মহাভারত - শান্তি পর্ব্ব
সূচনা :
ওম সর্বেষাম শান্তির্ভবতু ; ওম সর্বেষাম স্বস্তির্ভবতু।।
ওম সর্বেষাম পূর্নম ভবতু ; ওম সর্বেষাম মঙ্গলম ভবতু।।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।।
মহাভারতের যুদ্ধের পরে পঞ্চপাণ্ডব, ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর ইত্যাদি সবাই মিলে ভাগীরথীর জলে, যুদ্ধে নিহত সবার জন্য সলিলক্রিয়া সম্পাদন করলেন। এর পর পান্ডবরা ভাগীরথীর তীরে একমাস ছিলেন। এইসময় বহু মহাত্মা যেমন ব্যাসদেব নারদ কন্ব ইত্যাদি সবাই তাদের কাছে দেখা করতে আসতেন।এবং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ঋষি তাদের মূল্যবান উপদেশ দান করতেন। এই সময় যুধিষ্ঠির মনমরা হয়ে থাকতেন।
তো একদিন মহর্ষি নারদ বললেন, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, আপনি নিজ বাহুবলে, বাসুদেবের প্রসাদে ও ভাগ্যবলে এই অখন্ড ভূমন্ডল পরাজয় করেছেন, যুদ্ধের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছেন। এখন আপনার সুখের সময়, এই সময় আপনি বিষণ্ণ কেন ?
যুধিষ্ঠির বললেন : ভগবন, আমি আমার বাহুবলে নয়, এই যুদ্ধে বাসুদেবের অনুগ্রহে, আর ভীম অর্জুন, এদের বাহুবলে আমি এই পৃথিবীকে জয় করেছি। কিন্তু আমার রাজ্য লোভের জন্য, আমাদের জ্ঞাতিকুল ক্ষয় করেছি। দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্রকে হারিয়েছি, অভিমন্যুকে হারিয়েছি , এতে করে আমার এই জয়লাভ পরাজয়ের ন্যায় বোধ হচ্ছে। জানিনা শ্রীমধুসূদন দ্বারকায় গেলে পুত্রহীনা সুভদ্রা তাকে কি বলবে। পুত্রহীনা দ্রৌপদীকে দেখলে আমার শোকানল বাড়তে থাকে। না জেনে, আমাদের বড়ভাই কর্নকে আমরা নিহত করেছি। এতে করে আমি কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না।
নারদ বললেন : হে ধর্মরাজ আপনার বড়ভাই কর্ন বড় যোদ্ধা ছিলেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি একজন অভিশাপগ্রস্থ, বঞ্চিত মানুষ ছিলেন। অতয়েব তার জন্য শোক করা কর্তব্য নয়। সবই পূর্ব্ব নির্দিষ্ট। পুরুষার্থের দ্বারা ভাবিতব্যকে খণ্ডানো যায় সত্য, কিন্তু বিনাশকালে পুরুষার্থঃ নেতিবাচক কাজে লিপ্ত হয়ে যায়। তাই নিয়তির অবধ্য কেউ নয়। অতয়েব বৃথা শোক করো না।
ভাগীরথীর তীরে পঞ্চপাণ্ডব একমাস অবস্থান করেছিলেন। এইসময় বহু মূল্যবান উপদেশ তিনি বিভিন্ন ঋষি মহাঋষিদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। তাতে রাজধর্ম পালনের কথা যেমন আছে, তেমনি জীবন ধর্মের উপদেশ। আছে দেহতত্ত্বের কথা, আছে জীবাত্মা-পরম-আত্মার কথা, আছে মোক্ষের কথা । আমরা এই দেহতত্ত্ব ও আত্মার কথা শুনবো।কিন্তু তার আগে শুনবো, শোক নিবারণের উপায়।
এই শান্তিপর্ব্বে একটা অধ্যায় হচ্ছে মোক্ষপর্ব্ব। সেখানে যুধিষ্ঠির পিতামহ ভীষ্মকে একটি চিরন্তন প্রশ্ন করেছিলেন, - মানুষ কি ভাবে শোক তা সে যে কারণেই হোক অর্থাৎ ধনক্ষয় বা পিতা -মাতা পুত্র-কন্যা প্রভৃতির মৃত্যুতে আমাদের যে শোক হয় তার থেকে আমরা কি ভাবে পরিত্রান পাবো ?
