মস্তিষ্কের ব্যায়াম - BRAIN GYM
আমার এক দক্ষিণী বন্ধু ছিল. কার্তিক কৃষ্ণান। অসম্ভব মেধাবী ছেলে। অক্সফোর্ড-এর ডিকশেনারি ওর মুখস্ত ছিল। কার্তিক আমার কাছে ছিল একটা বিস্ময় যুবক। ও ছিলো স্টেনোগ্রাফার। কিন্তু ও স্টেনোগ্রাফের জন্য খাতার ব্যবহার খুব কমই করতো। চেম্বারে বসে বস যা বলতেন, বাইরে এসে টাইপ-রাইটার মেশিনে হুবহু তাই টাইপ করে ফেলতো। ও দুই হাত দিয়ে সমান দক্ষতায় খাবার খেতো, তা সে ভাত ডাল মাছ টোস্ট যাই হোক না কেন ? আমরা ওর খাবার খাওয়ার কায়দা দেখে ভাবতাম, অবাঙালী তো তাই বোধ হয়, গুছিয়ে ডান হাত দিয়ে খেতে পারে না। বহুদিন দেখেছি, ওকে উল্টো করে বই পড়তে । আমরা ভাবতাম, বই পড়ছে না, ও অন্যকিছু চিন্তা করছে বইটাকে সামনে রেখে। ও থাকতো বৌবাজারের চীনা পট্টিতে। আমি তখন বৌবাজারে একটা মেসে থাকি। একদিন সকালে গিয়ে দেখি, কার্তিক বা হাত দিয়ে নিম ডাল দিয়ে দাঁত মাজছে, আর একবার সামনে হাটছে, একবার পিছনে হাটছে । ওর সব কিছুতেই উল্টো ব্যাপার। প্রশ্ন করতেই বললো, এটা মস্তিষ্কের ব্যায়াম। এই মস্তিষ্কের ব্যায়াম ব্যাপারটা কি ? আসলে আমরা যা কিছু অভ্যাস করি, আমরা তাই হয়ে যাই। এই ব্যাপারটা বুঝতে গেলে আমাদের মস্তিষ্কের ভিতরের ব্যাপারটা একটু বুঝতে হবে।
আমাদের মাথার মধ্যে খানিকটা ফাঁকা জায়গা আছে, এগুলোকে বলা হয় প্রকোষ্ঠ বা VENTRICLE । এর মধ্যে মেরু-রস বা মস্তিস্ক-সুষুম্না রস দ্বারা পূর্ন। চারটি প্রকোষ্ঠ। প্রথম দুটো আছে গুরুমস্তিষ্কের গোলার্ধে। তৃতীয় প্রকোষ্ঠ আছে অগ্রমস্তিষ্কের শেষভাগে। আর চতুর্থটি সুষুম্না নাড়ীর অগ্রভাগে। সুষুম্না নাড়ী এখানে উন্মুক্ত। আমরা জানি আমাদের মধ্যে অনেক সময় অনিচ্ছাকৃত ভাবে বিভিন্ন সংজ্ঞাবহ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এগুলোকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে REFLEX ACTION বা প্রতিবর্ত ক্রিয়া। এই প্রতিবর্ত ক্রিয়া সুষুম্নাকান্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, এবং খুব দ্রুত সম্পন্ন হয়। যেমন ধরুন, চোখে যদি টর্সের আলো আসে, তবে আমরা তাড়াতাড়ি চোখের পাতা বন্ধ করে দেই। আবার পায়ে কাটা বিঁধলে, আগুনে হাত পড়লে, বা শরীরে আঘাতের সম্ভাবনা দেখলে, আমরা তাড়াতাড়ি সতর্ক হই, এবং হাত-পা-শরীর সরিয়ে নেই। আমাদের এই যে অভ্যাস এটি স্বতঃস্ফূর্ত। এই ক্রিয়া শর্তবিহীন, জন্মগত, প্রতিবর্ত ক্রিয়া। এই ক্রিয়া যে স্নায়ুপথ ধরে চলে, তা সুনির্দিষ্ট এবং জন্মসূত্রে প্রত্যেক জাতি তা সে মানুষ বা পশু যাই বলুন না কেন, পেয়ে থাকে। শিশুর স্তনপান, মশার কামড় থেকে বাঁচা, উত্তাপ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া, পতনের ভয় - এগুলো প্রতিবর্ত ক্রিয়ার উদাহরণ। এই প্রতিবর্ত ক্রিয়া যেমন আমাদের সহজাত, ঠিক তেমনি কিছু প্রতিবর্ত ক্রিয়া আমাদের অভ্যাসের দ্বারা তৈরী করে হতে পারে । যেমন কথা বলা, হাটতে শেখা, গান করা, সাইকেল চালানো, ইত্যাদি এমনকি আমাদের যে নির্দিষ্ট সময়ে অর্থাৎ স্নানের আগে ক্ষুধার উদ্রেগ হয়, বা সকালে চা খাওয়া, বা খাবার পরে একটা সিগারেট ধরানো, এগুলো আমাদের নিরন্তর অভ্যাসের ফলে হয়ে থাকে। আমি যখন কুকুরের কাছে বিস্কুট নিয়ে যাই, আমি দেখেছি, তার মুখে দিয়ে লালা বেরুচ্ছে। কাউকে কিছু সুখাদ্য খেতে দেখলে আমাদের জিভে জল আসে। আবার আমার অপছন্দের কিছু যখন কেউ তা সে পশু-পাখি খেলেও, আমাদের মধ্যে ঘৃণার উদ্রেগ করে থাকে। এগুলো আসলে আমাদের প্রতিবর্ত ক্রিয়ার ফল, যা আমরা নিরন্তর অভ্যাসের ফলে সংগ্রহ করেছি। এমনকি গাছপালার মধ্যেও এই প্রতিবর্ত ক্রিয়া হয়ে থাকে।
