Tuesday, 3 March 2020

সাধনা - পর্ব্ব - চার-ছয়, আট (আসন মুদ্রা ) HATHA YOG


সাধনা - পর্ব্ব - চার
 (আসন মুদ্রা - তথ্যসূত্রঃ - শিব-সংহিতা ও হঠযোগ প্রদীপিকা )
যে কোনো কাজ মনোযোগ দিয়ে করতে গেলে সঠিক আসন ও মুদ্রার সাহায্য নিতে হয়। আমাদের ছোটবেলায় বই পড়বার জন্য আসুনকুটে ভদ্রভাবে  বসতে বলতেন।  বা চেয়ার টেবিলে  বসতে বলতেন। মেরুদন্ড সোজা করে বসতে বলতেন। আসলে মনকে একাগ্র করবার জন্য বিশেষ আসনে বসা খুবই গুরুত্ত্বপূর্ন। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনের জন্যও বিশেষ আসনে বসবার নির্দেশ আছে। ঠিক তেমনি আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সাধনা করবার জন্য, বিশেষ বিশেষ আসনে বসবার নির্দেশ আছে। এমনকি খেতে বসতে গেলেও আমাদের বিশেষ আসনে বসতে দেখা যায়।  অর্থাৎ ধর্ম্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ ইত্যাদি লাভ করতে গেলে পুরুষার্থের জাগরণ ঘটাতে হয়। আর এই পুরুষার্থের জাগরণের জন্য, শরীর সুস্থ রাখা একান্ত প্রয়োজন। অসুস্থ ব্যক্তি কখনোই তার সংকল্প পূরণ করতে পারেন না। অসুস্থ ব্যক্তি কখনো সুখে বা আনন্দে থাকতে পারেন না। তাই পৈতৃক সূত্রে আপনি যাই পেয়ে থাকুন না কেন, তা সে ধন-সামগ্রী হোক বা সুদর্শন চেহারা হোক, এগুলোকে যদি আপনি সঠিক ব্যবহার না করতে পারেন, রক্ষা করতে না পারেন, তবে আপনার ইচ্ছেপূরণ কিছুইতে হতে পারে না। আপনার শরীরে যদি রক্ত সঞ্চালন ঠিক ঠিক মতো না হয়, তবে আপনার শরীর হবে দুর্বল। আর দুর্বল শরীরে কখনোই সিদ্ধি লাভ সম্ভব নয়।  ঠিক এই কারণেই আমাদের মুনি-ঋষিগণ কিছু যৌগিক প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেছিলেন। এই যোগক্রিয়ার সাহায্যে আমরা যেমন আমাদের শরীরকে সুস্থ-সবল রাখতে পারি, তেমনি যোগ সাধনার সাহায্যে আমাদের অভীষ্ট সাধন করতে পারি। 

এই যোগ ক্রিয়ার অন্তর্গত হচ্ছে প্রাণায়াম। আর এই প্রাণায়াম করতে গেলে, আসন অর্থাৎ কি ভঙ্গিমায় আমাদের বসা উচিত, এবং মুদ্রা অর্থাৎ কোন ভঙ্গিমায় আমাদের অঙ্গন্যাস করতে হবে তার শিক্ষা দিয়েছেন, আমাদের মুনি ঋষিরগন । ধারণা, ধ্যান, সমাধি করতে গেলে, আমাদের এই আসন-মুদ্রা সম্পর্কে একটা ধারণা থাকা দরকার। যোগ আসলে অন্তরঙ্গ সাধনা। আর প্রাণায়াম হচ্ছে বহিরঙ্গ সাধনা। আবার  প্রাণায়াম করবার জন্য জানা দরকার আসন-মুদ্রা ইত্যাদি।  

আসন দুই প্রকার। ধ্যানাসন ও স্বাস্থ্য-আসন। স্বাস্থ্যাসন  বিশেষ লক্ষ শরীরের স্বাস্থ্য ঠিক রাখা। শরীরের রোগ দূর করা। আর ধ্যান-আসনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, স্বচ্ছন্দ ভাবে ধীর-স্থির হয়ে বসে মনকে তন্ময় করে  আত্মদর্শন করা। 

মুদ্রার কাজ হচ্ছে, আমাদের শরীরে যে অন্তঃস্রাবী ও বহিঃস্রাবী গ্রন্থি আছে, সেগুলোকে সক্রিয় ও সবল করা। এগুলো যেমন আমাদের স্বাস্থা  রক্ষার জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয়, তেমনি মনের চিন্তাধারাকে নিয়ন্ত্রণ করবার জন্য এই মুদ্রার বিশেষ ভূমিকা আছে। 

একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, শরীর ও মন দুজনই আমাদের আধ্যাত্মিক জগতের বাহক। এদের অগ্রাহ্য করে,  আমরা এক পা-ও এগুতে পারবো না। আমরা জানি গ্রন্থি সমূহের মধ্যে যে রস ক্ষরণ হচ্ছে, সেই রস রক্তে মিশে আমাদের রক্তের পুষ্টি বিধান করছে। আবার এই গ্রন্থি রসেই আমাদের বিশ্বশক্তির স্পন্দন  অনুভূত হচ্ছে। এই স্পন্দনই আসলে আমাদের মনের ক্রিয়া। সুতরাং মুদ্রার অনুশীলন যেমন আমাদের স্বাস্থা  রক্ষার জন্য বিশেষ অনুকূল, তেমনি আমাদের মনের শক্তি বাড়াবার জন্য, বিশেষ কার্যকরী। 

আসন : আমরা আগেই শুনেছি আসন দূর রকম। ধ্যানাসন ও স্বাস্থ্যাসন। আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে ধ্যান-আসন। অর্থাৎ যে সব আসনে বসলে আমাদের কোনো কষ্ট  বোধ হবে না, অথচ শরীর  স্থির থাকতে পারবে, তাকেই ধ্যান-আসন বলে।  সিদ্ধাসন বা সুখাসন এবং পদ্মাসন।  এই দুটো আসন সর্ব্বোৎকৃষ্ট।

 তবে একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে, যে আসনেই বসি না কেন, আমরা যেন মেরুদন্ড সোজা রেখে বসি।  অর্থাৎ মস্তক-ঘাড়-পিঠ সোজা থাকে। আর একটা কথা, বিদ্যুৎ অপরিবাহী কোনো বস্তুর উপরে, অর্থাৎ কম্বলের আসনে, বা পশমের আসনে, ব্যাঘ্রচর্মের আসনে অর্থাৎ যার  মধ্যে থেকে আমাদের ধ্যানের  সময় শরীরে  যে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হবে, সেটা যেন আমাদের শরীরকে ঘিরেই অবস্থান করে। দ্বিতীয়ত,আমাদের আসন যেন কোলাহল বর্জিত স্থানে, ও সময়ে  হয়। রাতের দিকে পৃথিবীতে  ধীরে ধীরে উদ্ভূত শব্দের নাশ হতে থাকে। আর ভোরের দিকে পৃথিবী সম্পূর্ণ বা সব থেকে বেশি শান্ত-ধীর অবস্থায় থাকে। এই অবস্থায়, আমরা প্রকৃতির ধ্বনিগুলোই কেবল  শুনতে পাই। এইজন্য, ভোর রাতই  ধ্যানের উপযুক্ত সময়। আমাদের শরীরও তখন ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে না। ফলতঃ এই সময় আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো অন্তর্মুখী থাকে। আমরা তখন অন্তরের বাণী সহজেই শুনতে পাই। 

মুদ্রা : বিভিন্ন ভঙ্গিতে শরীরের অঙ্গস্থাপন করে বায়ুকে রুদ্ধ করাকেই মুদ্রা বলা হয়ে থাকে। যোগমুদ্রা, মূলবন্ধ মুদ্রা, মহামুদ্রা, মহাবেদমুদ্রা, মহাবন্ধ  মুদ্রা,ইত্যাদি অনেক মুদ্রা আছে, যেগুলো মূলতঃ শরীরের বাইরে বা ভিতরে বায়ুকে রুদ্ধ করবার প্রক্রিয়া মাত্র। এছাড়া আর এক রকম মুদ্রা আছে, যেগুলোকে  অঙ্গ ন্যাস বলা হয়ে থাকে। এর মধ্যে ধ্যানমুদ্রা, বায়ুমুদ্রা, শূন্যমুদ্রা, পৃথ্বীমুদ্রা, প্রানমুদ্রা, অপান মুদ্রা, সূর্য্য মুদ্রা, বরুন মুদ্রা, ইত্যাদি  প্রধান। তবে আমাদের উদেশ্য যেহেতু প্রাণায়াম-ধারণা-ধ্যান আমরা ধ্যান মুদ্রা বা ধারণা শক্তি মুদ্রাকে অবলম্বন করে আমাদের লক্ষের  দিকে এগুবো।

এইবার আমরা দেখে নেই কিভাবে আমরা আসনে বসবো। আমরা বসবো পদ্মাসনে অর্থাৎ  বাম উরুর উপর ডান পায়ের চরণ রাখতে হবে। আর ডান  উরুর উপরে বাম চরণ রাখতে হবে। বাহাত বাম উরুর উপরে, আর ডান হাত ডান উরুর উপরে স্থাপন করতে হবে। হাতের পাতা উপরের দিকে, ধ্যান-মুদ্রায়  অবস্থান করবে। ধ্যান-মুদ্রা, অর্থাৎ তর্জনীর অগ্রভাগ বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের অগ্রভাগের সঙ্গে স্পর্শ করবে।   মেরুদন্ড থাকবে সোজা।  চোখ দুটো নিবদ্ধ থাকবে নাসিকাগ্রে। জিহ্বা থাকবে রাজদন্তমূলে। 

আমরা ভদ্রাসনেও বসতে পারি। বা পায়ের গোড়ালি যোনিমুখে স্থাপন করুন। ডান পায়ের চরণ বা পায়ের পাতা বাম পায়ের উরুর উপরে তুলে দিন। মেরুদণ্ড সোজা রাখুন। হাতের পাতা বায়ুমুদ্রা ধারণ করুন।  অর্থাৎ তর্জনীকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের মুলে লাগিয়ে দিন।  বাকি তিনটি আঙ্গুল সোজা থাকবে। এক্ষেত্রেও আমাদের চোখ দুটো নিবদ্ধ থাকবে নাসিকাগ্রে। জিহ্বা থাকবে রাজদন্তমূলে। 

এই দুটো আসন-ই অভ্যাস করুন। কারন প্রথম দিকে একটা আসনে বেশিক্ষন থাকতে পারবেন না। তাই মাঝে মধ্যে আসন পালটে  নিতে হবে ।    

এর পরের দিন আমরা প্রাণায়াম নিয়ে আলোচনা করবো। তবে আমাদের উদ্দেশ্য কিন্তু ধ্যান-সমাধি। তাই শরীরকে সুস্থ রাখবার জন্য, যে ধরনের প্রাণায়ামের কথা বলা হয়ে থাকে, তা আমাদের আলোচনার উদ্দেশ্য নয়। প্রাণের মধ্যে যেহেতু চেতনা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, তাই আমরা প্রাণের সাহায্যে চেতনাতে প্রবেশ করবো। প্রাণ আমাদের গাইড বা সঞ্চালক মাত্র। প্রাণকে ধরা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমাদের উদ্দেশ্য চেতন শক্তি। আর একটা  কথা, যাঁরা আমরা এই আলোচনা শুনছি, তারা যেন এই আলোচনার ধারাবাহিকতা বজায় রাখি। না হলে আমরা পথভ্রষ্ট হবো। এসব তো বিনোদনের বিষয় নয়, বিষয়ের গভীরে যিনি প্রবেশ করতে পারবেন, তার মধ্যে একটা আগ্রহ জাগ্রত হতে পারে, আর এই পথ মোটেই মসৃন নয়। যোগে প্রবেশ করতে গেলে, একাহারী হতে হবে, ব্রহ্মচর্য্য পালন করতে হবে। চিন্তায়-মনে-প্রাণে শুদ্ধাচারী হতে হবে। এবং ধৈর্য্যশীল হতে হবে। কর্ম্মে প্রবৃত্ত হলে  বিশ্বাস অবশ্যই  আপনা থেকেই এসে যাবে। কেননা এই পথে পা দিলে, বর্তমান আমি-র  মৃত্যু অবশ্যই হবে, আর নতুন আমি-র জন্ম হবে। কেননা এই পথ সেই  পাগোলের পথ, যারা ধরো-মারো-কাটো-খাও প্রবচনে বিশ্বাস করেন । গুরুকে ধরো,  ইন্দ্রিয়গুলোকে মারো, বন্ধন-পাশ কেটে ফেলো, আর সদানন্দে অমৃত ভক্ষণ করতেই থাকো। 