ভীষ্ম বললেন : কারুর মৃত্যু হলে বা অর্থনাশ হলে আমরা শমগুণাদির দ্বারা এই শোক নিবারণ করতে পারি। শম অর্থাৎ ইন্দ্রিয়। এই ইন্দ্রিয় দমনের দ্বারা আমরা আমাদের শোক নিবারণ করতে পারি। এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলেছেন মহামতি ভীষ্ম। গল্পটা আমরা শুনবো।
শোনজিৎ রাজার স্ত্রী-পুত্র মারা গেছেন। এই সময় এক ব্রাহ্মণ শোকসন্তপ্ত শোনজিৎ রাজার কাছে এসে বললেন, মহারাজ আপনি অজ্ঞানের ন্যায় শোক করছেন কেন ? ভেবে দেখেছেন কি, দুদিন পরে, লোকে আপনার জন্যই শোক করবে। কি আপনি, কি আমি, আমরা সবাই পুরুষ হতে এই ইহলোকে এসেছি, আবার সেই পুরুষেই লয় প্রাপ্ত হবো।
সমস্ত জীব, কি মানুষ কি দেবতা, কি পশু কি পাখি আমরা সবাই নিজেদের কর্মের জন্যই দুঃখ ভোগ করছি। আমরা নিজের আত্মাকে নিজের বলে জ্ঞান করি না। অথচ এই অনিত্য জগৎকে নিজের বলে জ্ঞান করে থাকি। আমরা জানি এই পৃথিবীর সমস্ত বস্তুতে সবার অধিকার আছে। অথচ সেইসব বস্তু আমরা আমার সংগ্রহে রাখতে চাই। এজন্য আমাদের অন্তরে সুখ বা দুঃখের উদ্রেক হয় না। বিশাল সমুদ্রে দুটো কাঠের টুকরো ক্ষনিকের জন্য মিলিত হয়, আবার আলাদা হয়ে যায়। ঠিক তেমনি এই সংসার সমুদ্রে আমরা পরস্পর ক্ষনিকের জন্য মিলিত হই। আবার আলাদা হয়ে যাই। স্ত্রী, পুত্র, জ্ঞাতি-বান্ধব এরা সবাই ক্ষনিকের জন্য মিলিত হয়, আবার আলাদা হয়ে যায়। কিন্তু এই সমুদ্রেই তারা অবস্থান করে। তাই মায়া, মোহ, স্নেহ, এগুলো সবই বন্ধনের কারন। এসবে আমাদের অভিভূত হওয়া উচিত নয়। মিলন অবসম্ভাবী নয়, কিন্তু মিলন হলে বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী। এরা সবাই আমাদের চোখের অগোচর চিন্ময় সত্ত্বা থেকে উৎপন্ন হয়েছে, আবার সেই চিন্ময় সত্ত্বাতেই বিলীন হয়ে যায়। তোমার এই মৃত পুত্রের স্বরূপ তুমি জানো না। তাহলে তুমি কিসের জন্য শোক করছো ? বিষয় ভোগে অতৃপ্তি আমাদের দুঃখের কারন। আবার দুঃখের নাশেই সুখ। সুখ থেকেই দুঃখ আবার দুঃখ থেকে সুখ উৎপন্ন হয়ে থাকে।
এই জগতে সুখ-দুঃখ চক্রাকারে ঘুরছে। সুখের পরেই দুঃখ। আবার দুঃখের পরেই সুখ। কেউ চিরকাল সুখে, বা কেউ চিরকাল দুঃখে থাকে না। তুমি আগে সুখ ভোগ করেছো, তাই এখন দুঃখ ভোগ করতে হচ্ছে। কিছুদিন পরেই আবার সুখ ভোগ করতে পারবে।