এইবার আমরা দেখে নেই আমাদের দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কিভাবে বা কেন কাজ করে। আমরা ইন্দ্রিয় দ্বারা বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। তাই এই ইন্দ্রিয়গুলো হচ্ছে গ্রাহক যন্ত্র। এখন এই গ্রাহক যন্ত্রের দ্বারা গৃহীত ঘটনা বা চিত্র আমাদের মাথার মধ্যে যে প্রকোষ্ঠ আছে, আর তার মধ্যে যে মেরুরস আছে তার মধ্যে একটা উদ্দীপনা বা আলোড়ন সৃষ্টি করে থাকে। এই উদ্দীপনা অন্তর্বাহী স্নায়ুর মাধ্যমে (AFFERENT NERVE) মস্তিস্ক হয়ে, সুষুম্না কাণ্ডে পৌঁছায়। সুষুম্না কাণ্ডে উদ্দীপনা বিশ্লেষিত হবার পর, আজ্ঞা বা নির্দেশ বহির্বাহী স্নায়ুর (EFFERNET NERVE) মাধ্যমে কারক অঙ্গ অর্থাৎ পেশী বা গ্রন্থিতে পৌঁছায়। একদম শেষে কারক অঙ্গে ক্রিয়া সংগঠিত হয়।
আপনি যদি অমাবশ্যার গভীর রাতে আকাশের দিকে তাকান তবে দেখতে পাবেন, একটার পর একটা আলোর ফুলকি বিরামহীন ভাবে, ছুটে বেড়াচ্ছে। এই যে ছোটা, এর একটা কারন আছে, কিন্তু সময়ের মাপ নির্দিষ্ট নেই অর্থাৎ সময় শৃঙ্খলে এই ক্রিয়া বাঁধা নয় । আমাদের মাথার মধ্যেও এই আলোর ফুলকি প্রতিনিয়ত ছুটে বেড়াচ্ছে, যার কারন আমাদের মেরুরসে উদ্দীপনা। আমাদের মাথার মধ্যে এই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া যদি কোনো দিন ভিডিও করা যায়, তবে এটিকে পর্যবেক্ষেপন করা সম্ভব হবে। এই ছোটাছুটিই আমাদের বিভিন্ন বৃত্তির জন্ম দিচ্ছে।
আমাদের মস্তিষ্কের পিছনের অংশে সহজাত বৃত্তির জন্মস্থান। মধ্যমস্তিষ্কের অংশ আবেগের আঁতুরঘর।আর সামনের অংশ আমাদের যুক্তি-বিচার-বুদ্ধির সংগ্রহশালা। আর এই তিন অংশের সঙ্গেই মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের নিরন্তর লেনদেন চলছে। আমাদের মস্তিষ্কের কিছু অংশের অভ্যন্তরীন স্নায়ুকোষ বা নিউরোন আজীবন বংশ বৃদ্ধি করবার ক্ষমতা থাকে। আর এই স্নায়ুকোষগুলোর মধ্যে যোগাযোগ বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে হতে পারে, হয়ে থাকে। আর এই স্নায়ুকোষগুলোর যে নেটওয়ার্ক, বা জোটবন্ধন তার ভিত্তিতেই এরা নিজেদের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে চলে। আমাদের মস্তিষ্কের যে কাজকর্ম্ম তা নির্ভর করে এই নেটওয়ার্কের উপরে, আবার এই স্নায়ু বন্ধন আমাদের ব্যবহারিক, আচরণগত, ও চারিত্রিক বৈশিষ্ঠগুলোকে রূপ দেয়। এক-একটা স্নায়ুকোষ অন্তত ১০ হাজার স্নায়ুকোষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে থাকে। আর আমাদের মস্তিষ্কে এই স্নায়ুকোষের সংখ্যা অন্ততঃ ১০০ লক্ষ কোটি। আসলে এই সংখ্যা এখনো নির্ধারণ করা সম্ভব হয় নি। এই যে স্নায়ুকোষগুলোর মধ্যে যোগাযোগের রাস্তা এটি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে, বা হতে পারে। অর্থাৎ অসংখ স্নায়ুকোষ হাজার হাজার স্নায়ুকোষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, কিন্তু তাদের যাতায়াতের রাস্তা নির্দিষ্ট নয়। আর এই জন্যই আমাদের ভাবনা চিন্তা বা আমাদের ব্যবহারিক দিক নিয়ত পরিবর্তনশীল।
