Friday, 15 May 2020

শ্রীকৃষ্ণ উক্ত প্রাণায়াম

 
শ্রীকৃষ্ণ উক্ত প্রাণায়াম।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বারোটি যজ্ঞের কথা বলেছেন। যজ্ঞ বলতে আমরা সাধারণত বুঝে থাকি, অগ্নিতে আহুতি দেওয়া, বা অগ্নিতে নিক্ষেপ করা । তা সে ঘি হতে পারেন, বেলপাতা হতে পারে। বা অন্য কিছু নিদিষ্ট দ্রব্য হতে পারে। কিন্তু ভগবান যজ্ঞের আরো গভীরে প্রবেশ করেছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, এমনকি ঋষি  পতঞ্জলি বলছেন, প্রাণায়াম করাটাও একটা যজ্ঞ। কিভাবে সেই কথাই আমরা আজ শুনবো। এমনকি যোগীশ্রেষ্ঠ দুটো প্রাণায়ামের কথা বলেছেন।  আমরা সেই দুটো প্রাণায়ামের কথাও শুনবো। 

ছোটবেলা থেকে খাবার আগে আমাদের পিতৃদেব একটা মন্ত্র আওড়াতে বলতেন। এই মন্ত্রটি আপনারা সবাই শুনে থাকবেন। সেটি হচ্ছে :

ব্রহ্মার্পনং ব্রহ্ম  হবির্ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মনা হুতম।
ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্ম্মসমাধিনা। (গীতা শ্লোক  ৪/২৪)

অর্থাৎ যাকিছু যজ্ঞাগ্নিতে অর্পণ করা হচ্ছে, সবই ব্রহ্ম।  ঘৃত ইত্যাদি ব্রহ্ম, যিনি অর্পণ করছেন, তিনিও ব্রহ্ম, অগ্নিও ব্রহ্ম।  এমনকি এই যে আহুতি প্রদান ক্রিয়া এটাও ব্রহ্ম। যজ্ঞকারী ব্যক্তির ব্রহ্মেই কর্ম্মসমাধি হয়েছে।  আর এর ফলে যে কর্ম্মফল প্রাপ্তি সেটাও ব্রহ্ম। 
যজ্ঞে আহুতি হলো প্রধান ব্যাপার। সেই আহুতি-প্রদান কর্ম্ম তখনই সার্থক বা পূর্ন  হয়, যখন সেই পদার্থটি অগ্নির রূপ ধারণ করে থাকে। আহুতি দ্রব্যের তখন আর পৃথক সত্ত্বা থাকে না। ঠিক তেমনি যত রকম সাধনক্রিয়া আছে, সেসব তখনই সার্থক হয়, যখন সেই সাধন ক্রিয়া যজ্ঞে পরিণত হয়। যজ্ঞের উদ্দেশ্য হচ্ছে, আত্মতত্ত্ব অনুভব করা। আমরা যখন যজ্ঞ করি, তখন আহুতি দেই দ্রব্যরূপ আমাদের ভাবনাকে।

জগতের স্বরূপ হলো, কার্য্য ও পদার্থ। এই যে প্রকৃতি, যা আমাদের সম্মুখে উদ্ভাসিত, তা আসলে কর্ম্মের রূপ মাত্র। পদার্থ কখনো স্থির ভাবে থাকে না। পদার্থ প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে রূপান্তর হয়েই চলেছে। তাই সমস্ত পদার্থকে বলা যেতে পারে, পরিবর্তনশীল ক্রিয়াপূঞ্জ। আমাদের আসক্তির জন্য, আমরা পদার্থগুলোকে গুরুত্ত্ব দিয়ে থাকি। কিন্তু আমরা জানি সমস্ত ক্রিয়াই লয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে। অতয়েব জগৎ হলো, লয়রূপ ক্রিয়ার তাৎক্ষণিক ফল মাত্র। জগতের আমরা তিনটি অবস্থা সাধারণত দেখতে পাই, আর তা হলো, উৎপত্তি-স্থিতি-লয়। আর এই স্থিতিকাল এতটাই সামান্য যে এর উৎপত্তির আগের সময় ও লয়ের পরের সময়ের সঙ্গে বিচার করলে, এর কোনো স্থিতিকালকেই আমরা ধরতে পারি না। স্রোতের জলের স্থিতিকালের থেকেও কোটিভাগের এক ভাগ হবে কিনা সন্দেহ। জীবের দেহ প্রতিমুহূর্তেই নাশ হচ্ছে। এবং এই  পরিবর্তন এতটাই দ্রুত তালে সংগঠিত হচ্ছে, আমরা এটাকে ধরতে পারি না। 

ভগবান বলছেন, যজ্ঞাগ্নিতে যা কিছু সমর্পিত হচ্ছে, এবং যিনি সমর্পন করছেন, সবই ব্রহ্ম। এর পরে ৪/২৬নং শ্লোকে বলছেন, 
শ্রোত্রাদীনি-ইন্দ্রিয়াণি-অন্যে  সংয়ম-অগ্নিষু জুহ্বতি। 
শব্দাদীন বিষয়ান-অন্যে  ইন্দ্রিয়-অগ্নিসু জুহ্বতি। 
অর্থাৎ শ্রোত্র বা কর্ন ইত্যাদি ইন্দ্রিয়াগুলোকে সংযমরূপ অগ্নিতে আহুতি দিতে হবে। অন্যদিকে ইন্দ্রিয় যা গ্রহণ করছে, অর্থাৎ শব্দাদি বিষয়গুলোকে ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে আহুতি দিতে হবে।  একটু ভালোভাবে বিষয়টি বুঝবার চেষ্টা করি -আমাদের পাঁচটি জ্ঞান ইন্দ্রিয় - চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহ্ববা, ত্বক। আর এদের বিষয় হচ্ছে, রূপ, শব্দ, গন্ধ,রস, স্পর্শ।  ভগবান বলছেন, আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো যেন, এই বিষয়ের দিকে ধাবিত না হয়। সম্পূর্ণ সংযম তখনই  সম্ভব হবে, যখন এই পাঁচ ইন্দ্রিয় ও মন-বুদ্ধি-অহংকার এই সবগুলো থেকে অনুরাগ ও আসক্তি চিরতরে নাশ হয়ে যায়। অর্থাৎ শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ এইযে  বিষয়, এগুলো ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে কাজ করলেও, ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে যেন কোনো বিকার উপস্থিত না হয়। এই যজ্ঞ সম্পাদিত হলে,  অর্থাৎ আমাদের অনুরাগ ও আসক্তি সর্বোতভাবে নাশ হলে আমাদের পরমাত্মার প্রাপ্তি হবে। সংযম হলে আসক্তির লয় হয়, আবার আসক্তির লয় হলে সংযম হয়। 

এর পরে শ্লোকে বলছেন,
 সর্ব-ইন্দ্রিয়-কর্মাণি প্রাণ-কর্মাণি  চাপরে।
 আত্ম সংযম যোগাগ্নৌ জুহ্বতি জ্ঞানদীপিতে।  ৪/২৭ -
 অর্থাৎ যোগীগণ সমস্ত ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়াগুলো এবং প্রাণের ক্রিয়াগুলো জ্ঞানদ্বারা প্রকাশিত আত্মসংযম যোগরূপ অগ্নিতে হোম করে থাকেন। এর আগে আমরা সংযমের কথা শুনেছি, এবার বলছেন সমাধির কথা। এর আগে আমরা ইন্দ্রিয়ের আহুতির শুনেছি, এবার বলছেন প্রাণের আহুতির কথা। সমাধিকালে প্রাণকে অগ্নিতে আহুতি দিতে হবে। প্রথমে প্রাণকে রুদ্ধ করতে হবে। হঠযোগ যেমন বলছে, প্রাণকে কুম্ভকের সাহায্যে রুদ্ধ করা যায়, আবার  মনকে একাগ্র করলেও প্রাণের গতি স্বাভাবিক ভাবেই রুদ্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থাকে সমাধি বলা হয়ে থাকে। এখন কথা হচ্ছে, প্রাণের গতি যদি রুদ্ধ হয়ে যায়, তবে তো আমাদের মৃত্যু হয়ে যাবে।  না মৃত্যু হবে না। বর্ষা চলে গেলে পুকুরগুলো ধীরে ধীরে শুকোতে থাকে। পুকুরের মধ্যে যে সব প্রাণী ছিল, অর্থাৎ মাছ, ব্যাঙ, সাপ ইত্যাদি কোথায় গেলো ? বলবেন, মারা গেলো।  না সবাই মারা যায় না। আপনি খেয়াল করলে দেখতে পারবেন, আবার যখন বর্ষাকালে পুকুর জলে ভরাট হয়ে যায়, তখন রাতারাতি ব্যাঙের ডাকাডাকি শুরু হয়ে যায়। ছোট-ছোট মাছের খেলা, এমনকি  জলপোকার আবির্ভাব ঘটে। এগুলো কিভাবে হয় ? বর্ষার জল স্থির হলে, জলের মধ্যে যে পলিমাটি ছিল, সেগুলো থিতু হয়। আর পলির মধ্যেই এই সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীব এমনকি ব্যাঙ প্রায় প্রাণহীন অবস্থায় মাটির নিচে চাপা পরে থাকে। আবার বর্ষায় যখন মাটি নরম হয়, তখন এগুলো উপরে উঠে আসে, এবং আবার স্বশনক্রিয়া শুরু করে থাকে। সমাধিতেও মানুষ কয়েক ঘন্টা থেকে শুরু  করে, কয়েকদিন পর্যন্ত প্রাণক্রিয়া রুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে পারেন। তখন তার  না জীবিত  না মৃত অবস্থা, যাকে   জীবন্মৃত অবস্থা বলা হয়ে থাকে ।

ভগবান এর পরে বলছেন,   
অপানে জুহ্বতি প্রাণং প্রাণে-অপানং তথা পরে, 
প্রাণ-অপান গতিঃ রুদ্ধা প্রাণায়াম-পরায়ণাঃ।(৪/২৯)
 অর্থাৎ যোগীগণ প্রাণায়াম পরায়ণ  হয়ে, অপানে প্রাণকে পূরক করে, প্রাণ ও অপান -এর গতি রুদ্ধ করে, পরে প্রাণে অপানের আহুতি দেন।
 ৪/৩০ নং শ্লোকে বলছেন অপরে নিয়তহারাঃ প্রাণান প্রাণেষু জুহ্বতি , সর্বেঽঅপ্যেতে যজ্ঞবিদো যজ্ঞক্ষপিতকল্মসা।  