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম। 
সাধনা - পর্ব্ব - পাঁচ (তথ্যসূত্রঃ - শিব-সংহিতা ও হঠযোগ প্রদীপিকা )
আমরা আজ বিশেষ গুহ্য  বিদ্যার মধ্যে প্রবেশ করবো। 
এই গুহ্য যোগ বিদ্যার উপদেশ দান  করেছেন, স্বয়ং মহেশ্বর দেবাদিদেব শিব, সেই অনাদিনাথ।  আমরা তাঁর উদ্দেশ্য আমাদের ভক্তিপূর্ন  প্রণাম জানাই। ওম নমঃ শিবায়। আমরা প্রণাম জানাই হঠযোগ বিদ্যার সঙ্কলক সেই স্বাত্মারাম গুরুনাথকে। আমরা প্রণাম জানাই গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথকে, প্রণাম জানাই  গুরু গোরক্ষনাথকে। যাদের কৃপায় স্বাত্মারাম এই বিদ্যাকে আয়ত্ত্ব করেছিলেন।

আসলে এই যোগবিদ্যা মূলতঃ নাথসম্প্রদায়ের দ্বারা জাগরিত, রচিত ও প্রচারিত। এটি আসলে আমাদের মূলাধারস্থিত কুণ্ডলিনী জাগরণের প্রক্রিয়া। অশেষ কৃচ্ছসাধনের ফলে শরীরের মধ্যে অগ্নিশক্তি প্রজ্জ্বলিত ক'রে, কচ্ছপের মতো কঠিন আধার দ্বারা আবৃত এই কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগরিত করতে হয়। হঠযোগ সাধকের আশ্রয় অবশ্যই হওয়া উচিত উপযুক্ত গুরুর কাছে , আর বাস হওয়া উচিত  মঠ-মন্দিরে। এটি গুরুবিদ্যা। গুরুবিনা এই সাধন, ফল প্রসব করে না। এটি যেমন একটা শারীরিক প্রক্রিয়া, তেমনি এটা বায়ু ধারনের প্রক্রিয়া, মানসিক ভাবের প্রক্রিয়া। শারীরিক প্রক্রিয়া শেখানো যায়। বায়ু ধারনের প্রক্রিয়া হয়তো ক্ষানিকটা শেখানো যায়। কিন্তু বায়ু ধারনের ফলে যে প্রিতিক্রিয়া হয় আমাদের স্থূল শরীরে, তাকে প্রতিরোধ করবার জন্য, যে বিদ্যা তা শেখানো যায় না। আর সবথেকে বড় কথা হচ্ছে, মানসিক ভাবের উচ্চতা আনবার জন্য, গুরুদেব বাকহীন ভাবের বিনিময় করে থাকেন। এই ভাবের বিনিময় একমাত্র যোগ্য গুরুই করতে পারেন। অন্যভাবে সম্ভব নয়। তবে আমাদের  বিবেক গুরু যদি সক্রিয় থাকে তাহলেও সাধকের  উন্নতি সম্ভব।  কিন্তু তা কোটিতে গুটিমাত্র হয়ে থাকে। তাই এই পথে সৎ গুরুদেবের কৃপা ভিন্ন এই সাধনা নিষ্ফল। তাই  
আমরা আবার একবার  শুনবো, এই পথে গুরুকরণের আবশ্যকতা কেন ? 
প্রথমত এই বিদ্যা গুপ্ত বিদ্যা।  এই বিদ্যা একমাত্র গুরুই জানেন। এবং এর সঠিক প্রয়োগ একমাত্র গুরুই জানেন, তাই এই বিদ্যা গুরুমুখেই শুনতে হয়, গুরুর সান্নিধ্যে থেকেই অভ্যাস করতে হয়। মহাত্মা গোরক্ষনাথকে এই বিদ্যা শিখিয়েছিলেন, তার গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ নিজে। এই গোরক্ষনাথের নামেই গোরক্ষপুর। এই গোরক্ষনাথের নামেই গোর্খা সম্প্রদায়। এই মৎস্যেন্দ্রনাথ বাস করতেন নেপালে। সেখানে বৌদ্ধ ধর্মমতের মানুষ।  তথাপি মৎস্যেন্দ্রনাথ তার নিজ অলৌকিক ও ঐশ্বরিক ক্ষমতা বলে বৌদ্ধদের কাছ থেকে স্বয়ং মহাদেবের ন্যায় পূজিত হয়েছেন। এখনো বৌদ্ধরা মৎস্যেন্দ্রনাথকে সেই শ্রদ্ধার আসনেই বসিয়ে রেখেছেন। যাই হোক আমরা আলোচনা করছিলাম গুরুকরণের কথা। একটা কথা মনে রাখবেন, আপনি যদি এই পথের  পথিক হন, তবে গুরুকেই জানবেন, মাতা-পিতা-দেবতা। কোনো প্রকার সন্দেহ না রেখে, আমাদের মন-বাক্যের দ্বারা গুরুকে প্রসন্ন রাখতে চেষ্টা করবেন । তার সেবা করতে হবে। প্রতিদিন গুরুকে প্রদক্ষিণ করে অন্ততঃ তিনবার প্রণাম করতে হবে। অর্থাৎ গুরুর প্রতি প্রতিমুহূর্তে শ্রদ্ধা রাখতে হবে, তার আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে হবে অর্থাৎ নিজের অহংকারকে বিসর্জন দিতে হবে। গুরু-অন্ত  প্রাণ  নিয়েই প্রাণের সাধনা সম্ভব হয় । আর আমরা যদি গুরুণত প্রাণ হতে পারি, তবে অবশ্যই গুরুর কৃপায় আমাদের আত্মজ্ঞান লাভ হবে। সিদ্ধিলাভ অবশ্যম্ভাবী। 
যাইহোক, আজ আমরা এই বিষয়ে স্থুল জ্ঞানের বিনিময় করবো মাত্র। তার বেশি কিছু নয়। আর এই সাধনায় যেহেতু পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে, তাই গুরুবিনা এই সাধন যথেষ্ট বিপদের। কতকগুলো ঔষধ আছে, যেগুলো ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই আমরা খেয়ে থাকি। যদিও এটাও উচিত নয়, তথাপি এতে কোনো ক্ষতি নাও হতে পারে।  আবার কতকগুলো ঔষধ আছে, যেগুলো ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অবশ্য়ই সেবন করা উচিত নয় ।  তাতে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। তাই এই হঠযোগ বিদ্যাকে গোপন রাখা হয়ে থাকে। কারন হঠযোগ যেমন উচ্চফল প্রদায়িনী বিদ্যা, তেমনি পথভ্রষ্ট হলে এতে  সাধকের জীবন-সংশয় দেখা দিতে পারে। 

স্বাত্মারাম বলছেন, সাধক চার-হাত পরিমিত স্থানে বাস করবেন। আগুন, জল, পাথর বর্জিত স্থানে বাস করবেন। শরীর রক্ষার জন্য তিনি ভিক্ষা বৃত্তি অবলম্বন করবেন। আর সর্বদা নির্জনেই বাস করবেন। স্থানটি মশা-মাছি-পোকা-মাকড় বর্জিত হবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আর সব চেয়ে বড় কথা, গুরুসন্নিকটে যোগ অভ্যাস করতে হবে। 

পরিমিত আহার করতে হবে। অর্থাৎ পেটের অর্ধেক খাবার, একচতুর্থাংশ  জল, বাকি একচতুর্থাংশ বায়ু থাকবে। একাহারী হতে হবে। সূর্য অস্ত গেলে আর খাবার গ্রহণ করা চলবে না।  এতে করে, শরীর থাকবে মেদহীন, আলস্য দূরীভূত হবে, কাজ-কর্ম্মে উৎসাহ বাড়বে। অতিরিক্ত তেতো, অতিরিক্ত টক, মাছ, শাক, মাংস, মদ, রসুন, পেঁয়াজ, হিং, ইত্যাদিকে অপথ্য বলে জানবেন। রান্নাকরা খাদ্য সব সময় গরম খাবেন।  দুইবার গরম করা করা খাবার খাবেন না।  গম, জব, ঘি, দুধ মাখন, মিশ্রি, সরু ধানের চাল, মুগ, ছোলা, মাষকলাই, ইত্যাদি খাবার যোগীর পক্ষে ভালো।  তবে শেষ কথা হচ্ছে নিজের রুচি-পছন্দ মতো, নিজের শরীর বুঝে খাবার খান। মনে রাখবেন, শরীর রক্ষার জন্য খাবার, খাবারের জন্য শরীর নয়। শরীর উত্তেজিত হতে পারে, এমন কোনো খাদ্য যোগীর গ্রহণ করা উচিত নয়। আমরা সাধারণত যা খাবার খাই, তার এক-চতুর্থাংশ খাবারেই আমাদের শরীর বেঁচে থাকতে পারে। বাকি খাবার হয় উদ্বৃত্ত। ফলতঃ তা থেকে তৈরি হয় চর্বি বা বেরিয়ে যায় মল হিসেবে। তাই খাবার হবে আমাদের পরিমিত।   
বেশি কথা বলা চলবে না। সম্ভব হলে মৌন থাকতে হবে। সর্বদা গুরুমুখী হয়ে থাকতে হবে।
স্বাত্মারাম বলছেন, উৎসাহ,সাহস, ধৈর্য্য, তত্ত্বজ্ঞান, যোগের সিদ্ধিলাভ সম্পর্কে নিশ্চিত বিশ্বাস রাখতে হবে।  অবাঞ্চিত মানুষের সঙ্গ  ত্যাগ করতে হবে। 

যম-নিয়ম-আসন পালন করতে হবে। 
যম - অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রম্হচর্য্য, ক্ষমা, ধৃতি, দয়া, আর্জব, মিতাহার, শৌচ, এই দশটিকে বলে যম।  এগুলো নিয়ে আমরা আগে আলোচনা করেছি।
নিয়ম- তপস্যা - একই ভাবনাকে নিরন্তর চালিয়ে, ভাবনার শক্তিকে বৃদ্ধি  করা। 
সন্তোষ - নিজ সাধন পথে সাময়িক রূপে তৃপ্ত থাকা। 
আস্তিক্য - সৎ অর্থাৎ ঈশ্বর আছেন, এই ভাবকে দৃঢ় করা। 
দান - কোনোকিছু দেওয়ার প্রবৃত্তির অনুশীলন করা।  
ঈশ্বরপূজন - বিশ্বস্রষ্টাকে জেনে নিজেকে পবিত্র করা। 
সিদ্ধান্ত বাক্যশ্রবণ - পরীক্ষা নিরীক্ষার দ্বারা মুনি-ঋষিগণ যে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, সেই বিষয়ে শ্রবনের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন।  
হ্রী - নম্রতা বজায় রাখতে হবে। 
মতি - নিজের সুবুদ্ধিকে জাগ্রত করতে হবে। 
জপ - নিজের লক্ষ বস্তু বা কাম্য বিষয়ে নিরন্তর ভাবনা করতে হবে।

 আমরা জানি জীবন হচ্ছে শ্বাসের খেলা। শরীরে বায়ুর চঞ্চলতা থাকলে চিত্তও চঞ্চল হয়। আর এই বায়ু যখন নিশ্চল হয়, চিত্তও স্থির হয়। দেহে  যতক্ষন প্রাণবায়ু বিদ্যমান আছে, ততক্ষন আমরা বেঁচে থাকি। দেহ থেকে প্রাণবায়ু নিষ্ক্রান্ত হলে আমাদের এই স্থূল দেহের মৃত্যু হয়। অতএব দেহের মধ্যে বায়ু ধারণ করে রাখা বেঁচে থাকার জন্য জরুরী। 

