শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ
দ্বিতীয় অধ্যায়
আজ আমরা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ থেকে কিছু কথা শুনবো। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ কৃষ্ণ যজুর্বেদের অংশ। ঋষি শ্বেতাশ্বতর এই উপনিষদের সংকলক। ঋষি শ্বেতাশ্বতর ইন্দ্রিয়গুলোকে সংযত করেছিলেন। আমরা জানি,কঠ উপনিষদে শরীরকে রথের সাথে তুলনা করা হয়েছে। আর রথের ঘোড়াগুলোকে ইন্দ্রিয়ের সাথে তুলনা করে হয়েছে। শ্বেত - কথাটার অর্থ শুভ্র, অশ্ব কথাটার মানে ঘোড়া। তো যিনি ইন্দ্রিয়রূপ ঘোড়া গুলোকে বশ করেছিলেন, তিনি শ্বেতাশ্বতর। এই উপনিষদে কতকগুলো জটিল প্রশ্নের সমাধান করা হয়েছে। যেমন এই মহাবিশ্বের কারন কি ? কে আমাদের স্রষ্টা ? আমরা কোথা থেকে আসি ? পরিণামে যাবোই বা কোথায় ? কে আমাদের চালাচ্ছে ? আমাদের সুখ-অসুখের কারন কি ? আর সব থেকে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, আত্মজ্ঞান লাভের উপায় কি ? আমরা আজ এই শেষ প্রশ্নটির উত্তর খুঁজবো।
তত্ত্বজ্ঞান লাভের জন্য বা পরম-আত্মাকে জানবার জন্য আমাদের কি করা উচিত। পরমাত্মাকে জানলে সাধকের বা যোগীর কি হয়, সেই সম্পর্কে আমরা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ থেকে শুনবো।শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ বলছেন, পরমাত্মাকে জানতে গেলে প্রথমে প্রার্থনা করতে হবে । কিন্তু কার কাছে প্রার্থনা করবো ? আর কেনই বা প্রার্থনা করবো ? ধরুন আমি অদ্বৈতবাদী। আমি মনে করি, ঈশ্বর এক এবং সবত্র। তিনি আমার মধ্যেও আছেন, তিনি আমার বাইরেও আছেন। তাহলে আমি আবার কার কাছে প্রার্থনা করবো।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ উপনিষদ বলছেন, সূর্য্যের কাছে প্রার্থনা করুন। কারন যতক্ষন আপনার দেহবোধ আছে, যতক্ষন আপনি নিজেকে বিশ্বসংসার থেকে আলাদা মনে করেন, যতক্ষন নিজেকে স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে মনে করেন, ততক্ষন আপনাকে সেই বিশ্বশক্তির কাছে প্রার্থনা করতে হবে। এখন এই বিশ্বশক্তি তো আমার উপল্বদ্ধিতে নেই। তাই আমার উপল্বদ্ধিতে যা আছে, যা আমাদেরকে আমাদের জীবনকে সরাসরি প্রভাবিত করে, তিনি হচ্ছেন আকাশের সূর্যদেব । সূর্য এতই বিরাট বিশাল, এতই শক্তিমান, যে সূর্য বিনা আমাদের জীবন অসম্ভম। সূর্য না থাকলে পৃথিবীতে প্রাণের স্পন্দন দেখা যেত না। সমস্ত আলোর উৎস এই সূর্য, সমস্ত জীব উজ্জিত হয়ে ওঠে এই আলোর স্পর্শে। সূর্য ছাড়া কোনো কিছুর বেড়ে ওঠা বা আমাদের জীবন ধারণ অসম্ভব। তাই এই আলোর উৎসর কাছে প্রার্থনা করুন। আমাদের মনের আকর্ষণের বিষয় হচ্ছে এই জগৎ। এই জগৎ আমাদের মনটাকে প্রতিনিয়ত টানছে। আমরা যাতে এই জগৎ থেকে মনটাকে তুলে নিতে পারি,আর বিশ্বশক্তির চরণপদ্মে নিবেদন করতে পারি, সেইজন্য প্রথমে আমাদের সূর্যের কাছে প্রার্থনা করতে হবে।