দ্রব্যযজ্ঞে দ্রব্য আহুতি দেওয়া হয়, তপযজ্ঞে তপস্যা করা হয়ে থাকে, জ্ঞানযজ্ঞে ঈশ্বরজ্ঞানের স্বাধ্যায় করা হয়ে থাকে, আবার প্রাণযজ্ঞে প্রাণকে জঠরাগ্নিতে আহুতি দেওয়া হয়ে থাকে। আমরা জানি, প্রাণবায়ুর অবস্থান বা ক্রিয়াক্ষেত্র হচ্ছে হৃদয়দেশ। অপান বায়ুর কার্যক্ষেত্র হচ্ছে নাভির নিচের স্থান। আর সমান বায়ুর কার্যক্ষেত্র হচ্ছে এই দুইয়ের মাঝখানে।
যোগী প্রথমে চন্দ্রনাড়ীর মাধ্যমে বায়ুকে গ্রহণ করে থাকে। একে বলে পূরক।এই সময় বায়ু হৃদয়ে অবস্থিত প্রাণবায়ুকে সঙ্গে করে, নাভি থেকে স্বাভাবিক ভাবেই অপানে লিন হয়ে যায়। এরপর প্রাণবায়ু ও অপান বায়ু রুদ্ধ করা হয়। একেই বলে কুম্ভক।  কুম্ভকের পরে আবার সূর্য্য নাড়ী দিয়ে রেচক করে থাকে। এর পর, সূর্যনাড়ী দিয়ে পূরক তারপরে কুম্ভক, অর্থাৎ বায়ুকে বদ্ধ করে রাখা, এবং শেষে চন্দ্রনাড়ী দিয়ে রেচক করা। রেচকের পরেও কুম্ভক করা হয়ে থাকে। এতে করে আমাদের ভিতরে যে অগ্নিশক্তি আছে, তা  জাগ্রত হয়ে থাকে।আর এই অগ্নিশিখায় প্রাণবায়ু-অপান বায়ু উদ্দীপ্ত হয়ে শুদ্ধ সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর  হয়ে ওঠে, অর্থাৎ তখন বায়ুর মধ্যে যে চেতন শক্তি আছে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবং তখন সে ব্রহ্মরন্ধ্রের খোঁজ করে, অর্থাৎ উর্দ্ধগামী হবার জন্য রাস্তা খোঁজে। এবং নির্মল  সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে যে বজ্রাক্ষা ও তার ভিতরে যে চিত্রাণি নাড়ী  আছে, বায়ুর সূক্ষ্মতা অনুযায়ী সেই  রন্ধ্র পথে উর্দ্ধমুখী হয়ে যায়। এই উপলব্ধি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তা হলে কি ভাবে প্রকাশ করা যাবে। আসলে যে কোনোদিন লংকা  খায়নি, তাকে বোঝানো কঠিন লংকা খেতে কেমন লাগে। আমরা সেইদিনই লংকার প্রকৃত স্বাদ বুঝতে পারবো, যেদিন আমার জিভে কেউ লংকা ঘষে দেবে।  
 
ভগবান বলছেন, যিনি পরিমিত আহার করেন, তারাই প্রাণকে প্রাণে আহুতি দিতে পারেন। শরীর ও মনকে যারা পবিত্র করতে পেরেছেন, কামনা-বাসনার উর্দ্ধে যারা উঠতে পেরেছেন, তারাই এই যজ্ঞ করবার যোগ্য।  প্রাণকে প্রাণে আহুতি দেবার অর্থ প্রাণকে প্রাণে ও অপানকে অপানে আহুতি দেওয়া। এবং প্রাণ ও অপানকে নিজ নিজ স্থানে রুদ্ধ করে রাখা। এই প্রাণায়ামের অভ্যাসে আমাদের বৃত্তিগুলো শান্ত হয়ে যায়। আর আমাদের পরম-আত্মার প্রাপ্তি হয়। 

সব শেষে বলি, প্রত্যেক যজ্ঞে যেমন যজমান ও পুরোহিতের প্রয়োজন, তেমনি প্রাণায়ামরুপ যজ্ঞেও সাধক ও গুরুদেব প্রয়োজন। গুরুভিন্ন এই যজ্ঞ নিষ্ফল। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।  
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                        
 
            

Monday, 11 May 2020

শান্তির সন্ধান





শান্তির সন্ধান

আমরা হাজার হাজার বই পড়ি, কিন্তু নিজেকে পড়ি না। আমরা হাজার লোকের কথা শুনি কিন্তু নিজের কথা শুনি না। আমরা হাজার হাজার দৃশ্য দেখি কিন্তু নিজেকে দেখি না। আমরা সব ছেড়ে ঈশ্বরের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ি, কিন্তু নিজের সন্ধান করি না। আমরা শান্তির সন্ধান করি, সুখের সন্ধান করি, নিজের সন্ধান করি না।  কিন্তু কথা হচ্ছে, নিজের সন্ধান আবার করা যায় নাকি ? যে সন্ধান করে, তার আবার সন্ধান করা যায় নাকি ? আজ আমরা সেই মহাত্মার কথা শুনবো, যিনি নিজেকে সন্ধানের কথা বলেছেন।
এক কিশোর তার মা-বাবার হাত ধরে, মেলায় গিয়েছিলো।  তো মেলায় ভিড়ের মধ্যে মা-বাবার কাছ থেকে সে হারিয়ে গেলো। তো যখন তাকে খুঁজে পাওয়া গেলো, তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, তুই হারালি কি করে ? তো ছেলেটি বললো, বা-রে, আমি হারালাম কোথায় ? তোমরাই তো হারিয়ে গেলে। আসলে আমাদের কাছ থেকে শান্তি হারিয়ে গেছে, না আমরা শান্তির কাছ থেকে দূরে সরে গেছি ? একথাটা বোঝার চেষ্টা করবো আমরা আজকে। 

এক ভদ্রলোক, একদিন এক  মঠাধিসের কাছে গিয়ে নিবেদন করলো, আমি অতিরিক্ত টাকা-পয়সা  চাই না, আমি সন্মান চাই না, আমি যশ  চাই না, ক্ষমতা চাই না। আমি শান্তিতে বাঁচতে চাই। আমাকে দয়াকরে পথ দেখান।

মঠাধিস বললেন  : আমি কিছুই চান না, আবার শান্তিতে  থাকে চান। কে বলেছে আপনাকে যে  টাকা-পয়সা-নাম-যশ-ক্ষমতা-গাড়ি-বাড়ি-ছেলে-মেয়ে-বৌ-বন্ধু -বান্ধব-আত্মীয়-স্বজন এগুলো শান্তির অন্তরায় ? কে বলেছে যে এগুলো শান্তি  পেতে বাধা দেয় ? এগুলো নিয়েই তো অনেক মানুষ ভালো আছেন । তো আপনার সমস্যাটা  কোথায় ? দেখুন মানুষ কেন এগুলো চায় ? আনন্দের জন্য চায়। তো আপনি এগুলো চাইছেন না, তাও ওই আনন্দের জন্যই। আসল সমস্যা লুকিয়ে আছে, আপনার নিজের মধ্যে, আপনার অহংয়ের মধ্যে। আসলে আপনি একটা মানসিক দ্বন্দ্বের মধ্যে আছেন, আপনি দৈন্যতার মধ্যে শান্তি খুঁজছেন, আবার কেউ প্রাচুর্য্যের মধ্যে শান্তি খুঁজছে।  পার্থক্যটা এখানে।  দুটোই মেন্টাল কমপ্লেক্স, একটা সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স, একটা ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স। দীনতার মাধ্যমে আপনি অহংয়ের পরিতৃপ্তি চাইছেন। আর অন্যরা হয়তো প্রাচুর্য্যের মধ্যে পরিতৃপ্তি চাইছে। 

ভদ্রলোক : না আমি অহং-কে জয় করতে চাইছি।

মঠাধিস : অহং-কে ক জয় করবেন আপনি ? আবার আপনি শান্তি খুঁজছেন। শান্তি খুঁজছে কে ? শান্তি খুঁজছে আপনার  অহং। আগে অহংকে ধরুন। তারপর-তো অহংকে জয় করবেন।   দেখুন অহং হচ্ছে, আমাদের "আমি"-বোধ। এই আমিকে ধরবার চেষ্টা করুন। এই আমি কে ? আমি অমুক,   আমি অমুকের ছেলে, আমি অমুকের পিতা, আমি অমুক জায়গার বাসিন্দা, আমি  IPS Officer. ইত্যাদি ইত্যাদি।  এগুলো আপনার পরিচয়। কিন্তু আপনি কি কখনো ভেবেছেন, আপনার নাম অম্বরীষ না হয়ে বীরেশ্বর হতে পারতো। অম্বরীষ বা IPS Officer জন্ম নেয় নি। আপনার বাবা আপনার নাম অম্বরীষ রেখেছে, তাই আপনি অম্বরীষ। আপনি ভালো পড়াশুনা করে, পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছেন, তাই আপনি IPS Officer . এগুলো আপনার পরিচয় মাত্র, এগুলো আপনি নন। IPS Officr একদিন আপনি থাকবেন না।  কিন্তু তখনো আপনি থাকবেন। আপনি বাড়ি পাল্টালে, আপনার ঠিকানা পাল্টে যাবে, কিন্তু আপনি থাকবেন। আপনি সুখে থাকলেও আপনি থাকবেন। আপনি দুঃখে থাকলেও আপনি থাকবেন। অর্থাৎ আপনি সুখী বা দুঃখী নন। আপনার একটা আসল সত্ত্বা আছে।  যা এই সবকিছুর উর্দ্ধে। এবং এই সত্ত্বার সহজে কোনো পরিবর্তন হয় না। আসলে এই সত্ত্বাকে কেন্দ্র করেই আমাদের চিন্তা-ভাবনা ঘুরপাক খায়।আর এই চিন্তাই  আপনি সুখী বা দুঃখী করে থাকে।  আসলে আপনার শিক্ষা, আপনার সমাজ, আপনার রুচি, আপনার সংস্কার, আপনার সৎগুন ইত্যাদি নিয়ে আপনার মধ্যে একটা ব্যক্তিত্ত্ব গড়ে উঠেছে। এই ব্যাক্তিত্ত্বকেই আপনি "আমি" বলে ভাবছেন। কিন্তু আসলে এই ব্যক্তিত্ত্ব যাকে  ঘিরে অবস্থান করছে, সেটিই আসল "আমি"। আমার ব্যাক্তিত্ত্বের পরিবর্তন আছে। আপনার কোনো পরিবর্তন নেই।  আপনি যখন কলেজে পড়তেন, তখন আপনার একরকম ব্যক্তিত্ত্ব ছিল।  আপনি যখন IPS Officer হলেন, তখন আপনার ব্যাক্তিত্ত্বের পরিবর্তন হলো। আপনি স্ত্রীর কাছে, স্বামী হিসেবে, ছেলের কাছে পিতা হিসেবে,  অফিসে বস হিসেবে, বন্ধুদের সঙ্গে বন্ধু হিসেবে আপনি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের আচরণ করছেন। আসলে আপনি "আমি"র উপরে  মনের কোনো চিন্তা বা বৃত্তি আরোপ করছেন, আর সেটাকেই আপনি "আমি" ভাবছেন।

আসলে আমাদের সুখ-দুঃখ-ভালো-মন্দ এগুলো আমাদের মানসিক বৃত্তি। আমাদের বহুদিনের অভ্যাসের ফলে আমরা ভাবতে শিখেছি, এই বৃত্তিগুলোই "আমি" । এই বৃত্তিগুলোকে বাদ  দিয়ে আসল "আমি"কে ধরবার চেষ্টা করুন। গভীর ধ্যানে অহং তার নিজস্ব অস্তিত্ত্বটুকু নিয়েই আমাদের কাছে ধরা দেয়।  সে যাই হোক, অহং আর বৃত্তি আলাদা কিন্তু অহংকে বাদ  দিয়ে শুধু বৃত্তি বলে কিছু থাকতে পারে না।  আবার এই বৃত্তি পরিবর্তনশীল। চঞ্চল মনের মানুষের ক্ষেত্রে এই বৃত্তি দ্রুত পরিবর্তিত হয়। আর স্থির মনের মানুষের বৃত্তির সহজে পরিবর্তন হয় না।

