সর্ব্বম্ খলু ইদম্ ব্রহ্ম (ছান্দোগ্য উপনিষদ - ৭-ম অধ্যায়)
ওম আপ্যায়ন্তু মম অঙ্গানি বাক-প্রাণশ্চক্ষুঃ শ্রোত্রম অথো
বলম-ইন্দ্ৰিয়ানি চ সর্বাণি। সর্বং ব্রহ্মৌপনিষদম। মাঽহং
ব্রহ্ম নিরাকুর্যাং, মা মা ব্রহ্ম নিরাকরোৎ ;
অনিরাকরণমস্তু, অনিরাকরণং মেঽস্তু। তদাত্মনি নিরতে
য উপনিষৎসু ধর্মাস্তে ময়ি সন্তু, তে ময়ি সন্তু। ।
ওং শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।
পর্ব্ব - এক :
আমরা এখন ঘরবন্দি। আসুন উপনিষদের গল্প শুনি। আসলে বেদ যেন দুগ্ধবতী মাতাগাভি, আর উপনিষদ হচ্ছে দুগ্ধ। ব্রহ্মাপুত্র নারদ মহামুনি সনৎকুমারের কাছে গিয়ে একদিন বললেন, আমাকে শিক্ষা দিন। তো সনৎকুমার বললেন, তুমি যা জান তা আমাকে বলো, তারপর আমি তোমাকে বলবো। শিক্ষা দানের এটাই রীতি। তুমি যা জান তা আগে আমাকে বলো। তাহলে শিক্ষক বুঝতে পারবেন, ছাত্র কতদূর এগিয়ে আছে। এবং তারপর সেখান থেকে তাকে শেখাতে পারবেন।
তো নারদমুনি বললেন, আমি বেদ অধ্যায়ন করেছি, ব্যাকরণ অধ্যায়ন করেছি। গণিতশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্র, ভূতত্ত্ববিদ্যা, কলাবিদ্যা - এসব আমি জানি, পড়েছি। কিন্তু সত্য যা তা হচ্ছে, এইসব বইয়ের শব্দার্থ আমি জানি, কিন্তু আত্মাকে জানি না। আমি মহাত্মাদের কাছে শুনেছি, যাঁরা আত্মাকে জেনেছেন, তাঁরা শোকগ্রস্ত হন না। আমি শোকগ্রস্ত, আপনি আমাকে শোকের পরপারে নিয়ে যান। নারদ বিভিন্ন শাস্ত্র-বিদ্যা আয়ত্ত্ব করেছেন , এবং এতে করে তিনি বুঝতে পেরেছেন, আত্মজ্ঞান না হলে অর্থাৎ আত্মাকে না জানলে এই শাস্ত্রবিদ্যা অর্থ হীন। আসলে এই বোধ যতক্ষন না হয় - অর্থাৎ আত্মাকে না জানলে শোকের পরপারে যাওয়া যায় না - এই বোধ যতক্ষন না হয়, ততক্ষন আমরা শোকগ্রস্তই থাকবো। এই বোধ জাগা দরকার। আর সেটা শাস্ত্র অধ্যানের মাধ্যমেই হতে পারে। নারদের সেটা হয়েছে। তাই তিনি সনৎকুমারের কাছে এসেছেন, আত্মজ্ঞান লাভ করার বিদ্যা আয়ত্ত্ব করতে। আমরা ছোটবেলায় শুনতাম - লক্ষ্মী ও সরস্বতী এক জায়গায় থাকেন না। অর্থাৎ সনাতন যে বিদ্যা তা আমাদের অর্থ লাভের সহায়ক হয় না। পরবর্তী কালে এই শিক্ষার পরিবর্তন হয়েছে। তখন বলা হতো, লেখাপড়া করে যেই, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সেই। অর্থাৎ লেখাপড়া করে, অর্থ উপার্জন করা যায়। কিছু দুষ্টু মানুষ এটাকে বিকৃত করে বলতো, লেখাপড়া করে যেই, গাড়িচাপা পড়ে সেই। অর্থাৎ লেখাপড়া করে কিছুই হবার নয়, বরং এইসব চিন্তা করতে করতে বাস্তব জীবনে বিপদ ডেকে আনতে পারে। সত্যটা কিন্তু লুকিয়ে আছে এখানেই। সত্যিকারের জ্ঞান আমাদের জ্ঞানতৃষ্ণা বাড়িয়ে দেয়। আমরা তখন শাস্ত্র অধ্যায়ন থেকে মনন করতে শুরু করি। আসলে অপরা বিদ্যা হচ্ছে নিকৃষ্ট জ্ঞান আর পরা বিদ্যা হচ্ছে উৎকৃষ্ট জ্ঞান। মহর্ষি নারদ তাই বললেন, এইসব শাস্ত্র পড়ে আমি কেবলমাত্র শব্দার্থ জানতে পেরেছি, আত্মজ্ঞান লাভ করতে পারিনি। এবং শোকগ্রস্ত হয়ে আছি।
সনৎকুমার বললেন, তুমি এত দিন যা শিখেছো, তা "নাম" মাত্র। নামমাত্র কথাটার দুটো অর্থ, একটা হচ্ছে কিঞ্চিৎ আর একটা হচ্ছে, প্রত্যেক বস্তুর একটা প্রতীকি নাম আছে, এমনকি গুণেরও একটা প্রতীকি নাম আছে। শাস্ত্রে যা আছে, বা পুস্তকে যা আছে, তাই এই নাম মাত্র। আর এই নাম তৈরি হয়েছে বর্ণমালা দিয়ে। তুমি এই নামের উপাসনা করো, অর্থাৎ শাস্ত্রে যা লেখা আছে, তা অর্থ বুঝবার চেষ্টা করো। অর্থ বুঝবার পরে, অর্থ অনুধাবন করো। অর্থ অনুধাবন করে, বিষয়ের মধ্যে প্রবেশ করো। যদি তুমি এই নাম-ব্রহ্মর উপাসনা করো, তবে তুমি নামের গতি যতদূর, ততদূর তুমি ইচ্ছে অনুযায়ী যেতে পারবে।
তো নারদ ভাবলেন, সে না হয় বুঝলাম, নামের থেকে শ্রেষ্ট কি কিছু আছে? কেননা শাস্ত্র আমাদের শিক্ষা দেয়, অনুভূতি দেয় না। শাস্ত্র অনুশাসন দেয় কিন্তু তা পালন করবার শক্তি দেয় না। তাই বললেন, নামের থেকে শ্রেষ্ঠ কিছু আছে কি ? সনৎকুমার বললেন, নাম অপেক্ষা বাক শ্রেষ্ঠ। আমাদের বাগিন্দ্রিয় আছে বলেই আমরা কথা বলতে পারি। আমাদের মধ্যে বাকশক্তি আছে বলেই, আমরা সব কিছুকে প্রকাশ করতে পারছি। যদি আমাদের বাকশক্তি না থাকতো তবে, সত্য-অসত্য ধর্ম্ম-অধর্ম্ম ভালো-মন্দ কিছুই প্রকাশ করতে পারতাম না। অতএব তুমি বাকের উপাসনা করো। বাককে উপাসনা করলে, বাক্যের গতি যতদূর, ততদূর তুমি ইচ্ছে করলেই যেতে পারবে।
তো নারদ ভাবলেন, শব্দের গতি তো সীমাবদ্ধ, তো এই সীমাবদ্ধ-শক্তির থেকে শ্রেষ্ঠ কিছু আছে কি ? মহামুনি সনৎকুমার বললেন, বাক ও নাম দুটোই গুরুত্ত্বপূর্ন, কিন্তু এরাই সব নয়। এর দ্বারা আমরা বেশিদূর এগুতে পারি না। মন বাক অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। মন-ই বাক ও নামকে ধরে রাখে। মন না চাইলে বাক-নাম কোনো কাজ করতে পারে না। তাই হে মহাত্মা নারদ তুমি মনের উপাসনা করো। যিনি মনকে উপাসনা করেন, তিনি মনের যতদূর গতি, ততদূর তিনি স্বছন্দে তিনি যেতে পারেন।
নারদ জিজ্ঞেস করলেন, মন থেকে শ্রেষ্ঠ কিছু আছে কি ? সনৎকুমার বললেন, হ্যাঁ মন থেকে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে সংকল্প বা ইচ্ছাশক্তি। মানুষ আগে সংকল্প করে, তরপর মনের সাহায্যে চিন্তা করে, তারপরে বাককে পরিচালিত করে থাকে। সবশেষে বাক নাম উচ্চারণ করতে প্রবৃত্ত হয়। সমস্ত মন্ত্র নামে এবং সমস্ত কর্ম্ম মন্ত্রে একীভূত হয়। নাম, বাক, মন এগুলো সবই সংকল্পে লয় প্রাপ্ত হয়। দ্যুলোক-ভূলোক সংকল্প করেছিল, বায়ু-আকাশ সংকল্প করেছিল, জল-তেজ সংকল্প করেছিল। তাই এঁরা নিজ নিজ কাজ করে যাচ্ছে। এদের সঙ্কল্পেই বৃষ্টি সংকল্প করে, আবার বৃষ্টির সংকল্পে অন্ন সংকল্প করে। অন্যের সংকল্পে সমস্ত প্রাণ সংকল্প করে। প্রাণের সঙ্কল্পেই মন্ত্র সংকল্প করে, মন্ত্রের সংকল্পে কর্ম্ম সংকল্প করে, কর্ম্মের সংকল্পে কর্ম্মফল অর্থাৎ স্বর্গ-নরক সংকল্প করে। কর্মফলের সংকল্পে সমস্ত জগৎ সংকল্প করে থাকে। হে নারদ তুমি সংকল্পের উপাসনা করো। যিনি সংকল্পের উপাসনা করেন, তিনি নিজে ধ্রুব হয়ে ধ্রুবলোক প্রাপ্ত হন। যিনি সংকল্পের উপাসনা করেন, তিনি সংকল্পের যতদূর গতি, ততদূর তিনি ইচ্ছে করলে যেতে পারেন।
তো নারদ বললেন, সংকল্পের থেকে শ্রেষ্ঠ কিছু আছে কি ? সনৎকুমার বললেন, সংকল্পের চেয়ে চিত্ত (বুদ্ধি) অবশ্য়ই শ্রেষ্ঠ। একটু ভেবে দেখো, মানুষ প্রথমে অনুভব করে, তারপরে সংকল্প করে, তারপর বিষয়টির উপরে বার বার চিন্তা করে থাকে। পরে, বাকশক্তি প্রয়োগ করে, এবং নাম উচ্চারণ করে থাকে। চিত্তই সংকল্প-মন প্রভৃতির গতি। চিত্ততেই এদের প্রতিষ্ঠা। কোনো মানুষ যতই জানুক না কেন, বিচার-বুদ্ধি না থাকলে তাকে নির্বোধ বলা হয়ে থাকে। আবার কেউ যদি অল্পও জানে, কিন্তু যদি বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন হয়, তবে তার কথা লোকে শ্ৰদ্ধার সঙ্গে শুনতে চায়। এই চিত্তই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সুতরাং হে নারদ তুমি, চিত্তের উপাসনা করো। চিত্তকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করো। তবে তুমি ধ্রুব-লোকে ব্যথাশূন্য হয়ে ব্যথা-রোহিত লোকের বাসিন্দা হতে পারবে। এবং চিত্তের গতি যতদূর, ততদূর তুমি ইচ্ছে করলে যেতে পারবে।
মহাত্মা নারদের যেন নেশা পেয়ে গেছে। নারদ আবার বললেন, চিত্ত থেকে শ্রেষ্ঠ কিছু আছে কি ? যদি থাকে অনুগ্রহ করে, আমাদে সেই বিষয় সম্পর্কে শিক্ষা দান করুন। মহামুনি সনৎকুমার বললেন, চিত্ত থেকে ধ্যান অবশ্যই শ্রেষ্ঠ। দেখো, পৃথিবী ধ্যান-মগ্ন। দ্যুলোক - অন্তরীক্ষ লোক ধ্যানমগ্ন। দেবতা এমনকি মহৎ মনুষ্যগণ ধ্যানমগ্ন। এমনকি পাহাড় -সমুদ্র সবাই ধ্যান-মগ্ন। আর এই ধ্যানের ফলেই সবাই মহত্ত্ব লাভ করেছেন। যারা শ্রেষ্ঠ তারা সর্বদা ধ্যান অভ্যাস করেই শ্রেষ্টত্ত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন। সুতরাং তুমি ধ্যানের উপাসনা করো। যিনি ধ্যানকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, তিনি ধ্যানের গতি যতদূর, ততদূর পর্যন্ত ইচ্ছে করলে যেতে পারেন।
নারদ আবার বললেন, ধ্যানের থেকে শ্রেষ্ঠ আরো কিছু আছে নিশ্চয়ই। আপনি আমাদের সেই শ্রেষ্ঠ সম্পর্কে কৃপা করে, শিক্ষা দান করুন। সনৎকুমার বললেন, ধ্যান থেকে বিজ্ঞান শ্রেষ্ঠ। শাস্ত্রের মর্মার্থ উপলব্ধি করাই বিজ্ঞান। দেখো যা কিছু অজ্ঞাত তা জানতে গেলে বিজ্ঞানের সাহায্যেই তা সম্ভব। তা সে পার্থিব বস্তু বলো, বা অপার্থিব বস্তু বলো। অপরা এমনকি পরাবিদ্যাও একমাত্র বিজ্ঞানের সাহায্যেই অনুধাবন করা যেতে পারে। অতএব বিজ্ঞানের উপাসনা করো। যিনি বিজ্ঞানকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, তিনি জ্ঞানময় ও বিজ্ঞানময় লোকসমূহ লাভ করে থাকেন। আর এর ফলে বিজ্ঞানের যতদূর গতি, ইচ্ছে করলে, তিনি ততদূর পর্যন্ত যেতে পারেন।
