্ত সাধনাকে আশ্রয় করতে হয়। গোসাঁইজীকে দীক্ষাকালে এই সাধন পথ শিখিয়ে দিয়েছিলেন, ব্রহ্মানন্দ পরমহংস। একবার স্বভাবের যোগপথে পড়তে পারলে, আর কোনো চিন্তা নেই। কোনো বস্তু যখন স্রোতের জলের উপরে আকস্মিক ভাবে পড়ে যায়, তখন বিনাচেষ্টাতেই সে ভেসে যেতে পারে। ঠিক তেমনি যে একবার ভাগ্যক্রমে গুরুশক্তির বেগে পড়ে যায়, সে তখন গুরুশক্তির সাহায্যে পূর্ন পরিণতি প্রাপ্ত হয়। এরজন্য চাই গুরুর প্রতি ঐকান্তিক নির্ভরতা এবং পূর্ন আত্ম-সমর্পন।
এখন কথা হচ্ছে, আমাদের এই স্বভাবের পরিবর্তন বলতে কি বুঝি। স্বভাব কথাটার অর্থ হচ্ছে স্ব -ভাব অর্থাৎ নিজের প্রকৃত ভাব। অর্থাৎ আত্মজ্ঞান। মানুষ যখন সংসারে অনাসক্ত হয়ে কেবল ঈশ্বর চিন্তায় মগ্ন থাকে, তখন সে আত্মার ভাব বুঝতে পারে। দেখুন আমরা যখন শ্বাস প্রশ্বাস ক্রিয়া করছি, তখন এই দুইয়ের অন্তরকে ধরতে হবে। আমরা যখন চিন্তা করছি, এক বিষয় থেকে আরেক বিষয়ের চিন্তা করতে যাচ্ছি, এই দুই -এর একটা অন্তর আছে, যখন বা যে মুহূর্তে আমাদের মনে কোনো চিন্তা থাকে না। জ্ঞানের এই চিন্তাহীন বা চিন্তাশুন্য অবস্থাই আত্মার প্রকৃত স্বভাব। এই স্বভাবকে ধরতে পারলে, আমাদের আর কোনো অভাব থাকে না। সৎগুরু দীক্ষাদানকালে শিষ্যকে এই স্বভাবের যোগপথ ধরবার কৌশলটি শিখিয়ে দেন। কিন্তু কথা হচ্ছে কি সেই কৌশল ? আর কিভাবেই বা বুঝবেন, যে গুরুদেব তাকে এই স্বভাবের যোগপথে স্থাপন করে দিলেন ?
আমরা চিদাকাশের কথা শুনেছি। আমরা চোখ বুজলে যে জায়গায় অন্ধকার দেখতে পাই, সে জায়গার নাম হচ্ছে চিদাকাশ। যোগশাস্ত্র বলছে, দুটো চিন্তার মাধ্যবর্তীকালে জ্ঞানের যে নিরাধার অবস্থা হয়, তাকে বলে চিদাকাশ। এই চিদাকাশের আর-এক নাম হচ্ছে স্বভাব। শিষ্যকে স্বভাবের যোগপথে উত্তোলন করবার অর্থ হচ্ছে, চিদাকাশে স্থিতি। সৎগুরু যখন আমাদের এই চিদাকাশে স্থাপন করে দেন, তখনই বুঝতে হবে গুরু শিষ্যকে স্বভাবের যোগপথে স্থাপন করে দিলেন। আর তখন আপনি চোখ বুজলেই চিদাকাশে অন্ধকারের বদলে, জ্যোতি দেখতে পাবেন। একটা আলোর বিন্দু, বা আলোক রশ্মি আপনাকে উদ্বেল করে দেবে। মেরুদণ্ডের মধ্যে একটা শিরশিরানি অনুভব করতে পারবেন। মাথার পিছন দিকে একটা অস্বাভাবিকতা অনুভব করবেন। মাথার এই অস্বাভাবিকতা আপনাকে পাগল প্রায় করে দেবে। আপনার মধ্যে স্বাভাবিক জীবনের আকাংখ্যা লোপ পাবে। কিছুদিন পরে, মাথায় চুলকানি দেখা দিতে পারে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এইসব লক্ষণ লোপ পেয়ে যাবে, যদি কিনা আপনি গুরুউক্ত সাধন ক্রিয়ায় নিজেকে যুক্ত রাখেন। তবে আপনি এক নতুন মানুষ হবেন। আপনার স্থিতির জগৎ একটা অন্য মাত্রা নেবে। জানবেন এইসময় গুরুদেব আপনার সঙ্গে সঙ্গেই আছেন। এক মুহূর্তের জন্য আপনাকে তিনি পরিত্যাগ করবেন না। আর আপনি যখনই গুরুদেবকে স্মরণ করবেন, তখন তিনি আপনার সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দেবেন। কেননা এটি তার স্বভাবজাত।