এখন কথা হচ্ছে বায়ু চলাচলের রাস্তা হচ্ছে আমাদের নাড়ী মন্ডলী। এই নাড়ী যদি বিশুদ্ধ না থাকে, তবে বায়ু সঞ্চরণ সম্ভব নয়। অর্থাৎ নাড়ীর মধ্যে যে ছিদ্রপথ আছে, তা যদি পরিষ্কার না থাকে, তবে নাড়ীর মধ্যে বায়ু  প্রবেশ করতে পারেনা। এই নাড়ীগুলোর মধ্যে যে কফ-পিত্ত-মল  ইত্যাদিতে ভর্তি হয়ে আছে, প্রাণায়ামের সাহায্যে সুষুম্নানাড়ীর মধ্যে যে  সূক্ষ্ম ছিদ্রপথ আছে, তার মধ্যে যে মল-ইত্যাদি আছে তাকে বিশুদ্ধ করবার নামই নাড়ী শুদ্ধি প্রক্রিয়া।  

প্রাণের আয়াম অর্থাৎ প্রাণ-শক্তির বিস্তার, প্রসারণ, সংযমন।  প্রাণশক্তির বৃদ্ধি ও প্রাণশক্তির সংযম এই দুই কাজই  প্রাণায়ামের সাহায্যে হয়ে থাকে। সাধারণ ভাবে দেহের মধ্যস্থ বায়ুর ক্রিয়াকে প্রাণক্রিয়া বলে। এই বায়ু, দেহের মধ্যে নিয়মিত চলাচল করতে পারলে, আমাদের দেহে কোনো ব্যাধি বাসা বাঁধতে পারে না। এই জন্য দেহের নাড়ীর মধ্যে যাতে বায়ু স্বাভাবিক ভাবে চলাচল করতে পারে, সেজন্য দেহের ভিতরের বায়ুকে কতকগুলো প্রক্রিয়ার দ্বারা সংয়মিত করা হয়ে থাকে। দেহের মধ্যে বায়ুর যে ক্রিয়াস্থান, এই ক্রিয়া-স্থান ভেদে বায়ুকে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যেমন ১. বুকের মধ্যের বায়ুকে বলে প্রাণ। ২. নাভি থেকে নিম্নাঙ্গের বায়ুকে বলে অপান।  ৩. নাভি থেকে বুকের নিচ পর্যন্ত যে স্থান সেখানকার বায়ুকে বলে সমান। ৪. কন্ঠের বায়ু উদান। ৫. এছাড়া সর্ব্ব শরীরে যে বায়ু ছড়িয়ে আছে তাকে বলে ব্যান বায়ু।এগুলোর ক্রিয়া সম্পর্কে আমরা আগে শুনেছি।  এছাড়া আমাদের শরীরে যে সাড়ে তিন লক্ষ বা অসংখ্য  নাড়ী আছে তার মধ্যে ছড়িয়ে আছে যে বায়ু, সেগুলো হচ্ছে, নাগ, কূর্ম্ম, কৃকর, দেবদত্ত ও ধনঞ্জয়। আর এগুলোর কর্ম্মক্ষেত্ৰ বা চলাচলের ক্ষেত্র হচ্ছে ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, বজ্রাক্ষ্যা ও চিত্রাণি। নাগ বায়ু আমাদের উদ্গার তুলতে সাহায্য করে। কূর্ম্ম বায়ু আমাদের উন্মীলন অর্থাৎ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের সংকোচন-প্রসারণের সাহায্য করে থাকে। কৃকর বায়ু আমাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা জাগিয়ে তোলে। দেবদত্ত বায়ু আমাদের হাই  তুলতে সাহায্য করে। এবং ধনঞ্জয় বায়ু আমাদের হিক্কা তুলতে সাহায্য করে। এইভাবে বায়ু ও তার ক্রিয়া-পদ্ধতি সম্পর্কে যিনি উপলব্ধি করেছেন, তিনি সেই বিরাট-পুরুষ ব্রহ্মান্ডকে আবার এই ক্ষুদ্র ভান্ডকে জ্ঞাত হতে পেরেছেন।  তিনি নিশ্চিত-রূপে মুক্ত পুরুষ এবং অবশ্যই উত্তম অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছেন। 
স্বয়ং শিব বলছেন - যিনি বিষয়াসক্ত, যিনি অবিশ্বাসী, যিনি অহেতুক বেশি কথা বলেন, যিনি গুরু সান্নিধ্যে থাকেন না, তাদের এই পথে সাফল্য দুরস্ত। 
যারা মিথ্যাবাদী, নিষ্ঠূর বাক্য বলেন, গুরুর প্রতি অসন্তুষ্ট থাকেন, তাদের সিদ্ধিলাভ সম্ভব নয়। যিনি গুরুর প্রতি বিশ্বাসী নন, যিনি গুরুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন, যিনি গুরুকে ভগবান তুল্য মনে না করেন, যার সমতা ভাব আসে নি, যিনি ইন্দ্রিয় সংযম আয়ত্ত্ব করতে পারেন নি, যিনি অতিরিক্ত ভোজন করেন, তাদের যোগসিদ্ধির কোনো সম্ভাবনা নেই।  
যোগবিৎ গুরুলাভ ভাগ্যের ব্যাপার। যদিও ভাগ্যের ব্যাপার বললাম, কিন্তু আমাদের যোগ্যতার অর্জনের উপরে নির্ভর করবে গুরুলাভের উপায়। মৎস্যেন্দ্রনাথ স্বপ্ন দেখেছিলেন, স্বয়ং শিব তাকে নির্দেশ দিচ্ছেন, গোরক্ষনাথের খোঁজ করবার জন্য। যিনি গভীর জঙ্গলে পথ হারিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। তো মৎস্যেন্দ্রনাথ তাঁর শিষ্যদের পাঠিয়ে গোরক্ষনাথকে মঠে নিয়ে এসেছিলেন। এটা  ভাগ্যে, না আমাদের কর্ম্মফল সেটা সুধী পাঠক বুঝে নেবেন। 
এর পরে শুরু হবে আমাদের নাড়ীশুদ্ধি প্রক্রিয়া।  অর্থাৎ আমাদের নাড়ী সকলের মধ্যে যে মল জমে আছে, সেগুলোকে পরিষ্কার করবার প্রক্রিয়া ।   
 আসনে টান টান হয়ে বসে, হাতজোড় করে গুরুদেব কে প্রণাম করুন,ডানদিকে বিঘ্ননাশক 
শ্রীগণেশকে প্রণাম  করুন, বামে রুদ্রদেবতাকে  প্রনামকরুন। পুনরায়, বাম  দিকে মা দুর্গাকে প্রণাম করুন। এর পরে ধীরে ধীরে নাড়ীশুদ্ধি প্রক্রিয়া শুরু করুন। 
১. ডান হাতের বুড়ো আঙুলের দ্বারা ডান  নাক অর্থাৎ পিঙ্গলা নাড়ীকে বন্ধ করুন, এবার ইড়া নাড়ী দ্বারা অর্থাৎ বাম নাসাপুটের  দ্বারা বায়ুকে ধীরে ধীরে যথাসাধ্য টেনে নিয়ে অন্তর-কুম্ভক  করুন। এর পর পিঙ্গলা নাড়ী দিয়ে ধীরে ধীরে বায়ু ত্যাগ বা রেচক করুন। এর পর পিঙ্গলা নাড়ী দিয়ে বায়ু টানুন -  অর্থাৎ পূরক করুন, আবার অন্তর-কুম্ভক করুন। এই প্রক্রিয়া অনেকটা অনুলোম বিলমের মতো পার্থক্য হচ্ছে অনুলোম বিলোমের সময় কুম্ভক করতে হয় না। এক্ষেত্রে কুম্ভক করতে হয়। একটা কথা মনে রাখবেন, আমরা কিন্তু শরীরের স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য প্রাণায়াম করছি না। আমরা আত্ম-উপলব্ধি করতে চাই। আর এই প্রক্রিয়ায় কুম্ভক একটা বিশেষ ভূমিকা নেবে। আমাদের সেকথা মনে রাখতে হবে। এই প্রক্রিয়া প্রতিদিন সকাল, অর্থাৎ সূর্য-উদয়ের একঘন্টার মধ্যে, দুপুরে যখন সূর্য মধ্য-গগনে,  বিকেলে অর্থাৎ সূর্য অস্ত যাবার সময়, এবং মধ্যরাত্রে অর্থাৎ সূর্য যখন আমাদের অবস্থানের বিপরীতে অবস্থান করবে - এই সময়গুলোর সৎ-ব্যবহার করতে হবে। প্রতিবারে, ২-৩ মিনিট থেকে শুরু করুন, ক্রমে ক্রমে এই প্রক্রিয়া ১৫ মিনিট করে করতে থাকুন। এইভাবে তিনমাস প্রতিদিন নিয়ম করে,করতে থাকুন।  মনে রাখবেন, এক দিনের অনিয়ম মানে ১০ দিন পিছিয়ে যাওয়া। এতে করে তিন মাসে মধ্যেই অবশ্য়ই আপনার নাড়ীশুদ্ধি হয়ে যাবে অর্থাৎ আপনার নারীর মধ্যে যে মল জমে আছে, সেগুলো ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে যাবে। আর নাড়ীর মধ্যে বায়ু চলাচলের রাস্তা পরিষ্কার হবে। এটি যোগের আরম্ভ, তাই একে বলে আরম্ভ কুম্ভক।  
মহাদেব বলছেন : এই প্রক্রিয়া ঠিক ঠিক মতো চলতে থাকলে যোগীর দেহের মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখা দেবে। যোগীর সর্বাঙ্গে  একটা  সমতা দেখা দেবে। দেহের ঘামের দুর্গন্ধ দূর হবে। চেহারার মধ্যে একটা ঔজ্বল্য দেখা দেবে। কন্ঠস্বর মধুর হবে। এমনকি যে কোনোদিন গান গাইতে পারতো না, সেও সংগীত সাধনার যোগ্য হবে। খাদ্য হজমের জন্য জঠরাগ্নি উদ্দীপ্ত হবে। হৃদয়ে পূর্নতা আসবে। একটা সুখী সুখী ভাব স্ফূর্তি ভাব আপনাকে সব কাজে উৎসাহ যোগাবে। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি 


সাধনা - পর্ব্ব - ছয়  (তথ্যসূত্রঃ - শিব-সংহিতা ও হঠযোগ প্রদীপিকা )

আজ আমরা শিবসংহিতা থেকে কিছু অদ্ভুত ক্ষমতাসম্পন্ন কিছু মদ্রার কথা শুনবো। জরা-ব্যাধি-মৃত্যু থেকে অব্যাহতির এক গুহ্য সাধন-প্রক্রিয়া। 
ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব  একদিন নরেনকে বলেছিলেন তোর সব ভালো, কিন্তু তুই ঘুমোলে তোর শ্বাস -প্রশ্বাস জোরে জোরে বয়। এঁরা বেশিদিন বাঁচে না। ঠাকুরের এই কথা সত্যে পরিণত  হয়েছিল। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে স্বামী বিবেকানন্দ দেহ ছেড়ে চলে গেছেন। প্রাণায়াম হচ্ছে, এই শ্বাস-প্রশ্বাস-এর গতিকে নিয়ন্ত্রণ করা, ধীর করা। তাই যোগীদের প্রাণবায়ু তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। বিশ্বাস অবিশ্বাস বলে কিছু হয় না। অন্ধ বিশ্বাস বলেও কিছু হয় না। আসলে কথাটা হচ্ছে জ্ঞান ও অজ্ঞান। বিশ্বাস ও অবিশ্বাস দুটোই অজ্ঞান।  আর অন্ধ বিশ্বাস হচ্ছে, গভীর অজ্ঞান। যার জ্ঞান হয়েছে, তার বিশ্বাসের প্রয়োজন নেই। যারা অজ্ঞান তারাই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বে লিপ্ত। প্রাণায়ামের সাহায্যে  প্রাণের গতিকে ক্রমে ক্রমে ধীর  করতে  হয়। এবং বায়ুকে  রুদ্ধ করবার ক্ষমতা বৃদ্ধি হয়, এই প্রাণায়ামের সাহায্যে।   