আপনি প্রতিদিন যে রাস্তা দিয়ে স্কুলে বা অফিসে যান, হয়তো দেখা যাবে, সেটাই একমাত্র রাস্তা নয়। আপনি ইচ্ছে করলে ঘুরে-ফিরে হয়তো বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে আপনি যেতে পারেন আপনার গন্তব্যে । কিন্তু যে রাস্তা দিয়ে আপনি সাধারণত যান, সেটাই আপনার স্বাচ্ছন্দের রাস্তা। বা বলা যেতে পারে সোজা রাস্তা। আর যেখান দিয়ে মানুষ যাতায়াত করে, সেখানে একটা রূপ-রেখা তৈরী হয়ে যায়। ধরুন, আপনি প্রতিবেশী বন্ধুর বাড়িতে যাবার জন্য, খেলার মাঠ পেরিয়ে যান। তো কিছুদিন পরে দেখবেন মাঠের মধ্যে দিয়ে একটা সরু রাস্তা তৈরী হয়েছে, যেখানকার ঘাসগুলো মারা গেছে। এইজন্য বলা হয়ে থাকে মানুষের পায়ে ক্ষুর আছে। তো এই রাস্তা দিয়ে যদি বছর খানেক কেউ যাতায়াত না করে, তবে দেখবেন , সেই রাস্তার চিন্হ আর নেই। ওখানে ঘাস গজিয়ে রাস্তাকে নিশ্চিন্হ করে দিয়েছে।আমাদের মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো যখন যে পথে যাতায়ত করে, তাকে বলা হয় আমাদের অভ্যাস। অর্থাৎ একই রাস্তায় যেতে যেতে আমাদের একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। আর এর ব্যবহার না করলে, রাস্তাটি মুছে যায়। এইজন্যই আমরা ডান হাতে খাই, খেতে বসলে, কেউ বা হাত বার করি না। কিন্তু বা হাত দিয়ে খাওয়া যায় না তা কিন্তু নয়। আমরা যখন সাইকেলে চড়ি অভ্যাসের বসেই আমাদের পা প্যাডেল ঘোরাতে থাকে, হাত হ্যান্ডেল ঘোরাতে থাকে। আমরা যদি উল্টোটা অভ্যাস করতাম তবে তাই করতে পারতাম। প্রতিবন্ধী মানুষ কিন্তু হাত দিয়ে প্যাডেল ঘোরায়। যাই হোক। আমরা যদি স্বভাবের পরিবর্তন করতে চাই, তবে স্নায়ুকোষগুলো প্রতিনিয়ত যে পথে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, সেই পথের পরিবর্তন করতে হবে।
আর একটা কথা হচ্ছে, স্নায়ুগুলোকে যদি আমরা গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে গতিশীল করতে পারি, তবে আমাদের মধ্যে একটা একগুঁয়ে ভাব, বা প্রবল ইচ্ছেশক্তি তৈরি হবে। আমাদের স্বভাব পরিবর্তনের জন্য, এই স্নায়গুলোকে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে গতিশীল করতে হবে। অর্থাৎ যখন যে কাজটি করবো, সেই কাজেই আমাদের সমস্ত ইচ্ছাশক্তি নিয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ ধ্যানে বসবো, আর রান্নাঘরে বিড়াল ঢুকলো কিনা, সেটাও খেয়াল করবো, সেটি চলবে না। ধ্যানে বসবো আর মোবাইলে কে মেসেজ পাঠালো, সেটাও দেখে নেবো সেটি চলবে না। অর্থাৎ দুটো বিপরীত ধর্মী কাজ একসঙ্গে করা চলবে না।
আমরা বাড়িঘর পরিষ্কার করি, জামাকাপড় পরিষ্কার করি, এমনকি আমাদের এই দেহকেও বাইরের দিক থেকে পরিষ্কার করি। এমনকি আমরা পাকস্থলী পরিষ্কার করি, কিন্তু আমরা কখনো মস্তিস্ক পরিষ্কার করি না। আজ আমরা এই মস্তিষ্কের পরিষ্কার করবার কায়দা শিখবো। আসলে মস্তিস্ক পরিষ্কার করা মানে আমরা যে অভ্যাসের বাঁধনে আবদ্ধ সেখান থেকে বেরিয়ে আসা। আর এগুলোকে করতে হবে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোকে সজাগ করে।
নাক : বিভিন্ন গন্ধকে নির্বাচন করতে শিখুন। আপনি হয়তো শুয়ে আছেন। একটা সুগন্ধ বা দুর্গন্ধ আপনার নাকে আসছে, শুয়ে শুয়ে বোঝার চেষ্টা করুন, কোথেকে গন্ধটি আসছে, এবং এটা কিসের গন্ধ। অর্থাৎ নাক দিয়ে জিনিসের কথা ভাবতে থাকুন।