আমরা গায়েত্রী মন্ত্র শুনেছি। যাঁকে সাবিত্রী মন্ত্র বলা হয়ে থাকে। সেখানে সবিতা দেবের উদ্দেশ্য প্রার্থনার সুর ধ্বনিত হয়েছে। এখন কথা হচ্ছে, সবিতা দেবের উদ্দেশ্যে আমরা কি প্রার্থনা করবো ? আমাদের উদ্দেশ্য জগতের যিনি উৎস সেই ব্রহ্মের কাছে যাওয়া।
তাই আমাদের প্রার্থনা হবে "সূর্য যেন কৃপা করে আমার মন ও ইন্দ্রিয়গুলোকে পরমাত্মার দিকে চালিত করেন। আমার ইন্দ্রিয়গুলো সর্বদা বহির্মুখী, তারা বাইরের বিষয় নিয়েই মেতে থাকে। আমার এই ইন্দ্রিয়গুলো যেন বহির্মুখ থেকে অন্তর্মুখী হয়। হে সূর্যদেব, আপনার অগ্নির্জ্যোতি ও তার সমস্ত প্রকাশ শক্তি যেন আমার ইন্দ্রিয়গুলোকে প্রোজ্জ্বল করে তোলেন, যাতে আমার দেহ -মন পরমাত্মার উপল্বদ্ধির যোগ্য হয়ে উঠতে পারে। "
আসলে আমরা জানি অগ্নি সর্বদা উর্দ্ধমুখী। অগ্নিতে যা কিছু আহুতি দেওয়া হয়, সবই উর্দ্ধমুখী হয়ে যায়। আর সবিতাদেবের যে তেজঃশক্তি তা যেমন পৃথিবীর সব কিছুকে প্রকাশ করে, তেমনি মাটির ভিতরে যে সম্ভানাময় বীজ গ্রথিত আছে, তাকে উদ্গমন করে তোলেন এই সূর্যদেব । অগ্নি ব্যতীত প্রথিবীর কোনো কিছুই প্রকাশিত হতে পারে না। তাই নিজেকে প্রকাশিত করতে হলে আমাদের সেই সূর্যদেবের কাছে প্রার্থনা করতে হবে।
পঞ্চভূতের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মেলন হচ্ছে এই মানবদেহ। আর মানবদেহে স্থিত ইন্দ্রিয়গুলো বহির্মুখী হওয়ার ফলে এই জগৎ দৃশ্যমান হয়েছে। শব্দ স্পর্শ রূপ রস গন্ধ - এগুলোর উপলব্ধি ইন্দ্রিয় ব্যতীত হওয়া সম্ভব নয়। আর আমাদের সমস্ত জ্ঞান এই ইন্দ্রিয়ের সাহায্যেই হয়ে থাকে। তো এই ইন্দ্রিয়গুলোকে যদি আমরা বহির্মুখী না করে অন্তর্মুখী করতে পারি, তবে পরমজ্ঞান লাভ করতে আমরা সমর্থ হবো।
এর পরের কাজ হচ্ছে ধ্যানে নিবিষ্ট হওয়া। জ্যোতির্ময় সূর্যদেবের কৃপায় আমরা পরমাত্মায় মন স্থির করবো। ধ্যান ইত্যাদি দ্বারা আমরা পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত হবার চেষ্টা করবো। আর প্রার্থনা করবো, সূর্যদেব প্রসন্ন হয়ে আমার মনকে পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত করুন। তাহলে আমার পঞ্চইন্দ্রিয় অবশ্যই পরমাত্মার দিকে ধাবিত হবে। আমরা প্রার্থনা করবো, সেই জ্যোতিস্বরূপ পরমাত্মাকে উপলব্ধি করবার জন্য, আমাদের যে বিচার শক্তি প্রয়োজন, তাও যেন সবিতাদেব আমাদেরকে দান করেন।
এতে করে আমরা একসময় দেখবো, আমাদের মন এবং ইন্দ্রিয়গুলো পরমাত্মাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এইসময় আমাদের সর্বজ্ঞ সূর্যদেবের প্রতি একান্তভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। ধ্যানের মাধ্যমে ইন্দ্রিয়সকল ও তার অধীশ্বরকে নমস্কার করা উচিত। প্রাণের আকুতি নিয়ে, স্তুতি করুন, মনে করুন অমৃতপুত্ররা, যারা দিব্যধামে আছেন, তারা সবাই আপনার কথা শুনতে পারছেন। আর এই অবস্থায় আমরা যা কিছু করি না কেন, তার ভালো মন্দ যাই হোক না কেন, সেই কর্ম্মের কোনো ফল আমাকে আবদ্ধ করতে পারবে না। আমি সমস্ত কর্ম্ম বন্ধন থেকে মুক্ত থাকবো।