আমরা আগে আসনের কথা কিছু কিছু শুনেছি ।  এই আসন সিদ্ধির পরে, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিকে লয়বদ্ধ করাকে বলে প্রাণায়াম। যোগের ভাষায় শ্বাস যখন আমরা ভিতরে নেই তাকে বলে পূরক।  যখন বাইরে ছাড়ি, তখন তাকে বলে রেচক। এই শ্বাসকে যখন আমরা ভিতরে রুদ্ধ করে দেই, তখন তাকে বলে অন্তর-কুম্ভ, আর যখন আমরা এই শ্বাসকে বাইরে রুদ্ধ করে দেই, তখন তাকে বলে বাহ্য-কুম্ভ। প্রাণায়াম আসলে এই পূরক-অন্তকুম্ভক-রেচক-বাহ্যকুম্ভক -এর ক্রিয়া।
সফল যোগ সাধনার চারটি অবস্থা। আরম্ভ-অবস্থা, ঘটাবস্থা, পরিচয় অবস্থা- এবং নিস্পত্তি অবস্থা। 
আমরা আরম্ভাবস্থা অবস্থা সম্পর্কে শুনেছি।  অর্থাৎ নাড়ীশুদ্ধি সম্পর্কে শুনেছি। যোগে প্রবেশ করতে গেলে শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্তগুলো শ্রবণ ও পালন করা উচিত। দেহের ও মনের শুচিতা পালন করা উচিত। আমাদের হতে হবে মিতাহারী। আমাদের হতে হবে নিরাসক্ত। আর সব সময় গুরুমুখী হয়ে গুরুসেবা করতে হবে। যোগীর সূর্য নাড়ীতে যখন বায়ু প্রবেশ করে, অর্থাৎ পিঙ্গলা বা ডান নাক দিয়ে যখন শ্বাস-প্রশ্বাস প্রবাহিত হয়, এই সময় আমাদের ভোজনের সময়। চন্দ্র নাড়ীতে বায়ু প্রবেশ করলে অর্থাৎ ইড়া নাড়ী বা বাম নাক দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ যখন চলে তখন যোগীর নিদ্রার সময়। ভরা পেটে বা অত্যন্ত খালি পেটে  যোগ-অভ্যাস করা উচিত নয়। তাই প্রথম দিকে যোগীর বার বার অল্প অল্প করে খাবার গ্রহণ করা উচিত। ধীরে ধীরে একাহারি হতে হবে। প্রথমেই একাহারি হতে যাবেন না। 

শিব-সংহিতায় স্বয়ং শিব বলছেনযোগী যখন প্রথম প্রথম প্রাণায়াম সাধনার উদ্যোগ নেন, তখন তার শরীর  থেকে ঘাম নির্গত হতে দেখা যায়। আর ঘাম নির্গত হলে সেই ঘামবিন্দু নিজ শরীরেই মর্দন করবেন। কারন এটা না করলে, শরীরের ধাতু ক্ষয়প্রাপ্ত হবে।  যোগ সাধনের দ্বিতীয় পর্যায় শরীরে কম্পন উপস্থিত হয়, এবং পরে যোগীর ভেকের মতো গতি হয়। আরও অধিক অভ্যাস করলে যোগী আকাশে বিচরণ করবার ক্ষমতা অর্জন করেন। যোগী পদ্মাসনে বসে যখন পদ্মাসন অবস্থাতেই মাটি ছেড়ে শূন্যে উঠে যান তখন বুঝতে হবে যে তার বায়ু সিদ্ধি হয়েছে। বায়ুসিদ্ধি হলে সংসাররূপ ঘর অন্ধকার বিনাশপ্রাপ্ত হয়। তাই দেবাদিদেব মহাদেব বলছেন, যতক্ষন এই বায়ুসিদ্ধি না হয়, ততক্ষন পর্যন্ত গুরুবানী ও যোগশাস্ত্র কথিত নিয়ম অবশ্যি পালন করতে হবে। আর এই বায়ু সিদ্ধি হলে, যোগীর নিদ্রা কমে যাবে, শরীরে মল-মূত্রের পরিমান কমে যাবে। যোগীর দেহ হবে নীরোগ, তিনি হবেন তত্ত্বদর্শী, তার কোনো অভাব বোধ থাকবে না। সাধকের শরীরে বায়ু-পিত্ত-কফের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য আসবে । এই সময় অতিভোজন বা অনাহারের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। এমনকি শরীরে অসীম শক্তির অধিকারী হবেন। আর এই শক্তিকে বলা হয় ভূচরী  সিদ্ধি। 
যোগসাধনকালে যত  বিঘ্নই উপস্থিত হোক  না কেন, যোগী অবশ্য়ই যোগ থেকে বিরত থাকবেন না। বিঘ্নকালীন অবস্থায়, যোগীকে ইন্দ্রিয়-সংযম করতে হবে। গোপনে নির্জন স্থানে নিরন্তর প্রণব জপ করতে হবে।  তাহলে অবশ্যই  সর্ব্ব বিঘ্ন নাশ হবে। 
সাধকের পূর্ব্ব-পূর্ব্ব জন্মের এবং বর্তমান জন্মের সমস্ত কর্ম্মফল নাশ করতে পারবেন। পাপ-পুন্য ব'লে তার কিছুই থাকবে না। অষ্ট-ঐশ্বর্য্য অর্থাৎ অনিমা, লঘিমা, ইত্যাদি  লাভ করে ত্রিলোকে বিচরণ করতে পারবেন। 

ঘটাবস্থা : যোগীর যখন প্রাণ, অপান, নাদ , বিন্দু, জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন ঘটে তখন তাকে বলে ঘটাবস্থা। যোগী যখন অন্ততঃ  এক প্রহর অর্থাৎ তিন ঘন্টা কুম্ভক অব্লম্বন করতে পারবেন, তখন জানবেন তার ঘটাবস্থা হয়েছে। যোগী যখন আটঘন্টা বায়ুকে ধরে রাখতে পারবেন, তখন তিনি তুলোর মতো হালকা বোধ করবেন। 

আজ আমরা রোগশান্তির জন্য, শিব সংহিতায় কয়েকটি উপায়ের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে শুনবো।  

১. যে সাধক তালুমুলে জিহ্বা রেখে প্রাণবায়ু পান করেন, তার সমস্ত রোগ নাশ হয়। 
২.কাকের ঠোঁটের মতো মুখ সরু করে, জীব দিয়ে বায়ু সেবন করতে হবে। এতে  সংসারবন্ধন রূপ ব্যাধি থেকে মুক্ত হবেন। 
৩. জিহ্বাকে উপরের দিকে তুলে,ব্রহ্মতালু  থেকে ক্ষরিত সুধা পান করতে হবে। তাহলে এক মাসের মধ্যে সাধকের মৃত্যুকে জয় করতে পারবেন।  
৫. রাজদন্তে জিহ্ববা দৃঢ়ভাবে চেপে রেখে, কুন্ডলিনীতে ধ্যান করতে হবে। তাহলে তার মধ্যে কবিত্ত্ব শক্তি জাগ্রত হবে। 
৬. দাঁতে দাঁত চেপে ধরে জিহ্বা উপরে তুলে ধীরে ধীরে বায়ু পান করতে হবে। এতে করে মেধাশক্তি বৃদ্ধি পাবে। 
শিবসংহিতায় বলা হয়েছে, এগুলো ছয়মাস পালন করলে, সাধক সকল রোগ নাশ করতে পারবেন। একবছর পালন করলে পঞ্চভূতকে জয়  করতে পারবেনএবং নিশ্চিতরূপে শিবতুল্য হয়ে যাবেন।  

এছাড়া, শিব-সংহিতা আরো বলছেন,
১.  যোগী যদি অর্থক্ষনকাল জিহ্বাকে উপরে তুলে অবস্থান করতে পারেন, তবে ক্ষণকাল মধ্যেই তিনি জরা-ব্যাধি-মৃত্যু প্রভৃতি থেকে মুক্ত হতে পারবেন। 
২. যিনি প্রাণযুক্ত নিপীড়িত জিহ্বাকে বিশেষ রূপে চিন্তা করবেন অর্থাৎ জিহ্বাকে নিপীড়িত করে যে সব কর্ম্ম করা হয়ে থাকে সেই বিষয়ে বিশেষ রূপে চিন্তা করবেন তাহলে তার মৃত্যু হবে না। এই মুদ্রা অভ্যাস করলে, কামদেব সদৃশ্য হতে পারবেন। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা জয় করতে পারবেন। যোগী তখন, স্বচ্ছন্দে আপদ-বিপদ শূন্য হয়ে, এই পৃথিবীতে বিচরণ করতে পারবেন। এই সব সফল যোগীদের পুনর্জন্ম হয় না।  এঁরা দেবসুলভ আনন্দে বিচরণ করে থাকেন। এদের পাপ-পুন্য বলে কিছু থাকে না। 
সবশেষে বলি এগুলো গুরুবিদ্যা। গুরুমুখে শুনে, গুরুসান্নিধ্যেই এগুলোর সাধন সম্ভব। নতুবা এই সব প্রক্রিয়া ফল প্রসব করতে পারে না। কিন্তু দুঃখের কথা হচ্ছে, সাধারণ মানুষের কাছে, এই গুরুর সন্ধান নেই।  তবু এই পরম-গুহ্য জ্ঞান আমাদের ভারতীয় অমূল্য সাধন সম্পদ সম্পর্কে একটা ধারণা অবশ্যিই আমাদেরকে দিতে পারে। এই প্রয়াস সেই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য।  

ওং নমঃ শিবায়ঃ। ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। 

সাধনা - পর্ব্ব - (আট) - (তথ্যসূত্রঃ - শিব-সংহিতা ও হঠযোগ প্রদীপিকা )
একটা গল্প বলি। একজন সাধক কারুর কাছ থেকে শুনেছিলো, শ্বাস-প্রশ্বাসের দিকে নজর দিয়ে বসে থাকলে, নাকি সব অলৌকিক ব্যাপার দেখা যায়। তো সে প্রতিদিন নিয়ম করে, গভীর রাতে, নির্জন ঘরে কম্বলের আসনে মেরুদন্ড সোজা করে,  পদ্মাসনে বসে, চক্ষু মুদ্রিত করে, স্বাস প্রশ্বাসের দিকে খেয়াল করে বসে থাকতো। এতে করে কিছুদিনের মধ্যেই সে দুটো জিনিষ লক্ষ করলো। 
এক, শ্বাস দুই নাক দিয়ে ঢুকে ভ্রূ-যুগলের  মধ্যে ধাক্কা লেগে আবার নাক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। শ্বাস  আসলে বুকে পেটে যাবার কথা সেটা আর যাচ্ছে না। আর ফ্রুযুগলের মধ্যে সে একটা তাপ অনুভব করতো।
 দ্বিতীয়ত, মুদ্রিত চোখেই সে অনেক দৃশ্য- অনেক নতুন জায়গা-মানুষজন দেখতে পেতো। এবং তার মনে হতো, সে যেন আর সেই ঠাকুরঘরে বসে নেই। সেই পদ্মাসনে বসেই সে নানান জায়গায় পরিভ্রমন করে বেড়াচ্ছে। এমনটা প্রতিদিনই হতো।  এতে সে একটা মজা পেয়ে গেলো। আর এই আসনে বসে নানান দৃশ্য দেখা তার একটা নেশায়  পরিণত হয়ে গেল। এমনি একদিন সে দেখে, তার মা যিনি প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে থাকেন, তিনি বিছানায় শুয়ে পেটের  ব্যথায় কাতরাচ্ছেন।  তো সে করলো কি, একটু সর্ষের তেল ও জল নিয়ে মায়ের পেটে মালিশ করে দিলো। মা আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়লেন। 
তার এই স্বপ্নের  কথাগুলো বা অলৌকিক দর্শনের কথা  সে কাউকেই বলতো না। তো কিছুদিন পরে যখন সে মায়ের কাছে গেলো, মা বললো, জানিস আমি তোকে স্বপ্নে দেখেছিলাম। আমার পেট ব্যথা করছিলো, আর তুই আমার পেটে তেল-জল মালিশ করে দিয়েছিলি। তো সাধক ভাবলো, এতো বড়ো অদ্ভুত ব্যাপার। আমার  ধ্যানে পাওয়া দৃশ্য মায়ের গোচরে এলো কি করে ? ব্যাপারটা অদ্ভুত কিন্তু সত্য। এমনি অনেক ঘটনা অনেকের জীবনে ঘটে তার ব্যাখ্যা পাওয়া কঠিন।  তবে ঘটে।
শিব-সংহিতায় শঙ্কর বলেছেন : নানাবিধ চুরাশী আসন আছে।  আজ আমরা চারটি আসন নিয়ে কথা বলবো। সিদ্ধাসন, পদ্মাসন, উগ্রাসন, ও স্বস্তিকাসন।  (শিব-সংহিতা - শ্লোক - নং : ১০০-১২০) .
হঠযোগ প্রদীপিকা আবার বলছেন :  সিদ্ধাসন  বা  বজ্রাসন - ৩৮-৪০, পদ্মাসন শ্লোক : ৪১-৪৩, সিংহাসন -৪৪, ভদ্রাসন -৪৫ ) তো আজ আমরা এই প্রাথমিক আসনগুলো নিয়ে শুনবো। 