আমরা কথা বলছিলাম শান্তি নিয়ে। সাধারনতঃ সংসারী ব্যক্তি  প্রাচুর্য্যের মধ্যে শান্তি পায়। আবার সান্যাসীগণ ত্যাগের মধ্যে বা দীনতার মধ্যে শান্তি খোঁজেন । উদ্দেশ্য একই - আর তা হচ্ছে শান্তি। আবার আমরা দেখেছি, ভবিষ্যতের সুখের জন্য, আমরা বর্তমানকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখছি। শান্তির আশায়  আমরা কঠোর তপস্যা  করছি। তা সে পার্থিব বস্তু পাবার জন্যই হোক, বা অপার্থিব বস্তু পাবার জন্যই হোক। আমরা বর্তমানকে বিসর্জন দিচ্ছি কাল্পনিক ভবিষ্যতের সুখের আশায়। কাল্পনিক ভবিষ্যতের উপরে যে  আরোপিত সুখের কল্পনা সে-তো  অলীক। আবার  সেই স্বপ্ন পূরণ না হলে আমরা দুঃখী হচ্ছি। আরো একটা কারণে আমরা দুঃখী হই, সেটা হচ্ছে একঘেয়েমি। সারাক্ষন আমরা ঘরের মধ্যে থাকতে চাই না। সারাক্ষন আমরা গাছের ছায়ায় থাকতে চাই না। সারাক্ষন আমরা রসগোল্লা খেতে চাই না, তাই  এই একঘেয়েমি ভাব এলে আমাদের মন তখন নতুন বৃত্তি ওঠাতে চায়। এটাকেই আমরা বলি মনের চঞ্চলতা বা মনের অস্থিরমতি ভাব। আর এই কারণেই  আমরা একটার পর একটা আশার  জাল বুনে চলেছি। আমরা আমাদের জীবন গড়ে তুলছি, একটা কাল্পনিক দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে। তাই আমরা  সুখ, হয় কোনো স্থূল বস্তুর মধ্যে খুঁজছি অথবা সূক্ষ্ম অন্তরের মধ্যে খুঁজছি ।  এতে করে আমরা  কখনোই সত্যের সন্ধান পাবো না। কারন আমর মন   সত্যকে একটা  পরিচিত মোড়কে দেখতে চায়, যা তার কল্পনার মধ্যে এসেছিলো। কিন্তু সত্য তো কখনো দ্বন্দ্বের  মধ্যে নেই। সত্য এক ও অপরিবর্তনীয়।

যতক্ষন আমরা সুখের জন্য লালাইত  হবো, ততক্ষন আমরা সুখের সন্ধান পাবো না। যতক্ষন আমরা সুখের জন্য কিছু করবো, ততক্ষন আমাদের  সুখ  হতে পারে না।  কারন সুখ আমাদের কল্পনায়, সুখ আমাদের ভাবনায়। মন যখন বুঝতে পারবে, সুখের সন্ধান নিরর্থক, সুখের সন্ধান কেবল নতুন নতুন বন্ধনের সন্ধান দেয়, তখন মন শান্ত হয়ে যাবে। মানুষ  যখন কিছু আশা করে না, আবার যখন কিছু এড়িয়েও যায় না, তখন মানুষ শান্ত হয়ে যায়।  তখন মানুষ  নিরুদ্বিগ্ন  হয়ে যায়।

শান্তি মানে আমাদের মনের একটা অবস্থা। যেখানে মনে কোনো চিন্তা  থাকবে না। কিন্তু চিন্তাহীন মানুষ মানে তো জড় বস্তু। অথবা বলা যেতে পারে, মৃত অবস্থা। আসলে  শান্তিকে খুঁজলে হবে না। শান্তিকে বুঝতে হবে। আপনি যখনই সুখকে কাছে ডাকবেন , তখন সে দুঃখকে সঙ্গে নিয়ে আসবে। আপনি যখন শান্তিকে খুজবেন, তখন সে অশান্তিকে সঙ্গে নিয়ে আসবে। আপনি শান্তিকে না খুঁজে আপনি শান্তিকে বুঝবার চেষ্টা করুন। আসল শান্তি বাইরে নয়, যে তাকে খুঁজতে হবে।  শান্তি আমার  অন্তরে, আমরা সেটা বুঝি না। তাই  আমাদের  শান্তিকে বুঝতে হবে। কোনো বস্তুর মধ্যে, বা কোনো মানুষের মধ্যে আমরা  যে শান্তিকে খুঁজছেন, সেটি ক্ষণস্থায়ী। শুধু ক্ষণস্থায়ী নয় এটি অশান্তির লবনে মিশ্রিত। একে আপনি আলাদা করতে পারবেন না।  আমাদের অশান্তির কারন হচ্ছে, আমাদের অতৃপ্তি। অশান্তির কারন হচ্ছে বাহ্য বস্তু বা বাইরের মানুষের মধ্যে শান্তিকে খোঁজা। 

তৃষ্ণা পেলে আমাদের জল পান করতে হবে। ক্ষুধা পেলে আমাদের খেতে হবে। তৃষ্ণা মিটে  গেলে আমরা স্বস্তি বোধ করি। খিদের সময় খাবার পেলে আমরা সুস্থ বোধ করি। এই তৃষ্ণা বা ক্ষিদে যেমন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বার বার ফিরে ফিরে আসে। আর প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে  তাকে মেটাতেও হয়। যদি না মেটাতে পারি তবে আমাদের কষ্ট  হয়। এই কষ্ট আর অশান্তি কিন্তু এক নয়। এখন কথা হচ্ছে আমার তৃষ্ণা পেলে যদি শরবত খেতে হয়, খিদে পেলে যদি পোলাই-কোর্মা ক্ষেতে হয়, তবে শুরু হয়   অশান্তি । অর্থাৎ আমার প্রয়োজন ও চাহিদার মধ্যে ফারাক হচ্ছে।   গোলযোগটা এইখানেই।   আমরা কি করি, আমাদের মনের অতৃপ্তি দূর করতে চাই, অন্য একটা বৃত্তি উঠিয়ে। প্রথমে ভেবেছিলাম, ভালো রেজাল্ট। তারপর ভেবেছি, ভালো চাকরি, তার পর ভেবেছি, ভালো সংসার। ভালো বাড়ি, গাড়ি।  মনের খেলা লক্ষ করুন। আজ আপনি আমার কথা শুনে বুঝতে চাইছেন, কাল অমুক বই পড়ে জানতে চাইছেন।  এই বিভিন্ন মতামত নিচ্ছেন, এর মধ্যে আপনার যেটি পছন্দ হচ্ছে, সেটিকে আপনি বেছে নিতে চাইছেন। কিন্তু সত্য কখনো বাছাবাছির বিষয় নয়। অর্থাৎ আপনি সত্যকে নিজের মতো করে দেখতে চাইছেন। মানুষ নিজের কাছে যেটা পছন্দ হয়, সেটাই সে গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু সত্য যে আপনার মনের মতো হবেই, তার কোনো মানে নেই। এখন কথা হচ্ছে, আমরা তো পাঁচজনের কথা শুনে, বা পাঁচটা বই পড়ে , বিচার করে তবেই সঠিকটাকে  ধরতে পারবো।  তাই নয় কি ?  দেখুন বিচার করা তখনই সম্ভব যখন আপনার নিজের মধ্যে যে ভালো-মন্দ ধারণা আছে, সেটাকে সরিয়ে রেখে বিষয়টিকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখতে পারবেন । সুতরাং দরকার যেটা সেটা হচ্ছে, বোঝা, পছন্দ বা অপছন্দ নয়। আপনি হয়তো শান্তি খুঁজছেন, কোনো কাজের মধ্যে। বা আপনি হয়তো শান্তি খুঁজছেন কোনো জ্ঞানের মধ্যে। অথবা আপনি হয়তো শান্তি খুঁজছেন কোনো বিষয়ের মধ্যে, বা মানুষের মধ্যে । অর্থাৎ একটা ধারাবাহিক শান্তির আশা নিয়ে আমরা  বিভিন্ন  উপায়ের সন্ধান করছি ।  আর আমরা সত্য বলতে কি, ধারাবাহিক ভাবে অশান্তির মধ্যে ডুবে যাচ্ছি। একটা আশা যখন মানুষকে   সম্পূর্ণ তৃপ্তি দিলো, তখন মানুষ আবার অন্য আশা নিয়ে ঘুরতে থাকে। আসলে সমস্ত আশা তো মনের কল্পনা। আর আশা না মিটলেই হতাশা। হতাশা থেকে আবার নতুন আশা। 
  
কিন্তু কথা হচ্ছে, তাই বলে  কি আমরা কোনো আশা করবো না।  আশা না থাকলে  মানুষ বাঁচবে কি করে ? দেখুন কর্ম্মই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে।  আশা নয়। লক্ষ নিয়ে কর্ম্ম করা আর আশা নিয়ে কর্ম্ম করা এক নয়। লক্ষ পূরণের জন্য আমাদের পরিস্থিতির দাস হতে হয় না। আমরা তখন পরিস্থিতিকে  অনুকূল করে নেই।  কিন্তু আশা নিয়ে কর্ম্ম করতে গেলে আমরা পরিস্থিতির দাস  বোনে যাই। দেখুন আমরা কি চাই ? দুটো জিনিস আমরা চাই এক) আমাদের দৈহিক অস্তিত্ত্ব ; দুই) আমাদের মানসিক তৃপ্তি। দৈহিক অস্তিত্ত্ব বজায় রাখবার জন্য, আমরা দেহের যা প্রয়োজন তা অর্জন করবার চেষ্টা করি। অর্থাৎ অন্ন ঔষধ ইত্যাদি। আর এই অন্ন -ঔষধ পাবার জন্যই আমরা পড়াশুনার প্রস্তুতি নেই, পরীক্ষা দেই , চাকরি করি, বিয়ে করি, সন্তান উৎপাদন করি ইত্যাদি ইত্যাদি। আর মানসিক তৃপ্তি খুঁজি আমরা সমাজের মধ্যে। আমি প্রতিষ্ঠা চাই, আমি ক্ষমতা চাই। আর সেই কারণেই আমি IPS/IAS/ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, মন্ত্রী হতে চাই। অর্থাৎ সামাজিক স্বীকৃতির নিরিখেই আমি তৃপ্তি খুঁজছি। আর এখান থেকেই শুরু হয় আমাদের মধ্যে স্ব-বিরোধিতা। এখন কথা হচ্ছে সমাজের উপরে যদি আমার তৃপ্তি নির্ভর করে, তবে আমাদের সমাজের রীতি-নীতি মেনে নিতে হবে। অর্থাৎ এক কথায় সমাজের সঙ্গে আমাদের  আপোষ করতে হবে। সমাজ কেন একজন ঝাড়ুদারকে সমাজের উচ্চস্থান দেবে না, সে প্রশ্ন করা চলবে না। সমাজ যাকে স্বীকৃতি দেয়, আমাকে তাই হতে হবে। আমি যা চাই, অর্থাৎ আমার যা ভালো লাগে সেটা হলে. সমাজ আমাকে স্বীকৃতি দেবে না। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, আমি আমাতেই পূর্ন  হতে চাই। আমার স্বকীয়তাতেই স্বাধীনতা, আমার স্বকীয়তাতেই আমার পূর্নতা, আমার শান্তি। তাই আমাদের  স্বকীয়তা যখন সমুজ্বল হয়ে ওঠে তখন আমরা আসলে শান্তি পেতে পারি। আমাদের মানসিক পূর্নতার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে   আমাদের মানসিক শান্তি। অন্যের স্বীকৃতির জন্য, সামাজিক স্বীকৃতির জন্য, আমি নেতা হতে চাইছি, সরকারি পদাধিকারী হতে চাইছি। অন্যের হাততালিকে আমি গুরুত্ত্ব দিচ্ছি।  আমার স্বীয় প্রজ্ঞা এখানে গুরুত্ত্বহীন হয়ে গেছে। 