আমাদের জীবনে সবার একই লক্ষ মোক্ষ বা নির্বাণ লাভ। আর এই সমাধি লাভের জন্য, আমাদের এমন আসনে বসতে হবে, যাতে আমাদের মাথা-ঘাড়-বুক শরীরের এই তিনটি অংশ সোজা ও সমান্তরাল থাকে। এর পর আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলোকে প্রণব নামক নৌকার মাধ্যমে মনের মধ্যে একত্রিত করতে হবে। এইভাবে আমরা ভয়ঙ্কর এই জীবন নদী পার হবো। আসলে এই নৌকারই আর এক নাম ব্রহ্ম। আর ব্রহ্মই প্রণব।
যিনি যোগাভ্যাস করবেন, তার কর্তব্য-অকর্তব্য সম্পর্কে সদা সচেতন থাকতে হবে। অর্থাৎ খাদ্যাভ্যাস ও পবিত্র চিন্তা। শরীরকে পবিত্র রাখতে হবে। মনের চিন্তায় পবিত্রতা বজায় রাখতে হবে। সচেতন ভাবে, যত্ন সহকারে, প্রাণবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ক্লান্তিবোধ না করা পর্যন্ত নিঃশাস ত্যাগ করবেন না। মন যেন দেহরূপ রথের দুরন্ত-অশান্ত ঘোড়া। দক্ষ সারথির মতো, চঞ্চল মনকে সংযত করে, পরমাত্মায় নিবদ্ধ করতে হবে।
যোগ হচ্ছে আত্মসংযমের বিজ্ঞান। মন ও আমাদের ইন্দ্রিগুলোকে বসে আনতে হবে, আর এই কাজ অন্য কেউ করে দিতে পারবে না। তাই নিজেকে নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যোগী হতে চাইলে ধর্ম্মের ঠাকুর ঘরে ঢুকতে চাইলে সংযমরূপ চাবি নিজের হাতে নিতে হবে।
যোগের স্থান হবে, ১. সমতল, ২.শুদ্ধ। ৩.নুড়ি-পাথর বালি, বা আগুন থাকবে না। ৪.কোলাহলমুক্ত ৫.কাছাকাছি কোনো নদী বা হ্রদ থাকবে না। ৬. স্থানটি হবে মনোরম ও নয়নসূখকর। ৭.স্থানটি গুহা বা ঐজাতীয় স্থান হলে ভালো হয়, অর্থাৎ বাতাস যেখানে শান্ত। উপনিষদ তাই গুহায় ধ্যানের অভ্যাস করতে বলছেন।
ব্রহ্ম-উপলব্ধির ঠিক আগে যোগী-সাধক তুষার, ধোঁয়া, সূর্য, বাতাস, আগুন, জোনাকি, স্ফুলিঙ্গ, স্ফটিক, চাঁদ প্রভৃতি দেখতে পান। এগুলো সবই ব্রহ্মজ্ঞানের পূর্বাভাস। এইসময় সাধক স্থুল বস্তুর মধ্যে যে গুন্ নিহিত আছে, তার সন্ধান পেতে থাকেন। এই সময় যোগীর কাছে, পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু, আকাশ এই স্থূল পঞ্চভূত আর স্থুল থাকে না। তিনি এসবের মধ্যে, এর গুণগুলো অর্থাৎ রূপ, রস, শব্দ, স্পর্শ, গন্ধ প্রভৃতি গুনগুলোকেই দেখতে পান। যোগীর দেহও তখন আর স্থূল থাকে না। সে দেহীর রূপান্তর ঘটে। ব্যাধি জরা, মৃত্যু আর সে দেহকে স্পর্শ করতে পারে না। যোগীর তখন ইচ্ছা মৃত্যু হয়।
পৃথিবী-অপ-তেজঃ-অনিল-খে সমুত্থিতে
পঞ্চাত্মকে যোগগুনে প্রবৃত্তে।
ন তস্য রোগো ন জরা ন মৃত্যুঃ
প্রাপ্তস্য যোগাগ্নিময়ং শরীরম। (২/১২)