নারদ বলছেন, বিজ্ঞানের থেকে শ্রেষ্ঠ কিছু আছে কি ? সনৎকুমার বলছেন, হ্যাঁ অবশ্য়ই আছে, আর তা হচ্ছে বল বা শক্তি। একজন শারীরিক, মানসিক ও বৌদ্ধিক দিক থেকে বলবান ব্যক্তি, উদ্দমশালী হতে পারে। বলহীন অর্থাৎ শক্তিহীন ব্যক্তির পক্ষে না পার্থিব জগতে না আধ্যাত্মিক জগতে - কোথাও সে সার্থক হতে পারে না। এমনকি তুমি যদি স্নায়ুবিক দুর্বল-ব্যক্তি হও তবে, শাস্ত্রের অর্থও বুঝতে পারবে না। বল-ই সবকিছুর আশ্রয়। তাই হে নারদ তুমি বলের উপাসনা করো। বাস্তবিক পক্ষে সমস্ত প্রকৃতি, সবাই যে যার নিজের শক্তিতেই চলছে। এই শক্তি বাইরে থেকে ধার করা নয়। ঠিক তেমনি আত্মজ্ঞান লাভ করা যদি কারুর উদ্দেশ্য হয়, তবে তাকে অবশ্য়ই সমস্তদিক থেকে বলশালী হতে হবে। শক্তিহীনের প্রকৃতিতেও স্থান নেই। তাই হে নারদ, তুমি ব্রহ্মকে শক্তিরূপে উপাসনা করো। তাহলে তুমি ইচ্ছে করলে, বলের যতদূর গতি, ততদূর তুমি যেতে পারবে।
নারদ বলছেন : বল থেকে শ্রেষ্ঠ কি কিছু আছে ? মহামুনি সনৎকুমার বললেন : হ্যাঁ বল থেকে অন্ন শ্রেষ্ঠ। আমাদের শারীরিক শক্তি এই অন্নের আশ্রয়ে থাকে। যিনি অন্নকে ব্রহ্ম রূপে উপাসনা করেন, তিনি অন্নের গতি যতদূর, তিনি ততদূর ইচ্ছে করলে যেতে পারেন।
নারদ জিজ্ঞেস করলেন, অন্ন থেকে শ্রেষ্ঠ কিছু আছে কি ? যদি থাকে আপনি কৃপা করে তা আমাকে বলুন। সনৎকুমার বললেন, অন্ন থেকে শ্রেষ্ঠ জল। জল-বিনা প্রাণের উৎপত্তি হতে পারে না। শুধু প্রাণ নয়, অন্নও উৎপাদন হতে হতে পারে না। বৃষ্টি না হলে, ফসল হবে না। আর জল-বৃষ্টি ভালো ভাবে হলে অন্নের অভাব হবে না। আবার অন্নহীন প্রাণী কিছুদিন হলেও বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু জলবিনা মানুষ বাঁচতে পারে না। অতএব তুমি ব্রহ্মরূপে জলের উপাসনা করো। জলকে যিনি ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, তার সকল বাসনা চরিতার্থ হয়, তিনি সুখী হন।
নারদ বললেন, জলের থেকে শ্রেষ্ট কিছু আছে কি ? সনৎকুমার বললেন, জলের থেকে শ্রেষ্ট হচ্ছে তেজ। তেজ বায়ুর সাহায্যে আকাশকে তপ্ত করে থাকে। তেজই জলকে উর্দ্ধগামী করে, আবার তেজই বৃষ্টিরূপে নিম্নগামী করে। ফলে অন্নের সৃষ্টি হতে পারে। আসলে অগ্নিই জলরূপে নিজেকে প্রকাশ করে থাকে। তাই হে নারদ তুমি তেজকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করো। যিনি তেজকে ব্রহ্ম রূপে উপাসনা করেন, তিনি তেজের গতি যতদূর, তিনি ততদূর ইচ্ছে করলে যেতে পারেন।
আসলে মহামুনি সনৎকুমার নারদের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন। ধীরে ধীরে স্থুল থেকে সূক্ষ্ম জ্ঞানের পথে আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন। আমরা তো স্থুলেই আছি। তো আমাদের যাত্রা শুরু করতে গেলে স্থূল থেকেই শুরু করতে হবে। কিন্তু সত্য সূক্ষ্মে প্রতিষ্ঠিত। সেই ধারণা আমরা করতে পারি না। কিন্তু আমাদের যদি ধীরে ধীরে স্থূল বিষয়ের প্রতি গভীর মনোনিবেশ করি, তবে স্থূলের মধ্যেই আমরা সূক্ষ্মের খেলা বুঝতে পারবো। পরবর্তীতে আমরা আরো গভীরে প্রবেশ করবো। মহর্ষি নারদ ও মহামুনি সনৎকুমার -এর আলোচনা শুনবো। আজ বাক্যের বিরাম দিলাম।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
সর্ব্বম্ খলু ইদম্ ব্রহ্ম (ছান্দোগ্য উপনিষদ - ৭-ম অধ্যায়) পর্ব্ব - দুই
আমরা শুনছিলাম উপনিষদ থেকে ব্রহ্মকথা। আমরা শুনছিলাম মহর্ষি নারদ ও মহামুনি সনৎকুমারের ব্রহ্মবিষয়ক আলোচনা। আমরা এর মধ্যে শুনেছি, শাস্ত্র হচ্ছে কতিপয় মন্ত্রের সমাবেশ মাত্র। শাস্ত্রে যা আছে, তা বর্ণমালায় গ্রথিত নাম মাত্র। নামের চেয়ে শ্রেষ্ট হচ্ছে বাক, বাকের চেয়ে শ্রেষ্ট হচ্ছে মন, মনের চাইতে শ্রেষ্ট হচ্ছে সংকল্প, সংকল্পের চাইতে শ্রেষ্ট হচ্ছে চিত্ত। চিত্ত থেকে ধ্যান - ধ্যান থেকে বিজ্ঞান , বিজ্ঞান থেকে বল বা শক্তি ; শক্তি থেকে অন্ন, আবার অন্ন থেকে জল, জল থেকে তেজ শ্রেষ্ঠ। এবার আমরা আবার আলোচ্য বিষয়ে ফিরে যাবো।
আমরা শুনছিলাম তেজের শ্রেষ্ঠতার কথা। প্রাচীন কাল থেকেই, সমস্ত বিশ্বে অগ্নিদেবতার পূজা শুরু হয়েছিল। এটা কেউ কাউকে দেখে শুরু করে নি। মানুষের ভিতর থেকেই মনে হয়েছিল, অগ্নির গতি উর্দ্ধমুখী, অগ্নি সবকিছুকে শুদ্ধ করতে পারে। অগ্নি উজ্জ্বল, অগ্নি বলশালী, অগ্নি তেজস্বী, অগ্নি দীপ্যমান। অগ্নি আমাদের জীবনের উৎস। সূর্যই পারে, মাটির মধ্যে গ্রথিত বীজের মধ্যে যে সম্ভাবনা আছে, তাকে জাগ্রত করতে। মানুষের মধ্যে যিনি তেজস্বী তিনিই পারেন, অসম্ভবকে সম্ভব করতে। অগ্নি আমাদেরকে শুদ্ধ-পবিত্র করতে পারে। অগ্নি সবকিছুকে প্রকাশ করে থাকে। অগ্নি মলিনতাকে দূর করতে পারে। তাই আমরা সবাই জ্যোতির ধ্যান করে থাকি। অগ্নি জ্ঞানের প্রতীক। তমসো মা জ্যোতির্গময়। অন্ধকার থেকে যারা আলোতে যেতে চান, তাদের জ্যোতির সাহায্য নিতে হয়। আচার্য্য সনৎকুমার ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসু নারদকে আত্মজ্ঞানের দিকে নিয়ে চলেছেন।
ঋষিবর সনৎকুমার বলছেন, তেজের থেকে আকাশ শ্রেষ্ঠ। দেখো, সূর্য-চন্দ্র-নক্ষত্রবৃন্দ-অগ্নি-বিদ্যুৎ আকাশকেই আশ্রয় করে থাকে। আকাশের সাহায্যেই একে অপরকে আহ্বান করে থাকে, আকাশের সাহায্যেই শোনে। আকাশের মধ্যেই জীবের জন্ম হয়। শুধু জীব কেন, বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড আকাশেই স্থিত। আকাশই সব কিছুর আধার। অগ্নি আকাশের দিকে ধাবিত হয়। বৃক্ষ-লতা আকাশেই বেড়ে ওঠে। হে নারদ তুমি আকাশের উপাসনা করো। আকাশই আমাদের জন্ম-বৃদ্ধি ও মৃত্যুকালীন আশ্রয়। তুমি ব্রহ্মরূপে আকাশের উপাসনা করো। যিনি আকাশকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করে থাকেন, তিনি সীমাহীন, বাধাহীন, জ্যোতির্ময় লোকসুমহ লাভ করে থাকেন। এবং আকাশের গতি যতদূর, তিনি ইচ্ছে করলে, ততদূর পর্যন্ত যেতে পারেন।
জিজ্ঞাসু নারদের আজ যেন জিজ্ঞাসার শেষ নেই, তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আকাশের থেকে শ্রেষ্ঠ কিছু আছে কি ? আচার্য্যদেব সনৎকুমার বললেন, হ্যাঁ আছে বৈকি, আর তা হচ্ছে স্মৃতি। আকাশের থেকে স্মৃতি শ্রেষ্ট। স্মৃতির দ্বারাই আমরা একে অপরকে চিনতে পারি। যার স্মৃতি নেই তার শ্রবণও নেই। যার স্মৃতি নেই, সে অন্যের কথাও বুঝতে পারে না। স্মৃতির সাহায্যেই আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের, মা-বাবাকে চিনতে পারি। এমনকি এই যে আমি একটা ধারাবাহিকতা রেখে চলেছি, সেটিও আমরা স্মৃতির সাহায্যে বুঝতে পারি। ছোটবেলার আমি আর বৃদ্ধ আমি যে একই আমি তা আমরা স্মৃতির সাহায্যেই বুঝতে পারি। আমরা স্মৃতিভ্রষ্ট হবো, সেদিন আমরা আর আমি থাকবো না। আমরা যখন আচার্য্যের কাছ থেকে উপদেশ শুনি, তা আমরা স্মৃতির সাহায্যেই ধরে রাখি, বুঝতে পারি, চিন্তা করতে পারি, এবং বিষয়টি নিয়ে মনন করতে পারি। আচার্য্য সনৎকুমার বলছেন, যিনি স্মৃতিকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, তিনি স্মৃতির যতদূর গতি, ততদূর পর্যন্ত ইচ্ছে করলে যেতে পারেন।
তখন নারদ আবার বললেন, ভগবান, স্মৃতি অপেক্ষা শ্রেষ্ট কিছু আছে কি ? আচার্য্য বললেন, হ্যাঁ অবশ্য়ই আছে, আর তা হচ্ছে আশা। আশা মানুষের স্মৃতিকে উদ্দীপিত করে থাকে। এবং এই স্মৃতির সাহায্যেই মানুষ মন্ত্র পাঠ করে থাকে। আশাই মানুষকে স্ত্রী-পুত্রের কামনা করায়, এমনকি ইহলোক-পরলোক সম্পর্কে জানতে উৎসাহ জোগায়। আশাই মানুষকে জাগতিক উন্নতিতে উদ্দমী করে থাকে। আবার এই আশাই মানুষকে আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশের অনুপ্রেরণা দেয়। আশাহীন জীবন জড়। আশা নেই যার তার এমনকি বেঁচে থাকার ইচ্ছেও থাকে না। আশাই মানুষকে অতৃপ্তি থেকে তৃপ্তি এনে দেয়। আশাই মানুষের উন্নতির সোপান। তাই হে নারদ তুমি আশাকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করো। আশা দ্বারাই সমস্ত কামনা পূর্ন হয়। সব প্রার্থনা অমোঘ হয়। যিনি আশাকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, তিনি আসার গতি যতদূর, ততদূর তিনি ইচ্ছে করলে যেতে পারেন।
নারদ জিজ্ঞেস করলেন, হে ভগবান, আশা থেকে শ্রেষ্ট কিছু আছে কি ? আচার্য্যদেব সনৎকুমার বললেন, আশা থেকে প্রাণ শ্রেষ্ঠ। রথের চাকার শলাকাগুলো যেমন চাকার নাভিতে যুক্ত থাকে, তেমনি সবকিছু এই প্রাণেই নিহিত হয়ে আছে। প্রাণ, একমাত্র প্রাণই নিজস্ব শক্তিতে কাজ করে থাকে। প্রাণই প্রাণকে প্রাণের উদ্দেশ্যে দান করে থাকে। তাই প্রাণই মাতা, প্রায় পিতা, প্রাণই ভ্রাতা, প্রাণই ভগ্নি, প্রাণই আচার্য্য, প্রাণই ব্রহ্মন। আশার চেয়ে প্রাণ বড়ো। প্রাণ না থাকলে, আশাই বলো, আর স্মৃতিই বলো - কিছুই নেই। প্রাণই সব কিছুর আশ্রয়। বিশ্বব্রহ্মান্ড জুড়ে প্রাণ শক্তির খেলা চলছে। আমাদের মধ্যেও প্রাণের এক ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র অংশ বিরাজ করছে। প্রাণের শক্তিতে আমরা সব কাজ করে থাকি। আমরা জানি ব্রহ্ম বাক্য -মনের অতীত। কিন্তু ব্রহ্ম যখন প্রাণের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেন, তখনই জগতের খেলা শুরু হয়। শরীরের মধ্যে থেকে প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেলে, শরীরের কোনো অঙ্গ, কোনো ইন্দ্রিয় কাজ করতে পারে না। তেমনি সমষ্টি প্রাণ যদি নিজেকে জগৎ থেকে সরিয়ে নেয়, তবে জগৎ আর চলে না। জগতের সমস্ত কাজ তখন স্তব্ধ হয়ে যায়। এই জগৎ আসলে প্রানেরই প্রকাশ মাত্র। প্রাণ আছে, তাই প্রাণী আছে। প্রাণই নানানরূপে বিশ্বজুড়ে ক্রীড়ারত। প্রাণ যাকে ত্যাগ করেছে, বিশ্বভুবন তাকে ত্যাগ করে থাকে। তাই প্রাণহীন দেহ একটা পচনশীল বস্তু মাত্র। তাই প্রাণহীন দেহ তা সে আমার যত নিকট-জনেরই হোক না কেন, এমনকি মা, বাবা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-ভ্রাতা-ভগ্নি সবাইকেই আমরা শীঘ্র ত্যাগ করে থাকি। প্রাণই সবকিছু হয়েছে। যিনি জগৎকে এই দৃষ্টিতে দেখেন, যিনি এইভাবে চিন্তা করে থাকেন, যিনি এইভাবে জগৎকে জানেন, তিনিই সর্বশ্রেষ্ট বক্তা হন।