কিন্তু কথা হচ্ছে,  উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা না হয় বাদ  দিলাম। শান্তির আশা তো করতেই পারি। দেখুন আশা করলেই হতাশা থাকবে। সুখ চাইলে তার সঙ্গে দুঃখ আসবেই। সেইজন্য আমাদের দরকার হচ্ছে, শান্তিকে বোঝা, শান্তিকে খোঁজা  নয়। কামনাই আমাদের সব অশান্তির কারন। আমাদের কামনা যেদিন থাকবে না, সেদিন আমার অশান্তিও থাকবে না।  কিন্তু মানুষের পক্ষে কি কামনা দূর করা সম্ভব ? দেখুন জোর করে কামনাকে তাড়ানো যাবে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনার ধারণার যত  পরিবর্তন হবে, তত আপনি কামনা রহিত  হতে পারবেন। ধরুন, আপনি ছোটবেলায় খেলনা গাড়ি, বা খেলনা বন্দুক, বা পুতুল খুব ভালোবাসতেন।  বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আপনার মধ্যে ধারণার পরিবর্তন হয়েছে, এখন আপনি আর সেই খেলনা গাড়ি বা বন্দুকের প্রত্যাশা করেন না।  এগুলো আপনার কাছে এখন ছেলেমানুষি মনে হয়।  এর জন্য কিন্তু আপনাকে আলাদাকরে কিছুই করতে হয় নি। এমনি এমনি চলে গেছে ? না আপনার মধ্যে একটা নতুন ধারণার জন্ম নিয়েছে। আর পুরুনো ধারণা বদলে গেছে।  অর্থাৎ এখন আপনি, বাড়ি-গাড়ি-টাকা- পয়সা এসবের প্রত্যাশী হয়েছেন। কিন্তু আপনার যখন আরো বয়স হবে, তখন দেখবেন,  আপনার আজকের গুরুত্ত্বপূর্ন জিনিসগুলোর প্রতি আকর্ষণ কমে গেছে, বা একেবারেই নেই। তখন আপনার কাছে হয়তো অন্য চাহিদা হয়েছে। হয়তো এখন আপনি স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে-নাতি-নাতনির ভালোবাসার প্রত্যাশী হয়ে গেছেন। এগুলো আপনার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হয়েছে, বা আপনার মধ্যে ধারণার পরিবর্তনের জন্যই হয়েছে, এর জন্য আপনাকে আলাদা করে কিছু করতে হয় নি। এর পরের ধাপই  হচ্ছে হচ্ছে ঈশ্বরের ভালোবাসার জন্য কাঙাল হয়ে যাওয়া। ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা। এবং  এটাই পরিণতি।  এইখানে আপনাকে যেতে হবে। এখন সেটার জন্য, বা সেই অবস্থার জন্য আপনি বছরের পর বছর অপেক্ষা করবেন, না এখনই নিজেকে  তৈরি করবেন, সেটা আপনার ব্যাপার।  স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলুন। মায়ের কোলে ফিরে যান। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই বয়সে সেটা কি করা সম্ভব ? হ্যাঁ এর জন্যই দরকার আমাদের ধ্যান। ধ্যানের  মধ্যে "আমি" কে ধরবার চেষ্টা করুন। প্রথমদিকে আমরা আমাদের বৃত্তিগুলোকেই দেখতে পাবো। এই বৃত্তিগুলোকে ওল্টাতে থাকুন। ওল্টাতেও; ওলটাতে একসময় "আমি" সত্ত্বাকে ধরতে পারবেন। আর আমিকে যখন ধরতে পারবেন, তখন আপনার মন শান্ত হয়ে যাবে। এইসময় মন বৃত্তিগুলোকে আঁকড়ে থাকতে চায়। ধীরে ধীরে মন বুঝতে পারে, বৃত্তিগুলো আমার ভাবমূতি মাত্র, আমি নয়। এবং এই বৃত্তি বা ভাবমূর্তি সতত পরিবর্তনশীল। তথাপি সে মনে করে, আমার ভাবমূর্তি চলে গেলে আমি ধংশ হয়ে যাবো। ছোট্ট নরেনের একসময় এইরকমই মনে হয়েছিল, যখন ঠাকুর চৈতণ্যানুভূতির অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিলেন, নরেনের শরীরে। আমাদের ধ্যান যত  গভীর হবে, তত আমরা ঈশ্বরের ভালোবাসার জন্য ব্যাকুল হবো। আর জাগতিক বস্তুর প্রতি আমাদের মায়া-মোহ-লোভ-লালসা যা আমাদের দুঃখের কারন, সেগুলো দূর হয়ে যাবে। য্খনই নিজের মধ্যে অতৃপ্তি আসবে, ভালো করে বিশ্লেষণ করতে থাকুন সেই  অতৃপ্তি বোধকে। এগুলোকে সরাবার চেষ্টা না করে, দরকার শুধু বোঝা। সমস্যাকে ধরবার চেষ্টা করুন, তবেই সমস্যা বিলীন হয়ে যাবে আর সমস্ত মন জুড়ে নেবে আসবে এক অপূর্ব শান্তি। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।      
      

Friday, 8 May 2020

ধ্যানের পথে বাধা দূর করবো কি করে ? (1-2)

                                                                                                                                                           ধ্যানের পথে বাধা দূর করবো কি করে ?

সাধক ধ্যান করতে গিয়ে, নানান রকম বাধার সম্মুখীন হন । আজ আমরা সেই বাধাগুলোকে দূর করবার উপায় সম্পর্কে শুনবো।   এই বাধাগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।  এক) শারীরিক বাধা ; দুই) মানসিক বাধা।

শারীরিক বাধা : সাধক যখন প্রথম প্রথম ধ্যানের পথে পা বাড়ান, তখন কিছু দৈহিক বাধার সম্মুখীন হতে হয় । এইগুলো হচ্ছে, বেশিক্ষন বসে থাকতে  গেলে হাঁটুতে ব্যথা হয়, মেরুদন্ড সোজা  রেখে বসে থাকলে, কাঁধের মাংসপেশিতে বা মেরুদণ্ডে ব্যথা হয়, এছাড়া আছে, শারীরিক অসুখ-বিসুখ, আলস্য, এবং সবশেষে ঘুম।

এগুলো দূর করবার উপায় হচ্ছে, কিছু শারীরিক আসন ও প্রাণায়াম। প্রথম দিকে দু-চারটা সহজ  আসন আপনার সুবিধে  মতো করে নিন, যাতে শরীরের জড়তা কেটে যায়। এর পর   ভস্ত্রিকা, কপালভাতি, বাহ্য,  অগ্নিসার, অনুলোম-বিলোম, ভ্রামরী, উদ্গীথ করতে হবে । এছাড়া শুরুতে এবং শেষে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করুন। ভস্ত্রিকা-বাহ্য-অগ্নিসার-ভ্রামরী-উদ্গীথ এগুলো দুই মিনিট করে মোট দশ মিনিট করুন। কাপালভাতি ও অনুলোম-বিলোম  পনেরো মিনিট করে মোট ত্রিশ মিনিট করুন।  ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করুন শুরুতে দুই মিনিট জোরে জোরে শব্দ উচ্চারণ করে, এবং শেষে ২-৩ মিনিট নীরবে, এই সময় মনে মনে ভাবুন - আমি নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-আত্মা ।এই বোধ নিজের মধ্যে জাগিয়ে তুলুন।  ঈশ্বর আমাকে বিশ্বশক্তি দিয়ে ভরপুর করে দিয়েছেন। এর পরে ধ্যানে লিপ্ত হোন। দেখুন শরীর সুস্থ না থাকলে, কোনো সাধনাই সম্ভব নয়। তাই আসন-প্রাণায়াম নিয়ম করে অবশ্য়ই করবেন। এতে করে আপনি সারাজীবন সুস্থ থাকতে পারবেন। আপনার মধ্যে একটা উদ্দম, একটা তরতাজা  ভাব অনুভব করবেন। তার পরে ধ্যানে বসুন। মেরুদণ্ডে ব্যথা অনুভব করলে, কাউকে বলুন, আলতো  করে পাশাপাশি ম্যাসাজ করে দিতে। এতে করে ব্যথা চলে যাবে। যদি না যায়, তবে আপাতত ধ্যান বন্ধ রাখুন, দুই একদিনের জন্য। তবে একটা কথা মনে রাখবেন, আপনি একটা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সাধনায় প্রবিষ্ট হয়েছেন।  এক্ষেত্রে কিছু পথচলার অসুবিধা স্বীকার করে নিতে হবে, সহ্য করতে হবে। ধ্যানের  অভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গে এগুলো অবশ্যই  কেটে যাবে।
আর একটা কথা, ধ্যানে ঘুম হচ্ছে পরম শত্রূ। আবার ঘুম শরীরকে জীবনীশক্তি প্রদান করে থাকে। আমরা সারাদিন যে পরিশ্রম করি, তার ফলে আমাদের শরীরের যে  কর্ম্মশক্তি ক্ষয় হয়, তা পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে থাকে ঘুম। ঘুমের মাধ্যমে আমরা আমাদের কর্মশক্তি  সঞ্চয় করে থাকি।    তাই ঘুম আমাদের দরকার।  আবার আলস্যের কারনে, বা আমাদের শারীরিক অসুস্থতার জন্য,  আমাদের ঘুম বেড়ে যেতে পারে। এই জায়গায় আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

শিশু ও বৃদ্ধদের দিনে কমপক্ষে ৮ ঘন্টা ঘুম দরকার। অন্য সবার দিনে ৬ ঘন্টা ঘুম শরীরের জন্য দরকার। তবে ঘুমের গভীরতা অনুযায়ী এই সময়ের তারতম্য হতে পারে। সাধক ঘন্টা চারেক  ঘুমেই সম্পূর্ণ তরতাজা থাকতে পারেন, যদি তিনি ঘুমের কৌশল আয়ত্ত্বে আনতে পারেন।