এই সময় সাধকের শরীরে একটা হালকা ভাব অনুভূত হয়। অর্থাৎ শরীর হয় ছিপছিপে। রোগাদি ও ভোগলিপ্সার অভাব দেখা দেয় তখন । গায়ের রঙ হয় উজ্জ্বল। কন্ঠস্বর হয় মধুর। দেহে একটা সুগন্ধ পাওয়া যায়। এই অবস্থায় যোগীর মল-মূত্রের পরিমান কমে যায়। (১৩) স্বামী লোকেশ্বরানন্দ বলছেন, লক্ষণগুলো যে সর্বদা দেখা যাবেই, এমন কথা বলা যায় না। তবে এগুলো এলো কি এলোনা তা নিয়ে মাথা ঘামাতে নেই। সাধকের একটাই লক্ষ আর তা হচ্ছে ব্রহ্ম-উপলব্ধি।
এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা শুনি। রামকৃষ্ণদেব নরেনকে অদ্বৈতবাদ সম্পর্কে অনেক নিগূঢ় তত্ত্ব উপদেশ দিতেন। নরেন শুনতো কিন্তু সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম হত না। তো একদিন তামাক খেতে খেতে নরেন প্রতাপ চন্দ্র হাজরাকে বলছেন, " একি কখনো হতে পারে ? ঘাঁটিটা ঈশ্বর, বাটিটা ঈশ্বর, যা কিছু দেখছি এমনকি আমরা সকলেই ঈশ্বর। এমনসব ব্যাঙ্গালাপ চলছিল। তো ঠাকুর তখন অর্ধবাহ্য দশায়। ঠাকুর "তোরা কি বলছিস রে ?" বলে হাসতে হাসতে নরেনকে স্পর্শ করে সমাধিস্থ হলেন। আর এতে করে নরেনের মধ্যে এক অদ্ভুত ভাবান্তর উপস্থিত হল। আমরা সেইকথা স্বামীজীর মুখে শুনবো। বলছেন :
"ঠাকুরের ঐদিনকার অদ্ভুত স্পর্শে মুহূর্তের মধ্যে ভাবান্তর উপস্থিত হলো। স্তম্ভিত হয়ে সত্যি সত্যিই দেখতে লাগলাম, ঈশ্বর ভিন্ন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অন্য কিছু নাই। এমনটা দেখেও নীরব রইলাম, ভাবলাম - দেখি কতক্ষন পর্যন্ত এই ভাব থাকে। কিন্তু সেই ঘোর সেদিন কিছু মাত্র কমল না। বাড়িতে ফিরলাম, সেখানেও তাই। যা কিছু দেখতে লাগলাম, সে-সবই তিনি, এমন বোধ হতে লাগলো।"
যেকোনো কিছু ধৌত করলে, তা সে জল দিয়েই হোক, অগ্নি দিয়েই হোক বা কোনো রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে, ধৌত করলেই সোনা খন্ডের উজ্জ্বল্য ফিরে আসে, তেমনি যিনি নিজের আত্মাকে সকলের আত্মা বলে উপলব্ধি করতে পারেন, তবে বুঝবেন তিনি অন্তিম লক্ষ্যে পৌঁছে গেছেন। তিনি তখন সব সুখ-দুঃখের পরে চলে যান। (১৪)
এই সময় যোগী নিজেকে উজ্জ্বল দীপশিখার মতো দেখতে পান। তিনি যে ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম অনুভব করেন, ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যান। আর এই উপল্বদ্ধির ফলে তিনি জন্ম মৃত্যু, অর্থাৎ সমস্ত পরিবর্তনের উর্দ্ধে চলে যান। অজ্ঞানতার প্রলোভন তার কেটে যায়। অবিদ্যাজনিত সকল বন্ধন থেকে তিনি মুক্ত হয়ে জ্যোতিস্বরূপ পরম-আত্মাকে লাভ করেন। (১৫)
এই পরম-আত্মা, পরম-ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজ করছেন। তার প্রথম প্রকাশ বিশ্ব-মন রূপে। তিনিই মাতৃগর্ভে থাকেন। তিনিই শিশু হয়ে জন্মান। ভবিষ্যতেও তিনিই আবার শিশু হয়েই জন্মাবেন। সব মুখ তো তাঁরই মুখ। সব দেহের সমষ্টি তিনিই । তিনি বিরাট পুরুষ তিনি সকল সত্তায় বিদ্যমান। (১৬)
আমরা সেই বিরাট পুরুষকে নমস্কার করি। জলে স্থলে, ঔষধিতে বনস্পতিতে অর্থাৎ বিশ্বজুড়ে রয়েছেন সেই পরমাত্মা। তস্মৈ দেবায় নমো নমঃ। (১৭)
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম।