একজন সিদ্ধ পুরুষ যখন কথা বলেন, তার প্রতিটি কথাই যথার্থ। প্রতিটি কথাই অর্থবহ। তার প্রতিটি কথাই সত্য। যিনি সত্যকে জেনেছেন, সত্যকে যিনি অনুভব করেছেন, তার কথাবার্তায়, আচার অনুষ্ঠানে একটা প্রাণের ছোঁয়া পাওয়া যায়। কারন তিনি প্রাণকে জেনেছেন। আমরা যখন কথা বলি, তখন তা প্রাণহীন। আমাদের কথা কাকের কা-কা শব্দের মতো শোনায়, ঋষিবাক্য কোকিলের মধুর স্বর। উপনিষদের সত্যদ্রষ্টা ঋষিগণ উদাত্ব কন্ঠে ঘোষণা করছেন : হে অমৃতস্য পুত্র, শোনো, আমি সত্যকে জেনেছি। যাঁকে জানলে মৃত্যুকে অতিক্রম যায়। শোক রোহিত হওয়া যায়, অমৃতের সন্ধান পাওয়া যায়। এই পথই সত্যের পথ। যাইহোক, এর পরের দিন আমরা শুনবো, সত্যকে জানবার পথের সন্ধান। আজ ব্রহ্ম-বাক্যের বিরাম দিলাম।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
তত্ত্বমসি (ছান্দোগ্য উপনিষদ -ষষ্ঠ অধ্যায় )
ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র বলছেন , তার কপালকুণ্ডলা উপন্যাসে বলছেন : নাবিক দস্যুদের ভয়ে, দলবদ্ধ হয়ে যাতায়াত করা সেকালের প্রথা। কিন্তু গভীর কুয়াশায় আকাশ আবৃত থাকায়, শেষ রাতে নাবিকরা দিক ঠিক রাখতে পারে নি। নৌকা কোথায় যাচ্ছে, তা তারা বুঝতে পারছে না। এদিকে নৌকার যাত্রী প্রায় সবাই ঘুমিয়ে আছে। জেগে আছে, একজন প্রাচীন, আর এক জন যুবক। প্রাচীন বিষয় চিন্তায় মগ্ন। পচিঁশ বিঘা জমির ধান কাটতে হবে। মাঝিদের জিজ্ঞেস করলো, আজ কতদূর যেতে পারবি ? মাঝি বললো, বলতে পারবো না। প্রাচীন চেঁচামেচি জুড়ে দিলো। যুবক বললো, যা জগদীশ্বরের হাতে, তা পণ্ডিতেরাও বলতে পারে না, ওই মূর্খ মাঝি কি করে বলবে ? এই যুবকের নাম বঙ্কিমচন্দ্র রেখেছেন নবকুমার।
তো নৌকা তীরে উপস্থিত হলো, কাঠের অভাবে রান্না হবে না, এতগুলো লোক না খেয়ে থাকবে, ভেবে, অন্য কাউকে না পেয়ে একাকী নবকুমার সমুদ্রের পাড়ে গভীর জঙ্গলে কাঠ সংগ্রহ করতে গেলো। এদিকে জোয়ার আসতেই, নবকুমারকে রেখে দিয়েই নৌকা দেশের উদ্দেশ্যে পারি দিলো। নবকুমার জঙ্গলে নিঃসঙ্গ হয়ে অনিশ্চিত জীবনের পথে পা রাখলো। দেখা হলো, এক ভয়ঙ্কর কাপালিকের সঙ্গে। কাপালিক তাঁকে বলি দেবার মানসে, আশ্রয় দিলো। এই সময় সে একদিন জঙ্গলের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে পথ হারিয়ে ফেলেছে। কাপালিকের আশ্রম কোনদিকে তা সে বুঝতেপারছে না। আর তার এই অসহায় ক্ষনে, মন যখন পথের সন্ধানে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে, তখন ওই গভীর জঙ্গলের মধ্যে এক অপূর্ব মূর্তি দেখতে পেলো নবকুমার। অসংলগ্ন রাশীকৃত কেশভার যার সমস্ত অঙ্গ ঢেকে রেখেছে। যেন এক অপূর্ব ঝর্ণার শব্দ তার কানে এলো, "পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ ?" নবকুমারের হৃদয়বিনা বেজে উঠলো। রমনী কন্ঠ সম্ভূত এই স্বর তার হৃদয়তন্ত্রে, বার বার ধ্বনিত হতে লাগলো।পথিক তুমি পথ হারাইয়াছো ? এই প্রশ্নের কি অর্থ, কি এর উত্তর হবে কিছুই সে মনে করতে পারলো না। প্রশ্নকর্ত্রী আবার বললেন, "এসো" .নবকুমার নিঃশব্দে কলের পুতুলের মতো সেই শুভ্র মেঘের অনুসরণ করতে লাগলো। এই গল্প আমরা অনেকবার পড়েছি। আমরা সবাই এই গল্প সবাই জানি। পথ না হারালে, পথের সন্ধানের প্রশ্ন অবান্তর। আমি যে পথ হারিয়েছি, সেটাই আমরা বুঝতে পারি না। তো কে আমাদের পথের সন্ধান দেবে ?
ঋষি উদ্দালক পুত্র শ্বেতকেতুকে এমনই একটা গল্প বলেছিলেন। ( ছান্দোগ্য উপনিষদে ৬/১- শ্বেতকেতু নাম অরুণীর এক পুত্র ছিল ) গল্পটি বলে তাকে বলেছিলেন, বুদ্ধিমান পুরুষ যখন আকস্মিকভাবে পথপ্রদর্শকের উপদেশ পান, এবং তার নির্দেশিত পথে গমন করেন, তখন তার সকল দুঃখ দূর হয়ে যায়, সে তখন অনুভব করে এক মিলনের আনন্দ। উদ্দালক ঋষি বলছেন, এবম এব ইহ আচার্যবান পুরুষো বেদ - এইভাবেই এই সংসারে, যে বুদ্ধিমান পুরুষ ভাগ্যগুনে আচার্যকে লাভ করেন, তিনিই সকল তত্ত্ব জানতে পারেন। আচার্য আমাদের পথ-প্রদর্শক। আর এঁকে চাইলেই পাওয়া যায় না। আমাদের বহুজন্মের কর্ম্মফল, যাকে আমরা ভাগ্য বলে থাকি, সেই ভাগ্যক্রমে আচার্য লাভ করতেপারি। আর আচার্য হচ্ছেন, পরম-তত্ত্বজ্ঞ পরম করুনাময় গুরু, তার প্রসাদেই অন্ধজীবগন সাধনার পথে চলে, জ্ঞান লাভ করে, মোহমুক্ত হয়ে থাকেন। তত্ত্বমসি - তিনিই পরমাত্মা-ব্রহ্ম। হ্যাঁ তিনিই একমাত্র ব্রহ্ম।
সবকিছুর মধ্যে যা সূক্ষ্মতম তাই সৎ। জগৎ বৈচিত্রে ভরা। আমরা কাল যা দেখেছিলাম, আজ তা নেই, আজ যা দেখছি, কাল তা থাকবে না। এটাই সত্য। সব বস্তুর যা সার তার কোনো পরিবর্তন হয় না। আর সেই চিরন্তন সত্ত্বাই আমাদের স্বরূপ। তত্ত্বমসি, তুমিই সেই আত্মা - এই হলো বেদান্তের সার কথা। আমরা আজ হয়তো কাউকে একটা নামে জানি, কাল সে তার না পাল্টে দিতে পারে। যাকে আমি নান্টু বলে জানতাম, সে এখন মিস্টার নন্দকুমার সিংহ। যাকে আমি, পাড়ার বকাটে ছেলে বলে জানতাম, সে এখন মন্ত্রী। তাই বেদান্ত বলছে, যাকে আমি অতীতে সত্য বলে জেনেছিলাম, বর্তমানে তা সত্য নয়। আর আজ যা সত্য ভবিষ্যতে তা সত্য বলে থাকবে না। আর এই নাম ও রূপের থেকেই আমাদের সকল দুঃখের শুরু। আমরা নিজেকে দেহ বলে মনে করি, তাই নিজেকে সকলের থেকে আলাদা বলে মনে হয়। আমি ব্রাহ্মণ, আমি বিদ্বান , আমি লম্বা, আমি ফর্সা। আমি ভালো, আমি পুরুষ, আমি শক্তিশালী। বেদান্ত বলছে, ভুলে যাও এসব। এগুলো আমাদের উপাধি মাত্র । ভুলে যায় এই উপাধি, তোমার প্রকৃত স্বরূপকে জানো।
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় জাতিভেদ প্রথায় বিশ্বাস করতে না। জাতিভেদকে তিনি ঘৃনাই করতেন। এ নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে মাঝে মধ্যে তাঁর তর্ক হতো। বলতেন, দেখো আমি কেমিষ্ট। আমি প্রমান করে দিতে পারি, ব্রাহ্মণের রক্ত ও শূদ্রের রক্তে কোনো তফাৎ নেই। দুই-ই একই উপাদানে তৈরি। আর তোমরা কি না বলো "এ ব্রাহ্মণ" "ও শূদ্র" এই ভেদ সত্য নয়, কল্পিত। এখন কথা হচ্ছে, তাহলে সত্য কি ? বেদান্ত বলছে, সত্য হচ্ছে আমরা সবাই এক, শুদ্ধ চৈতন্য।
এখন শ্বেতকেতু এই কথাটা কিছুতেই বুঝতে পারছে না। তো পিতা তাকে বিভিন্ন উপমার মাধ্যমে বোঝাতে চেষ্টা করছেন। এইরকম কয়েকটা উপমা আমরা আজ শুনবো। বলছেন, দেখো মৌমাছিরা গাছে-গাছে ঘুরে নানান গাছ থেকে মধু সংগ্রহ করে। বিভিন্ন গাছের রস সংগ্রহ ক'রে, তারা মধু প্রস্তুত করে। সেই মধুর মধ্যে কোন্ কোন্ গাছের রস আছে, তাকে কি আলাদা করা যায় ? যায় না, আসলে সব রস একত্রে মিশে মধু হয়ে যায়। ঠিক তেমনি জীবাত্মা যখন সৎস্বরূপে মিলিত হয়, তখন সে জানতেও পারে না যে সে আগে আলাদা ছিল। মধুর মধ্যে এক-এক ফোটা মধু, তারা একে অপরকে বলতে পারে না, যে আমি এই গাছের রস, আর তুমি ওই গাছের রস। আসলে তখন তাদের এই পৃথক অস্তিত্ত্ব বোধই থাকে না। নানান ফুলের রস মিশ্রিত হয়ে মধুতে পরিণত হয়। ঠিক তেমনি আমরা অন্তিমে বা প্রারম্ভে আমরা কখনোই আলাদা ছিলাম না। মাঝে কয়েকদিনের জন্য, আমাদের এই ভেদবুদ্ধি জাগ্রত হয়, যখন আমরা নাম-রূপের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলি। আবার যখন আমরা স্বরূপে মিলিত হই , তখন আমাদের সব ভেদবুদ্ধি চলে যায়। তখন সব এক-অভিন্ন।
উপনিষ বলছে, যতদিন না অজ্ঞানতা দূর হচ্ছে, যতদিন না আমাদের আত্মজ্ঞান লাভ হচ্ছে, ততদিন আমাদের পৃথিবীতে বার বার ফিরে ফিরে আসতে হয়। মৃত্যু যেন আমাদের গভীর নিদ্রায় অর্থাৎ সুসুপ্তিতে মগ্ন হওয়া। আর জন্ম গ্রহণ করা মানে আবার ঘুম থেকে জেগে ওঠা। আমরা বার বার মারা যাই, বারবার জন্ম গ্রহণ করি। যতদিন না আমাদের আত্মজ্ঞান লাভ হচ্ছে, ততদিন এই চক্র চলতে থাকে। জ্ঞানলাভ হলেই এই জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি। তত্ত্বমসি - তুমিই সেই -এই হলো মহাবাক্য। কিন্তু শ্বেতকেতু বুঝতে পারছে না। এবার উদ্দালক আবার আরো একটা উদাহরণ দিচ্ছেন। বলছেন। দেখো দেশে দেশে কত নদী। তাদের উৎসও ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু সব নদীই শেষপর্যন্ত সমুদ্রে মিশে যাচ্ছে। তখন আর নদীগুলোর আলাদা অস্তিত্ত্ব থাকে না। গঙ্গা, যমুনা সরস্বতী, গোদাবরী, দামোদর, নর্মদা - তখন সমুদ্র মাত্র। সমুদ্রের একফোটা জল কি তখন বলতে পারে, এই আমি গঙ্গার জল। পারে না। ঠিক তেমনি মৃত্যুর পরে, আমরাও সাময়িক ভাবে আমাদের অস্তিত্ত্ব ভুলে যাই। আবার দেখো, এই নদী কোথা থেকে আসে ? সমুদ্রের জল সূর্য্যের তাপে/টানে বাষ্পীভূত হয়ে আকাশে মেঘের আকারে ভাসতে থাকে। একসময় মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে পৃথিবীতে, ধীরে ধীরে নদীর আকার নেয় , আবার সমুদ্রে গিয়ে মিশে যায়। আমরাও ঠিক তেমনি শুদ্ধ চৈতন্য থেকে আসি, আবার সেখানেই ফিরে যাই। কিন্তু একথা আমাদের স্মৃতিতে ধরা থাকে না। আমরা যখন জেগে উঠি তখন আমরা আমাদেরকে আলাদা ভাবতে থাকি, কিন্তু গভীর ঘুমে যখন আচ্ছন্ন থাকি তখন আমরা আমাদের নিজের আলাদা অস্তিত্ত্ব সাময়িক ভাবে ভুলে যাই। কিন্তু আমাদের অস্তিত্ত্ব থাকে, আমারা আমাদের সংস্কার ইত্যাদি নিয়ে আবার জীবদেহ ধারন করি। কিন্তু শ্বেতকেতু এসব কিছু ধারণা করতে পারছে না। তাই উদ্দালক আবার তাকে একটা দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছেন।