স্নায়বিক দুবর্ল মানুষের জন্য ধ্যান নয়। আমাদের আবেগ-অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। তা সে ভালো মন্দ যাই হোক না কেন। একটা আত্ম-সমর্পনের ভাব নিজের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের মনকে শান্ত রাখতে হবে। অনন্তের  সঙ্গে নিজেকে বেঁধে রাখতে হবে.. এতে করে আমাদের স্নায়বিক চাপ, বা মানসিক চাপ কমে যাবে। ধ্যানের  চেষ্টা করবার আগে শরীরকে ঢিলে করে ছেড়ে দিতে হবে।
সময়মতো বিশ্রাম নিতে হবে। দুপুরের দিকে বিশেষ করে গরমকালে, অবশ্যই কিছুক্ষনের জন্য ঘুমিয়ে নিতে হবে। অনেকের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়, কারন নানান কাজে তারা ব্যস্ত থাকেন, বা বাড়ির বাইরে থাকতে বাধ্য হন। কিন্তু সাধন জীবনে এই নিয়ম পালন  করতে পারলে ভালো হয়। আমাদের ঘুম যাতে সঠিক ভাবে আমাদের বিশ্রামের পথে নিয়ে যেতে পারে, তার জন্য আমাদের কিছু নিয়ম অবশ্য়ই পালন করতে হবে। ঘুমের আগে, কখনোই উপন্যাস বা গোয়েন্দার গল্প নিয়ে যেন না বসি। ঘুমের আগে মনে করুন, আপনি ঈশ্বরের কোলে শুতে যাচ্ছেন। ঘুমের আগে মনকে দিব্যভাবে ভাবিয়ে তুলুন। সন্ধ্যার পর থেকেই, নিজের মনকে ঈশ্বরের সঙ্গে জুড়ে রাখার চেষ্টা করুন। অর্থাৎ সন্ধ্যাপূজা বা নাম-গান নিয়ে খানিকটা সময় কাটান। খাবার পরে, একঘন্টা অবশ্য়ই জেগে থাকুন।  এইসময় কোনো আধ্যাত্মিক বই পড়ুন। বা সাধকের জীবনীগ্রন্থ পড়ুন। ঘুমুতে যাবার আগে, হাতে-পায়ে, চোখেমুখে জল দিন। বিছানায় উঠেই শুয়ে পড়বেন না।  বজ্রাসনে বসে জপ করুন বা সামনে রাখা ঠাকুর  দিকে তাকান। ধীরে ধীরে বিছানায় শুয়ে পড়ুন। যদি রাতে ঘুম ভেঙে যায়, মনে মনে জপ আরম্ভ করে দিন । তবে মনে রাখবেন, ঘুমভেঙ্গে জপ নয়, ঘুম হচ্ছে না তাই জপ।মোদ্দা কথা হচ্ছে, ঠিক ঠিক মতো ঘুম হলে, শরীর-মন ভালো থাকবে, তরতাজা থাকবে ।  আর আমরা ধ্যানে আরো বেশি একাগ্র হতে পারবো।

এবার আসি মানসিক সমস্যার কথায়।  মানসিক বাধা অনেক  রকম, এবং এক-একজনের ক্ষেত্রে এক-এক রকম।  এর মধ্যে আমরা কয়েকটি  বাধা নিয়ে  আলোচনা করবো ।

১)  সাধক নিশ্চই লক্ষ্য করেছেন, কোনো কোনো দিন ধ্যান করতে ইচ্ছে হয় না। অথবা ধ্যানে বসলেও ধ্যান ঠিক জমছে না। এই অবস্থা দুটো কারনে হতে পারে, এক) আধ্যাত্মিক উপল্বদ্ধির প্রতি যদি আমাদের অনুরাগ কম হয়। আর দুই) আমাদের মনের মধ্যে যদি দ্বন্দ থাকে। অর্থাৎ অবচেতন মন ও চেতন মনের মধ্যে যদি দ্বন্দ উপস্থিত হয়। এটা তাৎক্ষণিক কোনো ঘটনার জন্য হতে পারে, আবার আমাদের অবচেতন মনের মধ্যে যে সংস্কার আছে, তা যদি উন্মুখ হয়ে ওঠে, তবে হতে পারে । একে  জয় করতে হলে আমাদের ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। লক্ষ্য করতে হবে মনের গভীরে কোন্ বৃত্তি বা চিন্তা বাধা হয়ে দেখা দিচ্ছে। তখন মনকে ধরার চেষ্টা করুন, মন কোথায় যেতে চাইছে বা কোথায় যাচ্ছে, অর্থাৎ এই সময় মন কি ভাবছে। এই ভাবনাকে ধরতে পারলে, আপনি এই মনের ভাবনাকেই দেখতে থাকুন। সচেতন থাকুন, আপনি কি দেখছেন, সেটার প্রতি শুধু লক্ষ রাখুন।  তাহলে দেখবেন, এই বাধা দূর হয়ে গেছে।
২) আর একটা বাধা হচ্ছে, হয়তো আপনি আগ্রহ নিয়েই প্রতিদিন ধ্যান করছেন, কিন্তু আপনি যেন এগুতে পারছেন না। অর্থাৎ অন্ধকার দূর হচ্ছে না। হৃদয় যেন খুলছে না। বেশ কিছুটা এগিয়ে যেন থমকে গেলেন।  এগুবার রাস্তা পাচ্ছেন না। একটা দরজা যেন খুলছে না কিছুতেই। এই অবস্থা একাধিক দিন ধরে চলতে পারে । কিন্তু কেন এমন হয় ? আসলে ধ্যান হচ্ছে ধীশক্তিকে সুক্ষ করা, এবং উচ্চস্তরে নিয়ে যাওয়া। ধ্যানে মন যত শান্ত হতে থাকে আমাদের ধীশক্তি তত সূক্ষ্ম হতে থাকে। কিন্তু এই ধীশক্তিকে চালান করতে হলে, প্রবেশ পথ যত  সূক্ষ্ম হবে, আমাদের ধীশক্তিকে ততধিক  সূক্ষ্ম  করতে হবে।  আমরা যত সচেতন থাকবো, আমরা যত নিবিষ্ট চিত্ত হতে পারবো, আমাদের ধীশক্তি তত সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হতে থাকবে। তাই আমাদের আরো বেশি সচেতন হতে হবে এখন। কোনো রকম আকর্ষণ-বিকর্ষণ মনের মধ্যে না রেখে সত্যকে জানার বা অনুভবের ইচ্ছে যত তীব্র  হবে, ধী-শক্তি তত সূক্ষ্ম ও উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হবে।
৩) তৃতীয়তঃ হচ্ছে, আপনি খেয়াল করবেন, বহুদিন ধরে ধ্যানের  অভ্যাসের পরেও, অনেক দূর এগিয়ে গিয়েও, আজ যেন আগে যতটুকু এগিয়ে ছিলাম, সেটুকু পথও যেতে পারছি না। চেনা পথ যেন হারিয়ে গেল।  কেন এমন হয় ? আসলে আমাদের আলসেমি এখনো যায়নি। আমাদের ভোগ লালসার ইচ্ছে রয়ে গেছে। মনের গভীরে যে তীব্র বাসনা-রূপ সংস্কার ছিলো, তা যেন আজ মাথা চারা  দিয়ে উঠেছে। ঠিক এই কারণে সাধককে দৈনন্দিন কাজের দিকে, মনের চিন্তার-ভাবনার দিকে সব সময় কড়া নজর রাখতে হয়। মনের পবিত্র ভাব সামান্য সময়ের জন্যও যদি আঘাত প্রাপ্ত হয়, তবে এগিয়ে যাওয়া সাধককেও নিচে নাবিয়ে নিয়ে আসে। তাই প্রতিমুহূর্তে দৈনন্দিন কাজের মধ্যে, খেয়াল রাখুন, আপনি কি করছেন, কি ভাবছেন। কাজের মধ্যে, ভাবনার মধ্যে এক মুহূর্তের জন্যও আমরা যেন আমাদের মনের পবিত্র ভাবকে কলুষিত হতে না দেই।

৪) বিপর্যয় : সাধক অনেক সময় মনের কল্পনাকে আধ্যাত্মিক দর্শন বলে মনে করে থাকেন। আমাদের মস্তিস্ক দুর্বল হলেও, আমরা অনেক দৃশ্য দেখতে পারি। আমাদের স্নায়বিক দুর্বলতা থেকেও এসব হতে পারে। এগুলোকে বলা হয়ে থাকে বিপর্যয় জ্ঞান। আমাকে কেউ কেউ বলে থাকেন, তার কুণ্ডলিনী শক্তি মাথায় চলে যাচ্ছে। কোনো কোনো সময় সাধনা তাদের কাছে অস্বস্তির কারন হতে পারে। বিজয় গোস্বামীর মতো সিদ্ধিসাধকের একসময় মনে হতো, তিনি বোধহয়, মানসিক রুগী হতে চলেছেন । অর্থাৎ ভালো, মন্দ নানান রকম অনুভূতি হতে পারে সাধকের। এগুলো আসলে কোনো আধ্যাত্মিক অনুভূতির লক্ষণ নয়। আধ্যাত্মিক অনুভূতি সম্পন্ন মানুষ হবেন, অনাসক্ত, তিনি  উন্নত  দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী হবেন । আত্মজ্ঞান সম্পন্ন হবেন। সাধন করতে এসে যদি আপনার কোনো দর্শন-শ্রবণ বা উপলব্ধি হয়, সেটিকে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখুন।  মনকে শান্ত করে বোঝার চেষ্টা করুন, এর উৎস কোথায়। বিজয় গোস্বামী যখন নিজেকে অসুস্থ মনে করছিলেন, তখন তার গুরুদেব তাকে হঠযোগের বই পড়তে দিয়েছিলেন। এবং বুঝতে পেরেছিলেন, যোগের ফলে তার এই সব পরিবর্তন হয়েছে। অর্থাৎ আপনার মধ্যে যদি কোনো পরিবর্তন এসে থাকে তবে আপনি মুনিঋষিদের অনুভবের সাথে সেটা মিলিয়ে দেখুন।  অর্থাৎ শাস্ত্রে কি লেখা আছে সেটা দেখুন।  যুক্তি ও অনুভবের সঙ্গে মিল আছে কি না সেটা পরীক্ষা করুন।  তবেই আপনি সাধনার পথে সঠিক অবস্থানে আছেন বলে মনে করবেন। গুরুভিন্ন কারুর কথায়  প্রভাবিত হবেন না। নিজের উপলব্ধি নিজের মধ্যে রাখুন। সাতকাহন করে বেড়াবেন না।
৫) সন্দেহ : মাঝে মধ্যে আমাদের মধ্যে একটা সন্দেহের উদ্রেগ হয়। যা করছি, তা ঠিক হচ্ছে তো ? অহেতুক সময় নষ্ট করছি না তো ? ঈশ্বর বলে কি কিছু আদৌ আছে ? আত্মা বলে কি কিছু আছে ? কাল্পনিক মুক্তির আশায় ছুটছি না তো ? এমনিতর  নানান সন্দেহ আমাদের মধ্যে জেগে ওঠে। মনের মধ্যে যদি সন্দেহ জাগে, তা নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েই  পরীক্ষা করে নিতে হয়। মুনিঋষিগণের কাছে, যা সত্য, সাধারণের কাছে তা কখনোই সত্য হতে পারে না। সাধক যতক্ষন না তা উপলব্ধি করতে পারছেন, ততক্ষন তার কাছে সেগুলো তত্ত্ব কথা মাত্র। দেখুন, কোনো কিছু সম্পর্কে সত্য নির্ধারণ করতে গেলে, মনের মধ্যে যে পূর্বজ্ঞান আছে, তার মাধ্যমেই যদি আপনি তাকে বিচার করতে যান, তবে আপনি সত্যের সন্ধান নাও পেতে পারেন। কারন আপনার সে অভিজ্ঞতা হয় নি। আপনার কাছে সেগুলো শোনা কথা মাত্র। বইপড়া বিদ্যা  বা তত্ত্ব কথা মাত্র। এখন এগুলোকে যদি আপনি শুধুই বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করেন, তবে আপনার সত্যে উপনীত হওয়া হলো না। আপনাকে নিজেকেই সত্যের সন্ধানী হতে হবে।  তখন আপনার সন্দেহ কেটে যাবে। নিজের অন্তরে প্রশ্ন উঠুক।  অনুসন্ধানের জন্য উৎসুক হোন।  নিজের উপরে আস্থা রাখুন। আপনি যদি সন্ধানী হন, তবে সত্য আপনার কাছে প্রকট হয়ে উঠবেই । তবে একটা কথা বলি, এই পথ বড্ড দুর্গম। মুক্ত মনের মানুষ, দৃঢ় মনের মানুষ, সবকিছু তাচ্ছিল্য করে যখন সত্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন, তখনই তার কাছে সত্য উদ্ঘাটিত হয়। হতে পারে, তা অন্যের উপল্বদ্ধির সঙ্গে মিললো না, কিন্তু আপনি সন্দেহাতীত হতে পারবেন।   
৬) তুষ্টি : অনেক সময় মনে হয়, এইতো আমি অনেক কিছু পেয়ে গেছি। আমার মধ্যে অনেক অলৌকিক শক্তি এসে গেছে। ইষ্টমূর্তির দর্শন পেয়েছি।  জ্যোতিঃ দর্শন করেছি, অনাহত ধ্বনি শুনতে পেয়েছি, কুণ্ডলিনী জাগরণ হয়েছে, দূরের  দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি, ইত্যাদি ইত্যাদি। মনে রাখবেন, এগুলো নিতান্তই তীর্থপথের  দৃশ্য মাত্র। তীর্থ এখনো অনেক দূর, এবং তীর্থক্ষেত্র আরো-আরো সুন্দর, আরো মনোরম। জপের অভ্যাস যেমন দৃঢ় হলে জপ আপনা আপনি হতে থাকে।  এই অবস্থায়  বিরত থাকলে হবে না। থেমে  গেলে চলবে না।  আনন্দ শান্তি এগুলো তীর্থ পথের  পাওনা মাত্র ।  এখানে থেমে  গেলে তীর্থ দর্শন হবে না।  
একটা কথা সব সময় মনে রাখতে হবে, আমরা ধ্যানে বসেছি সত্যকে জানবার জন্য।  সত্যকে ধরবার জন্য। আমরা মনের শান্তির জন্য, বা মনের আনন্দের জন্য ধ্যানের পথে আসিনি। সুখ-শান্তি-আনন্দ খোঁজা সাধকের উদ্দেশ্য নয়। তাই সাধন পথে যে ধরনের উপল্বদ্ধিই হোক না কেন সেখানে থেমে যেতে নেই। উপল্বদ্ধিগুলোকে নিরাসক্ত হয়ে লক্ষ্য করতে হবে। তাহলে আমরা বন্ধনহীন হয়ে উচ্চতর স্তরে এগিয়ে যেতে থাকবো। একটা কথা মনে রাখতে হবে, সাধনার কোনো শেষ নেই। স্তরের পর স্তর আপনার কাছে উন্মুক্ত হতে থাকবে, আর আপনি সত্যের গভীরে প্রবেশ করতে থাকবেন। আপনি আজ যেখানে থেমে  যাবেন, পরবর্তী জীবনে সেখানে থেকেই আবার শুরু করবেন। অতএব চরৈবেতি - চরৈবেতি - এগিয়ে চলুন।  এ এক অনন্ত যাত্রা।  পথের দৃশ্যের পরিবর্তন হতে থাকবে, হতেই থাকবে। আর আপনি দ্রষ্টা হয়ে যাবেন। এই পথে সাফল্যের শিখর বলে কিছু নেই। শেষ বলে কিছু নেই। সমাধি-কৈবল্য শেষ কথা নয়, নিজের শেষ করে দেওয়াই সাধনা। তাই "আমি" এই বোধ যতক্ষন আছে, ততক্ষন সাধনা চলতেই থাকবে।  জন্ম জন্মান্তর ধরে চলতেই থাকবে। চরৈবেতি  চরৈবেতি।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম।