সুখ-দুঃখ আমাদের শরীরকে আশ্রয় করে থাকে। অতয়েব আমরা, যারা নিজেদেরকে দেহ মনে করি, তারা দেহকে আশ্রয় করেই যেমন কর্ম করে থাকি, তেমনি ফলভোগও আমাদের করতে হয়। জীবন আমাদের শরীরের সাথে উৎপন্ন হয়, শরীরের সাথে বর্তমান থাকে, আবার শরীরের সাথেই বিনষ্ট হয়ে যায়। বিষয়-আসক্ত অকৃতার্থ মানুষ মায়া-মোহ-স্নেহপাশে আবদ্ধ হয়ে জলের মধ্যে বালির সেতুর মতো ভেঙে পড়ে । কলু যেমন তিলকে চাকায় পেষণ করে, ঠিক তেমনি অজ্ঞান-জাত ক্লেশ আমাদেরকে সংসারচক্রে পেষণ করছে। নির্বোধ মানুষ স্ত্রী-পুত্র-আত্মীয়দের ভরন পোষণ করবার জন্য কুকর্ম করে, এবং শেষে একমাত্র নিজেই সেই কুকর্মের জন্য ক্লেশ ভোগ করে থাকে। আবার এদের মৃত্যুতে নিজেই নিজেকে দগ্ধ করে।
এই সংসারে সুখ দুঃখ ঐশ্বর্য্য - অনৈশ্বর্য্য সবই দৈবায়ত্ত। আমরা সবাই দৈব প্রভাবে সুখ-দুঃখ ভোগ করে থাকি। কেউ আমাদের সুখের বা দুঃখের কারন নয়। শত্রু আমাদের দুঃখের কারন নয়, আবার মিত্র আমাদের সুখের কারন নয়। আমাদের জ্ঞান বা কর্ম আমাদের অর্থ এনে দিয়েছে, এবং সেই অর্থ থেকে আমরা সুখ ভোগ করছি, এমনটা নয়। আবার আমাদের বোকামি আমাদের অর্থ নাসের কারন, বা আমাদের দুঃখের কারন এমনটা নয়। একমাত্র দৈবই আমাদের সুখের বা দুঃখের কারন। দৈব অনুকুল না হলে, সুখভোগের চেষ্টা নিরর্থক। গরুর বাচ্চা, গোপালক, গোস্বামী, গো-চোর এর মধ্যে যে গরুর দুধ পান করে, সেই গরুর দুধের অধিকারী। অন্যের উপর মমতা প্রকাশ বিড়াম্বনা মাত্র।
এইজগতে সেই সুখী, যে সুষুপ্তি লাভ করতে পেরেছেন । এই জগতে সেই সুখী যে নির্বিকল্প সমাধি লাভ করতে পেরেছেন । যারা ভেদ-দর্শী, যারা সর্বত্র বৈষম্য দেখেন, তারা সুখী হতে পারেন না। সুষুপ্তি ও সমাধি দ্বারাই যথার্থ সুখ ভোগ হয়ে থাকে।
যারা উন্নত বুদ্ধি সম্পন্ন - যারা সুখে থেকেও সুখ দুঃখ-শুন্য, যারা দুঃখে থেকেও সুখ-দুঃখ শুন্য এবং মাৎসর্য্যবিহীন হয়েছেন, অর্থ বা অনর্থ তাদেরকে কখনোই বিচলিত করতে পারে না। যারা বহুশাস্ত্রে পণ্ডিত, অথচ তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতে পারেন নি, তাদের অবশ্য়ই নিরন্তর সুখ দুঃখ ভোগ করতে হবে। বিবেকহীন বোকারা শত্রূকে পরাস্ত করে আনন্দ পায়। আর ভোগ বিলাসে মত্ত থাকে। আলস্যে দিন যাপন করে, তাদের পরিণামে দুঃখই হয়। সময়মতো দক্ষতার সাথে কাজ করাই সুখ উৎপত্তির কারন। ঐশর্য্য ও বিদ্যা উৎসাহী-দক্ষ ব্যক্তিকে আশ্রয় করে থাকে। সুখ দুঃখ, প্রিয়-অপ্রিয় যাই উপস্থিত হোক না কেন, অবিচলিত চিত্তে তাকে অনুভব করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