বলছেন, ধরো একটা বিশাল বটগাছকে কেউ আঘাত করলো, গাছটা তখন, বেঁচে থাকবে, কিন্তু আঘাতপ্রাপ্ত স্থান থেকে রস ক্ষরণ হতে থাকবে। কিন্তু জীবাত্মা যখন কোনো ডালকে ত্যাগ করে, তখন সেই শাখাটি শুকিয়ে যায়। জীবাত্মা যখন সমগ্র গাছটিকে ত্যাগ করে, তখন গাছটি শুকিয়ে যায়। অর্থাৎ উপনিষদ বলছে, জীবাত্মার শরীর ত্যাগই তার মৃত্যুর কারন। শরীরের মৃত্যু মানে জীবাত্মার মৃত্যু নয়। অর্থাৎ জীবাত্মা যখন শরীর ত্যাগ করে, তখনই জীবের মৃত্যু হয়। আমরা যেমন আমাদের বাসস্থান ছেড়ে যাই, তখন বাড়িটা শূন্য পড়ে থাকে, কোনো কাজে লাগে না। ঠিক তেমনি আত্মা দেহ ছেড়ে গেলে, দেহটা শূন্য ও অকেজো হয়ে যায়। ঋষি উদ্দালক বলছেন, জীবাত্মা দেহ ছেড়ে গেলে, দেহ তার মূল ভূতে ফিরে যায়। অর্থাৎ আত্মা যেন আঠা বা সিমেন্টের মতো, ভূতগুলোকে একত্রিত করে রেখেছিলো, যখন এই সিমেন্টরূপ আত্মা দেহকে ছেড়ে গেলো, তখন ইট খসে পড়তে লাগলো। কিন্তু জীবাত্মা মরে না। এইযে সূক্ষ্মতম বস্তু, এটাই সমস্ত জগতের আত্মা। ধরো একটা কাজ অসমাপ্ত রেখে তুমি ঘুমিয়ে পড়েছো। ঘুম ভাঙার পরে, তোমার সেই কাজটার কথা মনে পড়বে, আর কাজটা যেখানে শেষ করেছিলে, সেখান থেকে আবার শুরু করবে। জীব বার বার জন্মায়, তার কর্ম্মফল ভোগ করবার জন্য, কিন্তু আত্মা অবিকারী, আত্মার কোনো পরিবর্তন নেই।
উদ্দালক বললেন, এই বটগাছ থেকে একটা ফল নিয়ে এসো, এটাকে ভাঙ, কি দেখতে পাচ্ছো ? শ্বেতকেতু বলছেন, অনুর মতো বীজ, পিতা বললেন, এটাকেও ভাঙো। কি দেখতে পাচ্ছো ? শ্বেতকেতু বললো, কিছুই না। উদ্দালক বলছেন, হে পুত্র, এই যে বীজের সূক্ষ্ম অংশটাকে তুমি দেখতে পাচ্ছ না, কিন্তু এই সূক্ষ্ম অংশেই আছে, বিশাল বটগাছটা। তুমি আমার কথায়, বিশ্বাস করো, তুমি আমার কথায় শ্রদ্ধাবান হও। আসলে এই শ্রদ্ধাবান হওয়াটাই বড় কথা। আচার্য্যর কথাগুলো প্রথমে তোমার উপল্বদ্ধিতে আসবে না, কিন্তু যদি তাঁর কথায় তুমি বিশ্বাস করো, এবং এ বিষয়ে গভীর ধ্যান দিতে পারো, তবে ধীরে ধীরে, তোমার মধ্যেও আচার্য্যের কথার সত্যতা ফুটে উঠবে। অর্থাৎ তুমি যদি আন্তরিক হও, নিজের চঞ্চল মনকে যদি, স্থির করে লক্ষের দিকে ধাবিত করতে পারো, তবে তোমার কাছে, সত্য ধরা পড়বে। আর যদি, চঞ্চল ছেলের মতো, মনটাকে বিক্ষিপ্ত করে রাখো, তবে বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে পারবে না। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলতেন, আমাদের মনটা যেন সর্ষের একটা পুটলি, আর তা থেকে সর্ষেগুলো ছড়িয়ে পড়েছে। এই সর্ষেরূপ মনটাকে গুটিয়ে এনে আত্মায় একাগ্র করতে হবে। সব কিছুর মধ্যে যা সূক্ষ্মতম তাই জগতের আত্মা। আর তোমার মধ্যেও যা সূক্ষতম তাই তুমি, তুমিই সেই আত্মা।
এই বটগাছের উদাহরণ দিয়ে আত্মাকে বোঝাচ্ছেন, ঋষি উদ্দালক। হাজার হাজার বছর লেখা এই উপল্বদ্ধির কথা। আমার ভাবতে অবাক লাগে, তখন কি মানুষ জানতো যে গাছেরও প্রাণ আছে ? গাছেরও আত্মা বলে একটা কিছু আছে। ঋষি উদ্দালক বলছেন, বীজ থেকে যেমন বটগাছ, আত্মা থেকে তেমনি এই জগৎ। কিন্তু এই কথা থেকে শ্বেতকেতুর মধ্যে স্পষ্ট কোনো ধারণা জন্মালো না। তাই আবার বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে বললেন।
আসলে এই ব্যাখ্যাই চিরকাল চলে এসেছে, এই বিচার বিদ্যাই শাস্ত্র আমাদের শোনায়। কিন্তু উপলব্ধি তো আমাদের নিজেদেরকে করতে হবে। আর তার জন্য দরকার যোগ। যতক্ষন আমরা যোগে প্রবৃত্ত না হচ্ছি, ততক্ষন আমরা সত্যে উপনীত হতে পারবো না। আর আশ্চর্য্যের ব্যাপার হচ্ছে, ধ্যান কাউকে শেখানো যায় না। ধ্যান ভিতর থেকে হয়, ধ্যান ঈশ্বরের কৃপায় হয়।
ঋষি উদ্দালক আবার বোঝাতে লাগলেন, একখন্ড লবনের টুকরো দিয়ে বললেন, এটি জলে রেখে দাও। শ্বেতকেতু তাই করলেন। সকালে, বললেন, ওই জলপাত্র নিয়ে এসো। দেখো, লবন খণ্ডটি জলে মিশে গেছে। জলের উপর থেকে পান করো, কেমন লাগছে, লবনাক্ত। এর মাঝখান থেকে পান করো, কেমন লাগছে, লবনাক্ত। নিচ থেকে পান করো, কেমন লাগছে, লবনাক্ত। আসলে লবন জলের সর্বত্র রয়েছে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। ঠিক তেমনি, আত্মা আমাদের দেহের সর্বত্র রয়েছেন, কিন্তু আমরা তাকে দেখতে পাচ্ছি না। তার মানে এই নয়, যে আত্মা নেই। আর সত্য হচ্ছে, লবন দৃষ্টিগোচর না হলেও, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। তাই তুমি জলের মধ্যে এর স্বাদ নিতে পেরেছো। কিন্তু আত্মা আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। এমনকি মন দিয়েও তাকে ধরা যায় না। কারন আত্মা অতি সূক্ষ্ম। তাই আত্মাকে জানতে হলে এই আপেক্ষিক জগতের উর্দ্ধে উঠতে হবে। এই আপেক্ষিক জগতের উর্দ্ধে উঠতে গেলে আমাদের যোগে নিবিষ্ট হতে হবে। এর পরের দিন আমরা রাজযোগের ৫ম পর্ব্বের কথা শুনবো। যোগের মাধ্যমে, আমাদের সজ্ঞাকে তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর করতে হবে। তবেই আমরা আত্মাকে জানতে পারবো। আর এই পথ দেখাতে পারে, একমাত্র যোগাচার্য্যগন । তুমি যোগাচার্য্যের শরণ নাও। একমাত্র যোগ্য গুরুই এই পথ দেখাতে পারে। কর্ম্ম বন্ধন থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। তবে সহজে এই কর্ম্ম বন্ধন যায় না। ধনুক থেকে তীর বেরিয়ে গেলে তাকে আর ফেরানো যায় না। করাত দিয়ে গাছ কাটলেও গাছ ভুলুন্ঠিত হয় না, যতক্ষন না বাতাস তাকে নাড়া দিচ্ছে। তেমনি জ্ঞান লাভ করো, কিন্তু ভেবোনা, জ্ঞান লাভ করলেই মুক্তি হবে, যতক্ষন না তোমার প্রারব্ধ কর্ম্ম নিঃশেষ হচ্ছে, ততক্ষন তোমাকে দেহেই বিচরণ করতে হবে । আর প্রারব্ধ ভোগ করতে হবে। জ্ঞানী ব্যক্তির একসময় এই প্রারব্ধ কর্ম্মবন্ধন শেষ হয়, এবং মুক্তি লাভ করে থাকেন। তুমি জ্ঞানী হও তবেই তুমি মুক্তি পাবে।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
মাণ্ডূক্য উপনিষদ
ব্রহ্মের চার অবস্থা।
আমরা শুনেছি, পরমাত্মা সর্বত্র। কিন্তু সত্যি সত্যি আমরা কি তা অনুভব করতে পারি ? পারি না। আত্মা যদি সর্বত্র তবে তাকে আমরা দেখতে পাই না কে ? আপনি বলবেন, তাঁকে এই চর্ম চক্ষু দিয়ে দেখা যায় না। তো যাঁকে চর্মচক্ষু দিয়ে দেখতে পাই না, যাঁকে অনুভব করতে পারি না, তা যে আছে, এই বিশ্বাস আমাদের হবে কি করে। আমরা অনেক সূক্ষ্মবস্তু বা গুন্ দেখতে পাই না কিন্তু অনুভব করি, যেমন বাতাস, আকাশ। ভালোবাসা, রাগ দ্বেষ, এগুলো আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু আমরা অনুভব করি। কেউ কেউ বলেন, জীবের মধ্যেই একমাত্র আত্মা বা পরমাত্মা অবস্থান করেন। তাহলে আমরা পাথরের শিলাকে ঈশ্বর জ্ঞানে পূজা করি কেন ? আর যদি জীবের মধ্যেই শুধু ঈশ্বর থাকেন তবে ঈশ্বর সর্বত্র এই কথা সত্য হয় কি ভাবে ?
এসব প্রশ্ন চিরকালীন। আজ আমরা এইসব প্রশ্নের জবাব খুঁজবো। এইসব প্রশ্নের জবাব আছে, মাণ্ডূক্য উপনিষদে। আলোচনার শুরুতে আমরা মঙ্গলাচরণ করে নেই, অর্থাৎ প্রার্থনা দিয়ে শুরু করি।
মঙ্গলাচরণ
ওং ভদ্রং কর্নেভিঃ শৃনুয়াম দেবা
ভদ্রং পশ্যেম অক্ষভিঃ যজত্রাঃ।
স্থিরৈঃ অঙ্গৈঃ তুষ্টুব্যাংসঃ তনূভিঃ
ব্য়শেম দেবহিতং যদায়ুঃ।।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।।
হে দেবগন আমরা যেন যা কিছু ভালো, তাই কান দিয়ে শুনি, চোখ দিয়ে যেন ভালো কিছু দেখি। প্রার্থনা করি, আমাদের আয়ু যেন তোমাদের ইচ্ছে মতো হয়, তার বেশি বা কম না হয়। আমাদের ত্রিবিধ শান্তি হোক।
আমরা মাণ্ডূক্য উপনিষদ-এর মধ্যে প্রবেশ করবো, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, আমাদের শরীর মন যেন সুস্থ থাকে। আমরা যেন উপনিষদের বাণীর যথার্থ অর্থ বুঝতে সক্ষম হই।
মাণ্ডূক্য উপনিষদ আসলে অথর্ব বেদের অন্তর্গত। এখানে মাত্র বারোটি শ্লোক আছে। এর মধ্যে আজ আমরা প্রথম দুটো শ্লোকের গভীরে প্রবেশ করবো।
এখানে ওং (অউম) এই প্রতীকের সাহায্যে ব্রহ্মকে তুলে ধরা হয়েছে। ওম এর যেমন তিনটি ভাগ অ,উ,ম, আর সব মিলিয়ে ওম। জীবের তেমনি তিনটি অবস্থা হচ্ছে, জাগ্রত-স্বপ্ন-সুষুপ্তি এবং সবশেষে তুরীয়। অর্থাৎ সমস্ত জগৎ ব্রহ্ম। আর ব্রহ্মেরও চারটি অবস্থা।
মন্দিরে পাথরের শিবলিঙ্গ আছে, নারায়ণ শিলা আছে। এগুলোর পুজো হয়। আপনি কি মনে করেন, পূজারী এগুলোকে পাথর জ্ঞানে পূজা করেন ? না, তিনি এই পাথরের আড়ালে তার আরাধ্য দেবতাকেই পূজা করেন। এই পাথরগুলো তার কাছে প্রতীক। ঈশ্বর যেহেতু সর্বত্র রয়েছেন, এবং তিনিই সবকিছু হয়েছেন, সেই হেতু যে-কোনো কিছুই ঈশ্বরের প্রতীক হতে পারে। মাণ্ডূক্য উপনিষদ এই ওম বা অউম-কে ব্রহ্মের উপযুক্ত প্রতীক হিসেবে মনে করেছে।
এখন কথা হচ্ছে, সবকিছু ছেড়ে, এই অউম-কে প্রতীক হিসেবে ধরা হলো কেন ?