প্রথমে আমরা শুনে নেবো শিব-সংহিতা কি বলছেন। শিবসংহিতা বলছেন ৮৪টি আসনের মধ্যে চারটি আসন প্রাথমিক ভাবে গুরুত্ত্বপূর্ন। সেগুলো হচ্ছে  সিদ্ধাসন, পদ্মাসন, উগ্রাসন বা পশ্চিমোত্তসন, ও স্বস্তিকাসন।

১. সিদ্ধাসন  : 
শিবসংহিতা বলছেন : সিদ্ধপুরুষের সিদ্ধিদায়ক এই সিদ্ধাসন। সিদ্ধাসনেই সমস্ত সিদ্ধি লাভ হতে পারে। সাধক লিঙ্গ ও গুহ্যদেশের মধ্যস্থলকে বাম পায়ের গোড়ালি দিয়ে চেপে ধরবেন । ডান পায়ের গোড়ালি লিঙ্গের উপরে রাখবেন। এবার মনকে স্থির ও সংযত রেখে ভ্রূমধ্যে দৃষ্টি নিবদ্ধ করুন। এবং  বায়ু সাধন করতে থাকুন। অর্থাৎ কুম্ভক করতে থাকুন।   মেরুদণ্ড  থাকবে সোজা। আসন করবেন নির্জনে। একেই সিদ্ধাসন বলে। সিদ্ধপুরুষগণের সিদ্ধিদায়ক এই আসন, তাই একে বলে সিদ্ধাসন। 
সিদ্ধাসনের  যোগের সর্বোচ্চ অবস্থা লাভ করা যায়। এই সাধনের ফলে, সংসার সাগর উত্তীর্ন হয়ে উত্তম গতি প্রাপ্ত হওয়া যায়। আসনটি খুবই সহজ, কিন্তু অসীম ফলপ্রদ। এই একটা মাত্র আসন করে, সাধকের সিদ্ধি লাভ হতে পারে। আমরা আসনটি অর্থাৎ সিদ্ধাসন কিভাবে করতে হবে, সেটা একটু ভালো ভাবে শুনে নেবো। 
১. সিদ্ধাসন : (শ্লোক-৩৭-৩৮) দুটো পা ছড়িয়ে বসুন।  এবার বা হাটুর কাছে ভেঙে বা  পায়ের গোড়ালি সীবনী অর্থাৎ আমাদের লিঙ্গমূল থেকে গুহ্যদ্বার পর্য্যন্ত যে সেলাই আছে, সেখানে স্থাপন করুন। এবার অন্ডকোষ ও জনিন্দ্রিয় বাম হাতে তুলে ধরে, বাঁ পায়ের গোড়ালির উপরে রাখুন। এবার ডান পা হাটু থেকে ভাজ করে, ডান  পায়ের গোড়ালি লিঙ্গমূলের মেরুদেশে স্থাপন করুন। ডান  পায়ের আঙ্গুল বাঁ পায়ের উরুর উপরে রাখুন।  বুকের উপর চিবুক স্থিরভাবে স্থাপন করতে হবে। বুক ও চিবুকের মধ্যে তার আঙ্গুল ফাঁকা থাকবে।  এরপর ইন্দ্রিয় সংযম করে, ভ্রূমধ্যে অচল-দৃষ্টিতে দেখতে হবে। মেরুদন্ড থাকবে সোজা। হাত দুটদুটো ভাজ করে, হাঁটুর উপরে স্থাপন করুন। হাতদুটো সোজা নয়, ভাজ করে। কেউ কেউ হাতদুটো সোজা রাখতে বলে থাকেন, কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এতে মনের অহংভাব বিড়ম্বনায় ফেলে। অর্থাৎ আমি যোগ করছি, এই ভাব সহজে যায় না। আসলে যোগ তো আমি করছি না। যোগ হচ্ছে। আমি কোলে উঠতে চাইলে কোলে ওঠা হলো না। মা যখন কোলে নেবেন, তখনই একমাত্র কোলের শান্তি পাওয়া যায়। ঈশ্বর যতক্ষন আমাকে নিজের মধ্যে দ্রবীভূত না করছেন, আমি ততক্ষন আমিই থেকে যাবো। যাই হোক, হাত দুটো ভাজ করে নেবেন। হাতের পাতা আঙ্গুল থাকবে জ্ঞানমুদ্রায়, অর্থাৎ তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ- এর অগ্রভাগ চেপে ধরতে হবে।  এই অবস্থায় স্থির  হয়ে অবস্থান করতে হবে। একেই বলে সিদ্ধাসন। ১৫-৩০ সেকেন্ড  এই অবস্থায় থেকে, ৩-৫ বার কুম্ভকের অভ্যাস করুন। পরে  পায়ের অবস্থান পরিবর্তন করুন,অর্থাৎ ডান  পা এবার লিঙ্গের নিচে দিন, এবং বাঁ পা উপরে রাখুন।  আবার প্রতিবারে ১৫-৩০ কুম্ভক এইভাবে ৩-৫ বার কুম্ভকের অভ্যাস করুন। এই অভ্যাস কম পক্ষে চার বার করুন। অর্থাৎ প্রথম দিকে মাত্র ২-৫  মিনিট এই অভ্যাস করুন। মনে রাখবেন, মন থাকবে ভ্রূমধ্যে ঈশ্বরমুখী হয়ে। 
 এই সিদ্ধাসন অভ্যাসকারীর ৭২০০০ নাড়ীর মলবিশোধন হয়ে থাকে। পরিমিত আহার, ও পরমাত্মন চিন্তা করতে করতে সাধক বারো বৎসরের মধ্যে যোগসিদ্ধি লাভ করতে পারেন। এই আসনে সিদ্ধ হয়ে, কেবলমাত্র পূরক-রেচক-কুম্ভকের সাহায্যে সর্ব্বকার্য্য সাধন হয়ে থাকে। এই আসন অভ্যাসের প্রভাবে, কোনো আয়াস ছাড়াই মূলবন্ধ, জালন্ধর বন্ধ এবং উড্ডীয়ান বন্ধ এই তিন বন্ধই সিদ্ধ হয়ে থাকে। মৎস্যেন্দ্রনাথ বলছেন, সিদ্ধাসনের তুল্য আসন নেই, নাদতুল্য লয় নেই, খেচরী মুদ্রার ন্যায় মুদ্রা নেই, কুম্ভকের সঙ্গে একমাত্র কুম্ভকেরই তুলনা করা চলে। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি  ওম। 

সাধনা - পর্ব্ব - নয়   (তথ্যসূত্রঃ - শিব-সংহিতা ও হঠযোগ প্রদীপিকা )

আজ আমরা  পদ্মাসন সম্পর্কে শুনবো।  কিন্তু তার আগে একটা ঘটনার কথা বা আমাদের কাছে যা গল্পকথা, সেই রকম একটা কাহিনীর  কথা শুনে নেই।  আমরা সবাই রামঠাকুরের কথা শুনেছি। যোগসিদ্ধ পুরুষ ছিলেন। আজ সারা পৃথিবীতে তাঁর অজস্র ভক্ত ছাড়িয়ে আছেন। তো এই রামঠাকুরের ভাই শ্রী জগবন্ধু চক্রবর্তী তখন রায়পুরে, সপরিবারে বাস করেন। রামঠাকুর সেখানে অর্থাৎ রায়পুরে মাঝেমধ্যে যেতেন। এবং ভাইয়ের বাড়িতে থাকতেন। একদিন সন্ধ্যেবেলা, ঠাকুর ঘরের দরজা বন্ধ করে যোগ অভ্যাস করছেন।   এমনসময় তার বৌদি, প্রসন্নদেবী উঠোনের কোনে তুলসীমঞ্চে প্রদীপ দিতে এসেছেন। এখন ঠাকুর কিসব যোগ  দরজা বন্ধ  করে করেন, সে সম্পর্কে প্রসন্নদেবীর একটা কৌতূহল ছিল। তো সেদিন হলো কি, তার মনে কৌতূহল তীব্রতা পেল, এবং লাজ-লজ্বা-ভয়-ডরের মাথা খেয়ে ঘরের দরজা ফাক করে, ভিতরে উঁকি দিলেন। এবং তখন যে দৃশ্য তিনি দেখলেন, তাতে  তার বিস্ময়ের সীমা  রইলো না। দেখলেন, দেবর ধ্যানস্থ, পদ্মাসনে উপবিষ্ট। খেয়াল করুন পদ্মাসনে উপবিষ্ট।  কিন্তু মাটির সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। সারা দেহটি শূন্যে ভাসছে। এই কি অদ্ভুত কান্ড। ভয়ে-বিস্ময়ে তিনি বলে উঠলেন - "সোনা ঠাকুর, একি ! এ আপনি কি করছেন ? ভাইবৌয়ের  মুখ থেকে এই শব্দ নির্গত হতেই, রামঠাকুর ধপ্ করে মাটিতে পড়ে  যান। এবং তাঁকে  অনুরোধ করেন , এই ঘটনার কথা যেন বাড়ির অন্যকেউ জানতে না পারে। কিন্তু কথাতো চাপা থাকে না, তাই আমাদের মতো অবিশ্বাসীরা, এতো বছর  পরেও  সেই ঘটনার কথা শুনছি, এবং অবাক হচ্ছি। (তথ্যসূত্রঃ শঙ্করনাথ রায়ের "রামঠাকুর" প্রবন্ধ। ) 

যাই হোক পদ্মাসন এমন একটা আসন, যা আপনাকে অনেক অলৌকিক ক্ষমতা এনে দিতে পারে।  যদিও এই ঘটনা পদ্মাসনের  দৌলতেই  হয়েছে, এমনটা  নয়, এটি আসলে  বায়ু সাধনের ফল, তবে আসন বা  পদ্মাসন তো সহযোগী অবশ্যই। তাই আজ আমরা সেই অমোঘ ফলদায়িনী পদ্মাসনে কথা শুনবো।     