দ্বিতীয় অধ্যায়
আজ আমরা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ থেকে কিছু কথা শুনবো। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ কৃষ্ণ যজুর্বেদের অংশ। ঋষি শ্বেতাশ্বতর এই উপনিষদের সংকলক। ঋষি শ্বেতাশ্বতর ইন্দ্রিয়গুলোকে সংযত করেছিলেন। আমরা জানি,কঠ উপনিষদে শরীরকে রথের সাথে তুলনা করা হয়েছে। আর রথের ঘোড়াগুলোকে ইন্দ্রিয়ের সাথে তুলনা করে হয়েছে। শ্বেত - কথাটার অর্থ শুভ্র, অশ্ব কথাটার মানে ঘোড়া। তো যিনি ইন্দ্রিয়রূপ ঘোড়া গুলোকে বশ করেছিলেন, তিনি শ্বেতাশ্বতর। এই উপনিষদে কতকগুলো জটিল প্রশ্নের সমাধান করা হয়েছে। যেমন এই মহাবিশ্বের কারন কি ? কে আমাদের স্রষ্টা ? আমরা কোথা থেকে আসি ? পরিণামে যাবোই বা কোথায় ? কে আমাদের চালাচ্ছে ? আমাদের সুখ-অসুখের কারন কি ? আর সব থেকে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, আত্মজ্ঞান লাভের উপায় কি ? আমরা আজ এই শেষ প্রশ্নটির উত্তর খুঁজবো।
তত্ত্বজ্ঞান লাভের জন্য বা পরম-আত্মাকে জানবার জন্য আমাদের কি করা উচিত। পরমাত্মাকে জানলে সাধকের বা যোগীর কি হয়, সেই সম্পর্কে আমরা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ থেকে শুনবো।শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ বলছেন, পরমাত্মাকে জানতে গেলে প্রথমে প্রার্থনা করতে হবে । কিন্তু কার কাছে প্রার্থনা করবো ? আর কেনই বা প্রার্থনা করবো ? ধরুন আমি অদ্বৈতবাদী। আমি মনে করি, ঈশ্বর এক এবং সবত্র। তিনি আমার মধ্যেও আছেন, তিনি আমার বাইরেও আছেন। তাহলে আমি আবার কার কাছে প্রার্থনা করবো।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ উপনিষদ বলছেন, সূর্য্যের কাছে প্রার্থনা করুন। কারন যতক্ষন আপনার দেহবোধ আছে, যতক্ষন আপনি নিজেকে বিশ্বসংসার থেকে আলাদা মনে করেন, যতক্ষন নিজেকে স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে মনে করেন, ততক্ষন আপনাকে সেই বিশ্বশক্তির কাছে প্রার্থনা করতে হবে। এখন এই বিশ্বশক্তি তো আমার উপল্বদ্ধিতে নেই। তাই আমার উপল্বদ্ধিতে যা আছে, যা আমাদেরকে আমাদের জীবনকে সরাসরি প্রভাবিত করে, তিনি হচ্ছেন আকাশের সূর্যদেব । সূর্য এতই বিরাট বিশাল, এতই শক্তিমান, যে সূর্য বিনা আমাদের জীবন অসম্ভম। সূর্য না থাকলে পৃথিবীতে প্রাণের স্পন্দন দেখা যেত না। সমস্ত আলোর উৎস এই সূর্য, সমস্ত জীব উজ্জিত হয়ে ওঠে এই আলোর স্পর্শে। সূর্য ছাড়া কোনো কিছুর বেড়ে ওঠা বা আমাদের জীবন ধারণ অসম্ভব। তাই এই আলোর উৎসর কাছে প্রার্থনা করুন। আমাদের মনের আকর্ষণের বিষয় হচ্ছে এই জগৎ। এই জগৎ আমাদের মনটাকে প্রতিনিয়ত টানছে। আমরা যাতে এই জগৎ থেকে মনটাকে তুলে নিতে পারি,আর বিশ্বশক্তির চরণপদ্মে নিবেদন করতে পারি, সেইজন্য প্রথমে আমাদের সূর্যের কাছে প্রার্থনা করতে হবে।