আসলে সবকিছুই যদি ব্রহ্মের অন্তর্গত হয়, তবে সমগ্র ধ্বনিও ব্রহ্মের অন্তর্গত। উপনিষদ বলছে কার্য্য ও কারন উভয়ই ব্রহ্ম। এই দৃশ্যমান জগৎ হচ্ছে, ওম। যা কিছু অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবই ওঙ্কার। ত্রিকালের অতীত যদি কিছু থেকে থাকে তাও ওঙ্কার। ওম পবিত্রতার প্রতীক। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ সবাই ওঁকারকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ওঙ্কারকে বলা হয়ে থাকে নাদব্রহ্ম বা শব্দব্রহ্ম। সমগ্র ধ্বনিজগৎ এই ওঙ্কারের অন্তর্গত। অ বর্ণ প্রধান স্বর, এটি নির্গত হয় গলদেশের পশ্চাৎ ভাগ থেকে। উ হচ্ছে মধ্যস্বর, এটি উচ্চারিত হয় ঠোঁট খোলা অথচ চঞ্চুর মতো করে, ম হচ্ছে অন্ত স্বর, এটি ওষ্ঠ বর্ণ, আর উচ্চারিত হয় ঠোঁট বন্ধ করে। অর্থাৎ আমরা যখন কথা বলি, তখন মুখ-গহ্বর-এর যে যে অংশ বিভিন্ন শব্দ উচ্চারণ করতে কাজে লাগে, তার সমস্ত কিছু স্পর্শ করে এই ওঙ্কার।
ব্রহ্ম হচ্ছেন অক্ষর অর্থাৎ যার ক্ষয় নেই, বিনাশ নেই। এই ব্রহ্মই বিভিন্নরূপে নিজেকে প্রকাশ করেন। এই প্রকাশের প্রকারভেদ আছে, জন্ম-মৃত্যু আছে, সৃষ্টি-বিনাশ আছে। কিন্তু ব্রহ্ম ব্রহ্মই থাকেন। ওম-এর মধ্যেই আছে ত্রিকাল, অর্থাৎ অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। তবে এইযে ত্রিকাল বলছি বটে আমরা, কিন্তু কালের কোনো ভাগ হয় না। আমরা বুঝবার জন্য, এই কালের ত্রিবিধ অবস্থার কথা বলেছি মাত্র । কিন্তু কাল চিরন্তন, কালের কোনো ক্ষয় নেই, কোনো সংযোজন নেই। কাল একটা ধারা যা চির-বহমান। তেমনি ঈশ্বর বা ব্রহ্ম হচ্ছেন, দেশ-কালের অতীত একটা অবস্থা মাত্র। এই অবস্থা গুলোর পরিবর্তন হয়, কিন্তু ব্রহ্ম সত্বার কোনো পরিবর্তন হয় না।
উপনিষদ বলছে, সর্বং হি এতৎ ব্রহ্ম, অর্থাৎ এইসবই ব্রহ্ম। ব্রহ্ম ছাড়া কিছু নেই। তা সে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হোক, বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য না হোক, স্থুল হোক বা সূক্ষ্ম হোক, গোচর হোক বা অগোচর হোক, জ্ঞাত হোক বা অজ্ঞাত হোক, সবই ব্রহ্ম। আর এই ব্রহ্ম চতুষ্পাৎ। অর্থাৎ এই ব্রহ্মের চারটি অবস্থা। একই ব্রহ্মকে চার অবস্থায় দেখা যায়।
প্রথম অবস্থা পরিদৃশ্যমান জগৎ। অর্থাৎ আমরা যা কিছু দেখছি,শুনছি, আস্বাদন করছি, সবই ব্রহ্মের প্রথমবস্থা। স্থুল জাগতিক অবস্থা। আমরা যখন জেগে থাকি, তখন আমরা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে এই জগৎকে প্রতক্ষ্য করে থাকি। ঘুমিয়ে থাকলে এই দৃশ্যমান জগৎ আমাদের কাছে অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু স্থুল জগৎ তখনও থাকে।
কিন্তু ঘুমের মধ্যে আমরা এই দৃশ্যমান জগতের মতোই আর একটা জগৎ দেখতে পাই, এটি আমরা মনের দ্বারা উপলব্ধি করে থাকি। ব্রহ্মের এই অবস্থাকে বলা হয়ে থাকে তৈজস। তৈজস কথাটার মানে হচ্ছে তেজবিকার। সূক্ষ্ম শরীরে উপস্থিত চৈতন্যের দ্বারা আমরা এটাকে অনুভব বা দেখতে পারি। আমাদের মানসিক জগতের কার্যকলাপ এই চৈতন্য প্রভাবে আমাদের কাছে দৃষ্টিগোচর হয়। এটি আমাদের স্বপ্নাবস্থা।
এর পরবর্তী অবস্থা হলো সুষুপ্তি অর্থাৎ গভীর নিদ্রার অবস্থা। এই অখন্ড চৈতন্য অবস্থাকে বলা হয় প্রাজ্ঞ। প্রাজ্ঞ কথাটা মানে হচ্ছে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। কারন শরীরে উপস্থিত চৈতন্যে এই প্রাজ্ঞ অনুভূত হয়। সুসুপ্তির অবস্থায় যখন আমরা কারন শরীরে উপস্থিত থাকি, তখন অন্যান্য জ্ঞান সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ হয়ে যাই। কেবলমাত্র সুখানুভব করতে সমর্থ থাকি। এই অবস্থাকেই বলা হয় প্রাজ্ঞ। এই অবস্থা থেকে অর্থাৎসুষুপ্তি ভাঙার পরে, আমরা কারন শরীরে থেকে, আবার স্থূল শরীরে চলে আসি আমরা তখন খুব সতেজ অনুভব করি। এই সুসুপ্তির অবস্থায়, আমরা যেন ঘন অন্ধকারে একটা বৈচিত্রহীন জগতে বাস করি।
এর পরে আছে, তুরীয় অবস্থা। এই অবস্থায় আমরা চৈতন্যের সাথে এক হয়ে যাই। তখন আমরা ব্রহ্মের সাথে একাত্মতা অনুভব করি। এটি আসলে সমাধির অবস্থা বিশেষ। মায়ার অতীত চতুর্থ অবস্থা। কথায় বলে, ক্ষীরোদ সাগরশায়ী কৃষ্ণ দর্শনে আছে মায়াগন্ধ, / তুরীয় কৃষ্ণতে নাহি মায়ার সন্মন্ধ। তো তুরীয় অবস্থা মায়ার অতীত একটা অনির্বচনীয় অবস্থা।
উপনিষদে ব্রহ্মের এই চার অবস্থার কথাই বলা হয়েছে। কিন্তু এই অবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কি জীব বা জীবাত্মার কোনো পরিবর্তন হয় ? হয় না। সেই একই জীব, কখনো জেগে আছে, কখনো স্বপ্ন দেখছে, কখনো সুসুপ্তিতে আছে, আবার কখনো সমাধি অবস্থায় ব্রহ্মের সাথে এক হয়ে আছে। তাই জীবের বা জীবাত্মার যেমন চার অবস্থা, ব্রহ্মেরও চার অবস্থা। উপনিষদ বলছে এই এইযে জীব বা জীবাত্মা আর ব্রহ্ম বা পরমাত্মা এক ও অভিন্ন একটা ব্যষ্টি আর একটা সমষ্টি। ব্রহ্মের মধ্যেই জগৎ। দৃশ্যমান জগৎ, এমনকি অদৃশ্যমান জগৎ, স্থুল জগৎ আর সূক্ষ্ম জগৎ সবই ব্রহ্মময়। ব্রহ্ম ভিন্ন কিছু নেই। অয়ম আত্মা ব্রহ্ম, এই আত্মাই ব্রহ্ম। আমরা সবাই ব্রহ্ম বই কিছু নোই।
আমাদের এই মাণ্ডূক্য উপনিষদ কথা পরবর্তীতে আবার আমরা শুনবো। আজ শব্দব্রহ্মের বিরাম দিলাম।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
ওং ভদ্রং কর্নেভিঃ শৃনুয়াম দেবা
ভদ্রং পশ্যেম অক্ষভিঃ যজত্রাঃ।
স্থিরৈঃ অঙ্গৈঃ তুষ্টুব্যাংসঃ তনূভিঃ
ব্য়শেম দেবহিতং যদায়ুঃ।।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।।
আমরা শুনছিলাম, মাণ্ডূক্য উপনিষদ কথা। এর আগের দিন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্লোক শুনেছিলাম। আজ আমরা শুনবো তিন থেকে পাঁচতম শ্লোক পর্যন্ত। আমরা শুনেছিলাম, ব্রহ্মের চার অবস্থা। এর মধ্যে প্রথম অবস্থা হচ্ছে জাগ্রত অবস্থা। এই অবস্থায় আমরা বহির্জগৎ সম্পর্কে সচেতন থাকি। আর এই স্থূল জগৎকেই আমরা উপভোগ করে থাকি। তাই এই অবস্থায় আমরা স্থুলভূক। আর এই ভোগ হয় আমাদের দেহ ও ইন্দ্রিয় দ্বারা। আমাদের দেহের অঙ্গগুলো হলো মাথা, চোখ, নাক, হাত, পা, মূত্রাশয়। প্রথম হচ্ছে পাঁচটি জ্ঞানীন্দ্রিয়, পাঁচটি কর্ম্ম-ইন্দ্রিয়, এছাড়া আছে পঞ্চপ্রাণ। এগুলোর সঙ্গে আছে মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার। এগুলো সব আমরা জানি। এখানে একটা কথা বলা হচ্ছে, যে আমরা স্থুলভূক। অর্থাৎ এই সময় আমরা স্থূল বস্তুর ভোগ করে থাকি।
মহাত্মাগণ বলে থাকেন, ঈশ্বরকে বুদ্ধি দিয়ে, যুক্তিতর্ক দিয়ে বোঝা যায় না। এমনকি এই অব্যয় অক্ষয় শক্তিকে ভাষা দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু মাণ্ডূক্য উপনিষদ এর রচনাকার এই অসাধ্য সাধানটি করেছেন । ঈশ্বরকে যে যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায়, তা এই উপনিষদ না পড়লে বোঝা যাবে না। মাত্র বারোটি শ্লোকে এই অমর কীর্তি রেখে গেছেন। আর আশ্চর্য্য হচ্ছে, আচার্য্য শঙ্করের গুরু গোবিন্দপাদের গুরু গৌড়পাদ এই ১২টি শ্লোকের ব্যাখ্যা করতে দুশো শ্লোকের অবতারণা করেছেন। শঙ্করাচার্য্যও এই মাণ্ডূক্য উপনিষদএর ব্যাখ্যা করেছেন।
আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ধারণা হচ্ছে। ব্রহ্ম, ঈশ্বর, ভগবান একই কথা। আর এই ভগবানের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, একমাত্র মানুষের হৃদয়ে। আর সব আমাদের কল্পনা। অর্থাৎ পাহাড়ের পাথরে, মন্দিরে, গির্জায়, বা কোনো পূজাস্থানে অর্থাৎ নির্জীব পদার্থে ঈশ্বরের কোনো অস্তিত্ত্ব থাকতে পারে না। আসলে ভাগবত জ্ঞান যার হয়েছে, তিনি ভগবন। আর এই ভগবন এর বহুবচন হচ্ছে ভগবান অর্থাৎ যেসব মহান আত্মার প্রতক্ষ্য ভাগবৎ জ্ঞান হয়েছে, তাঁরাই ভগবান। পরমাত্মা যখন মায়ার বা প্রকৃতির সাহায্যে নিজেকে সৃষ্টি করেন, অর্থাৎ ব্রহ্ম যখন ক্রিয়ারত হন, তখন তাকে বলা হয় ঈশ্বর। এটা ব্রহ্মার উপাধি বিশেষ। ঈশ কথাটার অর্থ আধিপত্য করা। ঐশর্য্য বিশিষ্ট সগুন ব্রহ্মের নাম হচ্ছে ঈশ্বর। তাই ঈশ্বরকে বলা হয়েছে, সর্বশক্তিমান। কিন্তু বিশ্বশক্তি যখন নিষ্ক্রিয় তখন তিনি ব্রহ্ম। অর্থাৎ গুণাতীত বিশ্বশক্তি ব্রহ্ম।
ব্রহ্মের যে অংশ সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়- এর কর্তা তিনিই ঈশ্বর। মায়ার আধার হচ্ছে চৈতন্য। ব্রহ্মাদি এই সৃষ্টিশক্তির গুনবিশেষ থেকে উৎপন্ন। ব্রহ্ম আর ব্রহ্মা এক কথা নয়, ব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয় কিন্তু ব্রহ্মা অসংখ্য।