কান : আপনি বসে আছেন, একটা শব্দ আপনার কানে এলো। বসে বসে বুঝবার চেষ্টা করুন, এটা কিসের শব্দ। বেড়াল লাফিয়ে পালালো, না কোনো বাসন পরার শব্দ, না কোনো গানের শব্দ, না মেঘের ডাক, না কোনো পাখির ডাক। পাখির ডাক হলে বোঝার চেষ্টা করুন, কোন পাখির ডাক। তার দেহরাটা মনে আনবার চেষ্টা করুন। গান হলে এটা কার গলার গান। ঘড়ির টিক টিক আওয়াজ শুনুন মন দিয়ে। ইত্যাদি ইত্যাদি। ব্যস্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে মোবাইলে রেকর্ডিং অন করুন। বাড়ি এসে, রেকর্ড করা শব্দকে একমনে শুনুন, আর চেষ্টা করুন বুঝতে কোনটা কিসে শব্দ।
মুখ : কিছু মুখে দিয়ে, ভাববার চেষ্টা করুন, এটা কিসের স্বাদ। এর মধ্যে কি মসলা থাকতে পারে। শুকনো লংকার ঝাল, না কাঁচা লংকার ঝাল। পেঁয়াজ-রসুন-হিং-গরমমসলা কোনটা আছে। ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ মুখ দিয়ে জিনিসের কথা চিন্তা করতে থাকুন।
চোখ : দূরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করুন। আকাশের মেঘগুলোকে খেয়াল করুন। মেঘের মধ্যে আলোর আভা খেয়াল করুন। খেয়াল করুন, ক্ষনে ক্ষনে মেঘের আকৃতির পরিবর্তন হচ্ছে। দূরের তালগাছটা দেখুন , অস্পষ্ট বাড়ি নজরে পড়ছে। ওখানকার রাস্তা-ঘাট মানুষ-জন দেখতে চেষ্টা করুন। বাড়ি, পুকুর, মানুষ পশু গাছপালা আলাদা করতে চেষ্টা করুন।
ত্বক : চোখ বুজে বাড়ির দেওয়ালে হাত রাখুন, অনুভব করবার চেষ্টা করুন মসৃণতা বা এবড়ো খেবড়ো দেওয়াল। দেয়ালে কান পেতে শুনবার চেষ্টা করুন, দেওয়ালের ভিতরে কোনো জীবাশ্ম আটকে আছে কি না। দেওয়ালের গভীরতা মাপতে চেষ্টা করুন। আলতো করে বইটাকে বুকে চেপে ধরুন। বইয়ের কথাগুলোকে অনুভব করবার চেষ্টা করুন। চোখ বুজে বুক পকেটের টাকা বা প্যান্টের খুচরো পয়সা গুনুন তার আকার বা অনুভূতি দিয়ে। পুরোনো দিনের এলবামের ফাইল খুলুন - চোখ বুজে ছবিগুলোর উপরে হাত বোলান, আর ভাবতে থাকুন, কবে কোথায় এই ছবিগুলোকে তোলা হয়েছিল। কে-কে তখন ছিল। কি-কি- কথা হয়েছিল। ইত্যাদি ইত্যাদি।
উল্টো করে বই পড়ুন, পিছন দিকে হাঁটুন, পিছনে মুখ করে সামনের দিকে হাঁটুন, বা হাত দিয়ে খাবার খান, বা হাত দিয়ে দাঁত ব্রাশ করুন, বা হাত দিয়ে লিখুন, ঠাকুরের সামনে আরতি করুন অর্থাৎ এক হাতে ঘন্টা আর এক হাতে ধুনুচি বা প্রদীপ নিয়ে দুটো দুদিকে ঘোরান। ঘাড় না ঘুরিয়ে পিছন দিকটা দেখতে থাকুন। অর্থাৎ আপনার মধ্যে যা কিছু স্বাভাবিক বলে মনে হয়, তার উল্টো পথে নিজেকে পরখ করুন।
আসলে আমি বলতে চাইছি, আপনি জীবনের চেনা পথে না হেটে, একটু সময় নিজের জন্য বের করে, একটু অন্য পথে হাঁটুন। সকাল বা সন্ধ্যাবেলা যখন ভ্রমন করতে যাবেন, তখন মাঝে মধ্যে নতুন রাস্তায় হাঁটুন। নতুন লোকের সাথে কথা বলুন। চারিদিকের দৃশ্যের দিকে মনোযোগ দিন। কতদিন আগে এখানে এসেছিলেন, তখন কি দেখেছিলেন, মনে করবার চেষ্টা করুন। নতুন নতুন বই পড়ুন। পুরোনো বইগুলোকে আবার নতুন করে পড়ুন। এলবাম বের করে, পুরোনো চাবিগুলোকে দেখুন, আর পুরুনো দিনের কথা ভাবতে থাকুন। দেখবেন, আগে যা শোনেননি, আগে যা দেখেননি, আগে যা অনুভব করেননি, আজ তা দেখতে-শুনতে-অনুভব করতে পারছেন।