২. পদ্মাসন : পদ্মাসন দুই রকম, মুক্ত-পদ্মাসন ও বদ্ধ-পদ্মাসন। আমাদের আলোচ্য বিষয় মুক্ত-পদ্মাসন। একটা কথা মনে রাখবেন,  আমরা কিন্তু শরীরের স্বাস্থ্য  ঠিক রাখবার জন্য, আসনের আলোচনা শুনছি না। আমাদের উদ্দেশ্য যোগ। ঈশ্বরের যাতে মিলনের উপায় খুঁজে বার করা। পদ্মাসন খুবই সোজা আসন। দুটি উরুর উপরে, দুটি চরণ অর্থাৎ  বাম  উরুর উপরে ডান  পা এবং ডান উরুর উপরে বাম পা রেখে বসতে হবে।  মেরুদন্ড থাকবে সোজা। দুই পায়ের গোড়ালির উপরে, প্রথমে বাঁ হাতের তালু, তার উপরে ডান  হাতের তালু রাখতে হবে। তারপর  জিহ্বাটি রাজদন্তমূলে অর্থাৎ সামনের চারটি দাঁতের সঙ্গে লাগিয়ে রাখতে হবে। চোখের দৃষ্টি থাকবে আমাদের নাসাগ্রে নিবদ্ধ। চিবুক তুলে এবং বুক সামান্য উঁচু করে অর্থাৎ বুক  টানটান  করে ধীরে ধীরে বায়ু আকর্ষণ করতে হবে। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী বায়ুকে আকর্ষণ করে ধীরে ধীরে বায়ু দ্বারা উদর পূরণ করে সাধ্যমতো কুম্ভক করতে  হবে।এবার কুম্ভকের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ধীরে ধীরে রেচক করতে হবে। যতক্ষন কুম্ভক করবেন, রেচেকের সময় একই সময় দেবেন।  একে বলে মুক্ত পদ্মাসন। এই সঙ্গে একটা কথা বলি বায়ুসাধনের নিয়ম হচ্ছে ২:৪:৮:৪. অর্থাৎ যখন আমরা বায়ুসাধনের সম্পূর্ণ পি[প্রক্রিয়া তখন আমরা ২ সেকেন্ডে পূরক করবো, ৪ সেকেন্ড অন্তর কুম্ভক করবো, ৮ সেকেন্ডে অর্থাৎ ধীরে ধীরে বায়ু ছাড়বো, বা রেচক করবো এবং ৪ সেকেন্ড বাহ্যকুম্ভক  করবো। 

এই আসন সর্ব্ব ব্যাধি নাশক। এই আসনের অভ্যাস শুরু করলে, প্রাণবায়ুর গতি সহজে সুষুম্না পথে যাতায়াত করতে থাকে। এই প্রক্রিয়া প্রাণকে নিম্নগামী, অপানকে উর্দ্ধগামী করে, সমান বায়ুর সঙ্গে মিলিত করে। স্বয়ং শিব বলছেন, এতে করে যোগী সংসার বন্ধন  থেকে মুক্ত হতে পারেন। 

আগেই বলেছি, পদ্মাসন দুই রকম, মুক্ত-পদ্মাসন ও বদ্ধ-পদ্মাসন। বাম  উরুর উপরে ডান  পা এবং ডান উরুর উপরে বাম পা রেখে বসতে হবে। জিহ্বাটি রাজদন্তমূলে অর্থাৎ সামনের চারটি দাঁতের সঙ্গে লাগিয়ে রাখতে হবে। চোখের দৃষ্টি থাকবে আমাদের নাসাগ্রে নিবদ্ধ। মেরুদন্ড থাকবে সোজা। ডান  হাত ডান  উরুর উপরে, আর বাম  হাত বাম  উরুর উপরে স্থাপন করতে হবে। একে বলে মুক্ত পদ্মাসন। 
এছাড়া আছে বদ্ধ-পদ্মাসন। প্রথমে মুক্ত পদ্মাসনে বসতে হবে। এর পর, আমাদের ডান হাত পিঠের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে এনে বাম উরুর উপরে যে ডান পায়ের পাতা রাখা আছে, তার বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ধরতে হবে। আবার অন্যদিকে বাম হাত পিঠের পেছন দিক দিয়ে ঘুরিয়ে বাম পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ধরতে হবে। একেই বলে বদ্ধ পদ্মাসন।
পদ্মাসন (মৎস্যেন্দ্র নাথের মতে) দুটো পা চিৎ করে, দুই উরুর উপরে যত্ন সহকারে স্থাপন করুন। দুই হাত চিৎ করে উরুর মধ্যে স্থাপন করুন। দৃষ্টি নিবদ্ধ করুন নাসাগ্রে বা ভ্রূমধ্যে।  জিহ্বার দ্বারা রাজদন্তমূল স্পর্শ করুন।  চিবুক বুকের উপরে স্থাপন করুন। অর্থাৎ জালন্ধর বন্ধ করুন। এবার  ধীরে ধীরে বায়ু আকর্ষণ করে, উদর পূরণ করুন। এবং  ধীরে ধীরে বায়ুকে ছাড়তে থাকুন। একে মৎস্যেন্দ্রনাথের মতে সর্ব্বব্যাধি নাশকারী পদ্মাসন বলে জানবেন। এইসময় আপনার ইষ্টদেবতাকে স্থির চিত্তে ধ্যান করতে করতে ওপেন বায়ুকে উর্দ্ধে টানুন। এরপর প্রাণায়াম দ্বারা, পূরক করে, প্রাণবায়ু ও অপান বায়ুর মধ্যে ঐক্য সাধন করুন। এবার ধীরে ধীরে রেচক করুন। এই সাধনের ফলে, সাধক কুণ্ডলিনী শক্তির প্রভাবে অতুল জ্ঞানলাভ করতে পারবেন। প্রাণ বায়ু ও অপান  বায়ুর যখন ঐক্য সাধন হয়, অর্থাৎ সমান বায়ুর সান্নিধ্যে আসে, তখন কুন্ডলিনীর চৈতন্যশক্তি প্রাণবায়ু সুষুম্না নাড়ীর ভিতরে যে ব্রহ্মরন্ধ্র আছে, তার মধ্যে প্রবেশ করে। আর এই প্রাণবায়ু যখন ব্রহ্মরন্ধ্রে প্রবেশ করে, তখন সাধকের চিত্ত স্থির হয়, আর চিত্ত স্থির হলেই সংযম সাধিত হয় ও ব্রহ্মসাক্ষাৎকার হয়। এই একটা আসন ঠিক ঠিক মতো করতে পারলেই, সাধকের মনোবাঞ্ছা পূরণ হতে পারে।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।

৩. উগ্রাসন  বা পশ্চিমোত্তাসন 
মাটিতে বসে, পাদুটোকে সামনের দিকে বাড়িয়ে দিন। পায়ের আঙ্গুলগুলো উর্দ্ধমুখী থাকবে। গোড়ালি দুটো পরস্পর সংলগ্ন থাকবে। এবার ডান  হাত দিয়ে ডান পায়ের বুড়োআঙ্গুল, এবং বাম হাত দিয়ে বাম পায়ের বুড়ো আঙ্গুল ধরুন, এর পর শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে মাথাকে ধীরে ধীরে নিচের দিকে নাবান। এবং মাটিতে ছুঁয়ে থাকা, হাটুকে ছুতে চেষ্টা করুন। এবার শ্বাস বন্ধ করে, ৫-১০ সেকেন্ড হাঁটুতে কপাল ঠেকিয়ে রাখুন।  এর পর ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে নিতে পুরোনো অবস্থায় ফিরে যান। একেই বলে পশ্চিমোত্তাসন বা উগ্রাসন। 
এই আসনের অভ্যাসের ফলে আমাদের বায়ু পশ্চিম পথে অর্থাৎ সুষুম্না পথে সঞ্চারিত হয় তাই একে পশ্চিমোত্তাসন বলে। এই আসন অভ্যাসকারীর সকল সিদ্ধিলাভ হয়ে থাকে, একথা স্বয়ং শিব বলছেন। ৪.স্বস্তিকাসন বা সুখাসন : দুই জানু ও দুই উরুর মধ্যে দুই পায়ের তলা রেখে শরীর সোজা করে রেখে, সুখে বসে থাকলে যে আসন হয়, তাকে স্বস্তিকাসন বলে। একে সুখাসনও বলা হয়ে থাকে। বায়ু সাধনায় সিদ্ধি লাভ করতে গেলে এই সুখাসন ফলপ্রদ। শরীর  ব্যাধি মুক্ত থাকতে পারে। সমস্ত দুঃখের নাশ হয়।
এবার আমরা শুনবো হঠযোগী-প্রদীপিকা থেকে। এখানেও চারটি শ্রেষ্ঠ আসনের কথা বলা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে সিদ্ধাসন, পদ্মাসন, সিংহাসন ও ভদ্রাসন। 

১. সিদ্ধাসন : (শ্লোক-৩৭-৩৮) দুটো পা ছড়িয়ে বসুন।  এবার বা হাটুর কাছে ভেঙে বা  পায়ের গোড়ালি সীবনী অর্থাৎ আমাদের লিঙ্গমূল থেকে গুহ্যদ্বার পর্য্যন্ত যে সেলাই আছে, সেখানে স্থাপন করুন। এবার অন্ডকোষ ও জনিন্দ্রিয় বাম হাতে তুলে ধরে, বাঁ পায়ের গোড়ালির উপরে রাখুন। এবার ডান পা হাটু থেকে ভাজ করে, ডান  পায়ের গোড়ালিলিঙ্গমূলের মেরুদেশে স্থাপন করুন। ডান  পায়ের আঙ্গুল বা পায়ের উরুর উপরে রাখুন।  বুকের উপর চিবুক স্থিরভাবে স্থাপন করতে হবে। বুক ও চিবুকের মধ্যে তার আঙ্গুল ফাঁকা থাকবে।  এরপর ইন্দ্রিয় সংযম করে, ভ্রূমধ্যে অচলদৃষ্টিতে দেখতে হবে। মেরুদন্ড থাকবে সোজা। হাত দুটদুটো ভাজ করে, হাঁটুর উপরে স্থাপন করুন। হাতদুটো সোজা নয়, ভাজ করে। এই অবস্থায় স্থির  হয়ে অবস্থান করতে হবে। একেই বলে সিদ্ধাসন। ৩০ সেকেন্ড  এই অবস্থায়, থেকে পায়ের অবস্থান পরিবর্তন করুন,অর্থাৎ ডান  পা এবার লিঙ্গের নিচে দিন, বা পা উপরে রাখুন। এই অভ্যাস কম পক্ষে চার বার করুন। অর্থাৎ প্রথম দিকে মাত্র ২ মিনিট এই অভ্যাস করুন। 
 এই সিদ্ধাসন অভ্যাসকারীর ৭২০০০ নাড়ীর মলবিশোধন হয়ে থাকে। পরিমিত আহার, ও পরমাত্মন চিন্তা করতে করতে সাধক বারো বৎসরের মধ্যে যোগসিদ্ধি লাভ করতে পারেন। এই আসনে সিদ্ধ হয়ে, কেবলমাত্র পূরক-রেচক-কুম্ভকের সাহায্যে সর্ব্বকার্য্য সাধন হয়ে থাকে। এই আসন অভ্যাসের প্রভাবে, কোনো আয়াস ছাড়াই মূলবন্ধ, জালন্ধর বন্ধ এবং উড্ডীয়ান বন্ধ এই তিন বন্ধই সিদ্ধ হয়ে থাকে। মৎস্যেন্দ্রনাথ বলছেন, সিদ্ধাসনের তুল্য আসন নেই, নাদতুল্য লয় নেই, খেচরী মুদ্রার ন্যায় মুদ্রা নেই, কুম্ভকের সঙ্গে একমাত্র কুম্ভকেরই তুলনা করা চলে। 
  


৩. সিংহাসন : সাধক অন্ডকোষের অধোভাগে  লিঙ্গ থেকে গুহ্য পর্যন্ত যে সেলাই আছে তাকে বলা হয় সীবনী। এই   সীবনীর উভয়পার্শ্বে গোড়ালি  নিক্ষেপ করবে। অর্থাৎ সীবনীর ডান  দিকে থাকবে বা গোড়ালি, আর বাম পার্শ্বে থাকবে ডান  গোড়ালি। এই ভাবে গোড়ালি স্থাপনকরে জানুদ্বয়ের উপরে হাত দুটো স্থাপন করবে  যাতে হাতের তলদ্বয় জানুদ্বয়ে সম্যক সংলগ্ন হয়।  এর পর হাতের আঙ্গুলগুলো প্রসারণ করে মুখ থেকে জিহ্বা বের করতে করে, নাকের ডগা স্পর্শ করতে হবে। দৃষ্টি থাকবে  নাসিকার অগ্রভাগে। একেই সিংহাসন  বলে।
যোগীগণ এই আসনকে ভূয়সী প্রশংসা করে থাকেন। মুলবাঁধাদি এতে করে সিদ্ধ হয়ে থাকে।