আমরা শুনেছি, জীব বা জীবাত্মা হচ্ছে ব্যষ্টি আর পরমাত্মা হচ্ছেন সমষ্টি। ব্যষ্টি হচ্ছে স্থুল বস্তু বা শরীর, আর সমষ্টি হচ্ছে সব মিলিয়ে এক ও অভিন্ন। বেদান্ত বলছে, সমগ্র জগতে একটা মাত্র সত্ত্বাই বিরাজ করছে, এগুলোই বিভিন্ন নাম, বিভিন্ন রূপে দেখতে পাচ্ছি। এবং বিভিন্ন নাম ও বিভিন্ন রূপ হবার জন্য, আমরা এদের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ করছি, আসলে এই পার্থক্য হচ্ছে আপেক্ষিক। আমরা যে সমগ্র জগতের সঙ্গে এক, এই ধারণা করা আমাদের পক্ষে মুশকিল। আমরা কেউ ভাবি এই শরীরটা আমি, আবার মহাত্মাগণ বলছেন, আমি শরীর নোই, আমি জীব আত্মা। কিন্তু উপনিষদ বলছে, তুমি জীব আত্মা নও, তুমি পরমাত্মা। এই সত্যকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করো। আমাদের শরীর কতকগুলো অঙ্গের সমষ্টিমাত্র। আবার এই অঙ্গগুলোর মধ্যে যেমন আছে,রক্ত-রস, তেমনি আছে অসংখ্য কৃমিকীট, আছে অসংখ্য কোষ, এদেরও সবার প্রাণ আছে । এইসবে কিছুর সমষ্টি এই দেহ, যাকে আমরা "আমি" বলে চিনি। অঙ্গগুলোকে আলাদা করে, আমি ভাবি না। তখন অঙ্গগুলো আমার হয়ে যায়। অর্থাৎ আমার হাত, আমার পা, আমার মাথা, ইত্যাদি ইত্যাদি। ঠিক তেমনি উপনিষদ বলছে, এই বিশ্বটি হচ্ছে একটা বিরাট পুরুষদেহ। এখানে সূর্য তার চোখ, বায়ু তার প্রাণ, জলরাশি হচ্ছে মূত্রাশয়, পৃথিবী তার পা, অগ্নি তার মুখ। ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই উপনিষদ বলছে, এই জগৎ একটা অখণ্ড সত্ত্বা। আর একেই বলছে পরমাত্মা।
এখন কথা হচ্ছে, আমরা এই বাইরের জগৎকে দেখতে পাই অর্থাৎ দৃশ্য, আর যে দেখতে পায় অর্থাৎ দ্রষ্টা, অর্থাৎ দৃশ্য ও দ্রষ্টাকে তো পৃথক বলেই মনে হয় । এটা কেন হয় ? মহাত্মাগণ বার বার জোর দিয়ে বলছে, আমরা যে জগৎকে দেখছি, তার কোনো পৃথক সত্ত্বা নেই। পরমাত্মা আছেন বলেই এইসব পৃথক সত্ত্বা উপলব্ধ হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে পরমাত্মা। আর জগৎ-প্রপঞ্চ হচ্ছে পঞ্চভূতের সমাবেশ। এই পঞ্চভূতের পরিমানের পার্থ্যক্যের জন্য, বিভিন্ন রূপ বিভিন্ন আকারের রূপ দৃশ্যমান হচ্ছে। যখন এই পঞ্চভূত তার মূল উৎসে বা মূল অবস্থায় ফিরে যাবে, তখন একাত্ত্বতা অনুভূত হয়। এটাই অদ্বৈত তত্ত্ব। যা উপনিষদের বাণী। আমরা ধীরে ধীরে এই ব্যাপারটাকে ভালো ভাবে বুঝবার চেষ্টা করবো।
এখন ধরুন, আমরা বিশ্বাস করেছি, যে জীবজগৎ বা জগৎ পঞ্চভূতের সমষ্টি। এখন ধরুন কোনো কারনে এই পঞ্চভূত তার মূল উৎসে ফিরে গেল, তবে কি থাকবে, এই দৃশ্যমান জগৎ আর থাকবে না। থাকবে একমাত্র ব্রহ্ম। এখন কথা হচ্ছে তাহলে কি পঞ্চভূতের সমষ্টি ব্রহ্ম ? আসলে পঞ্চভূত হচ্ছে প্রকৃতি, বিরাট পুরুষ এই পঞ্চভূতের সাহায্যে অর্থাৎ প্রকৃতির সাহায্যে ক্রিয়া করে থাকেন। অর্থাৎ সৃষ্টি করে থাকেন। এখন কথা হচ্ছে শিশু আর শিশুর খেলনা এক জিনিস নয়। শিকারী আর শিকারীর অস্ত্র এক জিনিস নয়। এগুলো তার অর্থাৎ ব্রহ্মের অলঙ্কার বা গুন্। এই অলংকারগুলো ব্রহ্ম বা পরমাত্মা নন। এগুলো তার সৃষ্টি কার্য্যের সহায়ক মাত্র। আমাদের একটা ধারণা হচ্ছে, ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, ঈশ্বর দয়ালু। এগুলো আসলে আমাদের দ্বারা আরোপিত। আমরা যখন একজন সর্ব্বশক্তিমানকে খুঁজি, আমরা যখন একজন দয়ালুকে খুঁজি, তখন সর্বশক্তিমান হাজির হন, একজন দয়ালু হাজির হন আমাদের কাছে ঈশ্বর নামে। আসলে ব্রহ্ম নির্বিশেষ, অখন্ড। ব্রহ্মের কোনো বিশেষত্ত্ব নেই। ব্রহ্মের কোনো আধার নেই। ব্রহ্মই সব কিছুর আধার। ব্রহ্ম আছেন বলেই সবকিছু আছে। সবকিছুই ব্রহ্ম, তাই ব্রহ্মকে আলাদা করা যায় না।
নির্গুণ ব্রহ্মের মধ্যে যখন মায়ার প্রকাশ ঘটে তখন তা হলো ঈশ্বর। এখন কথা হচ্ছে, কথা থেকে আসে এই মায়া ? মায়া ব্রহ্মের ভিতরেই আছেন। এটি তার শক্তি। আগুন ও তার দাহিকা শক্তি, জলের যেমন আদ্রতা, বাতাসের যেমন গতি, এই শক্তি থেকে মূল বস্তুকে আলাদা করা যায় না। এই শক্তিভিন্ন ব্রহ্ম নিষ্ক্রিয়। আচার্য্য শঙ্কর নদীতে স্নান করতে যাবেন, ঘটে মৃত স্বামীর দেহকে রেখে স্ত্রী বিলাপ করছে। আচার্য্য শঙ্কর মৃত দেহকে সরে যেতে বললেন। স্ত্রী বললেন, ও কি করে সরবে, ওর দেহে সেই শক্তি নেই। তো শক্তি বিহীন দেহ যেমন কোনো ক্রিয়া করতে পারে না। ঠিক তেমনি মায়া বিহীন বা প্রকৃতি ছাড়া ব্রহ্ম নিষ্ক্রিয়। উপনিষদ বলছে এই সক্রিয় ব্রহ্ম হচ্ছেন, ঈশ্বর। যার ঐশর্য্য আছে তিনি ঈশ্বর। ব্রহ্ম এবং আমাদের ঈশ্বরের মধ্যে এখানে পার্থক্য। উপনিষদ মায়াযুক্ত ব্রহ্মকে বলছেন ঈশ্বর। অর্থাৎ সক্রিয় ব্রহ্ম।
আমরা হিরণ্যগর্ভ-এর কথা শুনেছি। হিরণ্যগর্ভ হচ্ছে প্রথম প্রকাশ, যেখানে জগৎ সূক্ষ্মরূপে ছিল। তখন সেখানে আমরা অর্থাৎ সমস্ত জীব জগৎ সূক্ষ্ম অবস্থায় ছিলাম। এই হিরণ্যগর্ভকেই উপনিষদে বিরাট পুরুষ হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। আমরা ক্রমবিকাশের তত্ত্ব শুনেছি। সেখানে সূক্ষ্ম থেকে কিভাবে স্থুল বিকাশ ঘটলো, সেটা শুনেছি, মাণ্ডূক্য উপনিষদ এই তত্ত্বকেই উল্টো দিক থেকে শোনাচ্ছেন, অর্থাৎ স্থুল থেকে সূক্ষ্মের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন আমাদের।জীবাত্মা ধীরে ধীরে ব্রহ্মে দিকে ধাবিত হচ্ছে, এবং শেষে ব্রহ্মে লিন হচ্ছে। অর্থাৎ ব্রহ্মের প্রথম অবস্থা হচ্ছে এই জড়জগৎ। যা আমরা জাগ্রত অবস্থায় দেখে থাকি। জেগে না থাকলে আমরা দেখতে পাই না। অর্থাৎ আমাদের মতো ব্যষ্টির কাছে বিশ্বজগৎ হচ্ছে ব্রহ্মের প্রথম অবস্থা ।
এর পরের অবস্থা হচ্ছে তৈজস। আমরা যখন স্বপ্ন দেখি, তখন আমরা যা কিছু করি,বা দেখি তা থাকে আমাদের মনে। স্বপ্ন কোনো বাহ্য বিষয় নয়। এটা পুরোপুরি আমাদের মনের ব্যাপার। আমরা জাগ্রত অবস্থায় যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে থাকি, যাকিছু বাসনা করে থাকি, তারই ফল স্বরূপ এই স্বপ্ন আমাদের কাছে প্রতিভাত হয়। জাগ্রত অবস্থার মতো স্বপ্নে আমাদের সমস্ত অঙ্গ ও ইন্দ্রিগুলো যেখানে যেমন তেমনই থাকে, কিন্তু আমরা স্বপ্নে যে কাজ করে থাকি বা দেখি সবই আমাদের মনের দ্বারা হয়ে থাকে। এই অবস্থায় আমাদের সঙ্গে বাইরের জগতের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক থাকে না। এই আমাদের মানস অভজ্ঞতা এর অধিপতি হলেন দ্বিতীয় ব্রহ্ম। অর্থাৎ জাগ্রত অবস্থায় চেতন মন কাজ করতো, এখন আমাদের অবচেতন মন কাজ করছে। এই সময় আমাদের জ্ঞান হয় অন্তর্মুখী। এইসময় আমরা যাকিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করি, সবই মনের সৃষ্টি। স্বপ্নে আমরা দেখি, শুনি, চলাফেরা করি, এমনকি খাওয়া দাওয়া করি, কিন্তু এসবই আমাদের মনের কল্পনা। এইসময় আমাদের যে সক্রিয়তা তা কোনো বাহ্যবস্তু দ্বারা প্রভাবিত হয় না। আমরা যখন কাজ করি, তা সে শারীরিক ভাবে হোক বা মানসিক ভাবে হোক, চিত্তে তার একটা ছাপ পড়ে। চিত্তের উপরে যেন একটা ছবি আঁকা হয়ে যায়। অর্থাৎ আমরা যা কিছু করি, তা সে সৎচিন্তা হতে পারে, সৎ কর্ম্ম হতে পারে আবার অসৎ চিন্তা বা অসৎ কর্ম্ম হতে পারে, যা কিছুই আমরা করি না কেন, তার একটা ছাপ আমাদের চিত্তের উপরে পড়বে। আর ছাপগুলোই পরে স্বপ্নে প্রকাশিত হয়। এইজন্য অধ্যাত্ম জগতে সৎকর্ম্মের উপরে যেমন গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়েছে, তেমনি সব সময় সৎ চিন্তা, করতে বলা হয়েছে। আপনি যদি অন্যায় কাজ করেন, তবে আপনার পুলিশের ভয় উৎপন্ন হবে। আর এই ভয় আপনাকে স্বপ্নে তারা করে নিয়ে বেড়াবে। এমনকি আপনি যদি অপমানিত হন, তবে আপনার মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা জাগ্রত হবে আর তা স্বপ্নে দেখা দেবে, এবং আপনি স্বপ্নে তাকে গালাগাল দিতে পারেন। এইজন্য, মুনিঋষিগন আমাদেরকে নিস্পৃহ থাকতে বলেছেন। অর্থাৎ আপনার মান বা অপমান যেন অন্যের কথার উপরে বা অন্যের কার্য্যের উপরে নির্ভরশীল না হয়। এক্ষেত্রে উপেক্ষাই শ্রেয়। এইজন্য বলা হয়েছে, অধ্যাত্ম জগতে ক্ষমাশীল হওয়া জরুরি।
যাইহোক, আমরা আগে শুনেছিলাম, জাগ্রত অবস্থায় আমরা স্থুলভূক। অর্থাৎ স্থূল বস্তু খেয়ে বেঁচে থাকি। কিন্তু স্বপ্নাবস্থায় আমরা প্রবিবিক্ত -ভূক। অর্থাৎ স্বপ্নাবস্থায় আমরা সূক্ষ্ম বস্তু ভোগ করি। এই অবস্থায় আমাদের স্থুল দেহের প্রয়োজন পড়ে না, আবার স্থুলবস্তু খাবার প্রয়োজন পড়ে না। আমরা যে কামনা করি সেই কামনা দ্বারা আমাদের ভোগ সম্পন্ন হয়। এই ভোগ মানসিক, শারীরিক নয়। এই অবস্থায়ই তৈজস। তৈজস কথাটির অর্থ হচ্ছে আলো বা চৈতন্য। আমাদের মনের চৈতন্য। আর এই স্বপ্নাবস্থা হচ্ছে ব্রহ্মর দ্বিতীয় অবস্থা, যাকে বলা হয় তৈজস।