সাধন পথের বাধা দূর করবো কি করে ? পর্ব্ব -দুই
সব শিক্ষার গুরু আছে। সাধন জগতেও গুরু আবশ্যক। কিন্তু সৎগুরুর অভাব। জীবিকা নির্বাহের জন্য, যারা গুরুগিরির পথ বেছে  নিয়েছেন, তাদের মধ্যেও অনেক জ্ঞানী ব্যক্তি আছেন। কিন্তু জ্ঞানীগুরু আর অনুভূতিসম্পন্ন গুরুর মধ্যে বিস্তর  ফারাক। আমাদের মনে হয়েছে, কিছু সাধন-পিপাসু মানুষ  নিজের চেষ্টায়, নানান রকম বই প'ড়ে, নানান লোকের কথা শুনে, সাধন পথে অগ্রসর হবার চেষ্টা করছেন। আমরা এই প্রয়াসকে স্বাগত জানাই। নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাবার এই যে প্রচেষ্টা, এতে করে আখেরে তার উন্নতি হবে, এবং ভবিষ্যতে দেখবেন, সৎগুরুর আশ্রয় পেয়ে যাবেন। 
আসলে ভালো কাজের বাধা অনেক। সাধন পথেও এই কথা আরো বেশী  সত্য। আমরা অনেক সময়, শুনে থাকি, সাধুরা শান্তিতে থাকেন। সাধুরা অনেক অলৌকিক কাজ করতে পারেন। এমনকি মরা মানুষ জ্যান্ত করতে পারেন। ইত্যাদি ইত্যাদি। তো আমরা শান্তিতে থাকবার অলীক কল্পনায় হোক বা অলৌকিক ক্ষমতা অর্জনের জন্য হোক, ক্ষনিকের আবেগের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, ঘর সংসার  ছেড়ে যেন বেরিয়ে না পড়ি। বরং অল্পবিস্তর সাধনা আমরা সংসার জীবনে থেকেই, বাড়িতে বসে  করতে পারি।
আর এর অন্যথা হলে, বাস্তব জীবনের রূঢ়তা আপনাকে বিপদে ফেলে দেবে। গেরুয়াধারী মানেই সাধু নন। আশ্রমবাসী মানেই সাধু নন। এদের মধ্যে অনেক মানুষ আছেন, যারা নিতান্তই সাধারণ মানের। এমনকি নিকৃষ্ট মানের। তাই এদের পাল্লায় না পরে, বাড়িতে বসে, সংসারের দায়িত্ত্ব কর্তব্য পালন করেই খানিক্ষন নির্জনে নিজের সঙ্গে জীবন কাটান। 