এখন দেখবেন, আপনার মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো নতুন পথে ঘোরাফেরা শুরু করেছে। আপনার ভিতরে একটা নতুন ভাবনা চিন্তা শুরু হয়েছে। আপনার মস্তিস্ক যেন হালকা বোধ হচ্ছে, আপনার মস্তিষ্কে একটা আলোড়ন শুরু হয়েছে। আপনার স্মৃতিশক্তি, আপনার বৌদ্ধিক শক্তি, আপনার অনুভবের শক্তিবৃদ্ধি পেয়েছে। আপনি একটা নতুন জীবনের স্বাদ গ্রহণ করতে পারবেন। আপনার একঘেয়েমি কেটে যাবে, জীবন হয়ে উঠবে আরো আনন্দপূর্ণ, জীবন হয়ে উঠবে আরো সৃষ্টিধর্ম্মি, জীবন হয়ে উঠবে আরো অনুসন্ধানী। সবাই ভালো থাকবেন।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম
ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় - SIXTH SENCE
বাড়িতে বেড়ালের খুব উৎপাত। তিনটে বাচ্চা হয়েছে। তো রাতের দিকে বিড়ালগুলোকে ধরে বস্তায় মুখ বন্ধ করে, বড় রাস্তার কাছে দিয়ে এলাম। পরেরদিন দুপুরে দেখলাম, বেড়ালগুলো আবার আমাদের বাড়িতে চলে এসেছে। একটা মানুষকে চোখ বেঁধে কোথাও নিয়ে গিয়ে অচেনা জায়গায় ছেড়ে দিলে, সে অন্য কারুর সহযোগিতা ছাড়া বাড়ি ফিরতে পারে না। বিড়াল কি করে পারে ? লোকটাকে দেখে ভালো মনে হয় না। কি এমন দেখলাম তার মধ্যে যে তাকে ভালো লোক বলে মনে হলোনা। ছেলের কথা ভাবছিলাম, হঠাৎ ছেলের টেলিফোন এলো। স্বামী যোগানন্দের গুরুদেব শ্রীযুক্তেশ্বরজী পুরীতে অসুস্থ হয়েছেন, খবর এসেছে স্বামী যোগানন্দের কাছে, যোগানন্দ বলছেন, শুয়ে আছি, হঠাৎ দেখি, দু'টো হেডলাইটের মতো আলো, আমার সামনে ঘুরছে। তখনই আমি বুঝেছি, গুরুদেব আর নেই। এই সব ঘটনার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে কি ? ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে কিছু আমাদের শরীরে আছে কি ?
ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ব্যাপারটা কি ?
প্রথমে আমরা নেই, ইন্দ্রিয় বলতে আমরা কি বুঝি? আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয়। আমরা এই পঞ্চইন্দ্রিয়ের দ্বারা আমরা পাঁচ রকমের অনুভূতি সংগ্রহ করে থাকি। আমাদের জ্ঞানীন্দ্রিয় পাঁচটি। - চক্ষু, কর্ন, নাসিকা জিহ্বা ত্বক - অর্থাৎ দর্শন-শ্রবণ-ঘ্রান-স্বাদ-স্পর্শ -ইন্দ্রিয়। এই পাঁচটি ইন্দ্রিয় আবার একাধিক কাজ করে থাকে। যেমন -
চোখ - যেমন দেখে, তেমনি আলো বা বর্ণের গ্রাহক হিসেবে কাজ করে থাকে।
কান - যেমন আমাদের শুনতে সাহায্য করে থাকে, তেমনি আমাদের দেহের ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে এই কান।
নাক - যেমন ঘ্রান অনুভব করে, তেমনি আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস কাজে সাহায্য করে থাকে।
জিহ্বা - যেমন স্বাদ গ্রহণ করে, তেমনি কথাবলা, এবং খাদ্যকে গলাদ্ধকরন করতে সাহায্য করে এই জিহ্বা।
ত্বক বা চামড়া - যেমন স্পর্শ অনুভবে সাহায্য করে, আবার শীত-তাপ অনুভব করে চামড়া। ব্যাথা ও চাপ অনুভব করে। দেহের কোমল পেশিকে রক্ষা করে থাকে এই চামড়া। ঘাম নিঃসরণ, দেহের তাপ নিয়ন্ত্রণ, এমনকি দেহ থেকে দূষিত পদার্থ নির্গত করতে সাহায্য করে এই ত্বক।