পরবর্তী অবস্থা হচ্ছে সুষুপ্তি। আমরা যখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন থাকি, তখন আমার মধ্যে কামনা বাসনা থাকে না। আর আমি স্বপ্নও দেখি না। এইসময় আমাদের মন থাকে নিষ্ক্রিয়। তাই সুসুপ্তির সময় আমাদের মনের কোনো ক্রিয়া থাকে না। মনের এই নিষ্ক্রিয় অবস্থার ফলেই মনে কোনো কামনা বাসনা জাগ্রত হতে পারে না। জাগ্রত অবস্থায় আমরা জাগতিক বস্তু সম্পর্কে সচেতন থাকি, স্বপ্ন অবস্থায় আমরা মানসিক কামনা বাসনা সম্পর্কে সচেতন থাকি, কিন্তু সুসুপ্তির অবস্থায়, আমরা বিষয় সম্পর্কে নিস্পৃহ থাকি। তাই বিষয়গত যে বৈষম্য বা বিষয়গত যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এগুলো থেকে নিষ্কৃতি পায় মন। এই অবস্থাকে বলে প্রাজ্ঞ। অর্থাৎ এই অবস্থায় আমাদের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি উপস্থিত থাকে। এইসময় আমাদের কোনো স্বপ্ন বা চিন্তা থাকে না। এই সময় থাকে শুধু চৈতন্য, অর্থাৎ চিদ্ঘন রূপ। আমরা যখন স্বপ্নাবস্থায় থাকি, তখন আমাদের যে চেতনা থাকে, তাকে আলাদা করা যায়, তখন বিশ্বের অনুরূপ আর একটা বিশ্বকে দেখতে পাই। যা আমরা মনের মাধ্যমে অনুভব করি। কিন্তু জাগ্রত অবস্থায় যে বিশ্বকে আমরা যা অনুভব করি, তা ইন্দ্রিয়সমূহ দিয়ে করে থাকি। সুসুপ্তির অবস্থায় আমাদের ইন্দ্রিয় ও মন দুটোই নিষ্ক্রিয় থাকায়, এই জগতের উপলব্ধি থাকে না। তখন শুধু চৈতন্য বিরাজমান। এই চৈতন্য একটা প্রদীপের মতো, সবসময় জ্বলছে, তা কারুর কাজে লাগুক আর না লাগুক।
কিন্তু কথা হচ্ছে, এই যে সুসুপ্তির অবস্থা, যা নিরবিচ্ছিন্ন চৈতন্যে সমাহিত ছিল, সেখান থেকে জাগ্রত অবস্থায় আসতে গেলে একটা বিক্ষেপের প্রয়োজন হয়। এই বিক্ষেপের কাজটি করে থাকে মায়া। অর্থাৎ অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা।.জাগ্রত অবস্থা থেকে যখন আমরা স্বপ্নাবস্থাতে যাই তখন জগৎ মনে লিন হয়, আবার স্বপ্নাবস্থা থেকে যখন আমরা সুসুপ্তিতে যাই তখন মন চৈতন্যে লিন হয়। আবার আমাদের মধ্যে যখন মায়ার প্রবেশ ঘটে, তখন আমরা আবার জাগ্রত অবস্থায় ফিরে আসি। সুসুপ্তিকে বলা হয় চেতোমুখ। অর্থাৎ চেতনার দ্বার, অর্থাৎ চেতনা মায়ার সাহায্যে এই দ্বার দিয়ে বেরিয়ে আসে - মন ও ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে মিশে যায়। তাই সুসুপ্তিতে কোনো দ্বৈত ভাব থাকে না। থাকে শুধু এক অনুভূতি।
উপনিষদ বলছে, সুসুপ্তিতে আমরা আনন্দ-ভূক অর্থাৎ কেবলমাত্র আনন্দই ভোগ করে থাকি। সুষুপ্তি আমাদের পরমশান্তির অবস্থা। কারন, মন ও ইন্দ্রিয় তখন কোনো কাজ করতে পারে না। তবে একটা কথা এই সুসুপ্তিতে আমরা যে আনন্দ অনুভব করে থাকি, সেই আনন্দ চিরস্থায়ী নয়। এই আনন্দের অস্তিত্ত্ব সাময়িক। কেননা এই অবস্থাতে মায়া আমাদের দ্বাররক্ষক। আর এই মায়াই আমাদের আবার টেনে নিয়ে আসে, মন ও ইন্দ্রিয়ের কাছে। অর্থাৎ এই সময়ে আমরা অজ্ঞানতা থেকে মুক্ত নোই। তাই ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আবার এই দৃশ্যমান জগতের সম্মুখীন হই। আবার আমরা সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে যাই।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
ওং ভদ্রং কর্নেভিঃ শৃনুয়াম দেবা
ভদ্রং পশ্যেম অক্ষভিঃ যজত্রাঃ।
স্থিরৈঃ অঙ্গৈঃ তুষ্টুব্যাংসঃ তনূভিঃ
ব্য়শেম দেবহিতং যদায়ুঃ।।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।।
আমরা আগেরদিন শুনেছিলাম, আমরা যখন গভীর নিদ্রামগ্ন থাকি, স্বপ্নাবস্থার উর্দ্ধে যখন থাকি তখন আমাদের মনে কোনো কামনা বাসনা থাকে না। আমাদের মন তখন নিষ্ক্রিয় থাকে। একেই বলে সুষুপ্তি। জাগ্রত অবস্থায় বা স্বপ্নাবস্থায়, আমরা বস্তু সম্পর্কে সচেতন থাকি। কিন্তু সুষুপ্তি অবস্থায় আমাদের কোনো বিষয় বা কোনো দ্বৈত দৃষ্টি থাকে না। তখন শুধুই এক। কিন্তু এই অবস্থায় আমরা বেশিক্ষন থাকতে পারি না। এ যেন এমন একটা অবস্থা, মনে হয় আমরা লক্ষে পৌঁছে গেছি। কিন্তু সত্য হচ্ছে, এই অবস্থা থেকে আমাদের আবার ফিরে আসতে হয়। যে অবস্থা থেকে আমাদের ফিরে আসতে হয় সেই অবস্থা হচ্ছে আত্মার প্রাজ্ঞ - অবস্থা অর্থাৎ আমাদের তৃতীয় অবস্থা, বা সুসুপ্তির অবস্থা।
এখন আমরা মাণ্ডূক্য উপনিষদের ষষ্ঠতম শ্লোক থেকে আলোচনা শুরু করবো। উপনিষদ বলছে, প্রজ্ঞা হচ্ছে সমস্ত বস্তুর অধীশ্বর। এই প্রজ্ঞাই সর্বজ্ঞ, ইনিই অন্তর্যামী। সমস্ত বস্তু এই প্রজ্ঞা থেকে উৎপন্ন হয়, আবার প্রজ্ঞাতেই লিন হয়ে যায়। প্রজ্ঞাই সমস্ত কিছুর কারন।
প্রজ্ঞার সমার্থক শব্দ হচ্ছে আত্মা। অর্থাৎ আত্মাই সর্বেশ্বর। আত্মাই সব কিছুর অধীশ্বর। এবং আত্মাই সব কিছুর নিয়ন্তা। জাগ্রত স্বপ্ন বা সুসুপ্তির অবস্থাতে "আমি"ই সব কিছুর অধীশ্বর। আত্মা যেহেতু সমস্ত জ্ঞানের উৎস তাই এঁকে বলা হচ্ছে সর্বজ্ঞ। এই আত্মাই আমাদের অন্তরে নিহিত, যিনি অন্তর্যামী। এই আত্মা আমাদের সকলের হৃদয়ে বিরাজিত। ইনি সর্বত্র, সর্ব্ব বস্তুতে বিরাজ করছেন। আত্মাই সব কিছুর কারন ও উৎস। এই আত্মাকেই উপনিষদ বলছে ব্রহ্ম, ব্রহ্ম ছাড়া কোনো কিছুর অস্তিত্ত্ব নেই। আত্মাই সমস্ত বস্তুর উৎপত্তি ও বিনাশের কারন। জন্ম ও মৃত্যুর জন্য ইনিই দায়ী। বলা হয়ে থাকে মৃত্যুর পর আমরা যেখান থেকে এসেছিলাম, সেখানেই ফিরে যাই, অর্থাৎ আত্মাতেই ফিরে যাই। বুদ্বুদ যেমন জলাধারে তৈরী হয়, আবার জলের সঙ্গে মিলিয়ে যায়, একই ভাবে প্রাণী বা ভূত বা সমস্ত বস্তু একই উৎস থেকে আসে আবার একই উৎসে ফিরে যায়।
উপনিষদ বলছে, সত্য এক ও অপরিবর্তনীয়। নাম ও রূপের ভিন্নতার জন্য আমরা বহু দেখি। অলঙ্কার ও সোনার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। মাটি ও কলসির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দৃশ্যমান জগৎ ও আত্মার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ক্ষণস্থায়ী বস্তুর মধ্যে বৈচিত্র, চিরস্থায়ী বস্তুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এখন কথা হচ্ছে, কেমন করে আমরা বুঝবো যে আমরাই সেই পরম সত্য। বেদান্ত বলছে, তুমি যদি নিজের অস্তিত্ত্বে বিশ্বাস করো, আর পরম সত্য বলতে যদি এক ও অভিন্ন বুঝে থাকো, তবে জেনো তুমি নিজেকে কখনো আলাদা করতে পারো না সেই পরম-সত্য থেকে। আর শুধু বিশ্বাস করলেই হবে না, আমরা যতক্ষন না সেই পরম সত্যের সঙ্গে একাকার হয়ে যাচ্ছি ততক্ষন আমাদের মূল অস্তিত্ত্বের বোধ জাগ্রত হবে না। এখন কথা হচ্ছে, এই অস্তিত্ত্বের বোধ জাগবে কি করে ? যে সত্য থেকে আমি নিজেকে পৃথক ভাবি, এই যে ভাবনা এটা আমাদের অজ্ঞান। এই অজ্ঞানতা থেকেই আমাদের দ্বৈত ভাবনার শুরু। কিন্তু পরম সত্ত্বা কখনোই দুটি হতে পারে না। আমাদের সবার মধ্যে সেই একই সত্ত্বা বিরাজ করছে। আর দ্বৈত ভাবনা থেকেই আমাদের সকল দুঃখের শুরু। আমাদের ভেদ বুদ্ধি আমাদের যন্ত্রণার কারন। উপনিষদ বলছে জীবাত্মা ও পরমাত্মা এক ও অভিন্ন।
মাণ্ডূক্য উপনিষদ ৭ম শ্লোকে বলা হচ্ছে : তুরীয় অবস্থা অন্তরস্থ ঘটনা সম্পর্কে সচেতন নন। তুরীয় তৈজস নন। তৈজস অর্থাৎ তেজবিকার যা রজোগুণ থেকে উৎপন্ন। বাইরের ঘটনা সম্পর্কে তুরীয় অবস্থা সচেতন নন। অর্থাৎ তুরীয় অবস্থায় আমাদের বাইরের বিশ্বের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকে না। এমনকি আমাদের জাগ্রত ও স্বপ্ন অবস্থার মাঝামাঝি কোনো কিছু সম্পর্কে সচেতন নন। আবার সুসুপ্তির অবস্থার প্রাজ্ঞ নন। ইনি সর্বজ্ঞ নন আবার অচৈতন্য নন.. ইনি অদৃশ্য, লৌকিক ব্যবহারের অতীত। কর্ম্ম-ইন্দ্রিয় বা জ্ঞান-ইন্দ্রিয় এই দুইয়ের উর্দ্ধে। যিনি মনেরও অগোচর। এমনকি কোনো শব্দ দ্বারা যিনি নির্দেশিত নন। এই অবস্থায় অর্থাৎ তুরীয় অবস্থায় থাকে শুধু আত্মার চৈতন্য, এখানে জগতের কোনো অস্তিত্ত্ব নেই। এখানেই শান্তি ও কল্যাণের মূর্ত প্রকাশ। এই চৈতন্য এক, ও অদ্বিতীয়। যারা প্রাজ্ঞ অর্থাৎ তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন, আত্মজ্ঞান সম্পন্ন, তাঁরা এঁকেই আত্মা বলে থাকেন। আর এই আত্মাকেই আমাদের উপলব্ধি করতে হবে।
আত্মাকে কখন আমরা উপলব্ধি করবো ? উপনিষদ বলছে, "প্রপঞ্চ উপশমং" । অর্থাৎ যখন আমাদের প্রপঞ্চের উপশম হবে, তখন আমরা আত্মাকে উপলব্ধি করতে পারবো। । প্রপঞ্চ কথাটার মানে হচ্ছে এই অনিত্য দৃশ্যমান জগৎ, আর উপশমং কথাটার অর্থ হচ্ছে দূরীভূত হওয়া বা অস্বীকার করা।
এই যে দৃশ্যমান জগৎ আমাদের সামনে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে পরিস্ফুট হচ্ছে, এই যে পঞ্চভূতের গড়া জগৎ একে যখন আমরা অস্বীকার করতে পারবো, তখন আমরা আত্মাকে উপলব্ধি করতে পারবো। এই জগৎ নাম-রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়। এই নাম-রূপ বর্জিত হলে, অবশিষ্ট থাকে একত্ত্ববোধ। এই একত্ত্ববোধেই শান্তি, আনন্দ - শান্তম শিবম অদ্বৈতম। সাধারণ ভাবে আমরা একে অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত। কিন্তু যেখানে দুই নেই সেখানে কোনো দ্বন্দ্ব নেই, সেখানে কেবল আনন্দ আর শান্তি। একেই বলে তুরীয় অবস্থা যা আমাদের চতুর্থ অবস্থা। ব্রহ্মের এই অবস্থায় আমাদের প্রকৃত অবস্থা। এই অবস্থাই আত্মার প্রকৃত অবস্থা। এই অবস্থাকে আমাদের জানতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে। এখন কথা হচ্ছে জানবে কে ? উপলব্ধি করবে কে ? কোনোকিছু জ্ঞাত হতে গেলে একজন জ্ঞাতা চাই, তো আমার যদি কোনো পৃথক সত্ত্বা না থাকে, তবে এই আত্মাকে বা জ্ঞেয় বস্তুর জ্ঞাতা কে ? আচার্য্য শংকর বলছেন, আমরা যে নিজেরাই আত্মা এই জ্ঞান একমাত্র আত্মাতেই জ্ঞাত হতে পারে। আমাদের আত্মা সম্পর্কে অজ্ঞানতা দূর হলেই আত্মাকে জানা যাবে। গৌড়পাদ বলছেন, দ্বিতত্ত্বের ধারণা যখন দূরীভূত হয়, তখন আত্মা জ্যোতির্ময় রূপে প্রকাশিত হন। আর আত্মার জ্যোতিচ্ছটা দ্বারা সকল বস্তুর মধ্যে ঐক্য দর্শন সম্ভব হয়। মানুষ যখন তুরীয় অবস্থায় উপনীত হয়, তার সমস্ত অজ্ঞান দূর হয়, তখন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দৃশ্যমান জগৎ মিলিয়ে যায়, আর ব্রহ্ম একীভূত অবস্থায় প্রকাশিত হয়। তাই তুরীয় অবস্থায় আমরা সবাই মুক্ত। তুরীয় অবস্থায় আমরা কোনো কিছুর সঙ্গে লিপ্ত থাকি না। তখন আমি অপরিবর্তনীয় স্বতন্ত্র অদ্বিতীয় সত্ত্বা। তখন মনে হয়, আমিই সকলের মধ্যে বিরাজিত এক ও অভিন্ন আত্মা।