শরীরের কোনো অঙ্গও যদি শোক, ত্রাস, আয়াসের কারন হয়, তবে তাকে পরিত্যাগ করা কর্তব্য। ত্যাগেই প্রকৃত সুখ হতে পারে। বিষয় অনুরাগী পুরুষ বিষয়ের অনুসন্ধান করতে করতেই জীবন শেষ করে দেয়। মানুষ তো পূর্ব্ব জন্মাকৃত কর্মফল ভোগ করবার জন্য জন্ম গ্রহণ করে। অর্থাৎ প্রারব্ধ ভোগ করার জন্য জন্মায়। কি পণ্ডিত, কি মূর্খ, কি বলবান, কি দুর্বল সবাইকে প্রারব্ধ ভোগ করতে হয়। তাই বর্তমানের সুখ দুঃখের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে, অকর্তা জ্ঞানে যথাযথ কর্তব্য করে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
কামনা আমাদের ক্রোধের হেতু। ক্রোধ আমাদের বুদ্ধিনাশের হেতু। বুদ্ধিনাশ আমাদের ধংসের হেতু। শোক আমাদের উৎসাহকে নষ্ট করে দেয়। অনুৎসাহ আমাদের আলস্য এনে দেয়। আলস্য আমাদের কর্মে অনীহা জন্মায়। কর্মে অনীহা আমাদের কর্তব্যকে অবহেলা করে। কর্তব্যে অবহেলা আমাদের বিনাশের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।
যখন আমরা ভয়, বিষয়-অনুরাগ, বিদ্বেষ বুদ্ধি কায়-মন-বাক্যে পরিত্যাগ করতে পারবো, তখন আমাদের চিত্ত প্রসন্ন হয়ে উঠবে, এবং আমরা যথার্থ সুখী হতে পারবো। পিঙ্গলা নামে এক প্রেমিকা একবার তার বাঞ্চিত প্রিয়তমের কাছ থেকে বঞ্চিত হয়ে বলছে : যে সর্ব্ব অন্তর্যামী নির্বিকার পুরুষ, আমরি হৃদয়ে বসবাস করছেন, আমি তাকে কামাদি দ্বারা সমাচ্ছন্ন করে রেখেছি । একদিনও তার স্মরনাপন্ন হইনি। আজ আমি আত্মজ্ঞান বলে অজ্ঞানরূপ খুঁটির উপর, এই নবদ্বার সম্পন্ন গৃহ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করবো। এতদিন যারপ্রতি আমি অনুরক্ত ছিলাম, এর পরে সে এলে তাকে আর আমার প্রিয়তম বা স্বামী বলে মনে করবো না। আজ আমার তত্ত্বজ্ঞান উদয় হয়েছে, আমাকে আর এই নররূপী ধূর্তরা বঞ্চনা করতে পারবে না। ভগবান তুমি অসীম দয়াময়, আমাকে এই বঞ্চনার মাধ্যমে তুমি আমাকে বিষয়বাসনা ত্যাগের জ্ঞান দিয়েছো। এই বিরহব্যথার মাধ্যমে তুমি আমাকে জিতেন্দ্রিয় হবার পথ দেখিয়েছো। আশা পরিত্যাগই পরমসুখের কারন। আশাহীন মানুষ সুখে নিদ্রা যায়।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি ওম।
শান্তির সন্ধানে (২) - কালের অমোঘ গতি :
একদিন যুধিষ্ঠির পিতামহ ভীষ্মকে জিজ্ঞেস করলেন, হে পিতামহ, কাল বড় ভয়াবহ। কাল অর্থাৎ সময় কখনো দাঁড়িয়ে থাকে না। প্রতিনিয়ত কাল অতীত হচ্ছে। এই অবস্থায় আমাদের কি করা
কর্তব্য ?