যারা যোগমার্গে সামান্য কিছু অনুশীলন করেছেন, তারা জানেন, আমাদের শ্বাস প্রশ্বাস দিন-রাত ২৪ ঘন্টায় ২১৬০০ বার ঘটে থাকে। এই বায়ু আমাদের ইড়া অর্থাৎ চন্দ্র নাড়ী এবং পিঙ্গলা অর্থাৎ সূর্যনাড়ী মধ্যে প্রবাহিত হয়ে থাকে। এই দুই নাড়ীর মধ্যস্থলে আছে আরো একটি সূক্ষ্ম নাড়ী, যার নাম সুষুম্না। এই সুষুম্না নাড়ীর উর্দ্ধ-ভাগকে বলে উত্তরা-সুষুম্না। আর নিম্ন ভাগকে বলে অপরা সুষুম্না। উত্তরা সুষুম্নার পথ হচ্ছে স্বভাবের অর্থাৎ আত্মার যোগপথ। গুরুর কৃপায় এবং গুরুর নির্দেশে সঠিক যোগপ্রনালীর সাহায্যে এই যোগপথের সন্ধান জানা যায়। অর্থাৎ সাধনার সাথে সাথে এই স্থানে এক স্পন্দন অনুভব হয়। তখন এর সঠিক অবস্থান আমরা উপলব্ধি করতে পারি । আসলে এটির অবস্থান হচ্ছে নিম্ন মস্তিক যেখানে আমাদের মেরুদণ্ডের শুরু আর উর্দ্ধ মস্তিস্ক অর্থাৎ বিন্দুর নিম্নভাগ পর্যন্ত এই উত্তরা সুষুম্নার বিস্তৃতি।
মানবশিশু মাতৃগর্ভে অবস্থানকালে মায়ের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে সন্তানের শ্বাসপ্রশ্বাস চলতে থাকে। সন্তান মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্লেষ্মা দ্বারা সুষুম্না মার্গটি রুদ্ধ হয়ে যায়। যোগীগণ বলে থাকন, কুল্ডলীনী মহাভুজঙ্গিনী সুষুম্নাদ্বারে মূলাধারে নিদ্রিতা হয়ে যান। এই অবস্থাকে বলা হয়ে থাকে মানুষের বদ্ধ অবস্থা। যোগীদের কাজ হচ্ছে, সুষুম্নাপথে প্রাণবায়ুকে চালনা করা। এই পথকে খুলবার উপায় হচ্ছে যোগক্রিয়া। ধ্যান-জপ-প্রাণায়ামের দ্বারা সুষুম্না মার্গের রুদ্ধদ্বার উন্মুক্ত করা যায়।
তীব্র ভাবনা, অর্থাৎ গভীর ধ্যানের দ্বারা, শিব সংহিতায় বর্ণিত বিশেষ ক্রিয়ার দ্বারা, মৎস্যেন্দ্রনাথের লিপিবদ্ধ হঠযোগ কথিত গুহ্য ক্রিয়ার দ্বারা, জপের দ্বারা, এমনকি প্রাণায়ামের দ্বারা এছাড়া আরো কিছু গুহ্য ক্রিয়া আছে, যার দ্বারা, সুষুম্না মার্গের এই রুদ্ধ দ্বার উন্মোচন করা যায়। এই সব কথা আমরা সময় সুযোগ মতো শুনবো।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
চলবে। ......
তীব্র ভাবনা, অর্থাৎ গভীর ধ্যানের দ্বারা, শিব সংহিতায় বর্ণিত বিশেষ ক্রিয়ার দ্বারা, মৎস্যেন্দ্রনাথের লিপিবদ্ধ হঠযোগ কথিত গুহ্য ক্রিয়ার দ্বারা, জপের দ্বারা, এমনকি প্রাণায়ামের দ্বারা এছাড়া আরো কিছু গুহ্য ক্রিয়া আছে, যার দ্বারা, সুষুম্না মার্গের এই রুদ্ধ দ্বার উন্মোচন করা যায়।
আমরা জানি, পুরুষ নিষ্ক্রিয়, প্রকৃতি সক্রিয়। প্রকৃতি ত্রি-গুনাত্বিকা। এই ত্রি-গুনের মধ্যে বৈষম্যের জন্যই সৃষ্টি হয়ে থাকে। সৃষ্টির কারন নিহিত আছে এই ত্রিগুণের মধ্যে ভারসাম্যের অভাবের মধ্যে ।
তাই বলছিলাম, গুরুদেবের দেহান্তর যে-কোনো প্রকৃতির নিয়মের বাইরে। এঁরা ইচ্ছেধারী। এদের জন্ম নেই, মৃত্যু নেই। এঁরা ইচ্ছেমতো দেহ ধারণ করেন, আবার ইচ্ছেমতো দেহত্যাগ করেন। তাই গুরুদেব মানুষ নন. গুরুদেব স্বয়ং সেই পরম-পুরুষের শক্তি, যা আমাদের সবার মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় আছে ।
চলবে। ....
No comments:
Post a Comment