আমরা গায়েত্রী মন্ত্র শুনেছি। যাঁকে সাবিত্রী মন্ত্র বলা হয়ে থাকে। সেখানে সবিতা দেবের উদ্দেশ্য প্রার্থনার সুর ধ্বনিত হয়েছে। এখন কথা হচ্ছে, সবিতা দেবের উদ্দেশ্যে আমরা কি প্রার্থনা করবো ? আমাদের উদ্দেশ্য জগতের যিনি উৎস সেই ব্রহ্মের কাছে যাওয়া।
তাই আমাদের প্রার্থনা হবে "সূর্য যেন কৃপা করে আমার মন ও ইন্দ্রিয়গুলোকে পরমাত্মার দিকে চালিত করেন। আমার ইন্দ্রিয়গুলো সর্বদা বহির্মুখী, তারা বাইরের বিষয় নিয়েই মেতে থাকে। আমার এই ইন্দ্রিয়গুলো যেন বহির্মুখ থেকে অন্তর্মুখী হয়। হে সূর্যদেব, আপনার অগ্নির্জ্যোতি ও তার সমস্ত প্রকাশ শক্তি যেন আমার ইন্দ্রিয়গুলোকে প্রোজ্জ্বল করে তোলেন, যাতে আমার দেহ -মন পরমাত্মার উপল্বদ্ধির যোগ্য হয়ে উঠতে পারে। "
আসলে আমরা জানি অগ্নি সর্বদা উর্দ্ধমুখী। অগ্নিতে যা কিছু আহুতি দেওয়া হয়, সবই উর্দ্ধমুখী হয়ে যায়। আর সবিতাদেবের যে তেজঃশক্তি তা যেমন পৃথিবীর সব কিছুকে প্রকাশ করে, তেমনি মাটির ভিতরে যে সম্ভানাময় বীজ গ্রথিত আছে, তাকে উদ্গমন করে তোলেন এই সূর্যদেব । অগ্নি ব্যতীত প্রথিবীর কোনো কিছুই প্রকাশিত হতে পারে না। তাই নিজেকে প্রকাশিত করতে হলে আমাদের সেই সূর্যদেবের কাছে প্রার্থনা করতে হবে।
পঞ্চভূতের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মেলন হচ্ছে এই মানবদেহ। আর মানবদেহে স্থিত ইন্দ্রিয়গুলো বহির্মুখী হওয়ার ফলে এই জগৎ দৃশ্যমান হয়েছে। শব্দ স্পর্শ রূপ রস গন্ধ - এগুলোর উপলব্ধি ইন্দ্রিয় ব্যতীত হওয়া সম্ভব নয়। আর আমাদের সমস্ত জ্ঞান এই ইন্দ্রিয়ের সাহায্যেই হয়ে থাকে। তো এই ইন্দ্রিয়গুলোকে যদি আমরা বহির্মুখী না করে অন্তর্মুখী করতে পারি, তবে পরমজ্ঞান লাভ করতে আমরা সমর্থ হবো।
এর পরের কাজ হচ্ছে ধ্যানে নিবিষ্ট হওয়া। জ্যোতির্ময় সূর্যদেবের কৃপায় আমরা পরমাত্মায় মন স্থির করবো। ধ্যান ইত্যাদি দ্বারা আমরা পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত হবার চেষ্টা করবো। আর প্রার্থনা করবো, সূর্যদেব প্রসন্ন হয়ে আমার মনকে পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত করুন। তাহলে আমার পঞ্চইন্দ্রিয় অবশ্যই পরমাত্মার দিকে ধাবিত হবে। আমরা প্রার্থনা করবো, সেই জ্যোতিস্বরূপ পরমাত্মাকে উপলব্ধি করবার জন্য, আমাদের যে বিচার শক্তি প্রয়োজন, তাও যেন সবিতাদেব আমাদেরকে দান করেন।
এতে করে আমরা একসময় দেখবো, আমাদের মন এবং ইন্দ্রিয়গুলো পরমাত্মাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এইসময় আমাদের সর্বজ্ঞ সূর্যদেবের প্রতি একান্তভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। ধ্যানের মাধ্যমে ইন্দ্রিয়সকল ও তার অধীশ্বরকে নমস্কার করা উচিত। প্রাণের আকুতি নিয়ে, স্তুতি করুন, মনে করুন অমৃতপুত্ররা, যারা দিব্যধামে আছেন, তারা সবাই আপনার কথা শুনতে পারছেন। আর এই অবস্থায় আমরা যা কিছু করি না কেন, তার ভালো মন্দ যাই হোক না কেন, সেই কর্ম্মের কোনো ফল আমাকে আবদ্ধ করতে পারবে না। আমি সমস্ত কর্ম্ম বন্ধন থেকে মুক্ত থাকবো।