আজ আমরা এই সব মানুষদের জন্য, কিছু মূল্যবান উপদেশ শুনবো। 
অন্যকে অনুকরণ করে, বহুক্ষণ ধ্যান অভ্যাস করতে যাবেন না। এতেকরে, প্রথমদিকে হয়তো উৎসাহের বসে ধ্যান করাটা নেশার মতো হয়ে যাবে। কিন্তু এতে প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। যারা প্রতিদিন এক-ঘন্টা ধ্যানের অভ্যাস করেন, তারা এইসব প্রতিক্রিয়ার বিন্দুবিসর্গ জানতে পারবেন না। কিন্তু নিজেকে প্রস্তুত না করেই, অত্যুৎসাহে ঘন্টার পর ঘন্টা ধ্যান-ধারণা-জপ-প্রার্থনা ইত্যাদি করতে থাকেন, তারা নিশ্চই অন্তরে এক অদ্ভুত প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হন। আর এই প্রতিক্রিয়া বাইরের থেকেও উদ্ভূত হতে পারে। ধ্যান আসলে মনকে মন্থন করা। ধ্যানে আমরা মনকে অন্তরে কেন্দ্রীভূত করতে চেষ্টা করি।  তখন আমাদের মনের অচেতন অংশে,  একটা গভীর আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ধ্যান অভ্যাস না করা পর্যন্ত আমাদের মনের এই অচেতন অংশের অস্তিত্ত্ব আমরা বুঝতে পারি না। আর একে অর্থাৎ অচেতন মনের ক্রিয়াকে সংযত করতে গেলে, সে বিদ্রোহ শুরু করে। এবং আমাদের চেতন মনে একটা বিক্ষেপের স্রোত বইয়ে দিতে থাকে।  অন্তরের এই বিক্ষেপ আমাদের আচরণ, আমাদের মনোভাবকে প্রভাবিত করে। ফলে যে সমাজে আমরা বাস করি, তার যে মূল্যবোধ, সেই মূল্যবোধের ক্ষেত্রে  আমাদের মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। এতেকরে, যেমন সে সমাজের শৃঙ্খলা মানতে অপারগ হয়, আবার অন্তর ও বাহ্য প্রতিক্রিয়ার মধ্যে একটা দন্দ্ব শুরু হয়।  তখন মনে হয়, এর চেয়ে আমি আগেই ভালো ছিলাম। এর আগে আমি সুখী ছিলাম। এতে করে আমাদের নিরুৎসাহ বোধ হয়। ধ্যানাদির অভ্যাস তখন বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থায়, কেউ কেউ একটা যান্ত্রিক অভ্যাসবসে ধ্যান করে থাকেন । যা আদৌ আধ্যাত্মিক উন্নতিতে সাহায্য করতে পারে না। অল্পসংখ্যক মানুষ আছেন, এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে, প্রচন্ড সাহস ও উৎসাহ নিয়ে, সমস্ত বাধা পেরিয়ে সাধনার পথে এগিয়ে যেতে পারেন । 
আমাদের সচেতন ভাবে আধ্যাত্মিক জীবন গড়ে তুলতে হবে। যা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এইসময় গুরুর সাহায্য দরকার পরে। কিন্তু আমরা যেহেতু গুরুহীন সাধনায় ব্রতী হয়েছি, তখন মানসিক দ্বন্দ জনিত কষ্ট  বাড়তে থাকে। আর এর প্রতিফলন দেখা যায়, আমাদের আচরণের মধ্যে যা আমার স্বজনবর্গের কাছে অহিতকর মনে হবে। 
 এই সময়, আমাদের শরীরও বিদ্রোহ করতে পারে। এইসময় আমাদের স্নায়ুর উপরে প্রচন্ড টান  পড়তে পারে। এইসময় আমাদের পূর্ব্ব পূর্ব্ব জীবনের সংস্কার, পূর্ব স্মৃতি, পূর্ব বাসনা ইত্যাদি তীব্র ভাবে উপরে উঠে আসে। এবং আমাদেরকে দৈহিক ভাবে ভারসাম্যহীন করে তোলে। এই অবস্থাকে অতিক্রম করা ভীষণ কঠিন।  আর আপনার চারিপাশে যারা আছেন, তাদের যেহেতু এই অভিজ্ঞতা নেই, তারা আপনাকে পাগল আখ্যা দিতেও পিছপা হবেন না। জীবন তখন বিষময়  হয়ে উঠবে। এই অবস্থা থেকে তুলে আনতে  পারেন, একমাত্র সৎ গুরু। কেননা তিনি এই অবস্থার অভিজ্ঞতা প্রতক্ষ্য করেছেন। সেখান থেকে উত্তীর্ন হয়ে আজ তিনি স্থিত হয়েছেন। এই অবস্থায়, তিনি কিছু শারীরিক প্রক্রিয়া, মনকে শান্ত করবার জন্য, কিছু মূল্যবান উপদেশ, এমনকি স্নায়ুর উত্তেজনা প্রশমিত করবার জন্য শরীরের বিশেষ স্থানে  কিছু মালিশ, বা চাপ দিয়ে থাকেন। কিছু খাদ্যাভ্যাস তাই করে দেন। 
সাধন পথের  এই যে বাধা এগুলো সবই আমরা নিজেরাই সৃষ্টি করে থাকি। আমাদের নিজেদের ভিতর থেকেই এগুলো ভেসে ওঠে। আর আমাদের একজনের যেহেতু এক-একরকম সংস্কার,  অর্থাৎ আমাদের পূর্ব-পূর্ব জীবনের কর্ম্ম যেহেতু এক-এক জনের ক্ষেত্রে একরকম, তাই আমাদের প্রতিক্রিয়াও এক-একজনের ক্ষেত্রে  এক-এক রকম হবে। তাই সবার জন্য এক ঔষধ নয়। তাই এখানে কোনো সাধারণ উপদেশ দেওয়া সম্ভব নয়। তাই শরীর  বুঝে, নিজের ক্ষমতা বুঝে, আমাদের সাধন-পথে অগ্রসর হতে  হবে। কাউকে অনুকরণ করে নয়।
আবার বলছি, সচেতন ভাবে আমাদের আধ্যাত্মিক জীবন গড়ে তুলতে হবে। আমাদের ভিতরে একটা ঝড় বইছে।  আত্ম-উপল্বদ্ধির আকাঙ্খা আমাদের সবার মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই আলোড়ন তুলছে। আবার সাংসারিক কর্তব্য, বিষয়ের প্রয়োজনীয়তা, এগুলোর অভাববোধ আমাদের মধ্যে একটা অস্থির ভাব  নিয়ে আসে। এই দুটোর মধ্যে একটা সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবন গড়ে তুলতে হবে। এর মধ্যেই   আত্ম-উপল্বদ্ধির জন্য যাদের মধ্যে ব্যাকুলতা সৃষ্টি হয়েছে,তারাই এই সাধনপথের  কাঠিন্যতা স্বীকার করে নিতে পারেন। এবং জানবেন, এই ব্যাকুলতা আপনার পূর্ব পূর্ব জীবনের শুভকর্ম্মের  ফল। আর যাদের মধ্যে  সেই ব্যাকুলতা জাগেনি, তাদের পরবর্তী জীবনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এবং শেষমেশ সবাইকেই এই সাধনপথের পথিক হতেই হবে। একথা আপনি বিশ্বাস করেন আর না করেন, তাতে কিছু আসে যায় না। আমরা যদি অধ্যাত্ম জীবন যাপন করতে চাই, তবে বহুকাল আমাদের একটা গুরুতর অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। আমাদের ভিতরে যে কামনা বাসনা আছে, তা যতদিন পর্যন্ত স্তিমিত না হয়, ততদিন পর্যন্ত আমাদের প্রচন্ড সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই যেতে হবে। আপনাকে একটা পর একটা  বেড়া ডিঙোতে হবে। এরজন্য মানসিক সাহস, শারীরিক স্বক্ষমতা, এবং দৈবকৃপা অবশ্যই  দরকার। যত আপনি সাধনার প্রতি নিষ্ঠাবান হবেন, তত আপনার নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হবে। এই অভিজ্ঞতা দিয়ে শিক্ষা নিয়ে, সাধনপথকেই আশ্রয় করতে হবে। তবে আপনার ব্যাকুলতা যত  দিন দিন বাড়তে থাকবে, তত দেখবেন, পথের  কাঁটা  কে যেন সরিয়ে দিচ্ছেন। না এটা কোনো কল্পনা নয়।  এগুলো সব বাস্তব সত্য। ধীরে ধীরে এগুলো আপনার অনুভূতিতে আসবেই আসবে।  তখন আপনি এক নির্ভিক, স্বশাসিত নতুন মানুষ হয়ে যাবেন। 
তাই যেটা বলছিলাম, প্রাথমিক সাধকের জন্য দিনে একঘন্টা ধ্যানই  যথেষ্ট। আর সেটা ভোরের দিকে করাই ভালো অর্থাৎ সূর্য ওঠার একঘন্টা আগে থেকে একঘন্টা পর পর্যন্ত। ধ্যানের  আগে বাহ্যক্রিয়া সেরে নেবেন।  হাতে-পায়-চোখে-মুখে জল দিয়ে নেবেন।  ধ্যানের আগে দুই-এক মিনিট অনুলোম-বিলোম  করে নিন। শান্ত হয়ে সিদ্ধাসনে বসুন।  কেননা, সিদ্ধাসন আমাদের ব্রহ্মচর্য্য রক্ষা করতে সাহায্য করে থাকে। আর সিদ্ধাসনে বসলে একঘন্টার মধ্যে পায়ে কোনো জড়তা না আসার সম্ভাবনা।সিদ্ধাসনে না বসতে পারলে, যে কোনো আসনে অর্থাৎ যাতে আপনি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন, সেই ভাবেই বসুন।  ধ্যানের জন্য কোনো নির্দিষ্ট  সময় নেই। ঈশ্বরচিন্তায় মগ্ন থাকা, শুভ চিন্তায় নিজেকে নিয়োজিত করে রাখাই ধ্যান, আর এটা আমাদের সারাক্ষণই করা উচিত। 
ধ্যানের  পথে সবথেকে বড় জিনিস হচ্ছে চিত্তশুদ্ধি। আমাদের মনের আনাচে কানাচে লুকিয়েআছে  ময়লা, অর্থাৎ আমাদের মন্দবুদ্ধি। এই মন্দবুদ্ধিকে যতদিন না আমরা দুর করতে পারছি, ততদিন আমাদের সমস্যার সমাধান হবে না। মনের আয়না যতদিন না  সম্পূর্ণ পরিষ্কার হচ্ছে, ততক্ষন আমরা সেই জ্যোতির সন্ধান পাবো না। অনেকসময় তাৎক্ষণিক ভাবে ময়লা কিছুটা পরিষ্কার হলে, অন্ধকার কেটে কিছুটা আলোর প্রবেশ ঘটে। মনে সামান্য একটু আলো  প্রবেশ করলেই বা সেখানকার ধুলা-ময়লাকে তখনকার মতো দূরে সরিয়ে দিলেই প্রকৃত আধ্যাত্মিক জ্ঞান হয় না। এক্ষেত্রে  সাধকের বর্তমান অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না। যা আমাদের প্রয়োজন তা হচ্ছে, কর্ম্মজীবনে পবিত্রতা বজায় রেখে চলা।  মনকে নিয়ন্ত্রনে রাখা। আবার মনকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে গেলে, আমাদেরকে  বৃত্তির দমন করতে হয়। প্রথমদিকে এই বৃত্তির দমন করতে চেষ্টা করলে, সাধক নিদ্রার দিকে আবিষ্ট হয়ে পড়েন । কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞানদীপ্তির উদ্ভাস। এইজন্য আমরা আগেই বলেছি, ঘুমকে কিভাবে দূর করবো। যাইহোক এসম্পর্কে নিরন্তর আমাদের আলোচনা চলবে।            
আজ ব্রহ্মবাক্যের বিরাম দিলাম। পরের দিন আমরা সাধনার পথে যে বাধা বা প্রতিক্রিয়া তার কারন সম্পর্কে আবার শুনবো। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।

 সাধন পথের বাধা দূর করবো কি করে ? পর্ব্ব - তিন

সাধন জীবন  মানেই সতর্ক জীবন। প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আমরা একদিকে আধ্যাত্মিক জীবনে প্রবেশের জন্য লালায়িত হবো, ধ্যান সাধনা করবো, আবার ভোগ-বিলাসের দিকে নজর থাকবে, এটা হতে পারে না।  অতিরিক্ত ভোজন, অতিরিক্ত নিদ্রা, আলস্য, অতিরিক্ত পরিশ্রম, বাজে কথা বলা, মিথ্যে কথা বলা, অযথা-অপাত্রে জ্ঞান দান করা, অন্যের কথায় প্রতিক্রিয়া করা, অর্থাৎ সাধক হতে গেলে, কোনোভাবে অগোছালো জীবন হলে চলবে না। আমাদের নিজের থেকেই একটা শৃঙ্খলতার মধ্যে বাঁধতে হবে নিজেকে । স্ব-শাসিত জীবন হবে সাধকের। বিবেকের বিরুদ্ধে কোনো কাজ বা কথা বলা চলবে না। তা সে যতই  বিপদ আসুক না কেন।  এমনকি একটা মুহূর্ত আলস্যে কাটানো চলবে না। সময় পেলেই মহাপুরুষের জীবনী পড়বার অভ্যাস করুন। উপনিষদ পড়বার অভ্যাস করুন। মনকে চঞ্চল হতে দেবেন না, নির্দিষ্ট বিষয়ের ভিতরে নিবদ্ধ করে রাখুন। যারা নিয়মের বাঁধনে নিজেকে বাঁধতে পারেন  না, দিনদিন সৎ-চিন্তা, সৎ-অভ্যাসের মাত্রা বাড়াতে পারে না, তাদের জন্য অধ্যাত্ম জীবন সম্ভব নয়। না আমরা নিরুৎসাহিত করবার জন্য এসব কথা বলছি না। আপনি আজ যা আছেন, কাল তার থেকে আপনাকে ভালো হতে হবে, এই আকাঙ্খা যদি না থাকে, এবং সেইমত যদি দৈনন্দিন কাজের রুটিন না হয়, তবে আপনি এগুতে পারবেন না। আপনাকে নিচে টেনে নাবাবার জন্য, আপনার চারিপাশে অনেক হাতছানি  আছে, অনেক বন্ধু আছে, কিন্তু আপনাকে উপরে তুলবার মানুষ গুটিকয়। তাই নিজেকেই সতর্ক থাকতে হবে, নিজের লক্ষে স্থির হতে হবে। এবং সেইমতো নিজের আচরণে শুদ্ধতা আনতে  হবে। 

সাধনার সময় আমাদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া হয়, তার কারন আমাদের মধ্যে যথেষ্ট পবিত্রতার অভাব, নিষ্ঠার অভাব,  নৈতিকতার অভাব। আমরা অনেকের মধ্যে লক্ষ করেছি, ধ্যান ধারণার জন্য তাদের আগ্রহ প্রচুর, কিন্তু নৈতিক সংযম পালনের মতো নিরস ও ক্লান্তিকর বিষয়গুলোর দিকে তাদের নজর নেই। বরং তাদের ধারণা বেশি-বেশি সময় যদি ধ্যান  করতে  পারি, তাহলে আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি হবে। তাই তারা নৈতিক বিষয়গুলোকে গুরুত্ত্ব না দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ধ্যানে বসে থাকতে  আগ্রহী। আর এখন, বাজারে ভালো-মন্দ অনেক আধ্যাত্মিক বই সহজলভ্য হয়েছে। এগুলোর মনোমুগদ্ধকর বর্ণনা পড়ে, এমনকি বিভিন্ন মিডিয়ার বিবরণ শুনে, মনে হয়, অধ্যাত্ম জীবন খুব সহজ ব্যাপার। জীবনে হয়তো কোনো কঠোর নিয়ম মানার দরকার  নেই, ব্রহ্মচর্য পালনের কোনো দরকার নেই, নৈতিক  জীবনযাপনেরও কোনো দরকার নেই, শুধু ঘন্টার পর ঘন্টা গভীর রাতে বা ভোরের দিকে আসনে বসে চোখ বুজে থাকলেই  হলো। বা কোনো কোনো বিশেষ শারীরিক বা স্বাস-প্রশ্বাসের প্রক্রিয়া করে আমরা আমাদের কুণ্ডলিনী জাগরণের মতো অদ্ভুত শক্তির জাগরণ বা সঞ্চয় করে নেবো। ব্যাপারটা কিন্তু আদৌ তা নয়। এইভাবে যারা অধ্যাত্ম জীবনের স্বপ্ন দেখছেন, তারা নিজেদেরকে ধোঁকা দিচ্ছেন। নিজের জালে নিজেই জড়িয়ে বিপদ ডেকে আনছেন। যদিও এর ফলে কেউ হয়তো কোনো অদ্ভুত অনুভূতি  লাভ করলেন, বা একটা উচ্চতর অভিজ্ঞতা লাভ করলেন, কিন্তু জানবেন, আপনার ভিতরে যে অপবিত্র শক্তি আছে, সেগুলো তখন দ্বিগুণশক্তিতে আপনাকে নিচে নাবিয়ে নিয়ে আসবে। এবং একটা জঘন্য অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হবেন।আর এর পরিনাম হবে ভয়াবহ। 
 