এই পাঁচটি প্রধান ইন্দ্রিয় ছাড়াও, প্রাণী দেহের বিশেষ কোনো অঙ্গ ইন্দ্রিয়রূপে কাজ করে থাকে যেমন, মাছের দেহের দুই পার্শে কানকোর পিছনে ছোট্ট ছোট্ট দুটো পাখা থাকে, এর সাহায্যে মাছ জলের চাপ, তাপ , গভীরতা, এমনকি দেহের ভারসাম্য রক্ষায়, ও আত্মরক্ষায় সাহায্য করে থাকে। এছাড়া আরশোলার সুর, বিড়ালের গোফ, শামুকের কর্ষিকা এগুলোকে বিশেষ ইন্দ্রিয় বলা হয়ে থাকে। এই সমস্ত ইন্দ্রিয়ের কাজ হচ্ছে, পরিবেশ থেকে বিশেষ বিশেষ উদ্দীপনা গ্রহণ করা, ও নির্দিষ্ট স্নায়ুপথে স্নায়বিক কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া।
এখন আমরা শুনে নেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলতে আমরা কি বুঝি ? আমাদের ধারণা হচ্ছে, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হচ্ছে
এমন একটা বিশেষ ইন্দ্রিয় যা আমাদের আগাম খবর এনে দিতে পারে, যে ইন্দ্রিয় অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলোর মতো দৃষ্টিগোচর নয়। আবার যা আমাদের সবার থাকে না। কিন্তু সত্য হচ্ছে, এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমাদের সবার আছে। কারুর সেটি বেশি সক্রিয়, আবার কারুর সেটি নিস্পৃহ।
বিজ্ঞান বলছে, আমরা সবাই এক একজন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। বিজ্ঞানের ভাষায় বলে প্রো-প্রায়োসেপশন। অর্থাৎ অনুমানের সাহায্যে আগাম জ্ঞান। আমরা আগেই শুনেছি, এই ক্ষমতা আমাদের সবার আছে। আর এই ক্ষমতা যদি আমাদের না থাকতো, তবে আমরা আমাদের নিজেদের সম্পর্কে একটা বিভ্রান্তিতে ভুগতাম। এমনকি আমাদের অবস্থান সম্পর্কেও আমাদের কোনো ধারণা করতে পারতাম না। অর্থাৎ আমি যে আছি, এটা আমাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের কাজ। ফুল ফুটলে আমরা বলতে পারি, ভবিষ্যতে ফল হবে। রেলগেটের সিগন্যাল লাল হলে আমরা বুঝতে পারি, এখন ট্রেন আসবার সময়। মেঘ দেখলে আমরা বলতে পারি, বৃষ্টি আসতে পারে। এই যে আগাম আভাস একেই বলে সিক্সথ সেন্স, বা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। আপনি বলতে পারেন, এটি আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলে থাকি। ঠিক পূর্ব-অভিজ্ঞতা থেকেই জন্ম নেয়, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। আপনি নিশ্চয় জানেন, আমাদের শরীরে কিছু অং আছে, যা নিষ্ক্রিয়। অর্থাৎ তার কি কাজ তা আমরা জানিনা, যেমন এপেন্ডিসাইটিস। এপেন্ডিসাইটিসের কাজ আজও চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে পারেন নি। আবার এই শাস্তি ইন্দ্রিয়ের অবস্থান সম্পর্কেও আমাদের বিজ্ঞান কিছু বলতে পারে নি। কিন্তু এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমাদের একটা সারভাইভাল সিস্টেম অর্থাৎ বেঁচে থাকবার কৌশল, আগাম বিপদের আভাস দিয়ে, আমাদেরকে সতর্ক করে থাকে এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় । এই প্রক্রিয়া যদি আমাদের না থাকতো, তবে আমাদের পদে পদে বিপদ আসতো, আর আমরা অকালে মারা যেতাম। অর্থাৎ আমার অবস্থান ও বিপদের অবস্থান সম্পর্কে বিশেষ ধারণা এনে দেয় এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। একজন মানুষের বুদ্ধি, মেধা, পরিশ্রম, টাকাপয়সা, বাড়ি গাড়ি যাই থাকুক না কেন, Intuition বা স্বজ্ঞা বা আগাম অনুমান করবার ক্ষমতাই একজন মানুষের থেকে আর একজন মানুষের মধ্যে পার্থক্য সূচিত করে। এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যার যত সজাগ, সে তত এগিয়ে যেতে পারে।
কোথায় থাকে ?
ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি-র একটা গবেষণা বলছে, আমাদের ব্রেনের মাঝখানে একটা সেন্টার থাকে এন্টিরিয়াল স্টিম্যুরিয়াল কর্টেক্স, যা আমাদের মনের সাথে সম্মিলিত ভাবে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের কার্যকলাপ করে থাকে। যদিও এই ব্যাপারে শেষ কথা বলবার সময় এখনো আসেনি।
যাই হোক, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়শক্তি আমাদের সবার মধ্যে এমনকি সমস্ত জীব-জন্তুর মধ্যেই কম বেশি আছে। এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ই আমাদেরকে "আমি" হিসেবে সব কিছু থেকে আলাদা করেছে। কিন্তু গবেষকগণ বলছেন, যাদের এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অতিরিক্ত শক্তিশালী, তাদের মধ্যে কিছু অদ্ভুত চরিত্র-লক্ষণ দেখা যায়। এরা নিজেদেরকে সবার থেকে আলাদা করে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে থাকে। এরা সবার থেকে নিজেকে আলাদা করে ভাবে। এরা নিজেদের মধ্যে একটা ধ্বনি শুনতে পান। কেউ কেউ মনে করেন, তাদের কাছাকাছি অশরীরী কেউ একজন ঘুরে বেড়ান। এবং নির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে এই অশরীরীর কাছ থেকে নির্দেশ আসে। এইসব মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সৃজনশীল হয়ে থাকেন। এরা নির্জনতা পছন্দ করেন। সমস্ত কিছু এরা খুঁটিয়ে দেখেন। অর্থাৎ তাদের অনুসন্ধানী মন। শরীরের বিভিন্ন অনুভূতি সম্পর্কে খুব সতর্ক ও অনুভূতিশীল। এরা বাহ্যিক নিয়মের ধার ধারেন না। কঠোর বিশ্বাস এদের ঝুঁকি নিতে সাহায্য করে থাকে।
কিভাবে অর্জন করা যায় ?
বিজ্ঞানীগন এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের প্রবল অধিকারী সম্পর্কে কারন খুঁজতে গিয়ে দেখেছেন, এরা সাধরনত ছোটবেলায়, কোনো চাইল্ড-হুড ট্রমাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। গভীর কোনো সমস্যার মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে। এতে করে তাকে অতিরিক্ত উদ্বেগের মধ্য সময় কাটাতে হয়েছে। জীবনে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিলো। ফলতঃ যেকোনো ছোটোখাটো বিষয়ে তাদের মধ্যে টেনশন হয়, এবং ঘটনার গভীরে স্বাভাবিক ভাবেই প্রবেশ করে। সব কিছুর মধ্যে সে একটা সাযুজ্য দেখতে পায়। সন্দেহপ্রবন বা বলা যেতে পারে অনুসন্ধিৎসু মন হয় এদের। অর্থাৎ আগের কোনো অবাঞ্চিত ঘটনার সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নিতে চায়। এরা অনেকবেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়। নিজেকে সবার থেকে স্বতন্ত্র ভাবে। এদের স্মৃতিশক্তি গভীর হয়। অর্থাৎ যেকোনো ঘটনায় সে নিজেকে গভীরভাবে জড়িয়ে ফেলে। আর এই গভীর স্মৃতি অর্থাৎ কোনো ঘটনাকে তারা বিশ্লেষণ করে তার পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। যেকোনো ঘটনার মধ্যে সে একটা নঞৰ্থক দিক খুঁজে নিতে পারে । ফলতঃ ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যাদের প্রবল, তারা আগাম বিপদের আভাস দিতে সক্ষম হয়। যদিও এই শক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার, অনাবশ্যক ভীতির সৃষ্টি করে। এদের অবচেতন মন বর্তমান ঘটনার সঙ্গে পুরনো ঘটনার সাযুজ্য খোঁজে। এতে যেমন বিপদ থেকে সে নিজেকে রক্ষা করতে পারে, তেমনি, এই নঞৰ্থক চিন্তা সেই দুর্ঘটনাকে বাস্তবে পরিণত করতে সাহায্য করে। এখানেই তার সাফল্য । আবার এটা আমাদের পক্ষে ক্ষতিকর। আমাদের দেশে মেয়েদের মধ্যে এই শক্তির প্রাবল্য বেশী। কারন এদের মধ্যে অসুরক্ষার, অনিশ্চয়তার মাত্রা অনেক বেশি। তাই তাদের পর্যবেক্ষন ক্রিয়া গভীর ও সন্দেহ প্রবন মন নিয়ে করে থাকে । আর এতে করে তারা সহজেই মানুষ চিনতে পারে। ভবিষ্যৎ অমঙ্গল সম্পর্কে সচেতন হতে পারে।
ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নিয়েই আমরা সবাই জন্মাই ।