পিতামহ ভীষ্ম বললেন, একটা ইতিহাসের গল্প বলি। একসময় তথাকথিত ধর্ম-কর্মে নিপুন এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। তার এক মেধাবী নামে পুত্র ছিল। এই পুত্র ছিল মোক্ষধর্মে কুশল। পিতাকে মেধাবী মোক্ষ লাভে অক্ষম দেখে, একদিন জিজ্ঞেস করলেন, হে পিতা মানুষের জীবিতকাল অতি সত্বর প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে। জ্ঞানী ব্যক্তিরা একথা জেনে, কি ধরনের অনুষ্ঠান করে থাকেন, এ সম্পর্কে আমাকে বিস্তারিত বলুন। আমি সেই অনুযায়ী কাজ করবো।
পিতা বললেন : হে পুত্র মানুষের শৈশব উত্তীর্ন হলে, ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন করা উচিত। এই সময় গুরুগৃহে থেকে বেদ অধ্যয়ন করা উচিত। তার পরে পিতৃলোকের পরিত্রানের জন্য, সংসারে থেকে পুত্র উৎপাদন করা উচিত। প্রৌঢ় অবস্থায় যথাবিহিত নিয়মে যাগযজ্ঞ করা উচিত। একদম শেষে জঙ্গলে গিয়ে মুনিবেশে সাধন ভজন করা উচিত।
পুত্র বললেন : হে পিতা প্রতিনিয়ত লোক ব্যাধিগ্রস্থ হচ্ছে, জ্বরাগ্রস্থ হচ্ছে, নিহত হচ্ছে, মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। কাল প্রতিনিয়ত সবকিছু গ্রাস করছে,কালের গতি অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু আপনি এসব ব্যাপারে বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্ন নন। আপনি কি সুন্দর ভালো ভালো কথা বলছেন, আর নিশ্চিন্ত আছেন ।
পিতা : কে মানুষকে আক্রমন করছে ? কে নিহত করছে ? কে সেই অবিনাশী যে নিয়ত যাতায়াত করছে ?
পুত্র : আপনি কি বুঝতে পারছেন না, যে জ্বরা-ব্যাধি মানুষকে প্রতিনিয়ত আক্রমন করছে। মৃত্যু মানুষকে নিধন করছে। দিন চলে যাচ্ছে, রাত্রি আসছে, আবার রাত্রি চলে যাচ্ছে দিন আসছে। আপনি এদের গতাগতি কি একদম অনুধাবন করতে পারছেন না ? আমার নিশ্চিত ধারণা, মৃত্যু কখনো কাউকে তোয়াক্কা করে না, কাউকে পরিত্যাগ করে না। এই অবস্থায় আমরা কি অন্ধের মতো কালের অপেক্ষায় থাকবো ? প্রতিদিন মানুষের পরম-আয়ু ক্ষয় হচ্ছে। এই জগতে কারুরই সুখের প্রত্যাশা প্রত্যাশা নেই। অথচ আমরা কেমন অন্যমনস্ক হয়ে বিষয় ভোগে প্রবৃত্ত হয়ে আছি। কিন্তু এই বিষয়ভোগ পরিতৃপ্ত হতে না হতেই মৃত্যু দ্বারা আমরা আক্রান্ত হয়ে থাকি। আমাদের কাজ, আমাদের ভোগ শেষ হতে হতে পারে না, তার আগেই মৃত্যু আমাদের আক্রমন করে থাকে।