৪. ভদ্রাসন : সাধক নিজের অন্ডকোষের নিচের দিকে যে সেলাই আছে তার উভয় দিকে উভয় গোড়ালিকে স্থাপন করুন। বামদিকে বাম গোড়ালি, ডান  দিকে ডান  গোড়ালি স্থাপন করুন। এইবার হাত দিয়ে পায়ের আঙ্গুল ধরুন। এইভাবে দৃঢ়বন্ধন করে,

উগ্রাসন  বা পশ্চিমোত্তাসন : মাটিতে বসে পাদুটো ছাড়িয়ে দিন এমন ভাবে, যাতে পাদুটো জোড়া না লাগে। তারপর নিজের দুই হাতের দ্বারা, দুই পায়ের আঙ্গুল ধরে হাঁটুর উপরে মাথা রাখবেন - অর্থাৎ শিরদ্বারা না বাঁকিয়ে দুই হাঁটুর মাঝখানে কপাল ঠেকবে।একে বলে উগ্রাসন। উগ্রাসন  জঠর-অগ্নি বৃদ্ধি পায়।  এই উগ্রাসন-এর আর একটা নাম পশ্চিমোত্তাসন। 

পশ্চিমোত্তাসন  : মাটিতে বসে, পাদুটোকে সামনের দিকে বাড়িয়ে দিন। পায়ের আঙ্গুলগুলো উর্দ্ধমুখী থাকবে। গোড়ালি দুটো পরস্পর সংলগ্ন থাকবে। এবার ডান  হাত দিয়ে ডান পায়ের বুড়োআঙ্গুল, এবং বাম হাত দিয়ে বাম পায়ের বুড়ো আঙ্গুল ধরুন, এর পর শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে মাথাকে ধীরে ধীরে নিচের দিকে নাবান। এবং মাটিতে ছুঁয়ে থাকা, হাটুকে ছুতে চেষ্টা করুন। এবার শ্বাস বন্ধ করে, ৫-১০ সেকেন্ড হাঁটুতে কপাল ঠেকিয়ে রাখুন।  এর পর ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে নিতে পুরোনো অবস্থায় ফিরে যান। একেই বলে পশ্চিমোত্তাসন। 

এই আসনের অভ্যাসের ফলে আমাদের বায়ু পশ্চিম পথে অর্থাৎ সুষুম্না পথে সঞ্চারিত হয় তাই একে পশ্চিমোত্তাসন বলে। 

সাধনা পর্ব্ব - ১২ 
যোনি-মুদ্রা ও তার ফল  
যোনিমুদ্রা আসলে কুন্ডলিনীশক্তিকে জাগরণের একটা গুহ্য প্রক্রিয়া। এই গুহ্য যোগ বিদ্যার উপদেশ দান  করেছেন, স্বয়ং মহেশ্বর দেবাদিদেব শিব, সেই অনাদিনাথ।  আমরা তাঁর উদ্দেশ্য আমাদের ভক্তিপূর্ন  প্রণাম জানাই। ওম নমঃ শিবায়। আমরা প্রণাম জানাই হঠযোগ বিদ্যার সঙ্কলক সেই স্বাত্মারাম গুরুনাথকে। আমরা প্রণাম জানাই গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথকে, প্রণাম জানাই  গুরু গোরক্ষনাথকে। যাদের কৃপায় স্বাত্মারাম এই বিদ্যাকে আয়ত্ত্ব করেছিলেন এবং সাধারণের মধ্যে বিতরণ করেছিলেন। 

যোনি কথাটির দ্বারা আমরা সাধারণত বুঝি, মূত্র, রজঃ বীর্য রস নির্গত হবার দ্বার বিশেষ। যোনিভুমি আমাদের কামনা বাসনা পূরণের স্থান।  কিন্তু অধ্যাত্ম জগতে যোনি, নিজেকে প্রকাশিত করবার দ্বার বিশেষ। আমাদের লিঙ্গ তিনটি - মন, প্রাণ, আত্মা অথবা ব্রহ্মগ্রন্থি, বিষ্ণুগ্রন্থি ও রুদ্রগ্রন্থি। এগুলোকে বলা হয় যোনি। এই যোনীদ্বারগুলোকে অতিক্রম করতে পারলেই, আমরা স্বরূপে স্থিত হতে পারবো। অর্থাৎ মন-প্রাণ-জীবাত্মা এই যোনীদ্বারগুলোকে অতিক্রম করতে হবে আমাদের। অনাহত চক্র বিশুদ্ধি চক্র ও আজ্ঞা চক্র  এক একটা যোনিদ্বার। যোনি মুদ্রা এই দ্বার অতিক্রম করবার উপায় বিশেষ।    
যোনিমুদ্রা দেবী সম্পদ। যারা শক্তির আরাধনা করেন, তাঁদের কাছে যোনি মুদ্রার গুরুত্ত্ব অপরিসীম। এই যোনিমুদ্রা আসলে মন্ত্রকে উজ্জীবিত করবার সাধন। যোনিমুদ্রায় অবস্থান ক'রে, যেকোনো মন্ত্র  উচ্চারণ করলে তা অধিক শক্তিশালী ও অব্যর্থ ফল প্রদান করে থাকে।

 বলা হয়ে থাকে যোনিমুদ্রাকারী, কোনো প্রকার পাপে লিপ্ত হতে পারেন না। যিনি মোক্ষ আকাঙ্খ্যা করেন, তিনি নিত্য  যোনী মুদ্রা অভ্যাস করবেন। যোনিমুদ্রার অভ্যাসের ফলে আমাদের সিদ্ধিলাভ হতে পারে, সমাধি লাভ হতে পারে, মোক্ষ লাভ হতে পারে।  এই অভ্যাসে শরীরের বায়ু সিদ্ধ হয়। বাকসিদ্ধ পুরুষ এই যোনিমুদ্রা করে থাকেন। এই মুদ্রার অভ্যাসে মানুষ এমনকি মৃত্যুঞ্জয়ী হতে পারেন । শিব সংহিতায় বলা হচ্ছে, এই বিদ্যা গোপন, প্রাণ গেলেও এই বিদ্যা কাউকে দান  করা উচিত নয়। তো আপনি বলতে পারেন, তাহলে আমরা এই সব মুদ্রার কথা কেন প্রচার করছি। আসলে ভারতের মুনি-ঋষিগণের দেওয়া, গোপন বিদ্যা দিনে দিনে লুপ্ত হতে চলেছে। আমরা চাই এইসব বিদ্যা প্রকাশ্যে আসুক। এগুলো আদৌ কোনো ফল দান  করতে পারে কি না, তা সর্বসাধারণ পরীক্ষা করে দেখুক। এছাড়া এ ব্যাপারে, আজকাল অনেক বই বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।   তবে হ্যাঁ অবশ্য়ই গুরু সান্নিধ্যে এই মুদ্রার অভ্যাস করা ভালো। কিন্তু গুরুবিনা এইসব মুদ্রা করা যাবে না এমন নয়।  নিজের শরীরের সাধ্য অনুযায়ী অভ্যাস করুন।  

 আমরা প্রাণায়াম সম্পর্কে  জানি, অর্থাৎ পূরক-অন্তরকুম্ভক-রেচক-বাহ্যকুম্ভক। অর্থাৎ শ্বাস নেওয়া, শ্বাস ভিতরে আটকে দেওয়া, শ্বাস ছাড়া ও শ্বাস বাইরে আটকে দেওয়া। একেই বলে প্রাণায়াম। এই যে কুম্ভক, তা সে বাহ্যকুম্ভক  হোক বা অন্তরকুম্ভক  হোক, নিজের সাধ্য অনুযায়ী করতে হবে। আর শ্বাস নেওয়া বা ছাড়া খুব ধীরে ধীরে করতে হবে। এবার আমরা যোনিমুদ্রার প্রক্রিয়া সম্পর্কে শুনবো।

প্রথমে সিদ্ধাসনে বসুন। এবার পুরকের  দ্বারা শ্বাস নিন। মনকে মূলাধারে স্থাপন করুন। গুহ্যদ্বার ও উপস্থের মধ্যবর্তী স্থানে যে যোনিমণ্ডল আছে, সেই  যোনিমণ্ডলকে আকুঞ্চিত করে, যোগ সাধনায় প্রবৃত্ত হতে হয়। ব্রহ্মযোনিরূপ এই যোনিমণ্ডল দেখতে একগুচ্ছ লাল  বাঁধুলী বা দুপুরে  ফুলের মতো। কোটি সূর্য্যের তেজ, কোটি চন্দ্রের স্নিগ্ধতা,  সুশীতল দীপ্তিময়ী দেবী সম্পদ অধিষ্টিত আছেন এখানে। অর্থাৎ সাধক এই মতো কল্পনা করে, নিজ আত্মাকে এই শক্তি দ্বারা আচ্ছাদিত করে দিতে হবে। অর্থাৎ প্রতিবার যখন আপনি পূরক করবেন, তখন বায়ুশক্তি দ্বারা এই শক্তিকে আচ্ছাদন করে দিতে হবে। এবং সাধ্যমতো সময় কুম্ভক করতে  হবে। আবার এই বায়ু শক্তিকে রেচকের সাহায্যে বাইরে ছেড়ে দিন।  বাহ্যিক কুম্ভক করুন।  অর্থাৎ এই শক্তি যেন রেচকের সাহায্যে ঊর্দ্ধ গতি সম্পন্ন হচ্ছে, এই মতো ভাবতে হবে। মনে করুন, বেলুনের  মধ্যে বায়ু শক্তি আছে, আপনি যখন বেলুনকে  চাপ দিচ্ছেন, সে সংকুচিত হচ্ছে, আবার যখন ছেড়ে দিচ্ছেন, তখন এই বেলুনের  বায়ু শক্তি দ্বিগুন বেগে  উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হচ্ছে। ঠিক তেমনি  এই কুম্ভকরূপ বায়ু শক্তি  আমাদের কুণ্ডলিনী শক্তিকে যখন আপনি অন্তর কুম্ভক করছেন , তখন সে সংকুচিত হচ্ছে, এবং আপনি যখন রেচক করছেন, তখন স্ফিত হচ্ছে, আর যখন বাহ্য  কুম্ভক করছে, তখন অধিক শক্তিতে সে উপরের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এবং যতবার আপনি এই প্রক্রিয়া করছেন, বায়ু গতিসম্পন্ন হচ্ছে, ফলতঃ বায়ুর মধ্যে যে অগ্নি আছে, তার শক্তি প্রকাশিত হচ্ছে। এই বার এই শক্তি অর্থাৎ কুণ্ডলিনী শক্তি মূলাধার থেকে উর্দ্ধে গমনশীল হবে। স্বাধিষ্ঠান, মনিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞা চক্র ভেদ করে, সহস্রারে গমন করছে। এবং এই ছয়  চক্রের দেবশক্তি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র, নারায়ণ, সদাশিব, পরাশিব একত্রিত হয়ে, বিন্দুর খোঁজে বেগবান হবে। এটাকেই বলে যোনিমুদ্রা।

 ঘেরন্ড-সংহিতায়  থেকে  যোনিমুদ্রার প্রক্রিয়া একটু অন্যভাবে বলা আছে। এই মুদ্রা অভ্যাসে আমরা সহজেই সমাধির অবস্থায় যেতে পারি। শিবসংহিতার যোনিমুদ্রা থেকে এটি আলাদা। 
সিদ্ধাসনে বসুন। দুই কান দুটো বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে, এবং দুটো চোখ তর্জনী দিয়ে, দুই নাক মধ্যমা দিয়ে এবং মুখকে অনামিকা ও কনিষ্ট আঙ্গুল দিয়ে নিরোধ করুন। এবার কাকীমুদ্রাযোগে অর্থাৎ মুখটাকে কাকের ঠোঁটের  মতো করে, প্রাণবায়ুকে আকর্ষণ করুন। এবং অপান  বায়ুর সঙ্গে অর্থাৎ নাভির নিচে আমাদের যে বায়ু থাকে, তার সঙ্গে মিলিত করুন।কুম্ভক করুন।  এবার আমাদের শরীরে যে ছয়টি চক্র আছে অর্থাৎ মূলাধার থেকে আজ্ঞাচক্র  পর্যন্ত যে ছয়টি চক্র আছে, সেই চক্রে হুং ও হংস মন্ত্রের দ্বারা ধ্যান করে, সাধক নিদ্রিত কুণ্ডলিনীকে জাগিয়ে তুলে, জীবাত্মার সঙ্গে মিলিত করে, সেই শক্তিকে সহস্রারে তুলে নেবেন। তারপর স্বয়ং শক্তিময় হয়ে পরমশিবের সঙ্গে মিলিত হয়ে আনন্দময় বিহার করতে থাকুন।  এইসময় চিন্তা করতে থাকুন, আমি স্বয়ং আনন্দ স্বরূপ, আমিই ব্রহ্ম। একেই বলে যোনী মুদ্রা। এই মুদ্রা ঠিক ঠিক মতো মাত্র একবার করতে পারলেই সমাধিস্থ হাওয়া যায়।  যোনিমুদ্রা  সিদ্ধিলাভের একটা উৎকৃষ্ট পন্থা। না এতে কোনো ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই। তবে শরীর বুঝে কুম্ভক করবেন। ধীরে ধীরে কুম্ভকের সময় বাড়াবেন। 