আমাদের জীবনে সবার একই লক্ষ মোক্ষ বা নির্বাণ লাভ। আর এই সমাধি লাভের জন্য, আমাদের এমন আসনে বসতে হবে, যাতে আমাদের মাথা-ঘাড়-বুক শরীরের এই তিনটি অংশ সোজা ও সমান্তরাল থাকে। এর পর আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলোকে প্রণব নামক নৌকার মাধ্যমে মনের মধ্যে একত্রিত করতে হবে। এইভাবে আমরা ভয়ঙ্কর এই জীবন নদী পার হবো। আসলে এই নৌকারই আর এক নাম ব্রহ্ম। আর ব্রহ্মই প্রণব।
যিনি যোগাভ্যাস করবেন, তার কর্তব্য-অকর্তব্য সম্পর্কে সদা সচেতন থাকতে হবে। অর্থাৎ খাদ্যাভ্যাস ও পবিত্র চিন্তা। শরীরকে পবিত্র রাখতে হবে। মনের চিন্তায় পবিত্রতা বজায় রাখতে হবে। সচেতন ভাবে, যত্ন সহকারে, প্রাণবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ক্লান্তিবোধ না করা পর্যন্ত নিঃশাস ত্যাগ করবেন না। মন যেন দেহরূপ রথের দুরন্ত-অশান্ত ঘোড়া। দক্ষ সারথির মতো, চঞ্চল মনকে সংযত করে, পরমাত্মায় নিবদ্ধ করতে হবে।
যোগ হচ্ছে আত্মসংযমের বিজ্ঞান। মন ও আমাদের ইন্দ্রিগুলোকে বসে আনতে হবে, আর এই কাজ অন্য কেউ করে দিতে পারবে না। তাই নিজেকে নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যোগী হতে চাইলে ধর্ম্মের ঠাকুর ঘরে ঢুকতে চাইলে সংযমরূপ চাবি নিজের হাতে নিতে হবে।
যোগের স্থান হবে, ১. সমতল, ২.শুদ্ধ। ৩.নুড়ি-পাথর বালি, বা আগুন থাকবে না। ৪.কোলাহলমুক্ত ৫.কাছাকাছি কোনো নদী বা হ্রদ থাকবে না। ৬. স্থানটি হবে মনোরম ও নয়নসূখকর। ৭.স্থানটি গুহা বা ঐজাতীয় স্থান হলে ভালো হয়, অর্থাৎ বাতাস যেখানে শান্ত। উপনিষদ তাই গুহায় ধ্যানের অভ্যাস করতে বলছেন।
ব্রহ্ম-উপলব্ধির ঠিক আগে যোগী-সাধক তুষার, ধোঁয়া, সূর্য, বাতাস, আগুন, জোনাকি, স্ফুলিঙ্গ, স্ফটিক, চাঁদ প্রভৃতি দেখতে পান। এগুলো সবই ব্রহ্মজ্ঞানের পূর্বাভাস। এইসময় সাধক স্থুল বস্তুর মধ্যে যে গুন্ নিহিত আছে, তার সন্ধান পেতে থাকেন। এই সময় যোগীর কাছে, পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু, আকাশ এই স্থূল পঞ্চভূত আর স্থুল থাকে না। তিনি এসবের মধ্যে, এর গুণগুলো অর্থাৎ রূপ, রস, শব্দ, স্পর্শ, গন্ধ প্রভৃতি গুনগুলোকেই দেখতে পান। যোগীর দেহও তখন আর স্থূল থাকে না। সে দেহীর রূপান্তর ঘটে। ব্যাধি জরা, মৃত্যু আর সে দেহকে স্পর্শ করতে পারে না। যোগীর তখন ইচ্ছা মৃত্যু হয়।
পৃথিবী-অপ-তেজঃ-অনিল-খে সমুত্থিতে
পঞ্চাত্মকে যোগগুনে প্রবৃত্তে।
ন তস্য রোগো ন জরা ন মৃত্যুঃ
প্রাপ্তস্য যোগাগ্নিময়ং শরীরম। (২/১২)
এই সময় সাধকের শরীরে একটা হালকা ভাব অনুভূত হয়। অর্থাৎ শরীর হয় ছিপছিপে। রোগাদি ও ভোগলিপ্সার অভাব দেখা দেয় তখন । গায়ের রঙ হয় উজ্জ্বল। কন্ঠস্বর হয় মধুর। দেহে একটা সুগন্ধ পাওয়া যায়। এই অবস্থায় যোগীর মল-মূত্রের পরিমান কমে যায়। (১৩) স্বামী লোকেশ্বরানন্দ বলছেন, লক্ষণগুলো যে সর্বদা দেখা যাবেই, এমন কথা বলা যায় না। তবে এগুলো এলো কি এলোনা তা নিয়ে মাথা ঘামাতে নেই। সাধকের একটাই লক্ষ আর তা হচ্ছে ব্রহ্ম-উপলব্ধি।
এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা শুনি। রামকৃষ্ণদেব নরেনকে অদ্বৈতবাদ সম্পর্কে অনেক নিগূঢ় তত্ত্ব উপদেশ দিতেন। নরেন শুনতো কিন্তু সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম হত না। তো একদিন তামাক খেতে খেতে নরেন প্রতাপ চন্দ্র হাজরাকে বলছেন, " একি কখনো হতে পারে ? ঘাঁটিটা ঈশ্বর, বাটিটা ঈশ্বর, যা কিছু দেখছি এমনকি আমরা সকলেই ঈশ্বর। এমনসব ব্যাঙ্গালাপ চলছিল। তো ঠাকুর তখন অর্ধবাহ্য দশায়। ঠাকুর "তোরা কি বলছিস রে ?" বলে হাসতে হাসতে নরেনকে স্পর্শ করে সমাধিস্থ হলেন। আর এতে করে নরেনের মধ্যে এক অদ্ভুত ভাবান্তর উপস্থিত হল। আমরা সেইকথা স্বামীজীর মুখে শুনবো। বলছেন :
"ঠাকুরের ঐদিনকার অদ্ভুত স্পর্শে মুহূর্তের মধ্যে ভাবান্তর উপস্থিত হলো। স্তম্ভিত হয়ে সত্যি সত্যিই দেখতে লাগলাম, ঈশ্বর ভিন্ন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অন্য কিছু নাই। এমনটা দেখেও নীরব রইলাম, ভাবলাম - দেখি কতক্ষন পর্যন্ত এই ভাব থাকে। কিন্তু সেই ঘোর সেদিন কিছু মাত্র কমল না। বাড়িতে ফিরলাম, সেখানেও তাই। যা কিছু দেখতে লাগলাম, সে-সবই তিনি, এমন বোধ হতে লাগলো।"
যেকোনো কিছু ধৌত করলে, তা সে জল দিয়েই হোক, অগ্নি দিয়েই হোক বা কোনো রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে, ধৌত করলেই সোনা খন্ডের উজ্জ্বল্য ফিরে আসে, তেমনি যিনি নিজের আত্মাকে সকলের আত্মা বলে উপলব্ধি করতে পারেন, তবে বুঝবেন তিনি অন্তিম লক্ষ্যে পৌঁছে গেছেন। তিনি তখন সব সুখ-দুঃখের পরে চলে যান। (১৪)
এই সময় যোগী নিজেকে উজ্জ্বল দীপশিখার মতো দেখতে পান। তিনি যে ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম অনুভব করেন, ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যান। আর এই উপল্বদ্ধির ফলে তিনি জন্ম মৃত্যু, অর্থাৎ সমস্ত পরিবর্তনের উর্দ্ধে চলে যান। অজ্ঞানতার প্রলোভন তার কেটে যায়। অবিদ্যাজনিত সকল বন্ধন থেকে তিনি মুক্ত হয়ে জ্যোতিস্বরূপ পরম-আত্মাকে লাভ করেন। (১৫)
এই পরম-আত্মা, পরম-ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজ করছেন। তার প্রথম প্রকাশ বিশ্ব-মন রূপে। তিনিই মাতৃগর্ভে থাকেন। তিনিই শিশু হয়ে জন্মান। ভবিষ্যতেও তিনিই আবার শিশু হয়েই জন্মাবেন। সব মুখ তো তাঁরই মুখ। সব দেহের সমষ্টি তিনিই । তিনি বিরাট পুরুষ তিনি সকল সত্তায় বিদ্যমান। (১৬)
আমরা সেই বিরাট পুরুষকে নমস্কার করি। জলে স্থলে, ঔষধিতে বনস্পতিতে অর্থাৎ বিশ্বজুড়ে রয়েছেন সেই পরমাত্মা। তস্মৈ দেবায় নমো নমঃ। (১৭)
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম।
No comments:
Post a Comment