হে পিতা কোনো কর্তব্য কর্ম আমাদের ফেলে রাখা উচিত নয়। আজকের কাজ এখনই করা উচিত। কালকের কাজ আজকেই করা উচিত। আমাদের কাজ শেষ হোক না হোক, মৃত্যু কিন্তু তার জন্য অপেক্ষা করবে না। কার কখন মৃত্যু হবে, কেউ তা জানে না। তাই আমরা যেহেতু জানিনা, মৃত্যু কখন আমাদের ডেকে নেবে, তাই বৃদ্ধাবস্থা অবধি অপেক্ষা করে, তবে আমাদের ধর্মাচরণ করতে হবে, এটা ঠিক নয়। তাই যখন যে অবস্থাতে থাকুন, আর যে বয়সে থাকুন, সব সময় আমাদের ধর্মানুষ্ঠান করা উচিত। ধর্মানুষ্ঠান করলে কি ইহলোক কি পরলোক সর্বত্র শাশ্বত আনন্দে থাকতে পারবো।
মানুষ মোহে আবিষ্ট হয়ে স্ত্রী-পুত্র-কন্যার নিমিত্ত কাজ করে থাকে এমনকি কেউ কেউ এদের সন্তুষ্টির জন্য কুকার্যে লিপ্ত হয়। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা যাতে ভালো থাকে, সুখে থাকে, আনন্দে থাকে তার জন্য, তার জন্য সে ভালো-মন্দ সব কিছুই করবার জন্য প্রস্তুত থাকে। কিন্তু কাল কাউকে রেহাই দেয় না। মৃত্যু কোনোদিন কোনোকিছুর জন্য অপেক্ষা করে না। যে বিষয়ের প্রতি আমরা আসক্ত ছিলে, যে স্ত্রী-পুত্র-কন্যার প্রতি আমরা মোহগ্রস্থ, সবার কাছ থেকে মৃত্যু আমাদের ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাবে। কোন কাজ করা হয়েছে, কোন কাজ করা হয় নি, কোন কাজ অর্ধেক করা হয়েছে, সবই যথাপূর্ব্ব পড়ে থাকবে। তুমি শুধু অসমাপ্ত কাজের কথা চিন্তা করতে থাকবে, আর মৃত্যু সবাইকে টেনে নিয়ে চলে যাবে। কাল কোনো কিছুর জন্য অপেক্ষা করে না। কার কি কাজ সমাপ্ত হয়েছে, আর কোন কাজ বাকি রয়েছে, কোনো কিছুর জন্য সে অপেক্ষা করবে না। এমনকি রাজা কি ভিক্ষারী, দুর্বল কি বলবান, জ্ঞানী কি অজ্ঞানী কাউকেই তোয়াক্কা করে না মৃত্যু । যখন মানুষের এই অবস্থা, মানুষ যখন প্রতিনিয়ত জরা ব্যাধি মৃত্যুতে আক্রান্ত হচ্ছে, আপনি, হে পিতা কি ভাবে নিশ্চিন্তে অবস্থান করছেন ?
জনশ্রূতি যাতে আপনি বিশ্বাস করেন, অরণ্য হচ্ছে দেবভূমি। সংসারে বা নগরে অবস্থান বন্ধন-সম। পুণ্যাত্মারা এই বন্ধন ছিন্ন করতে পারে, কিন্তু পাপাত্মারা এই বন্ধন ছিন্ন করতে পারে না। কিন্তু এই কথা ঠিক নয়। আপনি কোথায় আছেন, সেটা বড়ো কথা নয়। আপনি কার আশ্রয়ে আছেন সেটাও বড়ো কথা নয়, আপনার প্রবৃত্তি কেমন সেটাই বড় কথা। আপনি যদি হিংসাকে বর্জন করতে পারেন, আপনি যদি কায়-মন-বাক্যে অন্যের অনিষ্ট চিন্তা না করেন, আপনার জীবিকা যেন অন্যের জীবিকাকে অপহরণে প্রবৃত্ত না হয়। সত্যব্রত পরায়ণ ও শমদমনাদি গুন্ সম্পন্ন হয়ে কেবল সত্য়বলে মৃত্যুকে পরাজয় করা অবশ্য কর্তব্য।