ওম শান্তি শান্তি শান্তি।  হরি  ওম।    








 

  










  



  














   
ঘটাবস্থা : যোগীর যখন প্রাণ, অপান, নাদ , বিন্দু, জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন ঘটে তখন তাকে বলে ঘটাবস্থা। যোগী যখন অন্ততঃ  এক প্রহর অর্থাৎ তিন ঘন্টা কুম্ভক অব্লম্বন করতে পারবেন, তখন জানবেন তার ঘটাবস্থা হয়েছে। যোগী যখন আটঘন্টা বায়ুকে ধরে রাখতে পারবেন, তখন তিনি তুলোর মতো হালকা বোধ করবেন। 

হঠযোগে আসনের অভ্যাস গুরুত্ত্বপূর্ন। শিব চুরাশি প্রকার আসনের কথা বলেছেন।  এর মধ্যে বিশেষ কতকগুলো আসন হচ্ছে :

স্বস্তিকাসন : দুই জানু ও দুই উরুর মধ্যে দুই পায়ের তলা রেখে শরীর সোজা করে রেখে সুখে বসে থাকলে যে আসন হয়, তাকে স্বস্তিকাসন বলে।  যোগী এই আসনে বসে বায়ু সাধন করবেন।  তাহলে দেহে কোনো ব্যাধির আক্রমন হবে না, আর বায়ুসাধনায় সিদ্ধিলাভ হবে। একে সুখাসনও বলা হয়ে থাকে। শিবসংহিতায় বলা হয়েছে, এই আসনে সিদ্ধ হলে সমস্ত দুঃখের নাশ হয়। শরীর প্রকৃতিস্থ হয়, চিত্ত আত্মস্থ হয়। 
গোমুখাসন : ডান উরু বাম উরুর উপরে রাখুন। এবার ডান  পায়ের গোড়ালি বাম  দিকের পাছার সাথে মিশিয়ে দিন। আবার বাম পায়ের গোড়ালি ডান পাছায় সংলগ্ন করুন। এবার বা হাতটি ঘুরিয়ে, পিঠের 
বিরাসন :
কূর্মাসন :
কুক্কুটাসন :

উত্তান-কূর্ম্মকাসন :
ধনুরাসন : 
মৎস্যেন্দ্রাসন : 

ময়ূরাসন 

শবাসন 


  

বদ্ধ-পদ্মাসন ও মুক্ত-পদ্মাসন     

সিংহাসন 
ভদ্রাসন 

স্বাত্মারাম বলছেন, যোগীশ্রেষ্ঠগন আসনের অভ্যাসের দ্বারা, শ্রমের বিনিময়ে নাড়ীশুদ্ধি ও দেহস্থিত বায়ুকে বিভিন্ন মুদ্রা দ্বারা সংযম করে আসন, নানাপ্রকার কুম্ভক  ইত্যাদি দ্বারা নাদের অনুসন্ধানীর অভ্যাস করবেন। ব্রহ্মচারী, মিতাহারী, ত্যাগী, যোগপরায়ণ ব্যক্তি বছর খানেকের মধ্যেই অবশ্যই  সিদ্ধি লাভ করতে পারবেন।  এই বিষয়ে কোনো বিচার-বিতর্কের অবকাশ নেই। 


৪.খেচরী,
৫. জালন্ধর,
৬.মূলবন্ধ, 
৭.বিপরীত-করণী
৮.উড্ডীয়ান - পাদুটোকে এক দুই ফুট ফাঁক করে দাঁড়ান। হাতদুটো হাঁটুর ঠিক উপরে স্থাপন করুন। এইবার মাথা ঘাড়  বুক সামনের দিকে ঝুকে আনুন, ধীরে ধীরে স্বাস ছেড়ে দিন। পেট যেন একেবারে খালি হয়ে যায়। শ্বাস ত্যাগ হয়ে গেলে, পেটকে পিঠের দিকে টানুন। যতক্ষন শ্বাস রুদ্ধ করে রাখতে পারবেন, ততক্ষন এই অবস্থায় থাকুন। এর পর ধীরে ধীরে শ্বাস গ্রহণ করুন।  এবং সোজা  হয়ে দাঁড়ান। একেই উড্ডীয়ানবন্ধ মুদ্রা বলে।   
৯.বজ্রলি -  
১০.শক্তিচালন - পদ্মাসনে বা  গোমুখ আসনে বসুন। তারপর শ্বাসের সাথে 

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম। 



এইবার আমরা প্রাণায়ামের কথা শুনবো :









   



















  

এইবার আমরা শুনবো, তিনটি মুদ্রা  সম্পর্কে।            
  
মুদ্রা : দশটি বিশেষ মুদ্রা : 
মুদ্রা অনেক রকম হয়। তার মধ্যে ১০টি মুদ্রা যোগসিদ্ধিকর। মহামুদ্রা, মহাবন্ধ, মহাবেধ,, খেচরী, জালন্ধর, মূলবন্ধ, বিপরীত-করণী উড্ডীয়ান, বজ্রোলি, শক্তিচালন - এই দশটি মুদ্রা শ্রেষ্ঠ। এই মুদ্রার অভ্যাসে আমাদের মূলাধার চক্রে  সুপ্ত অবস্থায় স্থিত কুণ্ডলিনী শক্তি গুরুকৃপায় বিকশিত হয় এবং সমস্ত গ্রন্থি ভেদ করে, সহস্রারের দিকে ধাবিত হয়। 

১.মহামুদ্রা : গুরুসমুখে শুনে,  নিজের গুহ্যদেশ ও উপস্থ -এর মধ্যবর্তী যোনিমন্ডলকে বা পায়ের  গোড়ালি দিয়ে জোরে চেপে ধরুন, ডান  পা প্রসারিত করে, দুই হাত দিয়ে ডান পায়ের আঙুলগুলোকে ধরবেন। এবং দেহের যে নবদ্বার অর্থাৎ দুইচোখ, দুইকান, নাকের দুই ছিদ্র, মুখ, মলদ্বার, এবং মূত্রদ্বার  এগুলোকে সংযত করে, হৃদয়ের উপরে চিবুক স্থাপন করুন। মনকে ব্রহ্ম ভাবনায় যুক্ত করে, বায়ুসাধন অর্থাৎ প্রাণায়াম আরম্ভ করতে হবে। এবার ডান পায়ের গোড়ালি দিয়ে চেপে ধরে বা পা প্রসারিত করুন। এবং একই ভাবে মনকে ব্রহ্ম ভাবনায় যুক্ত রেখে প্রাণায়াম করতে থাকুন। প্রাণায়াম বলতে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে থাকুন, মনোযোগ সহকারে। এবং যতক্ষন ডান পায়ে করবেন, ততক্ষন বাম পায়ে করুন। 
এতে করে, যোগীর সিদ্ধিলাভ সহজ হয়, সকল নাড়ী শুদ্ধ হয়, আমাদের ইন্দ্রিয়সুখের লালসা বিনষ্ট হয়। এতে কুণ্ডলিনী তপ্ত হয়, বায়ু ব্রহ্মরন্ধ্রে প্রবেশ করে। জঠরাগ্নি বৃদ্ধি  হয়। সর্ব্বরোগের উপশম হয়। .জরা-মৃত্যুর ভয় থাকে না। এই মুদ্রা কামধেনুর মতো অভীষ্ট ফল প্রদান করেন।       
২.মহাবন্ধ : বাম পায়ের গোড়ালিকে যোনিস্থানে স্থাপন করবেন। এর পর বাম ঊরুর উপর ডান রেখে পূরক অর্থাৎ শ্বাস ভিতরে টেনে নিন, চিবুক হৃদয়ে চেপে ধরুন বায়ুকে সংকুচিত করে সুষুম্নাতে যুক্ত করবেন। এর পর ধীরে ধীরে বায়ু ছেড়ে দিন। এবার ডান পায়ের গোড়ালিকে  চেপে ধরে, স্বাস নিন, বুকে চিবুক চেপে ধরুন, কুম্ভক করুন, এবং ধীরে ধীরে ছেড়ে দিন। 
স্বাত্মাৰাম বলছেন, মৃত্যুপাস মহবন্ধন থেকে মুক্ত হবার জন্য এই মুদ্রা নিপুন ভাবে কাজ করে। ইড়া-পিঙ্গলা, সুষুম্না এই তিন নাড়ীর মিলন স্থান যাকে  আমরা ত্রিবেণী বলে থাকি, সেখানে তখন শিব-শক্তির মিলন হয়। 
৩. মহাবেধ  : মহাবন্ধে যিনি স্থিত হতে পারবেন, অর্থাৎ মহাবন্ধে স্থিত থেকে একাগ্র চিত্তে বায়ুর পূরক করুন, প্রাণ ও ওপেন বায়ুকে একত্র করে উদর পূর্ন করুন। উদরের  দুই পাশে চাপ দিন।  এই মুদ্রাকে বলে মহাবেধ।  যোগী শ্রেষ্ঠগন এই মহাবেধ মুদ্রা দ্বারা সুষুম্না পথে বায়ু প্রবেশ করিয়ে ব্রহ্ম গ্রন্থিকে ভেদ করেন। যিনি এই মহাবেধ মুদ্রা মুদ্রা প্রতিদিন অভ্যাস করেন, তার বায়ু সিদ্ধি হয়। জরামৃত্যু বিনাশ হয়। এই মহাবেধ মুদ্রার সিদ্ধির ফলে, ষঠচক্রে অবস্থিত ব্রহ্মা-বিষ্ণু-রুদ্রদেব প্রভৃতি দেবগন বায়ু তাড়িত হয়ে কাঁপতে থাকেন এবং মহামায়া কুণ্ডলিনী শক্তিও কৈলাশে অর্থাৎ মস্তকে পরমশিবের সঙ্গে মিলিত হন। 

এতক্ষন আমরা তিনটি মুদ্রার কথা শুনলাম। এই তিনটি মুদ্রাই একসাথে সাধন করতে হয়। এইজন্য প্রত্যেক যোগীর উচিত এই তিনটি মুদ্রাই  ক্রমান্বয়ে সাধন করা। যিনি এই মুদ্রা প্রতিদিন চারবার সাধন করেন, অর্থাৎ সকল, দুপুর, সন্ধ্যা ও রাত্রিতে এই তিনটি মুদ্রার সাধন করেন, শিবসংহিতা অর্থাৎ স্বয়ং শিব বলছেন, তিনি ছয়মাসের মধ্যে মৃত্যুকে যায় করতে পারেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সিদ্ধ পুরুষ ভিন্ন অন্য কেউ এই মুদ্রা জানেন না। যে সমস্ত সাধক সিদ্ধি লেভার ইচ্ছা করেন, তারা অবশ্যই এই মুদ্রার গোপনীয়তা রাখবেন। অপাত্রে এই জ্ঞান পড়লে, এর অপ-ব্যবহার জনিত কারণে তার জীবন সংশয় দেখা দিতে পারে। গুরুবিনা এই সাধন নিষিদ্ধ। এই কথাটা সর্বদা মনে রাখবেন। 

































No comments:

Post a Comment