"আমি-আমার" এই বোধ আমাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের কাজ। তাই জন্ম থেকেই "আমি-সত্তা", আমাদের মধ্যে কাজ শুরু করে দেয়। এছাড়া, কার কোথায় অবস্থান, সেটাও এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ঠিক করে দেয়। যেমন শব্দ কোথা থেকে আসছে, সম-মানসিকতার, বা ভালোবাসার মানুষকে চিনে নেওয়া, খাদ্য বা মায়ের দুধের প্রতি আকর্ষণ এটা আমাদের জন্মগত। অর্থাৎ পূর্ব-পূর্ব জীবনের অভিজ্ঞতার নিরিখে স্বাভাবিক ভাবেই, আমার জাতি অনুযায়ী কিছু আগাম জ্ঞান আমাদের অবচেতন মনে সঞ্চয় হয়ে থাকে ।
এই ভবিষ্যৎ ঘটনা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের ক্ষমতা যেমন আমাদের জন্মগত, তেমনি এই ক্ষমতা আমরা অর্জনও করতে পারি। আর দুই ভাবে আমাদের জ্ঞান অর্জন হয়ে থাকে। এক, কোনো কিছুকে সচেতন ভাবে শেখা। আর একটা হচ্ছে অজান্তে শেখা। আমরা কারুর হাসি দেখে বুঝতে পারি, সে ব্যাঙ্গের হাসি হাসছে, না ক্রূর হাসি, না ভালোবাসার হাসি। আমরা কারুর চোখ দেখে বুঝতে পারি, সে রেগে আছে কি না। এগুলো আমরা আমাদের অজান্তেই শিখেছি। এর জন্য আমাদের কোনো প্রশিক্ষণ নিতে হয় না । আবার গুরুজনদের কাছ থেকে শুনে বা বই পড়ে, আমরা অনেক জ্ঞান সংগ্রহ করে থাকি, যা আমাদের ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে আগাম সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সাহায্য করে থাকে। যেমন হিংস্র জীব-জন্তু থেকে নিজেকে আড়াল করতে হবে। আগুন থেকে, রোদ-বৃষ্টি থেকে কিভাবে আমরা বাঁচবো, সেটা আমরা সচেতন ভাবে শিখি। এই সমাজে কিসে ভালো হবে, কিসে মন্দ হবে, তা আমাদের গুরুজন শিখিয়ে দেন।
সাধারণ ভাবে, আমরা যাকে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়র কাজ বলতে বুঝি, তা আর কিছু নয়, ভবিষ্যৎ ঘটনার আগাম আভাস। এটা আমাদের যেমন জন্মগত তেমনি আমাদের অর্জিত। এই অর্জিত ক্ষমতা দুই ভাবে হতে পারে, এক হচ্ছে বাধ্য হয়ে প্রতিকূল পরিবেশে যারা মানুষ হয়েছেন, জীবনে যাদের বহু আকস্মিক বিপদের মধ্যে দিয়ে আসতে হয়েছে, তাদের মধ্যে আশঙ্কার মাত্রা থাকে তীব্র। তাই তারা যে কোনোকিছু, গভীর বিশ্লেষণাত্মক মন নিয়ে দেখেন। আর বিষয়ের গভীরে যখন তারা ঢোকেন, তখন তারা বিষয়ের ভূত-ভবিষ্যৎ দেখতে পান। কিন্তু যেহেতু এরা নঞৰ্থক উদ্দেশ্য নিয়ে ঘটনার বিশ্লেষণ করে থাকেন, তাই তারা আগাম বিপদের সংকেত দিতে পারেন। কিন্তু সব ক্ষেত্রে তা ঠিকও হয় না।
আর একটা হচ্ছে, যারা মন নিয়ে কাজ করেন, অর্থাৎ ধ্যানাদিতে লিপ্ত থাকেন, এবং পবিত্র জীবন যাপন করেন, পবিত্র মনের অধিকারী, যারা অষ্টাঙ্গ যোগের পালন করে থাকেন, নির্জনে বাস করেন, তারাই বিষয়ের প্রকৃত ভূত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সম্যক ধারণা করতে পারেন। তারাই প্রকৃত ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বা স্বজ্ঞা এদের সব থেকে শক্তিশালী। সাধন জীবনে যারা খানিকটা অগ্রসর ব্যক্তি, তাদের মধ্যে এই ক্ষমতা স্বাভাবিক ভাবেই এসে থাকে। তাই আমরা দেখে থাকি, জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে, তারা অনেক কথা বলেন, যা তারা নিজেরাই জানেন না, কেন বললেন। আর এইসব ক্ষমতার কোনো কার্য্য-কারন সম্পর্ক সন্মান্ধেও তারা জ্ঞাত নন। সাধন যোগে যারা সমাধিস্থ বা কৈবল্য লাভ করেছেন, তাঁদের মধ্যে এই ক্ষমতার স্ফূরণ বেশি হয়ে থাকে।
একদম শেষে দুটো কথা বলি, যা দিয়ে শুরু করেছিলাম। এক হচ্ছে - বিড়াল কিভাবে বাড়ি ফেরে, বিড়ালদের গোফ বিশেষ ইন্দ্রিয়ের কাজ করে থাকে। সে তার প্রতিমুহূর্তের অবস্থান বুঝতে পারে এই গোভের সাহায্যে, তাই তার চোখ বন্ধ থাকলেও, নতুন অবস্থান থেকে পুরুনো অবস্থানে যেতে তার কোনো অসুবিধা হয় না। কাউকে দেখে ভালো লাগা বা না লাগা এটাও আমাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের কাজ। ভালোবাসার মানুষের ভালো-মন্দ অনুভূতি নিজের শরীরে জেগে ওঠা, এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের কাজ।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
No comments:
Post a Comment