আজ এই পর্যন্ত। পরবর্তীতে আমরা ৮ম শ্লোক থেকে শুনবো। আসলে এই বিষয়টি গম্ভীর। বিশেষ করে তুরীয় অবস্থা জ্ঞাত হওয়া বাইরের বিষয় নয়। এটি অন্তরের বিষয়। তাই আমাদের অন্তর যত স্বচ্ছ হবে, তুরীয় অবস্থার চিত্র তত স্পষ্টভাবে আমাদের অন্তরে ধরা পড়বে । নতুবা এই সব বিষয় আমাদের কাছে বিস্বাদ লাগবে। যাই হোক, আজ বাক্যের বিরাম দিলাম। পরের দিন আবার আমরা এই বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করবো। এপর্যন্ত যা শুনলাম, তা যেন আমরা মনন করতে থাকি।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
মাণ্ডক্য উপনিষদ (শ্লোক ৮-১২) ওঙ্কারের তিন মাত্রা চারপাদ।
ওং ভদ্রং কর্নেভিঃ শৃনুয়াম দেবা
ভদ্রং পশ্যেম অক্ষভিঃ যজত্রাঃ।
স্থিরৈঃ অঙ্গৈঃ তুষ্টুব্যাংসঃ তনূভিঃ
ব্য়শেম দেবহিতং যদায়ুঃ।।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।।
আমরা শুনছিলাম মাণ্ডূক্য উপনিষ থেকে। এর আগের দিন আমরা সপ্তম শ্লোক অবধি শুনেছিলাম। আজ আমরা অষ্টম শ্লোক থেকে শুনবো।
আমরা শুনেছি, ব্রহ্ম বা আত্মা চতুষ্পাদ, আর এই পাদগুলো হলো, ১) জাগ্রত অর্থাৎ বিশ্ব, ২)স্বপ্ন অর্থাৎ তৈজস, ৩) সুষুপ্তি বা প্রাজ্ঞ এবং ৪) তুরীয় বা শুদ্ধ চৈতন্য। তুরীয় অবস্থাই আত্মার প্রকৃত অবস্থা। অর্থাৎ আত্মার মাত্রা তিনটি জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি।
আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল, ওঙ্কার বা প্রণব। এই ওঙ্কারের আলোচনা করতে গিয়ে আমরা ব্রহ্মার বা আত্মার বা পরমাত্মার তিনটি অবস্থার কথা শুনছিলাম। আসলে উপনিষদ উচ্চস্বরে ঘোষণা করছে, অহম ব্রহ্মাস্মিন - আমিই ব্রহ্ম। ওং তৎসৎ। ওঙ্কারই সত্য। তত্ত্বমসি - তিনিই সেই।
অষ্টম শ্লোকে বলছেন : জীবের যেমন বিভিন্ন অবস্থা, ব্রহ্মারও বিভিন্ন অবস্থা। ব্রহ্মা বা আত্মার তিনটি মাত্রা - বিশ্ব, তৈজস, ও প্রজ্ঞা। ঠিক তেমনি ওঙ্কারের মাত্রা তিনটি অর্থাৎ অ,উ,ম। এখানেও অর্থাৎ ওঙ্কারেও সেই একই পরমাত্মা। আত্মার পাদসমূহ ওঙ্কারের মাত্রা। আবার ওঙ্কারের মাত্রাগুলোই আত্মার পাদ। অকার, উকার, ও মকার এই তিনটি ওঙ্কারের মাত্রা। তুরীয় অবস্থা মাত্রার উর্দ্ধে। কারন তুরীয় অবস্থা বর্ণনার উর্দ্ধে।
নবম শ্লোকে বলছেন, জাগ্রত অবস্থায় বৈশ্বানররূপী যে পরমাত্মা তাকে "অ" এই বর্ণের দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে। বৈশ্বানর এবং "অ" উভয়ই সর্বব্যাপী। বৈশ্বানর কথার অর্থ হচ্ছে বহ্নি, অগ্নি, অনল। বিশ্বনর অর্থাৎ বিশ্বরূপী যে বিরাট পুরুষ তার ভিতরে যে অগ্নি আছে, তাকেই বলা হচ্ছে "অ" । বিশ্বনরের জঠরের ভিতরে যে অগ্নি বিরাজ করছে তাকে বলা হয় বৈশ্বানর। বিশ্ব প্রকাশিত হয়, অগ্নির সাহায্যে। অগ্নিবীণা জগৎ অপ্রকাশিত। আর ব্রহ্মের প্রথম অবস্থা হচ্ছে, এই বিশ্বজগৎ। আর ওঙ্কারের প্রথম অক্ষর হচ্ছে "অ" যা বর্ণমালার প্রথম অক্ষর। অর্থাৎ আদ্য অক্ষর হচ্ছে "অ" । "অ" এর উচ্চারণ স্থান হচ্ছে কন্ঠ। তাই একে বলা হয় কন্ঠবর্ন। "অ" এর সতের রকমের অর্থ আছে। আমাদের বিচার্য্য এসব নয়। আমরা এখানে ওঙ্কারের "অ" নিয়ে সম্পর্কযুক্ত। "অ" এর অর্থ অনল বা অগ্নি। যা সমস্ত জগৎকে প্রকাশিত করেছে। আর এর প্রতীক হচ্ছে সূর্য। সূর্য্যই জীবজগৎকে উদ্ভিদসমূহকে এমনকি ব্রহ্মান্ডের সমস্ত কিছুকে প্রকাশিত করছে। উপনিষদ বলছে, শুধু এইটুকু যিনি জানতে পেরেছেন, তার সমস্ত কামনা বাসনা পূর্ন হয়ে গেছে, অর্থাৎ তিনি আপ্তকাম হতে পেরেছেন। তিনি মনুষ্য শ্রেষ্ট।
দশম শ্লোকে বলছেন, স্বপ্নাবস্থায়, আমাদের অর্থাৎ আত্মার তৈজসে অবস্থান। ওঙ্কারের "উ" এর তুল্য ।
"অ" ও "ম" এর মধ্যবর্তী এর অবস্থান। আত্মার যে মাত্রা অর্থাৎ জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি এই তিনের মাঝখানে এর অবস্থান। স্বরবর্ণমালার পঞ্চমবর্ন এই "উ" । এই হ্রস্বস্বর-এর উচ্চারণ স্থান হচ্ছে ওষ্ঠ। ওষ্ঠদ্বয় সংকুচিত ক'রে, এবং সামনের দিকে লম্বালম্বি ক'রে, মুখবিবর ক্ষুদ্রতর ক'রে, এবং জিহ্বা খানিকটা সংকুচিত ক'রে, উচ্চারণ করতে হয়। "উ" শব্দে শিবকে বোঝায়। যেমন উমা অর্থাৎ শিবের স্ত্রী। "উ" শব্দে ব্রহ্মাকেও বোঝায়। "উ" বিকারকালে "ও" উচ্চারণ হয়। যাইহোক ওঙ্কারের "উ" অক্ষরটি হলো তৈজস, যা আমাদের স্বপ্নাবস্থার সঙ্গে তুলনা করে যেতে পারে। এই স্বপ্নাবস্থাতে আমাদের চৈতন্য থাকে। জাগ্রত অবস্থা বলুন, আর স্বপ্নাবস্থা বলুন, উভয় অবস্থাতে ব্রহ্ম বিরাজ করছেন । উপনিষদ বলছে, যিনি এই তত্ত্ব উপলব্ধি করেছেন, তার বংশে ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ জন্ম গ্রহণ করে থাকেন।
মাণ্ডক্য উপনিষদের ১১ তম শ্লোকে বলছেন, সুসুপ্তির অবস্থায়, আত্মা তথা প্রজ্ঞাকে ওঙ্কারের তৃতীয় অক্ষর "ম" এর দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে। উপনিষদে বলা হয়েছে, যেখানে অ এর সাথে বিশ্ব এবং উ এর সাথে তৈজসের সমাপ্তি ঘটে সেখানেই প্রাজ্ঞ এবং "ম" উভয়ের অবস্থান। প্রাজ্ঞ এবং "ম" হলো একত্বে বিলীন হয়ে যাবার সিংহদ্বার। যিনি একথা জানেন, তিনিই এই জগৎকে যথাযথ ভাবে জেনেছেন, এবং জগৎ তাঁর কাছে একটা বিশ্রামস্থল হয়ে উঠেছে।
"ম" - ব্যঞ্জন-বর্ণমালার পঁচিশতম বর্ণ হচ্ছে "ম" । এবং আমরা জানি ব্যঞ্জনবর্ণ কতকগুলো বর্গে বিভক্ত। সেগুলো হচ্ছে ক,চ, ট, ত, প। "ম" হচ্ছে প-বর্গের পঞ্চম অনুনাসিক ওষ্ঠ বর্ণ। প্রত্যেক বর্গের চতুর্থ বর্ন উচ্চারণ কালে, মুখ দিয়ে সমস্ত বায়ু নিঃশেষিত হয়ে যায়, সুতরাং তার পরের অর্থাৎ পঞ্চম বর্ণের উচ্চারনে, যে অতি-অল্প-মুখ-মরুৎ অবশিষ্ট থাকে তার সাহায্যে ওষ্ঠ ভেদ করার শক্তি থাকে না তাই , বর্ণ তখন অনুনাসিক হয়ে পড়ে । এইজন্য, আমরা যখন রুগ্ন-দুর্বল হয়ে পড়ি, তখন আমাদের স্বর অনুনাসিক হয়ে পড়ে । অর্থাৎ আমাদের জীবনীশক্তি যখন প্রায় নিঃশেষিত হয়ে যায়. তখন আমরা অনুনাসিক স্বরে কথা বলি। "ম" অর্থে শিব, ব্রহ্মা, যম, সময়, মরন ইত্যাদি বহু কিছু বোঝায়।
আমরা মাণ্ডক্য উপনিষদের শেষ শ্লোকে চলে এসেছি। ১২তম অর্থাৎ উপনিষদের অন্তিম শ্লোকে বলছেন ওম অর্থাৎ অ-উ-ম এর সম্মিলিত ধ্বনি ওঙ্কার হচ্ছে আমাদের চতুর্থ অবস্থা। বলা হয়, পরমাত্মার বা আত্মার চতুর্থ অবস্থা অর্থাৎ তুরীয় অবস্থা। আত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এই অবস্থায় ব্রহ্ম বা আত্মা অনন্ত। বাক্য-মনের অতীত, অদ্বয় ও শিবস্বরূপ। এই অবস্থা হল শুদ্ধ চৈতন্য, ঈশ্বরাতীত। এখানে স্থুলজগতের কোনো অস্তিত্ত্ব থাকে না। সমগ্র জগৎ বা দ্বিতত্ত্ববোধ তখন লোপ পায়। তুরীয় অবস্থায় আত্মা বৈ কিছু নেই। সাধকের এই অবস্থায় মুক্ত অবস্থা। এখন থেকে আর পুনর্জন্ম হয় না।
সবশেষে দু একটা কথা বলে ব্রহ্মবাক্যের সমাপ্তি টানবো। জীবের যে পরিক্রমা, তার এই চারটি বিশ্রামাগার। সাধারণের বেঁচে থাকা মানে জাগ্রত ও স্বপ্নাবস্থার মধ্যে যাতায়াত।এমনকি আমরা মৃত্যুর পরেও এই স্বপ্নাবস্থাতে অবস্থান করি। কেউ কেউ এখন থেকেই আবার নতুন দেহ ধারণ করে থাকি। যাঁরা ধীর-স্থির-শান্ত স্বভাবের মানুষ তাঁরা তৈজস অবস্থা বা দ্বিতীয় অবস্থা অতিক্রম করে সাময়িক সময়ের জন্য, অর্থাৎ গভীর ঘুমে এই তৃতীয় অবস্থার বা প্রাজ্ঞ অবস্থার আনন্দ গ্রহণ করতে পারেন।এঁরা মৃত্যুর পরে, হাজার হাজার বছর এই নিষ্ক্রিয় অবস্থায় অবস্থান করেন। এবং এঁরা সহজে দেহ ধারণ করে না। আর যাঁরা ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ তাঁরা জীবিত অবস্থায় প্রারব্ধ কর্ম্মে লিপ্ত থাকলেও, তিনি জ্ঞানাতীত চতুর্থ অবস্থার অধিকারী হয়ে থাকেন। এঁদের আর জন্ম মৃত্যু বলে কিছু থাকে না। তখন জীবাত্মাই পরমাত্মা হয়ে যান। এই অবস্থা আমাদের বোধগম্য নয়। কোটিতে গুটি মাত্র এই জ্ঞানাতীত আলোর সন্ধান পেয়ে থাকেন।
ওম সত্যম -শিবম-সুন্দরম।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ . হরি ওম।
No comments:
Post a Comment