আমাদের এই ঈশ্বর প্রদত্ত দেহের মধ্যে মৃত্যু ও অমৃতত্ত্ব উভয়ই প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। মোহে যারা অন্ধ তারাই মৃত্য়ুলাভ করে। আর যারা সত্যপথ অবলম্বন করে, তারা অমৃত লাভ করে। অতএব আমরা হিংসা, কাম, ক্রোধ পরিত্যাগ করে একমাত্র সুখপ্রদ সত্যকে অবলম্বন করে মৃত্যুকে পরিহাস করবো। এবং সূর্য্যের উত্তরায়ণের সময়ে শান্তিমার্গ অবলম্বন, জ্ঞান অর্জন, বাক্য-মন-কার্য্যে সংযম আয়ত্ত্ব করবো। আমাদের কারুরই পশুবলি যজ্ঞ বা ক্ষত্রিয়দের মতো বিনাশকারী কার্য্যে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়। আমার সন্তান বলে কিছু হয় না। বা আমি কারুর সন্তান বলে কিছু হয় না। সন্তান সব সময় সয়ম্ভূ।আমাদের উচিত পুত্র-উৎপাদনের বাসনা পরিত্যাগ করে, আত্মনিষ্ঠ হয়ে জীবাত্মাকে পরম-আত্মায় আহুতি প্রদান করা। এটাই আসল যজ্ঞ মনুষ্য জীবন এই সৎ-কর্মের জন্য। সৎকর্ম প্রভাবে এই মানুষ এই মঙ্গলময় যজ্ঞ করতে পারে। বিদ্যার মতো চোখ, ফল-ত্যাগের মতো সুখ, এবং বিষয়স্পৃহার মতো দুঃখ আর কিছুই নেই।
ঈশ্বরের প্রতি আমাদের একাগ্র হতে হবে, সর্বভূতে আমাদের সমভাব রাখতে হবে, সত্যে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। স্বধর্মে প্রতিষ্ঠিত থাকে হবে। অন্যকে দন্ড দেবার ভাবনা পরিত্যাগ করতে হবে। সরলতা অভ্যাস করতে হবে। তবেই আমরা প্রকৃত মানুষ হতে পারবো। এসবই মানুষের পরম ধন।
হে পিতা আপনাকে নিশ্চয়ই কালের কবলে পড়তে হবে, তখন আপনার জন্য, এই ধন-মান-যশ দারা -পুত্র পরিবার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজন কোন কাজে লাগবে না । এখন আপনার এই দেহ মধ্যে প্রবিষ্ট আত্মাকে অনুধ্যান করুন। আপনার পিতা-পিতামহ-মাতা-মাতামহ কোথায় গিয়েছে তাকি আপনি জানেন ? কে বলেছে আপনাকে আপনার পুত্র উদ্ধার করবে ? স্বয়ং স্বয়ংকে উদ্ধার ভিন্ন কোনো রাস্তা নেই। তাই পরলোকে কেউ কারুর নয়, কেউ কারুর প্রতি নির্ভরশীল নয়। এই জগতে আমরা ভাবি, আমরা কারুর না কারুর প্রতি নির্ভরশীল, আমরা প্রতিও আমার পরিবার নির্ভরশীল। এইরকম আমাদের পূর্বপুরুষেরাও ভাবতেন। কিন্তু সত্য হচ্ছে, বাস্তব হচ্ছে আমরা কেউ কারুর প্রতি নির্ভরশীল নয়। আমার পূর্বপুরুষেরা সবাই দেহ ত্যাগ করেছেন। আমরাও দেহ ত্যাগ করে চলে যাবো। জগৎ জগতের মতো চলবে।
এই কথা বলে মহাত্মা ভীষ্ম বললেন - হে ধর্মরাজ জ্ঞানবান পুত্র এই কথা বললে পিতা তার কথায় আস্থা রেখে সত্যধর্মের অনুষ্ঠান করে কাটিয়েছিলো। তুমিও সত্যধর্ম পরায়ণ হয়ে পরম-সুখে কালাতিপাত করো।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।
No comments:
Post a Comment