আমাদের মন বাসনায় পরিপূর্ন। এইযে ঈশ্বরকে পাবার ইচ্ছে, বা আধ্যাত্মিক শক্তি সংগ্রহের ইচ্ছে এটাও একটা বাসনা। হ্যাঁ এটা অবশ্য়ই পবিত্র বাসনা।  কিন্তু মনে রাখবেন,  বাসনা মানুষকে উত্তেজিত করে, মনকে অস্থির করে তোলে। অধিকাংশ সাধক এই অস্থির মন নিয়েই সাধনায় ব্রতী হয়। তাই দেখা যায়, অধ্যাত্ম জীবনের গোড়ার দিকে সাধকের উৎসাহ থাকে তাজা।এইসময় সে তার মানসিক অস্থিরতাগুলোকে উপেক্ষা করে এগুতে চায়।  কিন্তু যত  দিন যায়, তত তার উৎসাহে ভাটা  আসে। আর মানসিক অস্থিরতা আরো বাড়তে থাকে।  কেননা সে যে আশায় বা বাসনা নিয়ে সাধনা  শুরু করেছিল, তার বিন্দুমাত্র  আশা পূরণ হয় নি। বরং শারীরিক ও মানসিক  যে অত্যাচার  সে করেছে, তার জন্য তাকে পাওনা চোকাতে হয়। 

আমরা অনেক সময় আধ্যাত্মিক চাহিদা পূরণের জন্য, আমাদের যে জাগতিক যে  চাহিদা আছে, তাকে আমরা উপেক্ষা করে থাকি। আবেগের বসে আমরা সবকিছুকে ত্যাগ করে থাকি। সংযমের নামে সময়মতো খাওয়া-দাওয়া ত্যাগ করেছেন, নিদ্রা ত্যাগ করেছেন।   কিন্তু জানবেন, আধ্যাত্মিক জীবনে প্রবেশের জন্য যেমন আবেগের প্রয়োজন আছে, তেমনি দেহের ও মনের চাদিদা গুলোকে প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী মেটানো প্রয়োজন। আবার মন্দ চাহিদাগুলোকে তাড়াবার জন্য আবেগের প্রয়োজন আছে। শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ, ভক্তিমূলক সংগীত, বা ব্রাম্হসংগীত, বা প্রার্থনা সঙ্গীত, এমনকি সমাজসেবা, অন্যকে সাহায্য করবার মানসিকতা আমাদের মন্দ চিন্তাগুলোকে দূর করবার জন্য সহায়তা করে থাকে। শরীর  রক্ষার জন্য, সময়মতো খাদ্য গ্রহণ, প্রাণ শক্তি বাড়াবার  জন্য প্রাণায়াম, এবং মনন শক্তি বারবার জন্য সৎগ্রন্থ পাঠ, সৎ-সংগ করা উচিত।  এই চর্চাগুলোকে আমাদের বন্ধ করা উচিত নয়। যদিও উন্নততর সাধকের জন্য, এর কোনো দরকার পড়ে  না। কিন্তু সাধন জীবনের প্রথম দিকে এইসব অভ্যাস সাধককে নিম্নমানের চিন্তাকে দূর করবার জন্য,  অনেক-ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা নেয়। 

যতদিন না আমরা আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার অনুভূতি বা আনন্দ আস্বাদন করছি, ততদিন এইসব কর্ম্মের মাধ্যমেও আমরা  শুভ-পবিত্র কর্ম্মের আস্বাদন করতে  পারি। এর পরে যখন আমরা ঈশ্বর-অনুভূতির অধিকারী হবো, তখন এগুলো আমাদের কাছে, নিতান্তই কর্তব্যের পর্যায়ে থাকবে। 

সবশেষে বলি, যেটা আগেদিন বলেছিলাম - সেটা হচ্ছে, সাধকের সাধন প্রচেষ্টা কখনোই মাত্রা-অতিরিক্ত হওয়া উচিত নয়। আসলে সাধনার প্রথম দিকে, আমাদের একাগ্রতার অভ্যাস বেশিক্ষন ধরে রাখতে পারি না। বারবার প্রত্যাহার করতে হয়। সেটাও দীর্ঘক্ষণ অতিবাহিত হয়ে যাবার পরে। আর আমরা যদি বেশিক্ষন ধ্যানে বসে থাকতে চাই, তবে আমাদের শারীরিক ও মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়, যা সহ্য করবার মতো স্নায়বিক বল আমাদের নেই। এমনও দেখেছি, সঠিক নির্দেশের অভাবে, বা যে যা বলছে, সেইমতো  একই সঙ্গে অনেকগুলো ক্রিয়া অভ্যাসের চেষ্টা করছেন । এতেকরে আমাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। তাই আগে ঠিক করুন, আপনার পক্ষে সঠিক নির্দেশটি কি হবে। এবং সেই মতো চলতে থাকুন। কেউ কেউ আছেন, নিজেকে পরীক্ষা করবার জন্য, অতিরিক্ত সময় অবধি  ধ্যানে বসে থাকা, বা প্রাণায়ামের সাহায্যে কুন্ডলিনীকে জাগ্রত করবার জন্য নিজেকে কঠোরতার মধ্যে নিক্ষেপ করেন। এযেন নিজেকে নিজের অহমিকাকে বোঝানো দেখো আমি কত  কৃচ্ছ্রসাধন করতে পারি। নিজের দক্ষতাকে যেন নিজেই মাপতে চাইছি। শরীরকে সময়মতো স্বাভাবিক খাদ্য পরিবেশন, সময়মতো বিশ্রাম, সময়মতো নিদ্রা, এগুলো আমাদের সাধনাকে ব্যাহত করে না বরং আমাদের মনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে  সাহায্য করে থাকে। আর তা যদি না হয়, তবে আমাদের মানসিক শক্তি, আমাদের স্নায়বিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে, এবং আমরা ক্লান্তিকর অবস্থার মধ্যে ঢুকে যাবো। তাই আমাদের মানসিক ও শারীরিক শক্তি যে অব্যাহত থাকে, বা বাড়তে পারে, সেইমতো ব্যাস্থা নিতে হবে, যদি আমরা সত্যিকারের অধ্যাত্ম জীবনের প্রত্যাশী হয়। যেসব মানুষ স্নায়ুর রোগে ভুগছেন, বা অত্যধিক রক্তচাপে ভুগছেন, তাদের কখনোই হঠাৎ করে বেশিক্ষন ধ্যানে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়। তাদের অবশ্যি উচিত ধীরে ধীরে অভ্যাসের মাত্রা বাড়ানো। 
আবার বলছি, অন্ধের মতো কাউকে অনুসরণ করতে যাবেন না, বা কারুর কথায় প্রভাবিত হবেন না, এমনকি উৎকৃষ্ট বই পড়েও নিজের ক্ষমতার বাইরে যাবেন না। আগে নিজের শরীরকে বুঝুন, নিজের স্বভাবকে বুঝুন। আপনি হয়তো অল্পতেই রেগে যান। অনেকে আছেন, রক্ত দেখলে মাথা ঘুরে যায়। এমনকি ইনজেকশন নিতে ভয় পান। আপনার মাথার মধ্যে হয়তো অনেকগুলো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, এইসব মানুষের অবশ্য়ই একঘন্টার বেশি ধ্যানে প্রলুব্ধ হাওয়া উচিত নয়। বহুক্ষণ ধ্যান করতে গেলে, আপনার মেজাজকে অবশ্যই  ঠান্ডা রাখতে হবে। কঠোরভাবে ব্রহ্মচর্য্য পালন করতে হবে, এতে করে আপনার মস্তিষ্কের পুষ্টিসাধন হবে। মাথাও ঠান্ডা থাকবে। ব্রহ্মচর্য্য পালন সাধন জীবনে একটা গুরুত্ত্বপূর্ন অধ্যায়। এতে শরীর মজবুত ও নীরোগ হয়।  অর্থাৎ সুস্বাস্থের অধিকারী করে তোলে আমাদের ব্রহ্মচর্য । ব্রহ্মচর্য পালনে  ধীশক্তি বৃদ্ধি পায়, বৌদ্ধিক শক্তি বৃদ্ধি পায়, ফলে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়ে উঠি আমরা।  

এর পরে, যারা  একটু অগ্রসর সাধক তাদের জন্য, একটু অন্য কথা বলি। সাধক হয়তো লক্ষ করেছেন, কয়েক দিন, ভালো ধ্যানের  আনন্দ উপভোগ করবার পর, হঠাৎ যেন ধ্যানের  প্রতি আগ্রহ কমে গেছে। এখন মনকে একাগ্র করা অত্যন্ত কঠিন বোধ হচ্ছে। মনের মধ্যে যেন হা-হাকার করছে।  একটা শূন্যতা বোধ আঁকড়ে ধরেছে মনকে। এটা মানসদর্শনের প্রতিক্রিয়া।  অর্থাৎ গভীর ধ্যানে আপনি ইষ্টের মূর্তির মধ্যে প্রাণের ছোয়া পেয়েছিলেন। তার সঙ্গে আপনি ধ্যানের  মধ্যে ভাবের বিনিময় করতে পারতেন। ইষ্টদেব আপনাকে নির্দেশ দিতেন। এই দর্শন এই উপভোগ এখন যেন আর ঠিক ঠিক মতো হচ্ছে না। আপনার দৃষ্টির সামনে থেকে ইষ্টদেব যেন হারিয়ে গেছেন। এতে একটা মানসিক যন্ত্রনা বোধ হবে। এই মানসিক যন্ত্রনাই  শূন্যতাবোধ। আসলে এইসময় সাধকের কল্পনাশক্তি কাজ করছে না। এই অবস্থার সময় আমাদের মনে রাখতে হবে, আমার কল্পনা যাই হোক না কেন, আমার আত্মা অর্থাৎ জীব-আত্মা সবসময়ই পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত হয়েই আছেন। আমার কল্পনাশক্তি যেহেতু কাজ করছে না, তাই আমি এগুলো প্রতক্ষ্য করতে পারছি না। কিন্তু কিছুই হারায় না আমিও কিছুই হারাই নি। এই সময়টা সাধকের শুষ্ক সময়  বা ড্ৰাই  সিজন। এই শুষ্ক  সময় ধীরে ধীরে কেটে যাবে, কিন্তু আমাদের উচিত নিজের চেতনা-কেন্দ্রে মনকে স্থির রেখে ধ্যান-ধারণা-জপ অর্থাৎ যা আপনি করছিলেন, তা চালিয়ে যাওয়া।  তাহলে দেখবেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আবার ইষ্টদেবকে ধ্যানে ফিরে পাবেন। যদিও আমাদের উদ্দেশ্য চেতনকেন্দ্রে মনকে স্থির করা। 

আজ বাক্যের বীর্য দিলাম, আমাদের আলোচনা চলতে থাকবে। ধীরে ধীরে সমস্ত প্রশ্নের জবাব আমাদের  নিজের মধ্যেই জাগ্রত হবে। শুধু ধৈর্য্যের সাথে নিজের কাজে লিপ্ত থাকতে হবে। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।